সার্ভিসিং কোম্পানি

‘আহা, এ-জায়গাটা একদম ক্ষয়ে গেছে আপনার। শুকিয়ে চিমসে গেছে, ভেতরে রসটস নেই তেমন।’

খুবই মোলায়েম কণ্ঠে বলছিলেন ডাক্তার সাহেব, কিন্তু আয়েশা বেগমের চোখমুখ শুকিয়ে যেতে শুরু করল; আর যেটুকু রস অবশিষ্ট ছিল, তাও উবে গিয়ে ফ্যাকাসে দেখাতে লাগল। কিন্তু সেদিকে তাকানোর ফুরসত ছিল না ডাক্তার সাহেবের, নিবিষ্ট মনে তিনি পরীক্ষা করে যাচ্ছিলেন দেহের জোড়াগুলি, অপুষ্ট হাড়গুলির মাঝে সংযোগ সেতু হিসেবে অবস্থান করছিল যারা। মাঝে মাঝে অবশ্য ঠোকাঠুকিও চলছিল – বেশি নড়বড়ে জায়গাগুলিতে; বন্যার পানি বিদায় নেওয়ার পর যেরকম দেবে যায় শান বাঁধানো পথঘাট, তেমনি হয়ে গিয়েছিল জায়গাগুলি।

আয়েশা বেগমের পুরো শরীরেই ব্যথার টান ছিল, কিন্তু সব থেকে আক্রান্ত হয়েছিল কোমর আর পা দুটি, ফুলে-ফেঁপে মুড়ির টিনের মতো ঝনঝন করছিল। দাঁড়িয়ে নামাজ পড়া অনেক আগেই ছাড়তে হয়েছিল; কিন্তু ইদানীং ব্যথাটা এতটা প্রলয়ংকরী রূপ নিয়েছে যে না পারেন বসতে, না পারেন উঠতে। এমনকি নিশ্বাস নিতে গেলেও ব্যথা করে তার আজকাল। একটা কাশি পর্যন্ত কায়দামতো দিতে পারেন না ব্যথার চোটে, ভেঙেচুরে গিয়ে বিষবায়ুটা তার সর্বাঙ্গ কাঁপিয়ে দেয়, আর একটি ক্ষীণ অথচ বিকৃত আওয়াজ গড়িয়ে পড়ে তার স্বরযন্ত্রটা থেকে।

‘আহা! এ কী করেছেন! একদম তো পুড়িয়ে ফেলেছেন! ব্যথা বাড়লে নিজে নিজেই সেঁক দিতে শুরু করেন, তাই না? ডাক্তারের আর দরকার নাই।’ পায়ের গোড়ালি থেকে শুরু করে হাঁটু পেরিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু কোমরের কাছাকাছি যেতেই খেয়াল করলেন, একটা গনগনে আঁচ যেন তাকেও ঝাপটা মারছে। আর দম দেওয়ার যন্ত্রটাও কিঞ্চিত গোলমাল করছে। নিজের অজান্তেই ঘাড়টা তার ঘুরে গেল একটা অর্ধবৃত্ত তৈরি করতে করতে চলতি পথে; আর শেষমেশ তাই চোখে পড়ল, মনে মনে যার আন্দাজ আগেই হয়ে গিয়েছিল। পুরোই খিল মেরে আছে এসিটা। ইদানীং যে আলামত সে দেখিয়ে যাচ্ছিল, তাতে স্পষ্ট যে, আরো আগেই কপাট পড়েছে। কিন্তু যেটুকু ঠান্ডা হাওয়া সে ছেড়েছিল স্টার্ট নিয়েই, তা দিয়েই আরো কিছুক্ষণ চলে গিয়েছে ঘরের মানুষগুলোর। আর শুরুর দিকে পরিপূর্ণ খেয়াল থাকলেও ভোগ চালু হয়ে যাওয়ার পর বেমালুম ভুলে গিয়েছে তারা, যে ঘরে একটা যন্ত্র নিবেদিত ছিল তাদের সেবায়।

‘সাদেক, সাদেক …’

বেল টিপেছিলেন, এমনিতেই চলে আসার কথা, তাও তারস্বরে চেঁচাতে লাগলেন রশিদ সাহেব। ছোটখাট মানুষ। কুঁদে যাওয়া চোখজোড়া পশমের ভারে বিপর্যস্ত, মুখ ও কপালের জমিনটা দূর থেকে মসৃণ দেখালেও কাছে এলে ভেঙে পড়ে হুড়মুড় করে, মাথা ও থুতনির সীমানাপ্রাচীর বরাবর একটি শ্বেতরেখা প্রকট না হলেও ভালোমতোই দৃশ্যমান। আর এই মানুষটারই নাক-মুখ-চোখ-হাত-পায়ের যৌথ সঞ্চালনে যখন টগবগ করে ফুটতে থাকে পুরো চেম্বারটা, বাইরের সাইনবোর্ডে শক্ত শক্ত উচ্চারণের ডিগ্রিগুলো পড়ে আসা রোগীদের কষ্টই হয় মিলিয়ে নিতে।

‘সার্কিট পুইড়া গ্যাছে, স্যার। একটা মিনিট …।’ এসির নিচে একটা টুলের ওপরে দাঁড়িয়ে যখন সাদেক কথাগুলি বলতে থাকে, টুলের দুলুনিটা রসিদ সাহেবের হৃৎপিণ্ডটাকেও দোলাতে থাকে, আর হঠাৎই একটা অপ্রতিরোধ্য হতাশা নাটবল্টু লাগাতে শুরু করে তার অস্থিমজ্জায়।

‘ও মা, মাগো, মইরা গেলাম’ – আয়েশা বেগমের চিৎকারে অবশ্য সেখান থেকে জোর কদমেই বেরিয়ে আসেন ডাক্তার সাহেব। ব্যথাটা আবার ফিরে এসেছে মনে হচ্ছে। এরকমই হয়। ব্যথাগুলো মাঝে মাঝে নতুন বউয়ের মতো ঘোমটা দিয়ে থাকে, আর কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই নতুন করে গর্জে ওঠে।

‘একটু ধৈর্য ধরেন, মা! আসছেন যখন, সব ঠিক করে দেব ইনশা আল্লাহ। আচ্ছা, আপনার শরীরটার তেমন নড়াচড়া হয় না মনে হয়।’

‘মিছা কন নাই, বাবা, দিনের বেশিরভাগ সময় আমার বিছানাতেই যায়। আগে তো রান্নাঘরেই বেলা কাইটা যাইত, অহন ওইহানে ঢুকার লগে লগে পুরা শরীর ছ্যাত কইরা ওঠে।’ ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে যখন আয়েশা বেগম কথাগুলি বলেন, তার চোখ-মুখে হতাশারা দলা পাকিয়ে একটুখানি প্রশ্রয়ের আবেদন জানাতে থাকে যেন। আর আশ্চর্য হলো, ডাক্তার যেমন আয়েশা বেগমকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করেন, আয়েশা বেগমও তেমনি ডাক্তারকে ‘বাবা’ বলে সম্বোধন করতে থাকেন। কিন্তু সম্পর্কটা মা ও পুত্রের, নাকি, বাবা ও কন্যার – তা নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ থাকে না তাদের কারুরই, যেহেতু বলেকয়ে স্থাপিত হয় না সম্বন্ধটা।

 ‘আপনার থাইরয়েড বা হরমোনের সমস্যাও থাকতে পারে। এছাড়া মনে হচ্ছে, প্রস্রাবেও সমস্যা আছে। আসলে ব্যথার হাজারটা কারণ থাকতে পারে, আর সঠিক কারণটা জানতে কতগুলি টেস্ট জরুরি ভিত্তিতে করাতে হবে। এর মধ্যে দু-একটা টেস্টের রিপোর্ট সঙ্গে সঙ্গেই দেয়। চাইলে ওই টেস্টগুলির রিপোর্ট আমায় দেখিয়ে যেতে পারেন আজ।’

প্রেসক্রিপশানটা লেখার সময় এসিটা সক্রিয় হয়েছিল; কিন্তু মাত্রই কয়েক মিনিটের জন্য। তারপর যন্ত্রটার অবস্থার ক্রমেই অবনতি হতে লাগল এবং একটা সময় ঠান্ডার পরিবর্তে গরম হাওয়া বিলোতে শুরু করল সে; সঙ্গে জুড়ে ছিল বুড়ো জরাগ্রস্ত মানুষের মতো বিকট ও বিকৃত স্বরের শ্বাস-প্রশ্বাস। আয়েশা বেগম টেস্টের জন্য বের হয়ে যাওয়ার পর তাই আর ভিজিটর অ্যালাউ করলেন না ডাক্তার সাহেব। এই গরম ও বদ্ধ পরিবেশে রোগ নির্ণয় করা তার পক্ষে যেমন, রোগীর পক্ষেও বিপজ্জনক। ওয়েটিং রুমে জানিয়ে দেওয়া হলো, ডাক্তারকে জরুরি একটা অপারেশনে সাময়িক বিদায় নিতে হচ্ছে; রোগীরা যেন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেন। ওদিকে একটা এসি সার্ভিসিং কোম্পানিকে খবর দেওয়া হলো – এক ঘণ্টার মধ্যে মেশিনটাকে যেভাবেই হোক সারিয়ে তুলতে হবে।  

এসি সার্ভিসিং কোম্পানিগুলি শুধু সার্ভিসিংই করে, বিক্রিটিক্রির কোনো হাঙ্গামা নেই ওদের। সেজন্যই হয়তো ডাক পড়তেই সদ্য গোঁফের রেখা জেগে ওঠা একজন মেকানিক হাজির হয়ে গেল চেম্বারটিতে। আর দেখতে দেখতেই কাজ সেরে ফেলে একটা পাতলা দেখতে অথচ পুরো কাগজের বিল মেলে ধরল সে। কিছু লিক সারতে হয়েছে, একটা সার্কিট রিপেয়ার করতে হয়েছে, ওয়াটার গান স্প্রে করে কিছু ধুলো ঝাড়তে হয়েছে, আর সামান্য কিছু গ্যাস চার্জ করতে হয়েছে – তারপরও যে-বিল এসেছে, রশিদ সাহেব ভেবে দেখলেন, আরো দু-চারটা জুড়ে দিলেই একটা নতুন এসি কিনে ফেলা সম্ভব।

‘স্যার, কম্প্রেসারডা অহনো আছে। কিন্তু মোটরডা গেছেগা, নতুন কইরা কয়েল বানতে হইব। একে তো দুর্বল মেশিন, তার ওপর আবার ধুলার পাহাড়। … আপনের অফিসের দুইশো গজ দূরে যে নতুন ফ্লাইওভারটা হইতেছে সেইহান থাইকাই আহে …।’ ডাক্তার সাহেব আর বিল থেকে মাথা তুলছেন না দেখে জবাবের অপেক্ষা না করেই বলতে শুরু করে দিয়েছিল কিশোর সার্ভিসম্যান, তার পুরো অবয়বে একটা কাঁচুমাঁচু ভঙ্গি! 

‘আগেরবারও কিছু জিনিস খুলে নিয়ে গিয়েছিলে, আর একই ধরনের কথা বলেছিলে।’ খুব শীতল গলায় বললেও দাউদাউ করে গরম হাওয়া বেরুচ্ছিল। কী নির্বোধ তিনি, হাতে ধরা বিলটি নিয়েই মাথা ঘামাচ্ছিলেন, ওদিকে আরো সব বিলের রাস্তা তৈরি হচ্ছিল খেয়ালই করেননি।

একটা অজানা আশংকায় কিশোর সার্ভিসম্যানের হাড়গোড়সুদ্ধ মটমট করে উঠছিল। আর সেই আওয়াজ সার্ভিস কোম্পানির অফিসটিতে পৌঁছুতেই আকাশ ফুঁড়ে একটা ফোন উড়ে এলো আর রশিদ সাহেবের কানের ওপর বসে ত্রাহি ত্রাহি চিৎকার করতে লাগল।

‘স্যার, আপনে মালডা ভালো পান নাই। মোটরডা ঠিক হইয়া গ্যালে মোটামুটি চলবো। তয় পুরাপুরি ভালো হইব না। লোড একটু কম আছে মেইন লাইনে … যখন ইলেকট্রিসিটি আপ-ডাউন করে, একটু জিরাইতে দিবেন মেশিনগুলারে! মেশিন হইলে কি হইব, এইগুলিরও জান আছে। আর একটা কতা স্যার, সমস্যা হইলে নিজেরা হাত না দিয়া আমাগো ডাকবেন … সার্ভিসিংডা যদি নিয়মিত করাইতে পারেন … এই ধরেন, দুই মাস পরপর … আশা করি আরো অনেকদিন চালাইতে …।’ লোকটি নিজের পরিচয় দিয়েছিল কিশোর মেকানিকের ওস্তাদ হিসেবে। তাও তাকে কথাটা শেষ করতে দেন না রসিদ সাহেব, কপার পাইপের মধ্য দিয়ে আসা নিয়ন্ত্রিত বায়ুর মতো ভাজা ভাজা একটা স্বর বের হয় তার মধ্যে থেকে, ‘আর কষ্ট করার দরকার নেই। মেশিনই বদলে ফেলব আমি।’

‘তাইলে তো বেবাক ঝামেলাই মিইটা যায়, স্যার! তয় নতুন মেশিন ডিস্টার্ব দিলে একবার স্মরণ করার অনুরোধ জানাই।’ নতুন এসির গন্ধে যেন নতুন উদ্যম ভর করে ওস্তাদ মেকানিকের কণ্ঠে।

পুরো ঘর গ্যাসে পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু হাই না লো টেম্পারেচারের কারণে এই গ্যাসের জন্ম তা নিয়ে কোনো ধারণা ছিল না ঘরের লোকগুলির। দম ফুরিয়ে যেতে থাকলে আবার চিৎকার করতে শুরু করেন রশিদ সাহেব সাদেকের নাম ধরে। সার্ভিসিং করতে আসা ছেলেটির কারণে যে আবর্জনাগুলি তৈরি হয়েছে চেম্বারে, তা পরিষ্কার করে ফেলতে হবে এক্ষুনি; আর কয়েকটা টেবিল ফ্যানও জোগাড় করে আনতে হবে চেম্বার ও তার বাইরের ওয়েটিং রুমের জন্য।

দুই

‘জানি মা, গরমে কষ্ট হচ্ছে খুব। কিন্তু এই মেইনটেন্যান্সের লোকগুলি জঘন্য। গ্যাস যথেষ্ট থাকলেও বলবে গ্যাস চার্জ দরকার। পরে ভুয়া বিল বাগিয়ে ধরবে। আমার তো সন্দেহ হয়, ঠিক না করে উল্টো কিছু পার্টস এলোমেলো করে রেখে যায় তারা।’ আয়েশা বেগমের সদ্য জন্মানো রিপোর্টগুলি দেখতে দেখতে আপনমনেই বলতে থাকেন ডাক্তার সাহেব; যেন জিজ্ঞাসা করা না হলেও তিনি জানেন যে, বিষয়টি নিয়ে কৌতূহলী তার সামনে অপেক্ষমাণ রোগীটিকে।

‘ডাক্তার সাব, আমার হার্টে কি কোনো সমস্যা আছে? আপনে যেই টেস্টগুলা দিছেন, ল্যাবের কেউ কেউ কইল, ওইগুলা নাকি হার্টের পেশেন্টদের দেয়।’ কেমন একটা আতঙ্ক থলথল করতে থাকে আয়েশা বেগমের পুরো অবয়বে কথাটা বলার সময়।

‘যে দুটো টেস্টের ফল চলে এসেছে, তাতে তেমন কোনো সমস্যা পাওয়া যায়নি। তবে আমাদের কোমর ও কাঁধের সন্ধিস্থলটা যা দেখতে বলের মতো, ইচ্ছেমতো ঘোরানো যায়, সে-জায়গাটা কিছুটা চেপে গেছে। আর …’ আয়েশা বেগমকে এক্স-রে রিপোর্ট দেখাতে দেখাতে বলেন ডাক্তার সাহেব, ‘এই যে হাড়গুলো, এগুলোকে বলে তরুণাস্থি। এগুলো কিন্তু নরম হাড়, অথচ কেমন শক্ত দেখাচ্ছে।’

‘তাইলে?’ প্রায় মূর্ছা যেতে থাকেন আয়েশা বেগম।

‘আপাতত ফিজিওথেরাপি শুরু হচ্ছে, চলবে পুরো এক মাস। তবে ওই যে আগেই বলেছি, ব্যথার সঙ্গে হাজারটা কারণ জড়িত থাকতে পারে। এমনকি হার্টেরও ত্রুটি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আসলে আপনার বয়স হয়েছে। তার ওপর আমাদের দূষণ যে হারে বাড়ছে। বায়ু, পানি সবকিছুই তো দূষিত; জীবাণু ও ক্ষতিকর পদার্থে ভরা। বাকি টেস্টগুলোর রিপোর্ট হাতে এলেই সব ক্লিয়ার হবে।’

তিন

পরের কয়েকটা দিন আয়েশা বেগম খাওয়া-দাওয়া-নামাজ-রোজা-রান্নাবান্না – কোনোটাই আর ঠিকমতো করতে পারলেন না। তার মাথায় শুধু অনেকগুলি কারণ, আর অনেকগুলি রোগ, যা কুণ্ডলি পাকিয়ে ফণা তুলে যেতে লাগল চোখের সামনে। শেষমেশ যখন রিপোর্টগুলি নিয়ে পৌঁছলেন ডাক্তার সাহেবের চেম্বারে, দেখতে পেলেন নতুন একটা এসি শো শো করে হাওয়া দিচ্ছে, আর পুরো ঘরটিতে ঝর্ণাধারার মতো ঠান্ডা ছড়িয়ে পড়ছে। বাইরের পৃথিবীর দাবদাহের পর এই পরিবেশ আয়েশা বেগমের ভালো লাগছিল; তাছাড়া এতদিনের সব যন্ত্রণা-মন্ত্রণা উধাও হয়ে রায় শোনার প্রতীক্ষাটা তাকে একটা স্বস্তি জোগাচ্ছিল যেন।

রিপোর্টগুলির দিকে চোখ বুলাতেই অবশ্য মুখটা সামান্য কুঁচকে গেল ডাক্তার রশিদের, ‘আপনার রিপোর্ট মোটামুটি ভালো আছে মা, তবে চারটে হাড় ক্ষয় হয়ে চেপে গেছে প্রথমে, পরে ঢুকে গেছে কোমরের মাংসে। এ-কারণেই কোমরের অর্ধেকটা থেকে শুরু করে পাঁজরের হাড়ের দুদিকে ব্যথা অনুভূত হয় আপনার। যে ওষুধগুলি দিয়েছি তার সঙ্গে সঙ্গে থেরাপিটাও চালু রাখতে হবে আরো তিন মাস। আসলে মা, আপনার যে অসুখ, তা পুরো সারানোর কিছু নেই। কন্ট্রোল করে কমিয়ে রাখতে হবে। হাড় ভেঙে গেলে জোড়া লাগানো কষ্ট, তাই খেয়াল রাখতে হবে যেন ভাঙনের পর্যায়ে না যায়।’

প্রায় এক নিশ্বাসে কথাগুলি বলে যখন থামলেন ডাক্তার সাহেব, আয়েশা বেগম পুরোই স্তব্ধ হয়ে গেছেন ততক্ষণে। কী মনে করে এসির রিমোটটা হাতে নিলেন ডাক্তার সাহেব, আর যেই না কুলিং বাটনে আঙুলটা প্রেস করলেন, নতুন করে কপাট লাগিয়ে ফেলল মেশিনটা। আর আবার শুরু হলো ‘সাদেক, সাদেক …’ সেই অন্তর্ভেদী আর কর্কশ স্বরের চিৎকার।

চালানের রসিদটা দেখে দেখে সাদেক অবশ্য মুহূর্তের মধ্যেই নতুন এসির ভেন্ডরের সঙ্গে যোগাযোগ করল; কিন্তু যা জানতে পারল, তা রসিদ সাহেবের গরমই শুধু বাড়িয়ে দিলো। সব সার্ভিসিং টিম ঢাকার বাইরে। আগামী সপ্তাহ ছাড়া কোনো উপায় নেই। হঠাৎ পুরনো এসির সার্ভিসম্যানের কথা মনে পড়ে গেল রসিদ সাহেবের।

‘স্যার, আমার মেয়েজামাই কলেজের প্রফেসর। সে সব শুইনা কইল, আম্মা একজন হার্ট স্পেশালিস্ট দেখান। ব্যথার সঙ্গে ইদানীং বুকডাও ধড়ফড় করে।’

এসির বাতচিতে এতই মশগুল ছিলেন যে খেয়ালই করেননি, আয়েশা বেগম এখনো বসে আছেন এবং একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তারই দিকে। যেন খুব বড় একটা অপরাধ করেছেন, সেরকম একটি ভঙ্গি ফুটিয়ে তুলে আয়েশা বেগমের রিপোর্টে ফের চোখ বুলাতে শুরু করলেন রসিদ সাহেব, আর সে-অবস্থাতেই বলতে থাকেন, ‘না, না, কোনো দরকার নেই। ওই এক-আধটু ধড়ফড়ানি সবারই হয় এ-বয়সে। আপনাকে শুধু প্রেসক্রিপশনটা ফলো করতে হবে, ওই খাবারদাবারগুলি, ডায়েট চার্ট, আর যে ব্যায়ামগুলি শিখিয়ে দিচ্ছি, আর নিয়মিত চেকাপ, ফলোআপে থাকতে হবে।’

ডাক্তারের কথায় রোগী চাঙ্গা হলেন কি না বোঝা গেল না, কিন্তু ডাক্তার চাঙ্গা হয়ে উঠলেন যখন দেখলেন আয়েশা বেগম আর প্রশ্ন না করে শক্ত করে পার্সটা চেপে ধরলেন আর উঠে পড়লেন ভিজিটরের চেয়ার থেকে। ডাক্তার রসিদ অবশ্য সৌজন্যের কোনো কার্পণ্য না করে এগিয়ে দিতে গেলেন তার বয়োবৃদ্ধা রোগীটিকে দরজা পর্যন্ত। কিন্তু তার আগেই দরজার পর্দা ভেদ করে আসা একটি ছোকরার মুখ তাকে আবার বিপর্যস্ত করল।

 ‘গায়ে জার্মানি কোম্পানির লোগো থাকলেও মেশিনডা নকল, স্যার … মানে … ধরেন, আপনার ওই যে পুরান এসিডা … ওইরকম একটাই ঘইষা মাইজা দেওয়া হইছে। পার্টসগুলো তো দুই নাম্বার, আপনি যহন রিমোটে পাওয়ার বাড়াইছেন, তখন নিতে পারে নাই।’

‘অসুবিধা নাই, আমার ওয়ারেন্টি আছে।’

‘ইলেকটিক জিনিসের কোনো গ্যারান্টি হয় না, স্যার। ওয়ারেন্টি থাকলেও ওরা তো বদলায় দিব না, রিপেয়ার কইরা দিব খালি। তয় নতুন মেশিন যদি দেয়ও, আরো নিস্যা জিনিস পাইবেন, এইডার গ্যারান্টি দেওয়া যায়।’

কিশোর সার্ভিসম্যানের চোখ-মুখে কেমন একটি নির্বিকার ভঙ্গি, আগের দিনের মতো কাঁচুমাঁচু নয় এবার তার দাঁড়ানো। কিছুটা অপমান বোধ হয় রশিদ সাহেবের, কিন্তু গায়ে না মেখে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুই এত কথা জানিস কী করে?’

‘ওস্তাদের কাছ থেকে জানছি। আরো ভালো কইরা বুজতে চাইলে ওস্তাদরে ফোন দিতে পারেন।’

‘না, তার আর দরকার নাই। তুই-ই এখন থেকে ওস্তাদ। বল, এখন কী করতে হবে।’

‘কিচ্ছু না, স্যার … নিয়মিত সার্ভিসিং করাইবেন মেশিনগুলার। দুই মাসের কতা কই আমরা খরচোর কথা চিন্তা কইরা, তয় পরতেক মাসে করাইলে ভালো। আর একটা কতা স্যার, কিছু মনে কইরেন না … নতুন মেশিন আর লইয়েন না। অহন সব মেশিনেই ভেজাল। টাইনা-টুইনা যদ্দিন পারেন, চালাইয়া যান …।’

চার

এক মাস পরের কথা।

আয়েশা বেগম বসে আছেন ডাক্তার রসিদের চেম্বারে। শরীর আরো ফুলে গেছে। চোখ আরো বসে গেছে। মুখ আরো শুকিয়ে গেছে। যেন ঘুণে ধরা এক কংকাল।

‘থেরাপি আর ওষুধগুলি ঠিকমতো চলেছিল, মা?’

‘মিছা কতা কমু না, বাবা! আমি না-ই করছিলাম। তয় মাইয়া আর জামাই জোর কইরা আরেক ডাক্তোরের কাছে নিয়া গেছিল। তহন কয়দিন আপনার লেহা ঔষুধ বন্ধ রাখছিলাম … কিন্তু দুঃখের কথা কি কমু, শরীরডা আরো খারাপ হইয়া গেল।’

‘এই ওষুধগুলি একদমই দরকার ছিল না। এগুলির যে কাজ, তা তো অন্য ওষুধেই কভার করা আছে। … আরে আরে! এই ওষুধগুলি আবার কেন! এগুলিই পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছে …।’ অন্য ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনটাতে চোখ বুলাতে বুলাতে বলে ওঠেন রসিদ সাহেব, আয়েশা বেগমের অভিযোগগুলিকে কর্ণগুহায় তেমন একটা আশ্রয় না দিয়ে।

কিন্তু আয়েশা বেগম যেন হালে পানি পেলেন এবং ক্ষিপ্রগতিতে বলতে লাগলেন, ‘ইদানীং কোনো কাজে হাত দিলেই মনে হয়, মাথা ঘুইরা পইড়া যামু। মাঝেমদ্যে তামাম শরীর গরম হইয়া যায় … কিন্তু পুলাপাইন ফ্যান ছাইড়া দিলেই আবার শীত করে … সারা শরীর কাঁপতে থাকে থরথর কইরা।’

‘কি বলেন! এমন লক্ষণ থাকা তো ভালো কথা না। দাঁড়ান … লিখে দিচ্ছি … সমস্ত টেস্ট আর্জেন্ট ভিত্তিতে করিয়ে নিয়ে আসুন তো।’

‘আবার টেস্ট ক্যান? এই না কিছুদিন আগে …’

‘হ্যাঁ, আগের টেস্টগুলিই আবার করাতে হবে। সঙ্গে নতুন টেস্টও দেওয়া হয়েছে। আসলে আমাদের শরীরের ওপর কোনো জোর খাটে না, আজ কোনো ফাংশন ভালো থাকলেও আগামীকালই খারাপ হয়ে যেতে পারে।’ যখন কথাগুলি বলতে থাকেন রসিদ সাহেব, তখন একজন মুনি-ঋষির মতোই দেখায় তাকে, যেন পৃথিবীর সব নিয়ম আর সূত্র তার জানা।

‘এই টেস্টগুলা করাইলে কি রোগটা ধরন যাইব, ডাক্তোর? নাকি, মউত পর্যন্ত ব্যথা ভোগ কইরা যাইতে হইব আমার?’ একটা হিটওয়েব যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে হঠাৎ করে আর দাবানল ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র।

‘আসলে ইহকালটা ব্যথারই জায়গা, মা। এখানে তো কেউ নতুন করে জন্মাতে পারে না, শুধু মেরামতিটা করতে পারে! আমরা সেই মেরামতিটা করে দেব, বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা …, বুঝলেন, মা।’

আয়েশা বেগম অবাক হয়ে চেয়ে থাকেন রশিদ সাহেবের দিকে। ডাক্তারের কথাগুলি তার মাথায় ঢোকে কি না বোঝা যায় না; তবে হাতের পার্সটা আগের থেকেও শক্ত করে চেপে ধরে যখন বের হন সেই দরবার থেকে, তখন তার সারা শরীর আবার ঝাঁকুনি দিতে থাকে, বিকট সব শব্দ ও কটু সব গন্ধ তার মাথা গুলিয়ে দিতে থাকে। তার মনে হতে থাকে, তিনি এক মস্ত বড় সার্ভিসিং কারখানায় প্রবেশ করেছেন। কী অসহনীয় দাবদাহ সেখানে! আয়েশা বেগম পাগলের মতো কারখানাটির গরম বাতাসকে গিলতে থাকেন। তার আশা, তাহলে হয়তো ঠান্ডা একটা বাতাস বেরুবে, ঠিক এসিটার মতো।