‘কিন্তু তুমি নিজে চলো না, অন্যকে চালাতে বাধ্য করো। এটাই তো বিড়ম্বনা। অথচ জগৎসংসার তোমাকেই তপস্বী আর সাধক বলবে, আমার পিতাকে দানশীল বলবে, আর আমাকে? চঞ্চলমতি এক নারী, যাকে বিশ্বাস পর্যন্ত করা যায় না। এই তো…’; চরম বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যযাতি কন্যা মাধবী এমন বাক্য উচ্চারণ করে। মাধবী যাকে নিজের চেয়ে বেশি ভালোবেসেছিলো সেই গালব যখন ধর্ম আর কর্তব্যের অজুহাত তুলে প্রকৃত মাধবীকে প্রত্যাখ্যান করবার জন্যে নানা ছলচাতুরির আশ্রয় নিচ্ছিল, তার জবাবে মাধবীর সেই সংলাপে বর্তমান নারীর অস্তিত্বেরও সংকট প্রকাশ পায় পুরাণের উৎসমূলে। মাধবী কখনো আলাদা কোনো মানবী হতে পারে, তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার আলাদা কোনো মূল্য থাকতে পারে-এ কথা পুরুষ কখনো মানতেই চায় না। সে হয় কারো কন্যা, নয় কারো জায়া। এর ঊর্ধ্বে তার নিজস্ব কোনো অবস্থান হতে পারে এমন কথা পুরাণ থেকে বর্তমান পর্যন্ত কোনো কালেরই পুরুষ মেনে নিতে চায় না। থিয়েটারের সাম্প্রতিক প্রযোজনা রামেন্দু মজুমদার নির্দেশিত ‘মাধবী’ নাটকের সফল মঞ্চায়ন আমাদেরকে আবার স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের সমাজে, পরিবারে নারীর অবমানিত অবয়বটির কথাই।
মহাভারতের উদ্যোগ পর্বে উল্লিখিত একটি উপদেশমূলক কাহিনী থেকে ভীষম (নাকি ভীষ্ম) সাহানীর রচনা ও আশীষ গোস্বামীর অনুবাদে থিয়েটার মঞ্চে নিয়ে আসে ‘মাধবী’। আর ‘মাধবী’র মাধ্যমে দীর্ঘদিন পরে নির্দেশক হিসেবে মঞ্চে প্রত্যাবর্তন করলেন যশস্বী নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার। আর, প্রযোজনাটি দিয়ে থিয়েটার নাট্যগোষ্ঠীও প্রমাণ রাখলো নাট্যভাবনায় তাদের নতুন চিন্তা-ভাবনার। ঋষি বিশ্বামিত্র তার শিষ্য গালবের দর্পচূর্ণ করবার জন্য শিক্ষাসমাপক গুরুদক্ষিণা হিসেবে দাবি করলেন আটশ অশ্বমেধ ঘোড়া। এই কঠিন গুরুদক্ষিণা সংগ্রহে ব্যর্থ হয়ে গালব দানশীল যযাতির শরণাপন্ন হলো। যযাতি তখন রাজ্যপাট ত্যাগ করে আশ্রমবাসী। তার পক্ষে গালবের গুরুদক্ষিণা সংগ্রহে সাহায্য করা সম্ভব নয়। আবার গালবের বক্র বাক্যবানে বিদ্ধ যযাতি দানশীল হিসেবে নিজের যশ-খ্যাতির বিন্দুমাত্র দুর্নাম হোক তা-ও চান না। দানশীল মহারাজা হরিশ্চন্দ্র কিংবা দাতা কর্ণ থেকে তিনি যে কম না, তা প্রমাণ করবার জন্যে তিনি তার গুণবতী কন্যা মাধবীকেই দান করলেন গালবের হাতে। বিশেষ বরপ্রাপ্ত মাধবী চক্রবর্তী রাজার জন্ম দিতে পারবে এবং ইচ্ছে করলেই আবার সৌন্দর্য-কৌমার্যে ফিরে পেতে পারবে। অতএব যে কোনো রাজাই মাধবীকে গ্রহণ করে বিনিময়ে আটশ অশ্বমেধ ঘোড়া দেবে গালবকে।
পিতার সম্মান, পিতার যশ – এসবের কারণে আজো বলি হচ্ছে সুস্থ-স্বাভাবিক নারীর মন। কন্যাকে পিতার কথা মেনে নিতে হবে। এর অন্যথা হওয়া চলবে না। আবার পিতার কন্যাই এক সময়ে হয়ে ওঠে কারো প্রণয়িনী বা পরিণীতা। তখনো তার একই অবস্থা। সে কখনোই মুক্ত-স্বাধীন নয়।
পিতার দানে মাধবী গালবের সাথে চলে যায়। মাধবী গালবকে ভালোবাসে। ভালোবাসে নিজের চেয়েও বেশি। গালবও ভালোবাসে মাধবীকে। কতখানি? আটশ অশ্বমেধ ঘোড়া সংগ্রহের জন্যে যতটুকু প্রয়োজন হয় ভালোবাসার, ততটুকু। গুরুদক্ষিণা প্রদানের যে সংকল্প গালবের তাতে তার পৌরুষ নেই, আছে কেবলই দম্ভ, যা কর্তব্যের ছদ্ম-আবরণে পুরুষতান্ত্রিকতা। আর এ পুরুষতান্ত্রিকতার কাছে মাধবী একের পর এক বলি দেয় নিজের মন, নিজের কৌমার্য, নিজের সৌন্দর্য। গালবের আটশ ঘোড়ার মধ্যে ছয়শ ঘোড়া সংগ্রহের জন্য মাধবী তিন রাজাকে দান করেছেন নিজের যৌবন, সৌন্দর্য ও সন্তান। বাকি আর দু’শ অশ্বমেধ ঘোড়া পাওয়ার কোনো উৎসই যখন নেই তখন মাধবী গালব-গুরু বিশ্বামিত্রকে প্রস্তাব দিলো তাকে গ্রহণ করবার জন্যে। গালব গুরুঋণমুক্ত হতে পেরেছিলো যে মাধবীর জন্যে, ঋণমুক্তির পর গালব সেই মাধবীকেই চিনতে পারে না। এই মাধবীকে আর দরকার নেই গালবের। মাধবীকে সে গ্রহণ করতে পারে যদি মাধবী আবার অনুষ্ঠান করে নিজের সৌন্দর্য আর কৌমার্য ফিরিয়ে আনে। পুরুষের ইচ্ছে অনুযায়ীই যেন নারীকে সবকিছু করতে হবে। মাধবী অবশ্য গালবকে প্রত্যাখ্যান করে।
ইতিহাসের এই চাকাটি আজো সমান গতিতে চলছে আমাদের সমাজে। কখনো কখনো হয়তো মাধবীরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, প্রত্যাখ্যান করে; কিন্তু প্রত্যাখ্যান করার পরে কী হবে মাধবীদের? আবার কোনো পুরুষের কাছেই তাকে ধরা দিতে হবে। কারণ পুরুষের হাত অনেক বড়। মাধবীদের সমস্ত গুণ-গৌরব ভোগ করে পুরুষ নিজেকে করে আরো শক্তিশালী। ভীষম সাহানীর এ নাটক সর্বকালের নারীর প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে। পুরাণে, ধর্মে, সমাজে, সংসারে কোথাও নারীর প্রকৃত মূল্যায়ন নেই। যোগ্য মূল্যায়নের কথা ভাবাও যেন নিষেধ। নারীর করুণ অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন হুমায়ুন আজাদ তার ‘নারী’ গ্রন্থে। দেশ নাটকের ‘প্রকৃতি ও পুরাণ’ শীর্ষক নাট্যোৎসবে ২৭ ফেব্রুয়ারি পাবলিক লাইব্রেরিতে যখন ‘মাধবী’ নাটকের প্রদর্শনী সমাপ্ত, তখন বাংলা একাডেমীর বাইরে হুমায়ুন আজাদ সন্ত্রাসীদের দ্বারা আক্রান্ত। ‘মাধবী’ নাটকের সাথে হুমায়ুন আজাদের আক্রান্ত হবার কোনো যোগসূত্র নেই। তবে যে ধর্ম ও কর্তব্যের কথা বলে গালব যেমন করে মাধবীকে বাধ্য করিয়েছিলো তার কৌমার্য জলাঞ্জলি দিতে; তেমনি হয়তো বা কেউ ধর্মের ও কর্তব্যের কথা বলেই হন্তারককে প্ররোচিত করেছিলো হুমায়ুন আজাদের প্রাণনাশে। (এ লেখা তৈরি হওয়া পর্যন্ত হুমায়ুন আজাদ মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন হাসপাতালে। আমরা তাঁর সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করি)।
‘মাধবী’ নাটকটি প্রযোজনা করায় থিয়েটার অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। বিষয়বস্তুতে যে গভীর দর্শন, যে ভাবনা, তার বিস্তার দর্শকদের মাঝে যতবেশি হবে ততই সফল হবে এ নাটক। প্রয়োগিক দিক থেকে নির্দেশক রামেন্দু মজুমদার বিষয়বস্তুর প্রতি ছিলেন অত্যন্ত মনোযোগী। পৌরাণিক কাহিনীর নাটক অনেক সময়ই পুরানো নাটক হয়ে পড়ে। সেদিক থেকে তিনি পুরাণের আবহে চিরকালীনকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। ‘মাধবী’ নাটকের মঞ্চ-পরিকল্পনায় মুস্তাফা মনোয়ার এবং তার সহযোগী কিরিটী রঞ্জন বিশ্বাস অসাধারণ সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। মঞ্চের ওপর থেকে কাপড় ঝুলিয়ে দিয়ে বনের যে আবহ তৈরি করেছেন তা নাটকের মেজাজকে সুচারুভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম। আলোক পরিকল্পনায়ও নাসিরুল হক খোকন মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। সাইক্লোরমায় নানা বর্ণের, নানা ডেনসিটির আলো ফেলে দর্শকদের নিয়ে গেছেন বিষয়বস্তুর অভ্যন্তরে। দেবজিত্ বন্দ্যোপাধ্যায় নাটকের গানের এক কিংবদন্তি পুরুষ। তার সংগীত পরিকল্পনায় ‘মাধবী’ নাটক প্রাণ পেয়েছে। পোশাক পরিকল্পনা করেছেন ফেরদৌসী মজুমদার। অভিনয় শিল্পী, বিশেষত পুরুষদের ধুতিতে অনেক বেশি সাদা ব্যবহার করা হয়েছে। ধবধবা সাদাটা অনেক সময় বেশি আক্রান্ত করে চোখকে। সেক্ষেত্রে আশ্রমের পুরুষরা আরেকটু ম্লান সাদা পরলে হয়তো আশ্রমবাসী চরিত্রগুলোর প্রতিও অবিচার করা হবে না।
এ নাটকে সকলেই মোটামুটি সাবলীল অভিনয় করেছেন। তবে দু-চারজনের কথা বিশেষভাবে না বললে তাদের প্রতি অবিচার করা হবে। ‘মাধবী’ নাটকের নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ত্রপা মজুমদার। ত্রপা যে-মাপের সংযমী এবং তীক্ষ্ম অভিনয়কলা প্রদর্শন করেছেন তা ঢাকার বর্তমান মঞ্চে তার প্রজন্মের অভিনয় শিল্পীদের মাঝে বিরল। অতি অভিনয় কিংবা দুর্বল অভিনয়ের বিন্দুমাত্র ছাপ নেই কোথাও। পুরাণের মাধবী যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে ত্রপার অভিনয়ে। কাশীর রাজা দিবোদাসের ভূমিকায় জগলুল আলম চমৎকার অভিনয় দেখিয়েছেন দর্শকদের। গালবরূপী মারুফ কবীর, মহারাজা হর্যশ্বরূপী সমর দেবও ভালো করেছেন। কথকের ভূমিকায় ফেরদৌসী মজুমদারের কাছে আমার ব্যক্তিগত প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। হয়তো শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি তার অভিনয় ক্ষমতার চূড়ান্ত প্রকাশ ঐদিন করতে পারেননি। এটা নাটকের কোনো দুর্বলতা নয় কিংবা ফেরদৌসী মজুমদারের দুর্বলতাও নয়। এটা সাময়িক ত্রুটি। সামগ্রিক বিবেচনায় ‘মাধবী’ এ সময়ের অত্যন্ত সফল একটি প্রযোজনা। এ প্রযোজনার সাফল্যের কৃতিত্বের মূল দাবিদার নিঃসন্দেহে এ নাটকের নির্দেশক রামেন্দু মজুমদার। নির্দেশক রামেন্দু মজুমদার যদি আরো বেশি করে নির্দেশনার কাজে মন দেন, তাহলে ভবিষ্যতে আমরা হয়তো আরো সুন্দর সুন্দর নাটক দেখতে পাবো। আমরা সে প্রত্যাশায় রইলাম।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.