সংগীতের মুক্তি বেঙ্গল-নিবেদিত উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের সূত্রে

আবুল মোমেন
ভারতসভ্যতার যেসব মহত্তম উত্তরাধিকার প্রাচীনকাল থেকে ধারাবাহিকভাবে আজ অবধি চলে এসেছে তার মধ্যে শাস্ত্রীয় সংগীতকে সবচেয়ে এগিয়ে রাখতে হবে। পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে কাল এই সংগীতে তার স্বাক্ষর রেখেছে, কিন্তু তা কখনো এই মহৎ শিল্পকে ক্ষয়িষ্ণু বা নেতিবাচক হতে দেয়নি। ক্রিয়াত্মক শিল্পে (perfoming art) প্রকাশের যে-সুযোগের প্রয়োজন তা হয়তো সবসময় একইভাবে মেলেনি, গুরু ও ওস্তাদরা যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে কায়ক্লেশে জীবন কাটিয়েছেন হয়তো কখনো কখনো, কিন্তু শিল্পকে আপসের বলি হতে দেননি। বাজারের  হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা হালের ব্যাপার।
ভারতীয় উচ্চাঙ্গসংগীত বিশুদ্ধ ভারতীয় নয়, এককভাবে হিন্দুঐতিহ্য থেকে উৎসারিতও নয়। সপ্তম শতাব্দী থেকে উত্তর ও পশ্চিম ভারতে আফগান-ইরান ও মধ্য এশিয়ার বৃহত্তর তুর্কি-পারসিক সংস্কৃতির ঢেউ এসে লাগতে শুরু করে যা দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দী নাগাদ গভীর, বিস্তৃত হতে হতে সাঙ্গীকৃত হয়ে উপমহাদেশের মহৎ শিল্প হিসেবে স্থায়ীরূপ পেয়েছে। পোশাক, সৌধ, উদ্যান, ভাষা, খাদ্যসহ সংস্কৃতির সর্বত্র ছাপ ফেলে এই সংযোগ গভীর মহত্ত্বে পৌঁছেছে সংগীতে। তাই ভারতসভ্যতার শ্রেষ্ঠ ফসল যে উচ্চাঙ্গসংগীত তা ভারতসভ্যতায় পারস্যসভ্যতার অংশীদারিত্বের চমকপ্রদ নিদর্শন, আর তা বলা বাহুল্য, ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত সাধনার সর্বোৎকৃষ্ট ফসল।
বাংলাদেশ সাংস্কৃতিকভাবে ভারতসভ্যতারই অন্তর্ভুক্ত একটি দেশ। পশ্চিম ইউরোপে যেমন ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, হল্যান্ড, বেলজিয়াম, ইতালি বহু স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ আছে, যারা নিজ নিজ স্বার্থে ও প্রয়োজনে রক্তক্ষয়ী এবং দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ করেও একই আধুনিক পশ্চিম ইউরোপীয় সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত থেকেছে, আমরাও তেমনি স্বতন্ত্র সত্তায় স্বাধীন দেশ থেকে, প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় স্বার্থে যুদ্ধেও জড়িয়ে সংস্কৃতির মাধ্যমে যুক্ত আছি ভারতসভ্যতারই সঙ্গে। এই সংযোগ ছাড়া আমাদের সাংস্কৃতিক বিকাশ ব্যাহত হবে। ভাষা, সাহিত্য, নাটক, ধর্ম, সংগীত, ইতিহাস থেকে নিয়ে খাবার, পোশাক, আচার-অনুষ্ঠান সবকিছুতেই ভারতের সঙ্গেই মিল খুঁজে পাব, আর উৎসের খোঁজ করতে মিলব একই বিন্দুতে। এ বাস্তবতা আমাদেরই মতো পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলংকা, মালদ্বীপেরও; আফগানিস্তান বিশুদ্ধ পারস্য ও মিশ্র ভারতসভ্যতার সংযোগী দেশ।
বাংলাদেশে সংগীতসাধনা কয়েকটি কারণে ব্যাহত হয়েছে, এবং প্রায় একই কারণেই নানা বিভ্রান্তিরও শিকার হয়েছে। ১৯৪৭-এর দেশভাগের পেছনে হিন্দু-মুসলিমে ধর্মীয় তথা সাম্প্রদায়িক সংঘাত কাজ করেছে। প্রায় সাত-আটশো বছরের নিরন্তর মেলামেশার ফলে সমাজে মিশ্রণ, সমঝোতা, পারস্পরিক সংশ্লেষণের মাধ্যমে যে সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের ধারা তৈরি হয়েছিল, তা একদিকে ঔপনিবেশিক শাসকের নীতির ফলে এবং অন্যদিকে ক্রমশ ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের খপ্পরে দেশীয় রাজনীতি পড়ায় বিভেদ ও বিবাদে লিপ্ত হয়েছিল। ব্রিটিশ শাসকদের কাছ থেকে ক্ষমতাবদলের সময় হিন্দু ও মুসলমান উভয় পক্ষের রাজনৈতিক নেতৃত্বই পারস্পরিক ক্রমবর্ধমান অনাস্থা ও প্রতিহিংসার মনোভাব ঠেকাতে পারেনি, সে-উদ্যোগ নেওয়ার মতো সাহসও করেনি। এই প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতালাভের ফলে ভারতীয় সভ্যতার পারসিক ও মুসলিম ভূমিকা যেন আকস্মিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হলো। ভারতে রাষ্ট্রশক্তি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়ার পথে এগোলেও দেশভাগকালীন হিংসা-হানাহানির অভিঘাত সমাজে গভীর ধাক্কা দেওয়ায় মুসলিম সম্প্রদায় তো বটেই, হিন্দুসমাজেও ধর্মীয় সংকীর্ণতাবোধ সমন্বয়ের প্রচলিত উদার বোধকে ছাপিয়ে উঠেছিল। আর পাকিস্তান আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে মুসলিম সত্তার ওপর জোর তো দিলোই, ভারতসভ্যতার কোনো ছাপ স্বীকার করতেই রাজি ছিল না। রাষ্ট্র বরাবর এই অস্বীকারের নীতিই চালিয়ে গেছে, তাতে শাস্ত্রীয় সংগীতের চর্চা বিঘিœত হয়েছে। রাষ্ট্র সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলেও সমাজ নিজস্ব অভ্যাসে যেটুকু রক্ষা করেছে তা, দু-একটি ব্যতিক্রমী প্রতিভার গুণে, সমঝদারদের বাঁচিয়ে রেখেছিল।
পূর্ব পাকিস্তান, এবং পরে বাংলাদেশের জন্যে পরিস্থিতি আরো প্রতিকূল ছিল দুটি কারণে। প্রথমত, কলকাতার সঙ্গে বিচ্ছেদ, বহুকাল ধরে কলকাতাই ভারতসংস্কৃতির রাজধানী, এমনকি উচ্চাঙ্গসংগীতের সমঝদারিতে কলকাতাই এখনো পীঠস্থান। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে না হলেও সাংস্কৃতিক দিক থেকে দেশভাগের সময় তো পূর্ব বাংলা কলকাতার পশ্চাদ্ভূমি। দ্বিতীয়ত, বাঙালি জাতীয়তাবাদের জোয়ারে শাস্ত্রীয় সংগীতের সর্বভারতীয়, আমাদের জন্যে বিশেষভাবে উত্তর-ভারতীয়, অবাঙালি ধারাটির বিষয়ে শিক্ষিত-সুধিজনেরও ঔদাসীন্য চরমে উঠেছিল। ফলে দুভাবে আমরা শাস্ত্রীয় সংগীতের উৎসের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগ হারিয়ে ফেললাম।
সাহিত্য, নাটক, চিত্রকলা, এমনকি রবীন্দ্র-নজরুলসংগীতসহ নানা ধারার নাগরিক ও লোকসংগীতে আত্মপ্রকাশ ও উৎকর্ষের পথ খুঁজে পেলেও এভাবে শাস্ত্রীয় সংগীতে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। গান-বাদ্য-নৃত্য এই তিনে মিলে যে শাস্ত্রীয় সংগীত তা কেবল গুরুমুখী বিদ্যা নয়, আদতে যে-কোনো উচ্চাঙ্গসংগীতই ব্যক্তির জন্য সার্বিক এবং আজীবনের সাধনার বিষয়। ফলে তাঁর জীবনযাপন ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ হওয়া চাই সংগীত-অনুকূল। এক্ষেত্রে কোনোরকম ন্যূনতা বা ঘাটতির অবকাশ নেই।
ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাকিস্তান যে অস্বীকারের ধারা তৈরি করেছিল, তা স্বভাবতই নিজ অবস্থান শক্ত করার জন্যে ইসলামের সঙ্গে সংগীতের বিরোধের পুরনো তর্কটাকে ব্যবহার করেছে। রাষ্ট্রের এবং রাষ্ট্রলালিত প্রথার রক্তচক্ষুকে পরোয়া করেনি বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। কিন্তু তা, রাজনীতির সাহচর্যে থেকে গণসংগীত, লোকগান, রবীন্দ্র-নজরুলসহ নাগরিক গানচর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে, যা হয়তো জীবনের অন্যান্য দাবি এবং পরিবেশের প্রতিকূলতার মধ্যে প্রাপ্ত সামান্য সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আত্মরক্ষা করতে পেরেছে। এমনকি বিকশিতও হয়েছে। কিন্তু শাস্ত্রীয় সংগীতের ক্ষেত্রে এভাবে বিকশিত হওয়া অসম্ভব, টিকে থাকাও বেশ দুরূহ।
ফল যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। সীমিত ক্ষয়িষ্ণু একটি ধারা হিসেবে এটি টিকে আছে। যারা এত বিপত্তি ও বাধার মধ্যেও শাস্ত্রীয় সংগীতের চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের মূল ভূমিকা সীমিত হয়ে যাচ্ছে আধুনিক, রবীন্দ্র-নজরুল, বিশেষত নজরুলসংগীত, এবং অন্যান্য নাগরিক গানের ছাত্রছাত্রীদের গলা সাধার কাজটি করে দেওয়ার মধ্যে। ছাত্রছাত্রী এবং তাদের অভিভাবকদের লক্ষ্য এটুকুই বলে উচ্চাঙ্গ কণ্ঠসংগীতের কিছু সাধক-শিক্ষক টিকে আছেন, যন্ত্রসংগীতের ক্ষেত্রে এটুকু আগ্রহও নেই। আর সমঝদার গোষ্ঠী সেভাবে তৈরি না হওয়ায় আসরে সংগীত পরিবেশনের সুযোগও স্বভাবত ছিল না বললেই হয়। দীর্ঘ প্রায় সত্তর বছরের এই বিচ্ছিন্নতা, রাষ্ট্রীয় বিরোধিতা, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিভ্রান্তি-বিরোধিতা মিলে কোনোমতে ধারাটি টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে, বিকাশ ছিল অবরুদ্ধ। এই দীর্ঘ সময়ে যারা শত উপেক্ষা ও বিরূপতার মধ্যেও সংগীতের এই পবিত্র বীজতলা রক্ষা করে যাওয়ার কাজ করেছেন তাঁদের কাছে অপরিমেয় ঋণ আমাদের।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে – এমনকি পঁচাত্তরের পরে পুরনো পাকিস্তানি সংস্কৃতির ভূত ফিরিয়ে আনার চেষ্টা সত্ত্বেও – বাংলাদেশে শাস্ত্রীয় সংগীতচর্চায় ভারতীয় ওস্তাদদের সহযোগিতা গ্রহণের আগ্রহ ও সুযোগ ক্রমাগত বেড়েছে। গত চল্লিশ বছরে ভারতীয় বৃত্তি নিয়ে কিংবা ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেকেই ভারতের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ কিংবা গুণী শিল্পীদের কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেছেন। এখন সমস্যাটা প্রধানত হলো বহুকালের অনভ্যস্ততার ফলে বাংলাদেশে প্রায় সকল মানুষই শাস্ত্রীয় সংগীতের রস-রূপসহ আদত যে সম্পদ তার সঙ্গে পরিচিতই নয়। যাঁরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে যতœ করে অত্যন্ত খেটে প্রচুর সময় ও যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করে এ-বিদ্যা অর্জন করে দেশে ফিরেছেন তাঁরা ব্যক্তিগত বা দলবদ্ধভাবে, কিংবা বিভিন্ন সংগীত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নানাভাবে চেষ্টা করেও পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তন করতে না পেরে, হাল না ছাড়লেও, স্বভাবতই হতাশায় ভুগছেন।
পরিস্থিতি আরো প্রতিকূল হওয়ার কারণ পশ্চিমের নানারকম জনপ্রিয় সংগীতধারার অনুকরণে এদেশেও যে সংগীত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, তা আমাদের ঐতিহ্যবাহী লোকসংগীত থেকে কিছু আহরণ করলেও শাস্ত্রীয় সংগীত সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন, অমনোযোগী। একসময় এদেশে সুরেলা কণ্ঠস্বরের জয়জয়কার ছিল, আজ যন্ত্রানুষঙ্গের মাত্রাহীন ব্যবহারে যে নয়েজক্রেজ (Noise-craze) তৈরি হয়েছে তার নিচে বাঙালির সেই অগ্রাধিকারও চাপা পড়েছে।
তবে শাস্ত্রীয় কণ্ঠ ও যন্ত্রসংগীতের এই কাহিল অবস্থার মধ্যেও নৃত্যে কিছু লক্ষণীয় অগ্রগতি ঘটেছে। বেশ বড় সংখ্যায় নৃত্যশিল্পীরা ভারত থেকে বিশুদ্ধ শাস্ত্রীয় নৃত্য শিখে এসে তা বেশ উচ্চমান বজায় রেখে পরিবেশন করছেন। এমনকি এঁরা নৃত্যে যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন সেগুলোও শাস্ত্রীয় ধারাকে মেনেই করা হচ্ছে।
এই পটভূমিতে বেঙ্গল-আইটিসি এসআরএ উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবটি আয়োজিত হতে যাচ্ছে। অংশগ্রহণকারীর তালিকা পড়ে বোঝা যায় তাঁরা বর্তমান কালের শাস্ত্রীয় সংগীতের শ্রেষ্ঠ কলাবিদদের এতে হাজির করতে চেয়েছেন। উচ্চাঙ্গসংগীতের  এ-আসর যে গুণে-মানে অত্যন্ত উচ্চমানের, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এটিই এ-ধরনের প্রথম আয়োজন এদেশে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো বেঙ্গল কেবল একটি উচ্চাভিলাষী সম্মেলন আয়োজন করেই দায়িত্ব সম্পন্ন করতে চায় না। বরং তাদের উচ্চাভিলাষ আরো বেশি, বেঙ্গল দেশে শাস্ত্রীয় সংগীতচর্চার উচ্চমানের নিয়মিত ব্যবস্থা চালু করার লক্ষ্যে কাজ করছে। এ সম্মেলনের সূত্রে বেঙ্গল বাংলাদেশে শাস্ত্রীয় সংগীতচর্চার একটি বলিষ্ঠ কার্যকর প্রক্রিয়া চালু করার প্রতিশ্র“তি দিয়েছে। বস্তুত এদেশে উচ্চাঙ্গ কণ্ঠসংগীত চর্চার রুদ্ধ বাতায়ন খুলে দেওয়ার জন্যে বেঙ্গল অনেকদিন ধরে কাজ করে আসছিল। ভারতীয় সরকারের ঢাকাস্থ ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রও এ-কাজ করে আসছে। এবারে এ-সম্মেলনের মাধ্যমে শাস্ত্রীয় সংগীত  নিয়ে রীতিমতো একটি উৎসবের আয়োজন করে বেঙ্গল বাংলাদেশে শাস্ত্রীয় সংগীতের যে-সমারম্ভ করল তা আমাদের সাংস্কৃতিক অভিযাত্রার মহত্তর উত্তরণে হয়তো যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে।