আবু সাঈদ তুলু
সম্প্রতি প্রাঙ্গণেমোর প্রযোজনা করেছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চরিতমানস নিয়ে তথ্যবহুল নাটক আমি ও রবীন্দ্রনাথ। নাটকটির রচনা ও নির্দেশনায় নূনা আফরোজ। এ-নাটকে রবীন্দ্রনাথের জীবনের নানা কৌতূহলোদ্দীপক অধ্যায় যেমন উন্মোচিত হয়েছে, তেমনি হয়ে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের মঞ্চজীবনী। মঞ্চে রবীন্দ্র-চরিত্রের উপস্থিতির মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথের জীবন, দর্শন ও লেখনীর প্রেক্ষাপটসহ তাঁর সমকালীন নানা বিষয় অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে নাটকে। গত ২৬ ফেব্রম্নয়ারি ঢাকার সেগুনবাগিচার শিল্পকলার এক্সপেরিমেন্টাল হলে নাটকটির প্রদর্শনী হয়। ওই প্রদর্শনীর ওপর ভিত্তি করে রবীন্দ্রনাথের জীবনী প্রসঙ্গ, নাট্যরূপায়ণ, নাটকে বিধৃত রবীন্দ্রনাথ চরিতমানস, নাটকীয়তা, প্রযোজনা-বৈচিত্র্য, উপস্থাপন মনসত্মত্ত্ব, দর্শক-উপযোগিতা ও নান্দনিকতার স্বরূপ অনুসন্ধান লেখাটির মূল অভীষ্ট।
আমি ও রবীন্দ্রনাথ নাটকটি প্রাঙ্গণেমোর নাট্যদলের নবম প্রযোজনা। রবীন্দ্রনাথের নাট্যচর্চার প্রাধান্যে গঠিত এ-নাট্যদল ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে ইতোমধ্যে উপহার দিয়েছে অনন্যসব প্রযোজনা। তারুণ্য, শৈল্পিক মূল্যবোধ ও রবীন্দ্রচর্চার অনুপ্রেষণজাত আদর্শ এবং নান্দনিক প্রযোজনা নিয়ে ইতোমধ্যে নিজস্ব পরিচয়ে সুদৃঢ় আসন লাভ করেছে প্রাঙ্গণেমোর। দলটির নেতৃত্বে আছেন অনন্ত হীরা ও নূনা আফরোজ। রবীন্দ্রনাথের গান থেকে নেওয়া শব্দবন্ধের দ্বারা দলের নামকরণ করা হয়েছে। ‘প্রাঙ্গণেমোর’ নামকরণের মধ্যেই শিল্প-উৎসর্গিত চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। তাদের শিল্পপ্রাঙ্গণে শিল্প-উপভোগে দর্শককে আহবানই প্রতীয়মান হয়। সত্যিই আমি ও রবীন্দ্রনাথ নাট্য প্রযোজনা দিয়ে দর্শকদের নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের শিল্পভূমে বা শিল্পের উঠানে। চেতনার সম্প্রসারণ, শিখন ও বিনোদনের অপূর্ব সমন্বয় উপহার দিয়েছেন সেদিন। দলটি ইতোমধ্যে ‘দুই বাংলার রবীন্দ্র নাট্যমেলা’, ‘প্রাঙ্গণেমোর নাট্যোৎসব’ প্রভৃতি শিরোনামে উৎসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে নাট্যাভিজ্ঞতার সমৃদ্ধিতে অগ্রণী ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত প্রাঙ্গণেমোর নাট্যদলের উলেস্নখযোগ্য প্রযোজনা – স্বদেশী, শ্যামাপ্রেম, রক্তকরবী, আওরঙ্গজেব, লোকনায়ক, শেষের কবিতা, ঈর্ষা প্রভৃতি। প্রায় প্রতিটি নাটকই দর্শকনন্দিত এবং সৃজনশীলতার স্বাক্ষর বহন করে।
নবম প্রযোজনা হিসেবে বেছে নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষেতকে। নির্দেশনার দায়িত্ব নিয়েছেন দলেরই জ্যেষ্ঠ সদস্য নূনা আফরোজ। নাটকটির নামকরণ করেছেন আমি ও রবীন্দ্রনাথ। এক ভক্ত পাঠিকার দৃষ্টিতে রবীন্দ্র-জীবন, মানস ও সাহিত্য-চেতনার উন্মোচনই নাটকটির মূল উপজীব্য। মঞ্চে রবীন্দ্র-চরিত্রের ক্রিয়াশীলতার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন, দর্শন ও লেখনীর নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ অনুষঙ্গ ফুটে উঠেছে নাটকে।
বাংলা ভাষাভাষীর কাছে রবীন্দ্রনাথকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। বিশ্বজয়ী বাঙালি কবি ও ব্রাহ্ম দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) বাংলার সর্বসত্মরেই অতিপরিচিত। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারজয়ী এ-কবি বিশ্বকে ধারণ করেছেন তাঁর লেখনীতে। তাঁর জীবনের নানা পর্বে নানা নিরীক্ষা কিংবা সাহিত্যাদর্শের নানা পরিবর্তন ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথ বাংলা কাব্যসাহিত্যের এক নতুন যুগের ধারক-বাহক। এ-নাটকে প্রয়োজনানুসারে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের বিসত্মৃত জীবনের অতিগুরুত্বপূর্ণ এবং বিশেষ অংশগুলো নেওয়া হয়েছে। বিশেষত বাঙালি পাঠকের কাছে কৌতূহলী বিষয়গুলোকেই প্রাধান্য দিয়ে নাটকীয়তায় রবীন্দ্র-জীবন ও মানস উপস্থাপিত হয়েছে এ-নাটকে।
নাটকে দেখা যায়, অথৈ নামে এক রবীন্দ্রভক্ত তার বন্ধুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য কুঠিবাড়িতে বেড়াতে যায়। পারিবারিক জমিদারির সূত্রে ১৮৮৯/১৮৯১-১৯০১ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনিয়মিতভাবে এ-কুঠিবাড়িতেই অবস্থান করতেন। এখানে বসেই সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালী প্রভৃতি কাব্য রচনা করেছেন। এছাড়া গীতাঞ্জলি কাব্যের অনুবাদসহ তাঁর ছোটগল্প রচনার বিকাশও ঘটেছে এখানে। বর্তমানে এটি রবীন্দ্র-স্মৃতিবিজড়িত পর্যটনকেন্দ্র। কাহিনিতে এ-কুঠিবাড়ির কক্ষ ঘুরে দেখতে-দেখতে একসময় হ্যালুসিনেশনে চলে যায় অথৈ। মঞ্চে উপস্থিত হন স্বয়ং ২৯ বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ। ভক্ত পাঠিকা অথৈ ক্রমশ হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রপ্রেমিকা। রবীন্দ্রনাথ নিজেই নিজের পরিচয়কে অথৈর সামনে তুলে ধরতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ভক্ত অথৈ চায়নি রবীন্দ্রনাথ রঘুপতি চরিত্রে অভিনয় করুক। তাঁর রচিত রাজর্ষী উপন্যাসের প্রথম অংশ নিয়ে লেখা বিসর্জন নাটকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২৯ বছর বয়সে রঘুপতি এবং ৬৯ বছর বয়সে জয়সিংহ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, নিজেদের ঠাকুরবাড়ির নাট্যশালায়। বিসর্জন নাটকে জয়সিংহ আত্মত্যাগী মানবতাবাদের প্রতীক। অন্যদিকে রঘুপতি সনাতন ধর্মীয় সমাজের আধিপত্য ও ভ-ামির প্রতীকরূপে বিবেচ্য। এ-নাটকে রবীন্দ্রনাথকে মহৎ হিসেবেই দেখতে চেয়েছিল অথৈ। অথচ রবীন্দ্রনাথ নিজের যুগ-যন্ত্রণাকে বড় করে দেখেছেন। এতে দর্শকের কাছে রবীন্দ্রনাথের অভিনেতার পরিচয়ও বিধৃত হয়। হঠাৎ ২৯ বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথের কাছে অথৈ যেন নিজেই হয়ে ওঠেন অপর্ণা। অপর্ণা ও জয়সিংহের নতুন এক উদ্বেলিত প্রেমের রূপ ধরা দেয়। নব্য এ-নাট্যাংশে ছাগশিশু হত্যার প্রসঙ্গ নেই। আছে সমকালীন জীবন-যন্ত্রণার পরিপ্রেক্ষেতে দুটো হৃদয়ের মিলনের আর্তি। এ যেন নতুন সময়ের, নতুন কালের জয়সিংহ-অপর্ণা। হঠাৎ মায়ার বন্ধন কেটে যায় অথৈর।
৬৯ বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত হয় অথৈর সামনে। এ-সময়ের জয়সিংহের অভিনয়কারী রবীন্দ্রনাথকে ভালো লাগলেও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো কিংবা মৈত্রেয়ী দেবীকে ঈর্ষা করে অথৈ। প্রসঙ্গত, আর্জেন্টিনার লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো গীতাঞ্জলির ফরাসি ভাষায় অনুবাদ পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। ১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অসুস্থ অবস্থায় আর্জেন্টিনায় অবস্থানকালে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। সেখানে প্রায় দুই মাস ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ওকাম্পোকে ‘বিজয়া’ নামে ডাকতেন। ১৯২৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পূরবী কাব্যগ্রন্থটি ওকাম্পোকে উৎসর্গ করেন। ১৯৩০ সালে প্যারিসে রবীন্দ্রনাথের প্রথম চিত্রপ্রদর্শনীর ব্যবস্থাও করেছিলেন ওকাম্পো। ওকাম্পোর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ ছিল। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক নিয়ে নানা গুঞ্জন প্রচলিত আছে। একইভাবে মৈত্রেয়ী দেবীর প্রতি রবীন্দ্রনাথের অনুরক্তির কারণে সাধারণে রবীন্দ্র-মৈত্রেয়ী সম্পর্ক নিয়েও নানা গুঞ্জনের ঝড় ওঠে। ফ্রান্সে মির্চা এলিয়াদে লা নুই বেঙ্গলি উপন্যাস প্রকাশিত হলে রবীন্দ্রভক্ত মৈত্রেয়ী দেবী ব্যাপক আলোচিত হন। এতে রবীন্দ্রনাথ ও মৈত্রেয়ী দেবীকে নিয়ে নানা কথা আছে। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে মৈত্রেয়ী দেবীর নহন্যতে উপন্যাস প্রকাশ পায়। নহন্যতে উপন্যাসের অধিক অংশ জুড়ে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের প্রতি ভক্তি, তাঁর গান-কবিতা। মৈত্রেয়ী দেবী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠজন অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের কন্যা। শৈশব থেকেই রবীন্দ্র-কাব্যের ভক্ত। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাবশিষ্য। তাঁর স্বামী ছিলেন মনমোহন সেন। মৈত্রেয়ী দেবীর অনুরোধে তাঁদের বাড়ি ‘মংপুতে’ রবীন্দ্রনাথ এসে থাকতেন। রবীন্দ্রনাথের এক জন্মদিনও মৈত্রেয়ী দেবী ও তাঁর স্বামী এ-বাড়িতে পালন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের অন্তরঙ্গ স্মৃতি নিয়ে মৈত্রেয়ী দেবীর রচিত মংপুতে রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থটি রবীন্দ্র-জীবনেতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নারীর স্বভাবসুলভ আচরণে অথৈ ঈর্ষা করে ওকাম্পো ও মৈত্রেয়ী দেবীকে। আমি ও রবীন্দ্রনাথ নাটকে অথৈর সঙ্গে কথোপকথনের ধারায় ধীরে-ধীরে উন্মোচিত হয় ওকাম্পো ও মৈত্রেয়ী দেবীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের স্বরূপ। ভক্ত-পাঠক অথৈ হাজারো নারীর মতো একান্তভাবেই পেতে চায় রবীন্দ্রনাথকে। অথৈ প্রায় প্রতিটি ছোটগল্পের নারীর সঙ্গেও নিজের সাদৃশ্য খুঁজে পায়। অথৈ যখন সমকালীন কবি সৈয়দ শামসুল হক ও ঈর্ষা কাব্যনাটক প্রসঙ্গ তুলে কবির প্রতি অনুরক্তির ইঙ্গিত দেয়, তখন রবীন্দ্রনাথও ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠেন। নাটকটিতে পাঠক ও লেখকের মধ্যে এক অনবদ্য ভক্তি, প্রেম ও নিবেদনের অপরূপ মহিমা উপস্থাপিত হয়েছে।
বউঠান কাদম্বরীর সম্পর্ক নিয়ে কথোপকথনের ধারায় উন্মোচিত হয় রবীন্দ্র-বংশধারা, উচ্চাভিলাসী বড় বউঠান জ্ঞানদানন্দিনী, কাদম্বরীর অসহায়ত্ব, কাদম্বরীর জীবন, রূপ, সমত্মানহীনতা, নিঃসঙ্গতা, মৃণালিনীসহ ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের নানা বিষয়। তখন কাদম্বরীর বিচ্ছেদ প্রসঙ্গ বড় হয়ে ওঠে। প্রাসঙ্গিক যে, কাদম্বরী মাত্র নয় বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের বড়ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে এ-বাড়িতে এসেছিলেন। বাবা ছিলেন ঠাকুরবাড়ির বাজার সরকার শ্যাম গাঙ্গুলি। বয়সে কাদম্বরীর চেয়ে রবীন্দ্রনাথ দুই বছরের ছোট ছিলেন। বয়সগত কারণেই কাদম্বরীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তিনি সহপাঠী ও বন্ধুত্বের কারণে রবীন্দ্রনাথকে নানাভাবে কাব্যচর্চায় উৎসাহ জুগিয়েছেন। এ-বন্ধুত্ব নিয়ে নানা গুঞ্জন প্রচলিত রয়েছে। বিশেষত রবীন্দ্রনাথের বিয়ের চার মাস পর যখন কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করেন। কাদম্বরীর আত্মহত্যাটি ঠাকুর পরিবার নানাভাবে ধামাচাপা দিয়েছিল। কাদম্বরীর সুইসাইড নোট বা রবীন্দ্রনাথকে লেখা চিঠি
প্রকাশের পর ঘটনা আরো জটিলতর হয়ে ওঠে। কাদম্বরী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-সাধনার মূল প্রেরণাদাত্রী। বিহারীলালের মতো কাব্য রচনার প্রত্যাশায় রবীন্দ্রনাথের ওপর বারবার অনুপ্রেষণ তৈরি করতেন। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন কবিতা, গান কিংবা গল্পে প্রচ্ছন্নভাবে কাদম্বরীকে পাওয়া যায়।
একুশ বছরের রবীন্দ্রনাথের আগমন ঘটে। ধীরে-ধীরে অথৈ যেন নিজেই কাদম্বরী হয়ে ওঠেন। অথৈ যেন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে অসহায় নিঃসঙ্গ কাদম্বরী। প্রেম-ভালোবাসা ও কথোপকথনের মধ্য দিয়ে কাদম্বরীর আত্মাভিমান ও ঠাকুর পরিবারের গঞ্জনাসহ নানা প্রসঙ্গ উঠে আসে। লেখনীর বিকাশে কাদম্বরীর ভূমিকাসহ নানা আবেগী প্রসঙ্গ স্থান পায়। বন্ধুত্ব, প্রেম, আবেগ ও উদ্দামতায় দুজনই উন্মাতাল তখন। একসময় শারীরিক চাওয়া-পাওয়ার কাছে পরাভূত দুজন – তা নানা প্রতীকে উপস্থাপিত হয়। নাটকটিতে এ-পর্বই সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় ও স্পর্শকাতর নাটকীয়তায় উপস্থাপিত।
আজকের অথৈ রক্তকরবীর চরিত্রের মতোই পাগল। রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী নাটকের প্রসঙ্গ ওঠে নাটকে। রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর-রচিত এ-নাটকে যক্ষপুরীতে যখন প্রেম-ভালোবাসা-মানবতাহীন যন্ত্রকাঠামোয় শৃঙ্খলিত মানুষ, তখন অন্য সবার মতো নন্দিনীকেও ধরে নিয়ে আসা হয়। নন্দিনী মুক্তি, প্রেম ও সুন্দরের প্রতীক। ধীরে-ধীরে নন্দিনীর অমিয় আনন্দস্পর্শ যক্ষপুরীর মানুষকে লোভ থেকে, ধর্মসংস্কারের মোহ থেকে, অত্যাচার-অবিচার, দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির আহবান জানায়। নাটকে বিশুর গানের মধ্যে নন্দিনী যেমন তাঁর কাঙিক্ষত অরূপের সন্ধান পায়, তেমনি বিশু পাগলও নন্দিনীকে গান শোনাতে ভালোবাসে। প্রাঙ্গণেমোরের এ-নাটকে অথৈ আশি বছরের রবীন্দ্রনাথের চেয়ে চিরন্তন রবীন্দ্রনাথকেই একান্ত করে চায়। নিজে নন্দিনী হয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রচারেই যেন আত্মোৎসর্গিত অথৈ। সমাজের নানা প্রতিকূলতায়ও যেন আজীবনই অথৈ নন্দিনী। রবীন্দ্রনাথ জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে বিশু পাগল হওয়ার চেয়ে চিরবিদায় গ্রহণেই উন্মুখ। তাই আজ রবীন্দ্রনাথ ‘বিদায় অভিশাপে’র কচের ভূমিকায় অবতীর্ণ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-রচিত এ-কবিতায় দেবতারা যখন শুক্রাচার্যের সঙ্গে কৌশলে পারছিলেন না, তখন বৃহস্পতির পুত্র কচকে শুক্রাচার্যের কাছে পাঠান, যাতে কচ সঞ্জীবনীবিদ্যা শিখে আসে। কচ শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানীকে নানাভাবে সন্তুষ্ট করে শুক্রাচার্যের শিষ্যত্ব পায়। কয়েকবার কচ মারা গেলেও দেবযানীর অনুরোধে পুনঃজীবন লাভ করেন। কৌশলে কচ সঞ্জীবনী বিদ্যা শিখে দেবতালোকে ফেরত যেতে চাইলে দেবযানী অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠেন। পরস্পর পরস্পরকে অভিশাপ দেন। দুজনের বিদায়ের বিষাদময় কথোপকথনই ‘বিদায় অভিশাপ’ কবিতা। কচ যেমন স্বার্থ উদ্ধারের পর বিষাদঘন অভিশাপে দেবযানীর কাছ থেকে চিরবিদায় নিয়েছিল, তেমনি অথৈর কাছেও রবীন্দ্রনাথের চিরবিদায়ের সুর বেজে ওঠে। মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রবীন্দ্রনাথ-রচিত কবিতাগুলো কবির কণ্ঠে ধীরে-ধীরে আবৃত্তি হতে থাকে। এ-বিদায় যেন চিরবিদায়। হুইলচেয়ারে বসা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অন্য বয়সী রবীন্দ্রনাথরা ধীরে-ধীরে দূরে চলে যেতে থাকে। গান বাজতে থাকে – যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে। হঠাৎ ধ্যান ভাঙে অথৈর। এতক্ষণ মতিভ্রমে ছিল সে। এক বিদায়ী আবহের মধ্যে দিয়ে নাটকের পরিসমাপ্তি ঘটে।
নাট্যকার নাটকের নামকরণ করেছেন আমি ও রবীন্দ্রনাথ। এক্ষেত্রে নাট্যকার দর্শককে কোনো ফাঁকি দেননি। পাঠক-চেতনার সঙ্গে লেখক-চেতনার এক মিথস্ক্রিয়া ঘটেছে নাটকে। রবীন্দ্রনাথের বংশপরিচয়, অভিনেতা ও নাট্যকার হিসেবে রবীন্দ্রনাথের কর্ম, বিসর্জন নাটক, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, মির্চা এলিয়াদের লা নুই বেঙ্গলি, মৈত্রেয়ী দেবীর নহন্যতে, কাদম্বরী দেবীর সুইসাইড নোট, বড় বউঠান জ্ঞানদানন্দিনী, ‘নিষ্ফল কামনা’ কবিতা, ভানুসিংহের পদাবলি, রক্তকরবী নাটক, ‘বিদায় অভিশাপ’ কবিতা, কাব্যগ্রন্থ শেষলেখা প্রভৃতি রবীন্দ্রজীবন-ঘনিষ্ঠ নানা বিষয় কাহিনির গতিশীলতায় ভূমিকা রেখেছে। সৈয়দ শামসুল হকের ঈর্ষা নাটক প্রসঙ্গও এসেছে নাটকে। এসব নানা বিষয়কেই উপজীব্য করে রবীন্দ্রনাথের জীবন ও মানস নাট্যকার চিত্রিত করেছেন নাটকে।
নাট্যকারের মূল মনোযোগ ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবন ও মানস উপস্থাপন। প্রচুর তথ্যের সমন্বয় ঘটিয়েছেন নাট্যকার। চারটি স্কেচকে ধরে জীবন-পরিক্রমাটি ব্যাখ্যা করেছেন। কাহিনির মধ্যে নাটকীয়তা সৃষ্টি করেছেন। নাট্যকারের আরেকটি চ্যালেঞ্জ ছিল চার বয়সী চারটি রবীন্দ্র-চরিত্রকে যৌক্তিকতায় উপস্থাপন করা। কাহিনি উপস্থাপনে কখনো প্রলেপ বা সংক্ষেপ্ত কিংবা ভাঁড়ামি মনে হয়নি। ঘটনার পরম্পরায় নান্দনিক ব্যাখ্যানেই চরিত্রগুলোর প্রবেশ-প্রস্থান। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যচর্চার প্রেক্ষাপটেও অত্যন্ত স্থিতধীর পরিচয় মেলে। ঘটনা কিংবা সাহিত্যকর্মের নেপথ্যগুলো ও ঘটনার পরিপ্রেক্ষেতে উদ্ধৃত কবিতাগুলো তুলে ধরা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। গভীর পাঠ কিংবা উঁচুসত্মরের গবেষণার পরিচয়ই বহন করে। প্রচুর ক্রস রেফারেন্সও ব্যবহৃত হয়েছে নাটকে, যা রবীন্দ্রনাথের চেতনার বিকাশ অনুধাবনে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে।
ইউরোপীয় প্রসেনিয়াম মঞ্চধারায় নাটকটির উপস্থাপন। মঞ্চটি রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ির অভ্যন্তরের প্রতীকী রূপ। পেছনে একটি উঁচু পাটাতন। তার দুপাশে সিঁড়ি লাগানো। পাটাতনের গায়ে কাপড়ে রবীন্দ্রনাথের হাতে লেখা কবিতার লাইন। একটু সামনে দুপাশে রবীন্দ্রনাথের ভিন্নবয়সী চারটি ছবি। পাশে আরেকটি মুভিং সিঁড়ি। এটি দোতলা বাড়িতে ওপরে ওঠার প্রতীক। মঞ্চ ব্যবহারের কম্পোজিশনও অত্যন্ত চমৎকার।
বিনির্মাণবাদী ধারায় নব্য এক কাহিনির আলেখ্যে বাংলা সাহিত্যের কিংবদমিত্ম কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-চরিত্র অত্যন্ত নিপুণতায় উপস্থাপিত। নতুন একটি নির্মোহ গল্পের সৃষ্টি হয়েছে, যাতে রয়েছে এক পাঠকের প্রিয় লেখককে নিয়ে কল্পনা। নতুন এ-গল্পের প্রধান চরিত্র পাঠক অথৈ ও কালজয়ী সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের জীবনের নানা তাৎপর্যময় ঘটনা এ-নাটকের মধ্যে দিয়ে দর্শকের কাছে পৌঁছা। এ-মঞ্চনাটক রবীন্দ্রনাথের লেখনীর বিকাশ ও সমগ্রতা সম্পর্কে দর্শকের মধ্যে একটি সাধারণ ও সুস্পষ্ট ধারণার জন্ম দেয়। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা ক্ষুদিরাম দাসের গ্রন্থ পড়ে রবীন্দ্র-জীবন ও চেতনা সম্পর্কে যেমন উপলব্ধি জন্মে। এ-নাটক অতিসহজে বিনোদনের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ও বিকাশ সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা দেয়। অত্যন্ত সত্য যে, এ-নাটক থেকে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে একটা ধারণা জন্মে বটে। এটা কিন্তু রবীন্দ্রজীবনী পাঠ নয়, বা রবীন্দ্রসমগ্র নয়। রবীন্দ্র-জীবন ও চেতনা আরো ব্যাপক। এ যেন খেলাচ্ছলে রবীন্দ্রনাথের জীবনী শেখানো।
নাটকটি একটি ছোট্ট ইস্যুর মধ্যে দিয়ে আরম্ভ। রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি দর্শন। মাঝে রবীন্দ্র-পরিক্রমণ। শেষে ফেরত আসার মধ্যে দিয়ে শেষ। কৌতূহলের মধ্যে দিয়ে শুরু। টান-টান শ্বাসরুদ্ধ কাহিনির উপস্থাপন। ফলে এ-নাটকের সময়টা কীভাবে চলে যায় তা সাধারণ দর্শক বুঝতেই পারে না।
নির্দেশক নূনা আফরোজ বলেন, ‘লেখকের মনের কথা যখন পাঠকের মনের কথা হয়ে যায়, তখন তা পাঠকের মনে বিশেষভাবে আলোড়ন তোলে, পাঠকের মনকে চঞ্চল করে, ভাবনাকে উসকে দেয়। পাঠক সেই লেখাকে নিয়ে, সেই লেখককে নিয়ে প্রতিনিয়ত ভাবতে থাকেন। পাঠকের মন কল্পনায় ডানা মেলতে থাকে, নানা রং ছড়াতে থাকে। পাঠকের কাছে লেখক হয়ে ওঠেন অন্য এক মানুষ – পূজনীয় মানুষ, সম্মানিত মানুষ। ধীরে-ধীরে লেখক আর পাঠকের মধ্যে তৈরি হতে থাকে অদৃশ্য এক আত্মিক বন্ধন – এক ধরনের মিথস্ক্রিয়া। এই যোগসূত্র বা অনুঘটক হিসেবে কাজ করে লেখকের সৃষ্টি ‘লেখা’। পাঠক সেই লেখা পড়তে-পড়তে লেখককে নিয়ে এক স্বপ্ন-কল্পনায় বিভোর হয়ে ওঠে।
পাঠক ও পাঠকের কল্পনায় তার প্রিয় লেখককে নিয়ে আবর্তিত এই নাটক – আমি ও রবীন্দ্রনাথ। এখানে লেখক হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ যিনি রয়েছেন বাঙালির মনন ও জীবন জুড়ে আর তাঁর গুণমুগ্ধ ভক্ত-পাঠক ‘আমি’ হচ্ছে অথৈ নামের একটি মেয়ে।’ (নাটকের সুভিনিয়্যর)
অথৈ চরিত্রে অভিনয় করেছেন নাট্যকার ও নির্দেশক নূনা আফরোজ। অসাধারণ প্রাণবন্ত ও মেধাদীপ্ত অভিনয়। সাত্ত্বিক অভিনয় অসাধারণ। অথৈ চরিত্রের রূপান্তরে আরো মনোযোগ প্রয়োজন। মঞ্চে চলন-বচনে কোনো জড়তা নেই। নাটকের কাহিনির গতি-পরম্পরা এ অথৈ চরিত্রই নির্দিষ্ট করেছেন। সমসত্ম কাহিনিকে টেনে নিয়ে গেছে অথৈ চরিত্রটি। অভিনয় স্বতঃস্ফূর্ততা দেখে কখনো-কখনো মনে হয়েছে, ঘটনা নতুন করেই ঘটে চলেছে। পূর্বনির্ধারিত ঘটনার প্রলেপ দৃষ্টিগোচর মনে হয়নি। বাচিক অভিনয়ে আরো সুস্পষ্টতা প্রয়োজন। অথৈ চরিত্রের কোনো পোশাক পরিবর্তন লক্ষণীয় ছিল না। সবুজ রঙের শাড়ি একটি নির্দিষ্ট স্টাইলে প্যাঁচ দিয়ে পরিধান করেছেন। সবুজ রং কেন নির্ধারিত ছিল তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যার প্রতীকী ইঙ্গিত বোধগম্য হয়নি। শাড়ি পরার স্টাইলটিও সমকালের নারীদের মতো নয়। এটা রবীন্দ্রসময় ধরার প্রয়াসে কিনা তার ব্যাখ্যা স্পষ্ট নয়। শাড়ির রঙের ব্যবহারে নির্দেশকের আরো ভাবনার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়।
ঊনত্রিশ বয়সী রবীন্দ্রনাথ-চরিত্রে অভিনয় করেছেন তৌহিদ বিপস্নব। সাত্ত্বিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হলেও বাচিক অভিনয় শ্রম্নতিকটু বলেই মনে হয়েছে। কথা বলায় ভাবগাম্ভীর্য ও সাবটেক্সটের পরিচয় কম পাওয়া গেছে। রবীন্দ্রচেতনা আরো বিশ্বাসযোগ্য পরিসরে অনুধাবন প্রয়োজন। মেকআপ, গেটআপ অসাধারণ। রবীন্দ্রনাথের ঊনত্রিশ বছর বয়সী প্রাপ্ত ছবির মতো সঙ্গে অনেকটা মিল ঘটেছে।
ঊনসত্তর বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথের চরিত্রে অভিনয় করেছেন অনন্ত হীরা। প্রান্তবন্ত মেধাদীপ্ত অভিনয়। অসাধারণ সাত্ত্বিক স্থিতধী অভিনয়। বাচিক প্রক্ষেপণও অত্যন্ত শক্তিশালী। গেটআপ, মেকআপ ও মুভমেন্ট সবকিছু মিলে অত্যন্ত প্রাণবন্ত চরিত্র উপস্থাপন।
কথোপকথন অনুসারে চরিত্রের মেজাজ-মর্জি অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে।
একুশ বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ চরিত্রে অভিনয় করেছেন রামিজ রাজু। ইউরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত এবং উঁচু আভিজাত্যশীল বলে মনে হয়েছে অভিনয়ে। রবীন্দ্রনাথ এই বয়সের আগেই ভানুসিংহের পদাবলির মতো অধ্যাত্ম ও ভাববাদী রচনা করেছেন। এ বয়সেই তিনি বলেন, ‘মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যামসমান।’ সেহেতু চরিত্রে কিছুটা ভাববাদী প্রবণতার প্রয়োজন বলে হয়। যদিও নাটকে ব্যবহৃত এ-চরিত্রের পোশাকের মতো পোশাকি রবীন্দ্র-চরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। কিংবা জীবনেতিহাসে ইউরোপীয় শিক্ষার পরিচয়ও পাওয়া যায়। এ-প্রসঙ্গে আরো ভাবনার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়। বাচিক অভিনয়ে স্পষ্টতা ছিল। বাচিক প্রক্ষেপণেও অত্যন্ত কুশলতার পরিচয় পাওয়া গেছে।
এ-সময় বাল্যকালের রবীন্দ্র ও কাদম্বরীকে উপস্থাপন করা হয়েছে। কাদম্বরী রবীন্দ্রনাথের চেয়ে মাত্র দুই বছরের বড় ছিল। কিন্তু এতে বালক রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরীর বয়সের পার্থক্য অনেক বেশি বলেই মনে হয়েছে। আবেগ, ঘটনা কিংবা কথোপকথনের মধ্যে দিয়েই যখন রবীন্দ্র ও কাদম্বরীর সম্পর্ক উন্মোচিত হচ্ছে, তখন এ বাল্য দুটো চরিত্রের উপস্থাপন অনেকটা প্রক্ষেপ্তই মনে হয়েছে। খুব বেশি প্রয়োজন ছিল বলে মনে হয়নি। নাটকে বৈচিত্র্য সৃষ্টির জন্য যদি নির্দেশক উপস্থাপন প্রয়োজন মনেই করেন, তবে ভিন্নভাবে বা ভিন্ন মেজাজে উপস্থাপন করা দরকার। আবার তার যৌক্তিকতা ও নান্দনিকতা সৃষ্টি প্রয়োজন। আশি বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ-চরিত্রে অভিনয় করেছেন আউয়াল রেজা। মৃত্যুপথযাত্রী রবীন্দ্রনাথের চরিত্রাভিনয় অসাধারণ। তবে, মৃত্যুমুখী রবীন্দ্রনাথ যখন হুইল চেয়ারে বসে থাকে, তখন অথৈ তাকে নিয়ে ঘূর্ণন দেয়, কিন্তু
এ-ঘূর্ণনের ব্যাখ্যাটি অস্পষ্টই রয়ে গেছে।
চারটি রবীন্দ্রনাথের চরিত্রের অমত্মঃমিলগত জায়গায় নির্দেশকের আরো ভাবনা এবং কাজ করার আছে। চেতনায় রবীন্দ্রনাথ একই শুধু পার্থক্য বয়সগত, চিমত্মা, অভিজ্ঞতা ও দর্শনগত। নাটকে চারটি সময়কে ধরতে গিয়ে যেন চারটি আলাদা চরিত্র মনে না হয়। শুধু গেটআপ দিয়েই অন্তর্গত চেতনার রূপকে উহ্য রাখা যায় না। প্রায় সবার চরিত্রাভিনয়ই অসাধারণ। চরিত্রগুলোর বস্নকিং বা মুভমেন্ট অসাধারণ। মঞ্চে আলোর ব্যবহারে আরো সূক্ষ্মতা দাবি রাখে। ঘটনার প্রেক্ষাপট উপস্থাপনে জোনভিত্তিক আলোর প্রক্ষেপণ ঘটেছে। তবে কিছু-কিছু জায়গায় ফ্লাট আলোর ব্যবহারকে উপেক্ষা করে ঘটনা উপস্থাপনে আরো সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হওয়া দরকার ছিল। নাটকের কাহিনি যেভাবে দর্শককে ধরে রেখেছে, তেমনি আলো ব্যবহারে মঞ্চমায়া তৈরি করাও সম্ভব হতো।
বিষয়চিমত্মায় যেহেতু বিসত্মর পরিধিকে ধরা হয়েছে সেজন্য মঞ্চটাকে আরো বিসত্মৃত পরিসরে ব্যবহার করা যেত। ইউরোপীয় প্রসেনিয়াম ধারায় চরিত্রাভিনয়ে নাটকটি উপস্থাপিত। বাসত্মববাদী অনুষঙ্গে অতিপ্রাকৃত কল্পনার মিশ্রণ ঘটেছে নাটকে। নাটকটি দর্শককে অজানায় গতি নির্দেশ করে নাটকীয়তার মধ্যে দিয়ে জানার ইঙ্গিত দেয়। বাংলাদেশের শিক্ষাধারায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবশ্যপাঠ্য। শিশু শ্রেণি থেকে শুরু করে স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর পর্যায় পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ আলোচিত একটি বিষয়। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মগুলো পাঠ্য হওয়ায় জীবন-পরিক্রমা নিয়ে একটা কৌতূহলী মনোবৃত্তি প্রায় সবার মধ্যেই বিদ্যমান। দর্শকের মধ্যে আবেগের আপস্নুতাও সৃষ্টি হয় নাটকটিকে ঘিরে। শুধু তথ্য দিয়ে ক্ষান্ত নয়, রবীন্দ্রনাথের জীবন সম্পর্কে সাধারণ দর্শকের ভাসা-ভাসা ধারণাগুলোর আরো গভীরতর সত্য উপস্থাপন দর্শকের কাছে আরো গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করবে। উপস্থাপনাটির টিমওয়ার্ক অসাধারণ। অত্যন্ত সময়জ্ঞানসম্পন্ন ও পরিমিত মাত্রায় উপস্থাপন।
নাটকটিতে অভিনয় করেছেন – নূনা আফরোজ, অনন্ত হীরা, আউয়াল রেজা, রামিজ রাজু, তৌহিদ বিপস্নব ও সারোয়ার সৈকত। পোশাক ও মঞ্চপরিকল্পনায় নূনা আফরোজ, সংগীত-পরিকল্পনায় রামিজ রাজু, আলোক পরিকল্পনায় তৌফিক রবিন, রচনা ও নির্দেশনায় – নূনা আফরোজ।
কাহিনির গাঁথুনিতে দুঘণ্টা দশ মিনিট দর্শককে নিবিষ্টচিত্তে ধরে রাখতে সমর্থ নাটকটি। চারটি ভিন্ন বয়সী রবীন্দ্রনাথ চরিত্র উপস্থাপন দর্শককে এক অলীক আনন্দের স্রোতে ভাসিয়েছে। গেটআপ-মেকআপ মূল রবীন্দ্রচরিত্রের প্রাপ্ত ছবি অনুগামী। অত্যন্ত মেধাদীপ্ত ও নানদনিক উপস্থাপন। অথৈ চরিত্রের ছোট-ছোট রূপান্তরে আরো মনোযোগ প্রয়োজন। কুঠিবাড়ির অভ্যন্তর সাজেশনে মঞ্চবিন্যাসটি করলেও খুব হৃদয়গ্রাহী বা নান্দনিক হয়ে ওঠেনি বলে অনুভূত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের আগমনগুলোতে পদাবলি ও ধ্রম্নপদী নিনাদগুলো অসাধারণ উপভোগ্য। ঘটনার পরম্পরায় কবিতা, গানগুলোর ব্যবহার অসাধারণ। জীবনের জটিলতার কিংবা গভীরতার ব্যাপ্তি সৃষ্টির চেয়ে রবীন্দ্রজীবনের নানা তথ্য উপস্থাপনের প্রতি একটু বেশি ঝোঁক মনে হয়েছে। অসাধারণ তথ্যসমন্বয়। রোঁলা বার্থসহ সমকালীন অনেক লেখককে দেখার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উপেক্ষায় নির্দেশক মূলত রবীন্দ্র জীবন-সাহিত্যের স্বরূপ উন্মোচনে ব্যাপ্ত ছিলেন। এ যেন নাটকের মোড়কে মঞ্চে রবীন্দ্রজীবনের সাধারণ পরিচিতি। অত্যন্ত প্রাণবন্ত সুখদর্শন। অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও শৈল্পিক প্রযোজনা। এমন শিখনধর্মী মনোমুগ্ধকর, শ্রমসাপেক্ষ, নান্দনিক প্রযোজনার জন্য প্রাঙ্গণেমোর নাট্যদল নিঃসন্দেহে কৃতিত্বের দাবিদার। নাটকটির উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.