প্রত্যেক মানুষ এক একটি স্বতন্ত্র অস্তিত্ব। মানুষের এই স্বাতন্ত্র্যের দুটি দিক আছে। এর একটি হলো তার বাহ্যিক গড়ন এবং অন্যটি হলো তার জীবনাচরণ। বাহ্যিক গড়নের দিক থেকে একজন মানুষ কতভাবে যে অন্যের থেকে আলাদা তার কোনো হিসাব নেই। মোটা দাগে উল্লেখ করা যায় তার বর্ণ, উচ্চতা, ওজন, চোখের রং, চুলের রং, গড়ন-সৌষ্ঠব, হাঁটার ভঙ্গি, কথা বলার ভঙ্গি ইত্যাদি। কিন্তু জীবনাচরণের বিষয়টি অনেকাংশেই বুদ্ধিবৃত্তিক যা জীবন ও জগতের প্রতি ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি ও দৃষ্টিকোণের ওপর নির্ভর করে। এর সঙ্গে নিরাময়হীন নিয়তির মতো কাজ করে নিরন্তর পূর্বপুরুষদের উত্তর-সাধনা। কিছুতেই ব্যক্তি তার নিজের উত্তরাধিকারকে অস্বীকার করতে পারেন না। এসব মিলিয়ে তৈরি হয় একজন স্বতন্ত্র রীতির মানুষ। সুতরাং পৃথিবীতে এত যে বৈচিত্র্য – এর মূলে রয়েছে রীতির খেলা। যেখানে রীতির চর্চা আছে, শৈলীর চর্চা আছে, সেখানেই আছে বৈচিত্র্য, বৈচিত্র্যের সৌন্দর্য ও আনন্দ।
Style বা শৈলী বা রীতির বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়ে আসছে শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে। সুপ্রাচীনকাল থেকে অর্থাৎ শিল্প-সাহিত্য চর্চার সেই আদিলগ্ন থেকে তার শৈলী বিশ্লেষণের সাহিত্যও রচিত হয়ে আসছে। আর এই রীতির স্বাতন্ত্র্যের মধ্যেই একজন শিল্পী, একজন কবি বা কথাসাহিত্যিক অনন্য হয়ে ওঠেন। এখন যদি জীবনানন্দ দাশের কোনো কবিতা থেকে তাঁর নাম মুছে দিয়ে অনেকের কবিতার মধ্যে তাঁর কবিতা হারিয়ে যেতে দেওয়া হয়, তাহলে সেই অনেকের কবিতা থেকে একজন জীবনানন্দ-ভক্ত সহজেই ওই কবিতাটি খুঁজে নিতে পারবেন। আর এখানেই নিহিত আছে জীবনানন্দীয় কাব্যশৈলীর অনন্যতা।
এই শৈলী বা রীতির জগৎ তৈরি করা বা তৈরি হওয়ার বিষয়টি সহজ নয়। একটি জটিল প্রক্রিয়ায় বিচিত্র বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য, সমতা ও সমন্বয়তার ভেতর দিয়ে তৈরি হয় রীতির জগৎ। কবিতায়, কথাসাহিত্যে, নাটকে বা প্রবন্ধে এই রীতির জগৎ তৈরি হয় ভাষার আশ্রয়ে। বাচনের বিশিষ্ট গড়নের জন্য যেমন ব্যক্তিমানুষ অনন্য হয়ে উঠতে পারেন, তেমনি ভিন্ন এক মাত্রা ও উচ্চতায় ভাষার আশ্রয়ে তৈরি হয় সাহিত্যের বিশিষ্ট গড়ন। রং ও রেখায়, আলো ও আঁধারে তৈরি হয় শিল্পের অনন্যতার অবয়ব।
কিন্তু ভাষা নিঃসন্দেহেই একটি শাশ্বত বিষয়। প্রাচীনকালে এই ভূখণ্ডের মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলতেন, এখনো তারা বাংলা ভাষায়ই কথা বলছেন। সুতরাং ভাষা ব্যক্তিগত কোনো বিষয় নয় – ব্যক্তি ও কালের ঊর্ধ্বে ভাষা একটি সর্বজনীন বিষয়। কমপক্ষে কোনো ভাষাতাত্ত্বিক জাতি-গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে এই সর্বজনীনতা স্বীকার্য। সুতরাং বলা যায়, রীতির বিষয়টি ভাষার বিষয় নয় – বাচনের বিষয়। ফার্দিনান্দ দ্য স্যুসার এই বাচনকে বলেছেন ‘parole’। অর্থাৎ ব্যক্তিমানুষ যখন তার কথায় বা লেখায় ভাষা (langue) ব্যবহার করেন, তখন তাকে আর ‘ভাষা’ বলা যাবে না। তাকে বলতে হবে ‘বাচন’ বা parole। দাবা খেলার সুনির্দিষ্ট বিধিবিধান রয়েছে, যার একটি সর্বজনগ্রাহ্য অবয়ব আছে। এই অবয়বটি ইচ্ছামতো পরিবর্তনযোগ্য নয়। ভাষা দাবা খেলার নিয়মের মতো একটি সংগঠন। কিন্তু দাবা যখন কেউ খেলেন তখন প্রতিমুহূর্তে তিনি যে-চাল দেন, তা একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। এখানে কাজ করে তাঁর বুদ্ধিমত্তা, পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুধাবন করার যোগ্যতা এবং বিচিত্র বৈপরীত্যের সঙ্গে সংহতি স্থাপনের দক্ষতা। ভাষার ক্ষেত্রে স্যুসার একেই বলেছেন parole বা বাচন। সুতরাং রীতি ও শৈলীর প্রশ্নটি ভাষার প্রশ্ন নয় – বাচনের প্রশ্ন, যা একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। এক্ষেত্রে বক্তা যখন কথা বলেন, তখন তাঁর শব্দচয়ন থেকে শুরু করে বাক্য গঠন পর্যন্ত বক্তব্য উপস্থাপনের পুরো সংগঠনটি একান্ত তাঁর নিজস্ব হয়ে ওঠে, মানুষ হিসেবে তাঁর স্বাতন্ত্র্যের জন্য। নিরন্তর উত্তর-সাধনায় তিনি তাঁর দেহে যে জিন বহন করেন, সেই থেকে শুরু করে তাঁর আর্থ-সামাজিক অবস্থা, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, শিক্ষা-দীক্ষা ইত্যাকার পরিস্থিতির ওপর। সুতরাং যাকে আমরা রীতি বা style বলি, সেটা ভাষার বিষয় নয় – বাচনের বিষয়। আর এই বাচনই নির্ধারণ করে একজন কথাশিল্পীর অনন্যতার স্বরূপ।
উপন্যাসের ক্ষেত্রে রীতির এই প্রশ্নটি খুবই জটিল। কারণ উপন্যাসে বহুতর কণ্ঠস্বর এমন সব আর্থ-সামাজিক পটভূমিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে, যেখানে শুধু বৌদ্ধিক (cognetive) আচরণের সমন্বয় বিবেচ্য নয়, বরং একটি সমতৌলিক (plane field) পটভূমিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হয়। কেননা, ভাষার জগৎ অর্থাৎ বাচনের জগৎ আর ভাব, বস্তু ও ঘটনাময় বিশ্বচরাচরের মধ্যে দ্বৈরথ চিরকালের। একে স্থান, কাল ও সময়ের ঐক্য বলা যায় – বাচনের ভেতর দিয়ে সাহিত্যিকগণ যাকে মহিমান্বিত করে তোলেন। সাধারণ মানুষ এই দুয়ের মধ্যে একটি বৌদ্ধিক ও সমতৌলিক সমন্বয় সাধন করতে পারে না। কিন্তু যিনি শিল্পী-কথাশিল্পী-কথাসাহিত্যিক তিনি অনন্য এক বাচন-কৌশলের ভেতর দিয়ে ভাব, বস্তু ও ঘটনাময় বিশ্বচরাচরের ভেতরগত দরজা-জানালাগুলো পাঠকের সামনে তুলে ধরেন। অসাধারণ এক বুদ্ধিমত্তা ও অনুভবপুঞ্জের জটিল সমন্বয় প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে তিনি বাচনের এক জগৎ নির্মাণ করেন। কিংবা অসাধারণ বাচন-কৌশলের ভেতর দিয়ে তিনি ভাব, বস্তু ও ঘটনানিচয়ের এমন এক সমন্বিত জগৎ তৈরি করেন, যেখানে পাঠক নতুন কোনো অভিজ্ঞানের মুখোমুখি হন কিংবা নতুন কোনো অনুধ্যান ও অনুভবপুঞ্জ তাঁকে বিমোহিত করে। এ হলো বিপরীতের এমন এক ঐকতান সৃষ্টি, যেখানে বিপরীত উপাদানগুলো পরস্পরের সঙ্গে আপন অসিত্মত্ব বজায় রেখে মিলিত হয় না বরং আপন আপন স্বভাব পরিবর্তন করে
তৃতীয় কোনো রূপ পরিগ্রহ করে। একেই বলে সৃষ্টি। আর এই সৃষ্টির আনন্দ ও অভিবাদন তিনিই লাভ করেন, যিনি অনন্য এক জীবনতৃষ্ণার প্রচ- তাড়নায় বিপুল বৈচিত্র্যের বিশ্বচরাচরের গোপন ঐক্য ও সংহতি অসাধারণ এক বাচন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে তুলে ধরে নতুন এক জগতের আস্বাদ প্রদান করেন। জন্ম নেয় নতুন এক গল্পের, নতুন এক আখ্যানের।
উপন্যাসের শুরুটা তা হলে কীভাবে হয়? এই প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ নয়। বরং ভ্রূণ থেকে একজন মানবশিশুর পরিপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে ওঠার মতোই জটিল। প্রাণীর দৈহিক ও আত্মিক সংগঠনের মধ্যে বিপরীতের যে আনুপাতিক সংশেস্নষ ও সমন্বয় বিস্ময়কর তাৎপর্যে অন্বিত হয়, তার সঙ্গে সব শিল্পেরই সমাস্থা লক্ষ করা যায়। ভ্রূণের মতোই শুরুটা হয় কলমের ডগায় অথবা টাইপে আঙুল সঞ্চালনে একটি মাত্র শব্দ লেখার ভেতর দিয়ে। কিন্তু কোথা থেকে আসে এই শব্দ? কোনো বিপুল পরিকল্পনা ও কল্পনা-প্রতিভার মূর্তমান সংস্থাপনার সূচনাবিন্দু এই শব্দ? প্রথমে ভাবনায়, চকিত মুহূর্তের মাহেন্দ্রক্ষণে। তারপর কত কাজ! নোট নেওয়া, ঘটনার পরিকল্পনা, স্থানের ভূগোল নির্মাণ, চরিত্রের নাম, চরিত্রের জীবনালেখ্য, আখ্যান পরিকল্পনা, ঘটনা, স্থান ও সময়ের ঐক্য সংস্থাপন ইত্যাকার বিষয় বিবেচনায় রেখে শুরু হয় উপন্যাসের প্রথম শব্দটি লেখার হৃৎকম্পনসম সাহস নিয়ে অভিযাত্রা। পরপর প্রথম বাক্য, দ্বিতীয় বাক্য, তৃতীয় বাক্য এবং একসময় প্রথম প্যারা। এই প্রথম শব্দ, প্রথম বাক্য এবং প্রথম প্যারাটি শুরু যেভাবে হয়েছিল তা-ই যে পাঠকের কাছে পৌঁছবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। বরং উপন্যাসের শুরুটা সেই সীমার অবিচ্ছেদ্য অংশ, যেখানে উপন্যাসের সমাপ্তির প্রশ্নও জড়িত। এবং শুরুটা শুধু তা-ই নয়, লেখকের ভাবনার বিশ্বব্যবস্থায় এমন এক জৈবজগৎ ও ভাবজগতের সীমা বিনির্মাণ করা হয়, যার সঙ্গে বাস্তব বিশ্বব্যবস্থার পার্থক্য আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই পটভূমিতে ইংরেজি ভাষার একটি জটিল প্রবাদ তৈরি হয়েছে – ‘draw us in’। এখানেই শেষ নয়। এখনো আমরা লেখকের কণ্ঠস্বরের সঙ্গে পরিচিত হইনি। তাঁর শব্দভা-ারের পরিধি ও স্বভাবের পরিচয় জানি না, ভাষা সংগঠনের অন্বয় জানা নেই। সুতরাং আমরা দ্বিধা নিয়ে ধীরে ধীরে একটি উপন্যাস পড়তে যাই। এবং চরিত্রের নাম, একাধিক চরিত্রের সম্পর্কসূত্র ও সম্পর্কজাল; সময়, স্থান ও ঘটনার পরিধি ও ঐক্য ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। শওকত ওসমানের জননী (১৯৫৮) উপন্যাসের শুরুর চারটি প্যারা উল্লেখ করি :
আলী আজহার খাঁ মহেশডাঙার মামুলী চাষী। গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড এখানেই সরল রেখায় গ্রাম। গ্রামান্তরের দিকে চলিয়া গিয়াছে। ট্রাঙ্ক রোডের পাশেই সরু গ্রামের পথ। কয়েক মিনিট হাঁটিলেই প্রথমে পড়ে আলী আজহার বসত। সম্মুখে একটি বড় দহলিজ। বাম পাশে ছোট্ট ডোবা। পূর্বধারে প্রতিবেশীদের খড়োঘর। কয়েকখানা কলাগাছের সবুজ পাতা চালের ভিতর উঁকি মারিতেছে। উঠানে কেহ বোধহয় কলাগাছ রোপণ করিয়াছিল। আসন্ন বৈকালে এই অঞ্চল ভয়াবহ ঠেকে। জনবিরল গ্রাম। অরণ্যানীর ছায়াভাস আগাছার জঙ্গলে সর্বক্ষণ কালো দাগ আঁকিয়া রাখে। বর্ষাকালে পথঘাট দুর্গম। ঝড়ে পাতাপুতি, হেলানো বাঁশবনের কঞ্চি আর কাদায় রাস্তা চলা বিপজ্জনক। বেতবনের ঝোপ-নিষ্ক্রান্ত বিষাক্ত সাপ দিনেও আশেপাশে বিচরণ করে।
আলী আজহার খাঁকেও এই পথে হাঁটিতে হয়। লাঙল কাঁধে হালের বলদ দুটিকে ভৎর্সনার আহবান দিতে দিতে বহুদিন দেখা গিয়েছে সে আনমনে পথ হাঁটিতেছে।
আজ এই খাঁ-পরিবারের কোন ছেলেকে দেখিয়া বুঝা মুশকিল, একশ বছর আগে তাহাদের পূর্বপুরুষেরা বাঙালি ছিলেন না। আলী আজহার খাঁর চেহারা পাট্টা জোয়ানের। রঙ ফর্সা। শুধু এই অবয়ব অন্যান্য প্রতিবেশীদের কাছে সে বৈশিষ্ট্য-পৃথক। নচেৎ কৃষাণপলস্নীর ভেতর তার অন্য কোনো মাহাত্ম্য-গুণ নাই, যার জন্য শতজনের মধ্যে সে প্রথমে কাহারো দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে পারে।
উপন্যাসের শুরু হয়েছে একটি চরিত্রের পরিচয় দিয়ে। চরিত্রের নাম আলী আজহার খাঁ। এরকম চরিত্রের নাম দিয়ে তিনি অনেক উপন্যাসের সূচনা করেছেন। ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাসের শুরুতে তিনটি চরিত্রের নামোলেস্নখ করেছেন তিনি – খলিফা হারুনর রশীদ, তাঁর স্ত্রী বেগম জুবায়দা এবং বাঁদী মেহেরজান। আর চৌরসন্ধির শুরু কালস্নু চরিত্রের উলেস্নখ করে। অর্থাৎ শওকত ওসমানের উপন্যাসের শুরুর মধ্যে তাঁর নিজস্ব একটি গড়ন খুঁজে পাওয়া যায় এবং সেই গড়নের মধ্যে গল্পের আস্বাদ মিলে – আখ্যানের নয়। কিন্তু সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ উপন্যাসের শুরুটাই হয় আখ্যানের আস্বাদ দিয়ে। যেমন লালসালু উপন্যাস শুরু হয়েছে একটি বিস্ময়কর চিত্রকল্পের উপস্থাপন দিয়ে। শুরুর বাক্যটি এই, ‘শস্যহীন জনবহুল এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের বেরিয়ে পড়বার ব্যাকুলতা ধোয়াটে আকাঙক্ষাকে পর্যন্ত যেন সদাসন্ত্রস্ত করে রাখে।’ স্পষ্টতই অনুভব করা যায়, শওকত ওসমান উপন্যাসে গল্প লেখার দিকেই আগ্রহী – আখ্যান বিষয়ে নয়।
একটি মাত্র পঙ্ক্তি লিখে প্রথম প্যারাটি লিখে ফেলার প্রবণতাও আছে শওকত ওসমানের। শুরুতেই এই ঘটনা ঘটিয়েছেন তিনি একাধিক উপন্যাসে। জননীতেও তাই ঘটেছে। লিখেছেন, ‘আলী আজহার খাঁ মহেশডাঙার মামুলী চাষী।’ অর্থাৎ তিনি সরাসরি চরিত্রকেন্দ্রিক ঘটনার ইঙ্গিত দিয়ে যেতে চান বিবরণে। কিন্তু সেই ইঙ্গিতমাত্রের মধ্যে অনেকগুলো তথ্য দিয়ে রাখেন তিনি। যেমন ‘আজহার আলী খাঁ’ – এই নামের মধ্যে একটি আভিজাত্যের আর্কিটাইপ আছে। কমপক্ষে বাঙালি মুসলমানগণ এই নামের মধ্যে সম্মান ও শ্রদ্ধার ঐতিহ্য বুঝতে ভুল করবেন না। এর পরেই আছে ভূগোল-চেতনা – মহেশডাঙা। উপন্যাসের শুরুর বাক্যটিতেই তিনি সুনির্দিষ্ট করে দিলেন, একটি ভৌগোলিক স্থানের ঠিকানা। কিন্তু তারপরই আছে অন্য এক গল্প, যে-গল্প শোনার জন্য পাঠকগণ প্রস্ত্তত ছিলেন না। কেননা যখন চরিত্রের নাম আলী আজহার খাঁ তখন তিনি ‘মামুলী চাষী’ হওয়ার কথা নয়। বিপরীতের এই সহাবস্থানের ভেতর দিয়ে তৈরি হয় শওকত ওসমানের উপন্যাসের প্রাণবিন্দু।
দ্বিতীয় প্যারা – যেখানে শওকত ওসমান নির্ভার বিবরণ তুলে ধরেন এবং স্থান ও সময়ের ঐক্য সুনির্দিষ্ট করে ফেলেন। পরবর্তীকালে তিনি যে দীর্ঘ পথ পরিভ্রমণ করবেন, তা যেন এই স্থান ও সময়ের ঐক্যকে সংহত রেখে চলে, তার জন্য এই বিবরণ অপরিহার্য। এ যেন একটি ঠিকানার পরিচয় মুদ্রিত করে রাখা, যাকে কেন্দ্র করে পথ চলতে সুবিধে হয়।
কথাসাহিত্যে গল্প গুরুত্বপূর্ণ নয়। সুপ্রাচীনকালে গল্প ছিল। আজো গল্প আছে। ছেলেভুলানো গল্প থেকে আজব গল্পের, লোকগল্পের, ভূতপ্রেতের ও দেওদানোর গল্পের অভাব নেই পৃথিবীতে। এসব গল্পে রীতির বিষয় থাকে না – গল্প হলেই হলো। কিন্তু যেখানে বিষয় ছোটগল্প কিংবা কথাসাহিত্য, সেখানে গল্প না-থাকলেও চলে, কিন্তু আখ্যান থাকতেই হয়। আর এই আখ্যান অর্থাৎ ভাবনার বিচিত্র সম্ভাবনার জগৎ তৈরি হয় রীতিকে আশ্রয় করে – বাচনকে আশ্রয় করে। আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাসে শওকত ওসমান আখ্যানের যে-জগৎ তৈরি করেছেন তার মূলে রয়েছে বাচন নির্ধারণ। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, চরিত্রগুলোর কণ্ঠস্বরের স্বাতন্ত্র্য তৈরি এবং বস্তুনিচয়, ঘটনাপুঞ্জ ও ভাবগত জগতের বহু বিচিত্রের বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টির ভেতর দিয়ে মানুষের অফুরন্ত সম্ভাবনা ও মাহাত্ম্যের স্বরূপ উন্মোচন করা।
পরাধীন দেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন শওকত ওসমান, ২ জানুয়ারি, ১৯১৭ সালে, ব্রিটিশ-শাসিত ভারতবর্ষে। পরাধীনতায় দুই ধরনের মনোগড়ন তৈরি হতে পারে। একটি হলো দাস্য মনোবৃত্তি এবং অন্যটি হলো দ্রোহী। কবি কাজী নজরুল ইসলামসহ ঊনবিংশ ও বিংশ শতকের গোড়ার দিকে জন্মগ্রহণকারী এ-দেশের অনেক কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী, রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীর মতো শওকত ওসমান অসাধারণ এক দ্রোহী মনোগড়ন নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর কথাসাহিত্যের ডিসকোর্স তৈরি হয়েছে পরাধীনতার পটভূমিতে সৃষ্ট অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও মনোদৈহিক পশ্চাৎপদতা ও বিকার-বিকৃতির বিরুদ্ধে। ফলে তিনি যে-ভাষিক বা বাচনিক জগৎ নির্মাণ করেছেন, সেই জগৎ হাজার বছরের বাঙালি জীবনের উত্তর-সাধনার অনুবর্তী এবং তার বঞ্চনা ও দ্রোহের এক নিরবচ্ছিন্ন ঘটনানিচয়ের ঐক্য ও সংহতিতে সমৃদ্ধ। ছাবিবশ-সাতাশ বছরের একজন যুবক তিরিশের দশকের পশ্চিমবঙ্গের পটভূমিতে রচনা করেন উপন্যাস বনী আদম। উপন্যাসের শুরুটা হয়েছে বিবরণের ভেতর দিয়ে। লেখকের কণ্ঠস্বরে। আর সেই বিবরণ ও কণ্ঠস্বর এরকম :
প্রকৃতি তাকে বঞ্চনা করেছিল।
প্রকৃতি তাকে কোলে ঠাঁই দিয়েছিল।
এমন পরিহাস মানুষের জন্যে আজও ধাঁধা বৈকি!
বঞ্চনা এবং আশীর্বাদ দুই কি করে এক খোঁটে মেলে?
হারেসের জীবন আখ্যায়িকা তাই বিস্তারিত কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না। সে জন্মেছিল মুসলমান তন্তুবায় সম্প্রদায়ে। তাদের অধিকাংশই দরিদ্র। শুধু তাই নয়, সমাজেও তারা ব্রাহ্মণ-সমীপে শূদ্রের মত, যদিও মুসলমান সমাজের জাতিভেদ অনুপস্থিত। কার্যতঃ ইতিহাসের রায় অন্য রকম। [শওকত ওসমান উপন্যাস সমগ্র ১. সময় প্রকাশন, এপ্রিল ২০০০, ঢাকা, পৃ ১৭]
এই হলো শওকত ওসমানের বিবরণের ভাষা – যাকে আমরা বলি লেখকের নিজস্ব কণ্ঠস্বর। হারেস নামক একটি চরিত্রকে কেন্দ্র করে শওকত ওসমান যে জীবন ও জগতের উত্থান ঘটাতে চান – এই বিবরণের মধ্যে সেই জীবনের একটি ভূমিকার পরিচয় মিলে লেখকের কণ্ঠস্বরে। এবং এই কণ্ঠস্বর ব্যক্তিনিরপেক্ষ নয় – ভাষা-সংগঠনের মধ্যে তার পরিচয় আছে।
মানুষের মনোগড়ন প্রকৃতিবিচ্ছিন্ন নয়। মানুষ তার জৈব-গড়নের মধ্যে প্রকৃতি-নির্ধারিত নিয়তি অর্জন করে। সেই নিয়তিকে অতিক্রম করার জন্য গ্রিক ট্র্যাজেডির মতো মানুষ নিরন্তর চেষ্টা করে কিংবা করে না; কিন্তু নিয়তিকে সে অতিক্রম করতে পারে না কখনো। এই হলো প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগত নিয়তি। হারেসের জীবনের বঞ্চনা যেমন প্রকৃতিগত, তেমনি তার আশ্রয়ও প্রকৃতিগত। লেখকের এই বিবরণের মধ্যে জীবনের পরস্পরবিরোধী দুই তলের যে-পরিচয় পাওয়া যায়, সেখানেই নিহিত আছে সৃষ্টি-সৌন্দর্য – বিপরীতের ঐকতান ছাড়া যা কখনো সম্ভব নয়।
উদ্ধৃত অংশে ভাষিক সংগঠনের মধ্যে লেখকের অসাধারণ শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। প্রথম বাক্যে চারটি শব্দ – ‘প্রকৃতি তাকে বঞ্চনা করেছিল।’ একটি পুরাঘটিত অতীত ক্রিয়াপদের মাধ্যমে যে-বিবরণটি দেওয়া হয়েছে, তা আকস্মিক। প্রথাগত গল্পের শুরু কখনো এমন হয় না। এবং শুরুতেই সর্বনাম ব্যবহার করা হয় না। কথাসাহিত্যে এই আকস্মিকতা নতুন কোনো বিষয় নয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কপালকু-লা উপন্যাসের শুরুটা করেছেন এভাবে, ‘প্রায় দুইশত পঞ্চাশ বৎসর পূবের্ব একদিন মাঘ মাসের রাত্রীশেষে একখানি যাত্রীর নৌকা গঙ্গাসাগর হইতে প্রত্যাগমন করিতেছিল।’ এই বিবরণের প্রায় প্রতিটি তত্ত্বই আকস্মিক। এবং নিশ্চয়তা ও অনিশ্চয়তার রহস্য নিয়ে বিস্ময়কর। আকস্মিকতাকে কতটা নিশ্চিত করে তোলা চলে এবং কাহিনি-কল্পনার পটভূমিকে বাচনগত কাঠামোর মধ্যে কতটা বস্তুনিষ্ঠ ও অনিবার্য করে তোলা চলে, তার নিদর্শন হলো আমাদের কথাসাহিত্যের সূচনালগ্নের এই মহৎ রচনা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বউ-ঠাকুরানীর হাট উপন্যাসের শুরুটাও বঙ্কিমীয় সুরে বাঁধা। কিন্তু কবি রবীন্দ্রনাথের অনন্য কাব্য-প্রতিভা ও কাব্য-ভাষার আস্বাদ তাঁর কথাসাহিত্যেও লাভ করা যায়। তিনি লিখেছেন :
রাত্রি অনেক হইয়াছে। গ্রীষ্মকাল। বাতাস বন্ধ হইয়া গিয়াছে। গাছের পাতাটিও নড়িতেছে না। যশোহরের যুবরাজ, প্রতাপাদিত্যের জ্যেষ্ঠ পুত্র, উদয়াদিত্য তাঁর শয়নগৃহের বাতায়নে বসিয়া আছেন। তাঁর পার্শ্বে তাঁহার স্ত্রী সুরমা।
শুরুতেই কবি শব্দের প্রবহমান স্রোতধারার মধ্যে একটি দৃশ্যকল্প তৈরি করেছেন। আকস্মিকতাকে তিনি নিশ্চয়তার পটভূমিতে নিয়ে আসার জন্য বাচনের যে ধ্বনিমাধুর্য নির্মাণ করেছেন, তা আমাদের বাস্তব ন্যায়বোধকে যেমন তৃপ্ত করে, তেমনি সংগীতপ্রবণ মনেও আলোড়ন তৈরি করে। এই দুটি উদাহরণের কোনোটিতেই লেখকের কণ্ঠস্বরের বাইরে অন্য কোনো কণ্ঠস্বর শোনা যায়নি। প্রথাগত এই সূচনার বাইরে এসে যাঁরা সরাসরি চরিত্রের কণ্ঠস্বরে চলে গেছেন তাঁদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। অধিকন্তু লক্ষ করা যায় যে, উপন্যাসের সিংহভাগ জুড়ে লেখকের কণ্ঠে শুনতে হয় চরিত্রের বিবরণ; কিংবা চরিত্র যখন কথা বলে, সে-কথাও যেন লেখকের কণ্ঠ থেকেই নিঃসৃত হয়। ফলে বহুস্বরতার যে-শর্ত কথাসাহিত্যের প্রাণ, সে-শর্ত কিংবা বাচনিকতার ভেতর দিয়ে জীবনতৃষ্ণার যে-বহুত্ব নির্ধারিত হয়, সেই বহুত্বের বৈপরীত্য ও ঐক্যের সন্ধান পাওয়া যায় না অধিকাংশ কথাসাহিত্যে। বনী আদম বাংলা প্রথাগত উপন্যাস-ভাবনার বাইরে নয়।
কয়েকটি কণ্ঠস্বরের উদাহরণ দিই :
১. হারেসের মন মুষড়ে যায়। পথঘাট সে আদৌ চেনে না। আরিফের সঙ্গে দু’দিন হেঁটে এসেছিল সে! আরিফকেও আজ খুঁজে পাওয়া দায়। [লেখক]
২. আমাদের সঙ্গে চলো। আজ লোক কম আছে। মিস্ত্রীকে বলব কাজ হবে। [মিস্ত্রী]
৩. গরীব মানুষের ছেলে। আমাদের অত সখ কিসের? [হারেস]
তিনজন ব্যক্তির ‘বাচন’ উল্লেখ করা হলো। প্রথমটি লেখকের বিবরণ। এই বিবরণের ভাষা প্রমিত চলিত। এবং এই ভাষার মধ্যে বাচনের স্বাভাবিকতা নেই। ‘মুষড়ে’, ‘আদৌ’, ‘চেনে’, ‘দু’দিন’, ‘হেঁটে’, ‘দায়’ ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার এমন একটি বাক্য সংস্থাপনার মধ্যে ব্যবহার করা হয়েছে যার সঙ্গে মুখের ভাষা বা বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। ভাষা আঁটসাঁট ও দৃঢ়বদ্ধ। এই বাচনের মধ্যে স্বাতন্ত্র্য নেই; কিন্তু প্রবাহ আছে। দ্বিতীয় উদাহরণটি একজন মিস্ত্রির। তিনি শিক্ষিত মানুষ নন। নিশ্চয়ই তার নিজস্ব একটি ভাষিক পরিম-ল আছে। কিন্তু তিনি যে ভাষায় কথা বলেন সেই ভাষার মধ্যে তার সেই নিজস্ব পরিম-লের কোনো পরিচয় নেই। ‘আমাদের সঙ্গে চলো। আজ লোক কম আছে। মিস্ত্রীকে বলব কাজ হবে।’ এই বাক্যের প্রতিটি শব্দই প্রমিত চলিতরীতির ন্যায়সূত্র মেনে ব্যবহৃত। এমনকি বাক্যের গড়নের মধ্যেও আছে অসামান্য মাত্রাবোধ ও সংহতি। এই ভাষার মধ্যে একজন মিস্ত্রিকে খুঁজে পাওয়া যায় না। আর তৃতীয় উদাহরণটি হলো হারেসের। ‘গরীব মানুষের ছেলে। আমাদের অত সখ কিসের?’ হারেসের এই ভাষিক জগৎও সুসমন্বিত ও নিখুঁত চলতি রীতিতে গড়া। এবং লক্ষণীয় যে, তিনজন আলাদা মানুষের ভাষিক জগতের যে তিনটি উদাহরণ উলেস্নখ করা হলো তার মধ্যে তিন ধরনের কোনো কণ্ঠস্বর নেই। ফলে প্রত্যেক মানুষ যে আলাদা এবং দেহভঙ্গির বাইরে সেই স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় একমাত্র ব্যক্তির বাচনের মধ্যে মূর্ত হয়ে ওঠে, তার কোনো পরিচয় এই উপন্যাসে লক্ষ করা যায় না।
অথচ বিশ শতকের গোড়া থেকেই শুরু হয় বিবরণের ভাষার বাইরে চরিত্রগুলোর মুখে তাদের নিজস্ব ভাষা পুরে দেওয়ার প্রচেষ্টা। মূলত নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের উপন্যাসে বাচনের ও কণ্ঠস্বরের স্বাতন্ত্র্য খুব ক্ষীণভাবে ধরা দিতে শুরু করে এবং জগদীশ গুপ্ত ও বিশেষ করে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প-উপন্যাসের মধ্যে প্রাথমিকভাবে বহুস্বরতার প্রয়াস লক্ষ করা যায়। বোঝা যায় যে, চরিত্রগুলো তাদের নিজস্ব বাচনে কথা বলতে চাইছে এবং এই বাকরীতির ভেতর দিয়ে চরিত্রগুলো আলাদা স্বভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পে মানুষের জৈবপ্রবৃত্তির গোপন এক ইতিহাস বিস্ময়কর জীবনবোধ ও জীবনাকাঙক্ষার পটভূমিতে তুলে ধরেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। এই গল্পে ভিখু ডাকাতও প্রয়োজনে খুনি। পৃথিবীর সকল খাদ্য ও সকল নারী সে চায় ভোগ করতে। এর বাইরে আর কোনো মূল্যবোধ নেই তার। কিন্তু অবস্থাবৈগুণ্যে এখন সে ভিক্ষুক। এ সময় জৈব পশুবৃত্তির আকাঙক্ষা তার মধ্যে তীব্র হয়ে ওঠে। এই গল্প থেকে কিছু অংশ উলেস্নখ করি।
বাজারে ঢুকিবার মুখেই একটা ভিখারিণী ভিক্ষা করিতে বসে। বয়স তাহার বেশী নয়, দেহের বাঁধুনিও বেশ আছে। কিন্তু একটা পায়ে হাঁটুর নীচে হইতে পায়ের পাতা পর্যন্ত তাহার থকথকে তৈলাক্ত ঘা।
এই ঘায়ের জোরেই সে ভিখুর চেয়ে বেশী রোজগার করে। সে জন্যে ঘাটিকে সে বিশেষ যত্নে সারিতে দেয় না।
ভিখু মধ্যে মধ্যে গিয়া তাহার কাছে বসে। বলে, ‘ঘা’টি সারবো-না লয়?’
ভিখারিণী বলে, ‘খুব। ওসুদ দিলে অখনি সারে।’
ভিখু সাগ্রহে বলে, ‘সারা তবে, ওসুদ দিয়ে চটপট সারাইয়া ল। ঘা’টি সারলে তোর আর ভিক্ মাগতে অইবো না, – জান্স? আমি তোরে রাখুম।’
‘আমি থাকলি’ত।’
‘ক্যান? থাকবি না ক্যান? খায়ামু পরামু, আরামে রাখুম, পায়ের পর নি পা’টি দিয়ে গাট হইয়া বইয়া থাকবি। না করস্ তুই কিয়ের লেগে?’
অত সহজে ভুলিবার মেয়ে ভিখারিণী নয়। খানিকটা তামাক পাতা মুখে গুঁজিয়া সে বলে, ‘দু’দিন বাদে মোরে যখন তুই খেদাইয়া দিবি, ঘা’টি মুই তখন পামু কোয়ানে?’
ভিখু আজীবন একনিষ্ঠতার প্রতিজ্ঞা করে, সুখে রাখিবার লোভ দেখায়। কিন্তু ভিখারিণী কোন মতেই রাজী হয় না। ভিখু ক্ষুণ্ণ মনে ফিরিয়া আসে। […]
একদিন সকালে উঠিয়াই সে ভিখারিণীর কাছে যায়। বলে, ‘আইচ্ছা, ল, ঘা লইয়াই চল্।’
ভিখারিণী বলে, ‘আগে আইবার পারো নাই? যা; অখন মর গিয়া, আখার তলের ছালি খা গিয়া।’
‘ক্যান? ছালি খাওনের কথাডা কি?’
‘তোর লইগ্যা হাঁ কইরা বইসা আছি ভাবছস তুই, বটে? আমি উই উহার সাথে রইছি।’
ভিখারিণীর নাম পাঁচী আর সে এখন যে-পুরুষের সঙ্গে থাকে তার নাম বসির। সেও ভিক্ষা করে এবং ভিখুর মতোই জোয়ান। এই পাঠের মধ্যে দুইজন নর-নারীর মধ্যে প্রেমের পটভূমি দেখানো হয়েছে। প্রেমপ্রত্যাশী ভিখু পাঁচীকে প্রেমের প্রস্তাব দিচ্ছে এবং তাকে সুখে রাখার প্রলোভন দেখিয়ে নিজের করে নিতে চাচ্ছে।
এদের কাউকেই আমরা চিনি না এবং এদের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়নি কখনো। কিন্তু এরা যে ভাষায় কথা বলে, সেই ভাষার শব্দভার ও ব্যাকরণগত গড়ন প্রমিত ভাষার তুলনায় বিপর্যস্ত। তাদের এই ভাষিক জগতের ভিতর দিয়ে আমরা তাদের অনন্য এক ব্যক্তিত্বের পরিচয় পাই। আদর্শ-অনাদর্শ, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত ইত্যাদি ন্যায়শাস্ত্রের বিষয় হতে পারে কিন্তু কখনই তা ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব নির্ধারণে বিচার্য হতে পরে না। আর এই সামগ্রিক বিষয়টি নির্ধারিত হয় ব্যক্তির বাচনের ওপর ভিত্তি করে।
ভিখু ও পাঁচীর প্রণয়-সংক্রান্ত এই কথোপকথনের সঙ্গে যদি শওকত উসমানের কথাসাহিত্যের মানুষের ভাষিক জগতের তুলনা করা হয়, তা হলে ব্যক্তিত্বের রকমফের আকাশ-পাতাল ব্যবধানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জৈবিক গড়নের প্রত্ন-ইতিহাসের আলোকে কিংবা আরও স্পষ্ট করে বললে ফ্রয়েডীয় গূঢ়ৈষণার আলোকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাসাহিত্যে প্রথম ভাষিক স্বাতন্ত্র্যে ব্যক্তিত্বের উত্থান ঘটে। শওকত ওসমানের শিল্পমনীষা এই বর্গের অন্তর্ভুক্ত নয়। তাঁর কথাসাহিত্য বক্তব্যপ্রধান। কিন্তু কীভাবে সেই বক্তব্য উপস্থাপন করবেন, তা নিয়ে তিনি কখনই কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অবতীর্ণ হননি। বরং সহজাত শিল্পপ্রতিভার প্রবল চাপ ও তাপে তিনি যেসব উপন্যাস রচনা করেছেন – স্থান কাল ও পাত্রের অসাধারণ ঐক্য ও সংহতির ভেতর দিয়ে তা এগিয়ে গেছে স্বচ্ছন্দে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.