অনন্বয়-অনুভবে

জাফরিন গুলশান

‘From follows function’ বা উপযোগিতাভিত্তিক আঙ্গিক। এই তত্ত্বের আবির্ভাব আঠারো শতকে অভিজ্ঞতাবাদী দর্শনের অংশ হিসেবে। ‘খবর খাদ্য’ বা ‘News food’ শিরোনামের প্রদর্শনীটিকে উপযোগিতাভিত্তিক আঙ্গিকে বিবেচনা করা যেতে পারে।

সমকালীন সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে পঠিত দৈনিক  প্রথম আলোর পনেরোতম প্রতিষ্ঠাবর্ষে ওয়াকিলুর রহমানের একটি দৃশ্যশিল্প-প্রদর্শনী এটি।

জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রদর্শনী কক্ষজুড়ে যে-আবহ তৈরি এবং ফলে যে-ফর্ম বা আঙ্গিক তৈরি হয়েছে, তা প্রথম আলোর পনেরো বছরে গড়ে তোলা আর্কাইভ ঘেঁটে তৈরি। পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, অনেক ফুটেজ, দৈনিক বা বিশেষ সংখ্যা, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের ছবি – ইত্যাদির ভেতর থেকে দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিংবা আনন্দ-বেদনা, প্রতিবাদ-উৎসাহে ঘটে যাওয়া ঘটনাসমূহের চলমান ফটোগ্রাফিক প্রদর্শনী এটি।

গ্যালারির প্রতিটি দেয়ালে পত্রিকার বিভিন্ন ফুটেজ চলমান। চোদ্দোটি প্রজেক্টরের আলো ছাড়া আর কোনো আলো নেই। আলো-আঁধারের কক্ষে দর্শকের শরীর বেয়ে চলে যাওয়া ব্যবহৃত খবরের লাখোকোটি বর্ণমালা যে-মিথস্ক্রিয়া তৈরি করে, তা স্বভাবতই জটিল বাস্তবতার রূপায়ণ। এখানে ঘটনা ও সিদ্ধান্ত কমবেশি যে-বাস্তবতা নির্মাণ করে, তা সামগ্রিক অর্থে দৃশ্যশিল্প-প্রদর্শনীটিকে বিষয়ের দলিল এবং তথ্য-উৎসে সৃষ্ট প্রামাণিক আঙ্গিকে ফেলা যেতে পারে। বিশেষত যখন এটি আরো বেশি মাত্রা পায় ১২ জন পারফর্মিং শিল্পীর অংশগ্রহণে।

প্রদর্শনীর নাম ‘খবর খাদ্য’ কেন – এ-প্রসঙ্গে শিল্পী তুলে ধরলেন এর ব্যাখ্যা। ‘দৈনন্দিন জীবনে মানুষ নিজেকে খবরের কাগজ ছাড়া ভাবতে পারে না। প্রতিনিয়ত খবরের কাগজের বাছাই করা খবর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে মানুষের জৈবিক ও মনোজগৎ। ফলে এর ভূমিকা বেঁচে থাকার অন্যতম উপাদান তথা খাদ্যের পর্যায়ে চলে  গেছে।’ প্রথম আলোর দশম বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০০৯-এ ‘কাগজের ছায়ায়’ শিরোনামে একটি দৃশ্যশিল্প-প্রদর্শনী করেন ঢালী আল মামুন ও ওয়াকিলুর রহমান। ‘খবর খাদ্য’ পূর্বেরটির ধারাবাহিক উপস্থাপনা। ধারণা হিসেবে দেশ ও বিশ্বের প্রেক্ষাপটে প্রিন্টিং মিডিয়ার কর্তৃত্বপরায়ণ বাস্তবতার ভেতর দিয়ে গড়ে-ওঠা জনগোষ্ঠীর জটিল মনস্তত্ত্বের বিবিধ কাঠামোর একীভূত রূপান্তরের প্রয়াস।

পারফর্মিং শিল্পীরা বিভিন্নভাবে এ-প্রদর্শনীর ধারণার সঙ্গে সম্পূর্ণ কিংবা আংশিক সাযুজ্য ও স্বাধীনতায় খবর খাদ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন। ফলে প্রদর্শনীটি আদতে তিন স্তরে দর্শকের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া ঘটায়।

প্রথম আলোর পরিচয় ও প্রথম আলোকেন্দ্রিক কয়েকটি নির্দিষ্ট শ্রেণির ক্রমাগত সঞ্চিত ও বিকশিত অভিজ্ঞতা, যা প্রায় পনেরো বছর ধরে স্মৃতিতে বিদ্যমান অভ্যাস। দ্বিতীয়ত, এ-অভ্যাসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ওয়াকিলুর রহমানের ‘খবর খাদ্যে’র ধারণা ও প্রদর্শন। তৃতীয়ত, পারফর্মিং শিল্পীদের নিজ চিন্তাকে দৃশ্যশিল্প উপস্থাপনার সঙ্গে সম্পর্কিত ও বিশেস্নষিত নতুন উপলব্ধির মিথস্ক্রিয়া।

সুতরাং, তথ্যবিষয়ক, আঙ্গিকগত বিষয়ে, দৃশ্যগত ঘটনা বিষয়ে, চিত্রকল্প বিষয়ে এবং সর্বোপরি ‘খবর খাদ্যে’কে শিল্পকর্ম হিসেবে ব্যাখ্যার ক্ষেত্র প্রথম আলোর উপযোগিতার সঙ্গে সম্পর্কিত।

আবার, সহজ ও বিশদভাবে সব প্রিন্টিং মিডিয়ার সঙ্গে অন্তর্জ্ঞানসম্পন্ন দেশের জনগোষ্ঠীর সম্পর্ক (এক্ষেত্রে ‘শ্রেণি’ প্রশ্ন সম্পর্কিত হয়) কিংবা রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চরিত্র অনুশীলনে সংবাদপত্র মাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে সূত্রবদ্ধ করা যায়।

এক্ষেত্রে শিল্পী নিজে কোনো তত্ত্বগত অবস্থান গ্রহণ করেননি। নেতিবাচক বা ইতিবাচক কোনো বিশেষত্বের সন্ধান মেলে না। বরং ‘নিরপেক্ষ’ নির্বাচন ঘটেছে শিল্পীর ভাবনায়। ফলে আদতে রোমান্টিসিজমের অনুপ্রবেশ ঘটেছে।

শিল্পীর সঙ্গে আলোচনার একপর্যায়ে জানালেন, ফাস্টফুড যেভাবে দৈনন্দিন অভ্যাসে ঢুকে পড়েছে, খবর খাদ্যও তেমনি ফাস্টফুডের মতো। কারণ, খবরের কাগজের নিত্যদিনের খবর ও শিরোনামে দ্রুতগতিতে তৈরি হওয়া প্রতিক্রিয়াও পাঠকের স্মৃতিতে দ্রুতই হারিয়ে যায়। এভাবে প্রতিদিন হাজারো খবরের জন্ম-মৃত্যু ঘটে আমাদের স্মৃতির ইতিহাসে। এ-ধরনের নানাবিধ বাস্তবতার জটিল চিন্তন ও অভিজ্ঞতার কাঠামো প্রদানের চেষ্টা করেছেন শিল্পী।

ওয়াকিলুর রহমানের পূর্বের প্রজেক্টগুলোর সঙ্গে সাদৃশ্য তৈরি হয় ‘টেক্সট’ বা লিপিকে কোনো-না-কোনো উপায়ে শিল্পচিন্তার উপকরণ হিসেবে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে। ইতোপূর্বে ‘বই’ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের ইনস্টলেশন করেছেন, বিভিন্ন ধরনের লেখা নিয়ে নিজের মতো করে বিচিত্র মাধ্যমে কাজ করেছেন। তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ এ-প্রদর্শনীর শিল্প-উপাদানসমূহ। প্রদর্শনীটিতে রিপিটেশন, অলটারনেশন, হারমোনি, কনস্ট্রাস্ট, ডমিনেস্ট ও ব্যালেন্স নির্ণীত হয় প্রজেক্টরে চলমান ফটোগ্রাফিক প্রেজেন্টেশন যখন প্রদর্শনকক্ষ জুড়ে দেয়াল, ছাদ ও মেঝেতে প্রবাহিত হয়। প্রদর্শনীর পারফরম্যান্স শিল্পীরা হলেন – ইয়াসমিন জাহান নূপুর, সুমনা আক্তার সুমা, প্রিমা নাজিয়া আন্দালিব, ঋতু এ সাত্তার, সারদ দাশ, ঝুমা, ফাহমিদা, সাবাহ, সালেহ, নিলয়, পলাশ, স্বাধীন প্রমুখ।

প্রদর্শনীটিতে একদিন দর্শক ও শিল্পীদের মধ্যকার কথোপকথন হয়। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরীফ। আধুনিক শিল্পের দোষ হিসেবে সমালোচিত হয় যে-শিল্প ও শিল্পীর সঙ্গে দর্শকের দূরত্ব এবং শিল্পের দুর্বোধ্যতা, এর সম্ভাবনাময় সমাধানের পথ হিসেবে বর্তমানে চারুশিল্প-বলয়ে অধিক মনোযোগের সঙ্গে চর্চা হচ্ছে শিল্পীদের সঙ্গে দর্শকের কথোপকথনের বিশেষ এ-সেশনের। প্রদর্শনীটি শেষ হয়েছে ২২ নভেম্বর।