॥ ২ ॥

রদিন সকালেই ডাকাতি হলো আমাদের ফ্ল্যাটে।

প্রতিদিন সকাল ঠিক সাতটার সময় উৎপল এসে দরজার বেল দেয়। আমি কিংবা স্বাতী যে কোনো একজন উঠে গিয়ে খুলে দিয়ে আসি দরজা। আসলে বেল শোনার পরই স্বাতীর সঙ্গে আমার চোখাচোখি হয়। অর্থাৎ কে যাবে?

পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের কিছুটা অসুবিধে থাকে, রাত-পোশাকের ওপরেও মেয়েদের একটা কিছু জামা চাপাতে হয়, পুরুষরা খালি গায়েও দরজা পর্যন্ত যেতে পারে। তবু অধিকাংশ দিনই স্বাতীই আগে ওঠে, আগের রাতে বেশি পানাহার হলে আমি বেল না-শোনার ভান করি।

তবে পরপর দু’তিন দিন স্বাতী দরজা খুললে তার পরের দিন আমি স্বাতীকে কোনো সুযোগ না দিয়েই তড়াক করে নেমে পড়ি খাট থেকে। এরকম না করলে অন্য কোনো প্রসঙ্গে স্বার্থপরতার অভিযোগ ঘনীভূত হয়ে আসে।

উৎপল বেল দিতেই বুঝে যাই, সাতটা বাজে, ঘড়ির দিকে তাকাতে হয় না।

 সেদিন আমারই দরজা খোলার পালা।

খুলে দেখি, উৎপলের বদলে দাঁড়িয়ে আছে অন্য একটা ছেলে। হাতে একতাড়া কাগজ, সে বললো, নিউজ পেপার স্যার।

অন্যদিন কাগজগুলো দরজার বাইরে পড়ে থাকে কিংবা উৎপল নিয়ে আসে তলা থেকে। খবরের কাগজওয়ালাকে আমি কোনোদিন চোখেও দেখিনি।

তবু, ঘুম চোখে কোনো সন্দেহ হলো না। হাত বাড়িয়ে কাগজগুলো নিতে যেতেই সেই ছেলেটি আমাকে ঠেলে ঢুকে পড়লো ভেতরে। তার সঙ্গে আরও তিনজন। সবচেয়ে চোয়াড়ে চেহারার ছেলেটি আমার কপালে ফস করে একটা রিভলভার ঠেকিয়ে বললো, একেবারে টুঁ শব্দটা করবি না শালা!

চারজনেরই বয়েস চব্বিশ-পঁচিশের মধ্যে, প্যান্ট-শার্ট পরা, মুখ ঢাকারও দরকার মনে করেনি। এই বয়েসের ছেলেরা চট করে মানুষ খুন করে ফেলতে পারে, যেমন নিজেরাও তুচ্ছ কারণে প্রাণ দেয়।

আমাকে ঠেলতে ঠেলতে ভেতরে এনে রিভলভারধারী বললো, বেডরুম কোনটা?

এদের সঙ্গে কোনো রকম চালাকি করার সাধ আমার নেই। সিনেমার নায়কোচিত কায়দায় এক লাথি মেরে রিভলভারটা ফেলে দেওয়াও আমার পক্ষে সম্ভব নয়, অন্য দু’জনের হাতে ছুরি আছে।

এই সময় স্বাতী হঠাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

অথচ তার এত তাড়াতাড়ি শয্যা ত্যাগ করার কোনো কারণই নেই সেদিন।

 মেয়েদের অনুভূতি অনেক সূক্ষ্ম হয়। অন্যদিনের চেয়ে আলাদা কিছু একটা ব্যাপার হচ্ছে, সে টের পেয়েছিল ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ে।

রাত-পোশাকের ওপর শুধু একটা চাদর সে জড়িয়ে নিয়েছে, ডাকাতদের এক ছোকরা লাফিয়ে গিয়ে তার গলার কাছে চেপে ধরলো ছুরি।

স্বাতীকে ওরা মেরে ফেলবে, তা আমি ভাবিনি, বরং তখুনি আমার মনে হলো, স্বাতীকে নিশ্চয়ই এরা ধর্ষণ করবে। স্বামীকে বেঁধে রেখে তার সামনে স্ত্রীকে ধর্ষণ করতে এই ধরনের ডাকাতরা বিশেষ আনন্দ পায়।

স্বামী হিসেবে তা কি আমি সহ্য করবো? আমার পৌরুষের মর্যাদা তারপর আর এক বিন্দুও অবশিষ্ট থাকবে? আমাকে একটা কিছু করতেই হবে, এমনকি স্বাতীকে বিধবা হওয়ার ঝুঁকি নিয়েও!

আমি চেঁচিয়ে বললাম, স্বাতী, ওদের আলমারির চাবি দিয়ে দাও। যা নিতে চায় নিক। বাধা দিও না!

আজকাল কারুর বাড়িতেই বেশি ক্যাশ টাকা থাকে না। গয়না-টয়নাও থাকে ব্যাংকের লকারে। খুব দামি জিনিস বলতে দেওয়ালে ঝুলছে যামিনী রায়ের একটি আসল ছবি, আরও কয়েকজন নাম করা শিল্পীর ছবি। যেগুলোর দাম কয়েক লাখ, কিন্তু সেসব ছবির মর্ম কি ওরা বুঝবে?

সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে পড়লো, আমাদের বাড়িতে কালই আনোয়ারা রেখে গেছে একগাদা গয়না, তার দাম নিশ্চয়ই প্রচুর। পরের জিনিস! সেগুলো নিয়ে গেলে ফেরত দিতে হবে আমাদেরই! ডাকাতগুলো কি সে খবর আগে থেকে জেনে এসেছে?

স্বাতীর মুখেও ঠিক একই অলঙ্কার প্রতিফলন।

 ছোকরা চারটির চেয়ে আমার বয়েস দু’গুণেরও বেশি। তবু আমাকে তুই-তুকারি ও শালা এবং অন্যান্য গালাগাল দিতে তাদের বাধে না। অকারণেই তারা বেশি হম্বি-তম্বি করছে। আমি শুধু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি স্বাতীর দিকে। ভয়-ডর ছাপিয়ে চনমন করছে আমার বাঙাল রক্ত। যদি ওদের কেউ স্বাতীর গায়ে হাত দেয়, তা হলে আমি নিজে মরলেও ওদের একজনকে মারবোই! কী করে মারবো, তা অবশ্য জানি না।

ভেতরের ঘরে ঢোকার আগেই আবার দরজায় বেল বেজে উঠলো।

সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে উঠলো আমার বুক। আর আশঙ্কায় নয়, আশায়। উৎপল এসে গেছে। উৎপল বুদ্ধিমান ছেলে, ব্যাপারটা বুঝে নিয়েই নিশ্চয়ই দারোয়ান, লিফটম্যান, সিকিউরিটির লোকদের ডেকে জড়ো করবে, এই হঠকারী ডাকাত ছোকরাদের আর পালাবার উপায় থাকবে না।

দু’জন ডাকাত দরজার দু’পাশে আড়াল করে দাঁড়ালো। তারপর দরজাটা খুলে দিতে উৎপল ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তারা দু’জনে উৎপলের ঘাড় ধরে এক ঝটকায় ফেলে দিল মাটিতে। দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেল। এরকম আকস্মিকতায় উৎপল কোনো আওয়াজ করারও সুযোগ পেল না।

আর কোনো আশা নেই!….

আসলে, এরকম কিছুই ঘটেনি।

আমি আবার বলছি, এটা একটা ভোরবেলার আধো-জাগ্রত স্বপ্ন, আমাদের ফ্ল্যাটে সত্যিই কোনো ডাকাত আসেনি।

স্বপ্নটা ভাঙার পর ধড়মড় করে উঠে দেখি, মাত্র পৌনে ছ’টা বাজে। জানালার বাইরে এখনো পুরো দিনের আলো ফোটেনি। কাক ডাকছে। আর একটা চিল।

এরকম অতি নাটকীয় ঘটনা গল্প-উপন্যাসে হয়, আমাদের জীবনে ঘটে না। ডাকাতি অবশ্য অতি বাস্তব ব্যাপার, পৃথিবীতে কোথাও না কোথাও প্রতি পাঁচ মিনিটে একটি ডাকাতি সংঘটিত হচ্ছে। নানা ধরনের ডাকাতি। কোনোটা হিমালয় পর্বতের সমান, কোনোটা গরিবের ওপর বাটপাড়ি।

ফ্ল্যাট বাড়িগুলোতেও তো মাঝে মাঝে নানা ছলে ডাকাতি হয়, কাগজে পড়ি। আমাদের এ বাড়িটায় এ পর্যন্ত হয়নি। বস্তুত আমি এ পর্যন্ত কোনো ডাকাতকে চাক্ষুষ দেখিনি।

আজকাল তো শুনি ট্রেনে ডাকাতি করা প্রাইভেট টিউশনির উপার্জনের চেয়েও অনেক কম পরিশ্রমের এবং নিরাপদ। গুটিকয়েক দেশে দু’একটা সস্তা বন্দুক-পিস্তল যোগাড় করতে পারলেই টুকটাক ট্রেনে ডাকাতি করতে পারে। কেউ বাধা দেয় না, মন্দ রোজগার হয় না। কোনো ডাকাতদল ধরাও পড়ে না। আমি কত ট্রেনে ঘোরাঘুরি করি, কখনো আমার কামরায় কোনো ডাকাত ওঠে না।

এমনকি বিমান হাইজ্যাকিংও তো অহরহ ঘটে। সারা জীবনে কতবার প্লেনে উঠেছি, খুব শখ একবার একটা প্লেন হাইজ্যাকিং দেখি। সে সৌভাগ্য আমার আজও হলো না!

এটা একটা অতি বাজে স্বপ্ন! ঢক ঢক করে অনেকটা জল খেলাম। হিসি করে এসে আরও এক ঘণ্টা ঘুমিয়ে নেওয়া যায়।

কিন্তু আর ঘুম এলো না। স্বাতী বেশ নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে, এই গরমের মধ্যেও ও একটা চাদর চাপা দেয়।

মিতু অতগুলো গয়না রেখে গেছে। সেই দুশ্চিন্তা থেকেই অবচেতনে এই স্বপ্নটা তৈরি হয়েছে। গয়না নিয়ে আমি এত মাথা ঘামাচ্ছি কেন? আমি একজন লেখক মানুষ, অনেকে কবি হিসেবেও জানে। আমার পক্ষে তুচ্ছ গয়না-গাঁটি নিয়ে চিন্তা করা কি মানায়? অবচেতনের সঙ্গে লড়াই করাও তো যায় না।

আরও একটা ব্যাপার নিয়ে আত্মবিশ্লেষণ শুরু হলো। ঐ যে আমি স্বপ্নের মধ্যে বীরপুরুষ সাজবার চেষ্টা করে ভাবলাম, স্বাতীর গায়ে কেউ হাত দিলে কিছুতেই সহ্য করবো না। তাকে শেষ করে ফেলবো- বাস্তবে সেরকম কোনো পরিস্থিতি এলে সত্যিই কি তা-ই করতাম, না নিজের প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করতাম আগে? ভাগ্যিস বাস্তবে এরকম কোনো পরিস্থিতিতে পড়িনি, তাই পরীক্ষাও দিতে হয়নি।

সাতটার সময় বেলের টুংটাং হতেই স্বাতী চোখ মেলে তাকালো। আমি তাড়াতাড়ি বললাম, আমি যাচ্ছি, তুমি শুয়ে থাকো।

অন্যদিন বিনা-দ্বিধায় দরজা খুলে দিই। আজ একবার ম্যাজিক আই দিয়ে দেখে নিলাম বাইরে। উৎপল এসেছে কাগজের বান্ডিল নিয়ে।

অন্য দিনেরই মতো আর একটি স্বাভাবিক দিনের শুরু।

স্বপ্নটা দেখায় একটা লাভ হলো এই, মনে মনে ঠিক করে নিলাম, মিতুর গয়না সম্পর্কে একটা কথাও বলবো না স্বাতীকে। আমার অন্য অনেক চিন্তা আছে।

আজকের সব কাগজেই একটা ফ্ল্যাট বাড়ির ডাকাতি ও একটি ট্রেন ডাকাতির ঘটনা ফলাও করে ছাপা হয়েছে প্রথম পৃষ্ঠায়। তাত্ত্বিকভাবে বুঝি, এসবই হচ্ছে রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে বঞ্চিত মানুষদের প্রত্যাঘাত। তবে, নিজের গায়ে দু’একটা খোলামকুচি লাগলে তত্ত্ব-ফত্ত্ব সব হাওয়া হয়ে যায়।

দিনের প্রথম টেলিফোনটি পেয়েই চমকে উঠলাম। মুর্শিদাবাদের একটা বইমেলার উদ্বোধনে আমার নাকি যাবার কথা, উদ্যোক্তারা গাড়ি নিয়ে আসছে আধঘণ্টার মধ্যে।

এই রে, মুর্শিদাবাদে যাবার কথা দিলাম কবে? আজ তো দুপুর তিনটেয় সাহিত্য একাদেমির মিটিং। সন্ধেবেলা রশীদদের বাড়িতে নেমন্তন্ন। গাড়িতে মুর্শিদাবাদ এখন রওনা হলে কালকের আগে ফেরা যাবে না!

আমি টেলিফোনে বলার চেষ্টা করলাম, আজ তো ভাই আমার পক্ষে মুর্শিদাবাদ যাওয়া একেবারেই সম্ভব নয়। আসলে আগে ভালো করে জানাওনি।

চায়ের কাপ মুখের সামনে ধরে স্বাতী স্থির চোখে চেয়ে আছে আমার দিকে। দু’চোখ ভর্তি ভর্ৎসন।

খানিকক্ষণ বাক-বিসংবাদের পর ফোন ছেড়ে দিতে হলো। কোনো রকম ছাড়াছাড়ি নেই, উদ্যোক্তারা আসবেই।

স্বাতী ঠান্ডা গলায় বললো, গত রবিবার মুর্শিদাবাদ থেকে তিন-চারজন এসেছিল তোমার মনে নেই? তোমার নামে ছাপানো কার্ডও দিয়ে গেছে। কেন রাজি হয়ে যাও, প্রথমেই না বলে দিতে পারো না? একবার রাজি হবার পর না-যাওয়াটা খুব খারাপ। তোমার কথার কোনো দাম নেই?

আমি বললাম, একটা কিছু ব্যবস্থা তো করতেই হবে। আজ মুর্শিদাবাদ যাওয়া অসম্ভব! ওরা এলে বলে দাও, আমি অসুস্থ!

আমি ওসব মিথ্যে কথা বলতে পারবো না। তুমি টেলিফোনে কথা বলার সময় দিব্যি সুস্থ ছিলে! ডায়েরিতে সব লিখে রাখো না কেন?

সব যদি ঠিকঠাক করতে পারতাম, তাহলে তো কত উন্নতি করে ফেলতে পারতাম জীবনে!

রশিদের বাড়িতে না গেলে ও এমন চ্যাঁচামেচি শুরু করবে!

তুমি যাবে!

আমি একা যাবো?

একা কেন, শক্তি তো যাবেই। নবনীতাও যেতে পারে। ওদের কারুকে ফোন করে সঙ্গে চলে যেও!

তুমি ভুলে যাচ্ছো, আজকের প্রধান উপলক্ষ তোমার একটা গল্পের স্ক্রিপ্ট শোনাবে। শাবানা আজমির আসবার কথা, আর তুমিই থাকবে না? এর চেয়ে মুর্শিদাবাদ যাওয়া তোমার পক্ষে বেশি জরুরি হলো?

 সেই জন্যে তো মুর্শিদাবাদ যেতে চাইছি না।

তাহলে কথা দিয়েছিলে কেন? কথা দিয়ে কথা না-রাখাটা আমি মোটেই পছন্দই করি না।

একেই বলে উভয় সঙ্কট! আজ সকালটাই খারাপভাবে শুরু হয়েছে। এক একটা দিন এমন হয়। কোনো কিছুই ঠিকঠাক ঘটে না।

এক মিনিট চা শেষ করার নীরবতা।

তারপর স্বাতী আবার বললো, তুমি মুর্শিদাবাদ চলে যাচ্ছো, অথচ কাল আমাদের শান্তিনিকেতন যাবার কথা। টিকিট কাটা আছে। তুমি কক্ষনো আমার সঙ্গে শান্তিনিকেতনে এক সঙ্গে যেতে চাও না।

আমি তো মুর্শিদাবাদ যাচ্ছি না!

যাচ্ছো না মানে? লোকগুলো একটু পরেই চলে আসবে। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। তোমার তো আবার বাথরুমে এক ঘণ্টা সময় লাগে! পুরুষ মানুষ বাথরুমে এত সময় কাটায়!

আমি সারাদিনে একবার বাথরুমে যাই। তোমার মতন সাতবার যাই না। দুপুরবেলা বাথরুমে আয়নার সঙ্গে কথাও বলি না।

আয়না ছাড়া আর কার সঙ্গে কথা বলবো? তোমাকে তো বাড়িতে পাওয়াই যায় না। হয় লেখার টেবিলে, নয় সভা-সমিতি –

ঝড় ওঠার আগে যেমন বিদ্যুৎ চমকায়, এ হচ্ছে ঝগড়া শুরুর অশনি সঙ্কেত। কথাবার্তা অন্যদিকে না ঘোরাতে পারলে আর ঝগড়া আটকানো যাবে না।

দিনের প্রথম সিগারেটটা ধরিয়ে বললাম, মুর্শিদাবাদ থেকে শান্তিনিকেতন যাবার চমৎকার রাস্তা আছে।

স্বাতী ভুরু কুঁচকে বললো, তাতে কী হয়েছে?

তুমিও আমার সঙ্গে চলো মুর্শিদাবাদ। রাত্তিরে থাকবো সার্কিট হাউজে। কাল ওরা শান্তিনিকেতনে পৌঁছে দেবে!

 যে কোনো রকম বেড়াবার প্রস্তাবে স্বাতী উৎসাহিত হয়ে ওঠে। অন্য কোথাও রাত কাটাতে ও নতুনত্ব পায় এখনো। কিন্তু আজ আর ওর সেই উৎসাহটা ছোঁয়া গেল না।

স্বাতী বললো, তাহলে রশিদের বাড়িতে আমরা যাবো না?

পরে আর একদিন যাবো। ঐ চিত্রনাট্যের ব্যাপারে আমি তো বলেই দিয়েছি। কিছু কিছু বদল করলে আমার আপত্তি নেই। ওটা এখন আমার না শুনলেও চলবে।

রশিদকে আমি কথা দিয়েছি। শাবানা আজমিকে আমার কাছ থেকে দেখার ইচ্ছে আছে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়, গীতাদি আসবেন। শক্তি, নবনীতা, এরকম আড্ডা ছেড়ে মুর্শিদাবাদের সার্কিট হাউজে রাত কাটাবার একটুও ইচ্ছে নেই আমার। তোমাকে যেতেই হবে, তুমি যাও!

আমি এখন কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ছি। কেউ আসলে ডেকে তুলতে পারবে না।

ছি ছি ছি! ওরা তোমার নাম অ্যানাউন্স করে দিয়েছে। গাড়ি নিয়ে আসছে নিয়ে যাবার জন্য। সবরকম ব্যবস্থা করে রেখেছে, এরপরও তুমি যাবে না?

এবার আমি লম্বা করে চেঁচিয়ে বললাম, উৎপল। আর একটু চা দাও তো! মুর্শিদাবাদে পাঠাতে চাইছো কেন বলো তো?

স্বাতী অবিশ্বাসের সুরে বললো, আমি তোমাকে জোর করে পাঠাতে চাইছি?

তাছাড়া কি? আমার তো একদিন হঠাৎ অসুখ হতেও পারে! যদি খুব জ্বর হতো, তাহলে ওদের কথা দেওয়া সত্ত্বেও কি তুমি আমাকে মুর্শিদাবাদে যেতে দিতে? শরীরের অসুখের বদলে মনের অসুখটারও কি গুরুত্ব নেই? যেতে ইচ্ছে না-করাটাই মনের অসুখ!

উৎপল আবার চা নিয়ে এলে তাকে বললাম, মুর্শিদাবাদে বইমেলায় কী কার্ড দিয়ে গেছে, খুঁজে বের করো তো!

উৎপল এসব ব্যাপারে খুব সিদ্ধহস্ত। এক মিনিটে কার্ডটা এনে দেখালো। তাতেই হয়ে গেল সমস্যার সমাধান!

 সেই কার্ডে রয়েছে একগাদা নাম। একজন মন্ত্রী, একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, সভাপতি, প্রধান অতিথি, উদ্বোধক, বিশেষ অতিথি।

কার্ডটা অবহেলার সঙ্গে স্বাতীর সামনে ছুড়ে দিয়ে বললাম, এই দ্যাখো, হরেকেষ্ট পালকে করেছে উদ্বোধক, আর আমি বিশেষ অতিথি! বিশেষ অতিথি মানেই তো ফালতু! এখানে আমার যাওয়া উচিত!

মুহূর্তে নরম হয়ে গেল স্বাতী। বাড়ির মধ্যে নিজের স্বামীকে সম্মান করুক বা না-করুক, বাইরের লোকের কাছে স্বামীর অসম্মান কোনো স্ত্রী-ই সহ্য করে না।

স্বাতী বললো, সত্যি, এটা ওদের অন্যায়। সেদিন এমনভাবে বলে গেল, যেন তুমি না গেলে উদ্বোধন অনুষ্ঠানই হবে না। আসল উদ্বোধক তো অন্য একজন রয়েছে দেখছি!

হরেকেষ্ট পালকে স্বাতী একেবারেই পছন্দ করে না। মুখে সে কথা উচ্চারণ করবে না অবশ্য।

দাম্পত্য কলহের সূচনার মেঘটা সরে গিয়ে ফুরে ফুরে হাওয়া বইলো। এখন আমি একটা-দুটো মিথ্যে কথা বললেও স্বাতীর আপত্তি নেই। ও নিজেই বললো, সত্যি, এ জন্য অতদূর যাওয়ার কোনো মানে হয় না।

আমি হাসতে হাসতে বললাম, আজ থেকে আমি একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। বিশেষ অতিথি হয়ে আর কোনোদিন কোনো উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যাবো না!

স্বাতী বললো, সভাপতি-টভাপতি হয়ে যাওয়াটাও এখন থেকে কমাও! ফট করে কারুকে কথা দিয়ে ফেলো না।

মুর্শিদাবাদের বইমেলার উদ্যোক্তাদের ফিরিয়ে দিতে তেমন কিছু অসুবিধে হলো না। সময় লাগলো মোট দশ মিনিট। কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে না থেকে আমি তাদের কাছে এসে বিনীত কিন্তু কঠিন গলায় বলে দিলাম, ভুল করে আমি আরও এক জায়গায় যাবার কথা দিয়ে ফেলেছি, সুতরাং মুর্শিদাবাদে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কয়েকবার ওরা বললো বটে, চলুন স্যার, না গেলে আমরা ফল্স পজিশনে পড়ে যাবো স্যার, কিন্তু আমি অনড়। শেষ পর্যন্ত একটা শুভেচ্ছা বাণী লিখে দিতে হলো। এসব ধরা-বাঁধা গতের শুভেচ্ছা বাণী লিখতে আমার আড়াই মিনিট লাগে।

তারপরেও একজন কাতরভাবে বললো, যাবেন না স্যার? পোধান অতিথি বোধহয় আসতে পারবেন না। আপনি যদি পোধান অতিথির ভাষণটা দিতেন…

প্রধান শব্দটা উচ্চারণও করতে পারে না। তবু বইমেলা করা চাই। গাড়িটা শুধু আমার একার জন্যে আনেনি, এই গাড়িতেই উদ্বোধক এবং একজন গায়িকা যাবে। সুতরাং ওদের কিছু ক্ষতি হবারও প্রশ্ন নেই।

 সেদিন আমি মুর্শিদাবাদ চলে গেলে স্বাতীকে খুবই অসুবিধের মধ্যে পড়তে হতো।

দুপুরবেলা খেতে বসেছি, এমন সময় কামাল এসে হাজির।

কামাল এ বাড়িতে যখন তখন আসে, বছরের যে কোনো সময়।

ঢাকা কিংবা মালয়েশিয়া কিংবা টরোন্টো থেকে। সে বলতে গেলে আমাদের পরিবারেরই একজন, তার জন্য এ বাড়িতে ভাত রাঁধা আছে। সে এসেই আমাদের সঙ্গে খেতে বসতে পারে, কখনো কিছু কম পড়ে না।

কামালের সব সময় ব্যস্ত-সমস্ত ভাব। দরজার সামনে জুতো খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করলো, চলে গেছে না আছে?

 কোনো রকম কুশল সংবাদ জিজ্ঞেস করার আগেই কেউ এ রকম প্রশ্ন করে! কামালের পক্ষে সবই সম্ভব।

আমি বললাম, অনেকেই চলে গেছে। অনেকেই আছে। তুমি কার কথা বলছো?

কামাল বললো, আনোয়ারা?

তার কি এখানে থাকার কথা ছিল?

 সে এখানে আসে নাই?

এলেই কি সবাই থাকে?

কামাল ঠিক এ ধরনের কথা শুনতে অভ্যস্ত নয়। সে শুধু বোঝে ঘটনা। আছে না নেই?

তাকে বললাম, বসে পড়ো, খেয়ে নাও!

কামাল কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবলো। তারপর খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে বললো, আসো, ভিতরে আসো!

এবার দরজা দিয়ে ঢুকলো একজন তেত্রিশ-চৌত্রিশ বছরের যুবক। খেলোয়াড়সুলভ চেহারা, পরনে চিনে-বাদাম রঙের কোট-প্যান্ট, মুখখানা ব্যাজার। সে শুকনো গলায় খুব দ্রুত বললো, আস্সামু আলাইকুম!

আমি ডান হাত তুলে বললাম, আলাইকুম আস্সালাম!

কামাল বললো, এ হইলো শামীমের ছোট ভাই হাবিব। আনোয়ারার খোঁজ করতে আসছে। ভাবলাম, তোমরা নিশ্চয়ই জানবে। কলকাতায় এসে সে অবশ্যই স্বাতীর সঙ্গে দেখা করবে।

শামীম-আনোয়ারাদের বাড়িতে যে-কবার গিয়েছি, কখনো শামীমের কোনো ভাইকে দেখিনি। তার কোনো ভাইয়ের অস্তিত্বের কথাও শুনিনি। হতে পারে কোনো ফুফাতো-চাচাতো ভাই।

ডাল-বেগুন ভাজার সঙ্গে সবে মাত্র দু’গেরাশ ভাত মুখে দিয়েছি, এখন কথা বলতে গেলে সব ঠান্ডা হয়ে যাবে। অতিথিদের আপ্যায়ন করার মতো বিশেষ কিছু নেই আজ, আমরা সাধারণত দুপুরে শুধু ডাল-ভাত-মাছের ঝোল খাই। ঢাকায় এদের বাড়িতে বোধহয় প্রতিদিনই আট-দশ পদ থাকে।

তবু আমি ওদের দু’জনের দিকে তাকিয়ে বললাম, খাওয়া হয়নি নিশ্চয়ই? সামান্য যা আছে, আমাদের সঙ্গে বসে খেয়ে নাও!

উৎপল দু’খানা প্লেট এনে পেতে দিয়েছে এরই মধ্যে।

কামাল বসে পড়ে জিজ্ঞেস করলো, আনোয়ারা আসে নাই এ বাড়িতে?

স্বাতী বললো, এসেছিল, কালই তো চলে গেল।

কামাল বললো, হাবিব, বসো।

 সে ছেলেটি দাঁড়িয়ে থেকেই বললো, আমি কিছু খাবো না।

তার ভুরু কোঁচকানো, কপালে দুটি ভাঁজ, মুখখানি খুবই অপ্রসন্ন। সে সারাঘরে চোখ বুলিয়ে দেখে নিয়ে বললো, মিতু ভাবী এখানে নাই?

তার মানে কি, সে আমাদের কথা অবিশ্বাস করছে? আমরা মিতুকে লুকিয়ে রেখেছি! ফ্ল্যাটটা সার্চ করে দেখতে চায়?

এ ছেলেটি দেখছি ভদ্রতা-সভ্যতার ধার ধারে না।

স্বাতী একটু কঠোর চোখে তাকালো কামালের দিকে। অর্থাৎ, এরকম লোককে তুমি আমাদের বাড়িতে নিয়ে এসেছো কেন?

কামালের আর একটি নাম ‘পরোপকারী কামাল’। অন্যের যে কোনো সমস্যায় সে মাথা গলিয়ে অজস্র সময় ব্যয় করে। নিজের টাকাও খরচ করে। মিতুর খোঁজ করার জন্য সে হয়তো নিজের টাকায় প্লেনের টিকিট কেটে চলে এসেছে। অথচ ঐ পরিবারের সঙ্গে তার তেমন কিছু ঘনিষ্ঠতা নেই।

হাবিবের ব্যবহারে কামাল খানিকটা অস্বস্তিবোধ করছে। সে বুঝতে পেরেছে, পরে সে স্বাতীর কাছে বকুনি খাবে।

কামাল বললো, ব্যাপারটা হয়েছে কি, আনোয়ারা হঠাৎ চলে আসছে তো, কারুকে কিছু জানায় নাই। শামীমের সঙ্গে অতি তুচ্ছ কারণে ঝগড়া হয়েছে, ওর রাগ তো সাংঘাতিক, অমনি একটা ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে চলে আসছে।

আমি বললাম, হঠাৎ ঝোঁকের মাথায় ব্যাগ গুছিয়ে ঢাকা থেকে কলকাতায় আসা যায়? পাসপোর্ট লাগে, ভিসা লাগে, তা একদিনে হয়?

কামাল অম্লান বদনে বললো, ঢাকায় সবই হতে পারে। কলকাতায় আর তো কারুরে চেনে না। কোথায় যাবে?

 সে তো কলকাতায় থাকার জন্য আসেনি। সে চলে গেল সৌদি আরব। তা-কি একদিনের ঝোঁকের মাথায় হতে পারে?

কামাল স্তম্ভিতভাবে বললো, সৌদি আরব?

হাবিব খাবার টেবিলে বসেনি, অন্য কোনো চেয়ারেও বসেনি, দাঁড়িয়ে আছে এক জায়গায়। সে রুক্ষভাবে বললো, সৌদি আরবে যাবে কী করে? সে দেশের ভিসা পাওয়া সহজ নয়।

আমি বললাম, মিতু আমাদের বলেছে, বাংলাদেশীদের সৌদি আরবে যেতে ভিসা লাগে না।

হাবিব বললো, এ-কথা পাগলেও বিশ্বাস করবে না। ভিসা না থাকলে তাকে প্লেনে উঠতেই দেবে না। সে কইলকাতাতেই কোথাও আছে।

স্বাতীর মুখখানা লাল হয়ে গেছে। এই ধরনের রুক্ষ কথা সে একেবারেই সহ্য করতে পারে না। আমি উপস্থিত না থাকলে সে হয়তো কেঁদেই ফেলতো।

এবারে আমি ছেলেটির দিকে খানিকটা ধমকের সুরে বললাম, এ ব্যাপারে আমাদের সঙ্গে আর আলোচনা করে লাভ নেই। আপনারা খোঁজ করে দেখুন।

তারপর কামালের দিকে ফিরে বললাম, তুমি তো জানোই কামাল, খাওয়ার পর আমি কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে বিশ্রাম নিই। বিকেলে আমার একটা মিটিং আছে। তোমার সঙ্গে রাত্তিরে দেখা হবে। তোমরা পাশের ঘরে শুয়ে থাকতে পারো।

হাবিব বললো, চলেন কামাল ভাই, আমরা একটা হোটেলে যাই।

কামাল বললো, চলো, তোমারে এক হোটেলে রেখে আসি। আমি তো এখানেই থাকি।

আমি যে একজন লেখক এবং ছোটখাটো একজন গণ্যমান্য লোক, হাবিব বোধহয় তা জানে না। কিংবা কলকাতার সব মানুষকেই সে ইন্ডিয়ার লোক হিসেবে অপছন্দ করে। মোটকথা, আমার বা স্বাতীর প্রতি সে বিন্দুমাত্র সৌজন্য দেখাবার প্রয়োজন বোধ করলো না।

কামাল বললো, হাবিব, তুমি বাইরে দাঁড়াও, আমি আসতেছি। স্বাতীর কাছ থেকে কিছু এখানকার টাকা নিতে হবে।

 শোবার ঘরে এসে আমি সবেমাত্র একটা সিগারেট ধরিয়েছি। কামাল এসে আমার পাশে বসে পড়ে বললো, তুমি কিছু মনে করো না। হাবিব ছেলেটা এমনিতে খুব ভালো, খুব দিলদরিয়া, এখন ওর ম্যাজাজটা খুব খারাপ হয়ে আছে। ওকে নিয়েই তো শামীমের সাথে আনোয়ারার ঝগড়া, তাই ও নিজেকে রেসপনসিবল ভাবছে। যদি আনোয়ারার কোনো বিপদ হয়…

আমি বললাম, ওকে নিয়ে ঝগড়া? মিতু যে অন্য কথা বলে গেল! শামীম নাকি ওর কোনো এক ছাত্রীর সঙ্গে…

না, না, সেটা বাজে কথা। একেবারে বাজে কথা। শামীম সেই টাইপই না। আসলে হাবিবের সঙ্গে আনোয়ারার একটু বেশি ভাব, তাই লোকে মনে করে, হয়তো কিছুই না, আবার হতেও পারে সিরিয়াস, আনোয়ারার তো বাচ্চা হয় নাই, মানে, মেয়েটা তো ইমোশনাল, আর শামীম এত ভালো মানুষ…

 শোনো কামাল, কার সঙ্গে কার অ্যাফেয়ার হয়েছে, তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাতে চাই না। ওটা ওদের নিজস্ব ব্যাপার। তোমাকে শুধু এইটুকু বলি, মিতু মেয়েটা খুব সম্ভবত গভীর বিপদের মধ্যে পড়েছে। একদল মেয়ের সঙ্গে তাকে আমরা প্লেনে উঠতে দেখেছি। বললো, চাকরি করতে যাচ্ছে। কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই আমার ফিসি মনে হলো। যারা মেয়ে চালান দেয়, হয়তো সেই র‌্যাকেটে পড়েছে। শুনেছি, সৌদি আরবে এইসব মেয়েদের দিয়ে দাসী-বাঁদির কাজ করায়, নানারকম অত্যাচার করে। অনেকে পাগল হয়ে যায়। তুমি দেখো, তোমাদের দূতাবাসের মাধ্যমে ওর কোনো খোঁজ পাও কি-না। আমরা ওকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ওকে জোর করে আটকে রাখার তো কোনো উপায় ছিল না।

কামাল বললো, সৌদি আরব! ওখানে আমার দু’একজন চেনা আছে। দেখি যদি ওখানে চলে যেতে পারি…

নিজের টাকায় টিকিট কিনে মিতুকে উদ্ধার করার জন্য কামালের পক্ষে সৌদি আরবে চলে যাওয়া মোটেই অসম্ভব নয়। যদিও মিতুর সঙ্গে তার নিকট সম্পর্ক নেই।

উঠে দাঁড়িয়ে কামাল বললো, দেখি, কী করা যায়।

আমি বললুম, তাই ভাবো। এখন কেটে পড়ো। আমাকে একটু ঘুমোতে দাও!

কামাল বেরিয়ে যেতেই স্বাতী বললো, এই হাবিবের মতন একজন অভদ্র মানুষের সঙ্গে মিতু প্রেম করতে পারে, এ আমি কিছুতেই বিশ্বাস করি না।

 ছেলেটা অন্য সময় হয়তো এরকম অভদ্র নয়। এখন মাথাগরম হয়ে আছে। সবাইকেই শত্রু ভাবছে।

শামীমের মতন এমন চমৎকার মানুষ, তার বউ হয়ে মিতু এর সঙ্গে প্রেম করতে যাবে কোন দুঃখে?

 যে-সব বিবাহিতা মেয়েরা পর-পুরুষের সঙ্গে প্রেম করে, তারা সাধারণত স্বামীর ঠিক অপোজিট নেচারের পুরুষেরই প্রেমে পড়ে।

তাই নাকি? তুমি জানলে কী করে?

অবজারভেশন! এটুকু অবজারভেশানের ক্ষমতা না থাকলে লেখক হলাম কী করে? মিলিয়ে দেখো! আর্টিস্টের বউরা প্রেমে পড়ে কোনো ব্যবসায়ীর, খেলোয়াড়ের বউরা প্রেমে পড়ে গায়কের, অফিসারের বউরা প্রেমে পড়ে কোনো বাউন্ডুলে ছেলের, আর লেখকের বউরা প্রেমে পড়ে পুলিশের। যেমন তুমি?

বাজে কথা বলো না! তোমার থেকে আমার অবজারভেশান ক্ষমতা বেশি। নেহাৎ আমি লিখি না তাই!

একথা ঠিক। মেয়েরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক কিছু লক্ষ করে, যা পুরুষদের চোখ এড়িয়ে যায়। দলে দলে মেয়েরা সাহিত্যজগতে এলে অনেক পুরুষ লেখকদের ভাত মারা যেত। দেওরের সঙ্গে বউদির প্রেম তো চিরাচরিত ব্যাপার। সুতরাং মিতুর পক্ষে… তার স্বামী উদাসীন।

যাই বলো, আমার তবু ধারণা, শামীমের মতন ভদ্র, বিদ্বান মানুষের প্রেমে অনেক মেয়েই পড়তে পারে।

আপাতত এটা ত্রিকোণ না চতুর্ভুজ প্রেম, সে আলোচনা থাক।

 শোনো, গয়নার ব্যাপারটা কী হবে? ঐ হাবিবকে দিয়ে দেব? আমার কাছে রাখতে চাই না।

পাগল নাকি? হাবিবকে তো আমরা চিনিই না। মিতু রেখে গেছে, একমাত্র মিতুকেই ওগুলো ফেরত দেওয়া উচিত, নইলে ব্রিচ অফ ট্রাস্ট হবে।

কামালকে অন্তত জানিয়ে রাখবো?

একদম না। কামালকে বলা মানে সমস্ত বিশ্ব সংসারে রটিয়ে দেওয়া। তুমি গয়নাগুলো আজই ব্যাংকের লকারে রাখার ব্যবস্থা করো। মিতু একদিন না একদিন ফিরে আসবে নিশ্চয়ই।

যদি এর মধ্যে আমি মরে যাই? তখন গয়নাগুলোর কী হবে?

তুমি মরে গেলে? আমার আগে? সে সম্ভাবনা যদিও খুব কম, তবু ধরো যদি সে রকম কিছু হয়, তাহলে, আমাদের তো জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট, তোমার আর মিতুর সব গয়না আমি তুলে নিয়ে বাজারে ঝেড়ে দেব। বেশ কয়েক লাখ টাকা তো হবেই। তখন লেখা-টেখা ছেড়ে দিয়ে আমি হিমালয়ে একটা এয়ার কন্ডিশান্ড আশ্রম বানানো, সাধক সঙ্গিনী রাখবো গোটা চারেক।

আ-হা-হা, খুব শখ! গোটা চারেক!

তার মানেই বুঝলে, বিশ্বে কোনো একজনের প্রেমে পড়িনি।

 তোমাদের লেখকদের প্রেমের বাছবিচার নেই। যতজন ইচ্ছে…

এর পরেও আর ঘুমোনো গেল না।

কাগজ পড়তে পড়তে চোখ বুঁজে এসেছে মাত্র, ঝনঝন করে বেজে উঠলো টেলিফোন।

রশিদের বাড়িতে যেদিন আমাদের নেমন্তন্ন থাকে, সেদিন রশিদ অন্তত সাতবার ফোন করে মনে করিয়ে দেয়। কোনো প্রয়োজন নেই, ফোন করা ওর বাতিক। তা ছাড়া, সারাদিনে আমি কোথায় কখন থাকবো, তা ওর জানা চাই।

আয়াজ রশিদ খান কলকাতা পুলিশের একজন বড় কর্তা, সবাই তাকে চেনে। শুধু পুলিশের কাজ ছাড়া অন্য বহু ব্যাপারে তার দারুণ উৎসাহ। যেমন উচ্চাঙ্গ সংগীতের সে খুবই অনুরাগী, বড় বড় ওস্তাদরা এসে থাকেন তার বাড়িতে। রশিদের মাধ্যমেই ওস্তাদ আমির খানের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব হয়েছিল এক সময়ে। রশিদ নিজে কবিতা লেখে উর্দুতে, বাংলা কবিতাও প্রচুর পড়ে। ফিল্মের ব্যাপারেও একজন বিশেষজ্ঞ, সত্যজিৎ রায় খুব স্নেহ করেন তাকে। ফিল্মের জগতের সবাই তাকে ভালোবাসে। তাছাড়া তার মাছ ধরার শখ এবং তাস খেলার, যে কোনো আড্ডায় সে সকলের শেষে ওঠে। এর মধ্যে পুলিশের কাজ করে কখন?

ইদানীং সে ফিল্ম নিয়ে মেতে উঠেছে, ফিল্মের জগতে ঢুকে পড়বে পুরোপুরি। চাকরি ছেড়ে সে নিজেই ফিল্ম পরিচালনা করবে, চলে যাবে মুম্বাই। ‘দেবদূত অথবা বারো হাটের কানাকড়ি’ নামে আমারই একটি গল্প বেছে নিয়েছে, চিত্রনাট্য লিখে দিয়েছে এম এস সাথ্যু। ওমপুরি, নাসিরুদ্দিন শাহ, শাবানা আজমি খুব কম টাকায় অভিনয় করতে রাজি হয়েছে, সেদিন সন্ধেবেলা শাবানা আসছে চিত্রনাট্য শুনতে।

রশিদের বাবা ছিলেন পাঠান, মা বিহারী, কিন্তু রশিদ ভেতো বাঙালি হয়ে গেছে। আমারই মতন সুক্তো আর বেগুন ভাজা ভালোবাসে। নিজে রান্নাও করতে পারে। একদিন শুধু ধনেপাতা দিয়ে দুর্দান্ত মাংস রান্না করেছিল।

সাহেবদের মতন ফর্সা রং, অত্যন্ত সুপুরুষ, দীর্ঘকায়, বাইরের লোকের কাছে পদমর্যাদার জন্য যতই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হোক, আমরা জানি, ওর ভেতরে এখনো রয়ে গেছে একটি দুরন্ত শিশু। মাঝে মধ্যে যতই গাম্ভীর্যের ভাব করুক, তবু সেই শিশুটি উঁকি মারে।

রশিদ আজ সন্ধেবেলা কী কী হবে, কে কে আসবে, আমি আর স্বাতী যাতে আটটার আগেই পৌঁছে যাই, সাহিত্য একাদেমির মিটিং যদি বেশিক্ষণ চলে তাহলে ও পুলিশ ফোর্স পাঠিয়ে সভা ভেঙে দেবে, এইসব বলার পর জিজ্ঞেস করলো, তুমি পাগলা কামালকে আমার কাছে পাঠিয়েছিলে?

আমি বললাম, কামালকে কি পাঠাতে হয়? ও-তো নিজে নিজেই ইচ্ছে করলে দেশের প্রেসিডেন্টের বেডরুমে ঢুকে পড়তে পারে।

রশিদ বললো, আমি অফিসারদের সঙ্গে জরুরি মিটিং করছিলাম, ও তার মধ্যে ঢুকে পড়ে বড়বড় করে কী সব বলতে লাগলো, আমি যত বলি, একটু বাইরে ওয়েট করো, পরে শুনবো, তারই মধ্যে ও বলে যেতে লাগলো। সুনীলের বাড়ি, স্বাতীর সঙ্গে কথা হয়েছে, কোন একটা মেয়ে ব্রাদার ইন-ল’র সঙ্গে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে, কিছুই বুঝতে পারলুম না।

আমার হাসি পেয়ে গেল। কামালের স্বভাব তো জানি, ও যে কোনো কাহিনী মাঝখান থেকে শুরু করে। পটভূমিকাটা বোঝাবার তর সয় না। কার সঙ্গে কার কী সম্পর্ক, বোঝাই যায় না প্রথমে।

রশিদ আবার বললো, কোনো অ্যাডাল্ট মেয়ে যদি প্রেম করে বাড়ি থেকে পালায়, তাহলে পুলিশ কী করবে বলো তো? আগে কোর্টে যাক।

আমি বললাম, ব্যাপারটা ঠিক তা নয়, অনেক সিরিয়াস ব্যাপার। তোমাকে পরে বুঝিয়ে বলবো। তবে, এক্ষুনি তোমাদের কিছু করার নেই। সে অন্য দেশে চলে গেছে।

রশিদ সঙ্গে সঙ্গে প্রসঙ্গ পাল্টে বললো, গত মাসে চুঁচড়োয় একটা বিরাট ব্যাংক ডাকাতি হয়েছিল মনে আছে? সব ব্যাটাকে আজ ধরেছি। এর মধ্যে পালের গোদাটার কাছ থেকে আটাশ লাখ টাকা পাওয়া গেছে।

রশিদ পুলিশের কাজ কিছুই করে না বলে আমরা মাঝে মাঝে ওকে খোঁচা মারি, ও তাই এরকম দু’একটা কৃতিত্বের কথা সবিস্তার জানাতে চায়। তাও কৃতিত্ব মানে কী, রশিদ তো নিজে পিস্তল হাতে তাড়া করে ডাকাতদের ধরেনি, বিভাগীয় প্রধান হিসেবে ওর নামটাই কাগজে বেরুবে।

আমি বললাম, গুড ওয়ার্ক। কিপ ইট আপ। আরও অনেক ডাকাত এখনো ধরা না পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

সাহিত্য একাদেমির মিটিং তাড়াতাড়ি সেরে ফিরে এলাম বাড়িতে। স্বাতী সাজগোজ করছে। আবার রশিদের টেলিফোন। সুনীল, তোমাদের বাড়িতে বরফ আছে? এক বাকেট যদি নিয়ে আসতে পারো, সুভাষদার খুব বরফ লাগে।

ঠিক আছে। নিয়ে যাচ্ছি।

 তোমাকে আর একটা কাজ করতে হবে। শক্তিকে তুমি সামলাবে। আমি তো স্ক্রিপ্টটা পড়ে শোনাবো, শক্তি যদি তার মাঝখানে বেশি কথা বলে-

বলুক না। শক্তি পনেরো মিনিটের বেশি চুপ করে বসে থাকতে পারে না।

রশিদ, তুমি কি কামালকে নেমন্তন্ন করেছো?

না তো। করা উচিত ছিল?

তুমি নেমন্তন্ন করো বা না করো, কামাল ঠিক পৌঁছে যাবে।

তা আসুক না। কামালকে তো আমরা সবাই পছন্দই করি। একটু পাগল আছে বটে। পৃথিবীতে এরকম পাগল দু’ চারজন থাকা খুব দরকার।

রশিদ ফোন ছেড়ে দিল। আমি নিজের সঙ্গে বাজি ধরলাম। আমরা বেরুবার আগে রশিদ নিশ্চিত ফোন করবে আর একবার।

 যে কোনো পার্টিতে কামাল অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ভূমিকা নেয়। কামাল কোনোদিন বিড়ি-সিগারেট খায়নি। কিন্তু পকেটে লাইটার রাখে। অন্য কেউ সিগারেট বের করলেই দৌড়ে এসে ধরিয়ে দেয়। জীবনে কখনো মদের গেলাশে চুমুক দেয়নি, কিন্তু অন্যদের গেলাশ খালি দেখলেই বোতল এনে ঢেলে দেবে, কার কতটা জল বা সোডা লাগবে তা মনে রাখে। সে নিজে একটা কাচের গেলাশে সামান্য চা কিংবা কফি ঢেলে তাতে অনেকখানি জল মেশায়, সেটা হুইস্কি কিংবা রামের মতন রং হয়, সেই গেলাশ হাতে নিয়ে বসে থাকে। প্রত্যেকটি মেয়েকে কোল্ড ড্রিংক্স দেবে মনে করে। কোল্ড ড্রিংক্স কম পড়লে দৌড়ে কিনে আনবে রাস্তা থেকে।

আমি একদিন কামালকে বলেছিলাম, তোমার আর একটা নাম হওয়া উচিত গিরীশ মহাপাত্র!

উপস্থিত কেউই এ নামের মর্ম বোঝেনি, কামালও না। শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবি’ উপন্যাসের নায়কের এই ছদ্মনাম এখন কেই-ই বা মনে রেখেছে। ছদ্মবেশী সব্যসাচী পুলিশকে বলেছিল, আমি স্যার গাঁজা খাই না। তবে অন্য লোকদের গাঁজার কল্কে সেজে দিই।

স্বাতী বেরিয়েছে, আবার টেলিফোন।

আমি স্বাতীকে বললাম, নিশ্চয়ই রশিদ। তুমি এবার ধরো।

স্বাতী অবিশ্বাসের সুরে বললো, কী করে জানলে, রশিদ?

 ফোন তুলে স্বাতী আমার দিকে ভ্রƒভঙ্গি করলো? অর্থাৎ নিজের কাছে আমি বাজি জিতে গেছি।

এবার রশিদের ফোন ঠিক সাত মিনিট। শেষ মুহূর্তে তার মনে হয়েছে, তার নিজেরও কামালকে আমন্ত্রণ জানানো উচিত। সে তো আমাদের বাড়িরই লোক, কিন্তু কোথায় কামাল? দুপুরের পর থেকে তার পাত্তা নেই।

আমার বদলে স্বাতীকে পেয়ে রশিদ তার ডাকাত ধরার গৌরবকাহিনীটিও শোনাতে ছাড়েনি।

আমার বাড়ি থেকে রশিদের বাড়ির দূরত্ব বড় জোর পাঁচ মিনিটের। তাই

ইচ্ছে করেই একটু দেরিতে যাচ্ছি। লিফ্ট দিয়ে নিচে নামার পর স্বাতী হঠাৎ আমার পায়ের দিকে চেয়ে বললো, এ-কী, প্যান্টের সঙ্গে চটি পড়ে এসেছো? বাজে দেখাচ্ছে। শাবানা আজমি আসছে, কী মনে করবে? যাও, জুতো পরে এসো –

আমি লঘু সুরে বললাম, ওগো খুকী, শাবানা আজমির সামনে কি আমার বিশেষ সাজগোজ করার দরকার আছে? রশিদের বাড়িতে সবাই দরজার বাইরে জুতো খোলে। কে চটি পরে এসেছে, কে সু, তা বোঝা যাবে কী করে?

স্বাতী বললো, হ্যাঁ, বোঝা যায়। পা দেখলেই বোঝা যায়।

কিছুদিন আগেই সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘সতরঞ্চ কি খিলাড়ি’ মুক্তি পেয়েছে। এখন বাঙালিদের কাছে শাবানার খ্যাতি খুবই বেশি। কিন্তু আমরা তো এই অভিনেত্রীকে আগে থেকেই চিনি। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রায় মেয়ের মতন। এর আগের একটা পার্টিতে শাবানা বাচ্চা মেয়ের মতন সুভাষদার কোলে বসে পড়েছিল।

স্ত্রী সঙ্গে থাকলে জামা-প্যান্ট, চটি কিংবা জুতো নিজস্ব নির্বাচনে পরার স্বাধীনতা আমি হারিয়েছি অনেক দিনই। প্রতিবাদ করে লাভ নেই।

আমাদের আগে অনেকেই পৌঁছে গেছে। এমনকি শাবানাও, সঙ্গে এনেছে জাভেদ আখতারকে। শক্তি বেশ শান্ত। রশিদ ছটফটিয়ে বললো, এত দেরি করলে তোমরা? আমার লেখাটা পড়তে শুরু করতে পারছি না।

চিত্রনাট্যটি সাথ্যুর রচনা। রশিদ তার সঙ্গে অনেক আলোচনা করেছে ঠিকই। কিন্তু এখন এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন লেখাটাও ওর। ছবিটা হবে হিন্দিতে, চিত্রনাট্য লেখা ইংরেজিতে, সংলাপ লেখা উর্দু ভাষায়। এ সম্পর্কে আমি কি মতামত দেব?

সবার হাতে গেলাশ ওঠার পর রশিদ একটা ফাইল খুলে বললো, এবার পড়ি? সবাই মাথা নাড়লেও শক্তি বললো, খুব বেশি বড় তো না রে? কতক্ষণ দেরি করবি?

রশিদ বললো, নট মোর দ্যান অ্যান আওয়ার। শক্তি, তুমি এর মধ্যে গেলাশ রিফিল করে নিও। আর যদি শুনতে না চাও…

শক্তি বললো, হ্যাঁ, শুনবো। ঠিক এক ঘণ্টা।

রশিদ আমাকে বললো, সুনীল, তোমার গল্পের নাম খুব বড়। ফিল্মে চলবে না। আমরা নাম দিয়েছি, খোদা কা বস্তি। বাঙালিরা বস্তি বলতে যা ভাবে, এখানে তার অন্য মানে।

শাবানা আমাকে বললো, দিস নেইম সাউন্ডস গুড, দাদা!

আমি বললাম, ঠিক আছে।

শাবানা বললো, আমরা লোকেশান দেখতে গিয়েছিলাম। কী যেন জায়গাটার নাম?

রশিদ বললো, বসিরহাটের কাছে, স্বরূপনগর।

শাবানা বললো, দাদা, যে মেয়েটিকে নিয়ে আপনি গল্পটা লিখেছেন, তাকে দেখলাম। তার সঙ্গে আমার মিল আছে?

আমি কিছু বলার আগেই রশিদ বললো, খুব মিল। শি হ্যাজ আ টুথি স্মাইল লাইক ইউ।

শাবানার দাঁত সামান্য উঁচু। ‘টুথি স্মাইল’ শুনে ও হাসলো, বিরক্ত হলো না।

শক্তি বললো, অত কথার কী দরকার। পড়ো না! সুভাষ মুখোপাধ্যায় বললেন, হ্যাঁ, পড়ো। মুসলমান সমাজ সম্পর্কে সুনীল কী লিখেছে। জানতে আমার খুব আগ্রহ হচ্ছে।

রশিদ বললো, এই স্টোরিতে হিন্দু-মুসলমান দু’রকম ক্যারেকটারই আছে।

আমি বললাম, সুভাষদা, মুসলমান সমাজ নিয়ে আমি লিখিনি। সে ক্ষমতা আমার নেই। স্বরূপনগরে কয়েকদিন থাকার সময় একটি মেয়েকে দেখেছিলাম, শি হ্যাপেন্স টু বি আ মুসলমান মেয়ে। কিন্তু তার যা সমস্যা, তা সব সমাজেই হতে পারে।

শক্তি অধৈর্য ভাবে বললো, অত কথার দরকার কী, পড়ো না জিনিসটা!

রশিদের এক হাতে মদের গেলাশ, অন্য হাতে সিগারেট। আমাদের সবার চেয়ে বেশি ধূমপান করে রশিদ।

ফাইল খুলে রশিদ বললো। আগে একটু মিউজিকের কথা বলে নিতে পারলে ভালো হয়। আমার ছবিতে মিউজিক দিতে রাজি হয়েছেন ওস্তাদ আলি আকবর খান।

আমি বললাম, বাঃ!

শাবানা বললো, হি ইজ আ বিগ নেইম। কিন্তু ওঁকে তো ধরাই মুশকিল, সময় দিতে পারবেন?

রশিদ বললো, উনি আমাকে কথা দিয়েছেন, এই উইন্টারে এসে পুরো ওয়ান উইক কাজ করবেন।

হঠাৎ শক্তি হাত তুলে বললো, দাঁড়াও, দাঁড়াও, আমার একটা কথা মনে পড়েছে, সুনীল, তুমি একবার ঢাকায় আমজাদ হোসেনকে এই গল্পটার রাইট দিয়ে দিয়েছিলে না? আমজাদ তোমাকে টাকাও দিয়েছিল!

রশিদ আঁতকে উঠে বললো, মাই গুডনেস! সুনীল, তুমি এই গল্পের রাইট অন্য কারুকে বিক্রি করে দিয়েছো? আমরা এত দূর এগিয়েছি।

শাবানা এমনভাবে তাকালো, যেন, সিনেমা লাইনে এরকম তো প্রায়ই হয়!

আমি বললাম, আসলে শক্তি তোমার চিত্রনাট্য শুনতে চায় না, তাই বাগড়া দিচ্ছে। ওকে অন্য ঘরে পাঠিয়ে দাও! আমজাদ হোসেন এই গল্পটা নিয়ে ফিল্ম করবে বলে খুবই উৎসাহ দেখিয়েছিল ঠিকই। পরে পিছিয়ে যায়। এই গল্পে একটা রেপ সিন আছে, সেটা বাংলাদেশে নাকি দেখানো সম্ভব নয়। আমজাদের সঙ্গে আমার কোনো চুক্তি হয়নি। আর ঐ টাকা দেওয়ার ব্যাপারটা শক্তির সম্পূর্ণ বানানো।

শক্তি খানিকটা দমে গিয়ে মিনমিন করে বললো, একদিন কিছু টাকা বার করে দিল না পকেট থেকে?

আমি বললাম, ওঃ, সেই দিন? জামার বুক পকেট থেকে কিছু টাকা বার করে ফিল্মের গল্প কেনা যায় না, শক্তি। আমজাদ আমাকে একটা একশ’ টাকার নোট ভাঙিয়ে দিয়েছিল।

এবার অনেকেই হেসে উঠলো।

রশিদ বললো, ঐ রেপ সিনটাই তো গল্পের পক্ষে সবচেয়ে ভাইটাল, আমরা চিত্রনাট্যে জায়গাটা বিউটিফুলি হ্যান্ডল করেছি।

সুভাষদা বললেন, অনেক কথা হয়েছে। এবার পড়ো তো! রশিদ ফাইল খুলে সবে মাত্র এক লাইন পড়েছে, আবার বাধা এলো। দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লো কামাল, তার সঙ্গে হাবিব।

এখানে যে একটা কিছু পড়াশুনোর ব্যাপার চলছে, কামাল বেচারি তা বুঝবে কী করে? কোনো পার্টিতে সেটা ঠিক স্বাভাবিক নয়।

কামাল বললো, আমরা এসে পড়লাম। রশিদ, আমরা রয়াল জর্ডন এয়ারলাইন্সের অফিসে গেছিলাম, ওদের প্যাসেঞ্জার লিস্টে নাম আছে, তুমি যদি একটা টেলিফোন করো –

রশিদ অসহায়ভাবে আমার দিকে তাকালো।

সুভাষদা ধমক দিয়ে বললেন, এই কামাল, তুমি আগে বসে পড়ো তো! ওসব কথা পরে হবে! এখন অন্য কাজ হচ্ছে!

কামাল সঙ্গে সঙ্গে বললো, ও আচ্ছা! পরে হবে! বসো হাবিব।

ঘুরে ঢুকেই হাবিব এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তার মুখখানা গনগন করছে রাগে। সে ঠেলে ঠুলে বসে পড়লো ঠিক আমার পাশে। তার ক্রোধের আঁচ লাগছে আমার গায়ে।

রশিদ আবার পড়তে শুরু করতেই বাধা এলো অন্য দিক দিয়ে।

রশিদের ছোট মেয়ে মাস্তুল দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললো, বাবা, তোমার টেলিফোন। চিফ মিনিস্টারের সেক্রেটারি।

সঙ্গে সঙ্গে ধরফড় করে উঠে যেতে হলো রশিদকে।

আমার এই গল্পটায় গ্রহণ লেগেছে। আজ আর চিত্রনাট্য পড়া হবে বলে মনে হয় না। এর আগেও আরও দু’জন এই গল্প নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেও এগোতে পারেনি।

শক্তি নিজে নেবার আগে সুভাষদার গেলাশে পানীয় ঢেলে দিতে দিতে বললো, চাকরি ছেড়ে সিনেমা করার কোনো মানে হয়! রশিদটা কী যে পাগলামি করছে!

হাবিব আমার একটা হাত চেপে ধরে ফিসফিস করে বললো, আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে নিলোফারের অ্যাফেয়ার হয়েছে, এ কথা আপনি বলেছেন? এত বড় একটা মিথ্যা কথা আপনি কী করে বললেন?

এবার আমার সত্যিকারের বিরক্তি বোধ হলো। কামাল এ কাকে নিয়ে এসেছে? নিলোফারকে আমি চিনিই না। এই ধরনের কথা বলা কি আমাকে মানায়? আনোয়ারাই স্বাতীর কাছে এই ধরনের কথা বলে গেছে।

এর উত্তর দিতেই আমার ইচ্ছে হলো না। আমার চুপ করে থাকায় আরও রেগে গিয়ে হাবিব আমার দিকে কটমট করে তাকালো। এবার বোধহয় সে আমার মুখে একটা ঘুসিই মেরে দেবে।     (ক্রমশ)