অনুরক্ত তমাশা

রেজাউর রহমান
দিন-সপ্তাহ-মাস পেরিয়ে অন্তরা যখন হাসপাতালের পিঞ্জর থেকে বেরিয়ে আসে, তখন সান্ধ্য আকাশে চাঁদ ছিল না, তারা ছিল না, ছিল না কোনো রংও। আকাশে কোনো রং থাকে না, এমন দৃশ্য তার   বিশ-বাইশ বছরের জীবনে কোনোদিন দেখেনি। তারপরও সে ভাবে, মানুষের ভুল-ভ্রান্তি হয় না? হতেও পারে। সে হয়তো এমনটা দেখে থাকবে কোনোদিন, যা আজ তার মনে নেই।
অন্তরাকে নিতে এসেছেন তার মা মহাফেজা খানম। আবেদের আসার কথা। সে এখনো আসেনি। অন্তরা দুবার ফোন দিয়েছে। ফোন ব্যস্ত।
তার বাবা মোহাম্মদ ইব্রাহিম কাছে-কিনারে থাকলে অবশ্যই
আসতেন। তিনি আমেরিকাবাসী। ভাগ্যান্বেষণে দেশ ছেড়েছেন অনেকদিন। তিনি দায়িত্বশীল মানুষ। মাসকাবারে নিয়মিত টাকা পাঠান। মেয়ে-মায়ের অসুবিধা খুব একটা হয় না। হলোই-বা। ইব্রাহীমের আশ্বাসবাণীতে তারা অবিচল বিশ্বাসী : এই তো হয়ে গেল বলে কাগজপত্র সব। আর একটি বছর, ঊর্ধ্বে দুই… তোমরা চলে আসবে আমেরিকায়। এর মধ্যে অন্তরার গ্র্যাজুয়েশনটা হয়ে যাবে… মাস্টার্স এখানে…

মা-মেয়ে পোঁটলা-পুঁটলি গুছিয়ে সংক্রামক ব্যাধির বিভাগীয় প্রধানের রুমে এসে অপেক্ষা করছেন। তিনি অন্তরার সম্পর্কের নানা। মা তাড়া দেন, ‘অন্তরা… আবেদকে একটা ফোন দে না?’
আবেদের ফোন জানায়, এ নাম্বার ব্যস্ত… পরে আবার চেষ্টা করুন।
বিভাগীয় প্রধানের রুমের পশ্চিমের কাচের জানালা ধরে বাইরে চায় অন্তরা। সে দেখে অস্বাভাবিক রঙের পশ্চিম আকাশের রংকে করে তুলেছে আরো বেমানান, বিচিত্র। অন্যভাবে বলতে গেলে বলা যায়, ভাবলেশহীন, দুর্বোধ্য যেখানে কোনো বার্তা নেই। নেই স্বপ্নের হাতছানি।
কাচের জানালা থেকে চোখ ফিরিয়ে অন্তরা উঠে দাঁড়ায়। ‘মা ওঠো… আমরা যাই। আবেদ আসবে না।’
‘আসবে না… কেন?’ মা আহত হন।
জোর দিয়ে বলে অন্তরা, ‘না, আসবে না।’
মা-মেয়ে পোঁটলা-ব্যাগ-পানির বোতল নিয়ে হাঁটা দেয়। পুরনো হাসপাতাল বিল্ডিংয়ের উঁচু ফোকরে এনার্জি বাল্বের ফকফকে আলোতে বসে একদল চড়–ই তুমুল বিবাদে মেতেছে। রোগশোক, ঝরা-মৃত্যু-কান্না, নবজন্মের কোলাহল, নার্স-ডাক্তারের চলাচল,  ব্যস্ততা – সব ছাপিয়ে ছোট্ট পাখিগুলোর কিচিরমিচির উচ্চকিত করে রেখেছে হাসপাতালের এই অংশটা। হাঁটতে হাঁটতে অন্তরার তিক্ততা বাড়ে। অন্তরা-তার মা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে স্কুটার নেয়। অন্তরা স্কুটারযানে উঠে গেলে মা একটু দাঁড়িয়ে এদিক-সেদিক দেখেন খানিকক্ষণ।
‘ছেলেটা এসে গেলে ভালো হতো।’
মেয়ে বিরক্ত হয়, ‘ওঠো তো মা…।’
স্কুটার এগিয়ে চলে। তাদের যেত হবে অনেকদূর – কলাবাগানের এক লম্বা গলির শেষ সীমানায়। পথে যানজট। কতক্ষণে পৌঁছুবে তারা কে জানে?
আবেদ হোসেনের চেহারাটা অন্তরার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তারা গত তিন বছর থেকে একে অপরকে ভালোবাসে। প্রথাগত নিয়মে তাদের এই প্রেম নির্ভেজাল, নিখাদ। একই প্রাইভেট ভার্সিটিতে তারা পড়ে। আগামী বছর অন্তরার গ্র্যাজুয়েশন শেষ হবে। আবেদের হবে এ বছরই। অন্তরার মা আবেদকে নিজের ছেলের মতোই দেখেন। যেখানে তার আর কোনো সন্তান নেই।
আবেদের বাড়ি কুতুবদিয়ায়। সচ্ছল পরিবার। বাবা-মা জীবিত। তিন ভাইবোনের মধ্যে সে সবার ছোট। তার বড় ভাইবোন দুজনই চিটাগাংয়ে চাকরি করেন। বড় ভাই সরকারি চাকুরে, ছোট বোন ব্যাংকার। আবেদের পরিবার বোনের বিয়ের ব্যাপারে জোর খোঁজাখুঁজি করছে। বড় ভাইয়ের বিয়ে ঠেকে আছে বোনের বিয়ের জন্য।
অন্তরার অসুখটা প্রথম ধরা পড়ে মায়ের চোখে। তিনি মেয়েকে জানালার সকালের আলোতে টেনে নিয়ে তার চোখ দেখেন। – চোখটা একটু হলদেটে… জন্ডিস হলো না তো?
অন্তরাও তখন অনুযোগ তোলে, ‘হ্যাঁ মা… কয়দিন থেকে আমার কাহিল… কাহিল লাগে। শরীরে শক্তি পাই না… আজ শেষ ক্লাসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম…।’ ক্লাস শেষে আবেদ এসে আমাকে ডেকে তোলে। এবং প্রায় কোলেপিঠে করে বেবিট্যাক্সিতে তুলে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেছে।
অন্তরাদের বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত ৮টা-সাড়ে ৮টা বেজে যায়।
মাসকাবারে বাড়ি ফিরে অন্তরা আনন্দিত হয়। বাড়িঘর ছেড়ে হাসপাতাল কার ভালো লাগে?
ঘরেফেরা পথের পুরোটা সময় ভালো কাটেনি অন্তরার। সারাপথে থেমে থেমে চলা, কোথাও কোথাও একেবারে থেমে যাওয়া, আটকেপড়া ভ্যাপসা গরমের বিরক্তি ছাপিয়ে আবেদের না-আসার ব্যাপারটা সে সহজভাবে নিতে পারেনি। কারণ, একটা ধারণা পোষণের স্বপক্ষে ও বিপক্ষে নানা কথা, যুক্তিতর্ক সাজিয়ে অবশেষে সে ধরে নিতে থাকে যে, আবেদ আজ ইচ্ছে করে আসেনি। কেননা, মাত্র গতকাল আবেদ, মা ও সে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার বিষয়টা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেছে। এর সঙ্গে বাড়িফেরার পন্থা ও প্রস্তুতি নিয়েও তারা মোটামুটি একটা ছক করে রেখেছিল। সেখানে তার অনুপস্থিতিটা সে মেনে নিতে পারেনি।
তারা রিলিজ নিতে চেয়েছিল সকালে। সাধারণত তাই হয়। তাতে হাতে সময় বেশি থাকে। কিন্তু অন্তরার সম্পর্কের নানা ডা. আলমাসউদ্দিন কেন জানি তাকে বিকেলে যেতে বললেন। এবং তাঁর নির্দেশে সকালের ভিজিটের সময় নার্সকে ডেকে আর্জেন্ট একটা রক্ত পরীক্ষার কথা বলে গেলেন। সেই রিপোর্ট পেতে সময় লাগবে।
অন্তরার ডাক্তার নানা বিকালে এসেছিলেন। তিনি বাঁ-হাতে তাঁর ভারী লেন্সের চশমা তুলে রিপোর্টটা চোখের কাছে নিয়ে খানিকক্ষণ দেখলেন। তারপর অন্তরার মাথায় হাত রেখে মা-মেয়েকে অভয় দিলেন।
‘সব ঠিক আছে। একেবারেই চিন্তা করবেন না। লিড এ নরমাল লাইফ। তবে অন্তত বছর-ছমাসে একবার আমাকে দেখিয়ে যাবেন। ব্যস…।’
অন্তরা চিন্তিত ছিল। তার মা ছিলেন আরো বেশি।
হাসপাতালে ভর্তি হওয়া পর্যন্ত তারা ব্যাপারটা নিয়ে তেমন ভাবেননি। বিশেষ করে অন্তরার মায়ের এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতা আছে। ছোটবেলায় তার দুবার জন্ডিস হয়েছে। এই সপ্তাহখানেক বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়। সম্পূর্ণ বিশ্রাম। হালকা খাবার, ডাবের পানি, আখের রস… এই তো। তেমন ওষুধপথ্যও লাগেনি। সেরে উঠেছেন। ফিরে গেছেন স্বাভাবিক জীবনে। সেইসব অসুখ-বিসুখের কথা তার আর মনেও হয়নি তেমন। কিন্তু ডা. আলমাস দিন-দুই পরে যা জানালেন, এর সবকিছু না বুঝলেও তারা কিছুটা শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন।
তাঁর বক্তব্য : রোগটা বেশি ভালো না। বিলরুবিন হাই।… হেপাটাইসি-বি। সংক্রামক ব্যধি… ভাইরাস… এই রোগের সম্পূর্ণ আরোগ্যের খুব ভালো মেডিসিন না থাকলেও খুব ভালো প্রিভেনশন আছে। চিন্তার কিছু নাই। ফুল রেস্ট… টয়লেটেও যাবে না। ডিউটি নার্স সব ব্যবস্থা করবে।
জেনারেল ওয়ার্ডে আজকে রাতটা কাটুক। আগামীকাল একটা কেবিন…
দুপুরের পরপর হন্তদন্ত হয়ে কাদের আসে।
অন্তরার বেডের কাছে কাদের কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই ভারিক্কি গোছের মেট্রোন এসে তাকে স্মরণ করিয়ে দেন, ‘রোগীর সম্পূর্ণ বিশ্রাম দরকার। ডাক্তারের কড়া নির্দেশ। আপনাদের এখানে বেশি না থাকাই ভালো। এর ওপর এটি ফিমেল ওয়ার্ড… পুরুষ মানুষ এলে অন্য রুগীদের অসুবিধা হয়। একমাত্র ভিজিটিং আওয়ার ছাড়া…।’
কাদেরকে বিব্রত হতে দেখে অন্তরার মা তার সাহায্যে এগিয়ে আসেন।
‘ও…আমার ছেলে… ছেলের মতন।’
‘যাই হোক আমাদেরও তো হাসপাতালের নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। রুগীর ভালোর জন্য…।’
কাদের লজ্জিত হয়ে চলে যাওয়ার সময় অন্তরা আধাঘুমে। সে হাত উঁচিয়ে তাকে অভয়-ইশারা দেখায়।
ভিজিটিং আওয়ারে কাদের ফিরে আসে। তার সঙ্গে এক অল্পবয়েসি ডাক্তার। পরনে বোতামখোলা অ্যাপ্রন। গলায় স্ট্যাথো। চোখে ভারী চশমা। ডাক্তার ছেলেটি দেখতে যথেষ্ট কালো হলেও চেহারা শান্ত-সৌম্য।
কাদের অন্তরার মায়ের সঙ্গে তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়।
‘আন্টি… ও সুমন। আমার ছোটবেলার বন্ধু। ওর বাড়িও আমাদের ওখানে। সে এখানে ডাক্তারি পড়ে। ফাইনাল ইয়ারের…’
মা অন্তরার পায়ের কাছে কাত হয়েছিলেন। উঠে বসেন।
‘যাক ভালোই হলো। তোমার ডাক্তার বন্ধু পেয়ে গেলে। পরিচিত ডাক্তার থাকলে অনেক সুবিধা। ডা. আলমাসউদ্দিন অন্তরার নানা…। হসপিটালে আত্মীয়-স্বজন, চেনাজানা থাকলে খুব কাজে লাগে। বল-ভরসা পাওয়া যায়। যাক তোমাকেও পেয়ে গেলাম। আমাদের ভাগ্য… কাদের আমাদের ছেলের মতো…।’ এটুকু বলে অন্তরার মা আত্মসন্তুষ্টির হাসি হাসেন।
ডা. আলমাসের নাম শুনে সুমন আগ্রহী হয়ে এগিয়ে আসে। ‘তাই…। উনি তো আমাদের খুব নামকরা প্রফেসর। দেশের খুব বড় লিভার স্পেশালিস্ট।’
সুমন অন্তরার মাথার কাছে রোগীর ক্লিপ-ফাইলটা মনোযোগ দিয়ে দেখেন। তাকে দেখে ডিউটি নার্সও এগিয়ে আসেন। রোগীর ব্যবস্থাপনা নিয়ে কিছু কথাবার্তা বলেন তারা।
সুমন চলে যাওয়ার সময় অন্তরার মাকে তার টেলিফোন নাম্বার দিয়ে যান।
‘চিন্তা করবেন না। আমি কাছাকাছিই থাকি হোস্টেলে। কল দিলেই চলে আসবে। আর আপনারা আমাদের বড় স্যারের আত্মীয়…। আমাদের দায়িত্বও কম না…।’
কাদেরের প্রতি সন্তুষ্ট হন অন্তরার মা। তিনি মনে মনে আল্লাকে স্মরণ করেন, তিনি মেহেরবান।
…ছেলেটা ভালো… একমাত্র মেয়ের…।
সুমন-কাদের ঘনিষ্ঠ হয়ে বেরিয়ে যায়। তারা ক্যাফেটেরিয়ায় গিয়ে বসে।
‘এখানকার শিঙাড়া খুব ভালো হয়।’
তারা শিঙাড়া-চা নিয়ে বসে। সুমন কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে কাদেরের দিকে চেয়ে থাকে।
‘মাছ তো ভালোই বাগিয়েছিস। মেয়েটি বড় মিষ্টি… ভালো ঘরের নিশ্চয়ই… ডা. আলমাসের আত্মীয় যখন…।’
‘হ্যাঁ, বাবা আমেরিকায়। অনেকদিন থেকে। অন্তরাদেরও কাগজপত্র গোছানো হয়ে এসেছে প্রায়। তারাও যাবে।’
‘তার মানে তুইও এক পা এগিয়ে…। মেয়ের ঘাড়ে পা দিয়ে…।’
কাদের সলজ্জ হেসে বলে, ‘অনেকটা তাই…।’
সুমন চায়ে চুমুক দিয়ে ডাক্তার হিসেবে রোগীর প্রসঙ্গে আসে।
‘রোগীর প্রোফাইলটা যা দেখলাম তাতে খুব ভালো মনে হলো না। বিলরুবিন খুব হাই…। হেপাটাইটিস-বি। ভালো হয়ে যাবে। সময় লাগবে।’
‘জন্ডিস তো তেমন জটিল কিছু নয়। ছোটবেলায় আমার হয়েছিল। কয়েকদিন বিছানায় আটকিয়ে রাখলেন মা। একদিন সকালে মাকে না জানিয়ে ছুট দিলাম বাড়ি থেকে। দুপুরে ফিরে এলাম…। আর তো রোগের দেখা পেলাম না।’
‘তখন তা-ই ছিল। এখনকার জন্ডিস একটু জটিল। এর চার-পাঁচটা ধরন বেরিয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটা বেশ সিরিয়াস…। ভাইরাস সংক্রমণ… একবার পেয়ে বসলে, দূর করা মুশকিল। রোগ ভালো হয়ে গেলেও জীবাণু লুকায়িত থাকতে পারে বছরের পর বছর। সুযোগ বুঝে আবার অ্যাপিয়ার হয়।’
কাদেরকে উৎকণ্ঠিত দেখায়। ‘তাই বলে এতো সিরিয়াস?’
‘অনেকটা তাই। লিভার আক্রান্ত হয় কি-না।’ এটুকু বলে সুমন হেসে ফেলে। কাদেরকে নিশ্চিত করার চেষ্টা করে।
‘তাই বলে মেলামেশা একেবারে নিষেধ নয়, রেখেঢেকে। সাবধানের মার নেই। রোগটা খুব ছোঁয়াচে কি-না।’
‘কী রকম সাবধানতা?’
‘এই ধর রুগী ভিজিট করার পর ভালো করে হাতমুখ ধুয়ে ফেলা। কাপড়-জামা বদলে নেওয়া… ইত্যাদি। এই তো…।’
সুমন একটু দুষ্টুমি করার সুযোগ নেয়।
‘তবে আগের মতো যখন-তখন চুমু না খাওয়াই ভালো। তাই বলে একেবারে নিষেধ নয়। দু-একটা…’
কাদেরও হাসে। তবে তার মধ্যে নীরবে একটা অজানা আশঙ্কা কাজ করে যায়। সে মনে মনে স্থির করে নিতে থাকে যে আগের মতো এতো আগ্রাসী-অস্থির না হয়ে ধীরেসুস্থে এগোবে। হাত বাড়াবে রয়েসয়ে। সুমনের কথামতো রোগটা যে মারাত্মক রকমের সংক্রামক। একবার ধরে বসলে তা দেহে থেকে যায়।
সেদিন বাড়ি ফিরতে ফিরতে কাদের যথাযথ একটা প্ল্যানও করে ফেলে। তার রুগী দেখতে যাওয়া-আসা, তথ্য-তালাশির মাত্রা একটু কমিয়ে আনবে। প্রথমদিকে দুইবার আসার জায়গায় একবার। তারপর দুদিনে একবার। এবং নির্দিষ্ট বিরতিতে তিনদিনে একবার দর্শন দেওয়ার ব্যাপারটা কাদের ভেবে রাখে।… জীবন আগে।
এই রকম একটা ভাবনাচিন্তার পর সত্যি সত্যি কাদেরের এই সংযত আচরণচর্চা শুরু হয়ে যায়।
ডাক্তারের সাবধান-বারণ এবং অন্তরার নিজের শারীরিক দুর্বলতার কারণে কাদেরের এই সংযত রুটিন ভিজিট অন্তরা প্রথমদিকে ধরতে পারেনি। পরে একটু সুস্থ হতে শুরু করলে কাদেরের এই বিলম্বে আসার অনুযোগের পিঠে তার একেক দিন, একেক বানানো অজুহাত দিয়ে যেতে থাকে। প্রথমদিকে অন্তরা ব্যাপারটা তেমন আমলে না নিলেও পরেরদিকে তার মনেও সংশয়-সন্দেহের দানা বেঁধে উঠতে থাকে।
বিশেষ করে, এক মাস পরে হাসপাতাল থেকে রিলিজ হওয়ার সময়কার আজকে তার অনুপস্থিতিটা অন্তরার মোটেই ভালো ঠেকেনি। তা সে স্বাভাবিকভাবে না নিয়ে বরং মনে মনে উলটো একটা ক্ষোভ পোষণ করে রাখে। যেখানে বয়স বাড়তে থাকা মায়ের পক্ষে রাতের বেলা বাড়ি ফেরার পুরো ব্যবস্থাপনাটা একা সামলে ওঠা খুব সহজ ছিল না। আর তার ফোন কল রিসিভ না করার ব্যাপারটা অন্তরার ইচ্ছাকৃত মনে হতে থাকে।

মায়ের এগিয়ে দেওয়া গরম পানিতে অন্তরা গায়ে সুগন্ধি সাবান মেখে আরামের একটা গোসল সেরে নেয়। শরীরটা ঝরঝরে লাগে। সে-রাতে শোয়ার হালকা-পাতলা ম্যাক্সি পরে বের হয় গোসলখানা থেকে।
তখন তাদের বাড়ির দোরঘণ্টা বাজে। অন্তরার মা এগিয়ে দরজা খোলেন।
‘একি তুমি? আশ্চর্য… তোমার অপেক্ষায় আমরা…’
মায়ের কথা শেষ করতে দেয় না কাদের।
‘আন্টি বলবেন না আর… এক পাগলা মাস্টারের পাল্লায় পড়েছিলাম। অন্তরা জানে… তিনি মাঝে মাঝে আমাকে তাঁর প্রজেক্টের কাজে বাড়ি ডাকেন। তাঁর তখন সময়জ্ঞান থাকে না। কয়বার তাঁকে বলার চেষ্টা করলাম… রোগী… হাসপাতাল… তিনি কিছু শুনবেন না… কী করি? কাজ শেষ করে…।’
‘যাক, আমরা কোনো রকমে এসে গেছি। বসো, অন্তরা গোসলে গেছে… একটু বসো।…’
‘আমি বসছি খালাম্মা। তাড়াহুড়ার কিছু নেই।’
অন্তরা কাদেরের আসার খবর পেয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে বসে। মা এসে জানিয়ে গেছেন খবরটা।
অন্তরা তাতে খুব একটা আগ্রহ দেখালো না। সে যেন জানে কাদের আসবে অজুহাত নিয়ে।
অন্তরা দেরিতে ড্রইংরুমে আসে। পরনে তার শোয়ার ঢিলেঢালা ম্যাক্সি হলেও হালকা সাজে সেজেছে অন্তরা। গালে গোলাপি রুজের আস্তরণ। লিপস্টিকে টুকটুকে লাল ঠোঁট। কপালে টিপ। গায়ে দামি পারফিউমের ¯েপ্র।
কাদের কুশন ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।
‘দেখো অন্তরা আমি খুব দুঃখিত। ওই যে ইমতিয়াজ স্যার আমাকে আটকিয়ে ফেলে। কিছুতেই বেরোতে পারলাম না। হসপিটালে গিয়েছিলাম ততক্ষণে তোমরা…।’
অন্তরা কাদেরের পাশে গিয়ে বসে। সে শান্ত-সংযত। কাদের কী বলছে তা যেন তার কানে ঢোকেনি।
‘… দেখো সত্যিই আমি খুব দুঃখিত।’
‘যাক যা হয়ে গেছে।’ অন্তরাকে নিরুত্তাপ শোনায়।
মা কিচেন থেকে বেরিয়ে আসেন।
‘ঘরে তো তেমন কিছু নেই… ভাত-আলু চড়িয়েছিলাম। বরং আমি বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসি। চায়নিজ কিংবা অন্যকিছু। অনেকদিন ভালোমন্দ খাওয়া হয়নি। সবাই এক দৌড়ের মাথায়…।’
কাদের বিব্রত হয়ে উঠে দাঁড়ায়।
‘এটা কেমন দেখায়? বরং আমি যাই খাবার আনতে। না হয় ঘরে যা আছে… তাই…।’
মা তার কথায় কান না দিয়ে বেরিয়ে যান।
‘তোমরা বসো।’
কাদের অন্তরাকে দেখে। এমন অবস্থায়, এমন রূপে তাকে এর আগে কোনোদিন দেখেনি সে।
‘অন্তরা আজ তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। চার্মিং… গ্ল্যামারাস।’
‘তাই।’ সংক্ষিপ্ত উত্তর অন্তরার।
কাদের আলগোছে অন্তরার হাত তুলে নেয়। তার সুরভিত হাতে চুমু খায় কাদের। হাত থেকে নিয়ে হাতের পুষ্পিত বাহুমূলে ঘনঘন চুমোয় ভরিয়ে দিতে থাকে। কাদেরের শ্বাস ঘন হয়। শ্বাসের উষ্ণতা বাড়ে। বাড়ে বুকের কাঁপন। দুহাত তার বাধাহীন হয়ে ছড়িয়ে যায় অন্তরার সারা কবোষ্ণ দেহের নরম ভাঁজে ভাঁজে।
অন্তরা তাকে বাধা দেয় না, আবার এগিয়েও যায় না। বিবস্ত্র প্রায় অন্তরা চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকে কুশনে। কাদেরের চোখের সামনে অন্তরার কোমলসম্ভারে উপচানো বক্ষরেখা, সরু ললিত কটিরেখা ও ভরাদেহী নিতম্ব – ঊরুর ডৌল তাকে করে তোলে উন্মত্ত বেসামাল। কাদের বিরামহীন চুমোর ফাঁকে ফাঁকে ফিসফিসিয়ে বলে যেতে থাকে, ‘তুমি অপ্সরা, অপরূপা, তুমি স্বর্গীয়… তোমাকে ভালোবেসে, তোমাকে পেয়ে আমি ধন্য… ভাগ্যবান…।’
অন্তরা কোনো কথা বলে না। ম্রিয়মাণ, নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে। একসময় তাকে বলতে হয়, ‘ওঠো… মা চলে আসবেন।’
ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে কাদের।
‘ওহ… তাই তো।’
তড়িঘড়িতে কাদের জামা-কাপড় গোছগাছ করে উঠে দাঁড়ায়। হাতের আঙুলে চুল ঠিক করে। স্বাভাবিক হওয়ার ভান করে। কিন্তু তার হৃদ্কম্পন তখনো কমেনি।
অন্তরা ধীরগতিতে তার জামা-চুল ঠিক করতে করতে কাদেরের চোখের দিকে না চেয়ে বলে যায়, ‘তুমি বরং এখন চলে যাও। মাকে আমি একটা কিছু অজুহাত দিয়ে দেবো।’
অন্তরার শান্ত, নির্লিপ্ত চাপাকণ্ঠে এমন একটা আদেশের তেজ ছিল যে কাদেরের আর সেখানে থাকা সম্ভব হয়নি। সে বেরিয়ে যায়।

পরদিন বিকালে কাদের এসে বেল বাজালে অন্তরা দরজার দিকে এগিয়ে যায়। পিপহোল দিয়ে দেখে নিশ্চিত হয়ে সে ঘুরে দাঁড়ায়। মা তাকে অনুসরণ করেন।
‘কে রে?’
‘কাদের।’
‘দরজা খুললি না।’
‘না।’
মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন মা। সামনে তাঁর বন্ধ দরজা।