মায়ের সঙ্গে হাঁটছি। মায়ের এক হাতে শক্ত করে আমার হাতটা ধরা। এভাবে হাঁটতে ভালোই লাগে, ঘুরে বেড়াতে। কত নতুন পথ। কত নতুন ঠিকানায় ঘোরাফেরা। অথচ হারিয়ে যাওয়ার ভয় নেই। আবার যদি হারাইও – মা তো সঙ্গেই আছে। মাকে নিয়ে হারিয়ে যেতে বেশ লাগে। কত অজানা গন্তব্য।
এ-সময় মনে হয়, কোথায় আছি, কোথায় যেতে হবে – এসবের যেন কোনো ভাবনাই নেই আর। যেন নতুন পথ খুঁজতে খুঁজতে ঠিক ঠিকানা মিলে যাবে কোথাও। পাওয়া যাবে কাঙ্ক্ষিত সেই পথ। কিংবা সেই কাঙ্ক্ষিত পথ না মিললেও যেন কোনো ভাবনা নেই আর। ভাবনা নেই এখন সকাল-দুপুরে কোথায় যাবো, বিকেলে কোথায় থাকবো – সেসব ভাবার। মনে হয়, এভাবে বেঁচে থাকায় একটা অদ্ভুত আনন্দ আছে! আছে এভাবে দিনগুলিকে দেখার, এভাবে রাত। যখনই আমি এসব নিয়ে ভাবি, কতটা যে সময় পেরিয়ে যায়। ভাবতে ভাবতে হয়তো সারাটা রাত, ভাবতে ভাবতে ভোর। একদম ভোরের দিকে এসে একটু ঘুমিয়ে পড়ি। আবার মায়ের ডাকে জেগে উঠি। হাঁটতে শুরু করি আবার।
এখন যেমন প্রথমে এ রেলস্টেশনটায় এসে নেমেছি। নেমে প্রথমে বড় রাস্তা, বাজার, তারপর ক্রমশ ভিড় পেরিয়ে আরো এগিয়ে এসে এই গলিমুখ। ভিড় কমতে কমতে এখন এদিকটায় অনেকটাই ফাঁকা। আর এখানে এসে আর একটা গলিপথ পেরিয়ে, হাঁটতে হাঁটতে নতুন ঠিকানায়। নতুন ঘর। নতুন এক মানুষের খোঁজে।
শুরুতে প্রথম প্রথম বায়না ধরতাম ভীষণ।
ভ্যান-রিকশাস্ট্যান্ডের সামনে দাঁড়িয়ে যেতাম শক্ত হয়ে। হয়তো জেদ করতাম কিছুতেই আর হাঁটবো না বলে। মা অবশ্য আমাকে থমকে যেতে দিত না কিছুতেই। বলত, ‘এই তো আর একটু।’ সামনে এগিয়ে চলা গাড়িগুলোকে দেখিয়ে ঠিক ভুলিয়ে নিয়ে যেত আমার হাত ধরে। আমিও কি অবলীলায় মায়ের কথা শুনে সেসব ভুলে নতুন রাস্তা ধরে চলতে থাকা গাড়িগুলোকে দেখতে দেখতে এগিয়ে যেতাম আরো কতটা পথ।
এভাবেই হাঁটতে হাঁটতে যখন ঘরটার সামনে এসে দাঁড়াতাম। যে-ঘরটায় থাকার কথা লোকটার, অথচ এতদূর এসে দেখি সে হয়তো বাড়িতে নেই। আমি আর মা বসে আছি বেশ কিছুক্ষণ। হয়তো সেই সকালে এসেছি, এখন দুপুর। দুপুর পেরিয়ে বিকেল হতে চলল। অথচ কিছুতেই লোকটার দেখা নেই। মা হয়তো বারবার বলছে, ঠিক এ-সময়েই আসতে বলেছিল ও। অথচ লোকটা সন্ধের মুখে ফিরে এসে কিছুতেই সেকথা মানতে চাইছে না আর। মা যতই বলছে, সে ততই বলছে অন্য কথা। একসময় দেখছি মা ট্রেনের টিকিট দেখিয়ে বলছে, ‘এই যে আজ সতেরো তারিখ, আজকেই আসতে বলেছিলে।’ লোকটা সে-টিকিট হাতে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলতে ফেলতে বলে যাচ্ছে, ‘আজ সতেরো নয়, ষোলো, এটা গতকালের টিকিট।’ এবার দেখছি, মা কাঁদছে। মায়ের দু-চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। দেখছি, মায়ের পাশে কেউ নেই। শুধু আমি একা অসহায় বসে আছি। মাকে কাঁদতে দেখে আমারও ভীষণ কান্না পাচ্ছে। চোখ ভরে আসছে জলে। আবার সেই জল মুছে আমিও লোকটাকে ভালো করে দেখছি।
সে-রাতে মায়ের সঙ্গে যখন ফিরছি, মাকে দেখছি চোখ মুছে কেমন সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ততক্ষণে কেমন ভেতরে ভেতরে আরো শক্ত হচ্ছে মা। হয়তো বলছে, এর শেষ দেখে ছাড়বে। এভাবে পার পেয়ে যাওয়া মানুষটাকে কিছুতেই ছেড়ে দেবে না। আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি, মা বারবার বলতে চাইছে, আজ ষোলো নয়, সতেরো -। কিন্তু কিছুতেই সে-কথা প্রমাণ করা যাচ্ছে না। আমি মায়ের পাশে বসা। বুঝতে পারছি, মা ভেতর থেকে বলছে, ক্রমশ বলেই যাচ্ছে সে-কথা। আর প্রস্তুত হচ্ছে কিছু একটা করার জন্য।
আমি মায়ের কথাগুলো ভাবতে ভাবতে দেখতে পাচ্ছি, লোকটা আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে কেমন দাঁত বের করে হাসিমুখে। আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে কাঠি লজেন্স। আমি কিন্তু তখন রাগে একঝটকায় সেসব ছুড়ে ফেলে দিচ্ছি একদিকে। রেগে গেলে আমার মাথায় রক্ত ওঠে। আমি তখন আর শান্ত হয়ে থাকতে পারি না। আমি তখন যেন লোকটাকে কিছুতেই আর ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নই। কিছুতেই লোকটাকে এমনভাবে হাসতে দেখতে পারছি না। কিছুতেই লোকটাকে মেনে নিতে পারছি না। আমি তখন অন্য আমি।
কিন্তু লোকটা হঠাৎ করে কোথায় গেল? এতক্ষণ তো আমার সামনেই দাঁড়িয়েছিল কাঠি লজেন্স হাতে নিয়ে। মা আমার হাতটাকে ঝাঁকিয়ে বলল, ‘কিরে স্বপ্ন দেখছিলি নাকি?’ আমি তখন অন্য আমি। সত্যি সত্যি রাগ কোথায় উধাও হয়ে গেছে ততক্ষণে। দেখছি, একটা নতুন স্টেশনে এসে দাঁড়িয়েছে ট্রেন। নতুন গন্তব্য। এবার আমাদের নামতে হবে।
মায়ের সঙ্গে নেমে এসেছি নতুন কোথাও। স্টেশন পেরিয়ে নতুন পথ ধরে হাঁটতে শুরু করেছি আবার। এদিকটায় চারপাশটা বেশ খোলামেলা। কয়েকটা মাঠ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। বাচ্চারা খেলছে। একটু এগিয়ে একপাশে বড় ঝিল। দু-পাড় দিয়ে সারি সারি গাছ। হাওয়া ভেসে আসছে। সেই হাওয়ায় ভেসে আসছে এক অদ্ভুত গন্ধ। গন্ধটা কেমন চেনা লাগছে না? অনেকটা মামাবাড়ির রাস্তার মতো। সেদিকেও তো এমন অনেক মাঠ। খোলামেলা জমি। দূরে রেললাইনের ছুটে চলা। কালো ধোঁয়ামাখা ট্রেন। কিছুদূর যাওয়ার পর অদৃশ্য কেমন -।
মা হাঁটছে আমার হাত ধরে। শুকনো মাটির রাস্তা। দুপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কয়েকটা ঘর। পরিচিত মুখগুলো উঁকিঝুঁকি দিচ্ছি। ক্রমশ কাছে আসছে তারা। মাকে দেখতে পেয়ে এতক্ষণে কথা বলছে কেউ কেউ। জানতে চাইছে,
‘কেমন আছো গো জ্যোৎস্না? ছেলে তো অনেক বড় হয়ে গেল দেখছি।’ ওরা খোঁজ নিচ্ছে মায়ের। খোঁজ নিচ্ছে আমার। কেউ হয়তো ঘরে ডেকে বসাতে চাইছে। এতদিন পর মাকে পেয়ে কাজ ফেলে কথা বলতে চাইছে দু-দণ্ড। কত দিনের জমা কথা। কেউ কেউ হয়তো জিজ্ঞেস করছে, ‘এখন কোথায় জানি থাকো বললে? কী বললে, কলকাতা?’ তারপর হয়তো সেই বাড়ির খোঁজখবর নেওয়া, আমার স্কুল, আরো কত কথা। মা হয়তো এতক্ষণে ভুলেই গেছে মামাবাড়ি যাওয়ার কথা। ভুলেই গেছে দিদিমা মায়ের পথ চেয়ে সেই সকাল থেকে হয়তো দাঁড়িয়েই আছে জানালা ধরে। নিজেও হয়তো খায়নি কিছু। মা গেলে বারান্দায় বসে একসঙ্গে খেতে বসবে।
এখন হয়তো দুপুর। দূরে কোকিল ডাকছে। বসন্ত এখনো পুরোপুরি যায়নি এদিকে। মা বসেই আছে। কথা বলছে এখনো। এসব কথা যেন ফুরোনোর নয়। অথচ আমি ছটফট করছি মামাবাড়ি যাবো বলে। মামাবাড়ি গিয়ে খেয়ে উঠে খেলতে বেরুবো বলে। আমার কয়েকটা বন্ধু, হয়তো এতক্ষণে আমাকে না পেয়ে ঘুরে গেছে কয়েকবার। এ-বাড়ির লোকজন হয়তো বুঝতে পেরে মাকে বলছে খেয়ে যেতে। মায়ের হাত ধরে বসিয়েছে মাটির দাওয়ায়। মাও হয়তো আপত্তি করছে না এখন। হয়তো এতদিন পর এসেছে বলেই।
মাও হয়তো ভাবছে, দিদিমা রাগ করবে নিশ্চয়ই। খেয়ে এসেছে বলে এতক্ষণ অপেক্ষার পর অভিমান করবে মায়ের ওপর। মা হয়তো বোঝাতে চাইবে, ‘এতদিন পরে কাছে পেয়ে কিছুতেই না খাইয়ে ছাড়লো না ওরা।’ দিদিমা হয়তো তারপরও অভিমানে চুপ হয়ে থাকবে কিছুক্ষণ। এমনকি মা খেয়ে এসেছে জেনেও নিজে কিছুতেই কিছু খাবে না আর। অভিমান হলে দিদিমা খাওয়া বন্ধ করে দেবে জানি। এ-অনেক পুরনো অভ্যাস।
আমি তখন বুল্টিদের উঠোনে খেলতে বসে যাবো। আরো কত বন্ধু তখন আমার। আমরা গাছে চড়বো। লুকোচুরি খেলবো। আবার হয়তো বুল্টির মায়ের বকা খেয়ে ওদের বারান্দায় সবাই মিলে চুপচাপ শুয়ে থাকবো সারাটা দুপুর। মা হয়তো খুঁজতে আসবে তখন। এসে দেখবে আমি কেমন ঘুমিয়ে আছি ওদের মতো করে। মা আশ্চর্য হবে একটু। হয়তো ভাববে, আমি তো কখনো দুপুরে ঘুমোই না। কখনো মাকে না বলে কোথাও বেশিক্ষণ থাকি না। আর সন্ধে হওয়ার আগেই ফিরে আসি ঘরে।
সন্ধে হলে মামাবাড়িতে হারিকেন জ্বলে ওঠে। সে-আলো অবশ্য বেশিক্ষণ থাকে না। তেল ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই ঘুমিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে হয়। মা অবশ্য বলে দেয়, ‘নে এবার ঘুমিয়ে পর খোকা।’ আমিও তখন কী নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে যাই। আমি তো তখন মায়ের বন্ধু। মায়ের সঙ্গেই হাঁটছি। মায়ের সঙ্গে যাচ্ছি কত পথ। মাকে ছাড়া তখন এতটুকু এগিয়ে যাওয়া চলে না।
সকালে ঘুম ভাঙে মায়ের ডাকে। বাইরে হয়তো তখনো বেশ সকাল। কেমন শীত শীত ভাব। চারপাশে মাটির দেয়াল চুইয়ে কেমন হিম ঢুকছে। আমি সেই হিমসকালে মায়ের ডাক শোনামাত্র বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছি। মা উনুন ধরিয়েছে এতক্ষণে। কয়লার উনুন। ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে গোটা ঘর। ঠিক তখনই হয়তো মাস্টারদা এসেছে পড়াতে। আর পড়াতে বসে বলছে, ‘এত ধোঁয়া কেন? চোখ যে মেলতে পারছি না আর।’ দেখছি মাস্টারের দু-চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। মাস্টার তাকাতে পারছে না কিছুতেই।
মা হয়তো বলছে, এই তো একটু সময়। উনুনটা ধরে এলো বলে। আমিও দেখছি ধীরে ধীরে ধোঁয়া সরে গিয়ে চারপাশ কেমন পরিষ্কার হয়ে গেছে ততক্ষণে। মাস্টার চোখে জল দিয়ে এসে পড়াতে শুরু করেছে আবার। আমি পড়ছি ইতিহাস ভূগোল। পড়ছি অংক। হয়তো পড়া না পেরে বকুনি খাচ্ছি। মা কিন্তু সবকিছু দেখেও তখন কিছু বলছে না আর।
দুই
মাস্টার আমাকে অনেক বকা দিয়েছে। বকা দিয়েছে আজ পড়া কিছুই পারিনি বলে। আর বলেছে, সামনের দিন পড়া না পারলে আমাকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখবে বড় রাস্তার সামনে। মাস্টার চলে যাওয়ার পর আমি ভীষণ কেঁদেছি। কেঁদেছি পড়া কেন পারিনি তার চেয়েও মায়ের কথা ভেবে। মা নিশ্চয়ই ভেবেছে আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না আর। অন্তত পড়াশুনো তো নয়ই। মাস্টারদা যখন বকা দিচ্ছিল, মা নিশ্চয়ই আড়াল থেকে শুনছিল সে-সব। আমার আরো কান্না
পাচ্ছিল সেইসব ভেবে। অথচ মাস্টার চলে যাওয়ার পর আমি মায়ের কাছে গেছি, দেখি দিব্যি মা আমাকে সে-সব কথা কিছু জিজ্ঞেস না করে, ভাত বেড়ে দিয়েছে খেতে। গরম ভাত। সঙ্গে আরো কত কি। আমি ভাত খেয়ে উঠে বেরিয়ে পড়েছি খেলবো বলে।
আজ তো ছুটির দিন। ছুটির দিনে আমি সারাদিন খেলি। আমার স্কুল থাকে না, বাড়ির পড়া থাকে না। মাও সেদিন আমাকে আর পড়তে বসতে বলে না। সোনামণিদের বাড়ি পেরিয়ে ফাঁকা মাঠটাকে ঘিরে আমাদের ফুটবল, ক্রিকেট খেলার আয়োজন। আমরা ছেলেরা সেই মাঠে দাপিয়ে বেড়াই সারাটা দুপুর, দুপুর পেরিয়ে বিকেল, একদম সন্ধে পর্যন্ত খেলবো। যতক্ষণ না মায়ের ডাক আসবে। মা ডাকলেই আমাকে ফিরে আসতে হবে ঘরে।
সোনামণিদের বাড়ি পেরোলে এদিকে অনেক মাঠ। একদিকে ধানের ক্ষেত। সেই ক্ষেতে ফসল তোলা হয়ে গেলে কেমন আল ধরে আমাদের ছুটে চলা। সেই মাঠে শ্যালো মেশিনের জল। ধান তোলা হয়ে গেলে হয়তো অন্য কোনো সবজি চাষ। আমরা সেই আল ধরে বয়ে চলা শ্যালো মেশিনের জল ধরে এক মাঠ পেরিয়ে অন্য মাঠে পৌঁছবো। এদিকের সব মাঠই সবুজ, সব মাঠই কচি ঘাসে ভরা। এখন বর্ষার সময় নয়, তবু মাঠগুলো এখনো কত সবুজ হয়ে আছে। আমরা ছেলেরা দলবেঁধে সেই মাঠে নেমেছি। আরো কত ছেলে এসেছে আশপাশের পাড়া থেকে। আমাদের খেলা দেখতে এসেছে বড়রাও কেউ কেউ। সবাই দেখছে আমাদের ছোটদের খেলা। দেখছে আমাকে আর মিঠুনকেও।
মিঠুন দিন কয়েক হলো আমাদের পাড়ায় এসেছে। সরকার বাড়ির ঘর ভাড়া নিয়ে উঠেছে ওরা। মিঠুন পড়াশুনোয় যেমন ভালো, খেলাধুলাতেও দারুণ। সব বিষয়েই ওর অন্যরকম আগ্রহ। অল্পদিনেই কত ভালো বন্ধু হয়ে গেছি আমরা। যেদিন দুপুরে খেলা থাকে না, স্কুল থেকে ফিরে আমি আর মিঠুন মাঠের একপাশে বসে গল্প করি। কত গল্প জানে মিঠুন। রোজ আমাকে সে-সব শোনায়। আমি মিঠুনের হাত ধরে কল্পনার সাগরে ডুব দিই।
মিঠুনদের কোনো বাড়ি নেই। কিছুদিন অন্তর অন্তর ওদের ভাড়াবাড়ি বদলে যায়। এক পাড়া থেকে চলে যেতে হতো অন্য পাড়ায়। আমি মিঠুনকে বলি, ‘আমাদের পাড়া ছেড়ে অন্য কোথাও যাবে না তো?’ মিঠুন আমার হাত চেপে ধরে। ওর চোখ ছলছল করে ওঠে হঠাৎ। তারপর এক দৌড়ে বাড়ি ফিরে গিয়ে আরো বেশি করে পড়ালেখায় মন বসায়। মিঠুন জানে, সেকথা একদিন বলেওছিল আমায়, ‘যদি ভালো করে পড়াশুনো করো, দেখবে একদিন তোমার সবকিছু ঠিক পেয়ে যাবে, যাবেই -।’ মিঠুনের গলায় প্রত্যয়। অথচ মিঠুন ঠিক কী চাইছে বুঝতে পারছি না। শুধু ওকে মাঠে না দেখলে কেমন মন খারাপ করে। এমনকি বিকেল হয়েছে, আমাদের খেলার সময় আমরা সবাই মাঠে হাজির, শুধু মিঠুন নেই তখনো।
সঞ্জয় বলল, ‘আজ মিঠুনের খেলা বন্ধ। ওদের বাড়ি বদলে যাচ্ছে আবার।’
মাইকেল বলল, ‘ওরা তো আমাদের পাড়া ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কোন নতুন ভাড়াবাড়িতে গিয়ে উঠবে আবার।’
আমার তখন খুব রাগ হলো। তা বলে আগে থেকে একটু জানাবে না মিঠুন?
খেলার মাঠ জুড়ে তখন আমাদের মনখারাপ। আমরাও তখন খেলা ছেড়ে মিঠুনের জন্য ভাবছি। কখন যে এক ছুটে পাঁচিল টপকে সোজা মাঠে ছুটে আসবে। আর এসেই বলবে, ‘চল, শুরু করি -।’
সন্ধেবেলা মায়ের ডাকে ঘরে ফিরি। মনটা তখনো মিঠুনের জন্য খারাপ। অথচ যাওয়ার আগে একবারও দেখা হলো না ওর সঙ্গে। মা কেন জানি আমার মন খারাপ হলে ঠিক বুঝে ফেলতে পারে। জানতে চায়, ‘কী হয়েছে বল আমায়।’ আমি বলি মিঠুনের কথা। বলি আমার বন্ধুর কথা। বলি, ওদের বাড়ি বদলে যাওয়ার কথা। বলি, লেখাপড়ায় কত ভালো মিঠুন জানো মা। ও নিজেই বলেছে আমায়। এবার পরীক্ষায় ফার্স্ট হবেই হবে, দেখে নিও। আমার চোখে জল দেখে মা কেমন বুকে জড়িয়ে নেয় আবার।
রাতে ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখি, আমি আর মিঠুন কতদূর চলে এসেছি ক্রিকেট খেলতে। কত বড় মাঠ। হয়তো ম্যাচ হবে আজ। আমাদের পেছনে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে সঞ্জয়, সুবীর, মাইকেল, লিটন, পার্থ – আমাদের সমবয়সী ছেলেদের দল। আমি দেখছি মিঠুনের হাতে ব্যাট। এগিয়ে যাচ্ছে সবার আগে। ওর সঙ্গে সঙ্গে আমরা। আমাদের সামনে ফাঁকা মাঠজুড়ে বাইশ গজ। আর দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বিপক্ষ দলের ছায়া। আমি দেখছি সেই দলের সবাই আমাদের চাইতে বয়সে কত বড়। অথচ তারাও আজ আমাদের দলকে দেখে করতালি দিচ্ছে। আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে।
দেখছি, টসে জিতে আমরা ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি আর মিঠুন ওপেনিং জুটি – মাঠে নামছি ব্যাট হাতে। মাঠজুড়ে ছড়িয়ে পরা উত্তাপ। সেই দুপুররোদে প্রথম বলেই ছয় মারবে মিঠুন। তারপর দুটো চার। একটা শর্ট রান নিয়ে আমায় ব্যাট করার সুযোগ দেবে। চতুর্থ বলটা ইয়র্কার, কোনোমতে সামলে নেবো আমি। তারপর দু-দুটো চার। এরপর তো শুধুই রানের বন্যা। ঝড় তুলবে মিঠুন। ওকে সঙ্গ দিয়ে আমি।
এরপর হঠাৎ করে যে কী হয়ে যাবে! আমাদের ঝড়ের ইনিংসটা থমকে যাবে একটা বাউন্স বলে। আউট হয়ে ফিরে যাবে মিঠুন। আমাদের দলও এরপর ভেঙে পড়বে তাসের ঘরের মতো। গড়াতে গড়াতে একেবারে শেষ উইকেট।
আমি দেখছি, ফিল্ডিং করতে এসে মিঠুন বল তুলে দেবে আমায়। কাছে এসে বলবে, কিভাবে ভাঙতে হবে দেয়াল। বল হাতে দৌড় শুরু করবো আমি। আমার সামনে উঁচু উঁচু ছায়া। পাঁচিল তুলে দাঁড়িয়ে থাকা বিপক্ষ দল। আপ্রাণ দৌড় শুরু করবো আমি। দৌড়াতে দৌড়াতে ভাববো মিঠুনের কথা। তারপর লম্বা লাফ। হাত ঘুরিয়ে বলটা সোজা ছুড়ে দেব উইকেট লক্ষ করে। চিৎকার করে উঠবো, ‘ক্যাচ ক্যাচ’ বলে। অথচ কী সহজ ক্যাচটা ফেলে দেবে সঞ্জয়।
মিঠুন কিন্তু হাল ছাড়বে না তখনো। ভরসা দেবে আমায়। ফের নতুন করে ভাবতে বলবে। আমিও ফের নতুন করে দৌড় শুরু করবো আবার। এবার আরো নিখুঁত দৌড়, টার্গেট একদম স্থির। দেখব, বলটা সজোরে মিডল উইকেটটাকে ধাক্কা দিয়ে গড়িয়ে পড়বে একপাশে। ‘আউট, আউট’ বলে চিৎকার জুড়ে যাবে গোটা মাঠে। সঙ্গে সঙ্গে মিঠুন দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরবে আমায়। আমার সামনে উঁচু ছায়া সরে গিয়ে তখন ফুরফুরে বাতাস। দেয়াল ভেঙে রোদ ছড়িয়ে পড়া আলো।
‘আমরা জিতবো, জিততেই হবে আমাদের’, বলে উঠবে মিঠুন। সত্যি সত্যিই এরপর সেই বিপক্ষ দলটা পরপর আউট হয়ে ফিরে যাবে মাঠের বাইরে। আমরা প্রায় জয়ের মুখে এসে দাঁড়াবো। আর শেষ উইকেটটা তুলে নেওয়ার আগেই সেই ঝড়টা উঠবে হঠাৎ।
দেখবো, চারদিক অন্ধকার করে এলোমেলো হাওয়ায় ঢেকে যাবে আমাদের চোখ। আমি দেখবো, আমাদের সেই খেলার মাঠটা জুড়ে কালো পর্দা নেমে ঢেকে দেবে আকাশ। সেই ক্ষীণ আলোয় স্পষ্ট দেখতে পাবো, একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা এসে মিঠুনের হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ওদের পাড়ায়। মিঠুন চলে যাচ্ছে। আমরা সরে যাচ্ছি আরো দূরে। হঠাৎ বজ্রপাত এসে সজোরে ধাক্কা মারবে আমার বুকে। কেঁপে উঠবো আমি। ধড়ফড় করে লাফিয়ে উঠবো হঠাৎ। ঘুম ভেঙে যাবে আমার।
মা বলবে, ‘আবার সেই খারাপ স্বপ্ন?’ মা বলবে, ‘কী দেখছিলি বল।’ আমি নাকি মাঝে মাঝেই এমন খারাপ স্বপ্ন দেখে জেগে উঠি হঠাৎ। মা জানতে চাইবে সেই খারাপ স্বপ্নের কথা। সেই এমনভাবে হঠাৎ লাফিয়ে ওঠার আগে ঠিক যা ঘটেছিল, সেই কথা।
আমার কিন্তু তখন আর কিছুই মনে থাকবে না। আমি তখন মায়ের দিকে তাকিয়ে ভাববো, এখন সকাল, নাকি রাত? ভাববো আমার গা কি গরম হয়ে উঠছে আবার? না হলে মা এমনভাবে কপাল ছুঁয়ে দেখছে কেন। আর কেনই বা বলছে, এখন জলপট্টি দেবে আমার মাথায়। আমি শুয়ে থাকবো বিছানাকে ঘিরে। আমি শুয়ে থাকবো সারা শরীর জুড়ে সবুজ ঘাসের গন্ধ নিয়ে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.