সুরের বহমানতায় নারীদর্শন

এই যে আমরা বলি নারীর শাশ্বত রূপ, তা আসলে কী? প্রেমে, স্নেহে, দ্রোহে, শক্তিতে, জ্ঞানে, দাক্ষিণ্যে, দয়ায় ইত্যাদি প্রায় সকল রূপেই নারীকে খুঁজে পাই। ‘একই অঙ্গে অনেক রূপে’ রূপিণী নারী কখনো প্রেমময়ী, কল্যাণময়ী, বিদুষী, অন্নপূর্ণা, আবার সেই নারীই কিন্তু ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে শক্তিময়ী, তেজস্বিনী, স্রোতের বিপরীতে চলা কর্মযোগিনী। তাই ‘শাশ্বত নারী রূপ’-এর ভাবনা আমাকে বড় ধন্দে ফেলে দেয়। কাজী নজরুল ইসলামের নিজের সম্পর্কে বলা সর্বজনবিদিত পঙ্ক্তি ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণতূর্য’ – বৈপরীত্যে ব্যঞ্জনাময় এই পঙ্ক্তিটির মাঝে বরং আমি নারীর শাশ্বত রূপের বিপরীতমুখী অথচ বহুমাত্রিক প্রতিচিত্র খুঁজে পাই। আটপৌরে ছাপোষা জীবনে সর্বংসহা, মঙ্গলময়ী নারীই জীবনের প্রয়োজনে, ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ‘শক্তিরূপেণ সংস্থিতা’ হন অবলীলায় – শক্তিময়ী দশভুজা মা দুর্গা হয়ে পরাক্রমশালী অসুরকে বধ করেন। আকাশের রং-রূপ যেমন একেবারে পাল্টে যায় নানান ঋতুতে, দিনের নানান প্রহরে, জলের কাছে কিংবা পাহাড়ের কোলে – নারীও তেমনি জীবনের নানান বাঁকে, নানান সম্পর্কের সুতোর টানে কিংবা জটিল বাস্তবতার ঘাত-প্রতিঘাতে নানান রূপে আবির্ভূত হন বারবার!

‘শাশ^ত রূপে’র ঘেরাটোপের ধারণার বাইরে বেরিয়ে এই নারী চরিত্রের বহুমাত্রিকতার মাঝে আমি আসলে নানান রাগ-রাগিণীর রূপের দেখা পাই। নিজে একজন নারী হিসেবে আমি নানান রাগের রূপে, চলনে, গড়নের মাঝে তাই নিজেকেই যেন খুঁজে পাই, বুঝে নিই, নিজেকে নিজের কাছে মেলে ধরি। আমার অস্তিত্ব, আমার ভাবনা, আমার স্বপ্ন কিংবা আমার সুখ-শোক-যন্ত্রণা-অভিমান-বেদনা ঠিক যেন ভিন্ন ভিন্ন রাগের রূপ ধরে আমার কাছেই আমাকে প্রকাশমান করে, প্রস্ফুটিত করে। আমার নারীজন্ম, আমার আটপৌরে জীবন, আমার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আমার বলা-না বলা সকল ভাবনা বাক্সময় হয়ে ওঠে নানান রাগের সুরে আর স্বরবিন্যাসে। তাই প্রতিনিয়ত ভাবি – ‘স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম দেবা ন জানন্তি, কুত্রাপি মনুষ্যা’ যারা বলে গেছেন সেই সে প্রাচীনকালে, কিংবা যারা আজো এই ধারণা পোষণ করে চলেছেন, তাঁরা হয়তো কোনোকালেই রাগের সুরধ্বনিতে কিংবা স্বরবিন্যাসে নারীর অস্তিত্ব, অনুভূতি, প্রেম-অপ্রেম, মান-অভিমান, স্বপ্ন-অভিলাষকে খোঁজ করার কিংবা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করেননি বা করতে চাননি। 

নানান রাগের বিচিত্রতায়, অনন্যমাত্রিক সুরধ্বনিতে কিংবা স্বরবিন্যাসে যেমন মন রঞ্জিত হয় নানান রঙে, নানান ঢঙে; ঠিক তেমনি নারীর মন-মনন-মানসের বহুমাত্রিকতায় ভিন্ন রাগের ভিন্ন বিন্যাসের এক অদ্ভুত সমাপতন ঘটে। আর তাই আমি সুরে সুরে যেন অবিরত কেবল যে নিজের প্রতিচ্ছবিই দেখি তা নয়, বরং খুঁজে পাই, জেনে যাই‌ আর বুঝে নিই আমার চারপাশে থাকা বিচিত্র সব ভাষার, বিশ্বাসের, চরিত্রের নানা বয়সী নারীদের জীবনের সাতকাহন। সে-কারণেই আমার বোধ আর বুদ্ধিতে, আমার মন আর মননে প্রতিটি নারী যেন বিভিন্ন রাগের রঙে আঁকা একেকটি অনন্য সুরময় ক্যানভাসে ফুটে ওঠা সংগীতচিত্র। একই রাগ যেমন ভিন্ন গায়নে, ভিন্ন ভাবনায়, ভিন্ন প্রকাশভঙ্গিতে একেক শিল্পীর কণ্ঠে অনন্যতা পায়, তার নিজস্ব রূপ বজায় রেখে; ঠিক তেমনি একই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়েও ভিন্ন ভিন্ন নারীর ভাবনা, আবেগ, অনুভূতি, অভিব্যক্তি প্রকাশে সামষ্টিকতার একাত্মতার মধ্যেও দৃশ্যত বজায় থাকে স্বাতন্ত্র্য, প্রবলভাবে অনুভূত হয় বিশেষত্ব। তাই আমাদের প্রত্যেকের সুরের রঙের বর্ণচ্ছটা স্বতন্ত্র আর তাতে আঁকা জীবনের ছবিগুলোর ক্যানভাস, প্রকাশ, রঙের বিন্যাস – সব আলাদা; কিন্তু কোথাও গিয়ে সব যেন আবার এক অদ্ভুত একাত্মতায় সমাপতিত হয়।

‘পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর’ অতি সাধারণ নারী; কিন্তু ‘গভীর তার রহস্য, মধুর তার মায়াতন্ত্র, তার চাঞ্চল্য রক্তে তোলে তরঙ্গ, পৌঁছায় চিত্তের সেই মণিকোঠায়, যেখানে সোনার বীণায় একটি নিভৃত তার রয়েছে নীরবের ঝঙ্কারের অপেক্ষায়, যে ঝঙ্কারে বেজে ওঠে সর্বদেহমনে অনির্বচনীয় বাণী।’ সদ্য স্কুল-কলেজ পার করা কিশোর বয়সে এসব কাব্যময়তায় মোড়ানো বর্ণনায় মন ব্যাকুল হতো রহস্যময়ী ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা’ নারী হয়ে ওঠার প্রতীক্ষাতে। কিন্তু ধীরে ধীরে সেসব স্বপ্নালুতা পেরিয়ে মনে মনে নিজের নারীজন্মের অর্থ খুঁজে পেলাম নারীর শক্তিময়ী রূপে, তার চিত্তের গভীরতায়, তার আত্মপ্রত্যয়ে। দৃঢ়, ঋজু, আত্মপ্রত্যয়ী মায়ের মেয়ে হয়ে জন্মেছিলাম বলে নারীর ‘মাতৃরূপেণ সংস্থিতা’ আর তার ‘শক্তিরূপেণ সংস্থিতা’ রূপ আমার মননে ও মানসে একাকার হয়ে মিশে আছে।

নারীর এই শক্তিময়ী রূপে আমি আশ্রয় খুঁজি, প্রশ্রয় চাই, ভরসা পাই, ঠিক যেমন পাই রাগ মালকোষের গ্রহস্বর কোমল নিষাদে। এ-রাগের কোমল গান্ধার আর কোমল নিষাদ এক অদ্ভুত প্রতীতির আবেশ তৈরি করে হৃদয়ের গভীরে। নিজের ভেতর থাকা আত্মবিশ্বাস, গভীর প্রত্যয় নতুন করে শাণিত হয়, প্রেরণা জোগায়। বাদী স্বরমধ্যম স্থিরতা ও দৃঢ়তার সুরময় মূর্ত রূপ হয়ে আমার সকল অসহায় দিশেহারা মুহূর্তে বা নাজুক পরিস্থিতিতে আমাকে সামলে নেয়, আমার শক্তি হয়ে পাশে দাঁড়ায়। মালকোষ তাই আমার কাছে শক্তির আধার, গভীর রাতের অন্ধকারে আশার প্রদীপ – যার শিখা সতত দীপ্যমান, অনির্বাণ। নারীর আত্মপ্রত্যয়, তার শক্তি, তার নিজের প্রতি বিশ্বাস এ-রাগের সুরধ্বনি আর স্বরবিন্যাসে প্রতিফলিত হয়। মালকোষের গম্ভীর প্রকৃতিতে আমি বারবার নারীর দৃঢ়চেতা, ঋজু, প্রত্যয়ী সত্তা খুঁজে পাই। এর মীড়, গমক আর সুরের আন্দোলন আমাকে সবসময় মনে করিয়ে দেয় স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে নারীর জীবনের অবিরাম সংগ্রামের সংকল্প।

দেবী দুর্গার মহিষাসুর বধের পৌরাণিক আখ্যানে আমি যেমন মালকোষের সুর শুনতে পাই, ঠিক তেমন করেই আমাদের চেনা পৃথিবীর চারপাশের দেখা-অদেখা সকল দুর্গার স্বপ্নপূরণের গল্পে, নিজের পরিচয় প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে আমি মালকোষের দৃঢ়তর সুরের প্রতিফলন দেখতে পাই। মালকোষে সাত সুরের মধ্যে ঋষভ আর পঞ্চম অনুপস্থিত, তাই এ-রাগ জাতিতে সম্পূর্ণ নয়, বরং পঞ্চস্বরের ঔরব জাতি। এও ঠিক যেন শক্তিময়ী নারীর সব স্বপ্ন পূরণ না হওয়ার কঠিন বাস্তবতাকে মনে করিয়ে দেয়। এরা সময়ের সঙ্গে লড়াই করে বিকশিত হয় এবং নিজ আলোয় উদ্ভাসিত হয় গভীর রাতের গম্ভীর প্রকৃতির রাগ মালকোষ ‘সদা দীপ্ত রহে অক্ষয় জ্যোতি’ সঙ্গে নিয়ে, যেমন করে হৃদয়ের গভীরে কঠিন সময়েও জানান দিয়ে যায় ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’।

এই যে নারীর শক্তিময়ী রূপ, তার নিরন্তর অন্ধকার ভেদ করে আলো হাতে জ্বলে ওঠার অবিরাম প্রয়াস – এর মাঝে আমি এক গভীর মঙ্গলময়ী স্বপ্নদর্শী রূপ দেখতে পাই। নারীর এই রূপে কেবল সকল বাধা পেরিয়ে নিজে এগিয়ে যাওয়ার ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থপর ইচ্ছের প্রকাশ হয় না, বরং সকলের জন্য নিজেকে পরিস্ফুট করার অদম্য প্রয়াস থাকে। যে-নারী নিজের পরিচয়ের জন্য লড়াই করেন, তিনিই অন্যদের পরিচয় গড়তে সাহায্য করেন।
যে-নারী শক্তির প্রতীক, তিনিই তার চারপাশের সকলের ভরসার আশ্রয় হয়ে ওঠেন। সেখানেই সহজাতভাবে নারীর দুর্মর-দুর্বার শক্তিময়ী রূপের সঙ্গে তার মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী মমতাময়ী মাতৃরূপের সমাপতন ঘটে বলে আমার বিশ্বাস। নারীর শক্তিময়ী রূপ এবং মাতৃরূপ একসূত্রে গাঁথা বলেই মহিষাসুরমর্দিনী শক্তিময়ী দুর্গা দিনশেষে ভক্তের ‘মা’ দুর্গা হয়েই অধিষ্ঠিতা হন। নারীর শক্তিময়তাই তাকে মাতৃরূপিণী কল্যাণময়ী হয়ে উঠতে সাহায্য করে। তার অদম্য শক্তিরূপ তার মমতাময়ী মাতৃরূপের ভিত্তি রচনা করে আর তার অনন্য স্নেহময়ী মাতৃরূপ তার সেই শক্তিরূপকে গভীর ভালোবাসা ও মমতার বন্ধনে, মঙ্গলাকাক্সক্ষার ছোঁয়ায় চিরকল্যাণকর করে তোলে। নারীর শক্তিতে তাই ধ্বংসের সুর নেই, আছে শুভ ও সুন্দরের পথে পরম মমতা ও নির্ভরতার চাদর বিছিয়ে সকলকে আগলে এগিয়ে যাওয়ার এক সুরেলা গল্প। সেখানে উত্থান আছে, পতন আছে, বাধা আছে; কিন্তু সর্বকালে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে, সকল পরিস্থিতিতেই নারীর শক্তিময়ী রূপ তার কল্যাণময়ী রূপকে জিতিয়ে দেয় অবধারিতভাবে। তাই নারীর মঙ্গলময়ী রূপে তার প্রত্যয়ী, দৃঢ়চেতা, শক্তিময়ী রূপ পূর্ণতা পায় বারংবার।

নারীর এই কল্যাণী রূপে আমি শ্যামকল্যাণের স্বচ্ছ সৌন্দর্যের, শান্ত-গভীর জীবনবোধের, নিঃস্বার্থ মঙ্গলাকাক্সক্ষার সুর খুঁজে পাই। মালকোষের সুরের আর স্বরের গাম্ভীর্য যেখানে দৃঢ়চেতা নারীর শক্তিময়তার রূপক, সেখানে শ্যামকল্যাণ সেই শক্তিময়ী রূপে পরম আশ্রয়ের সন্ধান দেয়, দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের মর্মমূলে সন্নিবেশিত করে প্রশান্তির সুরভি। মালকোষের গভীরতা যেখানে আত্মবিশ্বাসের উৎস, শ্যামকল্যাণের প্রশান্তি সেখানে আত্মবিশ্বাসের আন্তরিক আশ্রয়। মালকোষ যদি হয় গভীর রাতের অন্ধকারে দীপ্যমান এক আলোকস্তম্ভ, শ্যামকল্যাণ সেক্ষেত্রে সন্ধ্যার কমনীয় মনোহর আলো, যা দিনমান কর্মব্যস্ততা শেষে ক্লান্ত হৃদয়কে পরম মমতাময় স্পর্শে নতুন করে উজ্জীবিত করে। আমার কাছে তাই শ্যামকল্যাণের রূপ চিরচেনা মাতৃসত্তার এক আড়ম্বরহীন অথচ ললিত উজ্জ্বল প্রতিরূপ, যার মোহময় সুর ও স্বরবিন্যাসে আমি বরাবর অনন্ত আশ্রয় খুঁজে পাই।

এই রাগের ‘তীব্র মা-পা-ধা-পা-তীব্র মা-পা-গা-শুদ্ধ মা-রে-সা’ স্বরবিন্যাস বা পকড় অস্থির সময়ে বারবার হৃদয়ে পরম করুণাময়ের শুভাশিস আর জন্মদাত্রী মায়ের নিরন্তর কল্যাণ-কামনার উপস্থিতি জানান দিয়ে আমার হতাশ মনকে আশ্বস্ত করে। আবার এই রাগের চলনে দুই মধ্যম কিংবা আরোহ অবরোহণে শুদ্ধ মধ্যমকে পরম মমতায় পা-গা-মা-রে-সা স্বরবিন্যাসে ঘিরে রাখার কোমল প্রাণস্পর্শী চলন আমাকে বারবার অপরের কল্যাণ কামনা বা আমার চারপাশের সকলের মঙ্গলচিন্তায় উদ্বুদ্ধ করে, উজ্জীবিত করে। এর তীব্র মধ্যম আর শুদ্ধ মধ্যমের সহাবস্থানে নারী হিসেবে আমি আমার মধ্যকার শক্তিময়ী আর কল্যাণময়ী রূপের মেলবন্ধনকে যাপন যেমন করি, উদ্যাপনও করি। শ্যামকল্যাণের সুরধ্বনি আর স্বরবিন্যাসে দুই মধ্যমের মনোগ্রাহী ব্যবহারে আমি মাতৃরূপের এক পরম দ্যোতনা খুঁজে পাই। আবার অবরোহণে দীর্ঘ ধৈবত আমাকে মনে করিয়ে দেয় সেই নিঃশব্দ দৃঢ়তাকে, যা আসলে নারীর মাতৃরূপে শক্তির পরম আকরের সঙ্গে তুলনীয়। এ-রাগের পঞ্চম স্বরের স্থিরতা অস্থির সময়ে, বন্ধুর সময়ে আমার মনে নারী হিসেবে নিজের কল্যাণচিন্তার সামর্থ্যকে, মঙ্গলাকাঙ্ক্ষার প্রবল শক্তিকে নতুন করে স্মরণ করিয়ে জীবনবোধ আর জীবনীশক্তিকে নতুন দিশা দিয়েছে বহুবার। আর তাই ‘রস ঘন শ্যামকল্যাণ’ আমার কাছে ‘শ্রান্ত মনের ভার’ হরা, ‘নিবিড় সমাধির গভীর আনন্দ’ময়ী, ‘অন্তরে বাহিরে সেই অমৃত’দায়িনী নারীর চিরায়ত রূপ। 

নারীচরিত্রের একদিকে দৃঢ়তা-ঋজুতা, অন্যদিকে স্নিগ্ধতা-মমতা। একাধারে সকল বিঘ্ন, বাধা, প্রতিরোধ কাটিয়ে অবিরাম সংগ্রামী, নিজের আর চারপাশের সকলের শক্তির আধার, আবার মমতার অনির্বচনীয় ফল্গুধারা, ভালোবাসা আর ভরসার পরম আশ্রয় এই যে নারী, তার জীবনটা আসলে একটা গল্প। জীবনের প্রতিটি বাঁকে নারী আসলে নিজেকেই খুঁজে চলে, নিজের সঙ্গে যুঝে চলে। নারীর এই অবিরাম আত্মানুসন্ধানই তার একান্ত গল্প। এর বাহ্যিক ঘটনাপ্রবাহ, কলাকুশলী, প্রেক্ষাপট হয়তো অন্য সকলের নজরে পড়ে, সে নিয়ে নানা মুনির নানা মত থাকে, উচ্চকণ্ঠে বাকবিতণ্ডাও চলে পাত্রভেদে ও পরিপ্রেক্ষিতে; কিন্তু নারীর নিজস্ব গল্পের বিশদটুকু কেবল সেই নারীই জানে। এই যে প্রতিমুহূর্তে নারীর আত্মানুসন্ধানের চির চলমান প্রয়াস – এ-প্রক্রিয়ার গল্পখানি আমার মানসে মধুবন্তী রাগে বাঁধা।

সন্ধিপ্রকাশের রাগ বিধায় মধুবন্তীর সুরধ্বনি ও স্বরবিন্যাসে বেলাশেষের সুর এবং রাতের সূচনার সুর একীভূত হয়েছে। প্রত্যেক নারীর আত্মানুসন্ধানের গল্প তথা তার সমগ্র জীবনই যেন এক সন্ধিক্ষণের পটভূমিকাতে গাঁথা হয়। আজন্ম সন্ধিক্ষণের সে-গল্পে আছে নারীর বিভিন্ন সামাজিক পরিচয় ও বন্ধন ছাপিয়ে আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার ঝঞ্ঝাময় কাহিনি। এ এক অনন্য যাত্রা, ঠিক যেন রাগ মধুবন্তীর সুর ও স্বরের প্রকৃতি, চলন আর গতির মতোই একদিকে আকাঙ্ক্ষা, ত্যাগ ও সংবেদনশীলতার প্রতিচিত্র, আবার অন্যদিকে নিরন্তর সংগ্রাম ও দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের প্রতিফলন। মধুবন্তীর কোমল গান্ধারের মতো নারী কখনো কোমল, আবেগপ্রবণ; আবার সেই নারীই মধুবন্তীর তীব্র মধ্যমের মতোই কঠিন সত্যকে জয় করার লক্ষ্যে স্থির।

মধুবন্তী রাগ বড়ই চিত্তাকর্ষক। ঠিক যেন নারীর চিরায়ত সৌন্দর্য। এই রাগের পরতে পরতে আছে ভালোবাসার অমূল্য রং। নারীজীবনের গল্পও তেমনি নানা রঙে আঁকা। মধুবন্তী তার সুরে শৃঙ্গার রসের বারতা বহন করে, তা কখনো পার্থিব, কখনো অপার্থিব, আবার কখনো উভয়ে মিলেমিশে একাকার। নারীর প্রেমের গভীরতায়, শৃঙ্গারের মোহনীয়তায় কিংবা নিজেকে মেলে ধরবার সুললিত প্রয়াসেও তেমনি লোক-লোকান্তর ছাপিয়ে যায়,
পার্থিব-অপার্থিবের গণ্ডি-বিভেদ ঘুচে যায়।

মধুবন্তীর সুরে, তার চলনে এক গভীর অনুরাগের ছোঁয়া আছে, কোমল গান্ধার আর তীব্র মধ্যমের সহাবস্থানে সেই অনুরাগ গভীরতর অর্থবহ হয়। দেশ, কাল, প্রজন্মভেদে নারীর নিজস্ব গল্পের মূলে যে সতত অবিরাম আত্মানুসন্ধান, তার মর্মমূলেও রয়েছে তেমনি গভীর অনুরাগের ছোঁয়া – নিজের মতো করে সকলকে নিয়ে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার প্রগাঢ় আকুতি, আছে স্বপ্ন দেখার আর সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার, সফল করে তোলার দুর্বার বাসনা। এই রাগের বাদীস্বর পঞ্চম যদি হয় নারীর আটপৌরে জীবনের উদগ্র অদম্য আবেগের প্রতিরূপ, তাহলে বাদীস্বর ষড়জ বারবার নারীকে ফিরিয়ে আনে যথার্থ সত্যের নিরিখে বাস্তবতার দ্বারপ্রান্তে।  

জীবনচলার পথে সকল টানাপড়েন সামাল দিয়ে, সমাজ ও পরিজনের চাহিদা চুকিয়ে বিভিন্ন সন্ধিক্ষণে নারী নিজের অস্তিত্বকে প্রশ্ন করে বারবার। সকল বাধা অগ্রাহ্য করে আত্মমগ্ন হতে চায়, নিজেকে চিনতে চায়, হিসাব মেলাতে চায়। এই আন্তরিক চাওয়াটুকুর সুরে আমি রাগ মধুবন্তীর চলন আর স্বরবিন্যাস দেখতে পাই। এতে আছে শুদ্ধ স্বর, আছে কোমল আর তীব্র স্বরের পাশাপাশি সহাবস্থান। তাই আমার কাছে নারীর জীবনের গল্প রচিত হয় মধুবন্তী রাগে, যেখানে শুদ্ধতা আছে, আছে জটিলতা, তীব্র দুর্জয় আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্নিল আশার কোমলতা। মজার ব্যাপার হলো, মধুবন্তীর প্রকাশভঙ্গি একেক শিল্পীর গায়নে, বাদনে একেক রূপ পেয়েছে। পণ্ডিত যশরাজ, ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, পণ্ডিত ভীমসেন যোশি, ওস্তাদ রাশিদ খান প্রত্যেকে নিজের মতো করে সন্ধিপ্রকাশ এই রাগে দিনের আলোর শেষভাগের সোনাঝরা কমনীয়তা কিংবা সন্ধে নামার আগে গোধূলির স্বপ্নময় আলোর প্রশান্তি খুঁজে পেয়েছেন। কারো মধুবন্তী তাই শেষ হওয়ার বেদনায় বিধুর, কেউবা রাত্রি আগমনের আনন্দ আলোয় প্রাঞ্জল; কিন্তু দুয়েতেই আছে অতল গভীরতা, যাতে ডুব দেওয়ার ব্যঞ্জনায় কোনো ব্যত্যয় নেই। ঠিক যেমনি করে আমাদের প্রতিটি নারীর গল্পের স্থান, কাল, পাত্র, ঘটনা পরিক্রমা, এর রচনাশৈলী, প্রকাশভঙ্গি, কাহিনির বুনট স্বতন্ত্র, সবিশেষ; কিন্তু শেষ অবধি এর অন্তর্নিহিত যে আত্মানুসন্ধান, এর আবেগ-আকাঙ্ক্ষা – স্বপ্নগুলির শেকড় গাঁথা একই মননভূমিতে আর মানসপটে, যেখানে ‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো, সেখানে যোগ তোমার সাথে আমারো।’

শুরু করেছিলাম নারীর শাশ্বত রূপ কী হতে পারে – এ-প্রশ্ন নিয়ে। এর উত্তর আমার কাছে একেবারেই হয়তো অন্যরকম। আমার ভাবনায় নারী আসলে এক বহতা নদীর মতো। এই নদী সকলকে জল জোগায়, ফসলের জীবনীশক্তি হয়ে কিষানের মুখে হাসি ফোটায়, বুকে করে নিয়ে যায় সকল জঞ্জাল। ঠিক তেমনি নারীর জীবন এক সতত প্রবহমান স্রোত, যেখানে সে বয়ে চলে কালের নিয়মে, চারপাশের সবকিছুর সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়ে। কিন্তু সেই নারীও কখনো আবার স্রোতস্বিনী বানভাসি নদীর মতো প্রতিবাদে দু-কূল ভেঙে সমস্ত প্রতিকূলতাকে উল্টে দিতে চায়। নারী চিনে নেয়, জিতে নেয়, উদ্যাপন করে অনিবার্য পরিবর্তনশীলতাকে। আর তাই যখন তার পথচলায় গতিপথ রুদ্ধ হয়, তখন বন্যার মতো তার আবেগ বিস্ফারিত হয়। নারীও তখন নদীর মতোই ভাঙে কেবল নতুন করে গড়ার জন্য। নারীর এই শক্তিময়তার গভীরতা এমন করেই পূর্ণতা পায়।

নারীর চিরায়ত রূপে আমি কখনো মালকোষের গম্ভীর গভীর বোধ, কখনো শ্যামকল্যাণের প্রশান্ত করুণাময় ধারা, আবার কখনো মধুবন্তীর মধুময় শৃঙ্গাররস খুঁজে পাই। এই রাগগুলোর মতোই নারীর জীবন বহুরূপময়তায় ঋদ্ধ, নানা ব্যঞ্জনায় পরিপূর্ণ। তাই নারী যখন আনন্দে উদ্বেল হয়, তার হাসিতে আমি রাগ হংসধ্বনির প্রাঞ্জল সুর শুনতে পাই। আবার উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত নারীর চাহনির আকুলতায় আমি মারবা রাগের গাঁথুনি খুঁজে পাই। প্রেমের মিলনে, ভালোবাসার উদ্যাপনে নারীর উজ্জ্বল উপস্থিতি কখনো তিলক কামোদ আবার কখনো বা বেহাগের সুরে থাকে বাঁধা। বাগেশ্রীর চলনে বা ললিতের বিন্যাসে একাকার হয়ে যায় বিরহী নারীর কান্না আর প্রতীক্ষার যন্ত্রণা। আমার কাছে নারীর বহুরূপময়তা ব্যক্ত হয় সুরে আর স্বরে, যা নদীর মতো চির বহমান, সতত পরিবর্তনশীল। আমার কাছে আমি ও প্রতিটি নারী তার নিজের রাগের রঙে রাঙানো, একান্ত নিজস্ব সুরধ্বনি আর অনন্য স্বরবিন্যাসে বোনা একেকখানা অনুপম সংগীতচিত্র। আমাদের এই সুরময় জীবন কোনো ফ্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ নয়, বরং ‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি’, যেখানে চির চলমান, সতত বহমান জীবনে ‘হঠাৎ আলোর ঝল্‌কানি লেগে ঝলমল করে চিত্ত’।