হাজার মাইল জুড়ে

বাস থেকে নেমে আধ ঘণ্টার মতো উত্তরে হাঁটতে হাঁটতে ডানপাশে একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প বাগেরহাটের সমেত্মাষপুর স্কুলটা সহজেই শনাক্ত করে রিপন। কিন্তু শহীদ বাবার কবর খুঁজে বের করার অস্থিরতার তোড়ে রওনার সময় তার মাথায় আসেনি যে, আজ সাপ্তাহিক ছুটি – স্কুল বন্ধ।

গ্রামগঞ্জের স্কুলে তালা মানে এমন বিরল খা-খা অবস্থা যেন কেউ কোনোকালে এখানে আসেনি, স্কুলটা যেন অনেক দিনের পরিত্যক্ত একটা টিনের পুরোনো দোচালা। এই স্কুলের আশপাশে, কি পুকুরপাড়ে কিংবা পেছনের ঝোপঝাড়ের মধ্যে কোথাও তার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বাবা আতাহার আলীর কবর। বাসি হয়ে যাওয়া এই তথ্যটা সে পেয়েছিল তাঁর মায়ের মুখে, তাও সে এসএসসি পাস করার পর। কেন যে মা আরো আগে বলেনি তার কারণ কস্মিনকালেও সে ধরতে পারেনি। হয়তো ছেলে অভাবের পায়ে ঘুরেফিরে নিদারুণ কষ্টেসৃষ্টে স্কুলপাঠ সাঙ্গ করে সাবালক হয়েছে – এখন বাবার গৌরবময় মৃত্যুর কথা তার বোধ-অনুভূতিতে জমা রাখা যায়। 

রিপনের মা স্বামীর সাহসী মৃত্যুর খবর পেয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ শেষে। ভাসার হাটের খুলে ফেলা কাঠের পুলের
এপাশে-ওপাশে মুখোমুখি এক যুদ্ধে শত্রুর গুলি এসে আতাহার আলীর মাথার খুলি উপড়ে দেয়। আতাহার আলীর এই শহিদি মৃত্যুর ঘটনা প্রায় পাঁচ মাস পর মুখ থেকে মুখে মাইল মাইল পাড়ি দিয়ে আসার কারণে যথাযথ সংবাদ কেউ বলতে পারেনি। যুদ্ধ শেষ, যে যার ভিটেমাটি ও স্বজনের কাছে ছুটতে ব্যস্ত থাকায় সারকথার জানাজানি থেকে রিপনরা বঞ্চিত থেকে গেছে। ওই যুদ্ধের শরিক এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে প্রতিবেশী বা নিকট গ্রামমনুষ্যি কেউ ছিল না বলে বিভিন্ন ঠোঁট হয়ে যেটুকু খবর পৌঁছায় তার মধ্যে কবরের নির্দিষ্ট জায়গার কোনো বার্তা ছিল না। রিপনের বয়স তখন মাত্র তিন বছর। মায়ের নিঃশব্দ কান্না, শুকনো মেঘমুখ, বুকের খাঁচা ছুঁয়ে আসা লম্বা হুতাশ দেখে দেখে ভেতরের রক্তক্ষরণে ওই বয়স থেকে রিপন হয়ে ওঠে নিরেট পাথর। কোনো কোনো রাতে ঘুম ভেঙে গেলে মাঠ ভেঙে আসা দস্যি বাতাসে ঘরের বেড়ার ফুটোয় গোঁজা সুপারিগাছের শুকনো পাতার হালকা শব্দ মনে হতো মায়ের জীবন্ত দীর্ঘশ্বাসের মতো। মায়ের হাতের প্রতিটি আঙুলের ডগা ফাটা আর খড়খড়ে। কোনো কোনো রাতে তার কোলের মধ্যে কুণ্ডুলি পাকিয়ে শোয়ার পর হাত মায়ের আঙুল স্পর্শ করেছে। তখন বোঝেনি, আজ সে চোখ বুজে পরিষ্কার ধরতে পারে – একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর যে-মর্যাদা নিয়ে স্বাধীন দেশে বেঁচে থাকার কথা ছিল, তার কিছুই মা পায়নি। পুরোনো জ্যালজ্যালে কাপড়ের আড়ালে কখনো কখনো তার মায়ের আকারই সে খুঁজে পায়নি। আচ্ছা, মায়ের পরনের কাপড়ে রং কই! তৈরির সময়ও কি রং ছিল না? নচেৎ কোনো রংই ওই কাপড়ে কেন সে দেখেনি। দেখো, সেই মায়ের রেখে যাওয়া শেষ ইচ্ছার মূল্য দিতে এই অচেনা অপরিচিত বিভুঁইয়ে সে ছুটে এসেছে।

সমেত্মাষপুর স্কুলে মুক্তিবাহিনীর বড় একটা ক্যাম্প ছিল। এখান থেকে ক্যাম্পলিডার, সম্ভবত তাঁর নাম ছিল ক্যাপ্টেন তাজুল ইসলাম, আশপাশের যুদ্ধ পরিচালনা করতেন। তাঁর পাঠানো মুক্তিযোদ্ধাদের একটা গ্রুপের সঙ্গে ভাসায় ঘোরতর যুদ্ধ হয়েছিল। ওই সময় বৃষ্টি হচ্ছিল। আতাহার নামের লম্বা মজবুত শরীরের এক মুক্তিযোদ্ধা ওই যুদ্ধে শহীদ হন। তাঁর লাশ মুক্তিযোদ্ধারা নিয়ে এসেছিলেন। এই স্কুলের আশপাশে কোথাও তাঁকে করব দেওয়া হয়। ওই কবরের খোঁজ এই তল্লাটের কেউ দিতে পারে কি-না।

– ‘কবর! কী যে কন? এতোদিনে তার দাগ-নিশানা!’ ছাপরার যুবক রিপনের খোঁজার বিষয় নিয়ে আপনা থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার চূড়ান্ত রায় দেয়।

মায়ের মৃত্যুসংবাদ এমন একসময় রিপন পায় যখন শাহবাগে পিজি হাসপাতালের সামনের জনজটে নিজেকে ধরে রেখেছিল। পকেটের মোবাইল ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠলে দেখে ছোটমামার কল। কোনো কিছু গোপন না করে তিনি রিপনকে সাফ জানিয়ে দেন – ‘এখনি তোকে ঢাকা থেকে রওনা দিতে হবে, তোর মা আর নেই।’ শুনে মোবাইল ফোনটা মুঠোয় সে চেপে ধরে। আপাদমস্তক সামান্য কেঁপে ওঠে। বুকের ভেতর হিম ভেঙে আসছে। ক্রমশ মনে হয় মাথার খুলির নিচে আদৌ কোনো কলকব্জা নেই – দারুণ ফাঁকা। গণজাগরণ মঞ্চ থেকে নতুন সেস্নাগান শুরু হলে রিপন নিজের বিবেচনাশূন্য নিষ্ক্রিয় ভাবটা কাটিয়ে উঠতে পারে। মা নেই, আশ্চর্য হাহাকারের কোনো চাপ নেই, দুঃখের মোটা-চিকন তারে টোকা পড়ছে না, শোকের কোনো বাষ্প তার মধ্যে ক্রিয়া করছে না।

মা বেঁচে থাকতে ছেলের ওপর অগাধ আস্থা রেখে তাঁর একটাই দাবি ছিল – মারা গেলে রিপন যেভাবেই হোক বাপের কবর খুঁজে সেখানের একমুঠ মাটি এনে তাঁর কবরের ওপর যেন বিছিয়ে দেয়, তাহলে মরেও তাঁর চিরশান্তি।

ভালোই, মাটির আড়ালে গিয়ে মা তাঁর জ্বালা-যন্ত্রণা থেকে চিরমুক্তি পেয়েছেন। মায়ের এই মৃত্যুর পর দাদা-নানা, কি চাচা-মামা বাড়ির সঙ্গে তার নামমাত্র সম্পর্কেরও মরণ হলো। এখন সে ঝাড়া হাত-পা। শুধু বাপের কবরটা খুঁজে পেলে একমুঠ মাটি তুলে এনে মায়ের কবরের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে সে নিজস্ব দূরের ডেরায় ফিরে চলে যাবে। তার জন্মই বুঝি হারিয়ে যাওয়ার জন্য। মাস ছয় আগে যখন সে গ্রামে মায়ের আঁচলের তলে চোখ ভরে ঘুমানোর জন্য আসে তখন খেয়াল করেছে মা একই কথা বিরতি দিয়ে দিয়ে বারবার বলছেন। তখুনি সন্দেহ হয়, মা মাথার ধার আর ধরে রাখতে পারছেন না। দৃষ্টিশক্তিও বুঝি ক্ষয় হয়ে গেছে।

রিপন নিজের ওপরই এবার বিরক্ত হয়। হুট করে একটা ঘোরের মধ্যে অজানা সম্বন্ধশূন্য ভূমিতে চলে আসা তার ঠিক হয়নি। এখন উচিত দক্ষিণমুখী দে’পাড়ার উদ্দেশে ফের রওনা দেওয়া। ওখান থেকে বাসে উঠে ফিরে যাওয়া। উপযুক্ত খোঁজখবর নিয়ে বাপের কবরের সন্ধানে তার আসা উচিত ছিল। মায়ের হঠাৎ মৃত্যু কি তার বুদ্ধি-বিবেচনায় গোলমাল করেছে? আন্দাজে নেমে পড়া মানে অন্ধকারে পথ হাতড়ানো। আরে, এতো বছর পর মুক্তিযুদ্ধেরই স্মৃতি নিজের ভেতর ক’জন ধরে রেখেছে? মুক্তিযোদ্ধা এখনো যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁরাও যুদ্ধের স্মৃতি ভুলে থাকতে পারলে বাঁচেন। কোথাও তাঁদের  দাম নেই।

গাছের শুকনো চিকন ডাল ছাপরার যুবক এবার তার থ্যাবড়া পায়ের নিচে চেপে মুটমুট শব্দে ভাঙতে ভাঙতে রিপনের কাছে জিজ্ঞাসা রাখে – ‘তা আপনি যার কবর খুঁজতিছেন সে কী হয় আপনার?’

প্রশ্নটা বুঝি ন্যায্যতার অধিকার নিয়ে ছাপরার সামনে কয়েকপ্রস্ত জায়গা থেকে আশপাশে, পথের ওপাশের গাছগাছালি, ঘন ঝোপ, তার পেছনের সরু খাল, এপাশে নির্জন সন্তোষপুর স্কুলের মাঠের ওপর দিয়ে উত্তর-দক্ষিণে উড়ে যায়। শীতকালের ফ্যাকাসে সবুজ আর ঝরাপাতাদের মৌসুম-আক্রান্ত এই পাড়াগাঁ, তার বুকের মধ্যে শ্রীহীন বারোয়ারি স্কুল, এই স্কুলে একাত্তরের যুদ্ধদিনে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প যে ইতিহাস ধরে আছে তা এখুনি ধুলোবালি মুছে হয়তো প্রশ্ন রাখবে – এতোদিনে ওই শহিদ মুক্তিযোদ্ধার শনাক্তহীন যে-কবর খুঁজছো সে কী হয় তোমার?

রিপন দারুণ অসহায় বোধ করে। ভেতরটা তার বুজে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। কী জবাব দেবে সে? বুকের খুব গভীরে আকুতি মাখানো তার চাওয়া শোনার পর ছাপরার এই জোয়ান, যদি ক্ষেপে যায়, ধারালো বিদ্রূপে তাকে ঝাঁঝরা করে দেয় – ব্যাটা, এতোগুলো বছর পর এসেছো বাপের  কবরের সন্ধানে? একমাত্র সসত্মান? তা এই সন্তান এতোদিন কী করেছে? আকস্মিক এক বোধোদয়ে রিপন সহসা উঠে দাঁড়ায়। উত্তেজনার তোড়ে তার আপাদমস্তকে ঝা ঝিন ঝিন শিহরণ বয়ে যায়। এতো বছর পর তার বাবার কবরের দরকার কী? বাগেরহাট মানেই বাংলাদেশ। একাত্তরে শহিদদের রক্তে সারাদেশের মাটি আরো উর্বর হয়েছে। সন্তোষপুর কেন, এদেশের ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়েই তো লাখ লাখ কবর। তার মায়ের কবরের ওপর ছড়িয়ে দিতে দেশের যে-কোনো প্রান্ত থেকে একমুঠ মাটি তুলে দিলেই তো হয়, সব শহিদ তো তার আত্মীয়।