দেবব্রত চক্রবর্তী
প্যারিসের গ্যালারি পিগালে রবীন্দ্রনাথের ছবির প্রদর্শনী হলো ১৯৩০ সালে। বিদেশে এই তাঁর প্রথম প্রদর্শনী। প্রদর্শনীর সাফল্যে অভিভূত হয়ে রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ড থেকে ওই বছরের ২৯ জুন নন্দলাল বসুকে এক চিঠিতে লিখেছেন –
‘আমার ছবিগুলি শান্তিনিকেতন চিত্রকলার আদর্শকে বিশ্বের কাছে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। এই খ্যাতির অংশ তোমাদের প্রাপ্য। কেননা তোমরা নানা দিক থেকে তোমাদের আলেখ্য উৎসবে আগ্রহে আনন্দে অন্তরে অন্তরে আমাকে উৎসাহিত করেছ। তোমরা রূপকলার প্রাণ নিকেতন ওখানে গড়ে তুললে – এ তো আর্ট স্কুল নয়, এ যে নীড়, তোমাদের জীবন দিয়ে এ রচিত। সেই জন্য এই হাওয়াতে আমার বহুকালের অফলা একটা শাখায় হঠাৎ ফল ধরল।’
চিত্রী রবীন্দ্রনাথের এই উক্তি আমাদের দেশের চিত্রকলার আন্তর্জাতিক সম্মানকে আমাদের কাছে তুলে ধরে। বহুমুখী প্রতিভায় রবীন্দ্রনাথ চিত্রীরূপে আবির্ভূত হন প্রায় জীবনের অপরাহ্ণে পৌঁছানোর পর। ভারতীয় আধুনিকতা (শিল্পকলার ক্ষেত্রে) ১৯১৯-২০ থেকে শুরু করে এই সময়ে এসেও নিঃশেষ হয়ে যায়নি। এখন আমরা যে-বিশ্বায়নের কথা বলি তা অনেককাল আগে রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন। শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীর পরিকল্পনায় এবং পরে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৯১৬ সালের ২২ আগস্ট পুত্র রথীন্দ্রনাথকে চিঠিতে লিখেছিলেন (জাপান থেকে) – ‘আমাদের নব্যবঙ্গের চিত্রকলার আর একটু জোর, সাহস এবং বৃহত্ব দরকার।’ ওই একই বছর ২৪ আগস্ট অবনীন্দ্রনাথকে ওখান থেকে লিখেছিলেন, – ‘আমাদের দেশে আর্টের হাওয়া বয় নি, সমাজ জীবনের সঙ্গে আর্টের কোনো নাড়ির যোগ নেই।’ ওই সময়ে সমরেন্দ্র ঠাকুরকে লিখেছিলেন, ‘ভারতবর্ষের আর্ট যদি পুরো জোরে সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে এগোতে পারে তা হলে গভীরতায় এবং ভাব ব্যঞ্জনায় তার কাছে কেউ লাগবে না।… আমাদের আর্টিস্টদের তুলির সামনে অসীম ক্ষেত্র দেখতে পাচ্ছি।’
শান্তিনিকেতনের কলাচর্চার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে বিশিষ্ট চিত্রী, ভাস্কর, শিল্প-গবেষক এবং ঐতিহাসিকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে উপস্থিত করেছিলেন। ১৯২১ সালে শিল্পবোদ্ধা এবং ঐতিহাসিক স্টেলা ক্রামরিশ, ১৯২২ সালে ফরাসি শিল্পী (পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট) অাঁদ্রে কারপেলেকে নিয়ে আসেন। কিছুদিন শিল্প-বিষয়ে বক্তৃতা দেন চার্লস ফ্রিয়ার অ্যান্ড্রুজও। ১৯২৪ সালের মে-জুন মাসে রবীন্দ্রনাথ চীন ও জাপান পরিভ্রমণ করেন। ১৯২৬ সালে তিনি নিয়ে আসেন ভাস্কর লিজা ফন পটকে। এঁর কাছে প্রাথমিক ভাস্কর্যের পাঠ নেন রামকিঙ্কর। পরে ভাস্কর্যের পাঠ দিতে আসেন মার্গারেট মিলওয়ার্ড এবং বের্গম্যান।
ছবি অাঁকতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ আবিষ্কার করেছিলেন এক আকারের জগৎ। ১৯২৮ সালে (১৩ অগ্রহায়ণ, ১৩৩৫) লিখেছিলেন নির্মলকুমারী মহলানবীশকে – ‘এর আগে আমার মন আকাশে কান পেতেছিল, বাতাস থেকে সুর আসত, কথা শুনতে পেত, আজকাল সে আছে চোখ মেলে রূপের রাজ্যে, রেখার ভিড়ের মধ্যে। গাছপালার দিকে তাকাই, তাদের অত্যন্ত দেখতে পাই – স্পষ্ট বুঝি জগৎটা আকারের মহাযাত্রা।… আবেগ নয়, ভাব নয়, চিন্তা নয় রূপের সমাবেশ।’
সম্প্রতি ‘ক্যালকাটা পেইন্টার্স’ শিল্পী দলের একটি উল্লেখযোগ্য শিল্প-কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়ে গেল সাঁতরাগাছির কোনা এক্সপ্রেস হাইওয়ের ওয়েলকাম গ্রুপের (আইটিসি) ফরচুন পার্ক পঞ্চবটিতে। যার সময়কালের বিস্তৃতি ছিল ২২ থেকে ২৫ মার্চ, ২০১২ পর্যন্ত। এ-কর্মশালায় কলকাতা এবং নতুন দিল্লির আমন্ত্রিত শিল্পীদের পাশাপাশি ছিলেন বাংলাদেশের শিল্পীরাও। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল ২০১০ সালের শুরুতে বাংলাদেশে গিয়ে বাংলাদেশের শিল্পীদের সঙ্গে একটি বড়মাপের শিল্প-কর্মশালায় অংশগ্রহণ এই দলের। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ঢাকার বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাইন আর্টসে ‘পথচলা ও সখ্য’ এই শিরোনামে ক্যালকাটা পেইন্টার্সের প্রদর্শনীর সময়কালের বিস্তৃতি ছিল ৫ থেকে ১১ জানুয়ারি, ২০১০ পর্যন্ত। পরে বাংলাদেশের শিল্পীদের সঙ্গে ক্যালকাটা পেইন্টার্সের যোগদান শিল্পশিবিরে। ৬ থেকে ১০ জানুয়ারি নড়াইলের কান্ট্রি সাইড অ্যান্ড গলফ রিসোর্টে মধুমতি আর্ট ক্যাম্প।
ক্যালকাটা পেইন্টার্সের শিল্পীসদস্যরা অর্থাৎ যাঁরা ফরচুন পার্ক পঞ্চবটিতে অংশগ্রহণ করলেন তাঁরা হলেন – অনিতা রায় চৌধুরী, অনিমেষ নন্দী, বরুণ রায়, বিপিন গোস্বামী, ধীরাজ চৌধুরী, দ্বিজেন গুপ্ত, গৌতম ভৌমিক, ঈশা মহম্মদ, নিখিলেশ দাস, প্রদীপ মন্ডল, প্রকাশ কর্মকার, শ্যামশ্রী বসু, শিবপ্রসাদ কর চৌধুরী, শুভব্রত নন্দী, সুব্রত ঘোষ, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুশান্ত চক্রবর্তী, তপন ঘোষ, ওয়াসিম কাপুর এবং আমি। উপস্থিত না থেকে ছবি পাঠিয়েছেন যোগেন চৌধুরী, অমলনাথ চাকলাদার, নীবেস সেনগুপ্ত।
বাংলাদেশের যে-শিল্পীরা উপস্থিত ছিলেন তাঁরা হলেন – কাইয়ুম চৌধুরী, রফিকুন নবী, মাহমুদুল হক, তাহেরা খানম এবং ফরিদা জামান। যাঁরা ছবি পাঠিয়েছেন তাঁরা হলেন – সমরজিৎ রায় চৌধুরী, আবদুস শাকুর, বীরেন সোম, হাশেম খান, কনক চাঁপা চাকমা, মাহবুবুর রহমান, মোহাম্মদ ইকবাল, মনিরুল ইসলাম, রনজিৎ দাস, শেখ আফজাল হোসেন প্রমুখ। কলকাতা ও নতুন দিল্লির আমন্ত্রিত শিল্পীরা হলেন – দীপ্তি চক্রবর্তী, মনোজ দত্ত, সন্তোষ ভার্মা, অসিত পোদ্দার, স্বাগতা বোস, ব্রততী মুখোপাধ্যায়, সুহাস রায়, তপন কুমার মিত্র, শুভঙ্কর মৈত্র এবং উমা রায় চৌধুরী। সুহাস আসতে পারেননি, ছবি পাঠিয়ে দিয়েছেন।
রবীন্দ্র জন্মসার্ধশতবর্ষের এই শিল্প-কর্মশালায় প্রকাশিত পুস্তিকার নাম সকল রসের ধারা।
২২ মার্চের উদ্বোধনী সংগীত অদিতি গুপ্তের এবং বেদগান গৌতম ভৌমিকের, সদ্য প্রয়াত বিশিষ্ট শিল্পী বিজন চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন, যিনি এই শিল্পী দলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন তারিক মহম্মদ আরিফুল ইসলাম (অ্যাক্টিং ডেপুটি হাইকমিশনার বাংলাদেশ), ফরচুন পার্ক পঞ্চবটির ম্যানেজিং ডিরেক্টর এস দে এবং বিশিষ্ট শিল্পীরা। সম্মান জ্ঞাপন করা হয় শিল্পীদের; তাঁরা হলেন – রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, গণেশ হালুই, শানু লাহিড়ী, সুহাস রায়, সুনীল দাস, প্রকাশ কর্মকার, উমা সিদ্ধান্ত এবং শঙ্কর ঘোষ।
সমগ্র অনুষ্ঠানের ভাবনায় ধীরাজ চৌধুরী, বরুণ রায় এবং দ্বিজেন গুপ্ত।
২৩ মার্চ শিল্প-কর্মশালা শেষে ‘ক্যালকাটা পেইন্টার্স’ দলের শিল্পীদের দল প্রসঙ্গে নিজস্ব আলোচনা এগিয়ে চলার নানা পরিকল্পনা এবং প্রস্তাবনা।
২৪ মার্চ সন্ধ্যায় এক বিশেষ আলোচনা সভার আয়োজন। ‘শিল্পীদের অন্বেষণে রবীন্দ্রনাথ’ অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ঈশা মহম্মদ। আলোচনায় অংশগ্রহণে – বরুণ রায়, ঈশা মহম্মদ, ধীরাজ চৌধুরী এবং আমি। সুব্রত ঘোষের রবীন্দ্রভাবনা ও গবেষণা বিষয়ক উপস্থাপনায় স্লাইড শোর মাধ্যমে বক্তব্য তুলে ধরা।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.