ভূমিকা ও অনুবাদ : সুরেশ রঞ্জন বসাক
ভূমিকা
হেলেন টিফিন ইংরেজি, মিডিয়া স্টাডিজ ও শিল্প ইতিহাসের অধ্যাপক এবং উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্ব ও সাহিত্য অধ্যয়নের বিশিষ্ট তাত্ত্বিক। বিল অ্যাশক্রফট ও গারেথ গ্রিফিথের সঙ্গে তাঁর সহ-সম্পাদিত The Post-Colonial Studies Reader, The Empire Writes Back : Theory and Practice in Post-Colonial Literatures, এবং Key Concepts in Post-Colonial Studies, এবং ডায়ানা ব্রাইডনের সঙ্গে সহসম্পাদিত Decolonising Fictions : Comparative Studies in Post-Colonial Literature উত্তর-উপনিবেশিক সাহিত্যতত্ত্বের আকরগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। তাছাড়া গ্রায়াম হাগান, গিলাম হুইটলক, স্টিভেন সেøমনের সঙ্গে সহসম্পাদিত বইগুলিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমার মনে হয়েছে, (সহ-সম্পাদক ইয়ান আডাম) Past the Last Post : Theorizing Post-Colonialism and Post-Modernism ঢের বেশি আকরগ্রন্থ, বিশেষ করে এর leitmotif-এর জন্যে, যা হেলেন টিফিনের ভাষায়, ÒThis is the first book to seek to characterize post-modernist and
post-colonial discourses in relation to each other, and to chart their interesting and diverging trajectories” (p vii). ‘Post-Colonial Literatures and Counter-DiscourseÕ শিরোনামের বর্তমান প্রবন্ধটি দ্য পোস্ট-কলোনিয়াল স্টাডিজ
রিডার-এর চৌদ্দ নম্বর প্রবন্ধ। নানা কারণে প্রবন্ধটি তাৎপর্যপূর্ণ।
জর্জ লেমিংয়ের পর্যবেক্ষণ দিয়ে প্রবন্ধের শুরু। সমসাময়িক বিশ্বের চার ভাগের তিন ভাগ মানুষকে সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ – তত্ত্ব নয়, প্রয়োগ হিসেবে – প্রত্যক্ষভাবে এবং সুগভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। আমরা জানি, উপনিবেশায়নের কালে সমাজ-রাজনীতি-শিল্প সাহিত্য-সংস্কৃতির শেকড়চ্যুতি ঘটেছিল, চিন্তা ও মননসহ সর্বক্ষেত্রে সংকরায়ন ঘটেছিল, ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক আখ্যানকে প্রধান ও একমাত্র কুলীন আখ্যান হিসেবে উপনিবেশিত-মানসে সুগভীর প্রোথিত করা হয়েছিল। বি-উপনিবেশিকায়নের দিন এসে গেলে, দেখা গেল, একদিকে এসবকে সমূলে উৎপাটন ও ছুড়ে ফেলে ঔপনিবেশিকতার স্পর্শমুক্ত অতীতকে যতটা পারা যায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা শুরু হলো, অন্যদিকে শুরু হলো সাহিত্য সংস্কৃতি ইতিহাসে এতদিনের আরোপিত ঔপনিবেশিক আখ্যানের বিপরীতে নতুন করে পাঠ ও নতুন করে উপনিবেশোত্তর
প্রতি-আখ্যান লেখার উদ্যোগ। পুনর্নির্মাণ-কৌশলে ইউরোপীয় প্রামাণিক টেক্সটগুলিকে বর্জন না করে শুদ্ধায়ন (Ôconsume’ their ‘biasesÕ) করার চেষ্টাও দৃশ্যমান হতে থাকে। এ চেষ্টাকে আমরা এলিট শ্রেণির টেক্সটের বি-উপনিবেশায়ন বলতে পারি।
হেলেন টিফিনের মতে, এইসব কৌশলের ভেতরে কমনওয়েলথ সাহিত্য বা নিউ রাইটিংয়ের মতো মডেলগুলিতে চেতন বা অচেতন, স্পষ্ট বা উহ্য, যেভাবে হোক না কেন, মূলধারার ব্রিটিশ সাহিত্যেরই চর্চা অব্যাহত থাকে। তাই প্রাগুক্ত দুই ধারা নয়, বরং তৃতীয় একটি ধারার ওপর হেলেন টিফিন জোর দিয়েছেন। সেটি হলো, নির্দিষ্ট ঔপনিবেশিক টেক্সটের বিপরীতে, অনেকটা প্রত্যুত্তরের মতো, উত্তর-ঔপনিবেশিক টেক্সট রচনার শিল্প-কৌশল, যা কনরাডের Heart of Darkness-এর উত্তরে আচেবের Things Fall Apart লেখার মতো। টিফিন এ-প্রবন্ধে উত্তর-ঔপনিবেশিক ‘রাইটিং ব্যাক’-এর দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখিয়েছেন শার্লোট ব্রন্টির Jane Eyre-এর উত্তরে জিন রিসের লেখা Wide Sargasso Sea এবং ড্যানিয়েল ডিফোর Robinson Crusoe-এর প্রত্যুত্তরে লেখা স্যামুয়েল সেলভনের Moses Ascending এবং জে. এম. কুটজিয়ার Foe – উপন্যাসত্রয়ীকে। এদের প্রতিটি টেক্সট একটি ব্রিটিশ ক্যানোনিক্যাল টেক্সটকে বেছে নিয়ে ওই টেক্সটের বিপরীতে
কাউন্টার-টেক্সট, আখ্যানের (discourse) বিপরীতে প্রতি-আখ্যান (counter-discourse) উপস্থাপন করেছে।
হেলেন টিফিন এ-প্রবন্ধে দেখাতে চেয়েছেন, উপর্যুক্ত উপন্যাসগুলি তথাকথিত প্রামাণিক টেক্সটের সর্বজনীনত্বের ধারণাকে নস্যাৎ করে কিভাবে উত্তর-উপনিবেশবাদী প্রতি-আখ্যান তুলে ধরেছে। এই ধারায় একজন উত্তর-উপনিবেশিক লেখক উপনিবেশিক ঘরানার প্রামাণিক কোনো একটি টেক্সটের অন্তস্থ ভাব বা চরিত্র নিয়ে তাকে ‘অপরাপরের’ (others) অবস্থান থেকে প্রতি-আখ্যান সৃষ্টি করেন। আর এভাবে পাশা উল্টে দিয়ে (subversion) Wide Sargasso Sea-এ অ্যান্টায়েনেটের বয়ানই মুখ্য হয়ে ওঠে, জেইনের নয়। Foe-এ বিগত-ঐশ্বর্য, নিষ্কর্মা, অল্প-কথার ক্রুসো (Ôa man of few wordsÕ) অপ্রধান হয়ে ওঠে, আর ফ্রাইডের (Ôa man of few wordsÕ) ‘বাকহীনতা’ই হয়ে ওঠে প্রতিপাদ্য বিষয়। ডিফোতে ভাষা ও ক্ষমতার রসায়নের উপস্থিতি এবং কুটজিতে তার অনুপস্থিতি বুঝিয়ে দেয়, উত্তর-উপনিবেশিক সাহিত্য উপনিবেশবাদের প্রতিক্রিয়াজাত শূন্যতা সর্বাংশে কাটিয়ে উঠতে পারে না। প্রাচীন লেখক ডিফোর আত্মাকে নব্য লেখক ফো তাঁর ঘাড় থেকে নামাতে পারেন না। কুটজিয়ার ফো সম্পর্কে মাইকেল বয়েডের পর্যবেক্ষণটি এখানে প্রণিধানযোগ্য, ÔHis (Coetzee) creation remains trapped in an intertextual prisonÕ (পৃ ৩৭)। তাই অনস্বীকার্য যে, উত্তর-উপনিবেশিক সাহিত্যগুলি ‘উত্তর’ উপসর্গ যোগ করে যতই বিউপনিবেশায়নের ধারণা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করুক না কেন, ‘কলোনিয়াল’ – মূল শব্দটিকে তারা এখনো পরিহার করার পর্যায়ে আসেনি।
তথ্যসূত্র : Michael Boyd, The Reflexive Novel : Fiction as Critique (Lewisburg : Bucknell University Press, 1983)
মূল
জর্জ লেমিং একদা অভিমত দিয়েছিলেন, সমসাময়িক বিশ্বের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি ভূখণ্ড সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের দ্বারা প্রত্যক্ষ এবং গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছে …। বিউপনিবেশায়নের শিল্প-সাহিত্য-নির্ভর প্রক্রিয়াসমূহ ইউরোপীয় চিহ্নায়কগুলিকে সমূলে উৎপাটন এবং ইউরোপীয় প্রধান আখ্যানগুলিকে উত্তর-উপনিবেশিক চেতনায় অগ্রাহ্য ও বিলোপ করার কাজে নিয়োজিত থেকেছে। এর সঙ্গে প্রায় সময় যুক্ত হয়েছে, সব ধরনের ঔপনিবেশিক কলঙ্কমুক্ত একেবারে সম্পূর্ণরূপে নতুন বা অতীত থেকে সম্পূর্ণ পুনরুদ্ধারকৃত ‘বাস্তবতা’র দাবি। নির্মমতার অতিমারি ও সাংস্কৃতিক কালিমা লেপনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে উপনিবেশক ও উপনিবেশিতের মধ্যে সম্পর্কের প্রকৃতি বিবেচনায় নিলে সেরকম দাবি কাঙ্ক্ষিত ও অবশ্যম্ভাবী বটে। কিন্তু এই প্রকল্পে সহজাত স্ববিরোধিতা রয়েছে, যেমন চিনুয়েইজু, জেমি ও মাদুবুইক The Decolonization of African Literature (চিনুয়েইজু ও অন্যান্য, ১৯৮৫)-এ দেখাতে চেয়েছেন যে, সেরকম উপনিবেশপূর্ব সাংস্কৃতিক শুদ্ধতা কখনো সম্পূর্ণভাবে ফিরে পাওয়া যাবে না।
উত্তর-উপনিবেশিক সংস্কৃতিগুলি অবধারিতভাবে সংকরায়িত হয়ে গেছে, কারণ, এই সংকরায়নের পেছনে কাজ করেছে ইউরোপীয় সত্তাতত্ত্ব ও জ্ঞানতত্ত্বের সঙ্গে স্বাধীন স্থানিক আত্মপরিচয় সৃষ্টি করা বা প্রাক্তন আত্মপরিচয়কে ফিরিয়ে আনার আবেগের মধ্যেকার দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক। বিউপনিবেশায়নের একটি প্রক্রিয়া, কোনো আগত বস্তু নয়; এটি আধিপত্যবাদী মধ্যপন্থী সিস্টেমস এবং প্রান্তিক অবস্থান থেকে সেগুলিকে অগ্রাহ্য করার চলমান দ্বান্দ্বিকতাকে নির্দেশ করে; একদিকে, ইউরোপীয় বা ব্রিটিশ আখ্যানসমূহ এবং অন্যদিকে, উত্তর-ঔপনিবেশিক কালে সেগুলিকে ভেঙে ফেলার চেষ্টার মধ্যে এই অগ্রাহ্য করা দ্বান্দ্বিকতা চলতে থাকে। যেহেতু ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসনের ঐতিহাসিক পরিণাম থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে জাতীয় বা আঞ্চলিক কাঠামো সৃজন বা পুনঃসৃজন করা সম্ভব নয়, তাই দুই বিশ্বের ভেতর থেকে (বা দুয়ের মাঝামাঝি থেকে), একটি প্রাধিকারের অবস্থানে দাঁড়িয়ে, উত্তর-উপনিবেশিক লেখালেখি ইউরোপীয় আখ্যানগুলিকে এবং তাদের আখ্যানগত কৌশলগুলিকে প্রশ্ন করার কর্মকৌশল বেছে নিয়েছে। এবং বিশ্বের অধিকাংশ জায়গায় ইউরোপ উপনিবেশিক আধিপত্য বিস্তারের জন্যে যে-পদ্ধতি চাপিয়ে দিয়েছিল এবং নির্দিষ্ট বিধিমালা দিয়ে তা বহাল রেখেছিল, তার অন্বেষণ করছে
উত্তর-উপনিবেশিক সাহিত্য।
আর এভাবে ইউরোপীয় ঐতিহাসিক ও কল্পনাশ্রয়ী দলিল-দস্তাবেজগুলি পুনর্পাঠ ও পুনর্লিখন গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য দায়িত্ব হয়ে উঠেছে। যা কিছু প্রকৃতই জাতীয় বা আঞ্চলিক, তা গঠন বা পুনর্গঠনের চেয়েও সেসব আখ্যানের উৎখাত-কর্মই
উত্তর-উপনিবেশিক টেক্সটের বৈশিষ্ট্য। এই নাশকতাবাদ হয়ে উঠেছে গড়পড়তা উত্তর-উপনিবেশিক আখ্যানের উপাদান। এভাবে উত্তর-উপনিবেশিক সাহিত্য/ সংস্কৃতিগুলি একই ধরনের চর্চার চেয়েও প্রতি-আখ্যানে আকীর্ণ হয়ে আছে, এবং তারা প্রধান আখ্যানের বিপরীতে অতি-অপ্রাসঙ্গিক কৌশল-সমৃদ্ধ ‘অধ্যয়ন ক্ষেত্র’ উপহার দিয়েছে (Lee 1977: 32-3)।
উত্তর-উপনিবেশিক প্রতি-আখ্যানের ক্রিয়াপদ্ধতি (Terdiman 1985) গতিময়, স্থবির নয়; এটি প্রধান আখ্যানের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্যে পাশা উল্টে দেয় না। উইলসন হ্যারিসের ধারণা-সূত্রানুসারে, বরং পাঠগত কৌশলের বিকাশ ঘটিয়ে ‘নিজেদের পক্ষপাতসমূহ’কে ‘অবিরতভাবে’ নিঃশেষ করে দেয় (Harris 1985:127), যা একইসঙ্গে প্রধান আখ্যানকে উন্মোচিত করে এবং ধীরে ধীরে ক্ষইয়ে দেয়…।
সাহিত্যের সর্বজনীনতার ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতে গিয়ে (অথবা, উত্তর-উপনিবেশবাদী অনুশীলন ও তত্ত্বকে উত্তর-আধুনিক বা উত্তর-কাঠামোবাদী বলে চালিয়ে দেওয়া ইউরোপীয় আত্মসাৎকরণকে চ্যালেঞ্জ করতে গিয়ে) উত্তর-উপনিবেশিক লেখক ও সমালোচকেরা প্রতি-আখ্যানে নিয়োজিত হয়ে পড়েন। কিন্তু, ‘কমনওয়েলথ লিটারেচার’ বা ‘নিউ রাইটিং ইন ইংলিশ’-এর মতো ভিন্ন মডেল অস্পষ্ট বা স্পষ্টভাবে ‘মূলধারার’ ব্রিটিশ সাহিত্যকে হয় অনুসরণ করে কিংবা সে-সাহিত্য থেকে উদ্ভূত হয় বিধায় সচেতনভাবে বা অচেতনভাবে পুনরায় সেসব আধিপত্যবাদী ধারণাকে আবাহন করে, যাদের বিরুদ্ধে জন্ম থেকেই উত্তর-উপনিবেশিক টেক্সট পথপরিক্রমা শুরু করেছিল। যেসব মডেল একই উপনিবেশিক ভাষা ও অভিজ্ঞতায় অতীতের সহযাত্রীত্বের ওপর গুরুত্ব দেয় (এবং এটা জেনেই যে, স্থান থেকে স্থানান্তরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রকাশভঙ্গিতে বিপুল ফারাক ছিল), তারাই পাল্টা-আখ্যানের কৌশল গ্রহণ করে। যদি গুরুত্বটি পাল্টা-অপ্রাসঙ্গিক কর্মচর্চার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা না হয়, তাহলে ওসব মডেলের নিজেদেরই উপনিবেশক হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। বিশেষ করে, আফ্রিকান সমালোচক ও লেখকেরা স্পষ্টত নব্য-আত্তীকরণমূলক উৎসে ফেরার অভীষ্ট দেখে এসব মডেলকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা তার পরিবর্তে জাতীয়তাবাদ বা প্যান আফ্রিকানকে বেছে নিয়েছে। অধিকাংশ উত্তর-উপনিবেশিক সাহিত্যের পেছনে ক্রিয়াশীল আবেগকে যদি আখ্যানের উত্তরে আখ্যান হিসেবে দেখা হয়, এবং যদি মেনে নেওয়া হয় যে, উদ্ভূত কৌশলগুলি বিভিন্ন সংস্কৃতিতে বিভিন্ন রূপ নিতে পারে, তাহলে আমার মনে হয়, প্রান্তিকীকরণের ওপর প্রতিষ্ঠিত জাতীয়, জাতিগত বা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী গঠনের চাইতেও সন্তোষজনক মডেল আমাদের রয়েছে, যা আগেকার সামষ্টিক মডেল ও দৃষ্টান্তসমূহের (paradigms) ত্রুটিগুলিকে এড়িয়ে যেতে পারে। অধিকন্তু, এমন একটা মডেল কার্যকর হতে পারে, যেমন ধরা যাক অস্ট্রেলিয়ানদের ক্ষেত্রে, যারা অদ্যাবধি ইউরোপ এবং ইউরোপীয় ভাবাদর্শ দ্বারা উপনিবেশিত, তারাই আবার তাদের আদি অধিবাসীদের সঙ্গে অবিরাম উপনিবেশকের ভূমিকা পালন করছে। এই মডেলে অভিযানোত্তর সব লেখালেখি ও মৌখিক সাহিত্যকে ‘অস্ট্রেলিয়ান’ প্রধান আখ্যানের বিপরীতে প্রতি-আখ্যান হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে, যা আবার অস্ট্রেলীয় আখ্যানের জন্মদাতা ইউরোপীয় আখ্যানেরও প্রতি-আখ্যান। এই মডেল নিয়ে আমি পরে আলোচনা করছি জে. এম. কুটজির Foe-এর আলোকে। এ-উপন্যাসে তিনি কৃষ্ণাঙ্গ সংখ্যাগুরুদের ওপর শোষণ-নির্যাতনের সঙ্গে শ্বেতাঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকার বসতকারীদের সাহিত্যের সম্পর্কের সমস্যা পর্যবেক্ষণ করেছেন…।
ভবিষ্যৎ উত্তর-উপনিবেশিক অধ্যয়ন-চর্চার জন্যে কমপক্ষে দুটো (সেগুলিকে পরস্পর বিনিময়যোগ্য হতে হবে, এমন কথা নেই) মডেল সূত্রবদ্ধ করা যেতে পারে। প্রথমত, যুক্তি উপস্থাপন করা যেতে পারে, একটি টেক্সটের উত্তর-ঔপনিবেশিকতা এর আখ্যানগত বৈশিষ্ট্যসমূহের ভেতরে, এবং দ্বিতীয়ত, বস্তুগত পরিস্থিতির সঙ্গে এর নির্ণায়ক সম্পর্কসমূহের পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যমান থাকে। প্রথম প্রস্তাবের বিপদ হলো, এতে উত্তর-ঔপনিবেশিকতা একগুচ্ছ অবস্থিতিহীন পঠনচর্চায় পর্যবসিত হতে পারে। দ্বিতীয়টির বিপদ হলো, এতে অপরিহার্যতাবাদের ছদ্মরূপে পুনঃপ্রবর্তন ঘটতে পারে। ইত্যাকার সম্ভাব্য ভ্রান্তি এড়াতে আমি এই দুটোকে যুক্ত করে একটি সুউচ্চ মডেলের আলোকে দুটো টেক্সটের আলোচনা করবো এবং প্রতি-আখ্যানের কৌশলাদির ওপর গুরুত্ব দেবো, যেগুলি উত্তর-উপনিবেশিক পাঠ-চর্চায় বা চর্চাসমূহের ক্ষেত্রে সাধারণ্যে অধিকতর সহায়ক হয়ে থাকে। তবে হ্যাঁ, এসব চর্চা রাজনীতিতে প্রোথিত; এদের উৎপাদনের স্থান ও ব্যবহারের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে রয়েছে তাদের উৎপাদিত মর্মার্থ। উত্তর-ঔপনিবেশিক লেখালেখিতে যোগাযোগ/ আদান-প্রদানের ক্ষেত্রটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ, এবং এই ক্ষেত্রই এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সীমানা-নির্ধারণকারী বৈশিষ্ট্য…।
প্রতি-আখ্যানের বৃহৎ পরিসরে অনেক উপগোষ্ঠীর পদচারণা সম্ভব এবং তাদের নিয়ে এখন পর্যালোচনা চলছে। এগুলির মধ্যে একটি ‘জাদু বাস্তবতা’ – যা উত্তর-উপনিবেশিক আখ্যান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে (দেখুন Dash 1974; Slemon 1987)। তেমন আরেকটি গোষ্ঠী – রঙ্গ-রগড় মার্কা পিকারেস্কের মতো ইউরোপীয় মেলাকেন্দ্রিক আনন্দোৎসব (carnivalesque) ঘরানার সাহিত্য-মাধ্যমকে উত্তর-ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটে স্থাপন/ প্রতিস্থাপন, যেখানে তারা প্রচলিত আখ্যানকে তাদের ধ্বংসাত্মক শক্তিবলে অগ্রাহ্য ও পরাভূত করতে পারে। স্টিভেন স্লেমন দেখিয়েছেন, উপনিবেশবিরোধী বা উত্তর-উপনিবেশিক আখ্যানে, প্রাধিকারের অবস্থান থেকে, রূপক কিভাবে খুব কার্যকর একটি মাধ্যম হতে পারে (Slemon 1986, 1988b)।
কিন্তু যে বিশেষ উত্তর-ঔপনিবেশিক প্রতি-আখ্যান নিয়ে আমি কাজ করতে চাই, তাকে আমি প্রামাণিক প্রতি-আখ্যান (canonical counter-discourse) নামে ডাকতে চাই। এই কৌশল জিন রিসের Wide Sargasso
Sea-এর মতো টেক্সটগুলির মাধ্যমে বোধ করি সবচেয়ে বেশি পরিচিতি পেয়েছে। এটি এমন একটি টেক্সট যেখানে একজন উপনিবেশোত্তর লেখক একটি প্রামাণিক ব্রিটিশ টেক্সট থেকে একটি বা একাধিক চরিত্র বা মৌলিক ধারণা হাওলাত নিয়ে সেসব ধারণাকে উন্মোচন করেন এবং উত্তর-উপনিবেশিক অভীষ্ট নিয়ে সেই টেক্সটের পাশা উল্টে দেন। উত্তর-উপনিবেশিক বিশ্বে পাঠ্যতার (textuality) আখ্যানগত দায়িত্ব সম্পর্কে এখানে একটি জরুরি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। ইউরোপীয় টেক্সটগুলি সেসব বিশ্বকে ধারণ করে, অতঃপর তাদের জ্ঞানীয় সংকেত-পদ্ধতির আলোকে সেসব বিশ্বকে আত্তীকরণ করে তাদের (প্রাগুক্ত বিশ্বের) অপরত্ব (alterity) ‘অধ্যয়ন’ করেছে। অভিযাত্রীদের রোজনামচা, নাটক, গল্প-উপন্যাস, ঐতিহাসিক বিবরণ, ‘মানচিত্রায়ন’ ইত্যাদি দেশ জয়, উপনিবেশায়ন, দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা এবং/অথবা অপরত্বের নিন্দাবাদ প্রচারে সহায়তা করেছে। অথচ প্রায় সময় উপর্যুক্ত যেসব টেক্সট বস্তুগত ও আত্মিক দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল, সেগুলিকেই ইউরোপীয় শিক্ষাব্যবস্থায় উপনিবেশিতদের ওপর ‘বিশ্বজনীন’ বিষয়ভিত্তিক ‘মহান’ সাহিত্য বলে চালিয়ে দিয়ে – চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর, এই সাহিত্যের সাংস্কৃতিকভাবে সংজ্ঞায়িত সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রকে উপনিবেশিত প্রান্তজনদের মেনে নিতে হয়েছিল, যেন তা চূড়ান্ত স্বতঃসিদ্ধ। আচেবে উল্লেখ করেছিলেন, এটি পরিহাসের বিষয় যে, উপনিবেশিক আফ্রিকান বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে কনরাডের Heart of Darkness পড়ানো হচ্ছে।
অতএব বোধগম্যভাবে, ইউরোপীয় পাঠ-সংক্রান্ত দখলদারিত্ব, উপনিবেশিক ও উত্তর-উপনিবেশিক পরিসরের নিয়ন্ত্রণকে নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করা এবং সেই আদি ও চলমান দমন প্রক্রিয়াতে হস্তক্ষেপ করাই সব উত্তর-উপনিবেশিক সাহিত্যের মুখ্য প্রকল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। উনিশ শতকের ফ্রান্স নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে রিচার্ড টার্ডিম্যান দেখলেন যে, ‘পাঠগত বিপ্লব’ (তাঁর ভাষায়) ‘সামাজিক স্তরবিন্যাসের কাঠামোগত পরিবর্তনের পেছনে নিয়োজিত শক্তিকে অবরুদ্ধ করে দেয়’ (Terdiman 1985 : 80)। কিন্তু তিনি যোগ করেন, তা সত্ত্বেও ‘সদৃশ তুলনায় সাহিত্য-বিপ্লব বিপ্লব নয়, বরং অভীষ্ট কর্মেই বিপ্লব। উপনিবেশোত্তর দেশগুলিতে শুরু থেকেই সাহিত্য-বিপ্লব সামাজিক ‘পরিচিতি-বিলোপন’-এর (Pecheux 1975 : 158) একটি সহজাত উপাদান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এসেছে। আচেবে তাঁর ÔThe Novelist as a Teacher’ (Achebe 1975: 167-74) শীর্ষক প্রবন্ধে উত্তর-উপনিবেশিক সামাজিক স্তরবিন্যাসে টেক্সটের অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার ওপর জোর দিয়েছেন। আচেবের মতে, টেক্সটের প্রধান কাজ বিপ্লব সৃষ্টি করা এবং হারানো সবকিছুকে পুনরুদ্ধার করা। এতএব এটা বিস্ময়কর নয় যে, আফ্রিকায় ইউরোপীয় দখলবাজি ও উপনিবেশায়নের ক্ষেত্রে টেক্সট ঠিক এ-ভূমিকাই রেখেছিল। উত্তর-উপনিবেশিক
প্রতি-আখ্যানের কৌশলগুলি প্রধান আখ্যানের কথা মাথায় রেখে আবর্তিত হয়েছে, প্রথমে পাঠ করে, পরে এর অন্তর্নিহিত ধারণাগুলির দরজা খুলে দিয়ে, অতঃপর সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্বের শিকার প্রজায়-পরিণত-হওয়া ‘স্থানীয়রা’ বহু-সাংস্কৃতিক অবস্থান থেকে সেসব ধারণাকে গদিচ্যুত করে। Wide Sargasso Sea সরাসরি ব্রিটিশ সার্বভৌমত্বকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে – সেটা ব্যক্তি, স্থান, সংস্কৃতি ও ভাষার পরিপ্রেক্ষিতে। উপন্যাসটি একটি সাময়িক আদর্শ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তার নিজস্ব দো-আঁশলা বিশ্বকে পুনর্নির্মাণ করে, কিন্তু ইচ্ছে করেই এই পুনর্নির্মাণকে সাময়িকত্ব দিয়ে রাখে। এর কারণ, দৃষ্টিভঙ্গির ব্যক্তিক প্রকৃতি তুলে ধরতে গিয়ে উপন্যাসটিকে রীতিমতো বেগ পেতে হয়েছে। আর এভাবেই অর্থজ্ঞাপকতার সাংস্কৃতিক নির্মাণ দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
শার্লোট ব্রন্টির Jane Eyre-এর প্রত্যুত্তরে জিন রিস যেমন Wide Sargasso Sea লেখেন, তেমনি করে ড্যানিয়েল ডিফোর Robinson Crusoe-এর প্রত্যুত্তরে স্যামুয়েল সেলভন লেখেন Moses Ascending এবং জে. এম. কুটজিয়া লেখেন Foe (বলতে গেলে, তাঁর সব লেখায় তিনি তা-ই করেছেন)। উভয় লেখক কেবল প্রামাণিক ইংরেজি টেক্সটের (canonical text) বিপরীতে ‘ফিরতি টেক্সট’ বা, ‘প্রত্যুত্তর’-এ সীমাবদ্ধ ছিলেন না, তাঁদের প্রত্যুত্তর ছিল পুরো আখ্যান-ক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে, যার ভেতরে থেকে একটি টেক্সট উত্তর-উপনিবেশিক বিশ্বে তার আরব্ধ কর্ম সম্পাদন করে এবং তা অব্যাহতভাবে করে যেতে থাকে। উইলিয়াম শেক্সপিয়রের The Tempest-এর মতো, Robinson Crusoe ইউরোপের সঙ্গে তাঁর ‘অপরাপর’-এর সম্পর্ক ‘নির্ধারণ’ করার প্রক্রিয়ার একটি অংশ ছিল, একইসঙ্গে সেই অপরাপরত্বের পঠন-পাঠনের জন্যে নমুনা এবং অপরাপরত্বের ‘অপরিবর্তনীয়তা’ (fixity) নির্মাণে ভূমিকা রেখেছিল। আর এভাবে নিজস্ব জ্ঞানীয় সংকেত-সূত্রে ইউরোপ ও তার অপরাপরদের মধ্যেকার সম্পর্ক-সূত্রটিকে স্বাভাবিকত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু উপনিবেশিক প্রান্তিক অঞ্চলে তেমন একটি প্রামাণিক টেক্সটের ভূমিকা বস্তুগত সাম্রাজ্যবাদী-চর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠতে পারে, এই অর্থে যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও জরুরি প্রতিষ্ঠানগুলির মাধ্যমে টেক্সটটি বিরতিহীনভাবে উপনিবেশিত প্রজাবর্গের কাছে তাদের অপরত্বের মৌলিক রূপ, বিলয়-প্রক্রিয়া, প্রান্তিকীকরণ বা স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়া ইত্যাদি কেবল প্রদর্শন করেই থামে না, পুনরাবৃত্তিও করে, যেন এটাই স্বতঃসিদ্ধ, সাংস্কৃতিকভাবে সুস্থিত, বিশ্বজনীন এবং স্বাভাবিক।
সেলভন ও কুটজি রবিনসন ক্রুসোকে ঘিরে জটিল আখ্যান-ক্ষেত্রকে বেছে নিয়েছেন এবং একে একে উন্মুক্ত করেছেন সব আপাতবন্ধ দরজা।
তথ্যপঞ্জি
1. Chinweizu, Onwuchekwu, Jemie and Ihechukwu Madubuike (1985), Towards the Decolonization of African Literature, London: Routledge and Kegan Paul.
2. Lee, Dennis (1977) Savage Fields:An Essay in Literature and Cosmology, Toronto: Anansi.
3. Terdiman, Richard (1985) Discourse/ Counter-Discourse : The Theory and Practice of Symbolic Resistance in Nineteenth-Century France, Ithaca and London : Cornell University Press.
4. Harris, Wilson (1985) ‘Adversarial Contexts and Creativity’, New Left Review 154 (November-December) :124-8.
5. Dash, Michael J. (1974) ‘Marvellous Realism : The Way out of Negritude’, Caribbean Studies 13 (4) :
57-70.
6. Slemon, Stephen (1986) ‘Revisioning Allegory: Wilson Harris’s Carnival’, Kunapipi 8(2) : 45-55.
7. Slemon,Stephen (1988b) ‘Post-Colonial Allegory and the Transformation of History’, Journal of Commonwealth Literature 23(1) : 157-68.
8. Pecheux, Michael (1975) Language, Semantics and Ideology, trans. Harbans Nagpal (1982), London : Macmillan.
9. Acebe, Chinua (1975) Morning Yet on Creation Day, Garden City, NY : Doubleday.
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.