বুলবুল- স্মরণ : শতবর্ষে সঞ্জীবিত   

জন্মের শতবর্ষ উদ্যাপনের চলমানতায় পরিবর্তনের স্রোতে ভেসে চলা বর্তমান বিশ্বে বুলবুলের জীবন, তাঁর স্বপ্ন, সাধনা ও কৃতি এক হিমালয়-বিস্ময়ের সামনে আমাদের দাঁড় করিয়ে দিতে সমর্থ, এখনো। সম্ভ্রান্ত, শিক্ষিত এবং সরকারি চাকরিজীবী পিতার ঘরে জন্ম তাঁকে এক গ-গ্রামের (চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার চুনতি গ্রাম) গ– থেকে মুক্তি দিয়েছে বটে; কিন্তু রাজদরবারের বা দেবমন্দিরের কোনো নর্তকীর নূপুরনিক্কণ রূপকথার গল্পচ্ছলেও যাঁর শৈশবের কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি তাঁর বুকে বাসা বেঁধে থাকা সে-শিল্পসাধ যতটা বিস্ময়কর, সমাজে, স্বধর্মে এবং স্বদেশে পদে পদে বিরুদ্ধতার সঙ্গে লড়াই করে সে-শিল্পসাধনার পথে স্থির লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়াটা তার চেয়ে কম কিছু নয়। আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ভিন্ন ওস্তাদ বা গুরু ভিন্ন আরাধ্য সে-শিল্পমাধ্যমটিকে তিনি কোন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিলেন আজ তা আর কারো অজানা নয়। মাত্র ৩৫ বছরের এক স্বল্পায়ু জীবন এবং সে-জীবনের বৃত্তে সাকল্যে ২০ বছরের এক সৃজনশীল জীবনের স্তরে স্তরে আরো কত যে-বিস্ময় জমে আছে অনুজপ্রতিম বন্ধু নীলরতন মুখোপাধ্যায় তাঁর বিশালায়তন জীবনীগ্রন্থে তা লিখে গেছেন। বুলবুলের একাধিক জীবনকথা লিখেছেন তাঁর সহোদরা এবং অনুরাগী বন্ধুজন। এক্ষেত্রে এযাবতকালের সর্বশেষ সংযোজন আফরোজা বুলবুলের স্মৃতিকথা, আমার ভালবাসার জীবন। সে-গ্রন্থে আমরা এক মহানায়কের করুণ জীবনাবসান প্রত্যক্ষ করি পরম বেদনায়। এ-বছর (২০১৯) পহেলা জানুয়ারি ছিল তাঁর জন্মশতবার্ষিকী।

নৃতকলা বুলবুল প্রতিভার প্রধান দিক নিঃসন্দেহে। তবে অভিযাত্রী তিনি ছিলেন সংস্কৃতির নানা পথের; ব্যর্থ হননি কোথাও। শুধু সময়ের দাক্ষিণ্য পেলে সাহিত্যিক বুলবুল নৃত্যশিল্পী বুলবুলের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হতেও পারতেন। মানিকগঞ্জ হাইস্কুলের ছাত্র বুলবুল (রশীদ আহমেদ চৌধুরী) স্কুল-বিচিত্রায় উপস্থিত দর্শকদের যখন ‘চাতক-নৃত্যে’ চমকে দিচ্ছেন, তখন ততদিনে বিশ্বকবিকে উৎসর্গকৃত তাঁর কাঁচা হাতে কবিতার পা-ুলিপি তৈরি হয়ে গেছে। তাঁর গীতিকবিতায় সুর দিয়েছেন বেণীমাধব বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিকগঞ্জের খ্যাতনামা সংগীতশিল্পী। নবম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে তাঁর একক প্রচেষ্টায় তাঁরই হস্তাক্ষরে বকুল নামে একটি পত্রিকার দুটি সংখ্যা তিনি বের করেন। মানিকগঞ্জ স্কুলেই ১৯৩৪ সালে চিত্র-প্রদর্শনী প্রতিযোগিতায় তাঁর ছবি প্রথম পুরস্কার পায়। এক্ষেত্রে সুদূর শৈশবে পিতার কর্মস্থল বাঁকুড়া থানা অফিসের কাছাকাছি নজরবন্দি এক স্বদেশি বিপস্নবীর কাছে তাঁর ছবি আঁকার হাতেখড়ি হয় বলে জানা যায়। পরবর্তীকালে মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে দেবদেবীর নৃত্যমুদ্রার নানা ভঙ্গির ছবি এঁকে নৃত্য অনুশীলনের কথাও তাঁর জীবনীতে পাওয়া যায়। গেরুয়া মাটির দেশ বাঁকুড়ার সাঁওতাল বালক ঝমরু, ঝমরুদের সাঁওতাল পলিস্ন, আদিবাসীদের আনন্দমুখর নৃত্যপর জীবনও তাঁর বালক মনে মূল্যবান স্মৃতির সঞ্চয় হয়ে ছিল নিশ্চয়ই। মানিকগঞ্জে জনৈক মুন্সেফের শামিত্মনিকেতনে পাঠরত দুই পুত্রকন্যার নাচও বুলবুলকে অনুপ্রাণিত করে। অতঃপর এই মানিকগঞ্জ হাইস্কুলেই ধারাজলের জন্য চাতকের প্রতীক্ষা এবং সে জলে অবগাহনের আনন্দ নিয়ে কিশোর বুলবুল তৈরি করেছিলেন চাতক-নৃত্য।

ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর স্বগ্রাম চুনতিতে স্থানীয় একটি হাইস্কুলের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে সাতকানিয়া টাউন হলে বন্ধুদের অনুরোধে চাতক-নৃত্য পরিবেশন করেন বুলবুল। এ-অনুষ্ঠানে উপস্থিত সাতকানিয়ার কৃতী সন্তান আবুল ফজল বলেন, ‘- নৃত্য যে আনন্দের কত বড় উৎস, সেদিন বুলবুলের নৃত্য দেখেই আমি তা বুঝেছিলাম।’ অবশ্য একই নৃত্যের জন্য সেদিন তাঁকে রক্ষণশীলদের আক্রমণের মুখোমুখিও হতে হয়েছিল। স্বদেশে এমন বিরুদ্ধতা তাঁর জন্যে নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তিনি পিছু হটেননি কখনো। সুধীজনের সাধুবাদের পাশাপাশি গোঁড়া রক্ষণশীল আত্মীয়স্বজনের নিন্দামন্দ, মৌলবাদী সমাজের হুমকি-ধমকি এবং ধিক্কার তাঁকে সয়ে যেতে হয়েছে। কেবল অনুষ্ঠানস্থল বা এলাকাবাসীর কাছ থেকেই বিরুদ্ধতা এসেছে, এমন নয়, নামিদামি পত্র-পত্রিকার অশালীন আক্রমণের শিকারও হতে হয়েছে তাঁকে। বুলবুল পত্রিকার ভাদ্র ১৩৪৩ সংখ্যায় তাঁর ‘ভারতীয় নৃত্য’ প্রবন্ধটি একই বছরের কার্তিক সংখ্যা মাসিক মোহাম্মদীর তীব্র আক্রমণের শিকার হয়েছিল। শনিবারের চিঠির ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ নজরুলের মতো তাঁকেও কম সইতে হয়নি। আসলে নানা কারণে ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় নৃত্যও তখন অধঃপতিত হয়ে পড়েছিল। ভদ্রসমাজে নৃত্য এতটাই অশ্রদ্ধেয় যে, খোদ রবীন্দ্রনাথকে শামিত্মনিকেতনে নৃত্যপ্রশিক্ষণের বিষয়টি আড়াল করার জন্য বলতে হতো যে, ‘ছাত্ররা মৃদঙ্গের তালের সঙ্গে ব্যায়াম শিক্ষা করছে।’ কলকাতার সঙ্গে ১৯২৭ সালে নটির পূজায় নন্দলাল বসুর কন্যা গৌরী বসুর নৃত্য প্রশংসিত হলে কবি স্বয়ং হালে পানি পান। অন্যদিকে, ইউরোপে চিত্রকলার পাঠ নিতে গিয়ে উদয়শঙ্কর চিত্র পরিত্যাগ করে নৃত্যে উৎসাহী হয়ে উঠেছেন। রাজস্থানের উদয়পুরের (তাঁর জন্মভূমি) লোকনৃত্য, রাজনর্তকীদের নৃত্যভঙ্গি এবং ব্রিটিশ মিউজিয়ামে ভারতীয় ঐতিহ্যম–ত নৃত্যের ভাস্কর্যচিত্র দেখে নিজেকে তৈরি করে নিচ্ছেন তখন। ইউরোপে নৃত্যশিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি লাভের পর রাশিয়ার ব্যালে শিল্পী আনা পাভলোভার সঙ্গে যোগ দিয়ে তিনি ইউরোপ-আমেরিকা জয় করে কলকাতায় ফিরেছেন ১৯৩০-এ। বুলবুল ১৯৩৪-এ কলকাতায় পা রাখার আগেই উদয়শঙ্কর ‘অসি-নৃত্য’, ‘রাধা-কৃষ্ণ’, ‘অজন্তা ব্যালে’, ‘হিন্দু-ওয়েডিং’ এবং ‘ইন্দ্রপতনে’র মতো নৃত্যে কলকাতা মাতিয়ে তুলেছেন।

প্রেসিডেন্সি কলেজের আইএ ক্লাসের ছাত্র বুলবুল চৌধুরী কলেজের বিচিত্রানুষ্ঠানে ‘সূর্য-নৃত্য’ পরিবেশন করে চিলড্রেনস ফ্রেশ এয়ার এক্সকারশন সোসাইটির কর্ণধার সমাজসেবী স্নেহলতা মিত্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পিতা ও স্বামীর দিক থেকে যথেষ্ট প্রভাবশালী এই নারীর আনুকূল্য পেয়েছেন বুলবুল তাঁর শিল্পীজীবনে। এরই মাধ্যমে যন্ত্রশিল্পী মিহিরকিরণ ও সুরশিল্পী তিমিরবরণ ভট্টাচার্য ভ্রাতৃদ্বয়ের সঙ্গে বুলবুলের পরিচয়। এঁদের একজন বুলবুলের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক, অন্যজন তাঁর কলকাতাকেন্দ্রিক শিল্পীজীবনের সংগীত-প্রযোজক ছিলেন আদ্যন্ত। এঁদের সহযোগিতায় একক নৃত্যনাট্য সুধম্বা তৈরি করেন বুলবুল। মিসেস মিত্রের এক্সকারশন সোসাইটির বার্ষিক অনুষ্ঠানে ফার্স্ট এম্পায়ার মঞ্চে ১৯৩৮-এ এই প্রদর্শনী বুলবুলের অগ্রযাত্রার পথ বেঁধে দেয়। তবে তার আগেই বেকার হোস্টেলে, প্রেসিডেন্সি কলেজের বিচিত্রানুষ্ঠানে, ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে বা ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুল রিইউনিয়ন প্রভৃতি অনুষ্ঠানে সৌখিন নৃত্যশিল্পী হিসেবে তিনি শিল্পবোদ্ধাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেন। স্বনামধন্য ইম্প্রেসারিও হরেন ঘোষ অতঃপর সাধনা বসুর সঙ্গে তাঁকে নাচের সুযোগ করে দেন। কেশব সেনের নাতনি রবীন্দ্রস্নেহধন্য সাধনা বসুর সঙ্গে বুলবুলের ‘কচ ও দেবযানী’, ‘রাসলীলা’, ‘মেঘদূত’, ‘স্ট্রিট সিঙ্গার’ প্রভৃতি নৃত্যে অংশগ্রহণ নৃত্যশিল্পী হিসেবে তাঁকে একটি সর্বজনস্বীকৃত প্রতিষ্ঠার আসন দান করে। স্কটিশ চার্চ কলেজের প্রথম বর্ষ স্নাতক শ্রেণির ছাত্র বুলবুল, যাঁর বয়স মাত্র আঠারো পেরিয়েছে এবং নৃত্যচর্চার বয়স যখন দুই বছরের বেশি নয়, তখনই তিনি গড়ে তোলেন তাঁর নিজের নাচের দল, ‘ওরিয়েন্টাল ফাইন আর্টস অ্যাসোসিয়েশন’ (ওএফএ)। মঞ্জুলিকা ভাদুড়ী, কমলেশ কুমারী, মণিকা দেশাই ও প্রতিমা দাশগুপ্তার মতো বিখ্যাত নৃত্য ও অভিনয়শিল্পীকে নিজের দলে পেয়েছিলেন তিনি। ওএফএর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে বাংলার গভর্নর লর্ড ব্রাবোর্ন ও লেডি ব্রাবোর্নকে বুলবুল পেয়েছিলেন। ১৯৩৮-এর ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বরে বন্যাদুর্গতদের জন্য চ্যারিটি শোর আয়োজনে উদ্বোধক হিসেবে বুলবুল পেয়েছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হককে। এ-সময় শ্রীমতি মিত্রের এবং নিজের সংগঠনের জন্য বুলবুল হিন্দু পুরাণের বাইরেও এমন কিছু নৃত্যরূপ তৈরি করেন, যেখানে মুসলিম ইতিহাসের এমন বহু ঘটনা ও কাহিনি তিনি নিয়ে আসেন যাদের নৃত্যসম্ভাবনা তাঁর আগে কেউ ভাবতেও পারেননি। পরবর্তীকালে এই বুলবুল চৌধুরীকেই আমরা দেখব এসব নৃত্যরূপের মধ্যে মুসলিম ঐতিহ্য, আবহাওয়া ও পরিবেশের স্বতঃস্ফূর্ততা এনে পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্রে নৃত্যকে জাতীয় শিল্পের মর্যাদায় উন্নীত করতে। পাকিস্তান আমলেই অগ্রগণ্য সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বুলবুল ললিতকলা একাডেমির প্রতিষ্ঠা বুলবুল প্রতিভার স্বীকৃতিই বটে।

নৃত্যশিল্পী হিসেবে তাঁর মাত্র দুই বছরের সাধনকালের মধ্যেই ভারত সফরে এসেছিলেন আমেরিকান মার্কাস কোম্পানি। বিশ্বের সেরা ব্যালে শিল্পীদের সমন্বয়ে গড়া এই দলের বিদায়ী অনুষ্ঠানে বুলবুল অতিথিশিল্পী হিসেবে আমন্ত্রণ পান। বস্ত্তত প্রতিভার মৌলিকত্ব এবং সাহসী, প্রগতিশীল নৃত্যরূপের স্রষ্টা হিসেবে সময়ের জ্বলন্ত সমস্যাগুলোকে তুলে ধরার কারণেও তিনি শিল্পবোদ্ধাদের মন জয় করেছেন। আমাদের লোকসংস্কৃতি নিয়েও তাঁর প্রতিটি কাজ মহান শিল্পকর্মে উত্তীর্ণ হয়েছে। লোকসংস্কৃতি ও গণমানসের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া এবং নৃত্যে তার প্রয়োগের জন্য উদয়শঙ্করকে ভারতীয় গণনাট্য সংঘে যোগদান পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। এঁদের যৌথ প্রচেষ্টায় নৃত্য যখন অনেকটাই গণমুখী রূপ নিয়েছে, কলকাতার নৃত্যমঞ্চে বুলবুলের আবির্ভাব হয়েছে তখন। তিনি এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন। ’৪২-এর পরে মেদিনীপুরের দুর্ভিক্ষ অবলম্বনে তাঁর দ্য গ্রেট হাঙ্গার এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে তাঁর বস্ন্যাক আউট নৃত্যনাট্য ভারতীয় গণনাট্য সংঘের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এঁদের ব্যালে স্কোয়াডের দায়িত্ব পান বুলবুল। গণনাট্য সংঘের আদর্শ ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে মানসচেতনা মিলে যাওয়ায় নৃত্যে ওদের কাঙিক্ষত রূপ ফুটিয়ে তুলতে বুলবুলকে বিশেষ কোনো কসরত করতে হয়নি। এ-সময় তাঁর সৃষ্টি নতুন মাত্রায় অভিষিক্ত হয়েছে। বাংলার মন্বন্তর ও স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি নিয়ে যথাক্রমে লেস্ট উই ফরগেট এবং দ্য অ্যালিউরিং ট্র্যাপ নৃত্যনাট্য রচনা করেন বুলবুল। ব্রিটিশবিরোধী রাজনীতির উত্তাপ নিয়ে তাঁর কুইট ইন্ডিয়া তৈরির তুঙ্গ সময়টায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও দেশভাগের আতঙ্ক বুকে নিয়ে তাঁকে ফিরতে হয় স্বগ্রাম চুনতিতে।

১৯৪২-এ, দেশ যখন আসন্ন দুর্ভিক্ষের আশংকায় আতংকগ্রস্ত, সীমামেত্ম জাপানি হুমকি, তখন বুলবুল চুনতিতে। এমএ পরীক্ষাটা সেবার তাঁর আর দেওয়া হলো না। বন্ধু সন্তোষচন্দ্র (সরোদবাদক) কলকাতা থেকে চিঠিতে পরীক্ষার কথা মনে করিয়ে দিলে বুলবুল উত্তরে জানান, ‘শতাব্দীর অগ্নিমঞ্চে আমাদের অগ্নিপরীক্ষা হোক।’ ২৫শে বৈশাখে লেখা এ-চিঠির শেষে বুলবুল কবিগুরুর স্মৃতির উদ্দেশে প্রণাম জানিয়ে লিখেছেন, ‘মহাকালকে উপেক্ষা করে যিনি আমাদের মাঝেই রয়েছেন তাঁর জন্মোৎসব তো চিরকাল ধরেই চলবে। ২৫শে বৈশাখ সেই আনন্দে অধীর হয়েছে।’ সেই সময়টাতে চট্টগ্রাম শহর থেকে অনেক দূরে (৪০ মাইল দক্ষিণে) পাহাড়, বনভূম  ও সমতলে ডুবে থাকা চুনতির সৌন্দর্যে মুগ্ধ বুলবুলের ভেতরে নতুন এক শিল্পযাত্রার প্রস্ত্ততি চলছে। সবুজের বুক চিরে চলে যাওয়া আরাকান ট্রাঙ্ক রোডের পথে যুদ্ধভীত, যুদ্ধতাড়িত উদ্বাস্ত্তদের মুখ থেকে শোনা কাহিনি চৈতন্যে অন্যরকম ঘা দিয়ে যাচ্ছে। জাপানি বোমায় বিধ্বস্ত রেঙ্গুন শহর থেকে দলে দলে উদ্বাস্ত্ত বাঙালি পালিয়ে আসছে এই পথে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধজাত একটা সংকটকে বার্মা-আরাকান চট্টগ্রামের জীবন ও ইতিহাসের সুতোয় গেঁথে বুলবুল লিখেছেন প্রাচী উপন্যাস। কলকাতার মলয় ও বার্মার তরুণী থিনের প্রেম এ-উপন্যাসে শামিত্ম ও আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখে। কামরুল হাসানের প্রচ্ছদে, সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ভূমিকায় বুলবুলের এ-উপন্যাসটি গোপাল হালদারের সহায়তায় কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৪৭-এ। বোন সুলতানা রহমান বুলবুলের জীবনীগ্রন্থে-বুলবুলকৃত নাগরিক, পাদপ্রদীপআরাকান ট্রাঙ্ক রোড নামে আরো তিনটি উপন্যাসের উলেস্নখ রয়েছে। তবে এর কোনোটিই পাওয়া যায়নি।

কলকাতার নামকরা সাহিত্য পত্রিকা পরিচয় বুলবুলের ‘পয়মাল’ ও ‘অনির্বাণ’ নামের দুটি গল্প ছেপেছে ১৯৪৫-এ। দ্বিতীয় গল্পটি রুশ ভাষায় অনূদিত হওয়ার খবর দিয়েছেন বোন সুলতানা রহমান। চট্টগ্রামের পত্রিকা উদয়নে ১৯৫০-এ ছাপা হয় বুলবুলের ‘আগুন’ গল্পটি। ১৯৫৩-এ পূর্ব বাংলার সমকালীন সেরা গল্পসংকলনে এটি স্থান পায়। মানুষের স্বপ্নভঙ্গের গল্প লিখেছেন বুলবুল। লিখেছেন নির্যাতিত মানবতার গল্প। লিখেছেন দুঃসময়ে দানব-মানবের উত্থানের গল্প। ভাষাসৈনিক মাহবুব আলম চৌধুরী তাঁর স্মৃতির সন্ধানে গ্রন্থে বুলবুলের ‘রক্তের ডাক’ গল্পটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে ‘রশিদ আলী দিবস’ ও ‘নৌ বিদ্রোহের’ কথা এনেছেন। বলেছেন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চিহ্ন’, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ঝড় ও ঝরাপাতা’ এবং চট্টগ্রামের সন্তান নৃত্যশিল্পী বুলবুলের ‘রক্তের ডাক’ ওই বিশেষ দিবস ও ঘটনা উপলক্ষ্যে লেখা। বুলবুলের গল্পে অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা তিনি বিশেষভাবে বলেছেন।

১৯৪৩-এ বুলবুল সংসারী হয়েছিলেন। আফরোজা বুলবুলের স্মৃতিকথা থেকে আমরা জানতে পারি, চার বছর প্রেমের পর ধর্মান্তরিত প্রতিভা মোদকের সঙ্গে (পরবর্তীকালে আফরোজা বুলবুল) এ-বিয়েটিও বুলবুল জীবনের সুন্দরতম বা মধুরতম কোনো ঘটনা নয়। দৈহিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ, বিপর্যস্ত বুলবুলকে সারিয়ে তোলায় আফরোজা বুলবুলের ত্যাগ ও পরিশ্রমের অন্ত ছিল না। ধীরে ধীরে সুস্থ হন বুলবুল। এ-সময় শিল্পচর্চার পাশাপাশি চাকরিও করেছেন তিনি। দেশভাগের পর শুরু হয় তাঁর নতুন জীবন। নতুন যুদ্ধ। জীবনের ও শিল্পের।

চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনারের আমন্ত্রণে কৃষি ও শিল্পপণ্য মেলা উপলক্ষ্যে প্রদর্শনী করতে এলেন বুলবুল। সাধনা বসু, কলকাতার দলবলসহ আগেও তিনি চট্টগ্রামে অনুষ্ঠান করে গেছেন। নতুন করে জনাকুড়ি নানাধর্মের নবীন শিল্পী নিয়ে নতুন করে পাকিস্তানের   সংস্কৃতির বন্ধ দুয়ারে হানা দেওয়ার জন্য প্রস্ত্ততি নিচ্ছেন বুলবুল। এ-যাত্রায় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা, ময়মনসিংহ, বরিশাল হয়ে সরকারি আমন্ত্রণে তিনি পৌঁছলেন সিলেটে। সিলেটের পৃথ্বীমপাশা সফররত ইরানের শাহের সম্মানে দু-রাত অনুষ্ঠান করেন বুলবুল। বুলবুলের অনুষ্ঠান দেখে শিকারের উদ্দেশে এসে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের দেখা না পাওয়ার দুঃখ ভোলেন ইরানের শাহ। ইরানরাজের মুগ্ধতা ও অনুষ্ঠানের সাফল্যে বুলবুল গড়ে তোলেন ‘বুলবুল চৌধুরী অ্যান্ড হিস ট্রুপ্স্।’

করাচির বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশনের আমন্ত্রণে করাচিতে অবস্থানরত বুলবুল (ততদিনে পাকিস্তানের জাতীয় নৃত্যশিল্পীর
স্বীকৃতিপ্রাপ্ত) পাকিস্তান সফররত ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহ্রম্নর সম্মানে অনুষ্ঠান করেন। নেহ্রম্ন হিন্দু-মুসলিম উভয় সংস্কৃতির এই রূপকারকে ‘গ্রেট আর্টিস্ট’ আখ্যায় অভিহিত করেন। করাচির ডন পত্রিকায় বুলবুলকে ‘দ্য ভেরি স্পিরিট অব কালচার ইন পাকিস্তান’ বলা হয়। এ-সময় করাচির হোটেল মেট্রোপলে এক সংবাদ সম্মেলনে বাঙালি শিল্পী হিসেবে বুলবুল একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। তিনি বলেন, বহুজাতি ও বহুসংস্কৃতির দেশ পাকিস্তানে ইসলাম কখনো সংস্কৃতির মূল বা একমাত্র উপাদান হতে পারে না। প্রাকৃতিক  বৈচিত্র্য, ভৌগোলিক পরিবেশ ও বিভিন্ন জাতিসত্তার ভিন্নতাসাপেক্ষে দেশটির সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য মানতেই হবে। এও মানতে হবে যে, সব
সংস্কৃতির মর্মমূলে রয়েছে জীবনের জন্য ভালোবাসা এবং সৌন্দর্যপ্রীতি। সুতরাং জাতীয় ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে
সংস্কৃতির বিচিত্র গতি রুদ্ধ করা সমীচীন নয়। বাংলা ও উর্দু ভাষার বিষয়টিকেও তিনি একই প্রেক্ষাপট থেকে বিচারের পরামর্শ দেন। এর অন্যথা হলে রাষ্ট্রের সংহতি বিপন্ন হতে বাধ্য। আমাদের ’৫২-র ভাষা-আন্দোলনের দু-বছর আগে বুলবুলের এ-ভাষণ ডন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে দেশভাগপ্রসূত স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার প্রেক্ষাপটে এক বাঙালির এ-ভাষণ বুদ্ধিজীবী মহলে এতটাই আলোড়ন তোলে যে, ভাষা ও বিষয়বস্ত্তর দিক থেকে ভাষণটিকে যুগপৎ সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক মূল্যে অভিষিক্ত করা হয়। বুলবুল মুলকরাজ আনন্দ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিনয় ঘোষ, গোপাল হালদার প্রমুখের পঙ্ক্তিভুক্ত হন।

মুক্তচিন্তা ও সুস্থ শিল্পচর্চার লক্ষ্যে একটা সময়ে বুলবুল ক্যালকাটা কালচারাল সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ-প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ইবসেনের দ্য গোস্ট অবলম্বনে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা চোরাবালি নাটকে অভিনয় করেন বুলবুল। সেদিনের শ্রীরাম মঞ্চে (আজকের বিশ্বরূপায়) তাঁর পরিচালনা ও অভিনয় দুটোই বিপুল প্রশংসা অর্জন করে। আনন্দবাজার পত্রিকায় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বুলবুলের ‘সুন্দর সুসংযত’ অভিনয়ের প্রশংসা করেন। নিউ এম্পায়ারে নাট্যচক্র-নিবেদিত প্রতিবাদী গণনাটক নীলদর্পণে বিন্দুমাধব চরিত্রে অভিনয় করে বুলবুল নিজে খুব আনন্দ পেয়েছিলেন। অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় মন্মথ রায়ের গল্প অবলম্বনে কৃষাণ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন বুলবুল। অভিনয়ের ডাক এসেছিল বোম্বে (বর্তমানে মুম্বাই) থেকেও। কিন্তু ও-পথে আর তিনি যাননি। ফিরে এসেছেন আপন ভুবনে। বুলবুলের এই স্বাদবদলের সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। তিনি বলেন, ‘জীবন ও অস্তিত্বের মূল সত্যটিকে স্পর্শ করার জন্য বুলবুল চৌধুরী যেমন নিবিড় অনুসন্ধান চালান এবং তাকে অনুভব করেন তাঁর প্রকাশের জন্য ভাষা, নাট্যমঞ্চ বা পর্দা তাঁর কাছে যথেষ্ট বিবেচিত হয়নি। অনুসন্ধান জ্ঞাপনের জন্য তাঁর দরকার পড়ে গোটা শরীরের, অন্য কোনো মাধ্যম সেখানে অল্প ও অসম্পূর্ণ।’ প্রসঙ্গত, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস গ্রিক কথাশিল্পী নিকোস কাজানজাকিসের জোবরা চরিত্রের সঙ্গে বুলবুলের তুলনা করেছিলেন। তীব্রভাবে, বিচিত্রভাবে বাঁচার জন্য জোবরা নানা পেশার সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। প্রেমিক জোবরা, বিপস্নবী জোবরা জীবনের প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করেছে। জোবরা কথাও বলে ক্লামিত্মহীন। কিন্তু তার বিপুল আনন্দ, তার গভীর বেদনা ও উপলব্ধি যখন ভাষায় কুলাত না, তখন জোবরা নাচত। নাচ তার বাক্যের বিকল্প হয়ে উঠত। জীবনের তীব্র ও গভীর মুহূর্তগুলো অসহনীয় হয়ে উঠলে নিজের ভেতরকার প্রবল কম্পন থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য নাচ ছিল জোবরার আশ্রয়। আখরুজ্জামান ইলিয়াস বলেন, এই জোবরার সঙ্গে বুলবুলের তফাৎ এইটুকু যে, জোবরা একজনের সৃষ্টি। বুলবুল নিজেই নিজের সৃষ্টি। তিনি শিল্পী। তিনিই তাঁর শিল্প। নৃত্য যে-বুলবুলের স্বধর্ম ছিল সে-কথা গোপাল হালদারও বলেছেন। তাঁর মতে, ‘বুলবুলের দেহচ্ছন্দে উচ্ছ্রিত ছন্দোচ্ছ্বাসে নৃত্য ছিল সহজগোচর।’ বন্ধু সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের চোখে বুলবুল ছিলেন ‘পোয়েট অব ফিজিক্যাল রাইমস’।

লিয়াকত আলী খান বুলবুলকে পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক দূত হিসেবে বিদেশে পাঠাতে ইচ্ছুক ছিলেন। তিনি আততায়ীর গুলিতে নিহত হলেন। বুলবুলও দেহমনে খানিকটা ক্লান্ত। পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় প্রতিটি জেলা শহরে তো বটেই, বড় বড় মফস্বল শহরেও তিনি অনুষ্ঠান করেন। ধর্মান্ধদের প্রবল বিরোধিতার মুখেও অটল ছিলেন বুলবুল। এ-সময় তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নৃত্যনাট্য লেস্ট উই ফরগেট (যেন ভুলে না যাই) নিষিদ্ধ করা হয়। কিছুদিন পরিবার ও দল নিয়ে ময়মনসিংহের শশী লজে মহারাজা স্নেহাংশুর সম্পত্তি দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করেন বুলবুল। সেখানে আগুন ও প্রজাপতি এবং অ্যাংলো আমেরিকান বস্নক ভার্সাস ইরান সৃষ্টি করেন।

বুলবুল চৌধুরী, ‘এক নৃত্যপাগল ব্যাকুলতার’ অন্য নাম। সরকারিভাবে যখন আর হলো না বেসরকারিভাবে ইউরোপ সফরের উদ্যোগ নেন তিনি। অর্থ সংগ্রহের জন্য ইচ্ছার বিরুদ্ধেও হাত পাততে হয় অনেকের কাছে। নানাজনের দাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভর করতে হয় তাঁকে। যাত্রার প্রতিটি পদক্ষেপে নানা ধরনের হয়রানির শিকারও হতে হয়। দলের ভারতীয় সদস্যদের জন্য পাকিস্তানি পাসপোর্ট বানাতে হয়। হিন্দু নাম বদলে মুসলমান নাম দিতে হয় অনেককে। আমাদের মনে পড়ে যায় এই বুলবুল লাহোর জামে মসজিদের ইমামকে তর্কযুদ্ধে আহবান জানিয়েছিলেন। তিনি প্রমাণ করবেন নাচগান বেশরিয়তি নয়। হেরে গেলে নিজে ধর্মত্যাগ করবেন। অন্যথা হলে ইমাম সাহেবকে ইমামতি ছাড়তে হবে। গভীর রাতে বুলবুলের সঙ্গে দেখা করে ইমাম তাঁর ফতোয়া প্রত্যাহার করে নেন। বিলেতযাত্রার আগে পাকিস্তানের জাতীয় শিল্পীর সম্মান এবং দেশের কালচারাল অ্যামবাসাডর হিসেবে বিদেশ সফরের প্রতিশ্রম্নতি নবায়ন করে নিয়েছিলেন বুলবুল। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। যদিও আট মাসের ইউরোপ সফরে ইংল্যান্ড-আয়ারল্যান্ড ছাড়াও বেলজিয়াম, ফ্রান্স, হল্যান্ড ও ইতালিতে অনুষ্ঠান করেন তিনি এবং বিপুল স্বীকৃতিও অর্জন করেন। দল নিয়ে ইউরোপের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রামেত্ম যখন ঘুরে বেড়াচ্ছেন বুলবুল তখন, ততদিনে মরণব্যাধি ক্যান্সারে তাঁর প্রাণশক্তি নিঃশেষিত প্রায়। নিদারুণ অর্থকষ্টে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েও চিকিৎসা অগ্রাহ্য করেন। নিষিদ্ধ লেস্ট উই ফরগেট মঞ্চস্থ করার দায়ে পাকিস্তান দূতাবাসের প্রতিশ্রম্নত ধারের টাকা থেকেও বঞ্চিত হতে হয় তাঁকে। দলের সদস্যদের মধ্যেও তখন নানা ধরনের দ্বন্দ্ব-কলহ। নিঃস্ব, অশক্ত, ব্যাধি-জর্জরিত বুলবুলকে ফিরতে হলো কমদামি পোলিশ জাহাজ ‘ব্যাটারি’তে কমিউনিস্ট দেশের জাহাজ বলে করাচি বন্দরে যার প্রবেশের অনুমতি ছিল না। চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার চুনতি গ্রামের আজম উল্লাহ চৌধুরী ও মাহফুজা খাতুনের জ্যেষ্ঠপুত্র রশিদ আহমদ চৌধুরী টুনু, পরবর্তীকালে বুলবুল চৌধুরী ১৯৫৪ সালের ১৭ মে চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হাসপাতালেপিতৃভিটা দেখার অপূর্ণ সাধ নিয়েই  শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। কলকাতা তিনজলা কবরস্থানে চিরনিদ্রায় সমাহিত বুলবুলের জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন করছে দেশ, জাতি।

ভারতবর্ষে তাঁর মৌলিকত্ব ও সাহসী শিল্পচর্চার খ্যাতি হয়েছিল। ইউরোপেও বিপুলভাবে প্রশংসিত ও সমাদৃত হয়েছিলেন তিনি। তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে অনুরাগী ও প্রভাবশালী বন্ধুজনদের উদ্যোগে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় বুলবুল ললিতকলা একাডেমি। ১৯৮৩-তে আসাদ চৌধুরী বলেছিলেন, ‘তাঁর সময়ে তাঁর মতো … শিল্পীর  উচ্চতা এবং সাফল্য … অনুভব করার ক্ষমতাও অনেকের ছিল না। … সংগীত, চিত্রকলা ও নৃত্যসমালোচনার ভাষা আজও তৈরি হয় নি।’ ১৯৮৪-তে তিনি স্বাধীনতা পদক পান। সব মিলিয়ে শতবর্ষের ব্যাপ্তিতে তাঁকে আমরা পাচ্ছি। হঠাৎ জেগে-ওঠা আকর্ষিক কোনো চরাঞ্চল তিনি নন। তিনি ছিলেন, আছেন, থাকবেন। ‘হিন্দু-মুসলমানের মিলিত বাংলায় যে-অর্থে নজরুল আমাদের জাতীয় কবি, সে-অর্থে বুলবুলেরও ‘জাতীয় শিল্পী’ অভিধাটি প্রাপ্য বলে মোরশেদ শফিউল হাসান মনে করেন। (প্রবন্ধ : ‘বুলবুল চৌধুরী : তাঁর শিল্পযাপন’) স্বাধীন বাংলাদেশে কবি নজরুল পেয়েছিলেন জাতীয় কবির স্বীকৃতি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়মত্মী সামনে রেখে বুলবুল জন্মশতবার্ষিকীতে আমরাও চাই বুলবুল ‘জাতীয় শিল্পী’ অভিধায় বৃত হোন।