অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক : জীবন ও কর্মসাধনা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণিটির বিকাশ ঘটেছিল, তার প্রথম সারির একজন হলেন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক। ১৯১২ সালে তিনি ঢাকার কেরানীগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ, ভাষা-আন্দোলন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের মতো ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। এই অঞ্চলের দুটি রাষ্ট্র সৃষ্টির পটভূমিকে তিনি অনেকটা স্বচক্ষে দেখে গেছেন। বিশেষত বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যে-প্রজন্ম বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক মহলে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন, তাঁদের অন্যতম অভিভাবক হিসেবে তিনি সুদীর্ঘদিন সরব ছিলেন। এরই মধ্যে তাঁকে নিয়ে যেসব তথ্য পাওয়া যায় তাতে জানা যায়, তাঁর সঙ্গে রাজনীতিবিদদের, যেমন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা তাজউদ্দীন আহমদসহ অনেকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক জ্ঞানচর্চার ধারায় যে-কজন ব্যক্তিত্ব অপরিমেয় প্রভাব বিস্তার করে গেছেন, তাঁদের মধ্যে রাজ্জাকের ভূমিকা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। পাকিস্তান আমলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অবৈধ সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিরুদ্ধে ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখতে অধ্যাপক রাজ্জাক ঐতিহাসিকভাবে অবদান রেখে গেছেন। ষাটের দশকে স্বয়ং তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছিলেন। ওই মামলা দুটিতে তাঁর পক্ষে রায় এসেছিল। পাকিস্তান আমলে বিদ্বৎসমাজে তাঁর যে-প্রভাব ছিল, এর সঙ্গে কারো তুলনা করা যায় না; কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, অধ্যাপক রাজ্জাকের মৃত্যুর দুই দশক পরও অ্যাকাডেমিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাঁর চিন্তার বিচার করা হয়ে ওঠেনি। অথচ বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে তাঁর ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, যা ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় জ্ঞানতত্ত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং নতুন চিন্তা ও গবেষণাকে উসকে দেয়। কিন্তু কোনো লেখক, গবেষক তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা নিয়ে অ্যাকাডেমিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে অদ্যাবধি এগিয়ে আসেননি। ইতোমধ্যে তাঁকে নিয়ে যেসব বই বের হয়েছে, সেগুলো কেবল গল্প ও ঘরোয়া আলাপের বিষয়, যেখানে তিনি বাংলার শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতি নিয়ে অনেক মন্তব্য করেছেন, যেগুলোর সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত তথ্যের বিরোধ রয়েছে; কিন্তু অদ্যাবধি এসব মন্তব্যের মীমাংসা করা হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অধ্যাপক রাজ্জাক

১৯১২ সালে অধ্যাপক রাজ্জাক ঢাকার কেরানীগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের এক দশক পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পায়। ১৯২৬ সালে ঢাকার মুসলিম হাইস্কুলে তিনি ভর্তি হন। এরই মধ্য দিয়ে কেরানীগঞ্জ থেকে ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে বিরতিহীনভাবে রাজ্জাকের বসবাস শুরু হয়। ফলে সুদীর্ঘকাল ধরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ এই অঞ্চলের বিবর্তনের সাক্ষী হয়ে আছেন। বিশেষত বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যে-প্রজন্ম বুদ্ধিবৃত্তিক মহলে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন, তাঁদের অন্যতম অভিভাবক হিসেবে তিনি দীর্ঘসময় সরব ছিলেন। ১৯৯৯ সালের ২৮ নভেম্বর অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক পরলোকগমন করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার এক দশক পর (১৯৩১) রাজ্জাক তৎকালীন ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে ঢাকা কলেজ) থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর থেকে কয়েক দশক ধরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছেন। অনেকেই অধ্যাপক রাজ্জাককে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমার্থ বিবেচনা করেন। পরবর্তীকালে উনিশশো ষাটের দশকে যেসব ব্যক্তি বিশেষত জ্ঞানচর্চায় নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন, তাঁদের প্রায় সবাই তাঁর গুণমুগ্ধ শিষ্য কিংবা ছাত্র ছিলেন। তাঁদের অধিকাংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে আছেন রেহমান সোবহান, কামাল হোসেন, প্রয়াত আনিসুজ্জামান, বদরুদ্দীন উমর, রওনক জাহান, হামিদা হোসেন, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, প্রয়াত মীজানুর রহমান শেলী, প্রয়াত সরদার ফজলুল করিম, প্রয়াত আহমদ ছফা প্রমুখ।

উনিশশো ষাটের দশকে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁদের অনেকেই তাঁকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রবক্তা বলেও চিহ্নিত করেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষাবধি তিনি জ্যেষ্ঠ লেকচারার পদে বৃত ছিলেন। এ-কেবল বৈষয়িক জগতের প্রতি তাঁর অনাকর্ষণকেই তুলে ধরে না; বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ককে অনন্য মহিমায় উপস্থাপন করে। কোনো ধরনের পেশাগত ও বৈষয়িক উন্নতির চেষ্টা না করে সুদীর্ঘকাল শিক্ষকতা করে যাওয়ার পেছনে তাঁর সুগভীর জীবনবোধকে ইঙ্গিত করে।

সরদার ফজলুল করিম লিখিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ : অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক-এর আলাপচারিতা ও আহমদ ছফার যদ্যপি আমার গুরু শীর্ষক বই দুটি রাজ্জাকের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গভীর সম্পর্ককে রেখাপাত করে। দেশভাগের আগে পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে তিনি পাকিস্তান নামক একটি পাক্ষিক পত্রিকার সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন।

স্বাধীনতার পর রাজ্জাকের অন্যতম প্রিয় ছাত্র মোজাফফর আহমদ চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সর্বজ্যেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে অধ্যাপক রাজ্জাক উপাচার্যের অনুরোধে বিভাগীয় প্রধানের পদে বৃত হন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান লিখেছেন যে, রাজ্জাকের দায়িত্ব গ্রহণের কারণ ছিল প্রশাসনে থাকলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে পুনর্গঠন করতে পারবেন। ১৯৪৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে পদত্যাগ করেন দর্শন বিভাগের প্রভাষক সরদার ফজলুল করিম। আইয়ুব খানের আমলে প্রতিকূল পুলিশ রিপোর্টের কারণে চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করে রাজ্জাক দুজনকেই নিজের বিভাগে ফিরিয়ে এনেছিলেন। ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ সরকার আব্দুর রাজ্জাককে জাতীয় অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ লিখিতপত্রে তাঁকে অভিনন্দন জানায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর সরকারের হস্তক্ষেপ ও আব্দুর রাজ্জাকের মামলা

ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন ও অ্যাকাডেমিক স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছিলেন আব্দুর রাজ্জাক। মামলা দুটিতে তাঁর পক্ষে রায় এসেছিল। আইয়ুব খানের আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এই ঘোষণার বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন অক্ষুণ্ন রাখতে ঐতিহাসিক অবদান রেখে গেছেন (দেখুন : আব্দুর রাজ্জাক বনাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৮ ডিএলআর ১৯৬৬ উচ্চ আদালত ১০৩)। তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে তিনি পুনরায় কোর্টের দ্বারস্থ হন। চুক্তিতে বর্ণিত শর্তের বাইরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো আদেশ বা নিয়ম প্রণয়ন করলে তিনি তা মানতে বাধ্য নন – এই শর্তে তিনি মামলাটি করেছিলেন। (দেখুন : আব্দুর রাজ্জাক বনাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও অন্যান্য, ২০ ডিএলরআর ১৯৬৮ উচ্চ আদালত ৯৬১)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ড. আবু মাহমুদও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একটি মামলা করেন। এই মামলার পেছনেও রাজ্জাকের যথেষ্ট ভূমিকা ছিল বলে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন (স্মারকগ্রন্থ, প্রথম সংস্করণ, পৃ ১২৭)।

ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ও  এককালীন সভাপতি জয়নাল আবেদীন আন্দোলনে গ্রেফতার হলে অধ্যাপক রাজ্জাকের মধ্যস্থতায় তাঁর পরীক্ষার ব্যবস্থা হয়েছিল। রাজ্জাক কিছুকাল এ কে ফজলুল হকের কৃষক-শ্রমিক পার্টির উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন।

বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও অধ্যাপক রাজ্জাক

একবার বঙ্গবন্ধু রাজ্জাকের কাছে নালিশ করেছিলেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ক্লাবে বসে তাঁর বিরূপ সমালোচনা করেন। উত্তরে রাজ্জাক নাকি বলেছিলেন, ‘তাতে তাঁর কী ক্ষতি হয়’ (স্মারকগ্রন্থ, প্রথম সংস্করণ, পৃ ১৩১)। ১৯৮০ সালে প্রদত্ত ‘মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী স্মারক বক্তৃতা’য় তিনি বঙ্গবন্ধু সম্বন্ধে একাধিক মন্তব্য করেছেন। তিনি লিখেছেন যে, ‘… বঙ্গবন্ধুকে আমাদের যুগের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। জাতির বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করতে, জাতির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কথা বিচার করতে, যে চালিকাশক্তি বঙ্গবন্ধুর মতো আশ্চর্য ব্যক্তিত্বের পেছনে কাজ করেছে, তার গভীরে যাওয়া প্রাসঙ্গিক।’ তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ‘কী কারণে তিনি জাতির জীবনে দাগ কাটতে পেরেছেন? বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় চরিত্র হওয়ার পেছনে তাঁর দাবিগুলো কী?’ এরপর তিনি লিখেছেন, ‘যাই করুন না কেন, বঙ্গবন্ধু কেন সেগুলো করেছিলেন? কেন মানুষটি তাঁর নিজের নিরাপত্তা সম্পর্কে এতো অসচেতন ছিলেন?’ বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘… বঙ্গবন্ধু দেশপ্রেমে বিহ্বল ছিলেন। দেশপ্রেমের সংজ্ঞাকে যতো ব্যাপক করে তোলা যাক না কেন, বঙ্গবন্ধু ততোখানিই তাঁর দেশকে ভালোবাসতেন’ (বাংলাদেশ : জাতির অবস্থা, পৃ ৪৪-৪৫)।

ওই বক্তৃতায় অধ্যাপক রাজ্জাক বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জিন্নাহ ও গান্ধীর তুলনামূলক বিচার হাজির করেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, গান্ধী বা জিন্নাহর কোটি কোটি ভক্ত থাকলেও ‘এইসব জনতার কেউই গান্ধী বা জিন্নাহকে তাদের নিজেদের একজন বলে ভাবতে পারতো না। এটাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জিন্নাহ বা গান্ধীর পার্থক্য। বঙ্গবন্ধু জাতি আর তাঁর নিজের মধ্যে একটা অবিভাজ্য মেলবন্ধন গড়ে তুলেছিলেন’ (বাংলাদেশ : জাতির অবস্থা, পৃ ৪৪-৪৫)।

মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ততার কারণে সরকারি এক বিজ্ঞপ্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষককের ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং সম্পত্তির ৫০ ভাগ বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক উপাচার্য মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক খান সরওয়ার মুরশিদ ও অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক (উৎস : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তথ্য মন্ত্রণালয়-প্রকাশিত, প্রথম প্রকাশ জুন, ১৯৮৪, পুনর্মুদ্রণ ডিসেম্বর ২০০৩)। এসময় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রাজ্জাককে কর্মচুত করে।

অধ্যাপক রাজ্জাক চর্চা ও তাঁর চিন্তার বিশিষ্ট দিক

অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক বৈভবের কারণে সমকালে ও অদ্যাবধি এক বিস্ময়কর ‘মিথ’ হয়ে রয়েছেন। বিভিন্ন মতাদর্শের শিষ্য ও ছাত্র তৈরি হওয়ার পেছনে প্রধানত তাঁর সেই বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষুরধার দৃষ্টিভঙ্গি ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আব্দুর রাজ্জাক তাঁর মৃত্যুর দুই দশক পরও ‘মিথ’ হয়েই রয়ে গেছেন। তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অদ্যাবধি কোনো সিরিয়াস তথা অ্যাকাডেমিক পাঠ হয়নি।

অধ্যাপক রাজ্জাকের চিন্তা এখনো কেন অ্যাকাডেমিক দৃষ্টিতে বিচার করা যায়নি? এর প্রধান দুটি কারণ হতে পারে – প্রথমত, যেহেতু আব্দুর রাজ্জাক ভাষণ কিংবা ঘরোয়া আলাপে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিশ্লেষণ না করে কেবল মন্তব্য ছুড়ে দেন, যা ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত সিদ্ধান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। অ্যাকাডেমিক পদ্ধতি অনুসরণে এ-ধরনের মন্তব্যের মোকাবিলা করা যেমন কষ্টসাধ্য বিষয়, তার চেয়ে বেশি কঠিন হলো সমাজে ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত চিন্তাচর্চার বিপক্ষে গিয়ে নতুন তত্ত্ব হাজির করা, যা গবেষকসমাজের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয়ত, তাঁর পিএইচ.ডি প্রকাশ না পাওয়ায় তাঁর চিন্তাভাবনা নিয়ে বিচার করার সুযোগ কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে বুদ্ধিবৃত্তিক মহলে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন আহমদ ছফা। আমাদের একথাও স্বীকার করতে হবে, যদ্যপি আমার গুরু বইয়ের মধ্য দিয়ে রাজ্জাক আমাদের কাছে একজন জনপ্রিয় কিংবদন্তি হয়ে উঠেছেন বটে; কিন্তু তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক সামষ্টিক দৃষ্টিভঙ্গি গল্পের মধ্যে তলিয়ে গেছে। এ-কারণে আব্দুর রাজ্জাক যে-পরিমাণ গল্পে উঠে এসেছেন, সেভাবে গবেষণালব্ধ বুদ্ধিবৃত্তিক পাটাতন থেকে তাঁর চিন্তার মোকাবিলা হয়নি। ইতোমধ্যে তাঁর পিএইচ.ডি থিসিস প্রকাশ না পাওয়া এবং তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বুদ্ধিবৃত্তিক মহলে অ্যাকাডেমিক দিক থেকে বিচার না হওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের এক চরম বুদ্ধিবৃত্তিক দীনতার পরিচয় তুলে ধরে।

অধ্যাপক রাজ্জাকের লেখা প্রথম কোনো রচনা প্রকাশ পায় ১৯৫৭ সালে। এটি ছিল রাজ্জাকের পিএইচ.ডির একটি অধ্যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের স্বনামধন্য অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ-সম্পাদিত নিউ ভ্যালুজ সাময়িকীতে ‘ÔThe Mind of the Educated Middle Class in the Nineteenth CenturyÕ শিরোনামে এটি প্রকাশিত হয়। ১৩৮৪ বঙ্গাব্দে (আনুমানিক ১৯৭৭ সালে) প্রখ্যাত সাংবাদিক প্রয়াত মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর-সম্পাদিত বক্তব্য নামক সাময়িকীতে রচনাটির তর্জমা প্রকাশ পায়। পরবর্তীকালে একাধিক পত্রিকায় রচনাটির অনুবাদ বের হয়। ১৯৮০ সালে আব্দুর রাজ্জাক তাঁর অন্যতম প্রিয় ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য মোজাফফর আহমদ চৌধুরীর ওপর একটি স্মারক বক্তৃতা দিয়েছিলেন। একই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রখ্যাত অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ-সম্পাদিত এশিয়ান অ্যাফেয়ার্স নামক সাময়িকীতে বক্তব্যটি মুদ্রিত হয়। পরবর্তী বছর এটি পুস্তিকা আকারেও বের হয়। এর পরে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে আব্দুর রাজ্জাক হাতেগোনা কয়েকটি ভাষণ দিয়েছেন, যার মধ্যে তিনটি তাঁর স্মারকগ্রন্থে প্রকাশ পেয়েছে। এর বাইরে আরো দুটি ভাষণ পাওয়া গেছে।

অধ্যাপক রাজ্জাকের চিন্তা নিয়ে অদ্যাবধি কোনো সিরিয়াস অ্যাকাডেমিক পাঠ হয়নি। তাঁকে নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণমূলক প্রথম বইটি লিখেছেন অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ স্মারক বক্তৃতার পর্যালোচনা হিসেবে ১৯৮৩ সালের এপ্রিলে ড. খানের বইটি বাংলাদেশ : জাতীয় অবস্থার চালচিত্র শিরোনামে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে বিশেষত সরদার ফজলুল করিমের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ : অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের আলাপচারিতা ও আহমদ ছফার যদ্যপি আমার গুরু বই দুটি প্রকাশ পাওয়াতে আব্দুর রাজ্জাকের বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাভাবনা গল্পের মধ্যেই প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। এরপর ১৯৯৩ সালের এপ্রিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজ্জাক সম্পর্কিত সরদার ফজলুল করিমের বইটি বের হয়। বইটি রাজ্জাকের কথোপকথনের ভিত্তিতে লিখিত। ইতিহাসবিষয়ক অনেক মন্তব্য বইটিতে হাজির করা হয়েছে; কিন্তু মন্তব্যগুলো আমাদের চিন্তাকে উসকে দিলেও অ্যাকাডেমিক দিক থেকে বেশিরভাগই তর্কসাপেক্ষ, যার মীমাংসা এখনো হয়নি। ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে আহমদ ছফা লিখিত যদ্যপি আমার গুরু বইটি প্রকাশ পায়। সুধীমহলে বইটি ব্যাপক সাড়া ফেলে। বিশেষত সমাজে তরুণদের ওপর আহমদ ছফার বিপুল প্রভাব এবং বইটির ভাষা ও চিন্তা প্রকাশের ধরন সহজ-সাবলীল এবং বাংলাদেশের মতো পাঠহীন সমাজে এ-ধরনের চরিত্রায়নের কারণে এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে, যা পাঠকমহলে অভাবনীয়ভাবে সমাদৃত হয়। বইটি অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে বিদ্বৎসমাজে ও তরুণদের কাছে কিংবদন্তিরূপে প্রতিষ্ঠিত এবং রাজ্জাক নিয়ে পাঠকমহলে অকল্পনীয় ভাবনার উদ্রেক করে। সম্প্রতি ড. মোহাম্মদ আজম তাঁর একটি লেখায় যদ্যপি আমার গুরুকে আহমদ ছফার উপন্যাস বলেও উল্লেখ করেছেন। এ-গ্রন্থটি আহমদ ছফার যথেষ্ট মুন্শিয়ানার সাক্ষ্য বহন করে। আহমদ ছফা ও সরদার ফজলুল করিমের পর হুমায়ুন আজাদ, নাসির আলী মামুন ও ফজলে রাব্বী তাঁর তিনটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। উল্লিখিত রচনাগুলো অধ্যাপক রাজ্জাককে সুধীমহলে কিংবদন্তিতে স্থায়ী ভিত্তি দেয়।

২০১২ সালে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক স্মারক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এতে প্রধানত তাঁর শিষ্যস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন। সবকটি লেখায় প্রায় রাজ্জাক নিয়ে একই বক্তব্য খুঁজে পাওয়া যায়। ২০১৪ সালে স্মারকগ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এতে রাজ্জাকের তিনটি ভাষণ ও দুটি রচনা পুনর্মুদ্রিত হয়। ইতোমধ্যে রাজ্জাকের আরো দুটি ভাষণ আমাদের হাতে এসেছে, যেখানে তাঁর ক্ষুরধার মন্তব্য রয়েছে, যা নতুন চিন্তাকে উসকে দেয়। এর বাইরে অধ্যাপক রাজ্জাকের চিন্তাভাবনা বিচার করার আরেকটি মাধ্যম ছিল তাঁর অপ্রকাশিত পিএইচ.ডি। যে কারো পক্ষে এটি সম্পাদনা করে প্রকাশের ব্যবস্থা করা অনেক কঠিন কাজ ছিল। এই থিসিসটি বের হলে আব্দুর রাজ্জাক নিয়ে নতুন তর্ক শুরু হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, যা ইতোমধ্যে সম্ভব হয়নি। ফলে অ্যাকাডেমিক দৃষ্টিকোণ থেকে রাজ্জাক নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণধর্মী মূল্যায়ন অনেকটা থমকে গেছে। আব্দুর রাজ্জাকের কোনো শিষ্য কিংবা কোনো উৎসুক গবেষক ইতোমধ্যে তাঁর চিন্তাভাবনা নিয়ে গবেষণালব্ধ তথা বিচার-বিশ্লেষণমূলক বড় ধরনের কোনো কাজ হাতে নেওয়ার উদ্যম কিংবা সাহস কোনোটাই দেখাননি। ফলে আব্দুর রাজ্জাক আমাদের মাঝে যতটা বাস্তব তার চেয়ে বেশি মিথ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

আহমদ ছফা কিংবা সরদার ফজলুল করিমের বই দুটিতে অধ্যাপক রাজ্জাকের ক্ষুরধার মন্তব্য পাওয়া যায় বটে; কিন্তু কোনো অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তি এগুলোকে অ্যাকাডেমিক পাটাতন থেকে বিচার করে দেখেননি। মন্তব্যগুলো রাজ্জাকের বুদ্ধিবৃত্তিক চৌকাঠ হয়ে পরিচিতি পেয়েছে বটে; কিন্তু এর যথার্থতা অ্যাকাডেমিকভাবে প্রতিষ্ঠা পায়নি। আশার বাণী হলো, অধ্যাপক রাজ্জাকের ছাত্র ও জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক ড. আহ্রার আহমদের সম্পাদনায় আব্দুর রাজ্জাকের থিসিসটি ইউপিএল থেকে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। এতে করে অধ্যাপক রাজ্জাক নিয়ে চিন্তাভাবনার ধরন ও দিক পাল্টাতে পারে বলে আমাদের বিশ্বাস।

অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের জীবনযাপন একটি রাষ্ট্রে বুদ্ধিবৃত্তিক পাটাতন তৈরির জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। সমাজে জ্ঞানের উৎকর্ষ সাধন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক নৈরাজ্য নিরসন, সাংস্কৃতিক বিকাশ ও রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব মোকাবিলা করার জন্য রাজ্জাকের মতো চিন্তাবিদ সবসময় তাৎপর্যপূর্ণ। বিশেষত এই মুহূর্তে বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক নৈরাজ্য নিরসনে এ-ধরনের চিন্তাবিদ অপরিহার্য; কিন্তু আশার বাণী খুবই ক্ষীণ। রাজ্জাক তাঁর সময়ে যতটা লিখেছেন তার চেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছেন একটি বুদ্ধিবৃত্তিক গোষ্ঠীর মধ্যে জ্ঞানের প্রতি তাঁদের উসকে দিয়ে। এক্ষেত্রে তিনি যথার্থ একজন গুরুর ভূমিকা পালন করেছেন। এই মুহূর্তে আব্দুর রাজ্জাক নিয়ে সবচেয়ে গুরুত্ববহ কাজ হবে তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে অ্যাকাডেমিক জায়গা থেকে বিচার করা। এক্ষেত্রে প্রকাশিতব্য থিসিসটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হতে পারে।

সংশ্লিষ্ট গ্রন্থ ও অন্যন্য

১.  Abdur Razzaq vs University of Dhaka, 18 DLR, 1966, HC p 103.

২.  Abdur Razzaq vs Vice Chancellor of the University of Dhaka and others, 20 DLR 1968, HC p 961.

৩.       বাংলাদেশ : জাতির অবস্থা, আব্দুর রাজ্জাক, সাহিত্য প্রকাশ, ২০০১, পৃ ৪৪-৪৫, প্রথম প্রকাশ ১৯৮১।

৪.       বাংলাদেশ : জাতীয় অবস্থার চালচিত্র, সলিমুল্লাহ খান, প্রাক্সিস অধ্যয়ন সমিতি, প্রথম প্রকাশ এপ্রিল ১৯৮৩।

৫.       ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ : অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের আলাপচারিতা, সরদার ফজলুল করিম,  সাহিত্য প্রকাশ, পঞ্চম মুদ্রণ, ২০১৬।

৬.       বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তথ্য মন্ত্রণালয়-প্রকাশিত, প্রথম প্রকাশ জুন, ১৯৮৪, পুনমুর্দ্রণ ডিসেম্বর ২০০৩।

৭.       যদ্যপি আমার গুরু, আহমদ ছফা, প্রথম প্রকাশ মাওলা ব্রাদার্স, ষষ্ঠ সংস্করণ ২০১৩।

৮.       জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক স্মারকগ্রন্থ, আনিসুজ্জামান, বেঙ্গল পাবলিকেশন্স, প্রথম প্রকাশ ২০১২, পৃ ১২৭, দ্বিতীয় সংস্করণ মে ২০১৫।