শফিকুল কবীর চন্দন

‘নাচ হলো কবিতা। হাত ও পা যার অস্ত্র। শিষ্ট, ভয়ানক ও প্রাণবন্ত চলাফেরায় শোভিত। যেন স্বপ্নসৃষ্ট কাব্যাভিনয়ের দৃশ্যমানতা।’
এমনি এক ঘোরলাগা বিষয় নিয়ে আঁকা শিল্পী দেগার চিত্রকর্ম চেনে দুনিয়াজোড়া শিল্পপ্রেমিকরা। আমরা দুই বাঙাল দেগার শিল্পরসের টানে ছুটে গিয়েছিলাম মিলান থেকে তুরিনে, উদ্দেশ্য ইম্প্রেশনিস্ট এই শিল্পীর শিল্পভাণ্ডারের খানিক তত্ত্ব-তালাশ। দেগার কাপোলাভরি দাল মুজে দি’অরসে।
সে-কথা বলার আগে একটা আশকথা-পাশকথা গাইতে চাই। আমরা যারা অভিবাসী, দীর্ঘদিন দেশে যাওয়া হয় না, তাদের কাছে স্বল্পমেয়াদে নানা প্রয়োজনে দেশ থেকে ঘুরতে আসা যে-কেউ আমাদের সাময়িক অতিথি হয়ে আগ্রহের পাত্র বনে যান। তেমনি আমার প্রায় ১০ বছরের অদেখা স্বদেশের ছবি হয়ে যাঁরা মিলানে আসেন, তাঁদের কাছে কথা, গল্প শোনা যেন শেষ হওয়ার নয়। সম্পাদক, শিল্প-সমালোচক, কিউরেটর রোজা (রোজা মারিয়া ফালভো) নভেম্বরের শুরুতেই জানিয়েছিলেন, ঢাকা থেকে রীপন শিগগিরই মিলানে আসছেন। এক বছর পর আবার দেখা হবে, গল্প হবে – এসব ভেবেই তাঁর আগমনে উল্লসিত হই। সে-উল্লাস আরো বেড়ে যায়, যখন জানি, এবার তার আসার কারণ ‘জয়নুল প্রকাশনা’, যা মিলানের বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা স্কিরা ও বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত হওয়ার কথা ডিসেম্বরে! রোজার সঙ্গে এ নিয়ে মাঝেমধ্যে কথা হলে আমারও উচ্ছ্বাস ঝরে। তাছাড়া জয়নুলকে বৃহত্তর লক্ষ্যে তুলে ধরার এ-প্রয়াসটিকে সামগ্রিক গুণসম্পন্ন করতে তাঁর আগ্রহের ব্যাপ্তিটিও আমাকে আনন্দিত করে! রীপন ভাইয়ের কাছে শুনি এ-বিষয়ে তাঁর নানা অভিজ্ঞতার কথা। নির্দিষ্ট কাজে তাঁর হাতে গোনা কদিনের মিলান বাসের সময়ে আমার পেশাগত জীবনের ফাঁকফোকর গলিয়ে কবে, কোথায়, কী উপলক্ষে খানিকটা ভ্রমণে যাওয়া যায় তার পরিকল্পনাও বাদ যায় না। মিলানের অদূরে পাভিয়া শহরে চলছিল পিকাসোর একটা প্রদর্শনী। ছিল রেনোয়া সংগ্রহ ও আলবের্তো বুররি ও অন্যদের কাজের দলগত প্রদর্শনী। তাঁর এসব দেখার ইচ্ছের কথা সমানতালে বলে যাচ্ছিলেন, তবে সঙ্গে অবশ্যই যোগ করছিলেন যদি সম্ভব হয় শব্দ কটি। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহের আবহাওয়া ছিল যুগপৎ ঠান্ডা ও বৃষ্টিতে বৈরী। সে-পরিকল্পনা আর বাস্তবায়ন করা গেল না। ফলে এক সপ্তাহান্তে সানসিরো স্টেডিয়ামে ইন্টার-কালিয়ারি ফুটবল ম্যাচ দেখা হলে অন্য সপ্তাহান্তে ঠিক হয় তুরিনের এডগার দেগার শিল্পকর্ম প্রদর্শনী দেখতে যাওয়ার। যেসব শিল্পকর্ম প্যারিসের অরসে মিউজিয়াম থেকে আনা।
রোজা দেগার প্রদর্শনীর প্রবেশপত্র সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন। ২৫ নভেম্বর মিলান কেন্দ্রীয় রেলস্টেশন থেকে দুই ঘণ্টার যাত্রা শেষে তুরিন পৌঁছে সে-সকালটা উদ্যাপন করেছিলাম পদব্রজে প্রদর্শনীস্থানে যেতে যেতে। এ হাঁটাপথে রোববারের নিরিবিলি রাস্তার সঙ্গে সখ্য করে অপেক্ষা করছিল যে ইতালিয়ান বার, তাতেই ‘বৃহস’ আর ‘কাপুচিনো’ দিয়ে সকালের নাস্তা সেড়ে নিয়ে মিনিট কয় হাঁটতেই আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম প্রদর্শনীর স্থান ‘পালাচ্ছিনা দেল্লা প্রমত্রিছে দেল্লে বেল্লে আরতি’তে। তখন তুরিনের আকাশে রোদ হেসেছে! আমরাও সময়ক্ষেপণ না করে প্রবেশ টিকিট ক্রেতাদের লম্বা লাইনকে পেছনে রেখে হাসিখুশি পা বাড়াই দেগার নর্তকীদের কোলাহলে।
‘লোকেরা আমাকে ‘নাচের কন্যাদের চিত্রকর’ বলেই ডাকে। তাদের একটা বিষয় কখনই দৃষ্টিগোচর হয়নি যে, আমার মূল উদ্দেশ্য নর্তকীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুদ্রাভঙ্গি এবং আকর্ষণীয় পরিধেয় বস্ত্রের চিত্রাঙ্কন করা।’
দেগার এ-উক্তির মাধ্যমেই আমরা তাঁর সৃষ্টিকর্মের জগতের নানা সময়ের সঙ্গে পরিচিত হতে হতে দর্শনার্থীদের কাফেলায় শরিক হয়েছিলাম। ২০০২ সালে আমার প্যারিসের অরসে জাদুঘর পরিদর্শনের সময় দেগার নর্তকীদের প্রথম দেখার সুযোগ হয়েছিল। সেই ১০ বছর আগের স্মৃতির পাতা উল্টাতে গিয়ে আরো আগে নব্বইয়ের দশকে ফিরে গিয়েছিলাম। তখনকার স্মৃতিতে লেপ্টে আছে প্রয়াত চিত্র সমালোচক সাঈদ আহমেদের কথা। মনে পড়ে তখন আমি ঢাকা চারুকলা ইনস্টিটিউটের স্নাতক পর্বের ছাত্র। শিল্পকলা একাডেমীর বিশেষ ‘শিল্প-সমালোচনা কোর্সের’ উপস্থাপক হিসেবে সাঈদ আহমেদ আধুনিক পাশ্চাত্য শিল্পীদের নিয়ে নির্বাচিত বিষয়ের শিরোনাম দিয়েছিলেন ‘মানুষ-অমানুষ-অতিমানুষ’। তাতে ছিলেন দালি, পিকাসো, গগ্যা, ভ্যানগঘ, দেগা প্রমুখের জীবনীর আলোচনা। তাঁদের অমানুষিক পরিশ্রম, অমানবিক, জেদী, বদরাগী, খ্যাপা স্বভাব মিলে আবার এক অতিমানবীয় শিল্পমানস। তেমনি এক শিল্পমানসের শিল্পকৃতি বারবার দেখার আগ্রহ থাকাটাই স্বাভাবিক। আমার প্রথম দেখায় অনেককিছুই যে দেখা হয়নি সেটাও এবার বুঝতে পারলাম! প্রদর্শনীকক্ষে প্রথমেই ছিল তাঁর বিখ্যাত ভাস্কর্য ‘১৪ বছর বয়সী ছোট নর্তকী’। তারপর একে একে দেখা হয় ব্যালে নর্তকী, ব্যালে রিহার্সাল, ঘোড়া অনুশীলন, স্নান, বেলেলি পরিবার, অর্কেস্ট্রা মিউজিশিয়ান, সুজানা উইথ বাথটাব ইত্যাদিসহ আরো অনেক চিত্রকর্ম ও ভাস্কর্য ।
দেগা বলেন, ‘আমার চিত্রপটের নর্তকীরা সহজ ও সৎ, যারা তাদের শারীরিক জীবিকা-বহির্ভূত কোনো কিছুতেই উদ্বিগ্ন নয় … এভাবে বলা হলে তা হবে চাবির ছিদ্র দিয়ে অবলোকন।’
মঞ্চে নর্তকীদের জাঁকজমক উপস্থাপনার বাইরে যে তাদের সারল্য ও সহজ যাপনচিত্র, তা দেগার নানা কাজে স্পষ্ট হয়ে আছে। কতভাবেই না তাদের দেখতে চেয়েছেন শিল্পী। তাঁর প্রিয় মাধ্যম প্যাস্টেল দিয়ে রঙের মমতা বুলিয়ে দিয়েছেন নর্তকীদের ব্যাক স্টেজের অতিসাধারণ সব মুহূর্তের চিত্রে। ফলে দেগা-র চিত্রকর্মে নগ্নতাও এসেছে। আর এসব নিয়ে দুর্মুখ সমালোচকও ছিলেন আক্রমণাত্মক। তাঁরা নর্তকী ‘সুন্দর কাপড় অঙ্কনের অজুহাত’ বলে তাঁকে তিরস্কার করতেও ছাড়েনি! শিল্পী সেসবকে থোড়াই কেয়ার করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা তাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টা, পোড়া, রক্তিম, ক্লান্তিতে নুয়ে পড়া হতভাগাদের সৌন্দর্য দেখতে না চাই , কিন্তু অভদ্রোচিত হলেও বলতে হয় যে, তারা আরো শালীন যখন তারা নগ্ন হয়।’
১৮৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফরাসি লেখক এডমন্ড দে গুনকর্ত ‘এক আজব চিত্রশিল্পী দেগার কর্মশালা পরিদর্শন করেছিলেন, যা সে-সময়কার একটি স্মরণীয় উপলক্ষ বলেই চিহ্নিত। গুনকর্ত তাঁর নর্তকীদের আন্দোলন বিষয়ক সাময়িকীতে লিখেছিলেন, ‘দেগার কাজের মধ্যে এক ধরনের মস্করা আছে, যা ব্যালে নাচের এক পরিকল্পিত ক্রমের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ!’ এই পরিদর্শনের বিষয়টিকে কৌতূহলোদ্দীপক আখ্যা দিয়ে দেগাকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেন, ‘তাঁর লক্ষ্য ছিল অগ্রসর, আর অস্ত্র ছিল চিত্রের বৃত্তাকার গাঠনিক বিস্তার, যা ছিল একজন চিত্রশিল্পীর তথা নৃত্য শিল্পের নন্দনতত্ত্বের সঙ্গে দারুণ বোঝাপড়া।’ দেগা নিজেও বলেছেন, ‘একটি চিত্রের জন্য প্রয়োজন একটু রহস্য, কিছু অস্পষ্টতা, একটু ফ্যান্টাসি। আপনি যদি সবসময় এর অর্থকে বর্ণনায় রূপ দিতে চান তাহলে শেষ পর্যন্ত তা দর্শকদের বিরক্তি উৎপাদন করবে।’
১৮৩৮ সালের ১৯ জুলাই ইতালীয় বংশোদ্ভূত শিল্পী এডগার দেগা ফ্রান্সের প্যারিসে জন্মগ্রহণ করেন। মধ্যবিত্ত পরিবারের এ-সন্তান মাত্র ১৩ বছর বয়সে তাঁর মাকে হারান। তিনি বিয়ে করেননি। নারীসঙ্গ বিষয়ে তাঁর বিশেষ কোনো উচ্চ ধারণাও পোষণ করেননি! জীবদ্দশায় শিল্পকর্ম নিয়ে তাঁকে যথেষ্ট ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। দেগা কেন বিয়ে করেননি এর উত্তরে বলেছিলেন, ‘সারাজীবন একটা নশ্বর দুর্বিপাক আমাকে সন্ত্রস্ত করে রেখেছে যে, হয়তো একটা শিল্পকর্ম সম্পন্ন হলে আমার স্ত্রী বলে উঠবে, সুন্দর! কিন্তু খুবই সাধারণ বস্তু।’
১৯১৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ৮৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করা শিল্পী দেগার প্রদর্শনীতে নানা পর্যায়ের কাজ সম্পর্কে ছিল খুবই পরিমিত সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। সঙ্গে শিল্পকাজের বাঁক পরিবর্তনের নানা উদাহরণ। তাঁর প্রিয় প্রাণী ঘোড়া নিয়ে এমন বর্ণনার পাশাপাশি ছিল ভিডিওচিত্র। তা ছাড়া দেগার জীবন ও শিল্পকর্ম নিয়ে ছিল অত্যন্ত চমৎকার ভিডিও উপস্থাপনা সব মিলে দেগার জীবন পেরিয়ে আমরা পা ফেলি প্রদর্শনী শেষ করে বাইরে। কেমন যেন ঘোরলাগা এই শিল্প-পরিভ্রমণ শেষে শুনতে পাই – দেগা বলছেন, ‘এই নর্তকী মেয়েরা আমাকে কখনই ভুলতে পারবে না এই ভেবে যে আমি তাদের বর্মহীন করেছি! কিন্তু আমি তাদের প্রণয়লীলার ভান ছাড়াই দেখতে চেয়েছি।’ মনে মনে বলি দেগা, আমরাও দুই বাঙাল তোমার এ-নৃত্যের জগৎ দর্শনের কথা মনে রাখব!
দেগার এ-প্রদর্শনীর মূল উদ্যোক্তা মিলানোর স্কিরা পাবলিকেশন। ফলে প্রদর্শনী-আঙিনার সঙ্গেই তাদের এ-প্রদর্শনী সম্পর্কিত কত রকম যে বিচিত্র প্রকাশনা পণ্য উপস্থাপন করেছে! রীপন ভাই বলছিলেন কবে যে আমাদের দেশে একটা প্রদর্শনী এমন সামগ্রিকভাবে উপস্থাপিত হবে? সেখানেই দেখা মিলল বেঙ্গল স্কিরা যৌথ পাবলিকেশনগুলো। সেসব মলাট যেন ভিনদেশে বাংলাদেশ হয়ে তাৎক্ষণিক হেসে উঠেছিল সেদিন!
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.