হুমায়ূন আহমেদের কথা

জোছনা ও জননীর গল্পের প্রকাশনা উৎসব হবে।
হুমায়ূন ভাই সাধারণত প্রকাশনা উৎসব ইত্যাদি এড়িয়ে চলেন। এ-বইটি নিয়ে তাঁর একটু বিশেষ মায়া আছে। মাজহারের প্রস্তাবে তিনি রাজি হলেন। ২০০৪ সালের কথা। ফেব্র“য়ারি বইমেলা চলছে। মেলার মধ্যেই আয়োজন করা হলো। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এক বিকেলে অনুষ্ঠান। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তিনি এলেন। কোনো বিশেষ অতিথি বা সভাপতি – এসব নেই। পাঁচজন বড়মাপের মানুষ বইটি নিয়ে কথা বলবেন। শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আনিসুজ্জামান, মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করবেন আসাদুজ্জামান নূর।
একদিন আগে হঠাৎ করে মত বদলালেন হুমায়ূন ভাই। মাজহারকে বললেন, উপন্যাস নিয়ে অনুষ্ঠান, এই অনুষ্ঠানের সঞ্চালক হবেন একজন লেখক। দায়িত্বটা তিনি আমাকে দিলেন। আলোচনা শেষে মোহিনী চৌধুরী রচিত সেই বিখ্যাত গান –
‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ হলো বলিদান
লেখা আছে অশ্র“জলে…’
খালি গলায় গেয়ে শোনালেন শাওন। হুমায়ূন ভাইকে দেখি উইংসের আড়ালে দাঁড়িয়ে শিশুর মতো কাঁদছেন। কান্নার কারণ সে-মুহূর্তে তিনি চলে গিয়েছিলেন ১৯৭১-এ। সেই ভয়ংকর সময়ের কথা ভেবে তিনি কাঁদছিলেন।
এই আবেগপ্রবণ শিশুর মতো মানুষটিই আবার খোঁচাখুঁচির ওস্তাদ, মজা করার ওস্তাদ। প্রিয় মানুষজনকে খুঁচিয়ে আনন্দ পান। তাঁর মুখ থেকে শোনা একটি ঘটনার কথা বলি। পিএইচ.ডি করে আমেরিকা থেকে ফিরেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আগের চাকরিতে ঢুকেছেন। হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে বেশ বন্ধুত্ব। তিনি খুবই সিরিয়াস টাইপের মানুষ। ইংরেজি সাহিত্যের এক সেমিনারে নিয়ে গেছেন হুমায়ূন আহমেদকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংবদন্তিতুল্য ইংরেজির অধ্যাপক, আমি তাঁর নামটা বলছি না, তিনি বক্তৃতা করছেন। হুমায়ূন আহমেদ ভদ্রলোককে চেনেন এবং তাঁর সম্পর্কে জানেন সবই। তবু তাঁর বক্তৃতা শুনে একটু মজা করতে চাইলেন। ভদ্রলোক বক্তৃতা শেষ করে স্টেজ থেকে নেমে আসার পর হুমায়ূন আহমেদ তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। হাসিমুখে বললেন, ‘স্যার, আপনার চিবিয়ে চিবিয়ে বলা ইংরেজি আমার ভালো লেগেছে।’
সেই ভদ্রলোক ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে এতই পস, জীবনে এ-ধরনের কথা বোধহয় শোনেনইনি। হতবাক হয়ে কিছুক্ষণ হুমায়ূন আহমেদের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘আপনি একটা কাজ করুন, আমার বক্তৃতার দু-একটি বাক্য না চিবিয়ে উচ্চারণ করুন তো।’
হুমায়ুন আজাদ গিয়েছিলেন ওয়াশরুমে। সেখান থেকে এসে পরিস্থিতি সামাল দিলেন। ইংরেজির অধ্যাপককে বললেন, ‘স্যার, ও তো আমাদের হুমায়ূন আহমেদ।’
ভদ্রলোক হুমায়ূন ভাইকে চিনতে পারেননি। নাম শুনে রাগ-বিরক্তি ভুলে গেলেন। হাসিমুখে বললেন, ‘আরে, আমি তো আপনার লেখার ভক্ত।’
এক বন্ধুর বাসায় দাওয়াত খেতে গেছেন। বন্ধুপতœী অতিযতেœ রান্নাবান্না করেছেন। বহু আইটেম। সঙ্গে আমি এবং আমাদের আরো দু-একজন বন্ধু আছেন। হুমায়ূন ভাই যা যা পছন্দ করেন, ওসবেরই আয়োজন করেছেন তিনি। বন্ধুপতœীর রান্না তেমন সুবিধার নয়। তবু ভদ্রমহিলা তাঁর সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে হুমায়ূন ভাই নির্বিকার গলায় বললেন, ‘এত বাজে রান্না জীবনে খাইনি।’
আমাকে একবার বললেন, ‘তোমাদের মাওয়ার ওদিককার পদ্মায় ভালো রিঠা মাছ পাওয়া যায়। তোমার বউকে বলো আমাকে রান্না করে পাঠাতে।’
মাওয়া থেকে রিঠা মাছ আনালাম। আমার স্ত্রী রান্না করে পাঠালেন। হুমায়ূন ভাই খেলেন, আমার স্ত্রীকে নিজের উপন্যাস সংকলন অটোগ্রাফ দিয়ে পাঠালেন। পরদিন হঠাৎ আমাকে বললেন, ‘রিঠা মাছটা মরা ছিল।’
আমি বিস্মিত। রিঠা মাছ মরা ছিল না জ্যান্ত, এটা বোঝা বেশ কঠিন। কারণ মাছটা আনার পর আমি একপলক দেখেছিলাম। একদম তাজা এবং জ্যান্ত মনে হয়েছে। কারণ রিঠা খুবই শক্ত প্রাণের মাছ, দু-চার ঘণ্টায় মরে না, ভালো রকম তাজা থাকে।
আমার খটকা লাগল। বাসায় এসে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা, রিঠা মাছটা জ্যান্ত ছিল না?’
সে বলল, ‘না, আনতে আনতে মরে গিয়েছিল। তবে তাজা ছিল, ফ্রেশ ছিল।’
আমি আরেকটা ধাক্কা খেলাম। একজন মানুষ কতটা খাদ্যসচেতন হলে এটা বোঝা সম্ভব!
আমাদের যেবার তিনি কুতুবপুরে নিয়ে গেলেন, ’৮৫-৮৬ সালের কথা। তাঁর বাবার নামে করা পাঠাগার উদ্বোধন। ওই যেবার হুমায়ুন আজাদ আর নির্মলেন্দু গুণ রাতভর ঝগড়া করলেন, সেবারের কথা। হুমায়ূন ভাইয়ের চাচা খুবই সমাদর করেছিলেন আমাদের, চমৎকার খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন ছিল। আমরা ফিরছিলাম ট্রেনে করে। ট্রেনের খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন হুমায়ূন ভাই, আমি তাঁর পাশে। মুগ্ধ গলায় বললাম, ‘চাচা খুবই সমাদর করলেন আমাদের। ভালো খাইয়েছেন।’
হুমায়ূন ভাই গম্ভীর গলায় বললেন, ‘হুঁ, দেড় হাজার টাকার একটা বিলও ধরিয়ে দিয়েছেন।’
তখনকার দিনে দেড় হাজার টাকা অনেক টাকা।
রাতের বেলা তাঁর অতিপ্রিয় একজনের ভাইয়ের বিয়েতে যেতে হবে। হুমায়ূন ভাই দলবল ছাড়া চলতে পারেন না। আমরা সবাই রেডি। কিন্তু হুমায়ূন ভাইয়ের তেমন ইচ্ছা নেই যাওয়ার। তাঁর ইচ্ছা নিজের ফ্ল্যাটে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেবেন।
সেটা সম্ভব নয়। যেতেই হবে। আমরা রওনা দিলাম অনেক রাতে। বিয়েশাদির খাওয়া-দাওয়া শেষ। আমরা যাওয়ার পর নতুন করে অ্যারেঞ্জ করা হলো। খেতে শুরু করেছি। হুমায়ূন ভাই একবার মাত্র সামান্য বিরিয়ানি মুখে দিয়েই প্রচণ্ড রেগে গেলেন। হাতের ধাক্কায় প্লেট সরিয়ে প্রিয় মানুষটিকে বললেন, ‘তুমি জানো না, আমি ঠান্ডা খাবার খাই না?’
খাবার তেমন ঠান্ডা ছিল না, তবু তিনি রাগলেন। এই রাগটা আসলে ওই রাগ, যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না; প্রকাশ করলেন অন্যভাবে। আর খেলেনই না। উঠে চলে এলেন। তাঁর সঙ্গে আমাদেরও খাওয়া হলো না।
গেণ্ডারিয়ায় আমাদের বন্ধু আলমগীর রহমানের বাড়িতে এখন থেকে বিশ-বাইশ বছর আগে আমরা খুব আড্ডা দিতাম। আলমগীর ভাইয়ের স্ত্রী ঝরনা ভাবির রান্নার কোনো তুলনা হয় না। আলমগীর ভাই নিজেও খুব ভালো রান্না করেন। আমরা বিকেলবেলা আড্ডা দিতে বসি। রাতের বেলা তাঁর ওখানে খেয়ে যে যার বাড়ি ফিরি। ওরকম এক বিকেলবেলা হুমায়ূন ভাই এসে বললেন, ‘আমি একটা সেলুনে চুল কাটাতে গিয়েছিলাম, নাকের লোম কাটার কথা বলে নাপিত আমার নাকে কাঁচি ঢুকিয়ে দিয়েছিল। আমি খুবই বিরক্ত হয়েছি। চুল না কাটিয়েই চলে আসছি। আলমগীর, একজন নাপিত ডেকে আনান, আমি আপনার এই বারান্দায় বসে চুল কাটাব।’
আলমগীর ভাইয়ের কাজের লোক গিয়ে সামনের সেলুন থেকে নাপিত ডেকে আনল। বারান্দায় চেয়ার পাতা হলো। সেখানে তোয়ালে জড়িয়ে তাঁর চুল কাটতে শুরু করল নাপিত। তিনি নির্বিকার ভঙ্গিতে সিগারেট টানতে লাগলেন। এক ফাঁকে নাপিতকে বললেন, ‘খবরদার, নাকে কাঁচি ঢোকাবে না।’

দুই
চুয়াডাঙ্গা থেকে এক ভদ্রমহিলা ফোন করলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আপনার লেখাটা নিয়মিত পড়ছি। তিনি এখন কেমন আছেন এ-কথা আপনি একবারও লিখছেন না। আমরা জানতে চাই তিনি কেমন আছেন।’
আমি বিনীতভাবে বললাম, ‘আমি তাঁর অসুস্থতার কথা লিখতে চাই না। আমার কলম সায় দেয় না। তবে তাঁর অসুস্থতার কথা, তিনি এখন কেমন আছেন – এসব দু-চার দিন পরপর সব কাগজেই লেখা হচ্ছে। আমাদের কালের কণ্ঠেও প্রথম কিংবা শেষ পৃষ্ঠায় আমরা ছাপছি।’
ভদ্রমহিলা একটু নাছোড় ধরনের। বললেন, ‘আপনি কবে কীভাবে তাঁর অসুস্থতার কথা জানলেন?’
আমার বলতে ভালো লাগছিল না। ব্যস্ততার ভান করে ফোন রেখে দিলাম। আজ এই লেখা লিখতে বসে মনে হচ্ছে, সেই ভদ্রমহিলার মতো হয়তো অনেক পাঠকেরই জানার আগ্রহ, আমি কীভাবে হুমায়ূন আহমেদের অসুস্থতার কথা জানলাম।
ঘটনাটা বলি।
আমার বহু বছরের পুরনো বন্ধু আলমগীর রহমান। বাংলাদেশের অত্যন্ত রুচিশীল ও বিখ্যাত প্রকাশন সংস্থা প্রতীক আর অবসরের স্বত্বাধিকারী। একসময় চমৎকার গল্প লিখতেন, সাংবাদিকতা করতেন। তারপর এলেন প্রকাশনায়। খুবই বন্ধুবৎসল মেজাজি মানুষ আলমগীর ভাই।
হঠাৎ একদিন তাঁর ফোন, ‘মিলন, আপনি হুমায়ূনের সঙ্গে দেখা করেন।’
আমি অবাক। ‘হুমায়ূন ভাই সিঙ্গাপুর থেকে ফিরেছেন?’
‘হ্যাঁ। শাশুড়ির পায়ের চিকিৎসার জন্য গিয়েছিল। নিজের চেকআপও করিয়ে আসছে। আপনি দেখা করেন। তিনদিন পর হুমায়ূন আমেরিকায় যাচ্ছে।’
আমি ছিলাম গাড়িতে। অফিসে যাচ্ছিলাম। আলমগীর ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘জরুরি কিছু?’
‘বলতে পারব না। আপনি দেখা করেন।’
আলমগীর ভাইয়ের গলায় এক ধরনের বিষণœতা ছিল। তিনি আর কথা বললেন না। ফোন রেখে দিলেন।
আমি একটু চিন্তিত হলাম। ব্যাপারটা কী?
ফোন করলাম মাজহারকে।
[আমার এই লেখায় প্রায়ই মাজহারের নাম আসে। হুমায়ূন ভাইয়ের পাশের ফ্ল্যাটে থাকেন মাজহার। ঠিক নিচের ফ্ল্যাটে আলমগীর রহমান। মাজহারের পুরো নাম পাঠক জানেন। মাজহারুল ইসলাম। অন্যদিন গ্র“পের প্রধান নির্বাহী। এই লেখার আগের পর্ব পড়ে মাজহার আমাকে ফোন করলেন, ‘মিলন ভাই, খাসি জবাই করে আকিকা দিয়ে আমার একটা নাম রাখা হয়েছিল – মাজহারুল ইসলাম। আপনি আমার সেই নামটাকে জবাই করে দিচ্ছেন।’
আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম। কী বলব বুঝতে পারছি না। মাজহার হো-হো করে হাসলেন, ‘ঠাট্টা করছি। আমাকে মাজহার বলেই প্রিয়জনরা ডাকে। কোনো অসুবিধা নেই।’
হুমায়ূন ভাইয়ের পাশে থাকতে থাকতে মাজহারও বেশ রসিক হয়ে উঠেছেন। অথবা মাজহার শুরু থেকেই রসিক। আমাদের বুঝতে দেরি হয়েছে। তবে মাজহারের একটা ডাকনাম আছে। সেই নামটা আমি বলব না।]
‘কী খবর, মাজহার? আলমগীর ভাই ফোন করে বললেন…’
‘হ্যাঁ, আপনি স্যারের সঙ্গে দেখা করেন।’
‘ব্যাপারটা কী?’
মাজহার বিষণœ গলায় বললেন, ‘খারাপ খবর আছে।’
‘কী হয়েছে?’
‘হুমায়ূন ভাইয়ের কোলন ক্যান্সার ধরা পড়েছে।’
আমি যেন পরিষ্কার বুঝতে পারলাম না কথাটা। ‘কী? কী ধরা পড়েছে?’
‘কোলন ক্যান্সার।’
প্রথমে দিশেহারা হলাম, তারপর স্তব্ধ। কথা বলতে পারছি না।
মাজহার বললেন, ‘সিঙ্গাপুরে যাওয়ার পর ভাবি বললেন, ‘আসছ যখন, তোমার চেকআপটাও করিয়ে নাও।’ চেকআপ করাতে গিয়ে ধরা পড়েছে। ওখানে চিকিৎসা করাতে রাজি হননি। পরশুর পরদিন নিউইয়র্কে যাচ্ছেন। আমিও যাচ্ছি সঙ্গে। মেমোরিয়াল স্লোন ক্যাটারিং ক্যান্সার হাসপাতালে চিকিৎসা হবে। এই হাসপাতালে সোনিয়া গান্ধীরও ক্যান্সারের চিকিৎসা হয়েছে। পৃথিবী-বিখ্যাত হাসপাতাল।’
মাজহার বলে যাচ্ছেন কিন্তু আমার কানে যেন ঢুকছে না কিছুই। মৃতের মতো অফিসে এলাম। কোনো কাজে মনই বসল না। প্রায় সারাটা দিন আমার রুমের সোফায় শুয়ে রইলাম। রাতেরবেলা একটু আগেভাগেই অফিস থেকে বেরিয়ে গেলাম দখিন হাওয়ায়। গিয়ে দেখি, হুমায়ূন ভাই যে-জায়গাটায় বসে লেখালেখি করেন, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেন, সেখানে তাঁর পাশে বসে আছেন জুয়েল আইচ। কিছুক্ষণ পর আলমগীর ভাই এলেন, মাজহার এলেন। আমাকে দেখে সব সময়কার মতো হুমায়ূন ভাই বললেন, ‘আসো, মিলন। বসো।’
আমি তাঁর পাশে বসলাম। তিনি শুরু করলেন তাঁর রসিকতা, ‘শোনো মিলন, সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথে আমার আর আমার মায়ের বাইপাস হয়েছিল। একই রুমে পাশাপাশি বেডে রাখা হয়েছিল মা-ছেলেকে। এরকম ইতিহাস ওই হাসপাতালে নেই। মায়ের পাওয়া গিয়েছিল ৯টি ব্লক, ছেলের ১১টি। এবার ওই হাসপাতালে চেকআপে গেছি। ডাক্তার চেকআপ করে বললেন, অমুক রুমে যাও। গেলাম। আরেক ডাক্তার চেকআপ করে বললেন, আরে, তোমার তো ক্যান্সার। বললেন এমন ভঙ্গিতে, যেন ক্যান্সার কোনো রোগই না। সর্দি-কাশির মতো সামান্য কিছু।’
আমার এমনিতেই সারাদিন ধরে মন খারাপ। হুমায়ূন ভাইয়ের রসিকতায় হাসার চেষ্টা করছি, হাসতে পারছি না। জুয়েল আইচের মুখে সব সময় হাসি লেগেই আছে। তিনি আমার দিকে তাকালেন, কিন্তু সব সময়কার মতো প্রাণ খুলে হাসতে পারলেন না। আমি মাথা নিচু করে হুমায়ূন ভাইয়ের পাশে বসে আছি। খানিক পর শাওন এসে বসল পাশে। সে খুবই উচ্ছল, প্রাণবন্ত। একপলক তার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি, ভেতরের গভীর কষ্ট অতিকষ্টে চেপে সে উচ্ছল থাকার চেষ্টা করছে। আমার চোখ ভরে আসছিল কান্নায়, গোপনে চেপে রাখছিলাম চোখের পানি।
হুমায়ূন ভাই নানা রকম কথা বলে যাচ্ছিলেন, তাঁর চিরাচরিত রসিকতাও করছিলেন। ‘আমি না থাকলে তো তোমার অনেক সুবিধা। তুমি তখন একচ্ছত্র রাজত্ব করবে’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি কাতর গলায় বললাম, ‘প্লিজ, হুমায়ূন ভাই…’
শাওন উচ্ছল গলায় বলল, ‘না না, মিলন আংকেলকে একক রাজত্ব করতে দেওয়া যাবে না। হুমায়ূন আহমেদ কমপক্ষে আরো ২০ বছর আছে।’
প্রিয় পাঠক, আপনাদের কারো কারো মনে হতে পারে শাওন আমাকে কেন ‘মিলন ভাই’ না বলে ‘মিলন আংকেল’ বলছে। আসলে আমাদের কয়েকজনের ক্ষেত্রে শাওন তার অভ্যাসটা বদলাতে পারেনি। যেমন – আসাদুজ্জামান নূর কিংবা আলমগীর রহমান কিংবা আমি। আমি শাওনকে চিনি ওর শিশুবয়স থেকে। বিটিভির ‘নতুন কুঁড়ি’র সময় থেকে। শাওনের গুণের পরিচয় তখন থেকেই জানি। ওর অসাধারণ অভিনয়ের কথা, অসাধারণ গায়কি প্রতিভার কথা, এমনকি টিভি নাটক পরিচালনার কথা সবাই জানে। আমি তার আরেকটা বড় প্রতিভার কথাও জানি। শাওন খুবই উচ্চমানের একজন নৃত্যশিল্পী। এখন আলোকিত করছে হুমায়ূন আহমেদের জীবন, একসময় আলোকিত করেছিল ‘নতুন কুঁড়ি’ প্রতিযোগিতা।
কথায় কথায় কত কথা যে আসে!
শাওনকে নিয়ে একটা ঘটনার কথা বলি। নুহাশ পল্লীতে হুমায়ূন ভাইয়ের নাটকের শুটিং ছিল। আমি আর ইফতেখার নামে হুমায়ূন ভাইয়ের এক বন্ধু গেছি তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিতে। নাটকের নায়িকা শাওন। পরদিন ইউনিভার্সিটিতে তার জরুরি ক্লাস। বিকেলবেলা ফিরতে হবে। আমি আর ইফতেখার ভাই যে-মাইক্রোবাসে ফিরব, শাওনও সেই মাইক্রোবাসে আমাদের সঙ্গে রওনা দিলো। রাস্তায় হঠাৎ আমি শাওনকে বললাম, ‘শাওন একটু পুরনো দিনের হিন্দি গান শোনাও না। দু-চার লাইন যা পারো।’
ধারণা ছিল, শাওন এই জেনারেশানের মেয়ে, ও কি আর পুরনো দিনের হিন্দি গান পুরোপুরি জানে কোনোটা? হয়তো দু-চার লাইন গাইতে পারবে।
শাওন আমার ধারণা তছনছ করে দিলো। একটার পর একটা পুরনো দিনের হিন্দি গান গাইতে লাগল। সামসাদ বেগম, নূরজাহান, লতা মুঙ্গেশকর, গীতা দত্ত, এমনকি মোহাম্মদ রফি, মুকেশের গানও। এমন নিখুঁত সুরে, একটি শব্দও ভুল না করে একের পর এক গেয়ে গেল। শাওন একটা করে গান শুরু করে, আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে তার মুখের দিকে তাকাই।
নুহাশ পল্লী থেকে ঢাকা, সারাটা পথ পুরনো দিনের হিন্দি গান গেয়ে শোনাল শাওন। ওর গান শুনতে শুনতে আমি চলে গেলাম আমার ছেলেবেলায়, কৈশোরকালে। সেই সময়কার আমার পুরান ঢাকার জীবনে, যেখানে চায়ের দোকানে দিনরাত বাজত এসব গান। গ্রামোফোনে, রেডিওতে। বিয়েবাড়ির অনুষ্ঠানেও বাজত।
বাংলার হেমন্ত মুখোপাধ্যায় মুম্বাইয়ে (তখনকার বোম্বাই) গিয়ে হয়েছিলেন হেমন্তকুমার। হিন্দি গান গেয়ে নাগিন ছবির সুর করে ভারতবর্ষ মাত করে দিলেন। সেদিন শাওন শেষ গানটা গেয়েছিল হেমন্তকুমারের ‘আয় আপনা দিল তো আওয়ারা’।
তিন
হুমায়ূন ভাই আর আমি যে একবার বিজনেস প্ল্যান করেছিলাম, সে-ঘটনাটা বলি।
১৯৮৫ সালের কথা। হুমায়ূন ভাই থাকতেন আজিমপুর কবরস্থানের পশ্চিম-উত্তর দিককার গলির ভেতর তৃতীয় তলার একটি ফ্ল্যাটে। আমি গেণ্ডারিয়ায়। হুমায়ূন ভাইয়ের তো ঢাকা ইউনিভার্সিটির চাকরি আছে, তখন তিনি অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। আমি একেবারেই বেকার। বাড়ি থেকে বিতাড়িত। থাকি কলুটোলার একটি বাসায়। চারদিকে ইটের দেয়াল, মাথার ওপর টিনের চাল। আমার স্ত্রী লজ্জায় ওই বাসায় আসেন না। তিনি থাকেন কাছেই তাঁদের তিনতলা বাড়িতে। বিতাড়িত হওয়ার পর শাশুড়ি আমাকেও তাঁদের বাড়িতে থাকতে বলেছিলেন। ব্যর্থ লোকদের অহংকার তীব্র হয়। আমার পকেটে দশটা টাকাও নেই। তবু শ্বশুরবাড়িতে না থেকে বারোশো না পনেরোশো টাকা দিয়ে যেন ওই টিনশেড ভাড়া নিয়েছি শ্বশুরবাড়ির কাছেই। এই বাসায় আমাকে একদিন দেখতে এসেছিলেন কবি রফিক আজাদ। আমার শোচনীয় অবস্থা দেখে নানা ধরনের জ্ঞান দিয়ে চলে গেলেন। লেখকদের জীবন এরকমই হয়… ইত্যাদি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদাহরণও দিলেন।
আমার কি আর ওসব কথায় মন ভালো হয়!
মন ভালো করার জন্য দু-একদিন পরপরই হুমায়ূন ভাইয়ের কাছে যাই। দুপুরে তাঁর ফ্ল্যাটে খাই, বিকেলে আড্ডা দিতে যাই ইউনিভার্সিটি ক্লাবে। দু-একদিন হুমায়ুন আজাদের বাসায়। শামসুর রাহমান, সালেহ চৌধুরী, হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ূন আহমেদ আর এই অধম, আমরা ইন্ডিয়ান এমবাসির এক ভদ্রলোকের ধানমণ্ডির ফ্ল্যাটেও আড্ডা দিতে যাই কোনো কোনো সন্ধ্যায়। অর্থাৎ আমার খুবই এলোমেলো জীবন।
এর আগে এবং পরে আমি বেশ কয়েকবার ছোটখাটো নানা রকম ব্যবসা-বাণিজ্য করার চেষ্টা করেছি। শুরু করার পর সেসব ব্যবসায় লালবাতি জ্বলে যেতে একদম সময় লাগেনি। আমার ধারণা, আমার মতো ব্যর্থ ব্যবসায়ী এই পৃথিবীতে আর একজনও নেই। যদি কখনো আত্মজীবনী লিখি তাহলে একটা চ্যাপ্টারের শিরোনাম হবে ‘আমার ব্যর্থ ব্যবসায়ী জীবন’।
যা হোক, ওই টিনশেডের বাসায় এক গরমের দুপুরে বসে ঘামে ভিজতে ভিজতে সিদ্ধান্ত নিলাম, লিখেই রুজি-রোজগারের চেষ্টা করব। এ ছাড়া আমি অন্য কোনো কাজ জানি না। ’৭৭ সালের শেষদিকে সাপ্তাহিক রোববার পত্রিকায় ঢুকেছিলাম জুনিয়র রিপোর্টার হিসেবে। পুলিশ নিয়ে রিপোর্ট লেখার কারণে চাকরি চলে গিয়েছিল। এসব কথা আগেও কোথাও কোথাও লিখেছি, কিন্তু লিখে জীবনধারণের সিদ্ধান্তটা তখন ছিল প্রায় আত্মঘাতী। পত্রপত্রিকা বলতে গেলে হাতেগোনা দু-চারটা। একটা গল্প লিখলে পাওয়া যায় বড়জোর ২০ টাকা। তাও সে-টাকা তুলতে বাসভাড়া, রিকশাভাড়া চলে যায় অর্ধেকের বেশি। বিটিভি একমাত্র টিভি চ্যানেল। তিন মাসে ছয় মাসে একটা নাটক লেখার সুযোগ মেলে। তাও নানা প্রকার ধরাধরি, তদবির। শেষ পর্যন্ত নাটক প্রচারিত হলে টাকা পাওয়া যায় শচারেক। পাবলিশাররা বই ছাপলে সেই বই কায়ক্লেশে পাঁচ-সাতশো-এক হাজার বিক্রি হয় বছরে। রয়্যালটি যেটুকু পাওয়া যায় তাতে মাসখানেক চলা মুশকিল।
এ-অবস্থায় ওরকম সিদ্ধান্ত।
তবে সিদ্ধান্ত মোতাবেক কাজ আমি শুরু করলাম। আজানের সময় ঘুম থেকে উঠে লিখতে বসি। টানা ১১টা-১২টা পর্যন্ত লিখি। এক ফাঁকে গরিব মানুষের দিন-দরিদ্র নাশতাটা সেরে নিই। তারপর যাই বাংলাবাজারে, প্রকাশকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরি। কোথাও কোথাও বসে আড্ডা দিই। দুপুরে কেউ কেউ খাওয়ায়। যেদিন ওরকম হয় সেদিন আর বাড়ি ফিরি না। একবারে আড্ডা-ফাড্ডা দিয়ে রাতে ফিরি।
হুমায়ূন ভাইও তখন দু-একদিন পরপরই বাংলাবাজারে আসেন। বিউটি বুক হাউস, স্টুডেন্ট ওয়েজ আর নওরোজ কিতাবিস্তানে বসে আড্ডা দিই, চা-সিগ্রেট খাই।
ওরকম একদিনের ঘটনা।
আমরা দুজনই এক প্রকাশকের কাছ থেকে কিছু টাকা পেয়েছি। দুপুরের দিকে হুমায়ূন ভাই বললেন, চলো আমার বাসায়।
আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি। চলুন।
বাংলাবাজার থেকে রিকশা নিলাম। যাব আজিমপুর। তখনো বাংলাদেশের প্রকাশনা জগৎ আধুনিক হয়নি। আমাদের বইপত্র তৈরি হয় হ্যান্ড কম্পোজে, প্রচ্ছদ তৈরি হয় হাতে তৈরি ব্লকে। অফসেটে প্রচ্ছদ ছাপার কথা তখনো ভাবতে পারেন না অনেক প্রকাশক।
আমার প্রথম বই ভালোবাসার গল্প ছিল ১২ ফর্মার। দাম ছিল সাত টাকা। আমি রয়্যালটি পেয়েছিলাম ৪০০ টাকা। হুমায়ূন ভাইয়ের নন্দিত নরকের দাম ছিল সাড়ে তিন টাকা। তখন বিশ-ত্রিশ হাজার টাকা হলে বাংলাবাজার এলাকার কোনো গলির ভেতর একটা রুম ভাড়া নিয়ে ‘কম্পোজ সেকশন’ করা যেত। সিসা দিয়ে তৈরি টাইপ সাজানো থাকে একধরনের কাঠের ছোট ছোট খোপওয়ালা পাত্রে। সামনে টুল নিয়ে বসে একটা একটা করে টাইপ তুলে পাণ্ডুলিপি অনুযায়ী লাইনগুলো তৈরি করে কম্পোজিটর, পৃষ্ঠা তৈরি করে। একেক খোপে একেক অক্ষরের টাইপ। ১৬ পৃষ্ঠা তৈরি হলে এক ফর্মা। ভারী একটা তক্তার ওপর ওই টাইপের দুটো করে পৃষ্ঠা। মোট আটটি ওরকম কাঠের তক্তা চলে যায় মেশিনে। অর্থাৎ একটা ফর্মা।
এভাবে ছাপা হয় বই। যারা বই ছাপার কাজ করে, ওরকম প্রেসগুলোরও অনেকেরই থাকে ‘কম্পোজ সেকশন’। ওসব ক্ষেত্রে ইনভেস্টমেন্টটা বেশি। আর মেশিন ছাড়া শুধু ‘কম্পোজ সেকশন’ ছোটখাটোভাবে করেও অল্প পুঁজিতে ব্যবসা করে কেউ কেউ। ওরকম কম্পোজ সেকশনের একটা সমস্যা হলো, কম্পোজিটররা অনেকেই সিসায় তৈরি টাইপ চুরি করে নিয়ে সের দরে বিক্রি করে ফেলে। পার্টনারশিপে যারা ‘কম্পোজ সেকশন’ করে তারা নিজেরাও এক পার্টনার আরেক পার্টনারের অজান্তে টাইপ চুরি করে। বিক্রি করলেই তো ক্যাশ টাকা।
রিকশায় বসে হুমায়ূন ভাইকে আমি বললাম, ‘হুমায়ূন ভাই, চলেন আমরা দুজন একটা বিজনেস করি।’
হুমায়ূন ভাই সিগ্রেট টান দিয়ে বললেন, ‘কী বিজনেস?’
‘একটা কম্পোজ সেকশন করি।’
‘হ্যাঁ, করা যায়। ভালো আইডিয়া। কত টাকা লাগবে?’
‘একেকজনে দশ-পনেরো হাজার করে দিলে হয়ে যাবে।’
‘সেটা দেওয়া যাবে।’
‘তাহলে চলেন শুরু করি।’
‘তোমার টাকা রেডি আছে?
‘আরে না। দশ টাকাও নেই।’
‘তাহলে?’
‘ধার করতে হবে।’
‘সেটা না হয় করলে, তবে আমার একটা শর্ত আছে।’
‘কী শর্ত?’
হুমায়ূন ভাই আমার মুখের দিকে তাকালেন। ‘চুরি করে টাইপ বিক্রির অধিকার সমান থাকতে হবে।’
আমি হাসতে হাসতে রিকশা থেকে প্রায় ছিটকে পড়ি।
আমাদের ব্যবসার ওখানেই যবনিকাপাত।

চার
পেপারব্যাকে উপন্যাস লেখার জন্য সিগারেটের প্যাকেটের ভেতর দিককার সাদা অংশে হুমায়ূন ভাই লিখলেন, ‘১০০০ (এক হাজার) টাকা বুঝিয়া পাইলাম।’ উপন্যাস লেখার জন্য ওটাই তাঁর জীবনের প্রথম অগ্রিম নেওয়া। হাতের কাছে কাগজ ছিল না বলে সিগারেটের প্যাকেট ছিঁড়ে তার পেছন দিকে লেখা হলো। এই ঘটনা ঘটল মুনতাসীর মামুনের বাসায়, মগবাজারের ইস্পাহানি কলোনিতে। সেই বাসা বা বাড়িটি বোধহয় এখনো মামুন ভাই রেখে দিয়েছেন। ইস্পাহানি কলোনির ভেতরে যাঁরা ঢুকেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই দেখেছেন গাছপালায় ঘেরা, সামনে সবুজ ঘাসের লন, হলুদ একতলা পুরনো ধরনের স্টাফ কোয়ার্টার করেছিল ইস্পাহানি কর্তৃপক্ষ। িস্নগ্ধ নির্জন সুন্দর পরিবেশ। ওরকম কোয়ার্টারে সেই সময় থাকতেন মামুন ভাই। এখনো কোয়ার্টারটি তাঁর আছে, তবে তিনি ওখানে থাকেন না। প্রতিটি রুমভর্তি বই। শুনেছি তিনি অনেক সময় লেখালেখির কাজ করতে যান ওখানে।
১৯৮৫ সাল। ২০-২২ দিন ধরে সংবাদপত্রে কর্মবিরতি চলছে। আলমগীর রহমান কাজ করেন সাপ্তাহিক বিচিত্রায়। সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী। শাহরিয়ার কবির, মাহফুজউল্লাহ, রেজোয়ান সিদ্দিকী কাজ করেন। মুনতাসীর মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক অথবা সহকারী অধ্যাপক। তারপরও বিচিত্রার সঙ্গে যুক্ত। নিয়মিত লেখালেখি করেন বিচিত্রায়। সংবাদপত্রে কর্মবিরতি চলে বলে অফিসে বসে চা-সিগারেট খেয়ে সময় কাটে সবার। শাহাদত চৌধুরীর মাথাভর্তি নানা রকম আইডিয়া। আলমগীর রহমানকে বললেন, ‘কাজী আনোয়ার হোসেনের সেবা প্রকাশনীর মতো করে বাংলাদেশের লেখকদের মৌলিক উপন্যাস বের করুন।’ আলমগীর ভাই রাজি হয়ে গেলেন। কারণ তাঁর রক্তের সঙ্গে প্রকাশনা। বাবা আবদুস সোবহান বিশাল প্রকাশক। পাকিস্তান বুক করপোরেশন, স্বাধীনতার পর হলো বাংলাদেশ বুক করপোরেশন, আলমগীর ভাইয়ের বাবা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখনো সেই প্রতিষ্ঠান আগের মতোই সুনাম নিয়ে চলছে। বাবা বেঁচে থাকতেই আলমগীর ভাইয়ের বড় ভাই খলিলুর রহমান যুক্ত হয়েছিলেন সেই ব্যবসার সঙ্গে। এখনো তিনিই দেখছেন প্রতিষ্ঠানটি। স্বাধীনতার দু-এক বছর আগে আলমগীর ভাইও মাঝেমধ্যে গিয়ে বসতেন পাটুয়াটুলীর পাকিস্তান বুক করপোরেশনে। পাঠ্যবই, রেফারেন্স বই প্রকাশ করত প্রতিষ্ঠানটি। আলমগীর ভাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, কিছু মৌলিক বই প্রকাশ করবেন। কারণ তখন তাঁর মাথায় সাহিত্যের পোকা ঘোরাঘুরি করছে। নিজে গল্প লেখেন। কামাল বিন মাহতাব-সম্পাদিত ছোটগল্পের বিখ্যাত মাসিক পত্রিকা ছোটগল্পতে নিয়মিত তাঁর গল্প ছাপা হয়। দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতায় ছাপা হয়। বিএ পরীক্ষা দিয়েছেন কিন্তু ওই বয়সেই তাঁর আড্ডার সঙ্গী শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, আল মাহমুদ। গেণ্ডারিয়ায় পুরনো আমলের বিশাল জমিদারবাড়ির মতো বাড়ি আলমগীর ভাইদের। কাছাকাছি থাকেন হায়াৎ মামুদ। হায়াৎ ভাইয়ের ছোট ভাই তাঁর বন্ধু। একসময় হায়াৎ ভাইও বন্ধু হয়ে গেলেন।
আবদুল মান্নান সৈয়দ তখন সিলেটের এমসি কলেজে বাংলার প্রভাষক। প্রবন্ধ, কবিতা, গল্প – সবই লেখেন। আলমগীর ভাই সিলেটে গিয়ে হাজির হলেন। মান্নান সৈয়দের প্রবন্ধের বই ছাপবেন। মান্নান ভাই বললেন, ‘প্রবন্ধ না, আমার একটা গল্পের বই ছাপুন।’
আলমগীর ভাই রাজি হলেন। মান্নান সৈয়দের গল্পগ্রন্থ সত্যের মতো বদমাসের পাণ্ডুলিপি নিয়ে ঢাকায় এলেন। অতি যতেœ ছাপা হলো বই। সরকার সেই বই বাজেয়াপ্ত করল। নিষিদ্ধ হয়ে গেল সত্যের মতো বদমাস। আলমগীর ভাই হতাশ হয়ে এমএ পড়তে চলে গেলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। অবশ্য এই ফাঁকে হায়াৎ মামুদের বইও ছাপা হয়েছিল তাঁদের প্রকাশনা সংস্থা থেকে।
রাজশাহীর পাট চুকিয়ে পড়াশোনা শেষ করে স্বাধীনতার পর সাংবাদিকতা শুরু করলেন আলমগীর ভাই। ১৯৮৫ সালে এসে আবার প্রকাশক হয়ে গেলেন শাহাদত চৌধুরীর বুদ্ধিতে। মুনতাসীর মামুনের বাসায় বসলেন তাঁরা। আমিও ছিলাম সেই বিকেলে তাঁদের সঙ্গে। প্রকাশনার নাম ঠিক হলো ‘অবসর’। লেখক তালিকায় আমিও আছি। তবে প্রথম বইটি লিখবেন হুমায়ূন আহমেদ। এক হাজার টাকা অগ্রিম দেওয়া হলো তাঁকে। হুমায়ূন ভাই লিখলেন তাঁর আধিভৌতিক বিষয়ের উপন্যাস দেবী। পেপারব্যাক সংস্করণ বেরোল। এক বইতেই বাজিমাত। সংস্করণের পর সংস্করণ হতে লাগল। পরে হার্ড বাইন্ডিংয়েও বেরোল দেবী। এ পর্যন্ত বোধহয় এক লাখ কপির ওপর বিক্রি হয়েছে। স্টেজ নাটক হয়েছে। ওই উপন্যাসেই প্রথম মিসির আলী নামের একটি চরিত্র এলো, যে-চরিত্র এখন বাঙালি পাঠকের মুখে মুখে। মিসির আলীকে নিয়ে বহু উপন্যাস পরবর্তীকালে লিখেছেন হুমায়ূন ভাই। তাঁর দুটি জনপ্রিয় চরিত্রের একটি হিমু এবং অন্যটি মিসির আলী।
দেবীর পর হুমায়ূন ভাই লিখলেন নিশিথিনী। সেই উপন্যাসও জনপ্রিয়তার রেকর্ড গড়ল। আলমগীর ভাইয়ের অবসর বিশালভাবে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর তিনি করলেন প্রতীক। হুমায়ূন ভাইয়ের বহু বইয়ের প্রকাশক তিনি। খণ্ডে খণ্ডে ছাপছেন হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসসমগ্র। দশ-বারো খণ্ড বোধহয় বেরিয়ে গেছে। এখন বাংলাদেশের রুচিশীল প্রকাশনার অন্যতম অবসর ও প্রতীক। বিভিন্ন বিষয়ের অসাধারণ সব বই ছাপছেন আলমগীর ভাই। আন্তর্জাতিক মানের রান্নার বই আছে অনেক।
রান্নার বই প্রকাশের ক্ষেত্রে অন্যপ্রকাশও বড় ভূমিকা রেখেছে। অসাধারণ সব রান্নার বই প্রকাশ করেছে তারা। আর প্রোডাকশন এত চমৎকার, হাতে নিলে মনেই হয় না বাংলাদেশ থেকে এ-ধরনের বই প্রকাশ পেতে পারে!
হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে অন্যপ্রকাশের সম্পর্ক তৈরির ঘটনাটা বলি। তার আগে বোধহয় আমার নিজের কথাও কিছু বলা দরকার, অর্থাৎ অন্যপ্রকাশের সঙ্গে আমার সম্পর্ক হলো কীভাবে। সেটা হয়েছিল হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে অন্যপ্রকাশের সম্পর্কের আগে। বোধহয় ১৯৯০-৯১ সাল। নানা ধরনের দুঃখদৈন্য কাটিয়ে আমি একটু একটু করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। সেই টিনশেডের বাসা থেকে গেণ্ডারিয়ার রজনী চৌধুরী রোডের চারতলার ওপর ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে উঠেছি। ছয়-সাতশো বর্গফুটের ফ্ল্যাট হবে। পাশের ফ্ল্যাটটি আরো ছোট। কাকলি প্রকাশনীর সেলিম ভাই থাকতেন। কাকলিও খুব বড় প্রকাশনা সংস্থা এখন। সেলিম ভাই উত্তরায় ছয়তলা বাড়ি করেছেন। ওই অতটুকু ফ্ল্যাট ছেড়ে একসময় তিনি চলে গেলেন। সাহস করে ওই ফ্ল্যাটটাও আমি ভাড়া নিলাম। দুটি অতি ক্ষুদ্র কক্ষ। একটায় আমার বসার ব্যবস্থা, আরেকটায় লেখার টেবিল-চেয়ার, বুক শেলফ। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ওখানে বসে লিখি। পাশের ফ্ল্যাট থেকে চা-নাশতা পাঠান স্ত্রী। আমার কাছে কেউ এলে তাঁরাও ওখানটায়ই বসেন। আমার ওই ছোট্ট ফ্ল্যাটে বহুবার গেছেন হুমায়ূন ভাই। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এলেন একবার, সমরেশ মজুমদার এলেন দু-তিনবার, এলেন রফিক আজাদ, সৈয়দ শামসুল হকসহ অনেকেই। এক দুপুরে কলিংবেল বাজল। দরজা খুলে দেখি আবু ইসহাক দাঁড়িয়ে আছেন। দেখে আমার মনে হয়েছিল দৃশ্যটা বাস্তব, না আমি স্বপ্ন দেখছি! এত বড় একজন লেখক আমার ফ্ল্যাটে!
আবু ইসহাক সাহেবের হাতে একটা বই। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস পদ্মার পলিদ্বীপ। বইটি তিনি আমাকে উপহার দেওয়ার জন্য বাংলাবাজার থেকে ঠিকানা জোগাড় করে আমার ফ্ল্যাটে এসেছেন। সেটি আমার জীবনের একটি স্মরণীয় দিন।
পদ্মার পলিদ্বীপের প্রথম নাম ছিল মুখর মাটি। ১৯৭৬ সালে বাংলা একাডেমীর উত্তরাধিকার পত্রিকায় মুখর মাটি নামে ছাপা হচ্ছিল। পাশাপাশি ছাপা হচ্ছিল আমার প্রথম উপন্যাস যাবজ্জীবন। পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন রফিক আজাদ। বই করার সময় প্রচুর ঘষামাজা করেছেন ইসহাক সাহেব, নাম বদলেছেন। বাংলাদেশের নদী আর চরের জীবন নিয়ে পদ্মার পলিদ্বীপের মতো উপন্যাস আর একটিও লেখা হয়নি। এ-এক কালজয়ী উপন্যাস।
আমার ওই ফ্ল্যাটে একদিন এলেন চার যুবক। তাঁদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল বাংলা একাডেমীর বইমেলায়। পজিট্রন নামে একটি প্রকাশনা করেছেন। এখন অন্যদিন নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা করবেন এবং প্রকাশনা করবেন। বাংলা একাডেমীতে পরিচয়ের সময়ই আমার বই ছাপার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। তখনো তাঁদের প্রত্যেকের নাম জানা হয়নি। যেদিন আমার ফ্ল্যাটে এলেন, নাম জানলাম চারজনেরই Ñ  মাজহারুল ইসলাম, মাসুম রহমান, সিরাজুল কবির চৌধুরী (এই যুবকের ডাকনাম কমল) আর আবদুল্লাহ নাসের। তাঁরা আমার বইয়ের জন্য এসেছেন। চা খেতে খেতে মাজহার আচমকা একটা পলিথিনের শপিং ব্যাগ আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এখানে দুই লাখ টাকা আছে। একুশে ফেব্র“য়ারি বইমেলায় আপনার একটা বই চাই।’
আমি কী করব খানিকক্ষণ বুঝতেই পারলাম না। সেদিনকার আগে দুই লাখ টাকা আমি একসঙ্গে কখনো চোখেই দেখিনি। একটা বইয়ের জন্য এত টাকা অগ্রিম! এই টাকা রেখে কী করব বুঝতেই পারছিলাম না। মাজহারদের সেই টাকায় আমার জীবন ঘুরতে শুরু করেছিল।
হুমায়ূন ভাইয়ের ক্ষেত্রে আরো বড় ঘটনা ঘটালেন এই চার যুবক। হুমায়ূন ভাইয়ের ফ্ল্যাটে গিয়ে হাজির একদিন – ‘স্যার, আমরা আপনার একটা বই করব?’
হুমায়ূন ভাইয়ের ততদিনে অনেক প্রকাশক। ঈদসংখ্যার লেখা, বইমেলার লেখা, নাটক লিখছেন বিটিভিতে (তখনো স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো আসেনি)। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা। অত্যন্ত ব্যস্ত মানুষ। এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বললেন, ‘একটা বইয়ের জন্য আমাকে ১০ লাখ টাকা অগ্রিম দিতে হবে।’
তাঁরা একটু চমকালেন, চিন্তিত হলেন। সম্ভবত ’৯২-৯৩ সালের কথা। কোনো কথা না দিয়ে বেরিয়ে এলেন। হুমায়ূন ভাই ভাবলেন, যাক ঝামেলা গেছে।
হুমায়ূন ভাই তখন সিনেমা তৈরির পরিকল্পনা করছেন। বিজয়নগরের ওদিকে একটা অফিস নিয়েছেন। মাজহাররা চারজন পরদিন সেই অফিসে গিয়ে হাজির। একজনের হাতে বাজার করার চটের বড় একটা ব্যাগ। হুমায়ূন ভাইয়ের সামনে গিয়ে ব্যাগটা উপুড় করে দিলেন – ‘স্যার, এই যে ১০ লাখ টাকা। বই দেবেন কবে?’
তার পরের ইতিহাস আর বলার দরকার নেই। এখন অন্যপ্রকাশ বিশাল ব্যাপার। হুমায়ূন ভাইয়ের প্রধান প্রকাশক। বাংলা একাডেমী বইমেলায় অন্যপ্রকাশের স্টলের সামনে পৌঁছতে ২০ মিনিট থেকে আধা ঘণ্টা সময় লাগে, এমন লাইন। শুধু হুমায়ূন ভাইয়ের বইয়ের জন্য।
আমি একবার বলেছিলাম, হুমায়ূন ভাইয়ের কারণে বাংলা একাডেমীর বইমেলা একদিকে কাত হয়ে গেছে। শুনে তসলিমা নাসরিন খুব হেসেছিলেন। আমাদের মেলা কাত করা লেখক, আপনি দীর্ঘজীবী হোন।

পাঁচ
‘পদ্মা গোমতী’ বেশ নামকরা সংগঠন।
বাংলাদেশ এবং আগরতলা মিলিয়ে কার্যক্রম চলে সংগঠনের। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ‘পদ্মা গোমতী’র সভাপতি ড. আনিসুজ্জামান আর আগরতলার হচ্ছেন অনিল ভট্টাচার্য। এই সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ত্রিপুরা দর্পণ পত্রিকার সম্পাদক সমীরণ দত্ত, কবি রাতুল দেববর্মণ প্রমুখ। রাতুল দেববর্মণ বিখ্যাত দেববর্মণ পরিবারের লোক। শচীন দেববর্মণ ও রাহুল দেববর্মণ আলোকিত করেছেন যে-পরিবার। শচীনকর্তার স্ত্রী মীরা দেববর্মণও কম বিখ্যাত নন। কী অসাধারণ সব গান লিখেছেন! আর শচীনকর্তার গানের কথা না-ই বা বললাম। বাংলা গানে সম্পূর্ণ আলাদা একটি ঘরানা সৃষ্টি করেছেন তিনি। সুরের মায়ায় এবং কণ্ঠের জাদুতে শচীনকর্তা বাঙালি সংগীতপ্রেমীদের হƒদয়ে চিরকালীন জায়গা করে নিয়েছেন। বাঙাল মুলুক ছাড়িয়ে বোম্বেতে (আজকের মুম্বাই) পাড়ি জমালেন। হিন্দি গানের জগতেও হয়ে উঠলেন কিংবদন্তি। এমনসব বিখ্যাত ও হিট ছবির সুর করলেন, উপমহাদেশ মাতিয়ে দিলেন। লতা মুঙ্গেশকর, মোহাম্মদ রফি, কিশোরকুমার – আরো কত কত গায়ক তাঁর সুর করা গান গেয়ে জগৎ জয় করলেন! শচীন দেববর্মণের সুর করা বহু হিন্দি ছবি থেকে দুটোর কথা বলি। একটি ছবির নাম অমর প্রেম। অভিনয় করলেন রাজেশ খান্না ও শর্মিলা ঠাকুর। কিশোরকুমার তাঁর অসাধারণ কণ্ঠে গাইলেন হƒদয় তোলপাড় করা গান। মূল গল্প বাংলা সাহিত্যের তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের একজন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। কী অসাধারণ প্রেমের গল্প, কী অসাধারণ প্রেমের ছবি! আরেকটি ছবির নাম গাইড। ভারতীয় ইংরেজি ভাষার লেখক আর কে নারায়ণের গল্প, অভিনয় করলেন দেব আনন্দ ও ওয়াহিদা রেহমান। গানগুলোর কোনো তুলনা হয় না। দুটো ছবিতেই শচীনকর্তা নিজের কণ্ঠ সামান্য একটু ব্যবহার করলেন। অমর প্রেমের গানটির একটি লাইন আমার মনে পড়ছে, ‘ও মাইয়ারে…’। গাইডে দু-তিন লাইনে তিনি গেয়েছিলেন গ্রামবাংলার বিখ্যাত সেই গান –
আল্লাহ মেঘ দে পানি দে
ছায়া দে রে তুই
শচীন দেববর্মণ হিন্দিতে করলেন –
মেঘ দে পানি দে
ছায়া দে রে তু রামা মেঘ দে
এখনো কানে লেগে আছে সেই সুর।
তাঁর একটি বিখ্যাত গান (আসলে বিখ্যাত বিখ্যাত বারবার বলা ঠিক হচ্ছে না। শচীনকর্তার সব গানই বিখ্যাত) –
বাজে তাকদুম তাকদুম বাজে
বাজে ভাঙা ঢোল
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এই গানের লাইন বদলে তিনি গাইলেন –
বাজে তাকদুম তাকদুম বাজে
বাংলাদেশের ঢোল
সব ভুলে যাই তাও ভুলি না বাংলা মায়ের কোল।
আমার বহুদিনের শখ ছিল একবার আগরতলায় যাব, শচীনকর্তার বাড়িটা দেখে আসব। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ অনেকখানি সংগঠিত হয়েছিল আগরতলায়। শরণার্থী ক্যাম্প হয়েছিল, মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনিং নিয়েছিলেন। লাখ লাখ বাঙালি ১৯৭১-এ আশ্রয় নিয়েছিলেন আগরতলায়। আগরতলাটা একবার দেখতেই হবে।
২০০৪ সালে সেই সুযোগ হলো।
‘পদ্মা গোমতী’ সংগঠন আমন্ত্রণ জানাল হুমায়ূন আহমেদকে। তাঁর সঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক শফি আহমেদ, প্রকাশক আলমগীর রহমান, মাজহারুল ইসলাম এবং আমাকে। হুমায়ূন ভাই দলবল ছাড়া চলতে পারেন না। তাঁর প্রিয় বন্ধু আর্কিটেক্ট আবু করিমকে নিলেন সপরিবারে, অন্যপ্রকাশের কমল আর তাঁর স্ত্রী, মাজহারও সস্ত্রীক। তখন তাঁর বড় ছেলে অমিয় খুব ছোট। শাওন তখনো মা হননি। বেশ বড় রকমের একটা বহর আমরা রওনা দিলাম। কমলাপুর থেকে বাসে করে লাকসাম। বর্ডারের বাংলাদেশ অংশের কর্মকর্তারা খুবই খাতির করে চা-নাশতা খাওয়ালেন আমাদের। তারপর বর্ডার ক্রস করলাম। ওপারে দেখি রাতুল দেববর্মণের সঙ্গে অনিল ভট্টাচার্য, সমীরণ দত্ত আর আমাদের শফি ভাই। তিনি দুদিন আগেই আগরতলায় পৌঁছে গেছেন। আমাদের এগিয়ে নিতে আসছেন বর্ডারে।
শফি আহমেদের আমি বিশেষ ভক্ত। বিচ্ছিন্নভাবে তাঁর লেখা পড়েছি। বেশিরভাগই প্রবন্ধ। মুগ্ধ হলাম যে-বই পড়ে, সে-বইয়ের নাম মুক্তো। জন স্টাইনবেকের পার্লের অনুবাদ। এত স্বচ্ছ সুন্দর প্রাঞ্জল অনুবাদ আমি কমই পড়েছি। আর শফি ভাই এত ভালো মানুষ, এত হাসিমুখের মানুষ, কী বলব। হুমায়ূন ভাইও তাঁকে খুব পছন্দ করেন। নিজের পছন্দের মানুষদের নানাভাবে খুঁচিয়ে আনন্দ পান তিনি, অদ্ভুত অদ্ভুত নামে ডেকে আনন্দ পান। শফি ভাই ভগবান কৃষ্ণের রংটি পেয়েছেন। হুমায়ূন ভাই তাঁকে ডাকেন ‘কালো বুদ্ধিজীবী’।
আমি সাহিত্য নিয়ে কঠিন কঠিন চিন্তাভাবনা করি, হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়ের প্রথমদিককার কথা। তখন মুগ্ধ হয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পড়ছি। সাহিত্যের আলোচনা উঠলেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়ে কথা বলি। হুমায়ূন ভাই বইমেলায় আমাকে তাঁর ফেরা উপন্যাসটি উপহার দিলেন। অটোগ্রাফের জায়গায় লিখলেন ‘আমাদের মানিকবাবুকে’।
আগরতলা কুমিল্লার মতো শহর। একেবারেই সাদামাটা, মফস্বল। শান্ত িস্নধ সরল টাইপের জীবন মানুষের। কোথাও কোনো হুড়োহুড়ি নেই, সন্ত্রাস মাস্তানি খুনখারাবি নেই। শান্তিময় পরিবেশ চারদিকে। অন্যদের কী হলো জানি না, আগরতলায় ঢুকেই আমার মন ভালো হয়ে গেল। এই সেই আগরতলা, এখানকার জমিদার রবীন্দ্রনাথকে মাথায় তুলে রেখেছিলেন। এই সেই আগরতলা, এখানে বসবাস করতেন শচীন দেববর্মণ। এই সেই আগরতলা, আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় গৌরব মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা সংগ্রামে যে-আগরতলার অবদান ইতিহাসের পাতা উজ্জ্বল করে থাকবে।
আগরতলায় তখন একটা বইমেলা চলছে। বিকেলবেলা সদলবলে বইমেলায় গেলাম আমরা। বিশাল এলাকাজুড়ে বইমেলা। আমাদের বাংলা একাডেমী বইমেলার মতো ভিড় ধাক্কাধাক্কি নেই। লোকজন কম। ঘুরে ঘুরে বইপত্র দেখছে, কিনছে।
একদিন বইমেলার স্টেজে উঠলাম আমরা। বাংলাদেশি লেখক প্রকাশক। হুমায়ূন ভাই তাঁর স্বভাবসুলভ মজার ভঙ্গিতে বক্তৃতা দিলেন। আমাদের দিনগুলো কাটছিল এদিক-ওদিক ঘুরে। বড় একটা মাইক্রোবাস দেওয়া হয়েছে ঘুরে বেড়ানোর জন্য। গাইড আছে সঙ্গে। আমরা এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়িয়ে দিন কাটাচ্ছি। দর্শনীয় জায়গাগুলো দেখছি।
প্রথম দিন বেড়িয়ে ফেরার পর মাইক্রোবাসের ড্রাইভারকে একশ রুপি অফার করলেন হুমায়ূন ভাই। লোকটি অবাক। ‘কিসের টাকা, দাদা?’
‘আপনি চা-টা খাবেন।’
‘না না, টাকা আমি নেব না।’
‘কেন?’
‘এই ডিউটি করার জন্য সরকার আমাকে মাইনে দিচ্ছে। আমি আপনার টাকা নেব কেন?’
আমরা হতভম্ব!
আগরতলার ‘নীরমহল’ খুব বিখ্যাত পর্যটনকেন্দ্র। চারদিকে পানি, মাঝখানে জমিদারবাড়ি। সেটাই এখন পর্যটনকেন্দ্র। স্পিডবোটে করে যেতে হয়। একটা রাত ওখানে কাটালাম আমরা।
আগরতলায় আমার সঙ্গে অদ্ভুত এক মজা করলেন হুমায়ূন ভাই। এমন লজ্জার মধ্যে ফেললেন আমাকে, আমি একেবারে চুপসে গেলাম।
ঘটনা হলো কি, ‘পদ্মা গোমতী’ থেকে আমাদের সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে একটি হলে। সন্ধ্যার পর বেশ ভালো আয়োজন করা হয়েছে। রাতুল দেববর্মণ, অনিল ভট্টাচার্য, সমীরণ দত্ত বক্তব্য দিলেন। একে একে আমাদের উত্তরীয় পরানো হলো। আগরতলার কিছু সুধীজন আর আমাদের পুরো দল। মাজহারের ছেলে অমিয় তখন আড়াই-তিন বছরের। ওই বয়সী শিশু যেমন হয় তেমনই। চঞ্চল, ছটফটে। এই এদিকে ছুটছে, এই ওদিকে ছুটছে। মাজহারের স্ত্রী স্বর্ণা চমৎকার মেয়ে। সে আপ্রাণ চেষ্টা করছে ছেলেকে সামলাতে। দুরন্ত শিশুটির সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। শিশুটি তো আর সাহিত্য কিংবা হুমায়ূন আহমেদ বোঝে না, আগরতলা কিংবা ‘পদ্মা গোমতী’ বোঝে না। সে তার মতো কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কেউ কিছু ভাবছেও না, মনেও করছে না। হুমায়ূন ভাই খেয়াল করছিলেন অমিয়র দুরন্তপনা। আমি তাঁর পাশে বসে আছি। আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন, ‘একটা কাজ করব নাকি?’
‘কী?’
‘অমিয়কে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দেব নাকি?’ (একেবারেই মজা করা অর্থে। কোনো শিশুর গায়ে হুমায়ূন আহমেদ হাত তুলবেন, ভাবাই যায় না)
আমি থতমত খেয়ে হুমায়ূন ভাইয়ের মুখের দিকে তাকালাম। ‘কী বলছেন, হুমায়ূন ভাই!’
‘তার মানে তুমি থাপ্পড় মারতে না করছ?’
‘আরে!’
ওই পর্যন্তই। অনুষ্ঠান শেষ হলো। খাওয়া-দাওয়া শেষ হলো। আমরা আড্ডা দিতে বসছি, হুমায়ূন ভাই গম্ভীর গলায় মাজহারকে ডাকলেন। ‘শোনো মাজহার। একটা কথা তোমাকে না বলে পারছি না।’
মাজহার তটস্থ। ‘কী কথা স্যার?’
‘গোপন কথা। বলা উচিত না। তবু বলছি। এইটুকু একটা শিশু, তার ব্যাপারে… মানে আমি অমিয়র কথা বলছি।’
‘কী হয়েছে স্যার?’
‘মিলন তোমার ছেলেকে থাপ্পড় মারতে চেয়েছে।’
আমি আকাশ থেকে পড়লাম। হায় হায়, বলে কী! নিজে ওরকম একটা প্ল্যান করে এখন আমার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন সব!
আমার মুখে আর কথা জোটে না। কী বলবো? দলের সবাই এ-ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। স্বর্ণা একপলক আমার দিকে তাকিয়ে মুখ নিচু করেছে। মাজহার স্বাভাবিক কারণেই গম্ভীর। আমি কীভাবে তাদেরকে বোঝাবো ঘটনা পুরো উলটো। একটা সময়ে অবশ্য সবাই বুঝে গেল এটা হুমায়ূন ভাইয়ের রসিকতা। তবে তারপর যে কদিন আমরা আগরতলায় ছিলাম সে কদিন তো বটেই, ঢাকায় ফিরেও হুমায়ূন ভাই মাঝে মাঝে বলতেন, ‘তোমার ছেলেকে থাপ্পড় মারতে চাইলো মিলন, আর তুমি তাকে কিছুই বললে না মাজহার!’
অমিয় এখন বড় হয়েছে। মাজহার স্বর্ণার সংসার উজ্জ্বল করে আরেকজন অমিয় এসেছে। এখনো অমিয়র দিকে তাকালে আগরতলার সেই ঘটনা আমার মনে পড়ে। যতদিন বেঁচে থাকবো, অমিয়কে দেখলেই ঘটনাটা আমার মনে পড়বে।
সেদিনকার সেই অনুষ্ঠানে খালি গলায় চমৎকার দু-তিনটা গান গেয়েছিল শাওন। আমরা তো আগে থেকেই শাওনের গানে মুগ্ধ, আগরতলার সুধীজনরাও মুগ্ধ হয়েছিলেন।
আগরতলায় শচীন দেববর্মণের বাড়ি আমরা দেখেছিলাম, বইমেলা যেখানে হচ্ছিল সেই সড়কটির নাম ‘শচীন দেববর্মণ সড়ক’। এক নির্জন দুপুরে সেই সড়কের দিকে তাকিয়ে আমার মনে পড়ছিল, ‘তুমি যে গিয়াছো বকুল বিছানো পথে।’