সমকালীন শিল্প ও শিল্পী

এস এম সাইফুল ইসলাম
মানুষ প্রকৃতিগতভাবে সৃজনশীল। প্রত্নতত্ত্ববিদগণের আবিষ্কারে প্রাচীন যুগের মানুষের অঙ্কিত গুহাচিত্র এবং পশুর হাড় ও শিং থেকে নির্মিত মানুষ ও জীবজন্তুর মূর্তিসহ বিবিধ শিল্পনিদর্শনের দেখা মেলে। ধারণা করা হয়, শিল্পকলার উদ্ভব হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার বছর আগে। ‘হোমো স্যাপিয়েন্স’ মানুষ তার চারপাশে যা দেখেছে তা-ই তার শিল্পমাধ্যমে ধরে রাখার চেষ্টা করে গেছে।

Art Work
Art Work

একজন শিল্পী, কবি বা সৃজনশীল যে-কোনো মানুষ নিজের ভেতর যুগপৎ ধারণ করে সাধারণ ও অসাধারণ দুটি সত্তা। সাধারণ সত্তাটি পৃথিবীর তাবৎ মানুষের মতো জীবনচক্রের অমোঘ নিয়মে পরিচালিত হয়। অন্যদিকে অসামান্য সত্তা আমৃত্যু মগ্ন থাকে আত্মানুসন্ধানে। দুটি সত্তার পার্থিব ও অপার্থিব প্রত্যাশার হিসাব-নিকাশ এবং অন্তর্দ্বন্দ্বও কম নয়। বস্ত্তত আত্মানুসন্ধানের যাতনায় মানুষ শিল্পী হয়ে ওঠে। যাতনা থেকেই উদ্ভূত হয় প্রকৃত শিল্প।
শিল্পীর সৃজন প্রধানত তার নিজের জন্য। শিল্পকর্ম গ্যালারিতে প্রদর্শিত হওয়ার পর তা শিল্পীর ব্যক্তিগত সীমানা পেরিয়ে জনসাধারণের হয়ে ওঠে। দর্শক, সংগ্রাহক ও শিল্পবোদ্ধা মারফত শিল্প কালোত্তীর্ণ হয় এবং ইতিহাসে স্থায়ী ব্যাপ্তি পায়।
মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে ঢাকার গুলশানে ‘সাজু আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটস’ নামকরণে বর্তমান সাজু আর্ট গ্যালারি যাত্রা শুরু করে। স্পষ্টত তখন ১৯৭৪ সাল। গ্যালারির কর্ণধার ১৯৭৭ সালে দেশের প্রবীণ ও নবীন শিল্পীদের শিল্পকর্ম নিয়ে প্রথম প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। সে-ধারাবাহিকতায় ৭ এপ্রিল থেকে ৮ মে ২০১২ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় ‘অ্যা গ্র্যান্ড গ্রুপ আর্ট এক্সিবিশন অব রিপিয়ুটেড বাংলাদেশি আর্টিস্টস’ শীর্ষক প্রদর্শনী। এতে দেশের বরেণ্য ও পথিকৃৎ শিল্পীদের শিল্পকর্মের পাশাপাশি একেবারে সমসাময়িক নবীন শিল্পীদের কাজ স্থান পায়। শিল্পী কামরুল হাসানের কালো রঙের ‘ঢোলক’ শীর্ষক কাঠখোদাই চিত্রটি অত্যন্ত সুপরিচিত এবং গুরুত্ববহ। বাংলার উৎসবের একটি চিরায়ত অনুষঙ্গ ঢোলক। লোকজ শিল্পকলার সঙ্গে পাশ্চাত্য শিল্পের সম্মিলনে কামরুল হাসানের নির্মিত চিত্রভাষা বাংলাদেশের চারুশিল্পকে একটি অনন্য মাত্রা দিয়েছে। এদেশের কৃষকগোষ্ঠী আজন্ম শক্তিমান এবং অপরাজেয় – বস্ত্তত এই গভীর দর্শন থেকে সৃষ্ট লাল মিয়া তথা শিল্পী এস এম সুলতানের সমগ্র শিল্প। প্রদর্শনীর ‘কৃষক’ শীর্ষক চিত্রকর্ম এর একটি উদাহরণ। এই উপমহাদেশে শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদ প্রকৃত অর্থে ছাপচিত্রের এক জীবন কিংবদন্তি। তাঁর চমৎকার ব্যক্তিত্ব, অসামান্য শিল্পসত্তা এবং শিক্ষক জীবনের আদর্শ ও বিশালত্ব আমাদের বিনম্রচিত্তে মুগ্ধতা তৈরি করে। কালোতে ছাপা ‘বন্যা’ শীর্ষক উড এনগ্রেভিং মাধ্যমের চিত্রকর্মে শিল্পীর দক্ষতা, নৈপুণ্য ও পরিমিতিবোধের দেখা মেলে।
আধুনিক বাংলা কবিতায় কবি শামসুর রাহমানের ভূমিকা অপরিসীম। তাঁর ‘পান্থজন’ শীর্ষক কবিতার পাশে শিল্পী আমিনুল ইসলামের তুলি ও কালিতে অাঁকা ড্রইং অসামান্য ব্যঞ্জনা পেয়েছে। কবির স্বহস্তে লেখা কবিতা এবং শিল্পীর নৃত্যরত রেখার সঙ্গে কাগজের চারপাশের পোড়া অংশ দর্শকের মনে ব্যাখ্যাতীত এক ভাবনা উসকে দেয়। বোধ করি এ-অনুভূতিকে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয় ‘আমার মন কেমন করে…’।
শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়ার নিঃসঙ্গতা ও নীরবতাপ্রসূত গভীর অনুভূতির বিমূর্ত চিত্রভাষা মনোমুগ্ধকর। এদেশে বিমূর্ত চিত্রশিল্পের বিকাশে তিনি পথিকৃৎ শিল্পীর ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর সামগ্রিক কাজ নিয়ে ধারাবাহিকভাবে সুষ্ঠু গবেষণা হওয়া দরকার। শিল্পী মনিরুল ইসলামের চিত্রকলা রং ও রেখায় চিত্রিত এক প্রকার মরমি কবিতা। তাঁর কাজের বিশুদ্ধ জ্যামিতিক রেখা, রং, ফর্ম ও বিন্যাস আমাদের চমৎকৃত করে। প্রদর্শনীতে শিল্পীর চারটি কাজেই এসবের দেখা মেলে। বিমূর্ত চিত্রকলার অন্য এক গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী শামসুল ইসলাম নিজামী। ‘কম্পোজিশন’ শীর্ষক তাঁর চিত্রকর্মে রঙের যে-ব্যঞ্জনা বিশেষত লাল ও হলুদের, তা শক্তিমান। শিল্পী সমরজিৎ রায় চৌধুরী প্রধানত প্রকৃতির বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও সময়ের পরিবর্তনে আগ্রহী। তাঁর ‘প্রকৃতির নির্যাস’ শীর্ষক চিত্রকর্মে রং ও রেখার জ্যামিতিক বিভাজন বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদের ‘স্নান’ শীর্ষক কাজে নারী ফিগারে বিশেষ ভঙ্গি ও গতি সঞ্চারিত হয়। তাঁর শিল্পে গতিময় মানুষের প্রাণপ্রাচুর্য ও বিজয় চেতনার প্রকাশ অতুলনীয়। বাংলাদেশে যে কয়েকজন নারীশিল্পী বিশিষ্টতা অর্জন করেছেন রোকেয়া সুলতানা তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। তাঁর কাজে একটি ধ্যানমগ্ন চৈতন্যের জগৎ আছে, যা দর্শককে সম্মোহিত করার বিশেষ ক্ষমতা রাখে। ‘ম্যাডোনা’ শীর্ষক প্রদর্শনীর চিত্রকর্মে লাল রঙের বিন্যাস ও ব্যঞ্জনা মনোমুগ্ধকর। শিল্পী শহিদ কবীরের কাজে বাস্তবানুগ অনুষঙ্গের প্রকাশে একটি ভিন্নধর্মী রস আছে। তাঁর কাজে চিত্রের জমিনে রঙের পরতে পরতে যে-স্তর তৈরি হয় তা দৃষ্টিসুখকর। শিল্পী শামসুদ্দোহার পরাবাস্তব শিল্পরীতির প্রতি বিশেষ ঝোঁক আছে। ‘ক্যাকটাস’ শীর্ষক চিত্রকর্মে শিল্পীর দক্ষতা ও নৈপুণ্যের দারুণ প্রকাশ ঘটেছে। বাংলাদেশের চারুশিল্পে প্রবীণ শিল্পীদের পাশাপাশি সম্প্রতি অনেক নবীন শিল্পীর কাজে সম্ভাবনার দেখা মেলে। এই প্রদর্শনীতে পঁচাশি জন শিল্পীর নানা মাত্রিক ও নানা মাধ্যমের শিল্পকর্ম পাঠ করে বাংলাদেশের চারুশিল্পের ধরন, বৈশিষ্ট্য ও মাধ্যমের সামগ্রিক অগ্রগতি এবং উৎকর্ষতা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পচর্চার সঙ্গে এদেশে স্থাপনাশিল্প, ভিডিও আর্ট, কনসেপচুয়াল আর্ট, ভিডিও ইনস্টলেশন ও পারফর্মিং আর্টসহ বিবিধ নিরীক্ষামূলক শিল্পমাধ্যমে কাজ শুরু হয়েছে। শিল্পের ভাষা এখন অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। প্রদর্শনীতে সদ্যপ্রয়াত শিল্পী মোহাম্মদ ফখরুল ইসলামের ‘ইমেজ’ শীর্ষক চিত্রকর্ম শিল্পের প্রতি তাঁর প্রবল তৃষ্ণার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত কাজের উল্লেখযোগ্য শিল্পীরা হলেন : কামরুল হাসান, এস এম সুলতান, সফিউদ্দীন আহমেদ, মোহাম্মদ কিবরিয়া, আমিনুল ইসলাম, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, শামসুল ইসলাম নিজামী, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, আবু তাহের, মনিরুল ইসলাম, মিজানুর রহিম, মাহমুদুল হক, আবদুস সাত্তার, কালিদাস কর্মকার, আবদুস শাকুর শাহ, বীরেন সোম, শাহাবুদ্দিন আহমেদ, নাসিম আহমেদ নাদভী, নাইমা হক, জামাল আহমেদ, মোহাম্মদ ইউনুস, শামসুদ্দোহা, নাসরীন বেগম, রোকেয়া সুলতানা, তাজুল ইসলাম, ইফতেখার উদ্দিন আহমেদ, কনক চাঁপা চাকমা, আনিসুজ্জামান, মোহাম্মদ ইকবাল, জাহিদ মুস্তাফা, রফি হক, খালিদ মাহমুদ মিঠু, শেখ আফজাল, রনজিৎ দাশ প্রমুখ।
সাজু আর্ট গ্যালারির এই বর্ণাঢ্য আয়োজনে চিত্রকর্মের সঙ্গে নানাবিধ নিরীক্ষাধর্মী কাজ, আধা বিমূর্ত ও বিমূর্ত চিত্র, কারুশিল্প, ট্যাপেস্ট্রি, ক্ষুদ্রাকৃতির ভাস্কর্য এবং ছাপচিত্রের সম্মিলন ঘটেছে। দর্শকের মনে একরম প্রদর্শনী বিবিধ অনুভূতির সঞ্চার করে।