রায়পুরা থেকে ময়মনসিংহ

আট

প্রতিমা পূজায় আমার দাদুর  খুব আগ্রহ আমরা দেখিনি। তিনি প্রতি রোববার এক ধরনের মেডিটেশন বা কায়মনে চুপচাপ বসে ধ্যান করতেন। তার সঙ্গে পাড়া-প্রতিবেশী কয়েকজন যোগ দিতেন। ধ্যানশেষে ভক্তিমূলক গান হতো। দু-একটি গানের কথা আমার এখনো মনে আছে :

গুরু আমায় করো করুণা

আমি ঝড়বাদলে বেয়ে যাবো

তোমার তরীখানা।

অথবা

ও গো তুমি চক্ষু দিলে

দিলে মস্ত দৃষ্টি

তোমায় প্রণাম তোমায় প্রণাম শতবার …

দাদু ছিলেন সাধক ও ভাবসংগীতকার মনমোহন দত্তের ভাবানুসারী। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগরের সাতমোড়া গ্রামে ১৮৭৭ সালে মনমোহন দত্তের জন্ম। মৃত্যু ১৯০৯ সালে। আঠারো বছর বয়সে তিনি কালিকচ্ছ গ্রামের সাধক আনন্দস্বামীর সাহচর্যে এসে সংসারবিরাগী হয়ে ওঠেন। তিনি চট্টগ্রামের মাইজভাণ্ডারের পীর মওলানা আহমদউল্লাহর সান্নিধ্যে এসে তাঁর দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছেন। তাঁর মধ্যে কোনো ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল না। সব ধর্মমতের সমন্বয় ছিল তাঁর সাধনা। তিনি প্রায় সাড়ে আটশো সাধনসংগীত রচনা করেছেন। তাঁর গানের একটি উক্তি :

কোরান পুরাণ আদি বাইবেল কি বেদ,

সবে ফুঁকারিয়া কয়, তার অবিচ্ছেদ।

মনমোহন ছিলেন মানবপ্রেমী। তিনি মানুষের সেবা এবং কল্যাণকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। পরবর্তীকালে তিনি তাঁর গুরুর নামে আনন্দাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। আশ্রমে প্রতিরাতে জলসা হতো। মনমোহনের জন্মোৎসব উপলক্ষে ভক্তরা তাঁর গান পরিবেশন করতেন। পূজাআর্চার বদলে গান গেয়ে স্রষ্টার নৈকট্যলাভের চেষ্টা। মনমোহন দত্তের এক শিষ্যের নাম ছিল লবচন্দ্র পাল। সম্ভবত এই শিষ্যের মাধ্যমেই দাদু মনমোহন দত্তের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। মনমোহন দত্তের

 জন্মদিন ১০ মাঘ আর লবচন্দ্র পালের জন্মদিন ১১ বৈশাখ। এই দুদিন আমাদের বাড়িতেও দাদু তাঁদের জন্মদিন পালন করতেন গান-বাজনার মাধ্যমে। সেদিন বাড়িতে হরেকরকম রান্না হতো। মাছ, মাংস, ডিম ছাড়াও পিঠা হতো। দুপুরে আসন পেতে সবাইকে খাবার পরিবেশন করা হতো। আশেপাশের নারী-পুরুষ অনেকেই আসতেন। কেউ কেউ সঙ্গে করে মিষ্টি কিংবা ফলও নিয়ে আসতেন। মেয়েরা নতুন অথবা পরিষ্কার শাড়ি পরে একটু সেজেগুজে শাড়ির আঁচলে চাবির গোছা বেঁধে আসতেন। ধ্যান বা প্রার্থনায় অংশ নিতেন।

ময়মনসিংহ শহরে তখন প্রচুর হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের বসবাস ছিল। তবে দুর্গাপূজা খুব বেশি হতো না। হাতেগোনা কয়েকটি মণ্ডপে পূজা হতো। পূজা উপলক্ষে এখনকার মতো আলোকসজ্জাও হতো না। আড়ম্বর কম ছিল। তবে মানুষের মনে ভক্তি-শ্রদ্ধা ছিল বেশি। আমরা নতুন জামাকাপড় পরে হেঁটে অথবা রিকশায় করে পূজামণ্ডপে ঘুরতাম।

আবদুল রশীদ নামের একজন শিল্পী ভালো দুর্গাপ্রতিমা বানাতেন। তাঁর বানানো প্রতিমাই বেশি দৃষ্টিনন্দন হতো। সবাই শিল্পী রশীদের রুচিবোধের প্রশংসা করতেন। পাকিস্তান আমল হলেও তখন সাধারণ মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা তীব্র ছিল না। শাসকগোষ্ঠী সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা পরিচালিত হলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির মনোভাব ছিল। আবদুল রশীদ যে দুর্গাপ্রতিমা বানাতেন, তাতে হিন্দু-মুসলমান কেউ কোনো আপত্তি করতেন না। তাঁর তৈরি প্রতিমারই বরং হিন্দুদের কাছে কদর ছিল বেশি। কোনো হিন্দু বলেননি যে, একজন মুসলমানের তৈরি প্রতিমা দিয়ে পূজা করা যাবে না। আবার মুসলমানরাও মূর্তি বানানোর কারণে রশীদের বিরোধিতা করেননি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে আবদুল রশীদ নিহত হয়েছিলেন।

আজ এখন অবাক হয়ে ভাবি, রাষ্ট্রযন্ত্র যখন সাম্প্রদায়িক ছিল, তখন মানুষ ছিল অধিক অসাম্প্রদায়িক। আর আজ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি আদর্শকে পরাজিত করে আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রায় ৫০ বছর পরে এসে দেখছি সাম্প্রদায়িকতার তেজীভাব। এখন অনেকেই ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিতে দ্বিধাগ্রস্ত। উগ্র ধর্মবাদীরা শক্তি সঞ্চয় করে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের শুধু বিরোধিতাই করছে না,  ভাঙার ঔদ্ধত্যও দেখাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা যেসব মূল্যবোধ অর্জন করেছিলাম, তা আর ধরে রাখতে পারছি না। আমরা ক্রমাগত পিছু হটছি। এর শেষ কোথায় তা আমরা জানি না।

এই প্রসঙ্গে খুব মনে পড়ছে ময়মনসিংহের এক অসাধারণ আলোকিত মানুষ আমীর আহমেদ চৌধুরীর কথা। আমরা তাঁকে রতনদা বা রতন স্যার বলেই বেশি চিনি। রতনদা ছিলেন একের মধ্যে অনেক। তিনি শিক্ষাব্রতী ছিলেন, মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, ক্রীড়াবিদ ছিলেন, সাংস্কৃতিক সংগঠক ছিলেন, সর্বোপরি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সমৃদ্ধ একজন রাজনীতিমনস্ক মানুষ।

আমীর আহমেদ চৌধুরীর জন্ম ১৯৪১ সালের ৮ নভেম্বর ফেনীর ফুলগাজীতে হলেও তাঁর শিক্ষা, বেড়ে ওঠা এবং কর্মজীবন ছিল ময়মনসিংহে। তিনি হয়ে উঠেছিলেন ময়মনসিংহের মাটির সন্তান। তিনি আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করে ১৯৬৪ সাল থেকে গৌরীপুর কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেছিলেন। তাঁর উদ্যোগে ১৯৫৯ সালে ময়মনসিংহে শিশু-কিশোর সংগঠন ‘মুকুল’ গঠিত হয়েছিল। ১৯৭০ সালে একটি জরাজীর্ণ ঘরে মাত্র ৪২ জন শিক্ষার্থী নিয়ে তিনি ‘মুকুল নিকেতন’ নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গৌরীপুর কলেজের অধ্যাপনা ছেড়ে তিনি ১৯৮৩ সালে মুকুল নিকেতনের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিয়ে নতুন যাত্রা শুরু করেছিলেন। তাঁর যোগ্য নেতৃত্ব, দক্ষতা ও পরিশ্রমের ফলে মুকুল নিকেতন এখন একটি দেশসেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

রতনদাকে অনেকে মানুষ গড়ার কারিগর বলে থাকেন। এটা একটুও বাড়িয়ে বলা নয়। কারণ তিনি কেবল পাঠ্যবইয়ের মধ্যে শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিকে সীমাবদ্ধ করে রাখতে চাননি। তিনি চেয়েছেন আনন্দমুখর পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা এমন একটি  আলেকিত প্রজন্ম যারা সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে সৃজনশীল ও মানবিকভাবে বিকশিত হবে। সেজন্য মুকুল নিকেতনে কেবল পড়াশোনা হতো না, আরো অনেক কিছু হতো। আবৃত্তি, নাচ, গান, বিতর্ক, খেলাধুলা, স্কাউট, গার্ল গাইডস – সবকিছু শেখানোর মধ্য দিয়ে প্রকৃত মানুষ হওয়ার শিক্ষা দেওয়া হতো সব শিক্ষার্থীকে।

কয়েক বছর আগে একবার ময়মনসিংহ বেড়াতে গিয়ে রতনদার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। উৎসাহ নিয়ে তাঁর স্বপ্নের স্কুলটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন। আবাসিক এই স্কুলটি ছিল রতনদার ধ্যানজ্ঞান।

বিকেলে স্কুলে একটি গানের ক্লাসে দেখলাম বয়স্ক

নারী-পুরুষের উপস্থিতি। বয়স্কদের শিক্ষাকেন্দ্র দেখেছি, বয়স্কদের জন্য গান শেখানোর স্কুল ময়মনসিংহের মতো শহরে রতনদার পক্ষেই করা সম্ভব হয়েছিল।

ব্রতচারী আন্দোলন এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টাও রতনদা করেছেন। ময়মনসিংহে তিনি একবার মুকুল নিকেতনে ব্রতচারী সম্মেলনেরও আয়োজন করেন। ১৯৩২ সালে ব্রিটিশ ভারতে গুরুসদয় দত্ত ব্রতচারী আন্দোলন শুরু করেছিলেন। দেশপ্রেম, জাতীয় চেতনা ও নাগরিকত্ব বোধ তৈরি করাই ছিল এ-আন্দোলনের মূল লক্ষ্য। সত্যনিষ্ঠা, সংযম, অধ্যবসায় ও আত্মনির্ভরতা ছিল এ-আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য। লোকনৃত্য, লোকসংগীত ও শরীরচর্চার মধ্য দিয়ে মানসিক ও আত্মিক বিকাশ এবং দেশপ্রেমের শিক্ষা ব্রতচারীদের দেওয়া হতো। ব্রতচারী হওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞা করতে হতো :

আমি বাংলাকে ভালোবাসি

আমি বাংলার সেবা করবো

আমি বাংলার ব্রতচারী।

গুরুসদয় দত্ত লিখেছিলেন :

ষোল আনা বাঙালি হ’

বিশ্ব মানব হবি যদি

শাশ্বত বাঙালি হ’। …

বাংলাদেশে পটুয়া কামরুল হাসান, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ওয়াহিদুল হক, অধ্যাপক ড. সন্জীদা খাতুন প্রমুখ এই ব্রতচারী আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

আমীর আহমেদ চৌধুরী, আমাদের প্রিয় রতনদাও ব্রতচারী আন্দোলনের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে খাঁটি বাঙালি এবং দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। এই লক্ষ্যে কাজও করছিলেন। আজ দেশে তরুণ সমাজের একাংশের মধ্যে আমরা উদ্বেগের সঙ্গে মাদকাসক্তিসহ নানা অবক্ষয় লক্ষ করছি। দেশপ্রেমেরও চরম ঘাটতি। এখন ব্রতচারী আন্দোলন এগিয়ে নিতে পারলে সুফল পাওয়া যেত বলে আমার মনে হয়। কিন্তু এখন নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো মানুষ সমাজে খুব একটা পাওয়া যায় না। এখন সবাই নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত।

অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, রতনদাও আর আমাদের মাঝে নেই। ২০২০ সালের ১৫ অক্টোবর স্বপ্নবান মানুষ রতনদা আমাদের মাঝ থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। রতনদার মৃত্যু যে-শূন্যতা তৈরি করেছে, বাস্তবিক পক্ষেই তা সহজে পূরণ হবে না।

নয়

আমার ছোটবেলায় দেখা ময়মনসিংহ শহরটা এখনো আমার চোখে ছবির মতো ভাসে। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে গড়ে ওঠা শহরের ইতিবৃত্ত তেমন জানি না। কবে কখন কীভাবে শহরটি গড়ে উঠেছিল, তা জানার খুব কৌতূহলও ছিল না। ময়মনসিংহে ছোটবেলায় খুব বড় দালানকোঠা দেখিনি। বেশিরভাগ বাড়ি ছিল একতলা দালান অথবা আধাপাকা অর্থাৎ ইটের দেয়াল আর ওপরে টিন। সরকারি ভবনগুলোও ছিল ব্রিটিশ আমলে তৈরি লাল ইটের একতলা বাড়ি। তবে অধিকাংশ বাড়ি ছিল অনেক বড়, বিশাল এলাকাজুড়ে। ডিসি, এসপির বাংলো, সার্কিট হাউস, পুলিশ লাইন্স – এসব ছিল দেখার মতো। টাউন হল ছিল, যেখানে বিভিন্ন উপলক্ষে সভা-সমাবেশ হতো। নাটক-থিয়েটারও হতো। মুসলিম ইনস্টিটিউশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান ছিল, সেখানে শরীরচর্চার ব্যবস্থা ছিল। কুস্তি শেখানো হতো বলেও জানতাম। ইন্ডোর খেলাধুলার ব্যবস্থা ছিল। এখন এগুলোর সংস্কার হয়েছে। আকার-আকৃতিতেও পরিবর্তন এসেছে।

আমরা ময়মনসিংহ শহরে মেয়েদের তিনটি স্কুল দেখেছি। সেই ষাটের দশকে খুব বেশি জেলা শহরে মেয়েদের জন্য তিনটি স্কুল ছিল বলে মনে হয় না। বিদ্যাময়ী স্কুল, মহাকালী স্কুল এবং রাধাসুন্দরী স্কুল। বিদ্যাময়ী স্কুলে মুক্তাগাছার জমিদারের অতিথি হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও একবার এসেছিলেন। এই স্কুলগুলো সম্ভবত রাজা বা জমিদারদের উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শহরে ছেলেদের জন্যও তিনটি স্কুল ছিল। জেলা স্কুল ছিল সরকারি। অন্য দুটি স্কুলের নাম ছিল মৃত্যুঞ্জয়ী স্কুল এবং সিটি স্কুল। শহরতলিতে নাসিরাবাদ স্কুল নামেও একটি স্কুল ছিল, যেটা পরে নাসিরাবাদ কলেজ হয়েছে। নাসিরাবাদ কলেজে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন যতীন সরকার। খ্যাতিমান প্রাবন্ধিক ও প্রগতিশীল রাজনীতির সক্রিয় মানুষ যতীন সরকার সম্পর্কে পরে আরো বলার সুযোগ হবে।

ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের অনেক খ্যাতি ছিল। মেয়েদের কলেজ হিসেবে মমিনুন্নেসা কলেজেরও ব্যাপক পরিচিতি ছিল। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার পর ময়মনসিংহ শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে নিঃসন্দেহে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নামে একটি সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠাও ময়মনসিংহের শিল্প-সংস্কৃতি বিকাশে অনুকূল ভূমিকা রেখেছে।

আমাদের সময়ে শহরে দুটি সিনেমা হল ছিল। একটি অলোকা, অন্যটি ছায়াবাণী। আমরা পালিয়ে বা লুকিয়ে ওই দুই সিনেমা হলেই সিনেমা দেখেছি। সাধারণত দুপুর আড়াইটার দিকে যে ম্যাটিনি শো হতো, আমরা সেটাতেই দেখতাম। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় পর্যন্ত ওই দুটি হলে ভারতীয় বাংলা ও হিন্দি সিনেমা  দেখানো হতো। কয়েকটি সিনেমার স্মৃতি এখনো মনে আছে।

ময়মনসিংহে তখন এস কে হাসপাতাল নামে একটি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ছিল। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার আগে পর্যন্ত এস কে হাসপাতালই ছিল চিকিৎসাসেবা পাওয়ার একমাত্র মাধ্যম। এস কে হাসপাতালকে এখন বক্ষব্যাধি হাসপাতালে পরিণত করা হয়েছে।

আমরা ছোটবেলায় কয়েকজন ডাক্তারের নাম খুব শুনতাম। মেডিসিনের ডা. কে পি ঘোষ, চোখের ডা. পি এম রায়, দাঁতের

ডা. কে বি ডন্ডের নাম খুব শুনতাম। তাঁরা সবাই মানবহিতৈষী ছিলেন। গরিব রোগীদের কাছ থেকে ফি নিতেন না, এমনকি অনেক সময় কাউক কাউকে ওষুধও দিতেন ফ্রি। তবে এই চিকিৎসকরা একসময় দেশত্যাগী হয়েছেন। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় অনেক সংখ্যালঘুর ওপর সরকারি নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা নিয়েছিল। নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতারও করা হয়েছিল অনেককে। চিকিৎসকরা তাঁর মধ্যে না পড়লেও যুদ্ধের পর তাঁরা হয়তো আর পাকিস্তানে থাকা নিরাপদ মনে করেননি।

রবি সেন নামেও একজন প্রসিদ্ধ এলএমএফ ডাক্তার ছিলেন। তিনিও অত্যন্ত পরোপকারী ছিলেন। তিনি আমাদের পারিবারিক চিকিৎসকের মতো ছিলেন। বেশ লম্বা-চওড়া গড়নের ডা. রবি সেন ধুতির ওপর ফুলহাতা শার্ট পরতেন। তার দুজন কম্পাউন্ডার ছিল। পয়সা ছাড়াই কতজনকে যে তিনি তাঁর বিখ্যাত মিক্সচার (শিশিতে তরল ওষুধ) দিতেন! তিনি রাজনীতিমনস্ক ছিলেন। বিকেলের দিকে তিনি কম রোগী দেখতেন। বিকেল-সন্ধ্যায় তাঁর ডিসপেনসারিতে বসতো রাজনৈতিক আড্ডা। সেখানে আওয়ামী লীগ নেতারা যেমন যেতেন, তেমনি কমিউনিস্ট পার্টির অনেকেরও আনাগোনা ছিল। মন্মথ রায়, আলোকময় নাহা, যতীন সরকার, রিয়াজুল ইসলামের মতো ব্যক্তিরা রবি দাসের সঙ্গে আড্ডা দিতেন বলে শুনেছি।

স্বাধীনতার পরেও রবিদা ময়মনসিংহেই ছিলেন। আমার পুত্রকন্যাদের আমি রবিদার পরামর্শমতোই ছোটবেলায় যত্নআত্তি করেছি। তিনি বাচ্চাদের বুকের দুধ খাওয়ানোর পরামর্শ দিতেন। বাচ্চাদের গড়ে-বেড়ে ওঠার জন্য মায়ের ভূমিকার ওপর জোর দিতেন সবসময়। সকালে ভালোমতো স্নান করিয়ে আবার বিকেলে শরীর ভালোমতো মুছে দিতে বলতেন। আমি তাঁর পরামর্শ মেনে চলার চেষ্টা করতাম।

ময়মনসিংহে তখন সবচেয়ে দর্শনীয় স্থান ছিল শশীলজ নামে রাজবাড়ি। ময়মনসিংহ শহরের প্রাণকেন্দ্রে ব্রহ্মপুত্রের অদূরে এই রাজবাড়ি অবস্থিত। ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে নয় একর জমির ওপর একটি অসাধারণ দোতলা ভবন নির্মাণ করেছিলেন মুক্তাগাছার মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য। তিনি তাঁর দত্তক পুত্র শশীকান্ত আচার্যের নামে এর নামকরণ করেছিলেন ‘শশীলজ’। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন ভূমিকম্পে ভবনটি বিধ্বস্ত হলে সূর্যকান্ত আচার্য খুবই ব্যথিত হয়েছিলেন। ১৯০৫ সালে একই স্থানে একই আদলে শশীলজ পুনর্নির্মাণ করেন শশীকান্ত নিজেই।

শশীলজে বা রাজবাড়ির মূল ফটকে আছে ১৬টি গম্বুজ। এছাড়া ভবনের প্রায় প্রতিটি ঘরে আছে ছাদ থেকে ঝুলন্ত ঝাড়বাতি। আছে নাচঘর, স্নানঘর। পেছনের স্নানঘর দোতলায়। স্নানঘরে বসে রানি পাশের পুকুরে হাঁসের খেলা দেখতেন বলে শোনা যায়। পুকুরটির ঘাট মার্বেল পাথরে বাঁধানো। স্নানঘরে একটি সুড়ঙ্গ আছে। এই সুড়ঙ্গপথে নাকি মুক্তাগাছা যাওয়ার ব্যবস্থা ছিল।

 শশীলজের মূলভবনের সামনে সুন্দর বাগান। বাগানের মাঝখানে শ্বেতপাথরের ফোয়ারা। সেখানে আছে গ্রিক দেবী ভেনাসের স্বল্পবসনা স্নানরত মর্মর মূর্তি। বাড়ির আশেপাশে নাগলিঙ্গমসহ প্রাচীন গাছগাছালি ছিল।

১৯৫২ সাল থেকে শশীলজ মহিলা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। ২০১৫ সালের ৪ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর জাদুঘর স্থাপনের জন্য শশীলজ অধিগ্রহণ করে।

আঠারোবাড়ির জমিদারবাড়িটি একতলা ভবন হলেও বেশ বড়সড় এবং দর্শনীয় ছিল। এছাড়া সাবেক মন্ত্রী ও রাজনীতিবিদ মনোরঞ্জন ধরের বাড়টি ছিল দোতলা। এটা নাকি তাঁকে দান করেছিলেন একজন কংগ্রেস নেতা। মনোরঞ্জন ধরও একসময় কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যে-সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয়েছিল, তিনি তাঁর সদস্য ছিলেন। ১৯৭২ সালে তাঁকে জাপানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করা হয়েছিল। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হন এবং বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় আইন ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায়ও তাঁকে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। আগেই বলেছি, মনোরঞ্জন ধরের স্ত্রী আমার স্কুলশিক্ষকা ছিলেন।

ময়মনসিংহের সব স্থাপনাই গড়ে উঠেছিল ব্রহ্মপুত্রকে ঘিরে। আমার দাদুবাড়ির কাছাকাছি ছিল শিববাড়ি, রঘুনাথজীর আখড়া, গুরুনানকের মঠসহ কিছু ধর্মীয় স্থাপনা। ময়মনসিংহে বেশ কয়েকটি মসজিদও ছিল। আমার মনে আছে, মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে এলে ভোরে আমাদের ঘুম ভাঙতো। মানুষ যার যার মতো ধর্ম পালন করতো। কেউ কারো ধর্ম পালনে বাধা দিতো না। আমরা গুরুনানকের মঠে গিয়ে খিচুড়িও খেয়েছি। মেয়েদের অবশ্য মাথায় কাপড় দিয়ে যেতে হতো।

পণ্ডিতপাড়া, বাঘমারা, পচাপুকুর – বিভিন্ন এলাকার এমন নাম ছিল। পণ্ডিতপাড়ায় কোনো বিখ্যাত পণ্ডিতের বাস ছিল কি না, কিংবা কেউ কখনো বাঘ মেরেছিলেন বলে জায়গার নাম বাঘমারা হয়েছিল কি না, তা আমি জানি না। তবে পচাপুকুর মোটেও পচা ছিল না। অনেককেই ওই পুকুরের জলে কাপড়চোপড় ধোয়া, বাসনকোসন মাজার কাজ করতে আমি দেখেছি। তবে গোল পুষ্কুরিণীর অস্তিত্ব এখন আর নেই। কালীবাড়ি, সেনবাড়ি বলে কিছু বাড়িও বেশ পরিচিত ছিল। কোনো কোনো জায়গার নামও পরিবর্তন হয়েছে।

ভোলাদার বেঙ্গল কেবিন একসময় বেশ নামকরা মিষ্টির দোকান ছিল। ওই দোকানেও অনেকের আড্ডা ছিল। চায়ের কাপে ঝড় তোলা কথাটি বেঙ্গল কেবিনে গেলে সত্য বলে মনে হতো। বেঙ্গল কেবিনে কখনো ‘রাজনৈতিক আলোচনা নিষেধ’ বলে সতর্কবার্তা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে শুনিনি। তবে কালস্রোতে যেমন জীবন যৌবন ধন মান ভেসে যায়, তেমনি বেঙ্গল কেবিনও তার জৌলুস হারিয়েছে।

দশ

ময়মনসিংহে নারীশিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে ১৯৫৯ সালের ২৯ জুলাই মুমিনুন্নিসা কলেজ উদ্বোধন করা হয়। সমাজসেবক আলহাজ সজুতুর রহমান খান, মজুতুর রহমান খান, ফয়েজউদ্দিন খান, মফিজউদ্দিন খানদের মা মুমিনুন্নিসার নামে এই কলেজটি তাঁরাই প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। কলেজটি প্রতিষ্ঠা করে এম আর খান কোম্পানি। এই কোম্পানি  ছিল সব ভাইয়ের সমন্বয়ে একটি পার্টনারশিপ কোম্পানি। ব্রিটিশ আমল থেকেই এই কোম্পানি চা এবং পাটের ব্যবসা করতো। এই কলেজের জমি থেকে শুরু করে সিংহভাগ অবকাঠামো এম আর খান কোম্পানির দান। মজুতুর রহমান খান (এম আর খান) নিজে বিভিন্ন ধনী ও সমাজসেবী ব্যক্তির কাছ থেকে কলেজের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন। শুরুতে খান সাহেবদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কলেজটি পরিচালিত হতো। কলেজের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল ছিলেন শিক্ষাবিদ আলহাজ রিয়াজউদ্দিন আহমেদ। কলেজটিতে বিজ্ঞান বিভাগ চালু হয় ১৯৬১ সালে এবং ১৯৬৩ সালে ডিগ্রি কলেজে উন্নীত হয়। পরে ১৯৮০ সালে মুমিনুন্নিসা কলেজ সরকারিকরণ হয়।

 আমি ১৯৬৪ সালে ম্যাট্রিক পাশ করে এই কলেজে ভর্তি হই। পরে বিএ পড়ার সময় মুমিনুন্নেসা কলেজ ছাত্রী সংসদের সাংস্কৃতিক সম্পাদক নির্বাচিত হই। এরপর ছাত্র ইউনিয়নের কাজকর্মে আমার অংশগ্রহণ বেড়ে গিয়েছিল। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা আমাদের কলেজে আসা-যাওয়া করতেন। আমিও তখন বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার জন্য কলেজের বাইরে যেতে শুরু করি। আবার কলেজের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায়ও মনোযোগী হয়ে উঠি। আমি সাংস্কৃতিক সম্পাদক থাকতেই দুটি গীতি আলেখ্য মঞ্চস্থ করে প্রশংসিত হয়েছিলাম। দুটি গীতি আলেখ্যে আমি নিজেও অভিনয় করেছিলাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সামান্য ক্ষতি’ কবিতা অবলম্বনে গীতি আলেখ্যে আমি রানির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলাম। এখনো মনে আছে সেই সংলাপ  :

উহু উহু শীতে মরি

সকল অঙ্গ উঠিছে শিহরি

জ্বেলে দে আগুন ওগো সহচরী

শীত নিবারিবো অনলে …

আরেকবার করেছিলাম ‘স্বর্গ হতে বিদায়’ অবলম্বনে গীতি আলেখ্য। আমি দেবযানীর ভূমিকায় পাঠ করেছিলাম। একটি সংলাপের অংশ মনে পড়ে :

আজ রজনীতে হয়েছে সময়

এসেছি বাসবদত্তা …

আমাদের সময় কলেজে অধ্যক্ষা ছিলেন মোসলেমা খাতুন। তাঁর কাছে শাসন এবং প্রশ্রয়  দুটোই পেয়েছি। শিক্ষকদের মধ্যে নারী ও পুরুষ উভয়ই ছিলেন। তবে পুরুষ শিক্ষকই বেশি ছিলেন। নারী শিক্ষকদের বেশি ছিলেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের স্ত্রী। অধ্যক্ষা কলেজ কম্পাউন্ডের বাসাতেই থাকতেন। ছাত্রীদের জন্য একটি আবাসিক হোস্টেল ছিল। তবে অল্পসংখ্যক ছাত্রী সেখানে থাকতো। আমরা মাঝেমধ্যে হোস্টেলে গিয়ে আড্ডা দিতাম। এখন কলেজে দুটি ছাত্রী হোস্টেল হয়েছে। কলেজে একটি লাইব্রেবি বা গ্রন্থাগার আছে। গ্রন্থাগারটি দিন দিন সমৃদ্ধ হয়েছে। বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক ইফফাত আরা এবং সংগীতশিল্পী মিতালী মুখার্জি এই কলেজের ছাত্রী ছিলেন। বর্তমানে মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় নেত্রী রেখা সাহাও এই কলেজের ছাত্রী ছিল। রেখা ছাত্র ইউনিয়ন থেকে কমিউনিস্ট পার্টির কাজেই বেশি আগ্রহী ছিল। তার বড় বোন শিখা সাহা ছিল আমার সহপাঠী। আমরা দুজনে একসঙ্গে ছাত্র ইউনিয়ন করতাম। এই দুই বোনের বাবা আশুতোষ সাহা ছিলেন খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ। তিনি ন্যাপ করতেন। জেল-জুলুম সহ্য করেছেন। রেখা সাহার স্বামী ছবি বিশ্বাসও সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। ছবি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন।

আমাদের সময় মুমিনুন্নিসা কলেজে কোনো ক্যান্টিন না থাকায় আমাদের চা-নাস্তা খাওয়ার সুযোগ ছিল না। অবশ্য  কলেজের সামনে বাদাম বিক্রেতা বসতো। বাদামই ছিল আমাদের প্রধান হালকা নাস্তা। তবে কলেজগেটে একজন হিন্দু বৃদ্ধ বিধবা মহিলা ক্ষীরের নাড়ু, নারকেলের তক্তি ইত্যাদি বিক্রি করতেন। কেউ কেউ সেগুলো কিনে খেতো। এখনকার মতো জলের বোতল তখন ছিল না। টিউবঅয়েলের জল ছিল আমাদের তৃষ্ণা নিবারণের উপায়।

কলেজের গেটে পাহারায় থাকতেন গগনদা। তিনি বেশ কড়া ধাঁচের মানুষ ছিলেন। ছাত্রীদের ওপর ছিল তাঁর কঠিন নজরদারি। কলেজের সামনে ছেলেরা ঘুরঘুর করে কি না, কোনো ফাঁকে গোপনে চিরকুট-বিনিময় হয় কি না – এসব দিকে নিজ গরজেই তিনি চোখ রাখতেন। সন্দেহজনক কিছু নজরে এলে অধ্যক্ষার কাছে রিপোর্ট দিতে ভুল করতেন না গগনদা। পথেঘাটে মেয়েদের হয়রানি-হেনস্তার কথা আমরা খুব একটা শুনিনি।

ছাত্র ইউনিয়নে সক্রিয় হওয়ার পর কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কেও জানতে শুরু করি। কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকলেও ছাত্র ইউনিয়নের শীর্ষ নেতারা গোপনে পার্টির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে আমরা জানতাম। আমার বড়ভাই বিকাশ পালও গোপন পার্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন।

কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে কেউ কেউ কমিউনিস্টদরদি ছিলেন। তাঁদের বাসায় পার্টির আত্মগোপনকারী নেতাদের

আসা-যাওয়া, গোপন মিটিং ইত্যাদি হতো। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শহর থেকে একটু দূরে হওয়ায় গোয়েন্দা নজরদারিও হয়তো কিছুটা শিথিল ছিল। বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও গবেষক শামসুজ্জামান খানও

কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। তাঁর বাসায় কমিউনিস্টদের যাতায়াত ছিল। ডিন করিম সাহেব এবং তাঁর স্ত্রী সুফিয়া আপাও বামপন্থী নেতাকর্মীদের নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। ড. সন্জীদা খাতুনের বোন ফাহমিদা খাতুনও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন। তিনিও প্রগতিশীল চিন্তার মানুষ ছিলেন।

১৯৬৯ সালে ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলে আমরা ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বাড়ি বাড়ি এবং দোকানে দোকানে গিয়ে ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ করে দুর্গত এলাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলাম। আমাদের এই উদ্যোগ মানুষের কাছে প্রশংসিত হয়েছিল। রাজনৈতিকভাবে আমাদের বিরোধীরাও আমাদের হাতে সাহায্যসামগ্রী তুলে দিতে দ্বিধা করেনি। মুসলিম লীগ নেতা হান্নান সাহেবের কাছ থেকেও আমরা চাঁদা নিয়েছিলাম বলে আমার মনে আছে। ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীদের সব দলমতের মানুষই একটু সমীহের চোখে দেখতো। আমরাও এতে উৎসাহ বোধ করতাম।

কলেজে থাকতেই দুজন মানুষের সঙ্গে পরিচয়ের কথা আমার চিরদিন মনে থাকবে। তাঁদের একজন সাহিত্যিক ও বিপ্লবী রাজনৈতিক আন্দোলনের নেতা সত্যেন সেন, অন্যজন  পদার্থবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক অজয় রায়। অজয় রায়ের সঙ্গে পরে আমাদের ঘনিষ্ঠ পারিবারিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।

সত্যেন সেন ময়মনসিংহে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচীর একটি কর্মসূচিতে অংশ নিতে গিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর লেখা দুয়েকটি বই ততোদিনে আমার পড়া হয়েছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য রুদ্ধদ্বার মুক্তপ্রাণ, গ্রাম বাংলার পথে পথে। সত্যেনদা আমাদের বাসায়ও এসেছেন। তিনি খুবই সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন। কথাও কম বলতেন। প্রথম সাক্ষাতের দিন আমি সত্যেনদার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, রুদ্ধদ্বার মুক্তপ্রাণ তাঁর আত্মকথা কি না। তিনি প্রশ্ন শুনে মুচকি হেসেছেন, কোনো কথা বলেননি। আমি অবশ্য পরে ওই প্রশ্ন করার জন্য লজ্জা পেয়েছি।

আমি সত্যেনদার সঙ্গে ঢাকায়ও একবার দেখা করেছি। তিনি তখন নারিন্দায় হেলেন আপার বাসায় থাকতেন। আমি গেন্ডারিয়ায় আমার এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেছিলাম। এটা পাকিস্তানের শেষ দিকের ঘটনা। সত্যেনদা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছেন। ইতিহাস-আশ্রিত তাঁর উপন্যাস এবং অন্য উপন্যাসগুলোও ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। বিজ্ঞানবিষয়ক কয়েকটি বইও তিনি লিখেছেন। দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেললেও অন্যের সাহায্য নিয়ে তিনি লেখালেখি আমৃত্যু অব্যাহত রেখেছিলেন। রাজনৈতিক সাহিত্যে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল।

সম্ভবত ১৯৬৮ সালে ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলনে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অজয় কুমার রায়। তিনি আমাদের বাড়িতে দুপুরে আহার করেছিলেন। প্রথম দেখেই আমি তাঁর ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়েছিলাম। একমাথা ঝাঁকড়া চুলের সুদর্শন অজয় রায়কে আমার দেবদূতের মতো লেগেছিল। আমি ঢাকায় আসার পর তাঁকে নিয়ে আমার কিছু মজার ঘটনার কথা মনে পড়ে। আমার স্বামী অজয় রায়ের সঙ্গে অধ্যাপক অজয় রায়কে কেউ কেউ গুলিয়ে ফেলতেন। কমিউনিস্ট পার্টির মিটিংয়ে গেলে অনেকেই আমার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য আমার নাম-পরিচয় জানতে চাইলে আমি বলতাম, আমি অজয় রায়ের স্ত্রী। তখন কেউ কেউ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলতেন, ও আপনি স্যারের স্ত্রী? স্যার খুব ভালো মানুষ। কেউ আবার বলতেন, স্যার তো আমাদের হলের প্রভোস্ট (জগন্নাথ হল)। নাম নিয়ে বিভ্রান্তির বিষয়টি বুঝেও আমি চুপ করে থাকতাম। কিছু বলতাম না। মনে মনে ভাবতাম, ঢাকায় থাকি, তাই রহস্যটা ঢাকাই থাক। অজয় রায় লেখা অধ্যাপক অজয় রায়ের প্যাকেট দু-একবার আমাদের বাড়িতে এসেছে। এই বিভ্রান্তি দূর হতে সময় লেগেছে।

অধ্যাপক অজয় রায় পরে একাধিকবার আমাদের বাসায় এসেছেন। আমরা পারিবারিক বন্ধুতে পরিণত হয়েছিলাম। তিনি বয়সে আমার বড় হলেও আমাকে বউদি বলেই ডাকতেন। তবে জয়ন্তীর বদলে আমি ছিলাম তার অঞ্জলি বউদি। কেন তিনি আমাকে অঞ্জলি নাম দিয়েছিলেন আমি জানি না।

২০০৭ সালে সিডরের পর আমরা পটুয়াখালীর খেপুপাড়ায় একসঙ্গে ত্রাণকাজে অংশ নিয়েছি। তাঁর মনটি ছিল দরদি। মানুষের বিপদ-আপদে তাদের পাশে দাঁড়াতেন। ২০০১-এর নির্বাচনের পর যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হয়, সেসময় তিনি বিপন্ন নারী-পুরুষ-শিশুদের নানা উপায়ে সাহায্য করেছেন। তিনি আমার স্বামী অজয় রায়ের সঙ্গে একসঙ্গে সামাজিক আন্দোলনও করেছেন। তাঁদের দুজনের মধ্যে রাজনীতি নিয়ে তর্কবিতর্ক হতো। কিন্তু মতান্তরের জন্য মনান্তর হয়নি কখনো। অজয় রায়ের পুত্র বিজ্ঞান লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়কে ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির কাছে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। পুত্রশোকে তিনি কাতর হলেও নাগরিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেননি আমৃত্যু। ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এর কয়েক বছর আগে তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। অনুষ্ঠানে তিনি মঞ্চে আমাকে তাঁর পাশে বসিয়েছিলেন এবং কিছু বলতে বলেছিলেন। তাঁর মতো কৃতবিদ্য মানুষ সম্পর্কে আমি আর কী বলতে পারি!  তারপরও নিয়ম রক্ষার জন্য বলেছিলাম, আপনি জয়ন্তী থেকে আমাকে অঞ্জলি বানিয়েছেন, তাই মনের অর্ঘ্য দিয়ে জন্মদিনে আপনার প্রতি নিবেদন করছি আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি।