শামসুর রাহমানের রাজনৈতিক দর্শনের সংস্কৃতি

শামসুর রাহমান কবি। বিশ্বজনীনতার বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল তাঁর কবিতা। তিনি আজীবন কবিতার সাধনা করে গেছেন। কবিতার সাধক তিনি। ত্রিশের নতুন যে-কাব্যভাষা বাংলা কবিতায় নতুন নির্মাণের পথ সৃষ্টি করেছিল তার ধারাবাহিকতা বজায় থাকেনি পরবর্তী দশকে। চল্লিশের দশকের সাম্যবাদী কাব্যভাষা নিয়ন্ত্রণ করেছে পুরোপুরি রাজনৈতিক আদর্শকে। তবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান – এই দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ফলে পঞ্চাশের দশক পূর্ব বাংলার কবিতা নিকটবর্তী চল্লিশকে যত না গ্রহণ করেছে তার চাইতে অধিক প্রভাবিত ত্রিশের কবিতার আন্দোলনের ধারাটিকে গ্রহণ করে। কিন্তু ত্রিশের উত্তীর্ণ কাব্যভাষা আত্মস্থ করে ষাটের দশক থেকেই পঞ্চাশের কাব্যধারাটি জীবন ও প্রকৃতি ঘনিষ্ঠতার চাইতে জীবন ও রাজনীতির গভীর অনুধ্যানে সৃষ্টিশীল। শামসুর রাহমান এ-ধারার অন্যতম কবি। তিনি মনোজগতের দর্শনে প্রেম ও মানবিক সৌন্দর্যবোধকে তাঁর সৌন্দর্য-সৃষ্টিতে রূপদান করেছেন প্রথমদিককার কবিতায়, অর্থাৎ পঞ্চাশের দশকের সমকালীন কবিতায়। ইতিহাস ও ঐতিহ্যগত বিষয়ের জায়গায় নতুন করে দেশপ্রেমে জাগ্রত হওয়ার গুরুত্ব এবং ভাষা-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারায় স্বদেশ গড়ার স্বপ্ন শামসুর রাহমানের কবিতাকে তাড়িত করে। আর সে-তাড়নায় তাঁর ভেতর ক্রিয়া করে রাজনৈতিক দর্শনের সংস্কৃতি। রাজনীতিতে সরাসরি তাঁর সম্পৃক্ততা নেই; কিন্তু দেশের মুক্তির লক্ষ্যে, নিজস্ব সংস্কৃতির ধারাটির বিকাশের লক্ষ্যে যে রাজনৈতিক মুক্তির প্রয়োজন নয়া ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে লড়াই করে, সংগ্রাম করে – সে-উপলব্ধি ছিল গভীর।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঐতিহ্যের কালসীমানা যদিও আধুনিক যুগে সূচিত হয়েছে বলে সমাজতাত্ত্বিকগণ অভিমত ব্যক্ত করেন, তবু বলা যায়, বাঙালি তথা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঐতিহ্য প্রাচীনকাল থেকেই ইঙ্গিত বহন করে আসছে। তাই মাতৃভাষা অর্থাৎ নিজের ভাষার প্রতি মমত্ববোধ এবং মাতৃভাষায় সাহিত্যচর্চা, দেববন্দনা, আল্লাহ্-রাসুলের নাম স্মরণ বা গুণ-কীর্তন-মহিমা  – সবকিছুতেই দেশি ভাষা হিসেবে বাংলাভাষার চর্চা ও প্রসার রাজনৈতিকভাবেও মূল্যায়িত হয়ে আসছিল। প্রাচীন যুগে যখন হাঁড়িতে ভাত না থাকার খবর পাই, যখন অন্ত্যজ-শ্রেণির অবস্থান নগরের বাইরে হয়, এই শোষণ এবং পেষণ যতটা রাজনৈতিক কারণে ততটা প্রাকৃতিক কারণে নয়।

অনুরূপভাবে মধ্যযুগের সাহিত্যেও সেন আমল, সুলতানি আমল, নবাবি আমল প্রভৃতিতে যে রাজনৈতিক চেতনাস্রোত সঞ্জীবিত ছিল তা মানুষকে প্রভাবিত করেছিল বলেই বাংলা কবিতায় এর অভিব্যক্তি সন্নিবিষ্ট ছিল।

১৯৪৭ সালে ধর্মভিত্তিক ভারতবিভক্তির প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের নতুন ভূখণ্ডে যেমন নতুন জীবনের প্রবাহ সূচিত হয়, তেমনি সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় বিচিত্র পরিসরে বাঙালি মুসলমানের স্বকীয় পদসঞ্চার শুরু হয়। এর ফলে নতুনভাবে ভূখণ্ডনির্ভর রাজনৈতিক চেতনা এদেশের মানুষের মধ্যে পঞ্চাশের দশকের প্রারম্ভ থেকেই পরিদৃষ্ট হয়।  নতুন করে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকচক্রের ঔপনিবেশিক কায়দায় শোষণ, ত্রাসন বাঙালির স্বপ্নভঙ্গের বেদনাকে জাগ্রত করে। তাই শুরু থেকেই ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা নতুন করে তাদের মধ্যে উজ্জীবিত হয়।

ভাষার বিরুদ্ধে যে-চক্রান্ত পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী এদেশের মাটিতে রোপণ করতে চেষ্টা চালায় তা ফলপ্রসূ হতে পারেনি। বাঙালি তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় গড়ে তোলে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক আন্দোলন। এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনে শরিক হয় ছাত্র-শিক্ষক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক তথা এদেশের সকল শ্রেণির মুক্তিকামী জনতা।

রাজনৈতিকভাবে নেতৃত্বে এগিয়ে আসেন ভাসানী-মুজিবসহ অনেকে। পাশাপাশি একুশের চেতনাকে ধারণ ও তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে লেখক-বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিক তাঁদের লেখায় লালন করেছেন সে-চেতনাকে।

একুশের রক্তাক্ত রাজপথ ধরে বাঙালির জীবনে মৃত্যুময় বিভীষিকা নেমে আসে। কিন্তু বাঙালি মৃত্যুভয়ে ভীত না থেকে স্বদেশের অস্তিত্বকে বিপন্ন হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে ঔপনিবেশিক পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ও প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শহিদ হন অনেকে। শহিদ দিবসের শোকাবহ ঘটনা এবং শহিদদের আত্মত্যাগকে জগৎখ্যাত মহাপুরুষদের আত্মদানের সঙ্গে তুলনা করে শামসুর রাহমান তাঁর কবিতায় প্রতিক্রিয়া বিধৃত করে বলেন,১

প্রমিথিউসের গানের মতো আমার গলার রৌদ্রোজ্জ্বল চীৎকার

কাঁপিয়ে দেবে এই পৃথিবীর আকাশ-বাতাস

ফেটে চৌচির হয়ে যাবে মিশরীয় স্ফিংসের স্থবিরতা

খসে যাবে তোমাদের রাত্রির দীপ্তিমান তারা, দিনের সূর্য ॥

…        …        …     

টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলো আমার সূর্যের মতো হৃৎপিণ্ড

…        …        …     

কিন্তু শোনো, একফোঁটা রক্ত যেন পড়ে না মাটিতে

কেননা আমার রক্তের কণায় কণায় উজ্জ্বল স্রোতের মতো

বয়ে চলেছে মনসুরের বিদ্রোহী রক্তের অভিজ্ঞান।

…        …        …     

তোমরা নিশ্চিহ্ন করে দাও আমার অস্তিত্ব,

পৃথিবী হতে চিরদিনের জন্য নিশ্চিহ্ন করে দাও

উত্তরাকাশের তারার মতো আমার ভাস্বর অস্তিত্ব।২

’৫২-র ভাষা-আন্দোলনের ক্রমধারায় বাষট্টিতে শিক্ষা-আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ছাত্র অভ্যুত্থানের জন্ম হয়। হামদুর রহমান শিক্ষা কমিশনকে কেন্দ্র করে এই আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে পূর্ব পাকিস্তানে বৈষম্য বাড়িয়ে তোলে। স্বাধিকারের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ-প্রণীত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ’৬৬-তে ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন। ৬ দফার আন্দোলনকে নস্যাৎ করার লক্ষ্যে পূর্ববাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজনীতি থেকে নির্মূল করার অভিপ্রায়ে আইয়ুব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অবতারণা করেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে অভিযুক্ত করায় সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং ক্ষেপে ওঠে। আন্দোলনরত ছাত্ররা এসময় ৬-দফার সমন্বয় করে ১১ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে। ক্রমে তা ’৬৯-এ গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়।

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে একুশের চেতনা নতুন তাৎপর্যে গতি পায়। এই অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে শামসুর রাহমান একুশের কবিতায় নতুনভাবে জেগে ওঠার চেতনা লাভ করেন –

নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছে আমার

                                                         সত্তায়।

…        …       …        

আজন্ম আমার সাথী তুমি,

আমাকে স্বপ্নের সেতু দিয়েছিলে গ’ড়ে পলে পলে,

তাই তো ত্রিলোক আজ সুন্দর জাহাজ হ’য়ে ভেড়ে আমারই

                                                    বন্দরে।

…       …        …     

উনিশো শো বাহান্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পঞ্জলি

বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী।৩

ঊনসত্তরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বছরের শুরু থেকে ছিল অস্থির। আইয়ুববিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু হয়েছিল আটষট্টির শেষের দিকে। ক্রমে তা সংঘবদ্ধ আন্দোলনে রূপ নিলে সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শের ছাত্রনেতা আসাদ প্রথম শহিদ হন। শহিদ আসাদকে উপলক্ষ করে তখন বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন প্রবল শক্তি অর্জন করে। আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এ-সময় থেকে ছয় দফার স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনকে প্রথম স্বাধিকার ও কিছুদিন পরেই স্বাধীনতার আন্দোলন হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করেন।

আসাদকে নিয়ে এ-সময় শামসুর রাহমান লিখলেন ‘আসাদের শার্ট’ নামে কবিতা। এ-কবিতায় কবি স্বাধীনতার পতাকাকে আসাদের শার্টের মধ্যে দেখতে পেয়েছেন, আসাদের শার্টকে তিনি সংগ্রামের প্রতীকরূপে বর্ণনা করেছেন –

গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের

জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট

উড়ছে হাওয়ায়, নীলিমায়।

আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা

সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক,

আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।৪

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতরে থেকেই তাদের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণের স্বপ্ন দেখলেও অল্প কিছুদিনের মধ্যেই পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষের মনে নানাবিধ প্রশ্ন দেখা দেয়। সাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যকেই যারা জাতীয় ঐতিহ্যরূপে লালন করতে আগ্রহী এবং পূর্ববাংলার সমাজ কাঠামোর সঙ্গে যারা অসংগতিপূর্ণ  সমাজকাঠামো গড়তে অনড় ও অটল যারা, তাদের বিরুদ্ধে যথার্থ জবাব দেওয়া হয় ভাষা-আন্দোলনের সূত্রপাতের মধ্য দিয়ে। ভাষা-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালির সাংস্কৃতিক সংগ্রামের ও স্বাধিকারের আন্দোলনের অগ্রগতি বাঙালির জন্যে এনে দেয় স্বাতন্ত্র্যবোধ।

মুক্তিযুদ্ধের কবিতার একটি ঐতিহ্যিক পটভূমি নির্মাণ করেছে মুক্তিযুদ্ধপূর্ব স্বদেশপ্রেমের কবিতা, একুশের কবিতা তো বটেই। স্বদেশেেপ্রমের কবিতার বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা ও স্বভূমির মহিমা বর্ণনার পাশাপাশি উঠে এসেছে স্বাধীনতার জন্যে আকাক্সক্ষা। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সে-আকাক্সক্ষা স্বপ্নে পরিণত হয়।

স্বদেশের ধ্বংসোন্মুখ ও অসহায় রূপ ফুটে উঠেছে পাকিস্তানি সামরিক সরকারের অত্যাচার-নিপীড়ন ও শোষণে। আর এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে একটি মারাত্মক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পূর্বাভাস প্রত্যক্ষ হয় শামসুর রাহমানের ‘টেলেমেকাস’ কবিতায়। পাশাপাশি এ-কবিতায় স্বদেশ প্রেমের জন্যে প্রকাশিত হয় ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ –

তুমি কি এখনো আসবে না ? স্বদেশের পূর্ণিমায়

…       …       …      

ইথাকায় রাখলে পা দেখতে পাবে রয়েছি দাঁড়িয়ে

দরজা আগলে, পিতা অধীর তোমারই প্রতীক্ষায়

এখনো কি ঝঞ্ঝাহত জাহাজের মাস্তুল তোমার

বন্দরে যাবে না দেখা? অস্ত্রাগারে নেবে না আয়ুধ

আবার অভিজ্ঞ হাতে? তুলবে না ধনুকের টঙ্কার?৫

স্বদেশের স্বাধীনতা-আন্দোলনের জোয়ারে বাংলাদেশের কবিরাও সংগ্রামী ভূমিকা লালন ও চেতনা পালন করেন। পরাধীন দেশের বেদনা ও ঔপনিবেশিকদের শোষণের যন্ত্রণা কবিদের হৃদয়-বিবেককে তাড়িত করে। স্বদেশের সংকটকালের দুঃখের সঙ্গে কবিরাও একাত্মতা ঘোষণা করেন।

শামসুর রাহমান তাঁর ‘বন্দী শিবির থেকে’ এবং ‘পথের কুকুর’ কবিতায় এর যথার্থ রূপ তুলে ধরেছেন। ‘বন্দী শিবির’ কবিতায় তিনি স্বাধীন দেশের কবিদের উদ্দেশে লিখেছেন তাঁর অবরুদ্ধ নগরী নিয়ে। তিনি বলতে চেয়েছেন, বন্দিশায় এমনভাবেই তিনি অবস্থান করছেন, যেখানে স্বাধীনতা ও বাংলাদেশ নামক শব্দ-দুটি পর্যন্ত উচ্চারণ করতে পারতেন না, …

বন্ধুরা তোমরা যারা কবি,

স্বাধীন দেশের কবি, তাদের সৌভাগ্যে

আমি বড় ঈর্ষান্বিত আজ।

যা এখন খুশি

মনের মতন শব্দ কী সহজে করো ব্যবহার :

অথচ এ দেশে আমি আজ দমবন্ধ

এ বন্দী শিবিরে

মাথা খুঁড়ে মরলেও পারি না করতে উচ্চারণ

মনের মতন শব্দ কোনো।

স্বাধীনতা, বাংলাদেশ এই মতো শব্দ থেকে ওরা

আমাকে বিচ্ছিন্ন ক’রে রাখছে সর্বদা।৬

অবরুদ্ধ ঢাকা জীবনধারণকে নগরীতে শামসুর রাহমান নরকবাস বলে অভিহিত করেছেন। এবং কবিতার ছত্রে ছত্রে সেই নরকবাসের সময়টিকে বিম্বিত করেছেন বিভিন্ন চিত্রের মধ্য দিয়ে, অবশ্য সেই নরকবাস থেকে মুক্তির স্বপ্নও প্রবল বেগ পেয়েছিল সেটা সত্য, –

কখনো নিঝুম পথে হঠাৎ লুটিয়ে পড়ে কেউ গুলির আঘাতে,

মনে হয় ওরা গুলিবিদ্ধ করে স্বাধীনতাকেই।

… অকস্মাৎ

ফাটে ফৌজী ট্রাকের ভেতর

মনে হয় স্বাধীনতা গর্জে ওঠে ক্রোধান্বিত দেবতার মতো।৭

সার্বিক গণআন্দোলনের পরিণাম হচ্ছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। এই মুক্তিযুদ্ধে কেবল ব্যাপকভাবে সমগ্র সাধারণ মানুষ আর উদ্দীপ্ত তরুণ সমাজই অংশগ্রহণ করেনি, অংশগ্রহণ রয়েছে প্রগতিশীল বুুদ্ধিজীবীর। প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের রাজনৈতিক আন্দোলনের ঐতিহ্য রয়েছে। তাছাড়া রাজনৈতিক জ্ঞানবুদ্ধি নিয়ে সময়কে বিচার করার ঐকান্তিক প্রয়াসও তাঁদের ছিল। বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনে প্রত্যক্ষ রাজীতিবিদ ও ছাত্রবৃন্দ অংশগ্রহণ করলেও পরোক্ষে ছিল অপর সচেতন অংশে বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা। আর এ-কারণেই প্রগতিশীল সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও বিজ্ঞানীদের বিভ্রান্ত করবার প্রয়াস অব্যাহত থেকেছে পাকিস্তান সরকারের। 

শহিদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অন্যতম মুনীর চৌধুরীকে নিয়ে শামসুর রাহমানের কবিতায় উঠে এসেছে সদ্য স্বাধীন বাংলাদশের আনন্দের পাশাপাশি মুনীর চৌধুরীর মর্মান্তিক মৃত্যুর প্রতি সহানুভূতি –

বলুন মুনীর ভাই, আপনি কি আগাছার কেউ?

… শকুনের? আপনি কি ক্রুর ঘাতকের?

…      …      …

শুনুন মুনীর ভাই,

কালো জঙ্গী পায়ের তলায় চাপা-পড়া

আপনার ‘বাংলাদেশ’ লক্ষ লক্ষ বুকের চেয়েও

বহু ক্রোশ বড়ো ব’লে বর্গীরা উধাও। বহুদিন

পরে আজ আমাদের মাতৃভূমি হয়েছে স্বদেশ।

মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষের জন্যে আপন পতাকার মহিমা এনে দিলেও সে-যুদ্ধে অনেকে প্রিয়জন হারিয়েছে। দেশমাতৃকার ভালোবাসায় রক্তপাত হয়েছে। সে রক্তপাত বাংলার শরীর ভিজেছে প্রিয়জনের রক্তে। স্বপ্নভর দু-চোখ বিস্তৃত দিগন্তের দিকে প্রসারিত করে প্রিয়জনরা চেতনার রঙে হয়েছে খুন।

পঁচিশ মার্চ সশস্ত্র স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং প্রতিরোধ আন্দোলনের কথা শহর থেকে শুরু করে গ্রামবাংলার প্রতিটি ঘটে পৌঁছে যাওয়ার পর ছাত্র-জনতা, ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, আনসার-পুলিশ ও কিছু বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তাঁদের মধ্যে তরুণ ছাত্র-জনতা নিয়ে গড়ে ওঠে গেরিলা বাহিনী বা হরণবাহিনী। এঁদেরকে স্বাধীন বাংলা সরকারের অনিয়মিত বাহিনীও বলা হতো। মুক্তিযুদ্ধে এদের অবদান সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। এরা ক্ষেতে-খামারে, বৃষ্টিতে ভিজে, কচুরিপানা মাথায় নিয়ে পানিতে গলা ডুবিয়ে পড়ে থেকে, কৃষক সেজে, মাঝি সেজে, বিভিন্ন কৌশলে দ্রুত পাকসেনাদের ঘায়েল করেছে। এদের নিয়ে শামসুর রাহমান লিখেছেন কবিতা। তাঁর কবিতার নাম ‘গেরিলা’।

শামসুর রাহমান তাঁর ‘গেরিলা’ কবিতায় খুঁজেছেন গেরিলা-অবয়ব। কেননা যুদ্ধের সময় গেরিলারা ছিল একটা কিংবদন্তির মতো। তবে বাংলার মানুষ ক্রমে তাঁদের চিনেছে, তাই শামসুর রাহমান লিখেছেন –

দেখতে কেমন তুমি? কী রকম পোশাক আশাক

পরে করো চলাফেরা? মাথায় আছে কি জটাজাল?

… দিত ডুব গহন পাতালে

সর্বত্র তোমার পদধ্বনি শুনি, দুঃখ তাড়ানিয়া

তুমি তো আমার ভাই, হে নতুন, সন্তান আমার।৮

স্বাধীনতার স্পৃহা যে একাত্তরের যুদ্ধের সময় সকল শ্রেণির মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিল, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্যে, তারই একটি চিত্র ফুটে উঠেছে শামসুর রাহমানের ‘গ্রামীণ’ কবিতায়। ‘গ্রামীণ’ শামসুর রাহমানের মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক কবিতা। এ-কবিতায় ব্যক্ত হয়েছে গ্রামের একজন সরল কৃষকসন্তানের মনের অভিব্যক্তি। কৃষকসন্তানটি নিজেই কল্পনায় ডুব দিয়ে একসময় ভাবতে থাকে কিভাবে সে মুক্তিযোদ্ধায় পরিণত

হয়েছে –

কেন তবে রক্তে উঠেছিলো ঝড় উত্থাল পাথালে?

আমি তো ছিলাম দূরে অতিশয় শান্ত গ্রামে তাল

তমালের ভিড়ে, মাঠে নিসর্গের উদার ডেরা।

যাকে ভালোবাসি সে যেন পুকুর ঘাটে ঘড়া রোজ

নিঃশঙ্ক ভাসাতে পারে, যেন এই দুরন্ত ফিরোজ

আমার সোদর, যেতে পারে হাটে হাওয়ায় হাওয়ায়,

বাজান টানতে পারে হুঁকো খুব নিশ্চিন্তে দাওয়ায়,

তাই মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও এই এতো গণ্ডগ্রামে

ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম কি দুর্বার সশস্ত্র সংগ্রামে।৯

২৫ মার্চ রাতে ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনী ঢাকাসহ সারাদেশে

ট্যাংক-কামান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লে রাত দেড়টায় প্রথম প্রহরে গ্রেফতার হবার পূর্বমুহূর্তে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ; কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপট নিয়ে জাতিসংঘে আলোচনা হওয়ার পরও জাতিসংঘ এ-যুদ্ধকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে চালিয়ে দেয়। অথচ বাঙালিরা উপলব্ধি করে, এই যুদ্ধে বাঙালির মুক্তির পথ নিহিত। এই যুদ্ধই পারে তাদের একমাত্র প্রাণের দাবি স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনতে।

এ-সময়ে স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক চেতনায় প্রভাবিত কবিরা স্বাধীনতার জন্যে আত্মত্যাগী জাগ্রত বাঙালিকে দেখতে পেলেন। দেখতে পেলেন বাঙালি সন্তানেরা কীভাবে স্বাধীনতার জন্যে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে শত বিপদেও। শামসুর রাহমান ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায় স্বাধীনতার যে-ব্যাপ্তি তা দেশীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মিথ এবং সমকালের সমসাময়িক বিভিন্ন উপমার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। স্বাধীনতাকে তিনি উপমায় দেখিয়েছেন রবি ঠাকুরের অজর কবিতা, কাজী নজরুলের ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ হিসেবে, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা হিসেবে, শহিদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা হিসেবে, অন্ধকারে খাঁ-খাঁ সীমান্তে মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিক হিসেবে, বোনের হাতের নম্রপাতার মেহেদীর রং রূপে। স্বাধীনতার জন্যে আত্মত্যাগ ও আকাক্সক্ষা ফুটে উঠেছে ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে হে স্বাধীনতা’ কবিতায়। এই কবিতায় একই সঙ্গে দেখিয়েছেন স্বাধীনতাপ্রাপ্তির আকাক্সক্ষায় কীভাবে বাঙালি প্রহর গোনে এবং স্বাধীনতা যে আসবেই – এই প্রত্যাশা দৃঢ়মূল ধরেই আত্মত্যাগের চালচিত্র। স্বাধীনতাকে পাবার জন্যে এদেশের সাধারণ মানুষ থেকে সর্বশ্রেণির মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সকিনা বিবির মতো অনেক বাঙালি রমণীর কপালে দুঃখভোগের ছায়া নেমে এসেছে। হরিদাসীর মতো কত না রমণীর সিঁথির সিঁদুর মুছে গেছে। দানবের মতো শহরের বুকে নেমেছে ট্যাংক। উজার হয়েছে বস্তি, ছাত্রাবাস, শহর-বন্দর, ছাই হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম, অনেক অবুঝ শিশু তাদের পিতা-মাতার লাশের ওপর হামাগুড়ি দিয়েছে। কবির ভাষায় বলা যায় –

স্বাধীনতা তোমার জন্যে

রাইফেল কাঁধে বনে-জঙ্গলে ঘুরে-বেড়ানো

সেই তেজী তরুণ যার পদভারে

একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হতে চলেছে –

সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।

পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত

ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে,

নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগি¦দিক

এই বাংলায়

তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা।১০

শামসুর রাহমানও যুদ্ধের সময় বাঙালির শোককে শক্তিরূপে দেখেছেন। হানাদার বাহিনীর বর্ণনাহীন নির্যাতনের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি দালালদের অর্থাৎ সত্তরের নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত  মুসলিম  লীগ,  নেজামে  ইসলাম,  জামায়াতে  ইসলাম প্রভৃতি দলের সমন্বয়ে গঠিত শান্তি কমিটি, আল-বদর, রাজাকার, আল-শামস প্রভৃতি সাম্রাজ্যবাদী দোসরদের বাংলার মাটিতে পদচারণা। তাদের দ্বারা সৃষ্ট নির্যাতনকে প্রত্যক্ষ করেছেন শামসুর রাহমান, ‘প্রাত্যহিক’ কবিতায়।

তবে এতো কিছু দেখার পর নির্যাতনের হাত থেকে মানুষের মুক্তির জন্যে, স্বাধীনতা প্রাপ্তির জন্য শামসুর রাহমান যুদ্ধের বিকল্প কিছু ভাবতে পারেননি। তাই তিনি ‘উদ্ধার’ কবিতায় সোচ্চার কণ্ঠে ঘোষণা করেন –

দগ্ধ, স্তব্ধ পাড়ার নিঃসঙ্গ যে ছেলেটা

বুলেটের ঝড়ে

জননীকে হারিয়ে সম্প্রতি খাপছাড়া

ঘোরে ইতস্তত, তাকে জিজ্ঞাসা করুন

এখন বলবে তারা সমস্বরে যুদ্ধই উদ্ধার।১১

শামসুর রাহমান এ-সমকালকে সময় নামক হিংস্র পশু দ্বারা আক্রান্ত দেখেছেন। ফলে তাঁর ঢাকা শহর, তাঁর স্বদেশ দাঁড়িয়েছে দুঃসময়ের মুখোমুখি। এই দুঃসময় রাজনৈতিক অসুস্থতারই ফসল। শামসুর রাহমান ‘আত্মজৈবিক’ কবিতায় বিধৃত করেছেন ঘাতক সময়ের বিবরণ, যুদ্ধোত্তর দাঙ্গা ও মর্মান্তিক স্বাধীনতা এবং নেতাদের চরিত্রহীনতা।১২

যৌবন দুর্ভিক্ষ বিদ্ধ, দাঙ্গা হাঙ্গামায় ভাঙ্গে দেশ,

এদিকে নেতার কণ্ঠে নির্ভেজাল স্বদেশী আকুতি

ভাষা দেখো আদর্শের ভরাডুবি মহাযুদ্ধ শেষে

মঞ্চ তৈরি : কে হবে নায়ক তবে? করি কার স্তুতি?১৩

এরশাদ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অর্জিত সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা তথ্য গণতন্ত্রকে বিলীন করে দিয়ে তাঁর সৃষ্ট রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক প্রবাহ চাপিয়ে দিতে চাইলেন দেশের প্রতিটি মানুষের ওপর। অবশ্য এর শুরুটা জিয়াউর রহমানই করে রেখে গিয়েছিলেন।

জিয়াউর রহমান যেখানে বহুদলীয় শাসনতন্ত্রের ছদ্মবেশে সামরিক কর্তৃত্ব বা বেসামরিক শাসনের ছদ্মাবরণে সামরিক শাসন চালিয়ে আসছিলেন, সেখানে তিনি রাজনৈতিক শাসন প্রবর্তনের ছদ্মবেশে সামরিক উপস্থিতির পুনরাবৃত্তি ঘটান সফলভাবে। তিনি কিছুদিনের মধ্যে হয়ে ওঠেন স্বৈরাচারী শাসক। দেশে এ-সময় দেখা দেয় নৈরাজ্য, নিরাপত্তাহীনতা, সন্ত্রাস, বিশ্বাসহীনতা, ধাপ্পাবাজি, সীমাহীন লুটপাট ও গণদরিদ্রের ভয়াবহ পরিস্থিতি।

এসবের মুক্তির লক্ষ্যে এবং স্বৈরাচার শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন তখন লাগাতার আন্দোলনে রূপ নেয়।

রাজনীতিবিদদের মতো কবিরাও সময়ের প্রয়োজন মেটাতে সমাজশোষণের বিরুদ্ধে, সামরিক শাসন ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সচেতনতাকে কাজে লাগান। শুধু সামরিক নয়, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনও তখন তুঙ্গে। বাংলাদেশের কবিরা জিয়া-এরশাদের সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকটকে প্রতিনিয়ত অবলোকন করেছেন শিল্পীর মেজাজে এবং আত্মস্থ করতে পারলেন যে, সামরিক শাসকরা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিশেষ কোনো ভূমিকা রাখতে পারেন না। যদিও তারা এর উল্টোটাই দাবি করেন। রাজনৈতিক বিকাশের ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা আরো বেশি হতাশাব্যঞ্জক। বেসামরিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রথমে রাজনৈতিক উন্নয়নে সমস্যার সম্মুখীন হন। সবশেষে, রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ফলে সামরিক বাহিনী দেশের অভ্যন্তরীণ এবং বহিঃনিরাপত্তা রক্ষায় অক্ষম হয়ে পড়ে।১৪

ফলে এই অক্ষমতাকে রাজনৈতিক অভিসিদ্ধ দ্বারা সামরিক সরকার সিদ্ধি পেতে চায়। দেশ তখন আবারো স্বৈরতন্ত্রের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়ে।

শামসুর রাহমান তাঁর যে ‘অন্ধ সুন্দরী কাঁদে’ কবিতায় যর্থাথই বলেছেন –

যে অন্ধ সুন্দরী কাঁদে রাত্রিদিন আমার নিঝুম

বুকের কন্দরে একাকিনী

তাকে আমি চিনি বলে মনে হয়।

সে অন্ধ সুন্দরী

ব্যথিত নন্দিনী আজ। তার পায়ে কোনো

প্রাচীন নূপুর নয়, লোহার শেকল বাজে প্রহরে প্রহরে।

… গোপন বন্দুক, সে দেখতে পাবে না কখনো কিছু

অবশ্য হঠাৎ সে চমকে ওঠে কোনো শব্দ শুনে হাতড়ে বেড়ায়?১৫

আসাদ মিছিলে গিয়েছিল স্বাধিকারের প্রশ্নে। নূর হোসেনও মিছিলেই গিয়েছিল। তবে স্বাধীন দেশে গণতন্ত্র অপহরণকারী স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। গণতন্ত্র আদায়ের লক্ষ্যে নূর হোসেন নব্বইয়ের গণআন্দোলনকে বেগবান করার চেতনার প্রতীক। বৈরী সময়ের রক্তগোলাপ। বাংলাদেশের হৃদয়ে সে-সময়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা। পঁচাত্তর-উত্তর ময়ের উদ্দিন, তাজুল, শাহজাহান সিরাজ, রাউফুন বসুনিয়া প্রমুখ শহিদের পাশাপাশি রাজনৈতিক চেতনায় ঘা দিয়ে নূর হোসেনও স্বৈরাচারবিরোধী চেতনাকে করেছে ত্বরান্বিত। নূর হোসেন একটি গোলাপ হয়ে ফুটে উঠেছে, যে-গোলাপের শরীর বুলেটবৃষ্টিতে ঝাঁঝরা অথচ লক্ষ কোটি রক্তবীজ মুহূর্তেই সারাদেশের মাটিতে মুক্তিকামী মানুষের মনে ছড়িয়ে দিয়ে যায়। শামসুর রাহমান যেমন রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৬৯-এ লিখেছিলেন ‘আসাদের শার্ট’ তেমনি ১৯৮৭-তে নূর হোসেনকে বিজয়ী করে লিখলেন ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’। নূর হোসেন হয়ে ওঠেন বিপ্লবের প্রতীক, বিদ্রোহের প্রতীক –

সারারাত নূর হোসেনের চোখে এক ফোঁটা ঘুমও

শিশিরের মত

জমেনি, বরং তার শিরায় শিরায়

জ্বলছে আতশবাজি সারারাত, কি এক ভীষণ

বিস্ফোরণ সারারাত জাগিয়ে রেখেছে

… বীরের মুদ্রায় হাঁটে মিছিলের পুরোভাগে এবং হঠাৎ

শহরে টহলদের ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সীসা,

নূর হোসেনের বুক নয় বাংলাদেশের হৃদয়

ফুটো করে দেয়; বাংলাদেশ

বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে, তার

বুক থেকে অবিরল রক্ত ঝরতে থাকে, ঝরতে থাক।১৬

মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আমাদের কবিরা অর্জিত স্বাধীনতা ও

সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের করুণ বিবর্ণতা দেখে আবারো শরণাপন্ন হয়েছেন স্বাধীনতার কাক্সিক্ষত সত্তার কাছে। যে-শামসুর রাহমান একাত্তরেই লিখেছেন ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে হে স্বাধীনতা’ কিংবা ‘স্বাধীনতা তুমি’ – তিনিই নব্বইয়ের উত্তাল-অস্থির দিনগুলোতে এসে স্বাধীনতাকে আহ্বান করলেন গর্জে ওঠার জন্যে –

কি করবো সে বসন্ত দিয়ে যাতে আছে শুধু ধু ধু

কোকিলের ডুকরে ওঠা নেই

ফুলের বাহার? সে বাগানে কি কাজ আমার

এখনো বন্দিনী তুমি, হাঁটতে পারো না রং ধনুর গালিচা মোড়া

                                                            পথে।

তুমি বিনে কি দুরূহ এই পথ চলা।

চৌদিকে আঁধার করে বিকট দানব আসে পায়ের তলায়

নিমেষে গুঁড়িয়ে দেয় নব্য সভ্যতার বুনিয়াদ,

নেলসন মান্দেলার দীর্ঘ কারাবাসের দোহাই

দিগন্ত কাঁপিয়ে ক্রুদ্ধ টাইটনের মতোই আজ

হাতের শেকল ছিঁড়ে ফেলে

গর্জে ওঠো, গর্জে ওঠো স্বাধীনতা।১৭

কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী চক্র হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি। তাদের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত চলতে থাকে গোপনে গোপনে। বাঙালির সত্তাবোধের বিকাশ, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ও অস্তিত্বগামী চেতনাকে বিপন্ন করার ঘৃণ্য প্রয়াস চালায় তারা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে এবং বঙ্গবন্ধুর পরিবার-পরিজনকে নির্মমভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে।

বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার যাতে না হয়, সেজন্য কুখ্যাত আইন করে বঙ্গবন্ধু-হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ করা হয়। জারি করা হয় ‘ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স’। পঁচাত্তর-উত্তর জিয়াউর রহমান সর্বপ্রথম প্রেসিডেন্ট

থাকাকালে সংসদকে দিয়ে এই আইন রক্ষার জন্যে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে পাশ করিয়ে নেন।

কিন্তু বঙ্গবন্ধুর চেতনা বাঙালির রক্তের শিরায় শিরায় নিয়ত বহমান। শুধু বাঙালি সাধারণ জনতা নয়, কবি-সাহিত্যিকরাও তাঁদের চেতনায় লালন করে আছেন বঙ্গবন্ধুকে।

বঙ্গবন্ধু তাঁদের চেতনায় জেগে আছেন উজ্জ্বল রৌদ্রের প্রতিভায়। সাম্যবাদের প্রতীক রূপে, গণতন্ত্রের প্রতীক রূপে, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক রূপে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক রূপে, মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক রূপে।

শেখ মুজিবকে নিয়ে কবিরা শুধু তাঁর মৃত্যুর পরই কবিতা লেখেননি, মৃত্যুর পূর্বেও একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে কিংবা মুক্ত স্বদেশে তিনি যখন বাঙালির পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, তখনো লেখা হয়েছে অনেক কবিতা। তবে মৃত্যুর পরপরই শেখ মুজিবকে নিয়ে কবিতা লেখাটা ছিল এক দুঃসাহসিক কাজ। কেননা শেখ মুজিবকে ক্ষমতাসীনরা এমনভাবে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলেন যে, যে-ব্যক্তি তাঁর নাম উচ্চারণ করবেন, সে-ই হয়ে উঠবে মহা অপরাধী। কিন্তু না, ক্ষমতাসীনদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশে অনেক কবিই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন।

শামসুর রাহমানের ‘ইলেক্ট্রার গান’ কবিতায় অ্যাগামেননের হত্যাকাণ্ডের পর নিহত পিতার জন্যে যেমন শোক করেছে, তেমনি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে শামসুর রাহমানের হৃদয়ে যে বেদনার ঝড় ও প্রতিশোধপ্রবণতা জ্বলে উঠেছে তা বিধৃত –

আড়ালে বিলাপ করি একা-একা, ক্ষুধার্ত পিতা

তোমার জন্যে প্রকাশ্যে শোক করাটাও অপরাধ।

এমন কি, হায় আমার সফল স্বপ্নেও তুমি

নিষিদ্ধ আজ : তোমার দুহিতা একি গুরুভার বয়।

… আমার গ্রীবায় এবং কণ্ঠে আগামীর বিশ্বাস।

নিহত জনক, এ্যাগামেনন কবরে শায়িত আজ।১৮

বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম যে বঙ্গবন্ধুর সাহসী ব্যক্তিত্ব ও চেতনায় উদ্ভাসিত, তা ব্যক্ত হয়েছে শামসুর রাহমানের ‘ধন্য সেই পুরুষ’ কবিতায় –

ধন্য সেই পুরুষ নদীর সাঁতার পানি থেকে যে উঠে আসে

সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে;

ধন্য সেই পুরুষ নীল পাহাড়ের চূড়া থেকে যে নেমে আসে

প্রজাপতিময় সবুজ গালিচার মতো উপত্যকায়

… ধন্য সেই পুরুষ যার নামের উপর ঝরে

মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ধ্বনি।১৯

দেশ নিয়ে ভাবনা, দেশের জন্য কল্যাণ কামনা ও দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা নিয়ে ভাবনার ভেতর রাজনীতির মূল সার নিহিত। শামসুর রাহমান উত্তাল ষাটের দশকে স্বাধিকার আন্দোলনে-সংগ্রামে তাঁর কবিতার মধ্য দিয়ে সরব ছিলেন, যা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এছাড়াও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের গণতন্ত্রের মুখোশ পরে সামরিক সরকার দ্বারা বাংলাদেশকে পেছনে হাঁটার ষড়যন্ত্রকেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী হিসেবে উপলব্ধি করেছেন। আর এজন্যেই তিনি ১৯৮২ সালে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের শিরোনামই করেছেন উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ। যেখানে গ্রন্থ-নামীয় কবিতায় বলেছেন – ‘উদ্ভট উঠের পিঠে চলেছে স্বদেশ বিরানায়; মুক্তিযুদ্ধ/ হায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়।’

তথ্যনির্দেশ

          ১.        সাঈদ-উর রহমান, পূর্ববাংলার রাজনীতি সংস্কৃতি ও কবিতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, ১৯৮৩, পৃ ২৮৩।

          ২.       শামসুর রাহমান, ‘একুশের কবিতা’, একুশে ফেব্রুয়ারি, দ্বিতীয় সংস্করণ, সম্পা. হাসান হাফিজুর রহমান, পুঁথিপত্র প্রকাশনী, ১৯৮৯, পৃ ১৯-২০।

          ৩.       শামসুর রাহমান, ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, নিজবাসভূমে, নওরোজ সাহিত্য সংসদ, ঢাকা, ১৯৮৫, পৃ ৯-১০।

          ৪.       শামসুর রাহমান, ‘আসাদের শার্ট’, নিজবাসভূমে, দ্বিতীয় সংস্করণ, নসাস, ঢাকা, ১৯৮৫, পৃ ২২।

          ৫.       শামসুর রাহমান, ‘টেলিমেকাস’, শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতা, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ১৯৯৩, পৃ ৬৬।

          ৬.       শামসুর রাহমান, ‘বন্দী শিবির থেকে’, প্রাগুক্ত, পৃ ১৬-১৭।

          ৭.       শামসুর রাহমান, ‘পূর্বলেখা’, প্রাগুক্ত, পৃ ১১।

          ৮.       শামসুর রাহমান, ‘রক্তাক্ত প্রান্তরে’, শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মরণে কবিতাগুচ্ছ, (স) বাংলা একাডেমী, পৃ ২১।

          ৯.       শামসুর রাহমান, ‘গেরিলা’, শামসুর রাহমানের রাজনৈতিক কবিতা, সুবর্ণ, ঢাকা, ১৯৮৮, পৃ ৩৩।

          ১০.      শামসুর রাহমান, ‘গ্রামীণ’, বন্দী শিবির থেকে, তৃতীয় সংস্করণ, বইঘর, চট্টগ্রাম, ১৯৯২, পৃ ৭৪।

          ১১.      শামসুর রাহমান, ‘তোমাকে পাবার জন্য হে স্বাধীনতা’, প্রাগুক্ত,

পৃ ১৮-১৯।

          ১২.      শামসুর রাহমান, ‘উদ্ধার’, প্রাগুক্ত, পৃ ৩২।

          ১৩.      হুমায়ুন আজাদ, ‘শামসুর রাহমান’, নিঃসঙ্গ শের পা, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৩, পৃ ৫৮।

          ১৪.      শামসুর রাহমান, ‘আত্মজৈবনিক’, বিধ্বস্ত নীলিমা, বইঘর, দ্বিতীয় সংস্করণ, চট্টগ্রাম, ১৩৮০।

          ১৫.      শামসুর রাহমান, ‘যে অন্ধ সুন্দরী কাঁদে’, যে অন্ধ সুন্দরী কাঁদে, বিউটি বুক হাউস, দ্বিতীয় সংস্করণ, ঢাকা, ১৯৯১, পৃ ৯।

          ১৬.      শামসুর রাহমান, ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’, বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়, দ্বিতীয় সংস্করণ, বিউটি বুক হাউস, ঢাকা, ১৯৯১, পৃ ৯-১০।

          ১৭.      শামসুর রাহমান, ‘গর্জে ওঠো স্বাধীনতা’, গৃহযুদ্ধের আগে, বিউটি বুক হাউস, ঢাকা, ১৯৯০, পৃ ১৪।

          ১৮.      শামসুর রাহমান, ‘ইলেক্ট্রার গান’, শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতা, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ১৯৯৩, পৃ ১৫২-১৫৪।

          ১৯.      শামসুর রাহমান, ‘ধন্য সেই পুরুষ’, রাজনৈতিক কবিতা, সুবর্ণ, ঢাকা, ১৯৮৮, পৃ ৭৪-৭৫। ৎ      – ছবি : ইন্টারনেট