রেনিয়া স্পাইগেলের পাঁচটি কবিতা

অনুবাদ : ভার্গব বন্দ্যোপাধ্যায়

রেনিয়া স্পাইগেল একজন পোলিশ কিশোরী, হলোকাস্টের বলি। জন্ম ১৮ জুন ১৯২৪, মৃত্যু ৩০ জুলাই ১৯৪২।

উরিনকোস নামে তৎকালীন একটি পোলিশ শহরে তাঁর জন্ম, যা বর্তমানে পশ্চিম ইউক্রেনের অন্তর্গত। রোমানিয়ার সীমান্তে অবস্থিত, নিস্টার নদীতীরে ছিল কিশোরীটির পিতার বিশাল খামার। সেখানেই ছয় বছরের ছোট বোন আরিয়ানার সঙ্গে বেড়ে উঠেছেন। ছোট বোন ছিল নামকরা শিশুশিল্পী।

১৯৩৮ সালে তাঁর মা তাঁকে মাতামহীর সঙ্গে থাকার জন্যে পাঠিয়ে দেন পেসেমিল (Przemys) শহরে আর নিজে চলে যান ওয়ারশ শহরে। সেখানে গিয়ে তাঁর সঙ্গে যোগ দেয় তাঁর ছোট বোন আরিয়ানা। ১৯৩৮ সালে মলোটভ-রিবেনট্রপ চুক্তি এবং তৎপরবর্তী নাৎসি জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণ তাঁদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। যুদ্ধ চলছিল, তার মধ্যেই রেনিয়া স্কুল এবং সামাজিক কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ১৯৪২ সালে পেসেমিল ঘেটো তৈরি হয়। অন্য ২৪ হাজার ইহুদির সঙ্গে রেনিয়াও থাকতে বাধ্য হয় ওই ঘেটোতে। একজন মুক্তিযোদ্ধা তাঁকে ওখান থেকে সরিয়ে, লুকিয়ে রাখেন তাঁর বাড়ির চিলেকোঠায়, কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে স্থানান্তরের হাত থেকে বাঁচাতে। একজন নাৎসি পুলিশ সে-খবর জেনে যায়। সেখান থেকে ধরে এনে রাস্তার ওপর গুলি করে মারে রেনিয়াকে। সেদিন ছিল ৩০ জুলাই ১৯৪২।

তাঁর জীবন নিয়ে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র ব্রোকেন ড্রিম আর তাঁর মৃত্যুর ৭৭ বছর পর প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ডায়েরি রেনিয়াস ডাইরি : এ হলোকাস্ট জার্নাল। – অনুবাদক

রচনাকাল : ৩১ জানুয়ারি ১৯৩৯

কবিতা-১

আবার কান্না আমাকে গ্রাস করেছে

কবে আমি সেইসব দিনগুলোকে ফিরে পাব

সেইসব লিনডেন গাছ, বাড়ি, প্রজাপতি, মরালেরা

দূরে … কোথাও … আমার দৃষ্টিসীমার বাইরে

আমি সেইসব হারানোদের দেখি, শুনি

হাওয়া এসে প্রাচীন গাছগুলোকে আদর করে যায়

কেউ আমাকে কিছুই বলে না

সেই কুয়াশার কথা, নৈঃশব্দ্যের কথা

সেই গভীর আঁধার, দোর খুলে দূরে চলে যায়

আমি সবসময় শুনি সেই ঘুমপাড়ানি গান

দেখো, কেমন পড়ে আছে আমাদের বাড়ি, পুকুর

আর আকাশে হেলান দিয়ে সেই লিনডেন গাছ …

রচনাকাল : ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯

কবিতা-২

একটা সাদা পাতা এলো

একটা সিনেমার সাপ্তাহিক পত্রিকা থেকে।

তারা আমাকে মাত্র গতকাল কিনে এনেছে

এর মাঝেই আমি হয়ে গেছি একটা আবর্জনা ছাড়া আর

                                                                কিছু নয়।’

তোমরা কিছু একটা দেখে থাকবে।

সে-পৃথিবীতে আমাদের বাস।

তুমি ছিলে চুপচাপ পত্রিকার স্তূপের মাঝে

যেখানে দিনরাত চলে বইপত্রের বেচাকেনা।

অন্যদিকে আমি ছুটতাম রাস্তা দিয়ে, গলা ফাটিয়ে।

তার থেকে ভালো ছিল সাপ্তাহিক হওয়া

বরং না হওয়া দৈনিক, রোজ যার চলে বেচাকেনা।

রচনাকাল : ৮ ডিসেম্বর ১৯৪০

কবিতা-৩

ওহে, এসো আমরা সুরা পানে মত্ত হই

আমাদের ওষ্ঠ থেকে চেটে নিই সে সুরা

যখন পানপাত্র শূন্য হয়ে যায়

এসো, আমরা আমাদের শোণিত পান করি

চেয়ে চেয়ে রত হই প্রার্থনায়

প্রেরণা আর ভালোবাসা জ্বলছে দাউদাউ

সৃষ্টি হোক অগ্নিকাণ্ডের

ক্রোধ জ্বলুক চিতার আগুনের মতো

কিন্তু হে কন্যা, মনে রেখো, ওই আগুনের শিখা

বইছে তোমার ধমনীতে

ওই রাত তোমাকে ভেতর থেকে পুড়িয়ে মারতে পারে

চেয়ে চেয়ে রত হই প্রার্থনায়

প্রেরণা আর ভালোবাসা জ্বলছে দাউদাউ

ক্রোধ জ্বলুক চিতার আগুনের মতো

লাল সুরার মতো হয়ে উঠেছে ঠোঁটের রং

এই জীবনের আগে মৃত্যু হয়েছে আরেকটা জীবনের

আগুনের তাপে আমাদের তরুণ হৃদয় উত্তপ্ত

শুধু আন্দোলিত হচ্ছে আমাদেরই জন্যে।

রচনাকাল : ১৯ মার্চ ১৯৪১

কবিতা-৪

ভালোবাসা নিয়ে আমার একটা ভয়ংকর অনুভূতি হচ্ছে

তপ্ত শোণিত ফুটছে আমার ধমনিতে

নৈকট্য যেন একটা মৌতাত হয়ে উঠেছে

গরম মাথায় বাসনার স্বপ্ন নিয়ে নিদ্রা এলো

আমার অনুভূতিগুলো ভেতরে ভেতরে মোচড় দিচ্ছিল

তারা আমাকে বেঁধে ফেলেছে, আষ্টেপৃষ্ঠে

আমি জানি, আমি একটা জন্তুতে পরিণত হয়েছি

আমার প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়েছি আমি

তবু আমি বুঝি একটা বিশ্বস্ত প্রাণীর মতো,

একটা লিংক্সের মতো লেজা নাড়াতে পারি না

আমার হৃদপিণ্ড ধড়ফড় করে, ভেতরে ভেতরে আমি গজরাই

যে-কোনো মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ে পশুর মতো সবকিছু

ঝাঁকিয়ে গাঁ গাঁ করে, হ্রেষাধ্বনি করে উঠে

ওই রক্তিম ওষ্ঠাধার কামড়ে ছিন্নভিন্ন করে দিই।

আমি উন্মত্ত, আমার ভয় ও টান প্রশমিত হবার নয়

আমি প্রাণবন্ত, শেষ হয়ে যাইনি

আর আমি চাই …

এইভাবে আর ভাবতে পারি না …

রচনাকাল : ৭ জুন ১৯৪২

কবিতা-৫

ভাবি, কাল হয়তো আমরা থাকব না

একটা শীতল ইস্পাতের ছুরি

আমাদের দুজনের মাঝ দিয়ে পিছলে যাবে, দেখো তুমি

কিন্তু আজ বেঁচে থাকার যথেষ্ট সময় আছে

কাল সূর্যে হয়তো গ্রহণ লাগবে

বুলেট এসে ঝাঁঝরা করে দেবে

হুংকার চারদিক, রক্তে ভেসে যাবে উঠোন,

ভরে যাবে নোংরা, দুর্গন্ধযুক্ত জমাট রক্ত আর বিষ্ঠায়।

আজ তুমি জীবন্ত

এখনো সময় আছে আত্মরক্ষা করার

এসো আমরা আমাদের রক্ত মাখামাখি করি

যখন সেই সংগীত আস্তে আস্তে এগিয়ে যায়

সেই ভয়ংকর বন্য সংগীত

জীবন্মৃতরা যাকে বয়ে এনেছে

শোনো, আমার প্রতিটি মাংসপেশি কাঁপছে

তোমার সান্নিধ্য পেতে আমার শরীর অধীর

এটা একটা কণ্ঠরোধ করার খেলা, এটা

নয় কোনো চুম্বনের চরম পরিসমাপ্তি।