কোথায় যেন পড়েছি – ‘মৃত্যু মানুষের প্রেমকে অমরত্ব প্রদান করে, নান্দনিক ও মহিমান্বিত করে।’ কারো গল্প কিংবা উপন্যাসে হয়তো। শরৎচন্দ্রের কোনো লেখায় কি? হতে পারে, নাও হতে পারে। ঠিক মনে করতে পারছি না। শরৎবাবু তো বলেছেন – ‘বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, দূরেও ঠেলিয়া দেয়’ – এই দূরে ঠেলে দেওয়াই কি মৃত্যু? হতে পারে, আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। মৃত্যু মানুষকে কোন সুদূরে নিয়ে যায় কেউ জানে না…।
যা হোক, দশ শব্দের এই কাব্যময় বাক্যটি বেশ কিছুদিন হলো, তা মাস-দুয়েক তো হবেই, মেয়েটি যেদিন মোবাইল ফোনে বললো, ফোন সেদিন মেয়েটিই করেছিল। আমাদের দুজনের মধ্যে একটা অলিখিত প্রেমের চুক্তি ছিল, প্রত্যেক রোববার বেলা বারোটায় মেয়েটিকে আমি ফোন করবো, সাড়ে বারোটা বেজে গেল কিন্তু আমি ফোন করলাম না, তখন মেয়েটি নিজেই ফোন করেছে, এই নিয়ম বছর বছর ধরে চলে আসছে। সেদিন কী একটা জরুরি কাজে আটকা পড়ে আমি ফোন করতে পারছিলাম না, মেয়েটি ফোন করলো, এবং অচেনা লোকের মতো গড়গড় করে বললো – ‘আমি তোমাকে কোনোদিন ভালোবাসিনি, এখনো তোমাকে ভালোবাসি না; আমি আলমগীরের বউ, আমি কমল ও সাগরের মা, তোমার কেউ না; তুমি আর কোনোদিন আমাকে ফোন করবে না…’ – সেদিন থেকেই আমার করোটিতে চেপে বসেছে, আমাকে রাতদিন সর্বক্ষণ উস্কানি দিচ্ছে, এই যে কথাকার, তুমি
কথাশিল্পের যতই ডালি সাজাও না কেন, কোনো লাভ নেই, তুমি যা আছ তাই থাকবে, বিশীর্ণ গল্পকার হিসেবেই লোকে চিনবে তোমাকে, এর বেশি কিছু তুমি পাবে না; তার চেয়ে বরং তুমি মৃত্যুকে বেছে নাও। সক্রেটিসের কথা কি ভুলে গেছ, মনে করে দেখো, কী অবলীলায় সহাস্যে হেমলকের পেয়ালায় চুমুক দিয়েছিলেন, সক্রেটিস অমর হয়ে আছেন; তুমি যদি মৃত্যুকে বেছে নাও, আত্মহত্যা করো, একই সঙ্গে তোমার প্রেম এবং তুমি এই পৃথিবীতে অমর হয়ে থাকবে…।
দেখুন, নশ^র এই পৃথিবীতে একদিন কিছুই থাকবে না, না মানুষ, না সৌরজগৎ। যারা মৃত্যুবরণ করেছে, কবি-সাহিত্যিক, দার্শনিক-বিজ্ঞানী, যোদ্ধা-রাষ্ট্রনায়ক – ক’জনের নাম মানুষ মনে রেখেছে? মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান কিংবা কোনো স্বজন মারা গেলে ক’দিন মানুষ সন্তাপ করে? দু’দিন, চারদিন, দু’বছর, চার বছর – একদিন সব স্বজনের নাম মানুষের স্মৃতিপট থেকে মুছে যাবে, এটাই নিয়ম, নিয়তি; এর মধ্যে দু’চারজন ব্যতিক্রম, তারা অমর হয়ে আছেন, মৃত্যু তাদের দেহকে গ্রাস করতে পেরেছে মাত্র, কিন্তু তাদের কীর্তি অমøান। তাহলে আমার মতো একজন বিশীর্ণ কথাকার যদি স্বেচ্ছায় জীবনত্যাগ করে অমর হতে পারে, ক্ষতি কী…?
বাক্যটি আমাকে, তা যেখানেই যাই না কেন, যেখানে যে পরিবেশেই থাকি না কেন – নিজের অফিসে কিংবা সন্ধ্যায় কবি মাহাফুজ মুজাহিদের অফিসের আড্ডায়, কি কোনো পানশালায়; দেখি ঘুমের মধ্যেও অবিরাম উসকানি দিয়ে যাচ্ছে – ওহে, কথাকার, অমর হওয়ার এখনই কিন্তু তোমার সুবর্ণ সময়, মেয়েটি যেহেতু তোমাকে এতদিন পর, সেই ১৯৯৬ সালে মেয়েটি বিয়ে করে, দুই পুত্রের মা হয়েছে, বড় ছেলে কমলের বয়স ২৪, জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ে, ছোট ছেলে সাগর হাইস্কুলের ছাত্র; তারপরও মেয়েটি তোমার সঙ্গে ২৭ বছর ধরে সম্পর্ক রেখে চলছিল, এখন এই প্রৌঢ় বয়সে এসে কল্পনাতীত কথা শুনিয়েছে, বলছে – তোমাকে কোনোদিন সে ভালোবাসেনি; এখনো ভালোবাসে না, অমরত্বলাভের জন্য এরচেয়ে জুতসই সময় আর তুমি কখনোই পাবে না। মেয়েটির সঙ্গে আবার সদ্ভাব হয়ে গেলেই, হবেও হয়তো বা, মেয়েটি হয়তো কোনো কারণে রাগ করে এসব বলেছে, কিংবা মেয়েটির মন খারাপ ছিল, ওর স্বামী কি সন্তানরা জেনে থাকতে পারে – মেয়েটির সঙ্গে তোমার সম্পর্ক ছিল, বিয়ের ২৭ বছর পরও মেয়েটি সেই সম্পর্ক জীবিত রেখেছে, তাই বিষণ্নতায় ভুগছিল মেয়েটি, তাতেই রাগ ও ক্রোধের বশে মেয়েটি ওসব বলেছে, ক’দিন গেলেই সে আবার নিজে থেকেই তোমাকে ফোন করবে, ফোন যে করবে তা কিন্তু নিশ্চিত; এতদিনের সম্পর্ক, তোমাদের সম্পর্ক তো ঠুনকো ছিল না; মেয়েটি হঠাৎ রাগের মাথায় এক ফুৎকারে সম্পর্ক উড়িয়ে দেবে, তা বোধহয় অবিশ্বাস্য; তখন তোমার হাতছাড়া হয়ে যাবে অমর হওয়ার সুযোগ। বাক্যটি আমাকে উস্কাচ্ছে, আমি উতলা হয়ে উঠছি, অমর হওয়ার তীব্র ইচ্ছাও জাগছে মনে, কিন্তু কী করবো, অমর হওয়ার পথ বেছে নেবো কি নেবো না, সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না…।
আমি যখন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি – আমার প্রেমকে অমর করে রাখার জন্য স্বেচ্ছায় নিজের প্রাণত্যাগ করবো কি করবো না, তখন, যারা স্বেচ্ছায় প্রাণত্যাগ করেছেন – সক্রেটিস, সেনেকা, সিলভিয়া প্লাথ, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, জন রোবম্যান, ভার্জিনিয়া উলফ, ডেভিট ফস্টার ওয়ালেস, হানটার স্টকটন থমসন, অ্যান স্যাক্সটন, ফারিন বোয়ে, জুকিয়ো মিলিমা, ইউসুনারি কাওবাতা, কায়েস আহমেদ, ফজল মাহমুদ, নওরোজ শামীম, সুনীল সাইফুল্লাহ, আরো অনেকের মুখ মনে পড়ে। তাঁরা সবাই পৃথিবীতে অমরত্বলাভ করেছেন, মানুষ এখনো তাঁদের স্মরণ করে, তাঁদের উদ্দেশে স্মরণসভা করে, শোকগাথা লেখে; কিন্তু তাঁরা কেন আত্মহত্যা করেছিলেন? তাঁদের কি কোনো মেয়ে কি ছেলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল, মেয়ে কিংবা ছেলেটি বলেছিল – আমি তোমাকে কোনোদিন ভালোবাসিনি, এখনো ভালোবাসি না, তারপর তাঁরা তাঁদের প্রেমকে মহিমান্বিত করার পথ বেছে নিয়েছিলেন? সক্রেটিসের আত্মহত্যার অনুষঙ্গ ভিন্ন। রাজনৈতিক। এটা আমরা জানি। এথেন্স-সরকার তাঁকে বাধ্য করেছিল হেমলক পান করতে। তিনি বন্ধু-ভক্ত পরিবেষ্টিত হয়ে চা পান করার মতোই আয়েশ করে বিষপান করেছিলেন। কিন্তু অন্যরা? সেনেকা, সিলভিয়া, হেমিংওয়ে, কায়েস…? প্রেমে ব্যর্থ হওয়া ছাড়াও, আমার মনে হয়, কেউ যদি কখনো, কোনো কারণে মনে করে, মানুষ হিসেবে তার কোনো মূল্য নেই, সে টুপ করে আত্মহত্যা করতে পারে…।
আত্মহত্যা-প্রবণতার ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা দেখতে পাবো – যদ্দুর খোঁজ মেলে, তাও অতি প্রাচীন। যিশুর জন্মের আগেও, আমরা দেখতে পাই, অমরত্বলাভের আশায় অনেক বিখ্যাত মানুষ আত্মহত্যা করেছেন। রোমান দার্শনিক সেনেকা, যিনি ছিলেন সম্রাট নিরোর উপদেষ্টা, খ্রিষ্টপূর্ব ৬৫ অব্দে ৬১ বছর বয়সে আদিষ্ট হয়ে আত্মহত্যা করেন। একদিন সেনেকা জানতে পারলেন – সম্রাট তাঁকে সন্দেহ করছেন, তিনি নাকি সম্রাটকে সিংহাসনচ্যুত করার ষড়যন্ত্র করছেন, তিনি সেনেকাকে আদেশ করলেন আত্মহত্যা করতে। কোনো অর্থ হয় না; সেনেকা ধারালো চাকু দিয়ে নিজের শরীর কেটে-কেটে শরীরের রক্ত ঝরালেন, তারপর নেমে পড়লেন চৌবাচ্চায় সংরক্ষিত ফুটন্ত পানিতে, মনে করলেন – এই তো সামান্য দূরেই অনন্ত সুখময় জীবন, যেখানে কেউ তাঁকে ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে সন্দেহ করবে না। সেনেকা আত্মহত্যার আগে নোটবইয়ে লিখেছিলেন – ‘ডেথ : দেয়ার ইজ নাথিং ব্যাড অ্যাবাউট ইট অল একসেপ্ট দ্য থিং দ্যাট কামস বিফোর ইট – দ্য ফিয়ার অফ অব ইট …।’
হয়তো মনুষ্য নামক এই প্রাণীর আদিকালেও আত্মহননের প্রবণতা ছিল। অমরত্বলাভের আকাক্সক্ষা ছিল। তা থাকতেই পারে। তখনো, সেই শুরুতেই খুনোখুনি যখন ছিল, আদি মাতা-পিতার সন্তান, দুই ভাই, বড়ভাই খুন করেছিল ছোটভাইকে, সুতরাং খুনোখুনি দেখে মানুষের মনে নিজেরও খুন হওয়ার কিংবা অন্যকে খুন করার ইচ্ছে জাগা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু সেই আদিকালে কে, কীভাবে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে – সেই তথ্য-উপাত্ত আমাদের হাতে নেই, সেনেকা থেকেই আমরা আত্মহত্যার খোঁজ পেতে শুরু করেছি…।
মনে পড়ে – সিলভিয়া প্লাথ, কত বড় কবি ছিলেন, তিনিও, স্বামী টেড হিউজের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর মনে করলেন – একাকী এই নিঃসঙ্গ জীবন বয়ে বেড়ানোর কোনো মানে নেই। তাঁর করোটিতে দিনমান কলরব করে – এই জীবন-জগৎ কিছু নয়, আত্মীয়-পরিজন কেউ কারো নয় – মানুষ মূলত একা, নিঃসঙ্গ, এবং এই নিঃসঙ্গ-জীবন বয়ে বেড়ানোর চেয়ে মৃত্যু অনেক সুন্দর। সিলভিয়া মাত্র ৩১ বছর বয়সে গ্যাসের চুলা খুলে সামনে মুখটা ঠেলে দিলেন। মৃত্যুই যে অনন্ত সুন্দর, সিলভিয়া প্লাথ হয়তো অস্কার ওয়াইল্ড থেকে তা জেনেছিলেন। ওয়াইল্ড লিখেছিলেন – ‘ডেথ মাস্ট বি সো বিউটিফুল। টু লাই ইন দ্য সফট ব্রাউন আর্থ, উইথ দ্য গ্রাসেস ওয়েভিং এবাভ্ ওয়ানস হেড, অ্যান্ড লিসেন টু সাইলেন্স। টু হ্যাভ নো ইয়েসটারডে, অ্যান্ড নো টুমোরো। টু ফরগেট টাইম, টু ফরগিভ লাইফ, টু বি অ্যাট পিস …।’
দেখছি, সবাই অনন্ত-সুন্দর-জীবন পেতে আগ্রহী। মনোবাসনা – অমর হবে। আমিও গা-মাথা ঝাড়া দিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম – এই বিষণ্ন-জীবনযাপন করার কোনো দরকার নেই, মেয়েটির কথার ব্যাখ্যা খুঁজতে-খুঁজতে শরীরের ওজন কমানোরও কোনো মানে নেই, আমি চলে যাবো, কিন্তু আমাকে, আমার প্রেমকে মৃত্যুহীন, অমর করে রেখে যাবো। তরুণ কবি সুনীল সাইফুল্লাহ লিখেছিল – ‘ঠিক তিন বছর পর আমি আত্মহত্যা করে যাবো…।’ আমি আজই…।
দুই
সেদিন রাতে, রাত তখন প্রায় বারোটা, পূর্ণিমা ছিল বোধহয়, কিংবা পূর্ণিমার আগের বা পরের রাতও হতে পারে, আকাশে কাঁসার থালার মতো চাঁদ ঝুলছিল, চরাচর মনকে বিভ্রান্ত করার মতো উতলা, আমি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় বাড়ি ফিরছিলাম, রাবনা ব্রিজে এসে চালককে অটো থামাতে বললাম। চালক অটো থামালে আমি ভাড়া দিয়ে নেমে পড়লাম। আমার এখানে নামার কথা নয়। এলেঙ্গার অটো। আমি রসুলপুরে নামবো বলে উঠেছিলাম। কিন্তু এত রাতে রাবনা ব্রিজে নেমে পড়ায় অটোচালক, অটোয় এলেঙ্গার একজন যাত্রী ছিল, মাঝবয়সী, চোখ কোটরাগত, কেন, কে জানে, ডিমের ব্যবসায়ী হবে হয়তো, হাতে ডিমের খালি খাঁচা, বোধহয় ডিম বেচতে শহরে গিয়েছিল, দুজনেই চোখ বড়-বড় করে, লোকটির কোটরাগত চোখও তখন বড় হয়ে গেল, অবাক-বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। তাদের বিস্মিতভাব কেটে গেলে, অটোচালক কিছু বললো না; কিন্তু লোকটি বললো – ‘ভাই, আপনি এই মধ্যরাতে এখানে নামছেন কেন? এখন তো পায়ে-হাঁটা লোকজন নেই সড়কে, বিপদ-আপদ হতে কতক্ষণ? দেশে চোর-ছ্যাচ্চর-ছিনতাইকারীদের যা বাড় বেড়েছে…!’
লোকটিকে আমি চিনি না। চোখ কোটরাগত, দেখেছি আগে, এখন চোখে পড়লো লোকটির কণ্ঠার হাড়ও হাড়গিলার মতো বেরুনো, আপাতদৃষ্টিতে দেখতে একেবারে কুৎসিত না হলেও অসুন্দর, এতক্ষণ তার পাশেই বসে ছিলাম কিন্তু লোকটিকে ভালো করে দেখিনি, বলা ভালো – তার দিকে ভালো করে তাকাইনি, নিবিষ্ট মনে সিগারেট টানছিলাম, লোকটির কথা শুনে তার মুখের দিকে তাকালাম; না, যা মনে করেছিলাম, লোকটি দেখতে ততোটা অসুন্দর নয়, একধরনের সৌন্দর্য তার শরীর থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। চোখ দুটোও আর কোটরাগত বলে মনে হচ্ছে না, আমি হয়তো ভুল দেখেছিলাম, কিংবা আমি এখানে কোনো বিপদে পড়তে পারি – তার এই শংকা ও ভীতি এবং ভদ্রতাবোধই এখন তার শরীরে সোনালুফুলের মতো সৌন্দর্য হয়ে ফুটে উঠেছে। মানুষের সৌন্দর্য হয়তো তার ভেতরে কোথাও লুকিয়ে থাকে, সময়-সুযোগমতো প্রকাশিত হয়; এই লোকটিকে এতক্ষণ অসুন্দর ভেবেছি বলে এখন বিব্রতবোধ করছি, লজ্জা পাচ্ছি, তার মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। লোকটি আবার বললো – ‘ভাই, আমার কথাটা রাখুন। এখন, এখানে নামলে পরে আর অটো-টটো কিছুই পাবেন না, হেঁটে বাড়ি যেতে হবে, রসুলপুর তো এখান থেকে দেড় কিলোর কম হবে না, পথে বিপদে পড়তে পারেন…।’
লোকটি তো আর জানে না – ওরা চলে গেলেই শ্যামলী পরিবহনের যে বাসটি আগে আসবে, ঢাকার দিক থেকেই আসুক কি উত্তরবঙ্গ থেকে আসুক, বাসটি আমার কাছাকাছি আসতেই, আমি বাসের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়বো। কথাটা লোকটিকে বলাও যাবে না। বললে আমার এবং আমার প্রেমের অমরত্বলাভের পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। লোকটিকে, বিনয়ের অবতার সেজে বললাম – ‘ভাই, আপনি আমার জন্য দুশ্চিন্তা করছেন, যে-যুগ পড়েছে, এখন কেউ আর কারো জন্য দুশ্চিন্তা করা দূরে থাক, কেউ কারো সমুখে বিপদে পড়লেও ফিরে তাকায় না, উটকো-ঝামেলা মনে করে অতি-তাড়াতাড়ি কেটে পড়ে, আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ, কিন্তু আমি এখন আপনাদের সঙ্গে যেতে পারছি না। এখানে আমার খুব জরুরি একটা কাজ আছে…।’
লোকটি আমার কথা শুনে কী ভাবলো, তা বোঝা গেল না। লোকটির মুখমণ্ডলে জোছনা পড়েছে। চকচক করছে। তার মুখ দেখে, সে-যে খুব মনোক্ষুণ্ন হয়েছে, তা বোঝা গেল। অটোচালক উসখুস করছে। এই মধ্যরাতে এরকম খোলা জায়গায় অটো নিয়ে দেরি করা অসমীচীন। বুদ্ধিমানের কাজ না। ব্রিজের নিচেই যে ডাকাত কিংবা ছিনতাইকারী ওত পেতে শিকারের অপেক্ষায় বসে নেই, কে জানে! ইদানীং ছিনতাইকারীদের উপদ্রব খুব বেড়েছে। ছিনতাইকারীরা নতুন কৌশল নিয়েছে, দেশ ভ্রমণকারীদের মতো দলবেঁধে চলাচল করে, চার-পাঁচজনের দল, পরনে শার্ট-প্যান্ট, কেউ কেউ জিন্সের প্যান্ট-গেঞ্জিও পরে; কাঁধে ব্যাগ ঝোলানো, ব্যাগের ভেতরে কিছু কাপড়-চোপড়, ব্রাশ-পেস্ট, ছোট আকারের আয়না-চিরুনি, আর এসবের সঙ্গেই থাকে ছোরা-চাকু; সহজেই কেউ তাদের দুর্বৃত্ত বলে সন্দেহও করে না; কোথাও বিচ্ছিন্ন কি নির্জন সড়কে একাকী অটোচালক কাউকে পেলে তার গলা কেটে খুন করে অটোরিকশাটি নিয়ে চম্পট; যাত্রীবেশেও তারা অটোরিকশা ছিনতাই করে, বাধা দিতে গেলেই চালক খুন! এই তো সেদিন, আমাদের গাঁয়ের অটোচালক হাসিব খুন হয়েছে, মধুপুরের পঁচিশ মাইল সড়কে। যাত্রী নিয়ে জামালপুর গিয়েছিল, ফেরার পথে মুক্তাগাছা আলোছায়া সিনেমা হলের সামনে থেকে যাত্রীবেশী চার ছিনতাইকারী মধুপুর যাওয়ার কথা বলে হাসিবের অটো রিজার্ভ করে। রাত তখন এগারোটার মতো হবে, মধুপুরের আগে পঁচিশ মাইল এলাকায় বনের ভেতর দিয়ে অন্তত দশ কিলোমিটার সড়ক, সড়কের দুপাশে কোথাও বাড়িঘর নেই, জনমানুষের চিহ্ন নেই, বনের ভেতর একটানা ডাকছে ঝিঁঝিঁ পোকা, ভয়ে গা ছমছম করে, হাসিবও ভয় পাচ্ছিল, দ্রুতগতিতে চালাচ্ছিল অটো, আর কিছুদূর সামনে গেলেই মধুপুর, তখন আর ভয়ের কিছু নেই, কিন্তু মধুপুর সে পৌঁছতে পারল না, তার দুপাশে বসা দুই ছিনতাইকারী সেভেন গিয়ারের চাকু তার বুকে ধরে অটোর নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে নিয়ে সড়কের একপাশে অটোর ইঞ্জিন বন্ধ করে ফেললো। হাসিব কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু বলতে পারল না। চার ছিনতাকারী তাকে কোরবানির গরুর মতো মাটিতে ফেলে তার গলা কেটে লাশ বনের ভেতর ফেলে রেখেছিল…।
আমাদের অটোচালকের উসখুসানি ও তার ভীতবিহ্বল মুখ দেখে লোকটি বললো – ‘ভাই, চলি তাহলে। আল্লাহ ভরসা…।’
অটোচালক অটো ছেড়ে দিলো। আমি তৈরি হওয়ার আগেই শ্যামলী পরিবহনের একটি বাস আমার সমুখ দিয়ে ভুস করে চলে গেল। পরের বাসটির জন্য, কে জানে, কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি – অন্য কোনো বাস নয়, শ্যামলী পরিবহনের বাসের সামনেই ঝাঁপ দেবো। কেন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তা এখন মনে করতে পারছি না। অবাক কাণ্ড…!
রাবনা ব্রিজে নেমে মনে হয়েছিল – আজ পূর্ণিমা কিংবা তার আগের কি পরের রাত। এখন মনে হচ্ছে আজ পূর্ণিমাই। চাঁদটা দেখতে যে একেবারে পরিপূর্ণ! আর কী মায়াবী জোছনা চুইয়ে-চুইয়ে পড়ছে! পূর্ণিমার রাত না হলে কী এত বড় মায়াবী চাঁদের দেখা মেলে! এটা বৈশাখ মাস। বৈশাখ মাসের পূর্ণিমার নামই তো বুদ্ধপূর্ণিমা। গৌতম বুদ্ধের নামে এই নামকরণ। নিশ্চয়ই বুদ্ধপূর্ণিমা আজ। কোথায় যেন পড়েছি – বুদ্ধপূর্ণিমার রাতে চাঁদ সম্প্রসারিত রূপ ধারণ করে। আজকের চাঁদটি তো দেখতে অনেক বড়ই লাগছে। তাহলে বলতে হবে – আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন, কারণ, বুদ্ধপূর্ণিমায়ই দুনিয়ার মানুষের সৎপথপ্রদর্শক, শান্তিকামী সিদ্ধপুরুষ, যিনি বলেছিলেন – ‘জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক’ – শুধু মানুষের সুখ তিনি ঈশ্বরের কাছে কামনা করেননি, জগতের অচ্ছুত সকল প্রাণীর সুখও চেয়েছিলেন, সেই মহামানব গৌতম বুদ্ধের শুভ জন্ম, বোধিজ্ঞান এবং মহাপরিনির্বাণ ঘটেছিল, সেই বুদ্ধপূর্ণিমায় আমিও নির্বাণলাভ করতে এসেছি …।
আমি ব্রিজের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি। সিগারেট টানছি। ধোঁয়ার রিং বানিয়ে ছাড়ছি। রিং শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। শ্যামলী পরিবহনের একটি বাসের জন্য অপেক্ষা। কত নৈশবাস চোখের পলকে আমার সমুখ দিয়ে চলে যাচ্ছে! হয়তো এখনই ঢাকা কিংবা উত্তরবঙ্গের শ্যামলী পরিবহনের একটি এসে যাবে। আমি বাসটির সামনে ঝাঁপিয়ে পড়বো। আমার শরীরের সব হাড়গোড় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে। মাথার মগজ হয়তো ছিটকে পড়বে দূরে কোথাও। রক্তের দলা গড়িয়ে যাবে এদিক-ওদিক। কেউ আর আমাকে সুমিত জহির হিসেবে হয়তো শনাক্তও করতে পারবে না। সারারাতই তো আমার রক্তমাংস, হাড়গোড়, মাথার খুলি, মগজের ওপর দিয়ে গাড়ি যাবে। সুমিত জহিরের কোনো চিহ্নই থাকবে না রাবনা ব্রিজে। না থাক, এটাই ভালো। সুমিত জহিরের মতো একজন বিশীর্ণ কথাকার হঠাৎ একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে বাংলা সাহিত্য কিংবা দুনিয়ার কারো ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না। যাবো যখন, মনস্থ করেছি, চিহ্ন রেখে গিয়ে কী লাভ…?
আমার কাক্সিক্ষত বাসটি আসছে না। সিগারেট পুড়ে ছাই। হঠাৎ আমার করোটিতে বাজে – আমার, মানে সুমিত জহিরের দেহটি তো মুহূর্তের মধ্যেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে কিংবা হয়ে গেল, কিন্তু আমার ভেতরে যে একটি পাখি ছিল, সে কোথায় গেল? এই পাখিরা আসলে কোথায় যায়? কোথায় তাদের নিবাস? মহান লালন সাঁইজির একটি পঙ্ক্তি মনে পড়ে – ‘হায় চিরদিন পুশলাম এক অচিন পাখি …।’ আমার ভেতরে একটি পাখি ছিল, সব মানুষের ভেতরেই এই পাখি বাস করে, পাখিটি আমার হয়ে কথা বলতো, গীত গাইতো; হঠাৎ একটি পাখি আমার নজরে আসে, আগুনরাঙা পাখি, জোছনা পাখিটির অগ্নিরং ঢাকতে পারেনি, অদ্ভুত একটি আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে পাখিটির গা বেয়ে! এটা হয়তো একটা বাজ হবে, সেরকমই লাগছে দেখতে, সেমেটিক কোনো-কোনো সম্প্রদায় বিশ্বাস করতো – নিজের ভেতরের আত্মা যখন বেরিয়ে যায়, সে আকাশে বাজপাখি হয়ে ওড়ে; পাখিটি এখন, এই রাতের বেলা শূন্যে, আমার মাথার ওপর স্থির হয়ে ভাসছে, ওটাই কি আমার ভেতরের পাখি? আমার আত্মা অবিনশ্বর …!
আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার মহাপরিনির্বাণ ঘটবে। আমার প্রত্যাশা পূর্ণ হবে, বাসটি হয়তো উত্তর দিক থেকে রসুলপুর পার হয়ে এসেছে। রাবনা ব্রিজে পৌঁছতে লাগবে মাত্র আর কয়েক সেকেন্ড। শ্যামলী-বাসের যে গতি! ও, এখন মনে পড়েছে – শ্যামলী-বাস রকেটের মতো দ্রুতবেগে চলে বলেই আমি নির্বাণপ্রাপ্তির জন্য এই বাস বেছে নিয়েছি।
যা-হোক, বাস এলো বলে! কিন্তু এই মাহেন্দ্রক্ষণে মেয়েটির মুখ মনে পড়ছে কেন? মেয়েটি তো সাফ-সাফ বলেই দিয়েছে – সে সুমিত জহিরকে কোনোদিন ভালোবাসেনি, এখনো ভালোবাসে না। তাহলে? মেয়েটির একটি পাসপোর্ট-আকারের ছবি সর্বদাই আমার বুকপকেটে থাকে, মেয়েটি তা জানেও, এখনো মেয়েটির সেই ছবিটি, এসএসসি পরীক্ষার আগে, ১৯৮৯ সালে, মেয়েটি তখন পনেরো বছরের উত্থিত বালিকা, শখ করে শাড়ি পরে তিথি স্টুডিওতে ছবি তুলেছিল, গোলাপি জর্জেট শাড়ি, গোপনে বলে রাখি ‘উনিশ-কুড়ি’র শোরুম থেকে শাড়িটি আমিই কিনে দিয়েছিলাম, ওর গলায় ছিল পুতির মালা, কানে দুল, নাকে শুকতারার মতো জ¦লজ¦লে নাকফুল, সবই কক্সবাজারের শঙ্খের তৈরি – ওর বড়ভাই কক্সবাজারে চাকরি করতো, এনডিসি ছিল, সে-ই এনে দিয়েছিল এসব গয়না, এই গয়নাগুলো পরলে কিশোরী মেয়েটিকে দেখতে পরির মতো লাগতো। তিথি স্টুডিওতে তোলা ছবির এক কপি আমাকে দিয়েছিল, লেমিনেশন করে রেখেছিলাম, সেই ছবিটি এখনো আমার পকেটে আছে, একবার বের করে দেখলাম, ছবিটি আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সুমিত জহিরের সঙ্গেই রাবনা ব্রিজের ধুলোয় মিশে যাবে…।
মেয়েটি হাসিয়া ভাবির চাচাতো বোন। ১৯৮৪ সালে, তখন ওর বয়স দশ বছর, গ্রাম থেকে এসে বিন্দুবাসিনী বালিকা বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হলো, ভাবির বাসাতেই থাকতো। হাসিয়া ভাবি একইসঙ্গে আমার খালাতো বোন এবং ভাবি। ওর বাসায় আমার অবাধ যাতায়াত। আমি তখন সা’দত কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে, মেয়েটিকে চোখের সামনে দেখতে-দেখতেই আমার বয়স বাড়ছিল, মেয়েটিরও, ততদিনে আমি গল্প-কবিতা লিখতে শুরু করেছি, লিখতে বসলেই মেয়েটির মুখ চোখের সামনে ভাসে, মেয়েটি তখন নাইনে উঠে গেছে, একদিন আমার মনে হলো – এই মেয়েটিই তো আমার সৌরজগৎ। তখনো ওর সঙ্গে আমার তুই-তোকারি সম্পর্ক, ‘তুই’ সম্বোধন করি, একদিন করলাম কী, রাত ন’টার মতো বাজে, মেয়েটি ওর টেবিলে বসে পড়ছিল, আমি বললাম – ‘এই তোর ডান হাতটা একটু দে তো দেখি …।’
‘হাত!’ মেয়েটি চমকে উঠলো। বললো – ‘আমার হাত দিয়ে কী করবেন …?’
– আগে দে। তারপর দ্যাখ, কী করি …?
মেয়েটি কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলো। তারপর আলতো করে ওর ডান হাতটি বাড়িয়ে দিলো। টেবিলে দুটি কলম ছিল। একটি কালো কালির, আরেকটি সবুজ কালির। আমি সবুজ কালির কলমটি দিয়ে মেয়েটির হাতের তালুতে লিখলাম – ‘সু …।’
‘এটা কী করলেন’ – বললো মেয়েটি। আমি বললাম, ‘তোর একটা নতুন নাম দিলাম। এই নামে আমি তোকে ডাকবো …।’
– কেউ যদি জানে …?
– জানবে না …।
– প্রমিজ …।
– প্রমিজ। জানবো শুধু আমি আর তুই …।
আমি মেয়েটির হাতের তালুতে নাকের ওপর চুমু খেলাম। ও বাধা দিলো না…।
সেই যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মেয়েটিকে, আমার দেওয়া নাম, কেউ জানবে না, সেই প্রতিজ্ঞা এখনো ভাঙিনি। এই যে, মেয়েটির আখ্যান লিখছি, এখন পর্যন্ত কিন্তু ওর নাম প্রকাশ করিনি। একদিন, মেয়েটি তখন দশমে, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি উপন্যাসটি পড়তে দিলাম। এর আগেও ফাল্গুনীর শাপমোচন, শরতের দেবদাস, নিমাই ভট্টাচার্যের মেমসাহেব, আরো অনেক বই আমার কাছ থেকে নিয়ে পড়েছে। অষ্টমে-নবমেই। এসব বই সহজবোধ্য। মেয়েটি ‘আউট বই’ পড়তে ভালোবাসে, আমিও উৎসাহ দিই। কিন্তু আমি ভাবছিলাম কবি পড়তে দেবো, ক্লাসিক সাহিত্যও এখন থেকেই পড়ুক। না-বুঝলেও ক্ষতি নেই। অন্তত ধৈর্য ধরে পড়তে শিখুক। তাই, দশমে এসে কবি দিলাম। দিন সাতেক পর, মেয়েটি একদিন বললো – ‘সুমিত ভাই, কবি খুব চমৎকার উপন্যাস। পড়তে-পড়তে আমার চোখে পানি এসে গেছিল। কী যে কষ্ট নিতাই আর ঠাকুরঝির …।’
মেয়েটি নিতাই আর ঠাকুরঝির কষ্ট ধরতে পেরেছে, উপলব্ধি করেছে, বাহ্! হঠাৎ আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল – ‘সু …, তুই আমার ঠাকুরঝি হবি …?’
‘হয়েই তো আছি …।’ মেয়েটি বললো।
মেয়েটি আমার ঠাকুরঝি! আমি যেন গুলিবিদ্ধ ঈগলের মতো ধুপ করে আকাশ থেকে পড়লাম। আমার দমবন্ধ হওয়ার জো …।
আমি কবিয়াল নিতাই, মেয়েটি আমার ঠাকুরঝি, আমি গীত বাঁধি – ‘আমার ভালোবাসার ধনে হবে তোমার চরণপূজা/ তোমার বুকের আগুন যেন আমার বুকে পিদিম জ্বালেরে …।’
আমাদের দেখা হয় – ভাবির বাসার ছাদে, যে-রাতে আকাশে পরিপূর্ণ গোল চাঁদ, পূর্ণিমা; কিংবা ওর স্কুলের কাছাকাছি, পৌর উদ্যানের উত্তর-পূর্বকোণের জারুলতলা, কথা হয়, আমি মেয়েটির হাতের তালুতে চুম্বন এঁকে দিই, গীত শোনাই – ‘চারদিকে চার বৃন্দাবনে বংশী বাজে কার …?’
‘তোমার বাঁশিই তো বাজে। আমার কানে সেই বাঁশির সুর বাজে।’ মেয়েটি তখন আমাকে ‘তুমি’ বলা শুরু করেছে …।
এভাবেই চলছিল। আমাদের বয়সও বাড়ছিল। সব মানুষেরই বয়স বাড়ে …।
তখন মেয়েটি কুমুদিনী কলেজে পড়ে, উচ্চ মাধ্যমিক, হোস্টেলে বসবাস, আমি সা’দত কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ি। সপ্তাহে একদিন, শুক্রবার, আমাদের দেখা হয়। আমরা কলেজ গেটের সামনে কড়িতলা বসি। তখন আর শুধু আমি একাই মেয়েটির হাতের তালুতে চুমু খাই না, মেয়েটিও, সাহসী হয়েছে, আমার হাতের করতলে চুম্বন অংকন করে। আমি একদিন, কী যে মনে করে, হয়তো বিষণ্নতায় ভুগছিলাম, মাঝেমধ্যে আমার এরকম হয়, কোনো কারণে কিছুদিন কোনো গল্প-কবিতা লেখা না হলে, লিখতে না পারলে কনকনে শীতের মতো বিষণ্নতা আমাকে জেঁকে ধরে, মেয়েটিকে আমি গীত শোনাই – ‘এই খেদ মোর মনে মনে/ ভালোবেসে মিটল না আশ – কুলাল না এ জীবনে/ হায়! জীবন এত ছোট কেনে/ এ ভুবনে …।’
আমার গুনগুনিয়ে-গাওয়া গান শুনে মেয়েটি ডুকরে কেঁদে উঠলো …।
– কী ব্যাপার সু …! তুমি কাঁদছ কেন …?
– তুমি এ-গান কেন গাইলে, সুমিত ভাই …?
– এমনি। কেন, তাতে কী হয়েছে …?
– ভালোবেসে তোমার আশ মিটল না! আমি কি তোমাকে ঠাকুরঝির মতোই ভালোবাসি না? … আর তুমি এখনই তোমার জীবন ছোট কি বড় – তা নিয়ে ভাবছ কেন? তোমার জীবন কেন ছোট হতে যাবে …?
মেয়েটির কান্নাজর্জর কথা শুনে আমি থ’ বনে গেলাম। মেয়েটি তো আধা-সত্যি না, প্রকৃত, পুরো-সত্য কথাই বলেছে। সে আমাকে ঠাকুরঝির মতোই ভালোবাসে। ওর ভালোবাসায় কোনো ফাঁক-ফোকর নেই। চাঁদ নেই। তাহলে, কেন, এই গীতটি আমার মনে এলো। গুনগুন করে গাইলাম …?
দেখছি, অনেকক্ষণ ভেবেও, কেন এই বিরহগীত গাইলাম, তার কোনো জুতসই জবাব পেলাম না। আপৎকালীন সিদ্ধান্ত নিতে পারি – আমার বিষণ্নতার ভারটা বুঝি কিছু বেশিই ছিল। আমি মেয়েটির চোখের পানি ঠোঁট চুবিয়ে শুষে নিলাম …।
কলেজে বড় ছুটি হলে মেয়েটি বাড়িতে চলে যায়। ধলেশ্বরীর ধুধু বালুচরের অন্তত সাত মাইল পায়ে-হাঁটা পথ দূরে ওদের বাড়ি। আমি হয়তো কোনো একদিন মধ্যরাতে ওদের বাড়ি গিয়ে উঠি। মেয়েটি হয়তো প্রতিরাতেই কান পেতে রাখে, সুমিত জহির হঠাৎ কোনো রাতে ওর নাম ধরে ডাক দেবে। লোকটির তো শোধবোধ কম। ভয়ডরও নেই।
যে-পথে দিনদুপুরেই ভয়ে গা ছমছম করে, চোখের দূরত্বে কোনো ঘরবাড়ি কি বসতি নেই, মানুষজনের দেখা মেলে কদাচিৎ, সেই পথে লোকটি আসে মধ্যরাতে …!
এক রাতে, মেয়েটি হয়তো সজাগই ছিল, ছোট বোনকে নিয়ে সে পৃথকঘরে থাকে, আমি ‘সু …’ বলতেই দ্রুত উঠে দরজা খুলে দাঁড়াল – ‘পথে ভয় পাওনি তো …?’
– ভয় পাবো কেন? আমি তো সব সময় মধ্যরাতেই আসি …।
– তোমাকে নিয়ে আর পারা গেল না। গতরাতে চরে চারটি লাশ পড়ে ছিল …।
– শুনেছি …।
– শুনেছ …?
– হ্যাঁ। শুনেছি। ঘাটপারে পথ ভুল করে ভুলপথে হাঁটা শুরু করেছিলাম। অন্ধকার রাত তো বুঝতে পারিনি। মাইল দুয়েক হাঁটার পর মনে হলো – ভুল পথে হাঁটছি। পথের দুপাশের বালির স্তূপ কই? একটু দূরে দূরে কাঁটাঝোপ – তাও তো দেখছি না। ভরদেশের পথের মতো পথে দূর্বাঘাস। এ-পথ তো তোমাদের বাড়ির পথ নয়। এটা হয়তো আবাদপুরের দিকে গেছে। আবার উল্টোপথে হাঁটা শুরু করলাম। ঘাটের কাছাকাছি যেতেই বুড়োমতো এক লোকের সঙ্গে দেখা, মেছুয়া, নদীতে মাছ ধরতে গিয়েছিল, কাঁধে সাত-আটটি জিয়ালা বড়শি আর দুটো বড় আকারের বোয়াল, তাকে পথের কথা বললে সে তোমাদের গাঁয়ের পথটি দেখিয়ে দিলো, কিন্তু বলল – ‘ভাই, আমার বাড়ি এই সন্নিকটেই, এলাসিন; আজ রাতটা দয়া করে আমার গরিবখানায় থেকে যান, গতরাতে রানুরচরে চারটি লাশ পড়ে ছিল, চরে জমির সীমানা নিয়ে মাঝেমধ্যেই খুনোখুনি হয়, গতরাতে চারটি লাশ পড়েছে, প্রতিশোধ হিসেবে আজ রাতে পাঁচটি লাশ পড়তে পারে, আপনি যেতে পারবেন না …।’
– তারপরও এই মধ্যরাতে তুমি এই বিরানচর পাড়ি দিয়ে এলে …?
– এলাম …।
– একটুও ভয় করল না …?
– না। অনেকদিন তোমাকে দেখি না। তোমাকে দেখতে পাবো, পথে ভয় পেলে চলবে কেন …?
মেয়েটি আমাকে জড়িয়ে ধরল, আমাকে যেন ফাঁসির মঞ্চে তোলা হয়েছিল, জল্লাদ প্রস্তুত; অলৌকিকভাবে বেঁচে এসেছি; চোখে প্লাবন নামিয়ে কাঁদতে শুরু করল …।
খালাম্মা উঠে আসে। বরাবরই তার কাছে মিথ্যা কথা বলি। মেয়েটিও জানে – যা বলি, সবই মিথ্যা। বলি – একটা জরুরি কাজে নাগরপুর গিয়েছিলাম, কাজ শেষে কজন বন্ধু জুটে গেল, সা’দত কলেজের ক্লাসমেট, ওদের সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়ে অনেক রাত হয়ে গেল, টাঙ্গাইল ফিরতে পারিনি, শেষমেশ ভাবলাম আপনাদের সঙ্গে দেখা করে যাই। হাসিয়া ভাবির সূত্রে মেয়েটির মাকে আমি খালাম্মা বলি। প্রতিবারই একই ধরনের মিথ্যা বয়ান। খালাম্মা কী ভাবে, খালুই বা কী ভাবে, কে জানে …!
যে যা ভাবে ভাবুক। মেয়েটির সঙ্গে দেখা করার জন্য, ওর মুখটা এক পলক দেখার জন্য, ওর ডান চোখের নিতলার ভুরু ঘেঁষে রাই সরিষার দানার মতো একটি তিল আছে, তিলটি মন্থন করার জন্য কিছু মিথ্যা কথা বললে, তা খুব একটা দোষের হবে, কখনোই মনে হয় না …।
তখন মেয়েটির সা’দত কলেজে মাস্টার্স পরীক্ষা চলছিল, প্রাণিবিদ্যা পড়ে, আমি পাশ করে অনেক আগেই কলেজ থেকে বেরিয়ে এসেছি, সরকারি চাকরি পেয়েছি, মাঠের চাকরি; সারাদিন গ্রামগঞ্জ চষে বেড়াই, একদিন মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে গেছি, কুমুদিনী কলেজে যেরকম প্রত্যেক শুক্রবার দেখা করতে যেতাম, সা’দত কলেজে সেরকম হয়ে উঠতো না, ছয়দিন সরকারি চাকরি, শুক্রবার পূর্বাকাশ-এর মেকআপ নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম, তবু সপ্তাহে বা পনেরো দিনে না হোক, সময় বের করে মাসে অন্তত একদিন যেতাম, এক মাসে অন্তত একবার দেখা করতে না গেলে মেয়েটি কেঁদেকেটে সাড়া হতো। সেদিন আমরা ওর হোস্টেলের পশ্চিম পাশে বাগানে বসে ছিলাম, বাগানটিতে যে কত প্রকারের দেশি-বিদেশি ফুলগাছ, হিসাব করা কঠিন; হয়তো সেদিনও আমি তীব্র বিষণ্নতায় ভুগছিলাম, তিন মাসে একটা গল্পও লিখিনি, লিখতে বসবো – সময় বের করতে পারছি না, মাথাটা কেমন খালি-খালি লাগে, করোটিতে যেন কোনো গল্প নেই, কী যে যন্ত্রণাদায়ক সময়; বাগানে বসেছি, মেয়েটিকে গুনগুনিয়ে কোনো গানের দুটো চরণ অন্তত শোনাতে হবে জানি, আমি সতর্ক ছিলাম – এমন কোনো গান শোনাবো না, যা শুনে মেয়েটি কষ্ট পেতে পারে, কিন্তু আমার অবচেতন মন গেয়ে উঠলো – ‘আমি ভালোবেসে এই বুঝেছি -/ সুখের সার সে চোখের জলেরে …।’
– তুমি মাঝেমধ্যেই এরকম গান গাও কেন, সুমিত ভাই …?
– যা মনে এলো, তাই গাইলাম …।
– তোমার কী মনে হয়েছে …?
– তোমার মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ প্রায়। বয়স বাইশ। এখন তোমার বিয়ে হয়ে যাবে …।
– মেয়েমানুষ, বিয়ে তো হবেই। তুমিও বিয়ে করে সংসারী হবে …।
– এজন্যেই তো গাইলাম, ‘আমি ভালোবেসে এই বুঝেছি -/ সুখের সার সে চোখের জলেরে …।’
– আমি কিন্তু কেঁদে ফেলবো, সুমিত ভাই …।
– সুখ যদি চোখের জলে ভাসে, তবে একটু কাঁদলে ক্ষতি কী …?
– আমরা যে যার মতো মা-বাবার পছন্দে বিয়ে করলেই কি আমাদের ভালোবাসার মৃত্যু হবে? তা কেন হবে? আমি তোমাকে ঠাকুরঝির মতো ভালোবাসি, তুমি আমাকে নিতাই কবিয়ালের মতো ভালোবাসো, ওরা যেমন দুজনে বিয়ে করেনি, আমরাও দুজনে বিয়ে করবো না, তারপরও আমাদের ভালোবাসা আমৃত্যু তো বটেই, মৃত্যুর পরও অটুট থাকবে। এই সত্য কি তুমি বিশ্বাস করো না, কবিয়াল …?
মেয়েটি এখন আলমগীরের বউ। কমল-সাগরের মা …।
এই ২৭ বছরে বাস্তবে কিংবা স্বপ্নে বহু জায়গায় আমাদের দেখা হয়েছে, আমরা মুখোমুখি বসে দুজন দুজনকে দেখেছি, আমি ওর হাতের তালুতে, ভুরুর নিচের তিলে চুমু খেয়েছি, ও আমার হাতে, কপালে চুমু এঁকে দিয়েছে, আমি গীত শুনিয়েছি, সবই সম্ভব হয়েছে, ওই যে মেয়েটি বিশ্বাস করতো – আমাদের ভালোবাসার কখনো মৃত্যু হবে না, আমিও তাই বিশ্বাস করতাম বলে। কিন্তু মেয়েটি এখন কেন, এই ৪৯ বছর বয়সে পা দিয়ে, প্রৌঢ় বয়সে এসে বললো – ‘আমি কোনোদিন তোমাকে ভালোবাসিনি, এখনো ভালোবাসি না …।’
যা-হোক, মেয়েটি যখন, এই আখ্যানে ‘সু …’-কে ‘মেয়েটি’ বলেই বারবার আখ্যায়িত করেছি, কিন্তু ৪৯ বছর বয়সী স্ত্রীলিঙ্গধারী কোনো মানুষকে ‘মেয়েটি’ বলা বেমানান, তাকে ‘নারী’ সম্বোধন করাই বিধিসম্মত, তো বলি – নারীর চরিত্র দেবতারাই বোঝে না, মানুষ তো কোন ছার! আলমগীরের বউকেও আমি বুঝতে পারলাম না। এই ২৭ বছর পর, নিজের কানে শুনলাম, সে বললো – ‘আমি কোনোদিন …’ – তাহলে, এ-কথা শোনার পর, কবি ফজল মাহমুদ তো রোকেয়া হলের সামনে প্রেমিকার মুখোমুখি হয়ে বিষপান করেছিল, সুমিত জহিরও নিশ্চয় রাবনা ব্রিজে বাসের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। অমরত্বলাভের জন্য এই সামান্য ভুলটুকু করলে, আপনারা এই আত্মহননকে ভুল কাজ বলবেন, তাই আমি বললাম ‘ভুলটুকু’ করলে, পাপ হবে না। ঈশ্বর তো সবই, কেন, কী, কীভাবে হবে, তা জানে …।
আমি তখন চন্দ্রগ্রস্ত, বুদ্ধপূর্ণিমার আগ্রাসী আলোর ভেতর হাবুডুবু খাচ্ছি, কখন বাস আসে, সেই চিন্তায় অস্থির, হঠাৎ করেই দেখি রসুলপুর অতিক্রম করে বাস আসছে।
শ্যামলী-বাস। বাসটি আমার থেকে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের দূরত্বে। এখনই রাবনা ব্রিজ অতিক্রম করবে। তার আগেই আমি বাসের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়বো। এই সুবর্ণ সুযোগ কোনোক্রমেই হাতছাড়া করা যাবে না …।
বাসের সামনে এখনই ঝাঁপিয়ে পড়বো, বিদ্যুৎবেগে বাসটি আসছে, আমি সর্বাত্মক প্রস্তুত; তখনই আমার কানে একটা চিৎকার ভেসে এলো, বেদনাপূর্ণ নারীকণ্ঠ, আমার নাম ধরে ডাকছে – ‘সুমিত ভাই, দোহাই তোমার নিজের সৃজিত
গল্প-কবিতার, একটু দাঁড়াও, তোমার সঙ্গে আমার খুব জরুরি কথা আছে …।’
চোখের পলক না-পড়তেই মহাশূন্য থেকে নেমে এলো এক পরি …।
– সুনন্দা তুমি …।
– এ তুমি কী করতে যাচ্ছিলে, সুমিত ভাই …?
– তুমি যে সেদিন বললে …, তোমার সেই কথা শোনার পর নিশ্চয়ই আমার বাসের সামনে ঝাঁপ দেওয়ার অধিকার অর্জিত হয়েছে …।
– তুমি লেখক-মানুষ, সুমিত ভাই। তোমার কোনো লেখায়ই পড়েছি – আমরা যা দেখি, সব সত্য যেমন সত্য না, সব মিথ্যাও তেমনি মিথ্যা না। তোমার বোঝা উচিত ছিল – জীবনে কখনো কখনো এমন সময় আসে – জলজ্যান্ত মিথ্যা কথাকেও সত্য হিসেবে তুলে ধরতে হয় …।
– সুনন্দা …।
– বলো …।
– জোছনা পড়ে তোমার বিখ্যাত তিলটা মার্বেল পাথরের মতো জ্বলজ্বল করছে। একটা চুমু খাই …।
– কবে আবার অনুমতি নিতে হয়েছে …!
পাদটীকা
হঠাৎ চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। আমি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বললাম – ‘সুনন্দা, চারদিকে এত অন্ধকার কেন? কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না …।’
– গ্রহণ লেগেছে। চন্দ্রগ্রহণ …।
– পূর্ণিমায় গ্রহণ লাগে …?
– দুনিয়ায় অসম্ভব বলে কিছু নেই …।
– তোমাকে তো দেখতে পাচ্ছি না …।
– আমি তোমার পাশেই আছি। সারাক্ষণ ছায়ার মতো তোমার পাশে-পাশেই থাকি …।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.