গল্পের প্রাণই হচ্ছে মনস্তত্ত্ব, মনের কথা। মানুষের কথাবার্তা, পরিবার-সমাজে যাপিত জীবনের মধ্য দিয়ে তার প্রকাশ ঘটে। সমাজ ও সাংস্কৃতিক জীবনধারাও গল্পের চরিত্রদের মনোজগৎকে কেন্দ্র করে জীবন্ত হয়ে ওঠে, চারপাশের প্রকৃতিও লেখকের সৃজনক্ষমতার গুণে ‘আলাদা চরিত্র’ হিসেবে ফুটে উঠে বাস্তব চরিত্রদের মধ্যে ভাববাদী কল্পনাশক্তির তুমুল আলোড়ন তুলতে পারে। এই ভাব কিংবা কল্পনার প্রভাবে বাস্তব চরিত্রগুলি প্রভাবিত হয়, হয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ সাহিত্যে প্লেটোর ভাবনাতত্ত্ব বা ভাববাদী সাহিত্যধারা কোনো না কোনোভাবে রিয়ালিজম বা বাস্তববাদী জীবনপ্রবাহকে বদলে দিতে পারে। অন্যান্য গল্প বা সাহিত্যের মতো রবীন্দ্রনাথের ‘অতিথি’ গল্পও তার অনন্য উদাহরণ। গল্পের ভেতর লুকিয়ে থাকা মনোজাগতিক বিষয়-আশয় খোঁজার প্রয়োজন কী? উত্তর জানতে হলে এই বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে এগোতে হবে।
রবীন্দ্রনাথ ‘অতিথি’ গল্পটি লিখেছেন ১৩০২ বাংলা সনে, প্রায় ১২৮ বছর আগে। বহু আলোচনা হয়েছে, বহু বিশ্লেষণ হয়েছে তাঁর সাহিত্য নিয়ে। তারপরও কেন খোঁড়াখুঁড়ি? এ-প্রশ্নেরও উত্তর পাওয়া যাবে ধাপে ধাপে।
এই গল্পটি সংকলিত হয়েছে রবীন্দ্র-গল্প সংকলন গল্পগুচ্ছ গ্রন্থে। প্রচলিত ধারায় বিশ^ভারতী-প্রকাশিত অখণ্ড গল্পগুচ্ছই ‘রবীন্দ্র-গল্প সংকলন’ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
চারু কতবার একান্তমনে প্রতিজ্ঞা করিয়াছে যে, সে তারাপদর সহিত সদ্ব্যবহার করিবে, আর কখনো তাহাকে মুহূর্তের জন্য বিরক্ত করিবে না, কিন্তু সোনামণি প্রভৃতি আর পাঁচজন মাঝে আসিয়া পড়াতে কখন তাহার কিরূপ মেজাজ হইয়া যায় কিছুতেই আত্মসংবরণ করিতে পারে না। কিছুদিন যখন উপরি-উপরি সে ভালোমানুষি করিতে থাকে তখনই একটা উৎকট আসন্ন বিপ্লবের জন্য তারাপদ সতর্কভাবে প্রস্তুত হইয়া থাকে। আক্রমণটা হঠাৎ কী উপলক্ষে কোন্ দিক হইতে আসে কিছুই বলা যায় না। তাহার পরে প্রচণ্ড ঝড়, ঝড়ের পরে প্রচুর অশ্রুবারিবর্ষণ, তাহার পরে প্রসন্ন স্নিগ্ধ শান্তি। (পৃ ২৫)
আলোচনার শুরুতে কেন এই উদ্ধৃতি? তারও উত্তর পাওয়া যাবে বিশ্লেষণের ভেতর থেকে।
রবীন্দ্রনাথ-সৃষ্ট এই সাহিত্য-আখ্যানের মনস্তাত্ত্বিক অনুষদ অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমরা দেখি ঈর্ষা এবং ঢ়ড়ংংবংংরাবহবংং বা একক অধিকারবোধের ওপর ভর করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘অতিথি’ গল্পে অসামান্য জীবনঘনিষ্ঠ এক আখ্যান উপহার দিয়েছেন। ঘোরলাগা প্রকৃতির বর্ণনায় রূপক-উপমার অনন্য ব্যবহার আর ভাববাদী সাহিত্যমতবাদের গূঢ় জীবনদর্শন এবং ব্রাহ্মণ বালক তারাপদর দেশত্যাগী, বিবাগী যাপিত জীবন ভিন্নমাত্রার সাহিত্য-আলো ছড়িয়েছে।
গল্পে আছে মূলত পাঁচটি চরিত্র : তারাপদ, চারুশশী, সোনামণি এবং অন্নপূর্ণা-মতিলাল দম্পতি। আরেকটি ভাববাদী চরিত্র হচ্ছে ‘প্রকৃতি’। তারাপদকে ঘিরে আখ্যান এগিয়ে গেলেও পাঠের এক পর্যায়ে মনে প্রশ্ন জাগে, আসলে কে এই গল্পের প্রোটাগনিস্ট?
অধিকাংশ পাঠক একবাক্যে বলবেন, তারাপদই এই আখ্যানের প্রধান চরিত্র। তার ওপর ভর করে গল্পের নামকরণ করা হয়েছে ‘অতিথি’। অতিথি কোনো বাড়িতে গেলে স্থায়ীভাবে থাকে না, কিছুদিন থেকে চলে যায়। সেই অর্থে গল্পের নামকরণ ‘অতিথি’ যথার্থ হয়েছে এবং তারাপদকে প্রধান চরিত্র ভাবতে কোনো ধরনের সংশয় থাকে না। তবে ওপরের উদ্ধৃতিসহ চারুশশীর আরো আরো ঘটনা প্রবাহের ভেতর অনুসন্ধিৎসু চোখ মেলে তাকালে পাঠকের ভাবনাজগতে কিছুটা হলেও দ্বিধা তৈরি হবে, হতে পারে।
আসুন, প্রিয় পাঠক, আমরা ধাপে ধাপে গল্পের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করি, আলোচনায় অগ্রসর হই।
পিতা-মাতার চতুর্থ পুত্র তারাপদ শৈশবে পিতৃহীন হয়ে গেলেও পুরো গ্রামে আদরের ছেলে হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল, কিন্তু একটা বিদেশি যাত্রাদলে মিশে সে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়।
তারাপদ হরিণ শিশুর মতো বন্ধনভীরু, আবার হরিণের মতো সংগীতমুগ্ধ। যাত্রার গানেই তাহাকে প্রথম ঘর থেকে বিবাগী করিয়া দেয়। (পৃ ১৭)
… সকলে খোঁজ করিয়া তাহাকে গ্রামে ফিরাইয়া আনিল। তাহার মা তাহাকে বক্ষে চাপিয়ে ধরিয়া অশ্রুজলে আর্দ্র করিয়া দিল, তাহার বোনরা কাঁদিতে লাগিল; তাহার বড়ো ভাই পুরুষ-অভিভাবকের কঠিন কর্তব্য পালন উপলক্ষে তাহাকে মৃদু রকম শাসন করিবার চেষ্টা করিয়া অবশেষে অনুতপ্তচিত্তে বিস্তর প্রশ্রয় এবং পুরস্কার দিল। পাড়ার মেয়েরা তাহাকে ঘরে ঘরে ডাকিয়া প্রচুরতর আদর এবং বহুতর প্রলোভনে বাধ্য করিতে চেষ্টা করিল। কিন্তু বন্ধন, এমন-কি স্নেহবন্ধনও তাহার সহিল না; তাহার জন্মনক্ষত্র তাহাকে গৃহহীন করিয়া দিয়াছে; সে যখনই দেখিত নদী দিয়া বিদেশী নৌকা গুণ টানিয়া চলিয়াছে, গ্রামের বৃহৎ অশ^থগাছের তলে কোন্ দূরদেশ হইতে এক সন্ন্যাসী আসিয়া আশ্রয় লইয়াছে, অথবা বেদেরা নদীতীরের পতিত মাঠে ছোট ছোট চাটাই বাঁধিয়া বাঁখারি ছুলিয়া চাঙারি নির্মাণ করিতে বসিয়াছে, তখন অজ্ঞাত বহিঃপৃথিবীর স্নেহহীন স্বাধীনতার জন্য তাহার চিত্ত অশান্ত হইয়া উঠিত। উপরি-উপরি দুই-তিনবার পলায়নের পর তাহার আত্মীয়বর্গ এবং গ্রামের লোক তাহার আশা পরিত্যাগ করিল। (পৃ ১৬)
গল্পের শুরুতে পাঠক দেখার সুযোগ পান কাঁঠালিয়ার জমিদার মতিলাল বাবুর নৌকায় চড়ে নন্দীগাঁয়ে যাওয়ার অনুমতি মিলেছে তার।
পনেরো-ষোলো বছরের গৌরবর্ণের এই বালক বেশ সুদর্শন। তার বড়ো বড়ো চোখ, হাসিমাখা ওষ্ঠাধর আর … ‘অনাবৃত দেহখানি সর্বপ্রকার বাহুল্যবর্জিত; কোনও শিল্পী যেন বহু যত্নে নিখুঁত নিটোল করিয়া গড়িয়া দিয়েছেন’ (পৃ ১৫)। এত সুললিত সৌকুমার্যের প্রকাশ ঘটলেও তারাপদর বিবাগী, উদাসীন, দেশত্যাগী উড়ো উড়ো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গল্পের শেষ লাইনেও পাঠকের মনে মোচড় দিয়ে নিদারুণ এক কষ্টের ছোবল বসিয়ে দেয়।
দেখা যায়, স্নেহ-প্রেম-বন্ধুত্বের ষড়যন্ত্রবন্ধন তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরার আগেই সে সমস্ত গ্রামের হৃদয় চুরি করে বর্ষার মেঘাচ্ছন্ন রাতে ‘আসক্তিবিহীন উদাসীন জননী বিশ্বপৃথিবীর নিকট চলিয়া গিয়াছে।’ (পৃ ২৭)
‘বিশ্বপৃথিবী’কে জননীর সঙ্গে তুলনা করেছেন লেখক। একইসঙ্গে বলেছেন, এই জননী আসক্তিবিহীন, উদাসীন। এই ভাববাদী সাহিত্য মতবাদ অনুযায়ী বলা যায়, গল্পের প্রধান চরিত্র তারাপদই।
তবে তাকে ঘিরে পুত্র-সন্তানহীন অন্নপূর্ণার মাতৃত্বের মৌলিক স্নেহধারারও অপূর্ব প্রকাশ ঘটে গেছে। ‘বিশ^পৃথিবী’ ভাববাদী চরিত্র আর ‘অন্নপূর্ণা’ বাস্তবের চরিত্র। দুই জননীর মধ্যে সংযোগ তৈরি করে দেয় মনের মৌলিক সম্পদ – ইতিবাচক আবেগ, যেমন স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা এবং গল্পে জীবন্ত হয়ে ওঠা প্রকৃতি। একইসঙ্গে আমরা দেখার সুযোগ পাই মনস্তাত্ত্বিক মতবাদ যেমন বিহেভিয়ারাল, সাইকোডাইনামিক, কগনিটিভ এবং নিউরোসায়েন্স আধিপত্যের প্রকাশ ঘটেছে আখ্যানের মধ্য দিয়ে। সরাসরি এসব কঠিন শব্দের সংজ্ঞা উপস্থাপন না করলেও এই বিশ্লেষণের ভেতর থেকে ধীরে ধীরে তা স্পষ্ট হবে বলে মনে করি।
গল্পের আরেকটি বিশেষ চরিত্র চারুশশী।
তারাপদকে পুত্রস্নেহে আশ্রয়দাতা মতিলাল-অন্নপূর্ণা দম্পতির ‘দীপ্তকৃষ্ণনয়না বালিকা কন্যা’ এই চারুশশী। তার অন্তর-জগতের ঝড়ঝঞ্ঝা-জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত ঢেউয়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ঈর্ষা-বিদ্বেষের তপ্তশেল আখ্যানের মধ্যে টানটান উত্তেজনা তৈরি করে। কীভাবে চারুশশীর মনোজগতের একক অধিকারবোধ, আবেগ ও আচরণ আখ্যানে ভিন্নমাত্রার শিল্প-হিমালয় নির্মাণ করেছে, তাও দেখার সুযোগ পাই আমরা :
… সে (চারুশশী) ভাবিয়াছিল, তারাপদ নামক তাহাদের নবার্জিত পরমরত্নটির আহরণকাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করিয়া সে তাহার সখীর কৌতূহল এবং বিস্ময় সপ্তমী চড়াইয়া দিবে। কিন্তু যখন সে শুনিল, তারাপদ সোনামণির নিকট কিছুমাত্র অপরিচিত নহে, বামুনঠাকুরনকে সে মাসি বলে এবং সোনামণি তাহাকে দাদা বলিয়া ডাকে – যখন শুনিল, তারাপদ কেবল যে বাঁশিতে কীর্তনের সুর বাজাইয়া মাতা ও কন্যার মনোরঞ্জন করিয়াছে তাহা নহে, সোনামণির অনুরোধে তাহাকে সহস্তে একটি বাঁশের বাঁশি বানাইয়া দিয়াছে, তাহাকে কতদিন উচ্চশাখা হইতে ফল ও কণ্টক শাখা হইতে ফুল পাড়িয়া দিয়াছে, তখন চারুর অন্তঃকরণে যেন তপ্তশেল বিঁধিতে লাগিল। চারু জানিত, তারাপদ বিশেষরূপে তাহাদেরই তারাপদ – অত্যন্ত গোপনে সংরক্ষণীয়, ইতরসাধারণে তাহার একটু-আকটু আভাস মাত্র পাইবে, অথচ কোনওমতে নাগাল পাইবে না, দূর হইতে তাহার রূপে গুণে মুগ্ধ হইবে এবং চারুশশীদের ধন্যবাদ দিতে থাকিবে। … সোনামণির দাদা! শুনিয়া সর্বশরীর জ্বলিয়া যায়! (পৃ ২২)
তারপর তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে চারুশশী সোনামণির সঙ্গে আড়ি দিয়ে বসল। এখানেই সে ক্ষান্ত হয়নি, তারাপদের ঘরে ঢুকে তার শখের বাঁশিটি বের করে তার ওপর লাফিয়ে-মাড়িয়ে নির্দয়ভাবে ভেঙে ফেলল। ওই সময় ঘরে ঢুকে তারাপদ চারুশশীর প্রলয়মূর্তি দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল! তারাপদ শুধু আমার – এই একক অধিকারবোধ মূলত চারুশশীর মনোজগতে প্রবল প্রতাপে বজায় থাকে। সোনামণি সেই মমতায় ভাগ বসিয়েছে দেখে, কাছের মানুষ অন্যের দখলে চলে যাচ্ছে ভেবে, তার মনে হতাশা, ঈর্ষা অনিয়ন্ত্রিত ধারায় জেগে ওঠে আর তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে আচরণের উগ্র বিস্ফোরণ, ভাংচুর-চিৎকার-চেঁচামেচির মধ্য দিয়ে। তার অবচেতন মনজুড়ে আসন নিয়ে বসে গেছে তারাপদ। চেতন মনে তার দিশা পায় না চারুশশী।
চেতন-অবচেতন মনের দেয়াল ভেঙে যাওয়ায় কখনো কখনো বিভ্রান্ত ও দিশেহারা হয়ে যায় সে। অন্তর কী চায় আর বাইরে কী ঘটছে – তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে না তার বোধে, ভেতর-বাহির একাকার হয়ে যাওয়ায় তার চাওয়া ও প্রাপ্তির মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। সেটাও লাঘব করতে পারে না চারুশশী। অপরাধ করলে কীভাবে ক্ষমা চাইতে হয় সেই বিদ্যাও কখনো সে অর্জন করেনি, কখনো তার অভ্যাসে তা ছিল না, … ‘অথচ (চারুশশীর) অনুতপ্ত ক্ষুদ্র হৃদয়টি তাহার সহপাঠীর ক্ষমালাভের জন্য একান্ত কাতর হইয়া উঠিল।’ (পৃ ২৪)
এখানে ফ্রয়েডের ইগো ডিফেন্স মেকানিজমের ডিসপ্লেসমেন্ট বিহেভিয়ার বা প্রতিস্থাপিত আচরণ চরিত্র নির্মাণে ভূমিকা রেখেছে বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। এই সাইকোডাইনামিক প্রত্যয়ে বলা হয়েছে, নিজের মনোজগতে হঠাৎ জেগে ওঠা ক্ষোভ, ক্রোধ অন্য নিরীহ ব্যক্তি কিংবা অন্যকিছুর ওপর নিজের অজান্তে আরোপ করে নিজের ‘ইগো’কে সুরক্ষা করে মানুষ।
আবার মনস্তত্ত্বের ফ্রাস্ট্রেশন-অ্যাগ্রেশন থিওরি দিয়েও চারুশশীর সামগ্রিক আচরণ বিশ্লেষণ করা যায় – হতাশ মানুষের অন্তর্জগৎ থেকে আচমকা ক্রোধের বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। তা আমরা দেখি চারুশশীর যাবতীয় কর্মকাণ্ডে। তবে তার আচরণের ঝড়-তুফানের মধ্য দিয়ে তা বোঝা গেলেও তারাপদর প্রতি চারুশশীর প্রীতিময় অনুরাগের কথা স্পষ্ট হয়েছে তার পিতা-মাতার কথোপকথনের মধ্য দিয়ে। মেয়ের বিয়ে নিয়ে দু-তিনটি ভালো সম্বন্ধ আনানোর পর ‘একদিন অন্নপূর্ণা মতিবাবুকে ডাকিয়া কহিলেন, পাত্রের জন্য তুমি অত খোঁজ করে বেড়াচ্ছ কেন। তারাপদ ছেলেটি তো বেশ। আর তোমার মেয়েরও ওকে পছন্দ হয়েছে।’ (পৃ ২৫)
লেখক সচেতনভাবে উপযুক্ত সব মনস্তাত্ত্বিক বিষয় ব্যবহার করেছেন বলেও মনে হয়নি। মনে হয়েছে, নিজস্ব জীবনবোধ, অভিজ্ঞান, উপলব্ধির ভেতর থেকে তিনি চরিত্রটিকে নিজের অজান্তে মনস্তাত্ত্বিকভাবে জীবন্ত করে তুলেছেন। এ বোধই শিল্পসম্মত চরিত্র নির্মাণে একজন লেখকের সবচেয়ে বড় শক্তিশালী উপায়। যুগে যুগে এভাবে জীবনঘনিষ্ঠ সাহিত্য রচিত হয়েছে। এ-কারণে শক্তিমান লেখক একজন মনোবিদ, সৃষ্টিশীল বিজ্ঞানী। রবীন্দ্রনাথও। সাহিত্যের ভেতর দিয়ে আমরা তাঁকে এভাবেই দেখতে চাই।
আবার অন্যদিকে পাঠক লক্ষ করেন, নিজের পুরনো প্রিয় বাঁশিটির আকস্মিক দুর্গতি দেখেও উত্তেজিত হয়নি তারাপদ, বরং হাসি লুকিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে; কিন্তু নিভৃতে চারুশশীর প্রতি তার অন্যরকম কৌতূহল জেঁকে বসে। এই কৌতূহলের আড়ালে তরঙ্গায়িত ভালো লাগার ঢেউও আমরা দেখতে পাব :
… তারাপদ অবসরের সময় নিজে ঘরে বসিয়া লিখিত এবং পড়া মুখস্থ করিত, ইহা সেই ঈর্ষাপরায়ণা কন্যাটির সহ্য হইত না; সে গোপনে তাহার লেখা খাতায় কালি ঢালিয়া আসিত, কলম চুরি করিয়া রাখিত, এমন-কি বইয়ের যেখানে অভ্যাস করিবার, সে অংশটি ছিঁড়িয়া আসিত। তারাপদ এই বালিকার অনেক দৌরাত্ম্য সকৌতুকে সহ্য করিত, অসহ্য হইলে মারিত, কিন্তু কিছুতেই শাসন করিতে পারিত না। (পৃ ২৩-২৪)
চারুশশীর এ-ধরনের আচরণ আর তারাপদর তা সহজভাবে গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে উভয়ের মনে গোপন এক সংযোগ-সেতু নির্মিত হয়ে যায়। সেই সেতুর খুঁটি নির্মাণে মনস্তাত্ত্বিক কী উপাদান ব্যবহৃত হয়েছে?
এখানে কি তারাপদর ভাববাদী দক্ষতা, উদাসীন-বিবাগী বৈশিষ্ট্য চাপা পড়ে যায়নি? মায়াময় বাস্তব জগতের সহজাত বন্ধন-বৈশিষ্ট্য অনন্য উচ্চতায় জেগে ওঠেনি? রবীন্দ্রনাথ তাঁর সৃষ্ট এই চরিত্রের মধ্যে কি একইসঙ্গে ভাববাদী ও বাস্তববাদী (রিয়ালিজম) সাহিত্যধারার দ্বন্দ্বসংকট ফুটিয়ে তোলেননি? আবেগের শৈল্পিক ব্যবহারের আলো ছড়িয়ে সংকটের মীমাংসা করার চেষ্টা করেননি? এসব প্রশ্ন উঠে আসে কৌতূহলী পাঠকের মনে।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে আমরা আরো দেখার সুযোগ পাই, মতিলালবাবুর বাড়িতে প্রায় দুই বছর কেটে যায় তারাপদর। ছোটগল্পের বিচারে দুই বছর সময়কাল কম নয়। এই দীর্ঘ সময়ে নানা ঘটনা-অণুঘটনা ঘটে যায় তারাপদ আর চারুশশীর জীবনেও।
মতিলালবাবুর একটি লাইব্রেরি আছে। সেখানে রয়েছে ইংরেজি ছবির নানা রকমের বই। ইংরেজি শিক্ষার অভাবে ছবির জগৎ থেকে রস গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছিল না তারাপদর। বহির্মুখী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং সহজে মানুষকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতার জন্য বাহিরের সংসারের সঙ্গে তার যথেষ্ট পরিচয় ঘটলেও ছবির জগতে প্রবেশ করতে পারছিল না সে। অন্তরে অতৃপ্তি রয়ে যেত। বিষয়টা খেয়াল করে মতিলালবাবু প্রশ্ন করলেন, ‘ইংরেজি শিখবে? তাহলে এ-সমস্ত ছবির মানে বুঝতে পারবে।’ তারাপদ তাৎক্ষণিক জবাব দিয়েছিল, ‘শিখব।’ (পৃ ২৩)
মতিলালবাবু খুশি হয়ে গেলেন। স্কুলের হেডমাস্টার রামরতনবাবুকে প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় এই বালকের ইংরেজি-অধ্যাপনা কাজে নিযুক্ত করে দিলেন।
আমরা লক্ষ করি, শেখার প্রতি তারাপদর আগ্রহ ছিল প্রবল। এর ভেতর থেকে তার মনস্তাত্ত্বিক দক্ষতা, মোটিভেশনাল ফোর্স বা ইনার ফোর্স বা অন্তর্গত প্রেষণার স্বরূপ দেখারও সুযোগ পেয়ে যান পাঠক। সে আগ্রহ স্বল্পকালীন ছিল না, ছিল স্থায়ী আর অখণ্ড মনোযোগী। তার স্মরণশক্তিও ছিল প্রখর। মনোযোগী হলে স্মরণশক্তি প্রখর হয়। মনোযোগ ধরে রাখা এবং স্মরণশক্তি প্রখর করে তোলার দক্ষতা মেধার বিষয়। মনস্তাত্ত্বিক এসব দক্ষতা এতই গভীর এবং বিশ্লেষণযোগ্য এ-কারণে যে, ভেতরের ঘরে গিয়ে অন্নপূর্ণার সামনে বসে আহার করতে বেশি সময় খরচ হয়ে যেত বিধায় মতিলালবাবুকে অনুরোধ করে সে বাইরে আহারের ব্যবস্থা করে নেয়। বালকের অধ্যয়নের উৎসাহ দেখে মতিলালবাবু অন্নপূর্ণার আপত্তি উপেক্ষা করে নতুন ব্যবস্থা অনুমোদন করেন। এখানেও আমরা লক্ষ করি, স্নেহের ক্ষুধার চেয়েও তার জ্ঞান অর্জনের ক্ষুধা ছিল বেশি, তার কগনিটিভ অনুষদ বা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা বেশ দাপুটে, শাণিত। জানা ও শেখার প্রতি তার ভেতরের তাড়না ছিল লক্ষ্যমুখী। আরো বলা যায়, প্রেষণার গোপন রসদের কথা, যা তার বাইরের আচরণের প্রকাশভঙ্গিকে নির্ধারণ করে দেয়। কেবল এ-ধরনের ঘটনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে গল্পের আলো তত উজ্জ্বলভাবে পাঠকের মনোজগৎ নাড়া দিত না। দেখা যাচ্ছে পরবর্তী ধাপে চারুশশী জিদ ধরে বলল, ‘আমিও ইংরেজি শিখিব।’ (পৃ ২৩)
একমাত্র অতি আদরের কন্যাকে ত্রুটিপূর্ণ প্যারেন্টিং স্টাইল বা ভুল পদ্ধতিতে অতি প্রশ্রয়ে বেড়ে উঠতে দেওয়ার কারণে চারুশশীর ব্যক্তিত্বের কিছু নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যের আলামত পেয়েছি আমরা। সে প্রশ্রয় পেয়েছে; পেয়ে পেয়ে হয়ে গেছে জেদি স্বভাবের। সে অস্থিরচিত্তের বালিকা – অবাধ্য, অশান্ত, দুরন্ত। সে ঈর্ষাপ্রবণ। আপন সম্পত্তি সোনামণি চুরি করে নিতে পারে ভেবে তারাপদকে আঁকড়ে রাখতে চায়, আবার তারাপদ তার পিতা-মাতার স্নেহের ভাগ বসাচ্ছে ভেবেও তার জন্য ঈর্ষামুখর হয়ে বিদ্বেষ পুষে রাখে মনে। সে রোদনমুখী এক দুর্ভেদ্য প্রহেলিকা; যখন প্রসন্ন থাকে তখন কিছুতেই তার কোনো আপত্তি থাকে না। কখনো অতি ভালোবাসা প্রকাশ করে মাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়, হেসে বকা দিয়ে অস্থির করে তোলে। একইভাবে সে হৃদয়ের দুর্বোধ্য বেগ প্রয়োগ করে তারাপদর পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটাতে লেগে যায়। পড়াশোনায় অমনোযোগী এই বালিকা পড়া মুখস্থ করতে পারে না, পিছিয়ে পড়ে। আবার দুর্বোধ্য কারণে তারাপদর পশ্চাতেও থাকতে চায় না। তারাপদ অবসর সময়ে নিজের ঘরে বসে আলাদা পড়াশোনা করে, লেখে, মুখস্থ করে, পুরনো বই শেষ করে নতুন বই কেনে। ঈর্ষাপরায়ণ কন্যার তা সহ্য হয় না। সে গোপনে তারাপদর লেখা খাতায় কালি ঢেলে দেয়, কলম চুরি করে নিয়ে আসে। ইতঃপূর্বে আমরা তা জেনেছি।
(চারুশশী) ‘কখনো রাগ, কখনো অনুরাগ, কখনো বিরাগের দ্বারা তাহার (তারাপদর) পাঠচর্চার নিভৃত শান্তি অকস্মাৎ তরঙ্গায়িত করিয়া তুলিত।’ (পৃ ২৬) প্রশ্ন আসতে পারে এই তরঙ্গ কী?
মনস্তাত্ত্বিক দ্বার খুলে দিলে দেখা যাবে, এটি হচ্ছে আবেগ, আবেগের ঢেউ, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্নায়ুতন্ত্রের ভেতর থেকে জেগে উঠে মনোভুবনে আলোড়ন তোলে। দেহের ভেতরের কিংবা বাইরের উদ্দীপক এই তরঙ্গায়িত অবস্থা সৃষ্টি করে। এই আলোড়নের ব্যক্তিগত অনুভূতি হচ্ছে ভালো লাগা। আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বলা যায়, ভালোবাসা। এ প্রজন্মের শাব্দিক অর্থের আলোকে বিশ্লেষণ করে ‘ক্রাশ’ শব্দটাও কাছাকাছি অনুরাগ বোঝাতে আমরা ব্যবহার করতে পারি। এক্ষেত্রে বাইরের উদ্দীপক হলো চারুশশী আর তার দুর্বোধ্য আচরণ।
বিবাগী বৈশিষ্ট্যের অধিকারী তারাপদর বিশেষ আরেকটা মনোজাগতিক দিকে নিশানা করতে পারি আমরা :
এত সুদীর্ঘকালের জন্য তারাপদ কখনও কাহারও নিকট ধরা দেয় নাই। বোধ করি, পড়াশুনার মধ্যে তাহার মন এক অপূর্ব আকর্ষণে বদ্ধ হইয়াছিল; বোধ করি, বয়োবৃদ্ধিসহকারে তাহার প্রকৃতির পরিবর্তন আরম্ভ হইয়াছিল এবং স্থায়ী হইয়া বসিয়া সংসারের সুখ স্বচ্ছন্দতা ভোগ করিবার দিকে তাহার মন পড়িয়া ছিল; বোধ করি, তাহার সহপাঠিকা বালিকার নিয়তদৌরাত্ম্যচঞ্চল সৌন্দর্য অলক্ষিতভাবে তাহার হৃদয়ের উপর বন্ধন বিস্তার করিতেছিল। (পৃ ২৫)
এই বন্ধনের মর্মমূলে গিঁট দিয়েছে ভালো লাগা, আবেগ-অনুভূতি, বললে ভুল বলা হবে না। সাহিত্য মতবাদ রোমান্টিসিজম কিংবা সেন্টিমেন্টালিজম আলো ছড়ায় এই আখ্যানে। আবেগের শৈল্পিক ব্যবহার ঘটে এই অনুভবের ভেতর দিয়ে।
আরো একটু গভীরভাবে আমরা তারাপদকে পর্যবেক্ষণ করতে চাই। দেখে নিতে চাই কীভাবে তাকে নতুন স্বপ্নের জালে জড়িয়ে ফেলল ভালো লাগার তরঙ্গটি? কীভাবে স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র নিউরোসায়েন্স মতবাদের প্রকাশ ঘটিয়েছে?
তাহাতে আজকাল এই নির্লিপ্ত মুক্তস্বভাব ব্রাহ্মণবালকের চিত্তে মাঝে মাঝে ক্ষণকালের জন্য বিদ্যুৎস্পন্দনের ন্যায় এক অপূর্ব চাঞ্চল্য সঞ্চার হইত। যে ব্যক্তির লঘুভার চিত্ত চিরকাল অক্ষুণ্ন অব্যাহতভাবে কালস্রোতের তরঙ্গচূড়ায় ভাসমান হইয়া সম্মুখে প্রবাহিত হইয়া যাইত, সে আজকাল এক-একবার অন্যমনস্ক হইয়া বিচিত্র দিবাস্বপ্নজালের মধ্যে জড়ীভূত হইয়া পড়ে। এক-একদিন পড়াশুনা ছাড়িয়ে দিয়া সে মতিবাবুর লাইব্রেরির মধ্যে প্রবেশ করিয়া ছবির বইয়ের পাতা উল্টাইতে থাকিত; সেই ছবিগুলোর মিশ্রণে যে কল্পলোক সৃজিত হইত তাহা পূর্বেকার হইতে অনেক স্বতন্ত্র এবং অধিকতর রঙিন। চারুর অদ্ভুত আচরণ লক্ষ্য করিয়া সে আর পূর্বের মতো স্বভাবত পরিহাস করিতে পারিত না, দুষ্টামি করিলে তাহাকে মারিবার কথা মনেও উদয় হইত না। নিজের এই গূঢ় পরিবর্তন, এই আবদ্ধ আসক্ত ভাব তাহার নিজের কাছে এক নূতন স্বপ্নের মতো মনে হইতে লাগিল। (পৃ ২৬)
মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের জন্য কয়েকটি শব্দ এখানে গুরুত্বপূর্ণ : ‘অপূর্ব চাঞ্চল্য’, ‘অন্যমনস্ক’, ‘সৃজিত কল্পলোক’, ‘স্বতন্ত্র’, ‘অধিকতর রঙিন’, ‘দিবাস্বপ্নের জাল’, ‘গূঢ় পরিবর্তন’, ‘আবদ্ধ আসক্ত ভাব’, ‘নূতন স্বপ্নের মতো’ ইত্যাদি। এসব শব্দের অন্তর্নিহিত ঐশ^র্য হলো ‘ভালোবাসা’, ইতিবাচক আবেগ। মস্তিষ্কের স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আবেগ জাগিয়ে তোলে। এখানে রয়েছে নিউরোসায়েন্সের জৈবরাসায়নিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার চুম্বকীয় টান। ভালোবাসার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে গেছে এসব শব্দবিন্যাসের উজ্জ্বল আলোয়।
তাহলে প্রশ্ন ওঠে, কেন চারুশশীসহ গ্রামের মানুষের ভালোবাসা চুরি করে শেষ মুহূর্তে পালিয়ে গেল তারাপদ? কেবলি কি তার দেশত্যাগী উদাসীন বৈশিষ্ট্যের কারণে?
মনস্তত্ত্বের ভাষা বলে, একই ঘটনাকে একেক জন একেক ভাবে মূল্যায়ন বা বিচার করতে পারেন। এই বৈচারিক মূল্যায়নের জন্য প্রয়োজন পাঠকের পাঠমগ্নতা এবং জীবনঘনিষ্ঠ বোধ, বিচক্ষণতা ও অতীত অভিজ্ঞতা। পারসেফচুয়েল কোয়ালিটি বা প্রত্যক্ষণের জোরালো শান কিংবা কগনিটিভ ইন্টারপ্রিটেশন বা বুদ্ধিভিত্তিক বিশ্লেষণ যথাযথভাবে প্রত্যক্ষণের ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয় এবং চিন্তনের যুক্তিপ্রয়োগ আর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও। এসব মনস্তাত্ত্বিক বিষয়-আশয়ের কারণে আমাদের নানা কিছু ভাবতে শেখায়, একই ঘটনাকে নানাভাবে দেখার চোখ খুলে দেয়।
লেখক কি এই গল্পে সাহিত্যশিল্প নির্মাণ করে শেষ মুহূর্তে দ্বিমুখী পথের নিশানা ঠিক করে দেননি?
আখ্যানের শেষের দিকে আমরা দেখতে পাই, তারাপদর সঙ্গে অতি গোপনে চারুশশীর বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু তাকে কিছুই জানানো হয়নি। আনুষ্ঠানিকতার যাবতীয় আয়োজন গোপনে চলতে থাকে। কলকাতার মোক্তারকে গড়ের বাদ্য বায়না দিতে আদেশ দেওয়া হয়, জিনিসপত্রের ফর্দ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তারাপদর মা ও ভাইদের আনতেও লোক পাঠান মতিলালবাবু।
কিন্তু সবশেষে আমরা কী দেখি?
পরদিন তারাপদর মাতা ও ভ্রাতাগণ কাঁঠালিয়ায় আসিয়া অবতরণ করিলেন, পরদিন কলিকাতা হইতে বিবিধ সামগ্রীপূর্ণ তিনখানা বড়ো নৌকা আসিয়া কাঁঠালিয়ার জমিদারি কাছারির ঘাটে লাগিল এবং পরদিন অতি প্রাতে সোনামণি কাগজে কিঞ্চিত আমসত্ত্ব এবং পাতার ঠোঙায় কিঞ্চিৎ আচার লইয়া ভয়ে ভয়ে তারাপদর পাঠগৃহদ্বারে আসিয়া নিঃশব্দে দাঁড়াইল, কিন্তু পরদিন তারাপদকে দেখা গেল না। (পৃ ২৭)
কেন সে পালিয়ে গেল?
কেবলই কি ভাববাদী বিবাগী বৈশিষ্ট্যের জন্য? বন্ধনমুক্ত থাকার মানসেই কি সে মেঘাচ্ছন্ন অন্ধকার রাতে উধাও হয়ে গেল আসক্তিবিহীন উদাসীন জননী, বিশ^পৃথিবীর কাছে?
কোথাকার কার সঙ্গে চারুশশীর বিয়ে হচ্ছে জানত না সে। তবে চারদিকে আয়োজনের আলামত দেখে সে কি ভাবতে পারে না যে, অন্য কারো সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে চারুশশীর। অতলের ভালো লাগা কিংবা ভালোবাসার চুম্বক টানে ক্রমশ জড়িয়ে যাওয়ার কারণে আসন্ন বিচ্ছেদবেদনার অগ্রিম শর কি বিদ্ধ করেনি, করতে পারে না তাকে?
এসব প্রশ্নও জাগতে পারে পাঠকমনে।
এখানেই সাহিত্যশিল্পের অন্যরকম ঐশ^র্য দেখার সুযোগ পেয়ে যান পাঠক।
প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আচরণের মোটিভটাও খুঁজে বের করতে হবে।
এই শরবিদ্ধ আচরণের পেছনে কি আবেগের টান, মনস্তত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ অনুষদ প্রেষণার মধ্যে তাড়িত হওয়া ভালোবাসার গোপন ঢেউ আর চাহিদা, অন্যের প্রিয় হওয়ার গোপন প্রণোদনা কিংবা প্রিয়জন হয়ে ওঠা চারুশশীকে হারানোর বেদনা লুকিয়ে থাকতে পারে না?
এ-বিষয়ে পাঠকের পাঠ-উপলব্ধির তারতম্য ঘটতে পারে, বিতর্ক হতে পারে জনে জনে। তবে ঠিক উত্তরটি খুঁজে পেলে প্রশ্ন তোলা যাবে, এই গল্পের প্রোটাগনিস্ট কি কেবলই তারাপদ? চারুশশীর অবস্থান কি একেবারেই তুচ্ছ, নগণ্য? নাকি যৌথভাবে উভয়েই প্রোটাগনিস্ট বা প্রধান চরিত্র? শুরুতেই এ-বিষয়ে প্রশ্ন রেখেছিলাম।
কয়েকটি ঘটনায় আমরা চারুশশীর সখী সোনামণি চরিত্রটি দেখার সুযোগ পাই। বোঝা যায়, তারাপদর প্রতি সেও অনুরাগী হয়ে ওঠে। কিন্তু সে চারুশশীর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে না কিংবা লেখক তাকে ভিলেন বা প্রতিদ্বন্দ্বী রূপে উপস্থাপনও করেননি। কেবল তার মনোজগতের নির্মোহ, নিরীহ, সহজ-সরল মমতার প্রকাশভঙ্গি দেখা যায় শেষচিত্রে। পাতার ঠোঙায় কিঞ্চিৎ আমসত্ত্ব আর আচার নিয়ে আসার মধ্য দিয়ে তার অন্তরের অন্য আলোর প্রকাশ ঘটেছে, তা উজ্জ্বল এবং নির্মল। সোনামণিকে আমরা তাই ছোট্ট চরিত্র বলে উপেক্ষা করতে পারি না। বরং বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ মহান মমতার মনোজাগতিক ছোঁয়া দিয়ে ছোটগল্পের ইতিহাসে ছোট চরিত্রটিকে কালজয়ী করে দিয়েছেন। এখানেও রবীন্দ্রনাথ অনন্য, অবিস্মরণীয় ক্ষমতাধর সৃজনশীল মনোবিজ্ঞানী।
প্রিয় পাঠক, আপনি কী বলেন?
তথ্যসূত্র
ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত গল্পগুচ্ছের প্রথম গল্প ‘অতিথি’ থেকে উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়েছে এই বিশ্লেষণে। প্রকাশকাল : কার্তিক ১৪২৯, অক্টোবর ২০২২।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.