মাঁউ খাঁউ

১. খাওয়া নিয়ে যত

দোন কিহোতের সহচর সাঙ্কো পাঞ্জা একবার বলেছিল এ-রকম একটা কথা – পৃথিবীতে যে লোকটা ঘুম আবিষ্কার করেছিল তাকে পেলে বেশ ভালো একটা পুরস্কার দিতাম। উপলক্ষ পেলে এই সাঙ্কো পাঞ্জাই হয়তো এ-কথা বলতে পারত যে, পৃথিবীতে যে লোকটা খাওয়া আবিষ্কার করেছিল ইত্যাদি ইত্যাদি।

না, আমরা জানি, কোনো লোক খাওয়া আবিষ্কার করেনি। আবিষ্কার কেউ করে থাকলে তা করেছিল পৃথিবীর আদিমতম প্রাণীরা, হয়তো উদ্ভিদেরা। খাওয়া ছিল তাদেরও বাঁচার শর্ত। তবে অন্যান্য সচল প্রাণীর মতো উদ্ভিদদের খাবারের সন্ধানে জায়গায় জায়গায় ঘুরতে হতো না আর মানুষের মতো চাষবাস, শস্যদানা ঝাড়াই-বাছাই, ফলপাকুড় সংগ্রহ, মৎস্য ও পশুশিকার, রান্নাবান্না, খাদ্য পরিবেশন – ইত্যাদির বিশাল ব্যাপক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারত না। পশুরাও তা পারেনি। খেতে হবে, খেতে হবে – এই হলো মানবসভ্যতার আদি মন্ত্র, আদি আর্তনাদ।

প্রায় ষাট-সত্তর বছর আগে ভারতের ওডিশায় একজন ‘নিখাকি মা’ এসেছিলেন, তিনি নাকি কিছুই খেতেন না। আর শিবঠাকুরের নানা জন্মের গিন্নি উমাও একসময় একটা করে গাছের পাতা খেতেন, তখন নাম ছিল ‘একপর্ণা’, তারপর, কী সর্বনাশ, ‘অপর্ণা’ হয়ে তিনিও নিখাকি মা হয়ে গেলেন। যে অঞ্চলে লোকের না খেয়ে মরাটা অভ্যেস হয়ে গেছে, যে ভাষায় কবিরা প্রায়ই বলেন, ‘জ্বলন্ত এই চুলিস্নতে মা একটু আগুন দে, আর কিছুক্ষণ বেঁচে থাকি বাঁচার আনন্দে’, কিংবা ‘ভাত দে হারামজাদা’, কিংবা ‘আমি আর আমার বাবা, দুজনেই সামান্য লোক – আমাদের পান্তাভাতে লবণের ব্যবস্থা হোক’ সে অঞ্চলে নিখাকি বা অপর্ণাদের সংখ্যা অঢেল হলে ভালোই হতো। সে সংখ্যা কত তা অনুমান করতে ভরসা পাই না, কারণ খবরের কাগজে অনাহারে মৃত্যুর খবর ছাপলেই শাসকরা হইহই করে বলে ওঠেন, ‘দূর, একদম বাজে কথা! মাইরি বলছি, ওরা মরেছে বার্ধক্যে অসুখে, আর বেশি মদ খেয়ে। অনাহারে মৃত্যুকে আমরা পোলিও আর পানিবসমেত্মর মতো দেশ থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছি।’

অবশ্যই বাঙালি একাধিক মন্বন্তর পার হয়েছে, কিন্তু ইচ্ছা করে না খাওয়ার কথা কখনো ভাবেনি। অনশনের সময় ছাড়া। গান্ধিজি অনশনের শিল্পটি ভালোই রপ্ত করেছিলেন, কখনো রবীন্দ্রনাথ, কখনো সুরাবর্দির হাতে লেবুপানি খেয়ে অনশন ভেঙেছেন। তবে আজকাল শুনেছি, চকোলেট খেয়ে অনশন করা যায়। মহাপুরুষদের কথা আলাদা, তবে আমরা সাধারণ মানুষেরা নিতান্ত নিরুপায় না হলে না খাওয়ার কথা ভাবি না।

না খাওয়ার কথা আমাদের মতো বাঙালি ভাবুক আর না ভাবুক, ভাষাই যদি একমাত্র প্রমাণ হতো, তাহলে বাঙালির মতো খাইয়ে জাত পৃথিবীতে আর নেই। বাঙালি শুধুই ‘খায়’। ইংরেজিভাষীরা যেখানে দিব্যি আলাদা আলাদা করে eat করে, drink করে আর smoke করে সেখানে বাঙালি সবই খায় – ভাত-আলুসেদ্ধ, বিড়ি-সিগারেট, মদ কিংবা নিমের পাচন। এমনকি অবাক কা- – চুমু, এবং তার শিশু সংস্করণ ‘হামি’ও খায়। এমনকি আরো অবাক কা-, বিপদে বা সংকটে পড়লে বলে ওঠে, ‘এই খেয়েছে!’ বা ‘খেয়েছে রে!’ কে খেয়েছে, কী খেয়েছে সেসবের তোয়াক্কা না করেই। পূর্ব বাংলায় এটার রূপ ‘খাইসে’ বা ‘এক্কেরে (এক্কেবারে) খাইসে!’ তবে বিড়ি-সিগারেট-গাঁজা খেলেও এদের নির্গলিত ‘ধূম’ সে দয়া করে ‘পান’ করে বটে। হিন্দিভাষী বন্ধুরা অবশ্য সিগারেটও পান করেন। অনেকদিন আগে শিখেছিলাম, প্রায় ভুলেও এসেছি – সভ্যতায় অতি উন্নত ইরানের ফারসিভাষী মানুষেরাও বাঙালিদের মতোই সবই ‘খেতেন’, এখনো খেয়ে চলেছেন কি না জানি না।

এ নিয়ে যখন অন্য ভাষার লোকেরা আমাদের একটু খোঁচানোর চেষ্টা করে তখন আমরা একটু ভারিক্কি চালে বলি, ‘আরে দাদা, বুঝছ না, যেকোনো রকমের oral intake-ই হলো আমাদের খাওয়া, সে লোকের দেওয়া বিনিপয়সার বিষ হলেও।’ আবার যদি কোনো ছেঁদো লোক এ নিয়ে ইংরেজি ভাষার মাহাত্ম্য প্রচারের চেষ্টা করে, তাকে বলি, ‘ওহে চাঁদ, না জেনে বাহাদুরি দেখাতে এসো না। ইংরেজিতে মাসি, পিসি, খুড়ি, জেঠি, মেসো, পিসে, খুড়ো, জ্যাঠা, খালা, খালু, ভাবি, দাদা, দাদু, নানা, নানি, শালি, শালা, জামাইবাবু, বেয়াই, বেয়ান – এতসব শব্দ দেখাও দেখি! সবই তো aunt, uncle, আর -in-law দিয়ে তাপ্পি মারা! কোথাওবা grand কথাটার পুলটিস লাগানো।’

যাহোক, কথা হচ্ছিল খাওয়া নিয়ে, খাওয়া থেকে অন্য প্রসঙ্গে চলে যাওয়া মহাপাতকের কাজ। খাওয়াটা যে কী মারাত্মক ক্যান্টাঙ্কারাস গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার সে-বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ তো বলেইছেন যে, ‘বাসনার সেরা বাসা রসনায়।’ কিন্তু প্রয়াত কবি সমর সেনের বাবা অরুণচন্দ্র সেনের (সাহিত্যের ঐতিহাসিক দীনেশচন্দ্র সেনের ছেলে) একটা দার্শনিক বক্তব্য থেকেও তা প্রমাণ হয়। তিনি সেটা বেহালার যেসব ছেলেছোকরার কাছে করেছিলেন তারাও প্রায় সবাই মহাকালের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। তাঁদেরই একজনের কাছে আমি শুনেছিলাম।

তাঁর বাড়ির রোয়াকে অর্থাৎ ‘রকে’ বসে তিনি ইউরোপের নানা দার্শনিকের প্রধান কথাগুলোকে খুব সংক্ষেপে, শারীরিক অভিব্যক্তি দিয়ে বোঝাচ্ছিলেন। বললেন, ‘হেগেল কেইম, অ্যান্ড হি সেইড্ (নিজের মাথায় থাবড়া মেরে), ‘দিস ওয়জ অল্’। দেন রুশো কেইম, অ্যান্ড হি সেইড্ (বুকে থাবড়া মেরে), ‘দিস্ ওয়জ অল্’। দেন মার্কস কেইম, অ্যান্ড হি সেইড্ (পেটে থাবড়া মেরে), ‘দিস্ ওয়জ অল্’। অ্যান্ড ফাইনালি ফ্রয়েড কেইম, হি ওয়েন্ট ইভন ডাউনওয়ারড্জ।’ অর্থাৎ হেগেলের কাছে প্রধান ছিল মন, রুশোর কাছে হৃদয়, মার্কসের কাছে পেটের খিদে, আর ফ্রয়েডের কাছে … – যাক, সেটা অরুণচন্দ্রও বলেননি, আমিও বলব না।

তাই আমরা ফ্রয়েড পর্যন্ত পৌঁছাতে চাই না, আমাদের সময়ের দুর্বুদ্ধিবশত মার্কসে আটকে যেতে চাই। ওই যে ‘পেট’, পোড়া পেটের  সওয়াল, সেই নিয়েই না সারা পৃথিবীর এত মারামারি-কাটাকাটি, এত স্নায়ুযুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, খ-যুদ্ধ, অখ-যুদ্ধ, মহাযুদ্ধ, ঠান্ডাযুদ্ধ। বাজার চাই বাজার। পেটে খেলে শুধু পিঠে সয় কেন, সর্বত্রই সয়। আর পেটের খাবার যখন অমিল হয়, তখন কিছুতেই সয় না। রোটি, কাপড়া আর মকানের মধ্যে ‘রোটি’টাই আগে আসে। তাই
কৃষক আর চা-শ্রমিকদের আত্মহত্যা থেকে বিয়াফ্রা, ইয়েমেন আর কালাহান্ডির মানুষদের গণমৃত্যু পর্যন্ত কত কী ঘটে যেতে পারে। ধরনা, মিছিল, বিক্ষোভ, বিদ্রোহও বাকি থাকে না। আমরা ওসবের মধ্যে পাঠককে নিয়ে যেতে চাই না। এখনকার অনেক পাঠক হয়তো বিয়াফ্রা কী, তা লোকে খায় না মাথায় দেয়, কিছুই জানে না।

২. কত খাওয়া : ইচ্ছায়, অনিচ্ছায়

ভদ্রলোকের পক্ষে অরুচিকর ও বিরক্তি-উৎপাদক না খাওয়ার থেকে খাওয়ার কথায় ফিরে আসি। আসলে খেতে কারো অনিচ্ছা হতে পারে, সেটা ভাবতে আমরা তাজ্জব হয়ে যাই। পশুদের হতেই পারে, তারা নাকি ভরপেট খাওয়ার পর খাবার শুঁকেও দেখে না, কিন্তু মানুষের? পেটুক তো শুধু মানুষের মধ্যেই পাই। পেটুকের যেমন পেটের সিংহদরজাটা সবসময় হাট করে খোলা থাকে, যখন যে খাবারই আসুক তাকেই ঢাকঢোল বাজিয়ে অভ্যর্থনা করে, সবাই সে-রকম হয়তো নয়। কেউ কেউ বিশেষ খাবারের জন্য ছাড়পত্র দিয়ে রাখে। যেমন যৌবনকালে আমার কোনো কোনো বন্ধু বলত, ‘রাজভোগ’ হচ্ছে সেই প্রিভিলেজ্ড খাবার, যাকে আমি কখনো মুখ থেকে ফিরিয়ে দিতে চাইব না। আমার পেট খেয়ে খেয়ে আস্ত একটা হরিণ-গিলে-খাওয়া বুনো অজগরের পেটের মতো ঢাউস হয়ে যাক, দু-চারটি রাজভোগ দেখলে আমি সবসময় বলব, ‘ওয়েলকাম, ফ্রেন্ড!’

মুখে খাওয়া তো আছেই। খাওয়া, ভোজন, আহার করা, গেলা, দাঁতে কুটো-কাটা, পেটে দুটো দানা দেওয়া, পান করা, চুমুক দেওয়া, শুষে নেওয়া, চিবোনো, সাবড়ানো, মুখে চালান করা, পেটে চালান করা, মুখে পোরা, গলাধঃকরণ, হজম করা, বদহজম, মেরে দেওয়া (রসগোল্লার রসটা তুই একা মেরে দিলি?)। আবার এর উলটো ব্যাপারগুলোও আছে, সেসব খুব মুখরোচক না হলেও, বাচ্চাদের মুখে দুধ তোলা, বমি করা, উগরে দেওয়া আরো কত কী।

তবে আমরা দেখব, খাওয়ার সব কথা সমান উপাদেয়, ইচ্ছাকৃত বা আকাঙিক্ষত নয়, ইচ্ছার বিরুদ্ধেও আমরা খাই। সে খাওয়া মুখে নয়, তবে মুখে মুখে তো বটেই। বাঙালি ‘খাওয়া’ কথাটা নিয়ে কত রকমের খেলা খেলেছে দেখুন। মুখে গ্রহণ ধরনের খাওয়াও আছে, যা অন্যমনস্ক খাওয়া – ‘নখ খাওয়া’, ‘আঙুল খাওয়া’। এমনকি একটা শারীরিক প্রতিক্রিয়া আছে, ‘ঠোঁট কামড়ানো’ – এই কামড়, আরো অনেক কামড়ের মতোই, খাওয়ার উদ্দেশ্যে নিশ্চয়ই নয়। আবার খাওয়া মানে শুধু ‘মুখে গ্রহণ’ নয়, ‘টাকা খাওয়া’, ‘ঘুষ খাওয়া’ তো হাতেও গ্রহণ – এ সবই ইচ্ছাকৃত। এরকম ইচ্ছাকৃত আরো খাওয়া হলো – বিড়ি-সিগারেট, গাঁজা পান থেকে শুরু করে মেয়েদের সাধ খাওয়া, হাওয়া খাওয়া, কসম খাওয়া, ইচ্ছাকৃত হোক বা না হোক সুখকর ‘আদর খাওয়া’। কিন্তু আবার এমন অনেক খাওয়াও আছে – ‘মার খাওয়া’ যেমন, যার অর্থ বোধ হয়, ‘অঙ্গে গ্রহণ’, সেটা কি খুব ইচ্ছাকৃত আর সুখকর এক কাজ? কেউ বলুক দেখি! পরে আমরা দেখব তার অর্থ আরো ছড়িয়ে যায়, রূপক বা মেটাফর হয়ে। তেমনই আরো যেমন ‘কানমলা খাওয়া’, ‘কিল/ চড়/ ঘুষি/ গাঁট্টা/ কোঁৎকা/ লাথি/ চিমটি/ খোঁচা/ ঠুসো খাওয়া’, ‘চাবুক/ জুতো/ হুড়কো/ লাঠি/ বেত খাওয়া’, ‘গুলি/ ঢিল/ ইট-পাটকেল খাওয়া’ (‘গুলি খাওয়া’ কথাটার অন্য মানেও আছে, ‘গুলিখোর’-এ যা পাই), ‘গুঁতো খাওয়া’, ‘আছাড় খাওয়া’, ‘ঠোকা খাওয়া’, ‘ঠোক্কর খাওয়া’, ‘ধাক্কা খাওয়া’, ‘খাবি খাওয়া’, ‘শক খাওয়া’, ‘তাড়া খাওয়া’, ‘ঠেলা খাওয়া’, ‘চোট খাওয়া’, ‘হোঁচট খাওয়া’, ‘গোরুর চাট খাওয়া’, ‘সাপের কামড় খাওয়া’ ইত্যাদি। তবে শেষেরটা ইচ্ছাকৃত হতেও পারে। আমরা গুজব শুনেছি যে, ‘কলেস্নাল যুগে’র বাঙালির সাহিত্যিকের যখন সব রকম নেশা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল, কোনো নেশাতেই আর শানাত না, তখন তিনি সাপের বিষ খেতেন, কীভাবে খেতেন তা জানি না। ভালো কথা যে, তাকে রানি ক্লিওপেট্রার মতো মরতে হয়নি। দ্বিতীয়জন তো ইচ্ছা করেই সাপের কামড় খেয়েছিলেন। আর একটা মর্মামিত্মক খাওয়া হলো ছেলে বা মেয়ের মা-বাপকে ‘খেয়ে’ জন্মানো বা জন্মে মা-বাপকে খাওয়া। ‘জন্মেই  ছেলেটা/ মেয়েটা মাকে খেয়েছে’ – এমন কথা হয়তো গ্রামে আজো শোনা যায়। এই স্মৃতিযন্ত্রণা হয়তো সন্তানদেরও সারাজীবন ‘কুরে কুরে খায়’।

খাওয়া যেমন প্রধানত মুখের কাজ, তেমনই কথা বলাও তাই। তা আমরা কথাও খাই নানা রকমের – যেমন, বকুনি খাওয়া, গালি খাওয়া, কথা হজম করা, এই একই অর্থে ঝাড় খাওয়া। আমরা যে গ্যাস খাই তাও তো কথারই তোল্লাই।

ইচ্ছাকৃত/ অনিচ্ছাকৃত ভাগ যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝবেন জল খাওয়া কথাটার দুটো প্রয়াগ থেকে। একটা ‘দুপুর রোদে বেরোবার আগে জল খেয়ে বেরিয়ো’, আর একটা ‘সাঁতার শিখতে গিয়ে আমার ছেলে প্রথমেই বেশ কয়েক ঢোক জল খেল’। তেমনই ইচ্ছাকৃত-অনিচ্ছাকৃতের বাইরেও ‘চোট খাওয়া’ কথাটা দেখুন – ‘গাড়িটা হেডলাইটের নিচে একটু চোট খেয়েছে’তে একটা শারীরিক অর্থ আছে, কিন্তু ‘তোর কথা শুনে শেয়ার কিনতে গিয়ে দু-লাখ টাকা চোট খেয়ে গেলাম’ – ক্ষতি হওয়ার একটা রূপক, প্রসারিত অর্থ নিয়ে এলো। ‘মাথা খাওয়া’র দিব্যিতে অর্থ এক, ‘আমার মাথা খাও, আজ শনিবার অবেলায় তুমি বাড়ি ছেড়ে যেয়ো না।’ কিন্তু ‘ওই মেয়েটাই তো আমার ছোট ছেলের মাথা খেয়েছে!’ ‘চিবিয়ে’ খেয়েছে বললে আরো খোলতাই হয়। ‘হাওয়া খাওয়া’ ইচ্ছাকৃত, কিন্তু ঝড়ে বেরিয়ে ‘ধুলো খাওয়া’ বোধহয় তত ইচ্ছাকৃত নয়।

মুখে বা অঙ্গে গ্রহণ না হোক, অভিজ্ঞতায় গ্রহণ অর্থও তৈরি হয় কিছু বাস্তব ঘটনা, ফুটবল বা হকি খেলায় ‘গোল খাওয়া’, তাস বা অন্যান্য খেলায় ‘পয়েন্ট খাওয়া’, গাড়ি চালাতে বা পার্কিং করতে গিয়ে ‘কেস খাওয়া’।

‘অঙ্গে গ্রহণ’ নয়, কোনো অর্থেই বাস্তব কোনো খাওয়া নয়, কিন্তু এক ধরনের অভিজ্ঞতায় গ্রহণ তো বটেই, সেখানে খাওয়ার অর্থ রূপক বা মেটাফরের আশ্রয় নেয় – ‘কচু খাওয়া’, ‘(কাঁচ) কলা খাওয়া’, ‘গোল্লা খাওয়া’, ‘ঘোল খাওয়া’ (আহা, ‘দই খাওয়ার’ সঙ্গে তার কত তফাত!), ‘টাইট খাওয়া’, ‘মাটি খাওয়া’ – যেমন মাটিখেকো কাজ, ‘থতমত খাওয়া’, ‘ল্যাং খাওয়া’, ‘হুড়কো খাওয়া’, ‘বাঁশ খাওয়া’, ‘প্যাঁক খাওয়া’, ‘গু খাওয়া’, ‘নিজের থুথু নিজে চেটে তোলা’ – এগুলো সব আত্মমুখী কাজ, যাতে কেউ নিজের অভিজ্ঞতার সঞ্চয় বাড়ায়। কিন্তু ‘চুকলি খাওয়া’, ‘মাথা খাওয়া’, ‘মাথা চিবোনো’র লক্ষ্য অন্যরা, অন্যে তার ফলভাগী হয়। ‘কানমলা খাওয়া’র বাস্তব আর রূপক দু-রকম অর্থই বাংলা ভাষায় আছে। ‘স্যারের কাছে কানমলা খেয়েছিস তো!’ ‘তোর জন্যেই আমাকে পাঁচজনের সামনে কানমলা খেতে (= অপমানিত হতে) হলো।’ তবে এ-ধরনের সব খাওয়া নেতিবাচক নয় – ‘ফুলে ফুলে মধু খাওয়া’ বা ‘কারো নুন খাওয়া’ যেমন। একই ক্রিয়াপদের সাধারণ বাস্তব আর রূপক অর্থও তৈরি হয়ে যায় – ‘ভোটাররা মার খেয়েছে’ আর ‘ব্যবসা মার খেয়েছে’। এই রকম ‘চোট খাওয়া’, ‘হোঁচট খাওয়া’ ইত্যাদি অনেক ক্রিয়ার রূপক অর্থ তৈরি হয়ে যায়। কখনো যা খাওয়া হয় শুধু সেটাই যে খাওয়া হয় তা বোঝায় না। আমরা যখন কাউকে বলি ‘ভাত খেয়ে এসেছ?’ তখন সে শুধু ভাত খেয়ে এসেছে বা আসেনি তা বোঝাই না। তেমনই পূজারি বামুনরা বা বিধবারা যে ‘ফলার’ (ফল+আহার) করেন তাতে শুধু ফল থাকে না, লুচি ইত্যাদিও থাকে।

আমাদের গুরু সুকুমার রায় বাঙালির খাওয়ার (‘যত কিছু খাওয়া লেখে বাঙালির ভাষাতে’) যে-তালিকা দিয়েছেন আমার তার বাইরে যাওয়ার খুব একটা সাধ্য আছে তা নয়। তাঁকে ছন্দের মিলের জন্য কিছুটা এলোমেলো তালিকা করতে হয়েছে, কিন্তু আমি তো তালিকা করব না, আমি ‘খাওয়া’ কথাটার বিচিত্র অর্থের খেলা দেখাব। অবশ্য শুধু খাওয়াতে আটকে থাকব না, ‘কামড়ানো’, ‘গেলা’, ‘চিবোনো’, ‘হজম করা’ সেসব নিয়েও দু-চার কথা বলব, তার পরের প্রক্রিয়া পর্যন্ত নাও যদি গেলাম। ধরুন আরেকটা খাওয়া হচ্ছে শারীরিক আচরণ – এটাও ইচ্ছাকৃত, যেমন ‘ডিগবাজি খাওয়া’, ‘চক্কর খাওয়া’ (ইচ্ছাকৃত নাও হতে পারে সবসময়), তুলনীয় ‘পাক খাওয়া’। কিন্তু ‘চক্কর দেওয়া’, ‘পাক দেওয়া’ ইচ্ছাকৃত, তবে কলুর বলদের পক্ষে ইচ্ছাকৃত নয় সম্ভবত।

যাকে থিসরাস বলে, সেসব বইয়ে ‘খাওয়া’র নিছক খাওয়ার, ‘মুখে ঢুকিয়ে পেটে চালান করার’ কিছু প্রতিশব্দ পাবেন। আহার করা, ভোজন করা, খাদ্য গ্রহণ হলো একটা স্তরের, যা সম্ভ্রান্ত বা আরো ওপরের ভদ্রলোকেরা বা ভদ্রনারীরা করে। ভক্ষণ বোধ হয় সবাই করে। উদরসাৎ, ক্ষুন্নিখুনিও করে। আরো কত কিছু করে, তার জন্যে বন্ধুবর অশোক মুখোপাধ্যায়ের সমার্থশব্দকোষ দেখুন। আমরা মধ্যবিত্তরা ‘খাই’, ‘মুখে দিই’, ‘দাঁতে কুটো কাটি’, ‘ডান হাতের কাজ’ সারি, সেটাই আবার ‘দক্ষিণ হস্তের কাজ’ হয়ে যায় সমাজের উঁচুস্তরে। আর ‘পেটে কিছু পড়ে’, কখনো খাবারের ওপর ‘হামলে পড়ি’, কখনো দীর্ঘদিন ধরে ‘অন্ন ধ্বংস’ করি কারো। খাবার প্রস্ত্তত হলে আসন পাতা হয়, টেবিল সাজানো হয়, নেমন্তন্ন বাড়িতে ব্যাচ বসে যায়। কারো বাড়িতে কারো ‘পাত পাতা’ থাকে, কোথাও দৈনিক ‘পাতা পড়ে’। এটা নিয়ে একটা গল্প নিশ্চয় আপনারা শুনেছেন। সাহেবের ঘোড়ার দানা চুরি করেছিল এক বাঙালি কর্মচারী। সাহেব ধরতেই, সে কাকুতি-মিনতি শুরু করে তার উনিশ শতকের ইংরেজিতে, ‘পিস্নজ ফরগিভ স্যার, পুয়োর ক্লার্ক, ডেইলি টুয়েন্টি লিভ্স ফল ইন মাই হাউস, হাউ ম্যানেজ!’

৩. মানুষ না হোক, অন্যদের খাওয়া

মানুষের এত রকম খাওয়া তো হলো, এতেও যদি পাঠকের খিদে না মিটে থাকে তবে, যারা মানুষ নয়, এমনকি যারা প্রাণীও নয়, তাদের খাওয়ার কথা শুনবেন। তাদের মুখ না থাকলেও বাংলা ভাষা তাদের খাওয়া থেকে বঞ্চিত করেনি। দেখুন, আকাশে ঘুড়ি ‘গোঁত্তা খায়’, ঘটি, স্যুটকেস, গাড়ি ‘টোল খায়’, গাড়ি বা তার চাকা আবার ‘টাল খায়’, ছবি, দেয়াল ‘রং খায়’, পেস্নন ‘চক্কর খায়’, ইঞ্জিন আর মেশিন ‘তেল খায়’। জিরক্স মেশিন প্রায়ই ‘কাগজ খায়’, পুরনো রেলের ইঞ্জিন ‘কয়লা খায়’। আমেরিকার অনেক বড় গাড়ি চালাতে বেশি বেশি তেল লাগে বলে সেগুলোকে বলে guzzlers। ভূতেরা পি– খায় বলে বিশ্বাস, তাই তারাশঙ্করের বিখ্যাত ‘অগ্রদানী’ গল্পের সেই বিখ্যাত সংলাপ, জ্যান্ত মানুষকে লক্ষ করেই – ‘খাও হে চক্রবর্তী’। গাছপালাকে রোদ খাওয়ানো হয়, মা-মাসিদের দেওয়া আচার-বড়ি – এসবকেও। গ্রামে গোরু অর্থাৎ গাভীকে ‘পাল খাওয়ানো’ হয়। আরেক দলে পাই গালাগাল – কেউ কিছু, আক্ষরিক অর্থে না হলেও খেয়েছে, অর্থাৎ ঠিকমতো ব্যবহার করেনি বলে নিন্দা – চোখখাকি, গতরখাকি। আক্ষরিক অর্থে গালাগাল বা অবজ্ঞাসূচক কথা পাই ‘গোরুখোর’, ‘চুকলিখোর’, ‘হারামখোর’, ‘চশমখোর’ – তা চোখখেকোর ফারসি সংস্করণ।

৪. খাওয়ার আশেপাশে

খাওয়া থেকে চারটি বিশেষণ হয়, ‘খাইয়ে’, ‘খেকো’, তার স্ত্রীলিঙ্গ ‘খাকি’, আর একটি বিশেষণ ‘খোর’। প্রথমটি একা বিশেষণ হিসেবে বসতে পারে, ‘ভুবনবাবু খুব খাইয়ে লোক’; কিন্তু বাকি তিনটি সমাসে পরপদ হিসেবে বসে – বাঙালিরা ‘মাছখেকো’, হিন্দিভাষী ভাইদের কাছে ‘মছলিখোর’, সাহেবরা ‘গোরুখেকো’, ফরাসিরা ‘ব্যাঙখেকো’, চীনারা ‘আরশোলাখেকো’। আর কত লোক যে ‘চোখখেকো’, ‘চোখখাকি’ তা কে জানে? তেমনই ‘নেশাখোর’, ‘গুলিখোর’, ‘ছাতুখোর’, ‘গাঁজাখোর’, ‘ঘুষখোর’, ‘সুদখোর’ ইত্যাদির সংখ্যাও কি কম! কোনোটিই খুব প্রশংসা বহন করে না। হিন্দিভাষীরা ‘খাউয়া’ বলে একটা বিশেষণ ব্যবহার করে – ‘ধোতি ঢিলিঢালি, ভাত-খাউয়া বঙ্গালি’। হিন্দি থেকে আমরা ‘খানেওয়ালা’ কথাটা ধার করছি, এটাও চলছে। এটায় তত অবজ্ঞা নেই। কিন্তু ব্যঙ্গে ব্যবহার হতেই পারে।

বাগ্ধারা প্রবাদেও খাওয়ার গুরুত্ব কম নয়। মাথা খাওয়া, মাথা চিবিয়ে খাওয়া আমরা আগেই দেখেছি। পরের মুখে ঝালও অনেকেই খাই, আবার নিজের কোলে যে ঝোল টানি সেটা তো খাওয়ারই জন্য। খাই খাই করা তো লোকের স্বভাব, বিশেষ করে নিরুপায় গরিব লোকদের। কিন্তু বইমেলায় বা হোটেল-রেসেত্মারাঁয় বড়লোকদের খাই খাইও তো কম দেখি না। ‘খাঁই’ কথাটা খাওয়ার সঙ্গেই যুক্ত, কিন্তু তাতে একটা চন্দ্রবিন্দু এলো কেন জানি না। তবে বাড়িতে আমরা অনেকে খাওয়ার সময় শাক দিয়ে মাছ ঢাকি, বা ভাজি উচ্ছে বলি পটোল। কেন বলি, কে জানে? এখন তো উচ্ছের দাম পটোলের চারগুণ। কেউ গাছেরটা খায়, তলারও কুড়ায়। কেউ আবার জীব দিয়েছেন যিনি আহার দেবেন তিনি বলে বসে থাকে। কারো পেট চলে না, কেউ আবার পেটরোগা। কেউ পায়ের ওপর পা রেখে খায়, কেউ পরের উচ্ছিষ্ট কুড়িয়ে খায়। কেউ চেয়েচিমেত্ম খায়, কেউ লুটেপুটে খায়। দিন আনে, দিন খায় এমন লোকই কি কম? পাগলাকে ভাত খেতে বললে সে জিজ্ঞেস করে ‘আঁচার কোথা?’ ‘কেউ মরে বিল ছেঁচে, কেউ খায় কই।’ ‘আগে গেলে নাকি বাঘে খায়, পিছে গেলে সোনা পায়।’ ছেলেমেয়েরা বলে ‘রাজা খায় ব্যাঙ ভাজা, রানি খায় পানি’ – তার সত্যমিথ্যা আমি জানি না। আবার শুনি ‘বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায়।’ স্বামীরা অনেক সময় স্ত্রীদের বা সন্তানেরা মায়েদের দুটো খেয়ে উদ্ধার করে। ঘাস খাওয়া কথাটা, তৃণভোজী প্রাণীদের কাছে আপত্তিকর মনে না হলেও মানুষের পক্ষে খুব সম্মানজনক নয়, তাই ‘ঘাস খায়’ বা ‘ঘাসে মুখ দিয়ে চলে’ বললে আমরা রাগ করা ছাড়া অন্য প্রতিক্রিয়া দেখাতে শিখিনি। ক্ষোভে আমরা যখন হাত-পা কামড়াই – সে কী রকমের খাওয়া? বিদেশ যাত্রা, অসবর্ণ বিবাহ ইত্যাদি খারাপ কাজ করলে একসময় গ্রামে গোবর খেয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হতো। শুধু গোবর খাওয়া নয়, সেই গোবর জিভের ওপর রেখে তাতে ধান বোনা হতো, ধানের অঙ্কুর বেরোলে তবে মুক্তি, প্রায়শ্চিত্ত সম্পূর্ণ হতো। থালার ওপর রাগ করে মাটিতে ভাত কেউ খায় কি না জানি না। যে-বাড়িতে বসে বসে খায় তার ওপর কেউ খুব একটা খুশি থাকে না। কেউ ‘আর-একবার সাধিলেই’ খায়, কেউ অনুরোধ করে, ‘নিজের বাড়ি মনে করে খান।’ উপোস করা, অনশন করা, প্রায়োপবেশন করা, হরিমটর করা, পেটে গামছা বেঁধে বা কিল মেরে পড়ে থাকা, ভাতের ওপর রাগ করা – এগুলো সব খাদ্যবিরোধী নানা অপকর্ম, তবে আজকাল চকোলেট খেয়ে অনশনও চালু হয়েছে শুনেছি। খিদে পেলে ছেলেমেয়েরা মুখ শুকনো করে ঘুরে বেড়ায়, সে মায়ের কাছে এক দুঃসহ দৃশ্য। কারো কারো ‘ভোখছানি’ লাগে, খিদেয় পেট পিঠের সঙ্গে লেগে যায়। খিদেয় মাথাও ঘোরে কত লোকের। অপমান আমরা হজম করি বা করি না, কিন্তু তা যে হজমের আগে খেতে হয় তা নিয়ে ভাষা চুপচাপ। পেটে খিদে, মুখে লাজ কোনো কাজের কথা নয়। সবার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।

খাওয়ার পরে ঘুম একটা অবশ্যকর্তব্য, এজন্য কেউ কেউ বলে, কাজের মধ্যে দুই, খাই আর শুই। কিন্তু যশোরের লোকদের অনেকে নাকি দুঃখ করতেন, ‘নাতি খাতি বেলা গেল হুতি পারলাম না।’ গরিবের মুখের কথাও আমরা খাই, নইলে তা বাসি হলে মিষ্টি লাগবে কেন? গাধায় জল খায় ঘুলিয়ে, পূর্ববঙ্গের মানুষ এ-রকম বলেন। খাওয়া যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তাও পূর্ববঙ্গের এই গৃহবধূর কথা থেকে বুঝতে পারি, ‘খাইয়া-দাইয়া মনে পড়ছে ননাইসের মায় মরছে।’ অর্থাৎ ননদের মা অর্থাৎ তার শাশুড়ি মারা গেছে তা তার খাওয়া শেষ করার পরেই মনে পড়েছে। আরো একজন নদীতে চানটান করে ফিরে এসে খাওয়া সারার পর বলছে, ‘ভালো কথা মনে পড়ল আসাইতে আসাইতে, ঠাকুরজিকে লইয়া গ্যাসে নাচাইতে নাচাইতে।’ আঁচাতে আঁচাতে তার মনে পড়েছে যে তার ননদকে চানের সময় কুমিরে নিয়ে গেছে। পূর্ববঙ্গের কথায় মনে পড়ল, সেখানে বাঘে শুধু মানুষ খায় না, ‘দিন’ বা ‘সময়’ বা স্মৃতিকেও বাঘে খেয়ে ফেলে। কেউ অতীতের সুখস্মৃতি নিয়ে ঘ্যানঘ্যান শুরু করলে বিরক্ত হয়ে আরেকজন বলতেই পারে, ‘হ্যা হব দিন বাঘে খাইয়া ফালাইসে’ (সে সব দিন বাঘে খেয়ে ফেলেছে)। বাংলাদেশে গেলে ওঁরা নেমন্তন্ন করে খুব কুণ্ঠিতভাবে বলেন, ‘অহন ত কিছুই পাওয়া যায় না, কী খাওয়ামু আপনেগো?’ বলে টেবিলের ওপর পাঁচ রকমের মাছ, তিন রকমের মাংস, চার রকমের সবজি, তিন রকমের ভাজা, চার রকমের ভর্তা, আর তিন রকমের মিষ্টি, দই আর শক্ত আর নরম পানীয় তুলে দেন। সে তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে নাকি আমরা বলি – ১. আপনি কি খেয়ে এসেছেন? না, বাড়ি গিয়ে খাবেন? ২. পেস্নটে একটা সন্দেশ সাজিয়ে বলি, ‘পুরোটা খেতে হবে কিন্তু!’

খাই তো, কিন্তু খেয়ে আমরা কী করি? খেয়ে আমাদের উদগার হয়, অম্বল বা অজীর্ণ হয়। আবার আমরা খেয়ে সব উড়িয়ে দিই, খেয়ে ভাঁড়ার ফাঁক করে দিই। খেয়ে মোটা হই, নেয়াপাতি ভুঁড়ি গজাই। খেয়ে গেরস্তকে ধন্য ধন্য করি, না হয় নিন্দে করি।

আমরা খাই কত রকমভাবে, ক্রিয়ার ক্রিয়াবিশেষণগুলো একবার দেখি তো? কেউ রসিয়ে রসিয়ে আয়েস করে খাই, কেউ মুখে দুটো গুঁজে অফিসের বাস ধরতে ছুটি, কেউ গবগব করে খাই, কেউ কুট কুট বা কুটুর কুটুর করে খাই। কেউ ফেলে-ছড়িয়ে খাই, কেউ খুঁটে খুঁটে বা গুছিয়ে জম্পেশ করে, চেটেপুটে খাই। কেউ দৃষ্টিভোজন করি, কেউ ঘ্রাণে – সেটা নাকি অর্ধভোজন। প্রাণীদের খাওয়া কত রকম। গোরু-মোষ চবর চবর করে জাবনা খায়, বেড়াল চুকচুক করে দুধ খায়। ইঁদুর আর কাঠবিড়ালি কুটুর কুটুর করে বাদামটাদাম খায়। ছারপোকা যে কুটুস করে কামড় দেয়, সেও তো এক রকমের খাওয়া। কী খাচ্ছি তারও ওপরে আওয়াজ তৈরি হয়। তরল পদার্থ ঢকঢক করে খাই, আবার ঢুকঢুক বা ঢুকুস ঢুকুস করে খাই। চোঁ চোঁ করেও খাই। একটু শক্ত, ভঙ্গুর জিনিস খাই খচমচ বা খচরমচর করে। চা খাই সুলুপ সুলুপ করে বা সুড়ুত সুড়ুত করে, যদিও সাহেবরা বলে, খবরদার চা খাওয়ার সময় শব্দ করা অসভ্যতা। শুনেছি প্রয়াত তুষারকামিত্ম ঘোষকে বিলেতে একজন সাহেব তাঁর চা খাওয়ার শব্দ নিয়ে ঠাট্টা করায় তিনি বলেছিলেন, ‘শোনো বাছাধনরা, তোমাদের বাপের জন্মে তোমাদের দেশে চা ছিল না, তোমরা খাচ্ছ আমাদের দেশের চা, আবার আমাদেরই চা খাওয়া শেখাচ্ছ!’

তবে বিলেত-আমেরিকার আরেকটা সাংস্কৃতিক ঘটনা দিয়ে শেষ করি, নইলে বাঙালিদের কাছে মান থাকে না। সেখানে বিকেলের দিকে কারো বাড়িতে বেড়াতে গেলে গল্পসল্পের পর গেরস্ত যদি মনে মনে ভাবে, ‘আরে, অনেক তো আড্ডা হলো, এবার এরা উঠে পড়ছে না কেন?’ তারা হাই তোলে, ঘড়ি দেখে। তাতেও যদি অভ্যাগতরা ওঠার উদ্যম না দেখায় তখন তারা বলে, ‘দেরি যখন হয়েইছে, আমাদের সঙ্গে ডিনার করে যান আজ।’ শুনে অতিথিদের পড়িমরি করে উঠে পড়তেই হয়। যারা তা না করে থেকে যায়, গেরস্তরা তাদের মু-ুপাত করতে থাকে। সেটা এক ধরনের মাথা খাওয়া কি না জানি না।

৫. একটু দেওয়ার কথা

কথায় বলে খাওয়া-দাওয়া। দাওয়া মানে ‘দেওয়া’ – খাবার-দাবারেও ওই সূত্রটা আছে। বেশিরভাগ খাবার কেউ কেউ দেয়, না দিলে আমরা খেতে পারি না। এমনকি আমরা যে গোল খাই, বকুনি খাই, ঝাড় খাই, বাঁশ খাই, প্যাঁক খাই – সেও কাউকে না কাউকে দিতে হয়। সত্যিকার বাস্তব খাবার কীভাবে দিতে বা পরিবেশন করতে হবে তা নিয়ে বিদ্যাসাগর মশাই, যিনি নিজে খুব পাকা রাঁধুনি ছিলেন, একটা সংস্কৃত শেস্নাক বলতেন, স্বরচিত বোধহয় –

হাঁ হাঁ দেয়ং, হুঁ হুঁ দেয়ং, দেয়ঞ্চ করকম্পনে।

শিরসি চালনে দেয়ং, ন দেয়ং ব্যাঘ্রঝম্পনে \

অর্থাৎ যে খাচ্ছে সে ‘হাঁ-হাঁ করে উঠলে দেবে, ‘হুঁ-হুঁ’ করলেও দেবে, হাত নাড়লে দেবে, মাথা নাড়লে দেবে। তবে বাঘের মতো পাতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে আর দেবে না। সব খাবার অবশ্য ‘দিতে’ হয় না, যেমন বা যা দেওয়া হয় সব খাবার নয়। সেটা আপনারা জানেন। লোকে ঠেলা বা ধাক্কা দেয় বলে আমরা ঠেলা বা ধাক্কা খাই, কিন্তু চোখের মাথা আমাদের কেউ দেয় না, তবু আমরা তা খাই। তেমনই লোকে আমাদের দক্ষিণা বা দেখলে হাসি দেয়, কিন্তু আমরা সে অর্থে দক্ষিণা খাই না, হাসিও খাই না। পেলেও খাই, যেমন বিনে পয়সায় সাপের বিষ, না-পেলেও খাই, যেমন কসম। কে যেন একজন বলেছিল, ‘রোজ দুবেলা আমি দু-খানা দু-খানা করে চারখানা সন্দেশ খাই। পেলেও খাই, না পেলেও খাই।’ শুনে শ্রোতা একটু সমস্যায় পড়ে বলল, ‘পেলে খান, সেটা বুঝলাম, কিন্তু না পেলে খান কী রকম?’ বক্তা উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে বললেন, ‘কী করব ভাই, অভ্যেস!’ যাক অনেক ‘খাওয়া’ হলো, হয়তো সব ‘খাওয়া’ শেষ হলো না। খান, ভালোবেসে খান, নিজে খান, অন্যকে খাওয়ান। কিন্তু খেয়োখেয়ি করবেন না।