শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায় : তাঁর জীবন ও গান

বিভূতিভূষণ মণ্ডল

ভূপেন হাজারিকার গাওয়া ‘আমি এক যাযাবর’, ‘মানুষ মানুষের জন্যে’, ‘গঙ্গা আমার মা পদ্মা আমার মা’, ‘সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ চেতনাতে নজরুল’, ‘একখানা মেঘ ভেসে এলো আকাশে’, ‘বিস্তীর্ণ দু’পারের অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও’, ‘শরৎবাবু, খোলা চিঠি দিলাম তোমার কাছে’, ‘দোলা হে দোলা’ প্রভৃতি গান বাঙালি শ্রোতাদের দশকের পর দশক আবিষ্ট করে চলেছে, সে-সব গানের কৃতী গীতিকার শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। একটি গান যখন রেকর্ড হয়ে বাজে, তখন গীতিকার, সুরকার এবং যন্ত্রীদের আড়াল করে দিয়ে শিল্পীই সবার সামনে চলে আসেন, শ্রোতারা মূলত শিল্পীকেই চেনেন। গীতিকারের নাম জানার সুযোগও যথেষ্ট কম থাকে। তবে প্রচারমাধ্যমে গানটি প্রচারিত হওয়ার সময় ঘোষক কখনো কখনো হয়তো গীতিকার-সুরকারের নাম বলেন। খুব সতর্ক এবং মনোযোগী শ্রোতা না হলে তাঁরা এসব বিশেষ মনেও রাখেন না। এসব কারণে শ্রোতাদের কাছে গানের গীতিকার প্রায়শই অপরিচিত থেকে যান। গীতিকার শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও এ-কথা প্রযোজ্য।

শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩২ সালের ২৭ ডিসেম্বর, তৎকালীন পূর্ববঙ্গ, বর্তমান বাংলাদেশের খুলনা শহরে। গঙ্গা আমার মা পদ্মা আমার মা গ্রন্থের শুরুতে ‘ইতিকথা’য় শিবদাস নিজেই লিখেছেন :

খুলনা শহরে আমার জন্ম। খুলনা শহর আমার জন্মভূমি। … মনের ফ্রেমে বাঁধানো আছে শৈশব-কৈশোরের দেখা দেশের ছবি। খুলনাকে ঘিরে রেখেছে ‘ভৈরব নদ’। আর রূপসী ‘রূপসা নদী’। ছোট, পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন, সবুজে সাজানো যেন এক রঙিন ছবি। সেই ছবির দেশ জানি না এখন কেমন আছে। (পৃ ৭)

শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাবা শচীগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন পুলিশ অফিসার এবং মা রাধারানী দেবী ছিলেন গৃহিণী। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ,

’৪৩-এর দুর্ভিক্ষ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশভাগ – অর্থাৎ চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের এক উত্তাল এবং দুর্যোগপূর্ণ সময়ে শিবদাসের শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনের প্রারম্ভিক পর্ব কাটে পূর্ববাংলার খুলনা শহরে। খুলনা শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই তাঁর লেখাপড়া চলতে থাকে। দেশভাগের পর ‘খুলনা-যশোর পাকিস্তান আনসার বাহিনীর দানবীয় ধ্বনিতে’ কম্পমান। বাড়িঘর সহায়-সম্বল ছেড়ে, জন্মভূমিকে শেষবারের মতো প্রণাম জানিয়ে খুলনা ছেড়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন শিবদাস তাঁর পরিবারের সঙ্গে। তখন পূর্ববাংলার নাম হয়েছে পূর্ব পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তানের ছিন্নমূল যে-মানুষগুলো পশ্চিম বাংলায় চলে এলো তাদের নাম হলো ‘রিফিউজি’, ‘বাস্তুহারা’, ‘উদ্বাস্তু’ প্রভৃতি। এসব মানুষের মিছিলে শামিল হয়ে শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবার এসে ঠাঁই পায় দক্ষিণ টালিগঞ্জের বাঁশদ্রোনী, শিবদাসের বড় বোন শিবানী চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে। দেশ ছেড়ে চলে আসার বেদনা নিয়ে শিবদাস লিখেছিলেন – 

অনেক দূরে চলে যাচ্ছি আজি

তোমায় ছেড়ে মাগো

মন ভুলানো কত কী যে দেখি

তোমায় আমি ভুলতে পারি নাগো।

পূর্ববাংলা থেকে উপড়ে-আনা অস্তিত্বের শেকড় পশ্চিম বাংলার মাটিতে প্রোথিত করার অন্তহীন প্রয়াস। শিবদাস নতুন করে আবার পড়াশোনা শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত কলকাতার আশুতোষ কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে তিনি খানপুর স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। তখন স্কুলে মাইনে এতো কম ছিল যে, সংসার নির্বাহ করা কঠিন হতো। তিনি স্কুলের আগে এবং পরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিউশনি করতেন। শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিদির বাড়ির কাছে তখন শিল্প-সাহিত্যের কয়েকজন দিকপাল মানুষের বসবাস। তাঁদের মধ্যে ছিলেন – ছবি বিশ্বাস, কানন দেবী, বসন্ত চৌধুরী, মঞ্জু দে, ছায়া দেবী, প্রণতি ঘোষ, মীরা মিশ্র, অভি ভট্টাচার্য, সুপ্রভা সরকার, অপরেশ লাহিড়ী প্রমুখ। প্রতিবেশী হিসেবে আলাপ-পরিচয় ঘটে অপরেশ লাহিড়ীর সঙ্গে। অপরদিকে প্রাবন্ধিক এবং চিত্রগ্রাহক হিসেবে শিবানী চট্টোপাধ্যায়ের একটি বিশেষ পরিচিতি এবং এসব মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল। দিদির উৎসাহ-অনুপ্রেরণায় শিবদাসও আনন্দবাজার, যুগান্তর, বসুমতী প্রভৃতি তখনকার বিখ্যাত সব পত্রিকায় গল্প-কবিতা লিখতে শুরু করেন। এই সূত্রে তাঁর কিছু সম্মানী এবং পরিচিতিও জুটে যায়। এই সময়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয় বটে, তবে আনন্দবাজার পত্রিকার আনন্দমেলায় তাঁর কবিতা ছাপা হয় স্কুলজীবনেই। এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথাও স্মরণ করা যেতে পারে। একদিন স্কুলে দুপুরের টিফিনের পরে সবে ক্লাস শুরু হয়েছে। হঠাৎ বেয়ারা এসে শিবদাসকে ডেকে নিয়ে গেল প্রতিষ্ঠানপ্রধানের কক্ষে। শিবদাসের  বুক দুরুদুরু করছে। মাঘ মাসের শীতেও তাঁর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের চিকচিক। কী অপরাধ তাঁর যে তাঁকে এভাবে ধরে নিয়ে যেতে বলা হয়েছে? প্রশস্ত একটি কক্ষ। বড় একটি টেবিলের পাশে প্রতিষ্ঠানপ্রধান এবং বাংলার শিক্ষক বসে আছেন। শিবদাস কক্ষে প্রবেশ করে মাথা নিচু করে দাঁড়ালেন। আন্দাজ করতে পারেন শিক্ষক দুজন তাঁকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। প্রতিষ্ঠানপ্রধান গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘অংকে কত পেয়েছ এবারের পরীক্ষায়?’ শিবদাস অংকে দুর্বল ছিলেন। ফলে নম্বর কম হওয়াটাই স্বাভাবিক। শিবদাস নিরুত্তর। ঘরে পিনপতন নীরবতা। দেয়ালে ঘড়ির টিকটিক শব্দ। শুধু কি অংকে কম নম্বর পাওয়ার জন্যই তাঁকে তলব করা হয়েছে? নাকি এর অন্য কোনো কারণ আছে? শিবদাস কিছুই ভেবে পাচ্ছিলেন না। বাংলার শিক্ষক শিবদাসের দিকে তাকালেন। শিবদাস জানালেন যে, তিনি অংকে ৪২ নম্বর পেয়েছেন। তখন তাঁর দিকে প্রশ্নবাণ ছুটে এলো, ‘কবিতা লেখো?’ শিবদাসের কবিতাচর্চার খবর কীভাবে শিক্ষকদের কানে কিংবা নজরে এলো সেটা তিনি বুঝতে পারলেন না। প্রতিষ্ঠানপ্রধান যে এতোক্ষণ কৃত্রিম ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন তা শিবদাস ভাবতেই পারেননি। তিনি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে দিয়ে বলে উঠলেন, ‘তোমার একটা চিঠি এসেছে আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে। আনন্দমেলায় কবিতা লিখে তুমি ফার্স্ট হয়েছো।’ তারপর অফিসের বড়বাবুকে ডেকে বললেন গাড়ি করে শিবদাসকে আনন্দবাজার পত্রিকার অফিসে নিয়ে যেতে। শিবদাস শিক্ষক দুজনকে সশ্রদ্ধ নমস্কার জানিয়ে চলে এলেন। পরবর্তী জীবনে পত্রপত্রিকায় কবিতা-গল্প লিখে পরিচিতি এলেও তিনি সে-পথ ছেড়ে চলে এলেন। কেননা তাঁর জীবনদেবতা তাঁর জীবনের গতিপথ ভিন্ন গন্তব্যে নির্ধারণ করে রেখেছিলেন।

স্কুল এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে শিবদাস গিয়ে হাজির হতেন অপরেশ লাহিড়ীর বাড়িতে। সেখানে নিয়মিত গানের আসর বসতো। গান নিয়ে আলোচনা হতো। বিভিন্ন

রথী-মহারথী এসে জমায়েত হতেন। উত্তমকুমার এবং মৃণাল সেনকে চাক্ষুষ দেখার সুযোগ পান শিবদাস এ-বাড়িতেই। উত্তমকুমার হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইছিলেন। আরেকদিন মৃণাল সেনকে দেখেন বসে বসে চিত্রনাট্য লিখতে। হঠাৎ একদিন অপরেশ লাহিড়ী শিবদাসকে ডেকে পাঠালেন তাঁর বাড়িতে। শিবদাস তখন স্কুলে। টিফিনের ছুটিতে গিয়ে দেখা করেন। গিয়ে দেখতে পান নতুন ইহুদি নাটকের লেখক সলিল সেন, অভিনেতা নেপাল নাগ, অভিনেত্রী বাণী গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ বসে আছেন। এঁরা সকলেই ‘ক্রান্তি শিল্পী-সংঘে’র সদস্য। পার্ক সার্কাস ময়দানে বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দলের পাঁচ দিনব্যাপী সম্মেলন হবে। তারই প্রস্তুতিমূলক আলোচনা চলছে। প্রস্তাব হলো, শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে ওই সম্মেলনের ‘উদ্বোধনী সংগীত’ লিখে দিতে হবে। শিবদাস একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না। পত্রপত্রিকায় গল্প-কবিতা লিখলেও গান লেখা সম্পর্কে তাঁর কোনো পূর্বধারণাই নেই, লেখার কথা ভাবেনওনি কখনো। খুব বিনীতভাবে শিবদাস তাঁর অক্ষমতার কথা প্রকাশ করেন। তাছাড়া এই সংগঠনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বা কার্যাবলি সম্পর্কেও তাঁর কোনো ধারণা নেই। মুখ খুললেন স্বয়ং সলিল সেন – ‘দুঃসহ, অসহায় নিপীড়িত মানুষের কথা লিখুন। তাদের জীবনযন্ত্রণার কথা লিখুন। লিখুন, হ্যাভস আর হ্যাভ নটসদের কথা লিখুন। আপনি তো তাদেরই একজন।’ (পৃ ৯)

দেশভাগের দগদগে ক্ষত শিবদাসের অন্তরে। নানাবিধ যন্ত্রণা-বঞ্চনায় জর্জরিত তিনি। সলিল সেনের উসকানিতে দেশলাই কাঠির মতো জ্বলে উঠল শিবদাসের ক্ষোভের বারুদ। চোখে জলও চলে এলো। জলেই আগুন জ্বলে উঠল। অপরেশ লাহিড়ী তাঁকে এই বলে আশ্বস্ত করলেন যে, শিবদাস গানের পরিবর্তে কবিতাও লিখতে পারেন। অপরেশ সুর বসিয়ে কবিতাকে গান বানিয়ে ফেলবেন। সেই রাতেই শিবদাস গান কিংবা কবিতা কিছু একটা লিখে ফেলেন। অপরেশ লাহিড়ী সুর সংযোগ করেন এবং গানটি যথারীতি ওই অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয়। এটাই ছিল শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচিত প্রথম গান। গানটি ছিল – ‘এই কি পৃথিবী সেই/ হেথায় আশার আলো শুধু ছলনা করে/ চোখের তারায় যে আশা কেঁদে মরে/ পৃথিবীর বুকে তবু কি মমতা নেই?’ গানের ভুবনে এই হলো শিবদাসের গৃহপ্রবেশ।

গানের সঙ্গে শিবদাসের এই যে ঘরগৃহস্থালি শুরু হলো তা অবিচ্ছেদ্য রইল আজীবন। একবার হলো কী, দমদম মতিঝিলে এক সাহিত্যসভা। পত্রপত্রিকায় কবিতা প্রকাশের পরিচিতিতে শিবদাসও সেখানে আমন্ত্রিত। কবিতা পড়েন তিনি। সভার সভাপতি প্রেমেন্দ্র মিত্র, কবি-গীতিকার-গল্পকার-ঔপন্যাসিক প্রভৃতি অভিধায় বিভূষিত তিনি। অনুষ্ঠানশেষে ফেরার পথে প্রেমেন্দ্র মিত্র শিবদাসকে বলেন, ‘তুমি গান লেখো না কেন?’ প্রেমেন্দ্র মিত্রের এ-প্রশ্নের জবাব শিবদাস দিয়েছিলেন গান লিখেই। পরবর্তীকালে তিনি নিজেই উদ্যোগী হয়ে শিবদাসকে আকাশবাণী কলকাতার তালিকাভুক্ত গীতিকার করে দেন। তারপর ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’ রেকর্ড কোম্পানির নজরে পড়েন শিবদাস। শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, অনল চট্টোপাধ্যায়ের সুরে, সনৎ সিংহের কণ্ঠে এইচএমভির প্রথম রেকর্ড ‘সরস্বতী বিদ্যেবতী’ গানটি সুপারহিট হয়। এরপর তাঁকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় না। কিছুদিন পরে অপরেশ লাহিড়ী এইচএমভি ছেড়ে ‘মেগাফোন রেকর্ড’ কোম্পানিতে যোগ দেন। তিনি শিবদাসকে পুজোর গান লিখতে বলেন। দুখানি গান লেখেন শিবদাস। কিন্তু সুর করবেন কে? বোম্বাই  থেকে তখন ছোটখাটো, সুদর্শন এক পার্সি যন্ত্রশিল্পী ভি. বালসারা ‘ইউনিভকস’, নামে একটি নতুন যন্ত্র নিয়ে কলকাতায় এসেছেন। এই যন্ত্রটির সুরে তখন গানের ভুবন মাতোয়ারা। অপরেশ লাহিড়ী শিবদাসকে বালসারার ঠিকানা দিয়ে বলেন গান দুখানি পৌঁছে দিতে। বালসারার নাম শিবদাস আগেই শুনেছেন। তিনি বাংলাভাষী নন বলে শিবদাসের মনে একটি দ্বিধা থেকে যায়। সেই দ্বিধা নিয়েই তিনি গান দুখানি দিয়ে এলেন, অপরেশ লাহিড়ীর কথার ওপর আর কোনো কথা রাখার সাহস পেলেন না। গান দুখানির একটি হলো – ‘লাইন লাগাও, লাইন লাগাও’ এবং অপর গানখানি – ‘আমি জন্মে মুখে কান্না নিলাম/ তোমার কোলে এসে/ দুচোখ ভরে অশ্রু নিলাম/ তোমায় ভালোবেসে।’ শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মা তখনো বেঁচে ছিলেন। মায়ের মনে একটি অপরাধবোধ জেগে উঠলো। তাঁর মনে হলো, তিনি শিবদাসকে লেখাপড়া শিখিয়ে উচ্চশিক্ষিত মানুষ বা প্রতিষ্ঠিত কেউ একজন হিসেবে গড়ে তুলতে পারেননি বলে সেই কষ্টবোধ নিয়ে শিবদাস এই গান লিখেছেন। শিবদাস মাকে বোঝান – ‘মা, এ আমার খুলনা – আমার জন্মভূমির গান।’ অর্থাৎ পরাধীন ভারত জননীর কোনো এক সন্তানের আর্তনাদ। ‘দুই মা মিলেমিশে এক নদী, এক সুর এক ভাষা হয়ে ওঠে।’ (পৃ ১৫)

এই গান ইতিহাস হয়ে আছে। শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের গানে সুর দিয়েই ভি. বালসারা বাদ্যযন্ত্রী থেকে সুরকার হয়ে ওঠেন। অর্থাৎ বালসারা তাঁর জীবনে সর্বপ্রথম সুর করেন শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের গানে। পরবর্তীকালে ‘ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যারের’ জন্য যতগুলো বিখ্যাত গান শিবদাস লেখেন, সেগুলোর কোনো কোনোটিতে সুর দিয়েছেন বালসারা। দুজনে একসঙ্গে সিনেমার গানেও কাজ করেছেন। ‘ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যার’ প্রসঙ্গে শিবদাস লিখেছেন –

মানুষের সামনে আমাকে প্রতিবাদী ও প্রগতিশীল গীতিকার হিসেবে তুলে ধরার কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন একমাত্র শ্রীমতী রুমা গুহঠাকুরতা, ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যারের অধিনায়িকা। দেশে-বিদেশে, শহরে-হাটে-মাঠে-ঘাটে যেখানেই তিনি অনুষ্ঠান করতে গেছেন, সেখানেই তিনি এই নগণ্য গীতিকারের নাম উচ্চারণ করেছেন। পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন মানুষের সঙ্গে। রুমাদির কারণেই অমিত কুমারের সঙ্গে পরিচয় এবং পরিচয়ের সূত্রে তার জন্য, বহুবছর ধরে পুজোর গান লেখা। আর সেই সূত্র ধরেই কিশোরকুমারের সান্নিধ্যে আসা, স্পর্শ পাওয়া। (পৃ ১১)

একটি ঘর বানাতে গেলে যেমন চারটি খুঁটির প্রয়োজন হয়, তেমিন শিবদাস তাঁর সংগীতগৃহের চারটি খুঁটি হিসেবে উল্লেখ করেছেন অপরেশ লাহিড়ী, ভি. বালসারা, রুমা গুহঠাকুরতা এবং কিশোরকুমারের নাম। এঁদের প্রতি তাঁর ঋণ এবং কৃতজ্ঞতার যেন শেষ নেই। একটি পর্যায়ে কিশোরকুমারের সঙ্গে শিবদাসের এতোটাই ঘনিষ্ঠতা জন্মে যে, তিনি কিশোরকুমারের পরিবারের একজন সদস্য হয়ে ওঠেন। কিশোরকুমারের সংসার ও ব্যক্তিজীবনের নানান টানাপড়েনের সাক্ষী হয়ে থাকেন শিবদাস। বিপর্যয়ে কিশোরকুমারকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য গানও লেখেন তিনি। অর্থাৎ শিবদাসের গানের মধ্য দিয়ে যেন কিশোরকুমারের বেদনাভার লাঘব হয়। কিশোরকুমারও তাঁর অন্তরের সকল দুঃখবেদনা, যন্ত্রণা, ক্ষরণ সবই উজাড় করে দিতেন শিবদাসকে। মূলত অমিতকুমারের জন্য গান লিখতে এসেই শিবদাস কিশোরকুমাররের ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন। শিবদাস কিশোরকুমারকে ‘সুরের সাগর’ বলে আখ্যায়িত করেন – ‘সেই সাগর কখনো বিরহের, কখনো বেদনার, কখনো আনন্দের, কখনো উচ্ছলতার। আরব সাগরের তীরে সেই সাগরের উপস্থিতি। … সব সাগর বারবার, কিশোরকুমার একবার। সমস্ত সাগরের জল লোনা, কিন্তু এই সাগরের জল মিষ্টি।’ (পৃ ১১) শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা কমবেশি ১২টি  গানে সুর দিয়েছেন কিশোরকুমার এবং সেগুলোর কয়েকটি তিনি নিজেই গেয়েছেন। সেইসব গানের মধ্যে স্মরণীয় – ‘প্রেম বড় মধুর/ কভু কাছে, কভু সুদূর’, ‘হাওয়া/ মেঘ সরায়ে, ফুল ঝরায়ে/ ঝিরিঝিরি এলে বহিয়া’, ‘ওরে হো -/ নাম আমার কিশোরকুমার গাঙ্গুলি’

প্রভৃতি। শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘রাখালচন্দ্র মাতাল’ নামে একটি গীতি-আলেখ্যে কিশোরকুমার একাই গান গান এবং অভিনয় করেন। শিবদাস লিখেছেন, ‘আমার সংগীতজীবন বৃথা হয়ে যেত যদি কিশোরজির সঙ্গে আলাপ না হতো।’

শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা সবচেয়ে বেশিসংখ্যক গানের সুরকার ভূপেন হাজারিকা। এছাড়া ভি. বালসারা ১৮টি, অমিতকুমার ২০টি, কল্যাণ সেন বরাট ১৬টির মতো গানে সুরারোপ করেছেন। অর্থাৎ বেশিসংখ্যক গানের সুরকার এঁরাই। এঁদের বাইরেও শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক বা একাধিক গানের সুর যাঁরা করেছেন তাঁদের মধ্যে আছেন – অপরেশ লাহিড়ী, পবিত্র চট্টোপাধ্যায়, নচিকেতা ঘোষ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, অনল চট্টোপাধ্যায়, মান্না দে, সলিল চৌধুরী, পান্নালাল ভট্টাচার্য, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, বাপ্পী লাহিড়ী, হৈমন্তী শুক্লা, সনৎ সিংহ, অলোকনাথ দে, অংশুমান রায়, মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়, অমল হালদার, সুধীন দাশগুপ্ত, শৈলেন মুখোপাধ্যায়, শৈলেন রায়, সৈকত মিত্র, স্বপন চক্রবর্তী, শিবাজী চট্টোপাধ্যায়, অজয় দাস, নৌসাদ, নীতা সেন, অজিত পাণ্ডে, ঋতু মুখোপাধ্যায়, শ্রাবন্তী মজুমদার, সলিল মিত্র, হিল্লোল মণ্ডল, অরূপ ঘোষ দস্তিদার, নিসার রাজমী, আলাউদ্দীন আলী, এম আশরাফ, রবীন বন্দ্যোপাধ্যায়, ওয়াই এস মুলকি, জ্যোতির্ময় বেলেল, দেবজিৎ, কৌশিক প্রমুখ। অর্থাৎ শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনকালে সেই সময়ের বিখ্যাত প্রায়-সব সুরকারই তাঁর গানে সুর দিয়েছেন।

শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায় আধুনিক গান, দেশাত্মবোধক গান, শাক্তসংগীত, ভক্তিগীতি, সিনেমার গান – সব মিলিয়ে ৩০০টির মতো গান লিখেছেন। তাঁর গানে যাঁরা কণ্ঠ দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে আছেন – অপরেশ লাহিড়ী, ভূপেন হাজারিকা, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, ইলা বসু, অনুপ ঘোষাল, রুমা গুহঠাকুরতা, মৃণাল চক্রবর্তী, কিশোরকুমার, শ্যামল মিত্র, মান্না দে, নির্মলা মিশ্র, হৈমন্তী শুক্লা, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, পান্নালাল ভট্টাচার্য, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, পিন্টু ভট্টাচার্য, সুবীর সেন, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, লতা মঙ্গেশকর, মাধুরী চট্টোপাধ্যায়, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, আশা ভোঁসলে, অমর পাল, শিবাজী চট্টোপাধ্যায়, অরুন্ধতী হোম চৌধুরী, বনশ্রী সেনগুপ্ত, উষা মঙ্গেশকর, উষা উত্থুপ, শ্রাবন্তী মজুমদার, অংশুমান রায়, সনৎ সিংহ, স্বপ্না চক্রবর্তী, ললিতা ধরচৌধুরী, শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায়, অমিতকুমার, রুনা লায়লা, ভূপেন্দ্রর সিং, অনুরাধা পাডুয়াল, চিন্ময় রায়, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়, শ্রীকান্ত আচার্য, সৈকত মিত্র, অজিত পাণ্ডে, রুমা মুখোপাধ্যায়, রামানুজ দাশগুপ্ত, সুধীন সরকার, মুনা বন্দ্যোপাধ্যায়, চন্দ্রানী মুখোপাধ্যায়, রূপরেখা চট্টোপাধ্যায়, সর্বাণী সেন, লোপামুদ্রা, শ্যামল বন্দ্যোপাধ্যায়, মেহুলী ঠাকুর, মুনমুন ঘোষ, ইন্দ্রানীল সেন, অলক ভৌমিক প্রমুখ নবীন-প্রবীণ শিল্পী। অর্থাৎ শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের গানে কণ্ঠ দেননি তাঁর জীবনকালে এমন শিল্পী খুবই কম ছিলেন। কিন্তু আধুনিক বাংলা গানের ইতিহাসে গীতিকার এবং শিল্পীর এক অসামান্য জুটি খুলনার শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আসামের ভূপেন হাজারিকা। অর্থাৎ শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের গানে বহু সুরকার সুরারোপ এবং বহু শিল্পী কণ্ঠদান করলেও শিবদাসের সঙ্গে মূল গাঁটছড়া বাঁধা ছিল ভূপেন হাজারিকার। শিবদাসের লেখা ১৮টির মতো গানে সুর সংযোজন করেছেন ভূপেন হাজারিকা – যে গানগুলো গেয়েছেন বিভিন্ন শিল্পী। আবার ভূপেন হাজারিকা নিজে শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে-৩১টি গান গেয়েছেন সেগুলোরও প্রায় সব গানের সুরকার ভূপেন হাজারিকাই। তবে এমন কিছু গান আছে যেগুলো ভূপেন হাজারিকার সুরে গেয়েছেন রুমা গুহঠাকুরতা, রুনা লায়লাসহ আরো কোনো শিল্পী। সেই গানগুলোই আবার পরবর্তীকালে রেকর্ড হয়েছে ভূপেন হাজারিকার কণ্ঠে। এই প্রসঙ্গে ‘একখানি মেঘ ভেসে এলো আকাশে’ কিংবা ‘গঙ্গা আমার মা পদ্মা আমার মা’ গানদুটির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এবং বিশেষভাবে বিবেচনার বিষয় এই যে, ভূপেন হাজারিকার কণ্ঠে গাওয়া গানগুলোই চমৎকারিত্বে শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করেছে। শ্রোতারা ভূপেন হাজারিকাকেই গ্রহণ করেছেন। যে-গানগুলোর জন্যে বাঙালি শ্রোতারা ভূপেন হাজারিকাকে চিনেছেন এবং বহুকাল মনে রাখবেন কিংবা যে-গানগুলো দিয়ে ভূপেন হাজারিকার বিপুল পরিচিতি, খ্যাতি এবং বলতে গেলে প্রতিষ্ঠাও – ‘সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ চেতনাতে নজরুল’, ‘আজ জীবন খুঁজে পাবি ছুটে ছুটে আয়’, ‘বিস্তীর্ণ দুপারের অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও’, ‘গঙ্গা আমার মা পদ্মা আমার মা’, ‘আমি এক যাযাবর’, ‘এ কেমন রঙ্গ জাদু এ কেমন রঙ্গ’, ‘মানুষ মানুষের জন্য জীবন জীবনের জন্য’, ‘একখানা মেঘ ভেসে এলো আকাশে’, ‘শরৎবাবু খোলা চিঠি দিলাম তোমার কাছে’, ‘দোলা হে দোলা’ প্রভৃতি গান শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনা। শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ভূপেন হাজারিকার সমন্বয়ে এই গানগুলো পূর্ণাঙ্গ রূপে সার্থক হয়ে উঠেছে। খুলনা এবং আসাম – ব্রিটিশ ভারতের দুই প্রান্তের দুজন সংগীতজ্ঞ কলকাতায় এসে অপূর্ব রসায়নে আধুনিক বাংলা গানের ভুবনকে ভরিয়ে দিলেন আশ্চর্য বিস্ময়ে। বরাক নদীর স্রোত এবং

রূপসা-ভৈরবের ধারা যেন গঙ্গার মোহনায় এসে মিশে গেল কলকাতাকে সাক্ষী রেখে। শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাণী এবং ভূপেন হাজারিকার সুর ও কণ্ঠ যেন দেহ এবং আত্মার মতো একীভূত হয়ে গেছে গানের ভেতর দিয়ে।

এককভাবে ভূপেন হাজারিকার কণ্ঠে এতো গান বিপুল জনপ্রিয়তা লাভের পাশাপাশি অন্যান্য কণ্ঠে শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আরো কিছু গান স্মরণীয় হয়ে আছে। যেমন – ভি. বালসারার সুরে অপরেশ লাহিড়ীর কণ্ঠে ‘সিঁড়িভাঙা অংকের মত এ-জীবনে যোগ-গুণ ভাগে পূর্ণ’ কিংবা ‘টক্কা টরে টক্কা টরে/ খবর এসেছে ঘর ভেঙেছে দারুণ ঝড়ে’, অংশুমান রায়ের সুরে ও কণ্ঠে ‘আমার বেটার বিয়া দিব সময় হয়েছে’, কিশোরকুমারের সুরে ও কণ্ঠে ‘সেই রাতে রাত ছিল পূর্ণিমা’, ‘প্রেম বড় মধুর/ কভু কাছে কভু সুদূর’, ‘হাওয়া/ মেঘ সরায়ে/ ফুল ঝরায়ে’, নচিকেতা ঘোষের সুরে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘মায়াবতী মেঘে এলো তন্দ্রা’, ভূপেন হাজারিকার সুরে লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে ‘ভালো করে তুমি চেয়ে দেখো/ দেখো তো চিনতে পারে কি না’, অজয় দাসের সুরে শ্যামল মিত্রের কণ্ঠে ‘যেমন শ্রী রাধা কাঁদে শ্যামের অনুরাগী/ তেমনি করে কাঁদি আমি পথেরই লাগি’, অংশুমান রায়ের সুরে স্বপ্না চক্রবর্তীর কণ্ঠে ‘বউদিদি গো/ আমার আইবুড়ো নাম আর ঘুচলো না’ প্রভৃতি। কয়েকটি ছায়াছবির জন্যও গান লিখেছেন শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। সেগুলোর মধ্যে আছে – চলাচল (১৯৬০), চারমূর্তি (১৯৭৯), হীরের টুকরো (১৯৭৯), পরিচয় (১৯৭৯), নবদিগন্ত (১৯৭৯), জ্যোতি বসু জবাব দাও (১৯৭৯, ছবিটি শেষ পর্যন্ত মুক্তি পায়নি), দিন যায় (১৯৮০), স্বর্ণশিখর প্রাঙ্গণে (১৯৮৭) প্রভৃতি। এই ছায়াছবিগুলোর মধ্যে চারমূর্তি ছবিতে অজয় দাসের সুরে মান্না দে-র গাওয়া ‘ভারত আমার ভারতবর্ষ/ ভারত আমার স্বপ্ন গো’ গানটি একটু আলাদাভাবে আলোচনার দাবি রাখে। সুরকার অজয় দাসের স্ত্রী সর্বাণী দাসের স্মৃতিচারণ (অবসর, শনিবার ৪ আষাঢ় ১৪২৮) থেকে জানা যায় :

সেই সময়কার কথা ভেবে পরিচালক উমানাথ ভট্টাচার্য টেনিদার (ভূমিকায় চিন্ময় রায়) গলাতে একটি দ্বিজেন্দ্রগীতি রাখতে বলেছিলেন। একটু স্বাধীনতার প্রত্যাশায় অজয় দাস দ্বিজেন্দ্রগীতির মতোই একটা গান সৃষ্টি করেছিলেন। ‘ভারত আমার ভারতবর্ষ’ শুনে উমানাথ ভট্টাচার্য রীতিমতো আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন, ‘এটা দ্বিজেন্দ্রগীতি নয়?’ তবে এই স্বীকৃতির সঙ্গে আরেকজনেরও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে। তিনি গীতিকার শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়ে একটা দ্বিজেন্দ্রসুলভ স্বদেশিয়ানা আনতে পেরেছিলেন। ‘কিরীটিধারিণী তুষারশৃঙ্গা সবুজে সাজানো আমার দেশ, তোমার তুলনা তুমিই তো মা’ এই শব্দবন্ধগুলির মধ্যে দ্বিজেন্দ্রপ্রভাব সচেতনভাবেই রেখেছিলেন গীতিকার। ‘যেদিন সুনীল জলধি হইতে/ উঠিলে জননী ভারতবর্ষ’ বা ‘কোথায় এমন হরিৎক্ষেত্র/ আকাশতলে মেশে’ – এই বিখ্যাত দ্বিজেন্দ্র-রচিত পঙ্ক্তির সঙ্গে আগের পঙ্ক্তিগুলির অসামান্য সাদৃশ্য রয়েছে। পরে অনেক সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এই গানটি ভুলবশত দ্বিজেন্দ্রগীতি হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছে। স্কুলের প্রার্থনাসংগীত হিসেবেও এটা চালু হয়ে গিয়েছিল (‘অজয় দাস : সুদূর আকাশে মিলিয়ে যাওয়া সুরকার’, অনিরুদ্ধ ভট্টাচার্য, অবসর, শনিবার ৪ আষাঢ় ১৪২৮)

পূর্বেই বলা হয়েছে যে, শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান রচনার হাতেখড়ি হয়েছিল আরএসপি অর্থাৎ বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দলের

সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ক্রান্তি শিল্পী সংঘে’র একটি সম্মেলনের উদ্বোধনী সংগীত রচনার মধ্য দিয়ে। এ-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, গান রচনার দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে ওই সংগঠনের সঙ্গে শিবদাসের সম্পর্ক শেষ হয়ে যায় না, বরং গাঢ় হতে শুরু করে। এই সংস্পর্শ শিবদাসকে অধিকার এবং রাজনীতি সচেতন করে তোলে। তিনি ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সদস্য হন। ষাটের দশকে বাংলার উত্তাল রাজনীতির আঁচ শিবদাসকে নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। যেখানেই মানুষের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে সেখানেই শিবদাস ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। তীব্রভাবে প্রতিবাদ করেছেন। বলিষ্ঠভাবে প্রতিরোধে শামিল হয়েছেন। সেজন্য তাঁকে মাশুলও গুনতে হয়েছে। ক্ষুধার্ত নিরন্ন মানুষের পক্ষে খাদ্য-আন্দোলনে নেমে পুলিশের হাতে প্রহৃত হয়েছেন। ট্রাম শ্রমিকদের আন্দোলনকে সমর্থন করে কারাবরণ করেছেন। এসব আন্দোলনে তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। তাঁর শিল্পীসত্তা নির্মাণে আন্দোলন-সংগ্রামের অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। পাশাপাশি চল্লিশ থেকে সত্তরের দশকের মধ্যে ভারতবর্ষসহ গোটা পৃথিবীর আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক ভাঙাগড়ার পালাবদলের অভিজ্ঞতাও তাঁকে ঋদ্ধ করেছিল। শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের গানে দুর্ভিক্ষের চিত্র এবং নিরন্ন মানুষের হাহাকারের সন্ধান মেলে। তিলোত্তমা নগরী কলকাতার ফুটপাতে ক্ষুধার্ত মানুষের অসহায় অবস্থানের কথা লিখেছেন শিবদাস তাঁর গানে –

তুমি কি দেখেছো,

‘উলঙ্গ-যিশু’ ফুটপাতে শুয়ে রাতে

মাতা মেরিদের বুকে মুখ রেখে

অনাহারে শুধু কাঁদে

সমবেদনার হাত বাড়াল না তবু, কেউ একজনও।

তুমি কি দেখেছো,

‘অন্নপূর্ণা’ ভিখারিণী বেশে, হায়

‘এক মুঠো ভাত’ হাত পেতে চায়

মানুষের দরোজায়

তবু, কেউ তার কান্না মোছাতে এলো না তো কোনও দিনও॥

শুধু যে তেতাল্লিশের মন্বন্তরে কলকাতার ছবি এঁকেছেন শিবদাস তা নয়। পরবর্তীকালে ওড়িশার খরাপীড়িত ‘কোরাপুট’ এবং ‘কালাহান্ডি’র অনাহারী জীবন্ত লাশের মিছিলের ছবিও ফুটে উঠেছে তাঁর গানে। ‘কঙ্কাল সে তো মানুষের এক নাম/ অনাহারে ভেঙে গেছে জীবনের হাট/… ক্ষুধার ভূগোলে লেখা আছে দুটো নাম/ শকুনের ঠোঁটে খুঁজে পাবে তার দাম’, কিংবা ইথিওপিয়াতে খরা এবং অজন্মার ফলে খাদ্যসংকটের কবলে পড়া বিপুলসংখ্যক মানুষের হাহাকারও ব্যথিত করেছে শিবদাসের চিত্তকে। শিবদাস কৃষ্ণকায়া আফ্রিকাকে নিজের কৃষ্ণকলি মায়ের সঙ্গে একাত্ম করে দেখেছেন। দুই মায়ের চোখের অশ্রুধারা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে শিবদাসের চেতনায়, তাঁর গানে। তিনি লেখেন – ‘ইথিওপিয়ার ক্ষুধার জ্বালা/ কান্না হয়ে শেষে/ কঙ্গো নদীর স্রোতের ধারায়/ গঙ্গাতে আজ মেশে/ প্রাণের সুতোয় গাঁথা মোদের দুঃখ এবং সুখ।’ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং দেশভাগের মতো মর্মান্তিক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন তিনি। সুতরাং সেই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি শান্তি ও সমন্বয়ের বাণী প্রচারের মাধ্যম করলেন তাঁর গানকে। বিভক্ত ভারতবর্ষ কিংবা ভাঙা বাংলাকে তিনি চেতনার সূত্রে এক করে গেঁথে রাখতে চান। তিনি মুছে দিতে চান পূর্ব-পশ্চিমের কৃত্রিম সীমারেখা। তাই তো তিনি লেখেন – ‘গঙ্গা আমার মা পদ্মা আমার মা/ আমার, দুই চোখে দুই জলের ধারা/ মেঘনা, যমুনা’, কিংবা ‘পৃথিবী কত দূর? সীমানা কতদূর/ আমরা যতদূর রয়েছি ছড়িয়ে/ বিশ্বভুবনের সবার জীবনের/ সঙ্গে রয়েছি আমরা জড়িয়ে।’ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সমন্বয়কে উজ্জ্বল প্রদীপের মতো তুলে ধরেছেন শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি লিখেছেন :

এই সেই দেশ এখনও এখানে শুনি আজানের ধ্বনি

গীতা বাইবেল ত্রিপিটক আর শোনা যায় রামায়ণী

কবি কালিদাস ইকবাল আর গালিবের পদাবলি

হাজার সূর্য চোখের তারায় আমরা যে পথ চলি॥

কিংবা,

গঙ্গার জল, পদ্মার পানি আলাদা কি করা যায়

কে ভগবান, কে যে আল্লাহ চেনার কী উপায়?

কে মৌলভী কে যে ব্রাহ্মণ/ একই রক্তে গড়া দুইজন

রক্তের রঙ দেখে জাত-পাত বিচার কি করা যায়?

কিংবা,

কেউ বা করে চণ্ডীপাঠ কেউ দেয় ‘আজান’

কেউ বা বলে-‘আ-মেন’ সবই তো সমান

পাশাপাশি আছেন যিশু আল্লাহ ভগবান॥

শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিভিন্ন আঙ্গিকের গান রচনা করেছেন। তাঁর গানগুলোকে কবিতা হিসেবে পাঠ করলেও সেগুলোর মর্মোদ্ধার করতে কোনো অসুবিধা হয় না। জীবনদৈর্ঘ্যরে বিচারে শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায় অন্য অনেক গীতিকারের তুলনায় কম গানই লিখেছেন বলা যায়। আসলে সংখ্যা দিয়ে তো মান বিচার হয় না। শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায় নিবিড় বনের মধ্যে বিরল চন্দনবৃক্ষ। সংখ্যায় অল্প কিন্তু গন্ধ-মাধুর্যে অনুপম। গান ছাড়াও তিনি

গীতি-আলেখ্য এবং বেশকিছু নাটক রচনা করেছেন। নাটকগুলো মঞ্চে অভিনীত এবং বেতারে সম্প্রচারিত হয়েছে। জীবনের উপান্তে এসে শিবদাস অসুস্থ হয়ে পড়েন। হৃদযন্ত্রটি গোলযোগ শুরু করলে অস্ত্রোপচার করিয়ে নিতে হয়। তবু পূর্বের মতো সুস্থতা আর ফিরে আসে না। চোখের দৃষ্টিও অস্পষ্ট হতে থাকে। ম্যাগনিফাইং গ্ল­াসের সাহায্যে কিছু পড়াশোনার চেষ্টা করেন। তাও একসময় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তারপর চোখের আলো এবং জীবনপ্রদীপ নিভে যায়। তারিখটি ২০০৯ সালের ৮ আগস্ট। তাঁর স্মৃতিরক্ষার্থে কলকাতা পুরসভার সৌজন্যে ১১২নং ওয়ার্ডে শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি তাম্রমূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। ভাস্কর্যটি উন্মোচন করেন তাঁর ভাগ্নে, শিবানী চট্টোপাধ্যায়ের ছেলে, পশ্চিমবঙ্গের একসময়ের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। সারাজীবন বিপুলসংখ্যক শ্রোতার শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা অর্জন করেছিলেন শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। শ্রোতাদের শ্রদ্ধা-ভালোবাসার জবাবে তিনি জানিয়ে গেলেন –

তোমাদের এই ভালোবাসা আমার গানের পুরস্কার

যাবার আগে জানিয়ে গেলাম আমার, প্রীতি নমস্কার

আমায়, যা দিয়েছো তাই নিয়েছি

রেখেছি এই হৃদয় ভরে।

তথ্যঋণ :

শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, গঙ্গা আমার মা পদ্মা আমার মা, দে’জ, কলকাতা, ২০০৬। – ছবি : ইন্টারনেট