অম্লান দত্ত এক অমলিন স্মৃতি

সাইফুল ইসলাম

যে-জ্ঞান মানুষকে কিছুমাত্র পরিবর্তিত করে না সেটা তার অন্তরের বস্ত্ত হয়ে ওঠেনি। জ্ঞানকে সদর্থে মনের অংশ করে তোলাই মননের যথার্থ কাজ।

– অম্লান দত্ত

 

বলে নিই, এ-লেখায় ‘আমি’ ব্যক্তি মানুষটি জড়িয়ে যাবে। সেজন্য পাঠকের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে চাই। স্মৃতির জানালা খুলে অন্যের কথা বলতে গেলে, যেন নিয়তির মতো নিজেরই কথা এসে পড়ে বেশি। এটা এমন লেখার প্রধান সমস্যা। সম্ভবত এ-সমস্যা সমাধানের কোনো উপায় নেই। তবে সব কথা আটকে থাকবে না ব্যক্তি-সীমানার মধ্যে। ব্যক্তি থেকে নৈর্ব্যক্তিক হয়ে ওঠা মুক্তমনের ধর্ম। সেই ধর্মের কথা স্মরণ করে এগিয়ে যাওয়া ভালো।

অম্লান দত্তের (১৯২৪-২০১০) সঙ্গে আমার পরিচয় হয় তাঁর জীবনের শেষ অধ্যায়ে, মৃত্যুর কিছুকাল আগে। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হবে, এমনটা ভাবিনি। দু-একটি ঘটনা ও কাজের উপ  সেটা হয়ে ওঠে। একটি বিশেষ কারণ ছিল আমার মানসিক প্রবণতা। বাঙালি আর পাঁচটি ছেলের মতো আমাকে সস্তা কবিতা-গল্পে পেয়ে বসেনি। যদিও বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ অংশের সঙ্গে আমার পরিচয় শুরু হয় স্কুলজীবনে। কিন্তু আমাকে বেশি টেনেছিল বুদ্ধিবৃত্তিক রচনা। যে-রচনা চিন্তাধর্মী, যাতে ঘটেছে সবল মনের পরিচ্ছন্ন প্রকাশ, যা কোনো ইশারা-ইঙ্গিতের তোয়াক্কা না করে সরাসরি অজ্ঞানের গলায় ছুরি বসিয়ে দেয়, এটা আমার ভালো লাগত। এর থেকে কলেজে পড়ার সময়েই আবু সয়ীদ আইয়ুবের (১৯০৬-৮২) লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তাঁর পথের শেষ কোথায় (১৯৭৭) গ্রন্থের ‘ভাষা শেখার তিন পর্ব এবং প্রসঙ্গত’ রচনার এক জায়গায় তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের কথায় তিনি লিখেছিলেন, ‘মানবেন্দ্রনাথ রায়ের অনুগামীদের মধ্যে দুজন উজ্জ্বল রত্নের সঙ্গে বন্ধুত্ব লাভ করলাম চলিস্নশের দশকেই – অম্লান দত্ত ও শিবনারায়ণ রায়।’ ব্যস! এটুকুই আমাকে নাড়া দিয়ে যায়।

আবু সয়ীদ আইয়ুবের নাম জেনেছিলাম রবীন্দ্র-কাব্যের সমালোচনা পড়ার সুবাদে। শিবনারায়ণ রায় (১৯২১-২০০৮) ও অম্লান দত্তের নাম জেনেছিলাম আইয়ুবের বই পড়ে। রংপুরের মতো মফস্বল শহরের কলেজ-পড়ুয়া শিক্ষার্থীর পক্ষে এঁদের নাম জানা একটু কঠিনই ছিল মনে হয়। তবু যে জেনেছিলাম, তার দুটো কারণ ছিল। আমার বয়োজ্যেষ্ঠ এক বন্ধু আছেন। তাঁর মধ্যে দেখেছি অতৃপ্ত মানসিক ক্ষুধা। তাঁর সঙ্গে যখন কিছুটা সখ্যের সম্পর্ক তৈরি হলো, তখন তিনিই আমাকে নিয়ে গিয়ে রংপুর পাবলিক লাইব্রেরির (১৮৫৪) সদস্য বানিয়ে দিলেন। এই লাইব্রেরি ছিল বাংলা সাময়িকপত্র ও গ্রন্থের একটা সোনার খনি। এই লাইব্রেরিতে পেয়েছিলাম শিবনারায়ণ রায়ের রেনেসাঁস (১৯৯২) আর কবির নির্বাসন ও অন্যান্য ভাবনা (১৯৭৩), স্রোতের বিরুদ্ধে (১৯৮৪); অম্লান দত্তের গণযুগ ও গণতন্ত্র (১৯৬৭), প্রগতির পথ (১৯৬৮), পলস্নী ও নগর (১৯৭৩), ব্যক্তি যুক্তি সমাজ (১৯৭৮), দ্বন্দ্ব ও উত্তরণ (১৯৮৯) ছোট ছোট বইগুলো। অম্লান দত্তের অর্থনীতি আর দর্শনঘেঁষা ভাবনায় পুষ্ট বইগুলোর সব কথা বুঝতে পারতাম না। কিন্তু ভাষার আকর্ষণ আমাকে মুগ্ধ করত। যুক্তি টেনে নিয়ে যেত। বাংলাদেশে যাঁরা চিন্তাধর্মী লেখা লেখেন, লক্ষ করেছি, এঁদের সঙ্গে তাঁর ভাষা ও যুক্তি-বিবেচনায় বেশ অনেকটা ফারাক। তাঁর ভাষা নির্মেদ, যুক্তি পূর্বাপর সুশৃঙ্খল, বিবেচনা কল্যাণকামী, রচনা ভাবের আবেগে মনকে কোথাও বিগড়ে দেয় না। তাঁর লেখা নতুন চিন্তার জমি তৈরি করে। সদিচ্ছা আর সত্যানুসন্ধান যে মুক্তচিন্তার অন্যতম শর্ত, তখনই মনে হয়েছিল, অম্লান দত্তের এই বইগুলোতে এই দরের চিন্তার একটা সার্থক ভূমিকা আছে।

ইতোমধ্যে দুটো বিষয় আমাকে খুব উদ্দীপ্ত করে তোলে। অক্ষয়কুমার দত্ত ও আবু সয়ীদ আইয়ুব। এঁদের সম্পর্কে তখনো কোনো
বই-পুস্তক বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে কোথাও পাওয়া যেত না। আইয়ুব সম্পর্কে প্রবন্ধ লেখা হলেও বই হয়নি। অক্ষয় দত্তকে নিয়ে জীবনীগ্রন্থ ছাড়া সমালোচনাধর্মী বই ছিল না। সেসব জীবনীও দুষ্প্রাপ্য। অথচ দুই কালের এই দুজন লেখকের ভূমিকা আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনে মৌলিক। অবশ্য এঁদের কথা একই সঙ্গে ভেবেছি বলে এটা মনে করার কারণ নেই যে, এঁদের ভূমিকা সমানভাবে তুল্য। প্রথমজন বাঙালি জাতির অন্যতম স্রষ্টা; দ্বিতীয়জন এই জাতির একটি বিশেষ অংশের ব্যাখ্যাতা। দুজনের মেজাজের মধ্যে সাসুয্য হচ্ছে শুভবুদ্ধির ঐক্যে। কিন্তু এঁদের দুজনের বিষয়ে তখন বাংলাদেশ ছিল মরুভূমি। এঁদের জানার জন্য কোনো বইপুস্তক ছিল না। কাজেই সাত-পাঁচ না ভেবে, এ-বিষয়ে অম্লান দত্তের কাছে চিঠি লিখি। সে-চিঠির তারিখ ছিল ১২ জানুয়ারি, ২০০৪। তিনি আমাকে সহায়তা করতে পারেন কিনা, তাই ছিল চিঠির প্রতিপাদ্য। কিছুদিন পরেই, ৪ ফেব্রম্নয়ারি শান্তিনিকেতন থেকে আরতি সেন আমাকে লিখেছেন যে, তিনি অম্লান দত্তের কাছে আমার আগ্রহের বিষয় জেনে লিখছেন। আরতি সেনের সঙ্গে আমার জানাশোনা ছিল না। তবে জিজ্ঞাসা পত্রিকায় তাঁর লেখা পড়েছি। বুঝতে দেরি হলো না যে, অম্লান দত্তের অনুরোধে তাঁর এই চিঠি। আমার আরব্ধ বিষয়ে আরতি সেন বেশ কিছু তথ্যও চিঠিতে উল্লেখ করেছেন। লিখেছেন, আমার দরকার হলে তিনি যথাসাধ্য সহায়তা করবেন।

আরতি সেনের চিঠি পেয়ে খুব খুশি হলাম এবং সেই সঙ্গে একটা বিষয়ে আমি সম্বিত ফিরে পেলাম। কারণ, অম্লান দত্তের বয়স তখন আশি। তাঁর পক্ষে আমার চাহিদার সমান সহায়তা করা সম্ভব ছিল না। আমি আরতি সেনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করি। তিনি ছিলেন অম্লান দত্তের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনি বিশ্বভারতীতে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিশ্বভারতীর বিনয়ভবনে অধ্যক্ষতার দায়িত্ব পালন করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের বিদ্বৎসমাজে তিনি বেশ পরিচিত ছিলেন। পরে জেনেছি, সাহিত্য আবহপূর্ণ চারটি পরিবারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল আকৈশোর। আবু সয়ীদ আইয়ুব, শিবনারায়ণ রায়, গৌরকিশোর ঘোষ ও অম্লান দত্ত পরিবারের তিনি ছিলেন মানসিক ভাবের পরমাত্মীয়। আমার সঙ্গে যখন আরতির পরিচয় হয়, তখন তাঁর বয়স ছিয়াত্তর। গ্রন্থিবাতে তাঁর পায়ের আঙুল বাঁকা হয়ে গিয়েছিল। অপরদিকে পিঠের ব্যথায় কিছুটা কুঁজো হয়ে চলাফেরা করতেন। শারীরিক এই সীমাবদ্ধতা নিয়েও ওরকম বয়সে তিনি বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিলেন শহরের একপ্রান্ত থেকে অন্তপ্রান্তে। এমন কষ্টসহিষ্ণু, সরলপ্রাণ আর পরোপকারে তৎপর নারী, আমি খুব বেশি দেখিনি।

 

দুই

আরতি সেনের পরপরই পেলাম অম্লান দত্তের চিঠি। তাঁর ১৬ ফেব্রম্নয়ারির লেখা চিঠিটি উল্লেখযোগ্য।

কলকাতা ৭০০০৬৪

১৬. ২. ২০০৪

প্রীতিভাজনেষু,

আপনি যে মূল্যবান কাজে নিজেকে নিযুক্ত করেছেন তাতে আপনার সাফল্য কামনা করি। এখানে কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি যাঁরা অক্ষয়কুমার দত্ত ও আবু সয়ীদ আইয়ুব বিষয়ে ভালো জানেন, আপনাকে সুপরামর্শ দিতে পারবেন। আপনার ঠিকানা তাঁদের দিয়েছি। আশা করি তাঁদের কাছ থেকে আপনি সংবাদ পেয়েছেন অথবা পাবেন। এঁরাই আপনার নির্বাচিত বিষয়ে আমার চেয়ে যোগ্যতর সহায়ক হবেন বলে আমি মনে করি।

ঢাকায় বন্ধুদের আমার অভিবাদন জানাবেন। প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানবেন।

শুভার্থী

অম্লান দত্ত

তিনি আমার চিঠি পেয়ে কেবল আরতি সেনকে নয় – শিবনারায়ণ রায়, শঙ্খ ঘোষ, নরেশ গুহ, স্বপন মজুমদার প্রমুখের সঙ্গে কথা বলে সকলকেই আমার ঠিকানা দিয়ে, আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করেছিলেন। হাতেনাতে এর প্রমাণ পেলাম। ৬ মার্চ শিবনারায়ণ রায় আমাকে লিখেছেন, তিনি অম্লান দত্তের কাছে আমার আগ্রহের বিষয় জেনে, তাঁর কাছে ঠিকানা পেয়ে লিখছেন। শিবনারায়ণ রায় আমাকে লিখেছিলেন কেবল অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্য নয়, যথার্থ অর্থে আমাকে সহায়তা করার জন্য। কারণ, অক্ষয়কুমার সম্পর্কে এর আগে একটি ছোট কাজ করতে গিয়ে তাঁর তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল। কাজেই এ-ব্যাপারে আমার আগ্রহের কথা জেনে অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে আমাকে লিখেছিলেন। তাঁর চিঠি পাওয়ার কিছুকাল পরেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে আমার সম্পাদনায় ক্ষয়কুমার দত্তের শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ (২০০৫) নামে একটি সংকলন প্রকাশিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে এই সংকলনের একটি কপি আমি অম্লান দত্তকে পাঠিয়ে দিই। বই পেয়ে তিনি আমাকে লিখেছিলেন,

কলকাতা ৭০০০৬৪

১৯. ০১. ২০০৫

প্রীতিভাজনেষু,

আপনি যত্ন করে বই পাঠিয়েছেন, ভালো

 

লাগল। সেই সঙ্গে পরিচয় হল আপনার বান্ধবীর সঙ্গে, তাকেও ভালো লাগল। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এইসব নতুন যোগাযোগ, যত অল্প কালের জন্যই হোক না কেন, তবু সৌভাগ্যের কথা। বিশ শতকটা ছিল আমাদের কাল। একুশ শতক আপনাদের। জানি না কেমন কাটবে, পারি শুধু দূর থেকে শুভেচ্ছা জানাতে।

ইতি

অম্লান দত্ত

এই সময় আমি বেশ কয়েকটি কাজে হাত দিয়েছিলাম। ২০০৩ সালে মোতাহের হোসেন চৌধুরীর (১৯০৩-৫৬) জন্মশতবর্ষ ছিল। ‘স্বদেশচিন্তা সংঘে’র উদ্যোগে ২০ অক্টোবর ঢাকায় তাঁর জন্মদিনের শতবর্ষ পালিত হয়। সেখানে আমি মূল প্রবন্ধ পাঠ করেছিলাম। সে-উপলক্ষে একটি স্মরণগ্রন্থ করার ইচ্ছাও ছিল আমার।
নতুন-পুরনো মিলে সব লেখা তখনো জোগাড় করার বাকি ছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আবু সয়ীদ আইয়ুব সম্পর্কেও তেমন একটি কাজ। তাঁর জন্মশতবর্ষ ছিল ২০০৬। সে-কাজেরও অনেকখানি এগিয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু কলকাতা না-যাওয়া পর্যন্ত সে-কাজটি কিছুতেই সম্পন্ন করা যাচ্ছিল না। কেননা তাঁর পরিবার,
আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবই তো কলকাতায়। কাজেই বাংলাদেশ থেকে যদ্দূর সম্ভব সে-কাজ গুছিয়ে নিচ্ছিলাম। অপরদিকে তখন আমার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল অক্ষয়কুমার দত্ত। সে নিয়ে একটা গভীর অনুসন্ধানের সদিচ্ছা ছিল আমার। এ-বিষয়ে ইতোমধ্যে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিলে ভর্তি হয়েছিলাম। তাঁর ওপর কোনো ভালো গবেষণা হয়নি। বিচ্ছিন্নভাবে তাঁকে নিয়ে বাংলা-ইংরেজি ভাষায় বেশ কিছু প্রবন্ধ লেখা হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো তখনো কেউ একসঙ্গে করে কোনো সংকলন বা স্মরণগ্রন্থ কিছু করেননি। দেখলাম, আমার হাতে তখন পর্যন্ত যে-সমস্ত লেখা আছে এবং তথ্য-উপাত্ত থেকে যে লেখাগুলো পাওয়া সম্ভব, তা দিয়ে অনায়াসে বাংলা-ইংরেজি মিলে দুটি আলাদা বই হতে পারে। নিভৃতে, নীরবে কাজ চলতে থাকল। এসব কাজের ফল ও পরিণতি কী হবে, তখন তা একেবারে মাথায় ছিল না। বাংলাদেশে এসব কাজের বিশেষ কোনো মূল্য ছিল না, আজো নেই। তার প্রমাণ – তখন আমি কোথাও এর প্রকাশক খুঁজে পাইনি। আজো পাওয়া সহজ নয়।

কাজেই তখন এর সবই ছিল আমার আকাঙক্ষা ও স্বপ্নের জগতে। এই আকাঙক্ষার সঙ্গে আর একটি কাজের সূত্রও উঁকি দিয়েছিল। অক্ষয়কুমার দত্তের জীবনী লিখেছিলেন প–ত মহেন্দ্রনাথ রায় বিদ্যানিধি। সে-বইটি প্রথম প্রকাশের পর আর দ্বিতীয়বার সংস্করণ বা মুদ্রণ হয়নি। অনেক অনুসন্ধানের পর এই বইটি আমার হাতে আসে। উনিশ শতকের শ্রেষ্ঠ চিন্তক ও সমাজ-সংস্কারকদের নিয়ে যে-সমস্ত জীবনী লেখা হয়েছিল তখন, আমার বিবেচনায় এটি ছিল সেসব জীবনীর মধ্যে সবচেয়ে বস্ত্তনিষ্ঠ ও নির্ভরযোগ্য। দুষ্প্রাপ্য এই জীবনীও প্রকাশ করা দরকার বলে আমার মনে হয়। এ-বইটি যাতে সুসম্পাদিত হয়ে প্রকাশিত হয়, তা নিয়েও আমি যথেষ্ট পরিশ্রম করে তথ্য-উপাত্ত জোগাড় করেছিলাম। এসব কাজ নিয়ে শিবনারায়ণ রায়ের সঙ্গে কথা বললে, তিনি আমাকে আশ্বস্ত করেন এবং কলকাতায় আহবান জানান। তাঁর সে-আহবান ছিল আমার কাম্য লক্ষ্যের প্রতি যথার্থ ও যোগ্য পুরস্কার।

তিন

হাতে চারটি পা-ুলিপি নিয়ে ১০ সেপ্টেম্বর, ২০০৫ সালে কলকাতার কলেজপাড়া, হ্যারিসন রোডের একটি হোটেলে গিয়ে উঠি। দুদিন পরে, অম্লান দত্তের সি.বি. ১১০ নম্বর সল্টলেকের বাসায়, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই। এর আগে তাঁকে আমি সাক্ষাৎভাবে দেখিনি। তাঁর ছবি দেখেছি বইয়ের মলাটে। সে-ছবি ছিল তাঁর যৌবনের। কলারওয়ালা সাদা শার্ট পরা পেটা গড়নের শরীর, চোখে পুরু চশমা, উলটো দিকে মাথাভর্তি কালো চুল পাট করে অাঁচড়ানো। দীপ্তিমান দুটি চোখ, চোয়াল ঈষৎ চাপানো; কপালের বলিরেখা বলে দেয় স্থিরবুদ্ধির উজ্জ্বলতায় শানানো মেজাজ। আশি বছর বয়সের সেই মানুষটির সঙ্গে যখন আমি দেখা করতে গেলাম, তখন প্রথম দেখেই আমার মনে হলো – একেবারে শান্ত, অবিচলিত-সহিষ্ণুতায় সমাহিত, যেন কোলাহলহীন নিরুত্তাপ গভীরতাই এঁর ধর্ম। শীর্ণকায়, বেঁটে-খাটো, শরীরের হাড় কখানি ছেরেফ চামড়ার আবরণে ঢাকা। চোয়াল বসে গেছে, কপালের নিচে চোখ দুটো উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো জ্বলছে। মাথার প্রায় সব চুল উঠে গেছে। অবশিষ্ট যা আছে, সেসব যেন চলে যাওয়ার জন্য কর্তার কাছে করজোড়ে ছুটি চাইছে।

তিনি যে-বাড়িতে থাকেন, সেটি দোতলা। তিনি নিচতলার বাসিন্দা। খাবার স্থান ও বসার স্থান অভিন্ন। এ বাদে দুটো কক্ষ। শোবার ঘরে একটি খাট পাতা, সেই সঙ্গে মেঝেয় একটি ইজিচেয়ার, আরো ছোট ছোট দুটো টুলবিশেষ। কিছু বই পুস্তক এখানে-সেখানে ছড়ানো থাকলেও দুটো আলমারি বইয়ে ঠাসা। ড্রইংরুমে একটি খাটিয়া, দু-তিনটে টুল, একটি হেলান দিয়ে বসার মতো গদিওয়ালা কাঠের সোফা। সোফার সামনে ছোট একটি টেবিল। দুটো বুকশেলফ, পাশে দেয়ালের সঙ্গে লাগোয়া টুলের ওপর সাবেক কালের টেলিফোন সেট – যাতে আঙুল ঘুরিয়ে নম্বর ডায়াল করতে হয়। তাঁর লেখার জন্য আছে একটি টাইপরাইটার। আধুনিক কম্পিউটার, ফ্যাক্স কিংবা মুঠোফোন তিনি ব্যবহার করতেন না। এসবের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়নি, তা নয় কিন্তু, তাঁর জীবনব্যাপী সাধনার ধ্যান ভাঙতে পারেনি এই ফলিতবিজ্ঞান। সেটা মন্দ হয়নি। তাঁর বসার ঘরের দেয়ালে তিন মনীষীর তিনটি ছবি। গান্ধী-রবীন্দ্রনাথ-শহীদুল্লাহ্। চীনা শিল্পীর অাঁকা একটি বুদ্ধ পোর্ট্রেট। তিনি চীনে বক্তৃতা করতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে এটি উপহৃত। এই ফ্ল্যাটের তিনি একমাত্র সদস্য।

তাঁর এই ফ্ল্যাটে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে একটি মেয়ে আসে। প্রতিদিনের ঘরকন্নার কাজ করে দিয়ে যায়। মেয়েটিকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। মেয়েটির নাম রোজা। মেয়েটি ধর্মে মুসলমান। এই নিয়ে তাঁর সংসার। বাসায় কেউ এলে, তিনি নিজের হাতে চা কিংবা কফি বানিয়ে বিস্কুট কিংবা খোরমা দিয়ে অতিথিসৎকার করেন। অম্লান দত্তকে যাঁরা জানেন, তাঁরা এর বেশি আশা করেন না। যাঁরা তাঁকে জানেন না, তাঁরা তাঁর বাসায় এলে তাঁকে অনেকটা বুঝতে পারেন। কেউ তাঁর সঙ্গে খেতে চাইলে, তাঁর অনুমতি নিয়ে, রুচি অনুযায়ী তাঁকে বাসা থেকে কিংবা বাইরে থেকে খাবার নিয়ে এসে তাঁর সঙ্গে বসে খেতে হয়। এর অন্যথা হওয়ার সুযোগ নেই। তিনি নিরামিষভোজী ছিলেন। এজন্য ডলি তাঁকে ভক্তির দৃষ্টিতে দেখত। তিনি ডলিকে বিশেষ স্নেহ করতেন। মোটকথা, এ যেন অনেকটা ইমানুয়েল কান্টের মতো। মাপমতো চলা, মাপমতো বলা, মাপমতো খাওয়া, ওঠাবসা, ঘুমানো, বিশ্রাম, সবই চলে এই নিয়মের নিগড়ে। তবে কান্ট বিয়ে করেননি। অম্লান বিয়ে করেছিলেন। ঘটনাক্রমে স্ত্রী আমেরিকান। নাম গ্রহণ করেছিলেন, কেটি দত্ত। দুটি সন্তান আছে। একটি মেয়ে, একটি ছেলে। তারা মায়ের সঙ্গে লন্ডনে থাকে। অম্লান দত্তের দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে এর বেশি কিছু আমি জানি না। এ-ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞাসা করার ভরসা পাইনি। অন্য কারো কাছ থেকে তাঁর এ-জীবন সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য কিছু শুনিনি।

 

চার

২০০৫ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ছিল আমার জীবনে বিশেষভাবে স্মরণীয় দিন। কেননা বিশ শতকের একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি চিন্তকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। সেদিন প্রায় ঘণ্টাদুয়েক তাঁর সঙ্গে কাটিয়ে ছিলাম। সল্টলেকের সকালবেলার পরিবেশটা বেশ ঠান্ডা ছিল। চারপাশটা ছিল নিস্তব্ধ। ওঁর বাসাটা সূর্যমুখী অর্থাৎ পূর্বদিকে মুখ করা। সামনের অংশটা অনেকখানি ফাঁকা। একটি ছোট পার্ক স্থানটিকে রমণীয়তা দিয়েছে। এর সহজ কারণ আছে। সকালের সূর্যের আলো এসে পার্কের গাছগুলোতে ধাক্কা খেয়ে ছায়ামাখানো একটা ঘন শীতলতা দান করে। তাতেই তৈরি হয়ে যায় আলাপযোগ্য একটা মানবিক পরিবেশ। তিনি ইতোমধ্যে আন্দাজ করেছিলেন আমার বয়স কিছু বেশি হবে। আমি যে-বিষয় নিয়ে আগ্রহী, সম্ভবত সেটাই তাঁর এই অনুমানের কারণ। আমাকে দেখে তাঁর সে-ভুল ভাঙল। সে-কথা দিয়েই তিনি কথা শুরু করলেন। একটা স্নিগ্ধ হাসির আবহ তৈরি হলো। হাসতে হাসতেই আমি ঘরের চারদিকে দেখছিলাম। তিনি তর্জনী তুলে একটি ছবির দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘বলো তো ওই ছবিটা কার।’ বললাম, ‘শহীদুল্লাহ্র’। খুশি হলেন। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি তো গান্ধী-রবীন্দ্রনাথের অনুসারী, কিন্তু শহীদুল্লাহ্র ছবি আপনার ঘরে কেন?’ বললেন, ‘তাঁর মতো সরল মানুষ, অসাম্প্রদায়িক মানুষ এবং প–ত এক সুনীতিকুমারকে বাদ দিলে আমাদের দেশে আর তেমন কাউকে পাবে না। তিনি ধর্ম, সামাজিকতা কিছুই ত্যাগ করেননি। বাঙালি ও বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা ছিল তাঁর জীবনের কেন্দ্রে। ধর্ম এবং জ্ঞান দুই-ই তাঁর আন্তরিক অনুভবে মান্যতা পেয়েছিল। সব মানুষের সঙ্গে মিশতে পারতেন। সাধারণ মানুষ তাঁকে পীরের মতো শ্রদ্ধা করতেন। সেই শ্রদ্ধায় তিনি তাঁদের বাধা দেননি। তাঁর মধ্যে অহংকার বলে কিছু ছিল না।’ আমার ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। বললাম, ‘এ শিক্ষা মহৎ।’ শহীদুল্লাহ্র ছবিটা আমি আরো একবার দেখে নিলাম। তিনি একটু স্নিগ্ধভাবে হাসলেন। তাঁর এ-হাসির অর্থটা বুঝতে আমার দেরি হলো না। তিনি আমাকে একটু হালকা করে নিতে চাইছিলেন।

তিনি বাংলাদেশের অনেক সংবাদ জানতে চাইলেন। জিলস্নুর রহমান সিদ্দিকীকে চিনি কিনা, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, তসলিমা নাসরিন, এএফ সালাহউদ্দীন আহমদ, আনিসুজ্জামানের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে কিনা ইত্যাদি। প্রিয়ভাষিণী কাঠখড়, গাছের গুঁড়ি ইত্যাদি সামান্য উপকরণ দিয়ে ভাস্কর্য তৈরি করার জন্য বাংলাদেশে সুপরিচিত। তাঁকে লেখা অম্লান দত্তের চিঠির বাহকতার সুবাদে প্রিয়ভাষিণীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। সেই স্বল্প পরিচয়পর্বে তসলিমার একটা ভিন্ন মাত্রার দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণের কথা জেনেছিলাম। মনে হয়েছিল এমন জীবন্ত কথা পাঁচজনের সামনে প্রকাশযোগ্য। তসলিমার সত্য ভাষণের ও সাহসী ভূমিকার কথা ফেরদৌসী বিশেষভাবে উল্লেখ করলেন। কিন্তু দেশে তাঁর ঠাঁই হলো না। রাষ্ট্রে বাক্-স্বাধীনতা না থাকার ফল নিয়ে তিনি অনেক আলোচনা করলেন। তখন বাংলাদেশে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর শাসন চলছিল। তিনি এই শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে বিশেষভাবে জানতে চাইলেন। জানতে চাইলেন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের ভূমিকার কথা।

তিনি প্রশ্ন করেই চললেন। বললেন, ‘ঢাকার বিদ্বৎসমাজের কী অবস্থা? তাঁরা এই সংকট কীভাবে মোকাবিলা করছেন? তাঁদেরও তো দায়িত্ব আছে। তোমার কী মনে হয়?’ আমি একটু অপ্রস্ত্তত হলাম। তিনি আমাকে এভাবে গুরুত্ব দেবেন, ভাবিনি। বললাম, ‘আপনি যাঁদের চেনেন, জানেন, তাঁরা একরকম বিচ্ছিন্ন। বিদ্বৎসমাজের কোনো সংঘশক্তি নেই। তাছাড়া ঢাকায় বিদ্বৎসমাজ বলেও কিছু নেই। বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ নানা দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। কাজেই বৃহৎ স্বার্থে, সত্যের বড় পস্ন্যাটফর্মে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে, কথা বলতে তাঁদের দেখা যাচ্ছে না।’ বললেন, ‘তুমি বিদ্বৎসমাজের যে সংঘশক্তির কথা বলছ, সেরকম কিছু তো কোথাও নেই। তবু অন্যায়ের বিরুদ্ধে বার্ট্রান্ড রাসেলের যে-ভূমিকার কথা আমরা জানি, বিদ্বৎসমাজের ভূমিকা তো সেরকমই হওয়া উচিত।’ আমি বললাম, ‘ব্রিটিশ ভারতে আমরা ছিলাম শারীরিকভাবে পরাধীন। স্বাধীন দেশে আজ আমরা মানসিকভাবে বন্দি। এটা আরো ভয়ানক। আসলে শাসনের মৌল স্তরে দেশি-বিদেশি পার্থক্য নেই।’ কথাটা বোধ হয় একটু কটু হলো। তিনি কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে গেলেন।

 

পাঁচ

নীরবতা না ভেঙে তিনি তার ফাঁকে কফি বানিয়ে বিস্কুটসহ ছোট্ট টেবিলটায় হাজির করলেন। ছোট ছোট পেয়ালা। তাতে দুই-তৃতীয়াংশ কফি ভর্তি। কফি-বিস্কুট খেতে খেতে আমার কাজের খবর জানতে চাইলেন। বললাম, ‘আইয়ুবের জন্মশতবর্ষ ২০০৬-এ। ওঁর সম্পর্কে নানাজনের লেখা সংগ্রহ করে আমি একটি পা-ুলিপি তৈরি করে নিয়ে এসেছি। যদ্দূর জানি, ওঁর সম্পর্কে আজো কোনো বই হয়নি।’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, হয়নি। কেউ উদ্যোগ নেয়নি।’ পা-ুলিপিটি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। তাঁকে দেখতে দিলাম। দেখতে দেখতে বললেন, ‘শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে কথা বলো। আমি তোমার কথা বলেছি। তিনি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য মানুষ। স্বপনও (স্বপন মজুমদার) তোমার কথা জানে। স্বপনের সঙ্গেও কথা বলবে। দে’জ আইয়ুবের সব বই-ই প্রকাশ করেছে। সুধাংশুবাবুকে বললে, এটাও তিনি করতে পারেন।’ বললাম, ‘আইয়ুব সম্পর্কে আপনার কোনো লেখা দেখিনি। আপনি কবে লেখা দেবেন?’ বললেন, ‘লেখা হয়নি, লিখব।’ পরে অবশ্য তিনি লিখেছিলেন, ‘আবু সয়ীদ আইয়ুব জন্মশতবর্ষের শ্রদ্ধার্ঘ্য।’ আমার ইচ্ছা ছিল বইটি আইয়ুবের জন্মশতবর্ষে ২০০৬-এ প্রকাশিত হোক এবং সে-উপলক্ষে তাঁর বন্ধুরা মিলে তাঁর শতবর্ষ পালন করুন। কেননা তখন শিবনারায়ণ রায়, অম্লান দত্ত, নরেশ গুহ, শঙ্খ ঘোষ, আরতি সেন, অরুণ দাশগুপ্ত, মানসি দাশগুপ্ত, মৃন্ময়ী দেবী, স্বপন মজুমদার, মিরাতুন নাহার, স্বরাজ সেনগুপ্ত এবং আবু সয়ীদ আইয়ুবের পুত্র ও পুত্রবধূ সকলেই ছিলেন।

আমার এই ইচ্ছা আমি শঙ্খ ঘোষ, নরেশ গুহ ও স্বপন মজুমদারের কাছেও ব্যক্ত করেছিলাম। নরেশ আইয়ুব সম্পর্কে আমার উৎসাহ লক্ষ করে তাঁকে লেখা আইয়ুবের সমস্ত চিঠিপত্র আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এমনকি বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত দুর্লভ ইংরেজি জার্নাল বিশ্বভারতী কোয়ার্টালি
‘আইয়ুব-সংখ্যা’টিও আমাকে দেখতে দিয়েছিলেন। আইয়ুব সম্পর্কে নরেশ গুহ আমাকে একটা মূল্যবান কথা শুনিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আইয়ুব আমাদের গদ্যভাষার শৈথিল্য থেকে মুক্তি দিয়ে প্রকৃত চিন্তা ও যুক্তির ধার বার করেছিলেন। রবীন্দ্র-কাব্যের তাত্ত্বিক আলোচনা তাঁর সেই চিন্তা ও যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথের কাব্য-সত্য ও জীবন-সত্য আলাদা নয়, অভিন্ন। এই তত্ত্বের প্রকাশ বাংলা ভাষায় নতুন। এটাই তাঁর প্রতিভার সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান। এই কারণে, সমকালীন বাঙালি বিদ্বজ্জনেরা আইয়ুবকে বিশেষ সমীহ ও শ্রদ্ধা করতেন।’

পশ্চিমবঙ্গে আমি সেবার চলিস্নশ দিন অবস্থান করেছিলাম। আইয়ুব-সম্পর্কিত পা-ুলিপিটি যথাসম্ভব গুছিয়ে স্বপন মজুমদারের হাতে দিয়েছিলাম। তাঁর হাতে পা-ুলিপি দেওয়ার একটা বড় কারণ ছিল। আবু সয়ীদ আইয়ুব যখন অম্লান দত্তকে সঙ্গে নিয়ে কোয়েস্ট পত্রিকা সম্পাদনা করছিলেন, তখন স্বপন ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের ছাত্র (পরে এই বিভাগে অধ্যাপনা করেন)। এই সময় আইয়ুব কোয়েস্টের কাজে স্বপনকে পেয়েছিলেন। স্বপনের নানা কাজে পারদর্শিতা ও গুণগ্রাহিতা দেখে আইয়ুব ও গৌরী দুজনেই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, স্বপন তাঁদের দুজনেরই বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য হয়ে ওঠেন। স্বপন বহু-বিচিত্র বিষয়ের খবর রাখতেন। আইয়ুব ও গৌরীর পক্ষে এ ছিল দারুণ প্রাপ্তি। স্বপনের মধ্যে তাঁরা আরো দেখেছিলেন অপরিসীম কর্মস্পৃহা এবং অন্যকে উৎসাহ দেওয়ার সমর্থ। সত্য যে, অবিরত উৎসাহ-দান না থাকলে অসুস্থ আইয়ুবের শেষ দিকের রচনাগুলো হয়তো হয়েই উঠত না। আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ থেকে পরবর্তী সব বই-ই স্বপনের উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনায় আলোর মুখ দেখেছিল। কাজেই আইয়ুব-পরিবারের সমস্ত ব্যাপারে স্বপন ছিলেন ডানহাত। এসব কারণে তিনি গৌরী ও আইয়ুবের পুত্রতুল্য হয়ে উঠেছিলেন।

আমি এসব তথ্য জেনেছিলাম আরতি সেন ও অম্লান দত্তের কাছে। স্বপন মজুমদারের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর, আমারও মনে হয়েছে কথাগুলো মিথ্যা নয়। অম্লান যে আমাকে স্বপনের সঙ্গে দেখা করতে বলেছিলেন, তার কারণ সম্ভবত এই।

স্বপন মজুমদারের সঙ্গে কথা হয়েছিল সংকলনটি আইয়ুবের জন্মশতবর্ষে প্রকাশিত হবে। তিনি দে’জ পাবলিশিংয়ের অন্যতম উপদেষ্টা। তিনি দায়িত্ব নিলেন দে’জ থেকে সেটা প্রকাশিত হবে। সংকলনটির নামকরণ – আইয়ুব স্মরণগ্রন্থ, স্বপন করে দিয়েছিলেন এবং কয়েকটি লেখাও তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। তিনি নিজেও লিখেছিলেন। আমি উৎসর্গপত্র ও অন্যান্য কাজ সম্পন্ন করে দিয়েছিলাম। যে-সমস্ত কাজ ও উদ্দেশ্য নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে গিয়েছিলাম, তার অনেকটা এগিয়ে নিয়ে ঢাকায় ফিরেছিলাম। যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিল আমার কাজগুলোর অগ্রগতি। আমি ইতোমধ্যে গ্রন্থের ভূমিকা ও আরো দুটি লেখা সংকলনভুক্ত করার জন্য পাঠিয়েছিলাম। ২০০৬ ডিসেম্বর গড়িয়ে ২০০৭-এর ডিসেম্বরও আসছে কিন্তু আইয়ুব স্মরণগ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে না। স্বপন মজুমদার ও অম্লান দত্তকে চিঠি লিখে জানতে চাইলাম, কী সংবাদ। অম্লান দত্ত আমাকে লিখেছিলেন,

সি. বি. ১১০

সল্টলেক

কলকাতা ৭০০০৬৪

২৮. ১০.০৭

প্রীতিভাজনেষু,

আপনার চিঠি পেলাম। কাল চিঠি পেয়েছি, কালই স্বপন মজুমদারের সঙ্গে কথা বলেছি। স্বপন বলছেন, বইটা ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত হবে। সেই সময়ে পূষণ (আইয়ুবের পুত্র) কলকাতায় আসবে, পূষণের উপস্থিতিতে বইটি বেরোবে। দেখা যাক, যা বলা হল তাই ঘটে কি না! স্বপন বলছেন উনি এই মর্মে আপনাকে চিঠি পাঠিয়েছেন, আপনি চিঠি পেয়েছেন?

যে শ্রম ও নিষ্ঠার সঙ্গে আপনি আইয়ুব সম্বন্ধে বইটি প্রস্ত্তত করেছেন সেটা শ্রদ্ধার যোগ্য। অনেক আগেই পুস্তকটি প্রকাশিত হওয়া উচিত ছিল। দীর্ঘকাল ধরে কাজটা পড়ে আছে, প্রকাশনার নির্ধারিত সময় ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছে, এটা দুঃখের ও লজ্জার কথা।

যশোরে আমার এক বন্ধু থাকেন, অধ্যাপক মাযহারুল হান্নান। ওখানকার কলেজে ইতিহাসের শিক্ষক ছিলেন, পরে কলেজের অধ্যক্ষ হন। উনি আমাকে ডেকেছেন ওখানে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে কিছু বলবার জন্য।

আমার প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানবেন।

অম্লান দত্ত

অম্লান দত্ত তখনো চিঠিতে আমাকে ‘আপনি’ সম্বোধন করেছেন। পরে তা পরিবর্তিত হয়েছে। যা হোক, তাঁর চিঠি পেয়ে কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। সেই সঙ্গে একটু খারাপও লাগল। খারাপ লাগল এই কারণে যে, কাজটির অগ্রগতি ও অন্যান্য সংবাদ আমাকে জানানোর দায়িত্ব প্রকাশকের। কথাও হয়েছিল সেভাবে। স্বপন মজুমদার হয়তো আমাকে লিখেছিলেন, কিন্তু তাঁর চিঠি আমি পাইনি। আমার উৎকণ্ঠা নিরসন করলেন অম্লান দত্ত! এ আমার সৌভাগ্য।

কিছুদিন পরে জানা গেল, বইটি নিশ্চিত বের হচ্ছে এবং সে-উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানের দিন-তারিখ ঠিক করে কার্ড ছাপা হয়েছে। আমি যেন নির্দিষ্ট দিনে উপস্থিত হতে পারি। এ-সংবাদ আমি পেলাম অনেক দেরিতে। ভিসা ওই নির্দিষ্ট তারিখের আগে পাব কিনা সন্দেহ ছিল।

আমি ভিসার জন্য চেষ্টা করলাম। ভিসাও পেলাম কিন্তু অনুষ্ঠানের তারিখ পার হওয়ার পরে। কলকাতায় অনুষ্ঠানটি ছিল ২৩ ডিসেম্বর, ২০০৭-এ। আমি ভিসা পেয়েছিলাম ২৬ ডিসেম্বর। ভিসার এই জবরদসিত্ম দেখে কলকাতায় যাওয়ার আগ্রহ কমে গিয়েছিল। পরে আমি ২৪ জানুয়ারি, ২০০৮-এ গিয়েছিলাম। শঙ্খ ঘোষ ও অম্লান দত্তের কাছে জেনেছিলাম, আইয়ুবের পুত্র ও পুত্রবধূ, তাঁর অনুরাগী ও বন্ধুরা প্রায় সকলেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন। ভিসা পেতে দেরি হয়েছে জেনে, তাঁরা দু-দেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক জটিলতাকে দায়ী করে দুঃখ প্রকাশ করলেন। অনুষ্ঠানে আমি না থাকায়, তাঁরা বলছেন, আমার কথা স্বাভাবিকভাবেই কিছু বেশি হয়েছিল। এ-কথা শুনে আমি খুব সংকোচবোধ করেছিলাম।

 

ছয়

আর একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করে এ-লেখা শেষ করব। ঢাকায় আহমদ শরীফ প্রতিষ্ঠিত ‘স্বদেশ চিন্তা সংঘে’র পরিচালনা কমিটির আমি অন্যতম সদস্য ছিলাম। তখন এই সংগঠনের সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। আজো তিনি সভাপতি। সম্পাদক হাসান ফকরী। প্রথমবার কলকাতা থেকে ফিরে এসে সংগঠনের নিয়মিত শুক্রবারের বৈঠকে উপস্থিত হলে, সকলেই আমার কলকাতার অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলেন। আলোচনায় বিশেষভাবে আমি অম্লান দত্তের কথা উল্লেখ করেছিলাম। সেদিনই ঠিক হয়, ‘ড. আহমদ শরীফ স্মারক বক্তৃতা’ করার জন্য অম্লান দত্তকে আনা হবে। আমি সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বয়সের কথা তুলে বললাম যে, উনি ঘর-বার খুব কম হন। বক্তৃতা করার জন্য এতদূরে আসতে চাইবেন কিনা, জানি না। তবে বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর মধ্যে একটা ভিন্ন রকম আগ্রহ দেখেছি। তিনি কুমিল্লার সন্তান।

২০০৯ সালের আহমদ শরীফ স্মারক বক্তৃতার জন্য অম্লান দত্তের নাম ঠিক করা হলো। সম্পাদক হাসান ফকরী কলকাতা গিয়ে তাঁকে সম্মত করিয়ে, তাঁকে ‘বাই রোডে’ নিয়ে আসার কথা বলে এলেন। এটা শুনে আমি আপত্তি করলাম। তাঁকে air-এ নিয়ে আসার জন্য ‘ড. আহমদ শরীফ স্মারক বক্তৃতা’ আয়োজক কমিটির প্রধান দুই ব্যক্তিকে অনুরোধ করলাম। তাঁরা বললেন, ‘তোমার দুশ্চিন্তার কারণ নেই। তিনি নিজেই ‘বাই রোডে’ আসতে রাজি হয়েছেন – কোনো অসুবিধা হবে না।’ আমি বললাম, ‘সম্ভবত, তিনি নিজের বাবদে অতিরিক্ত ব্যয়ের বিষয়টিকে বাহুল্য মনে করে ‘বাই রোডে’ আসতে চেয়েছেন। তাঁর এ বিবেচনায় আমাদের সম্মত হওয়া উচিত হবে না। কারণ, তাঁর বয়স তখন পঁচাশি।’ আমার কথায় কাজ হলো না। সম্পাদকের সঙ্গে কী কথা হয়েছিল আমি তখন জানতাম না। আমার মন খারাপ হয়ে গেল। আমি আর উচ্চবাচ্য না করে চুপচাপ থাকলাম পরিণতি দেখার জন্যে। ২৩ ফেব্রম্নয়ারি তিনি ঢাকায় এলেন। বেনাপোল থেকে তাঁকে নিয়ে আসার কথা আমাকে বলা হয়েছিল। আমি না করেছিলাম। কেননা তাঁর এই ‘বাই রোডে’ আসাটা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। আমি রাস্তাঘাটের অবস্থা ভালো করে জানতাম। তাঁর অসহনীয় কষ্ট হবে আমি নিশ্চিত ছিলাম। সেটা সহ্য করতে পারব না বলে আমি তাঁকে আনতে বেনাপোলে যাইনি। পরে ‘স্বদেশ চিন্তা সংঘে’র অন্য একজন কর্মী বেনাপোল থেকে তাঁকে একটি গাড়িতে করে নিয়ে এলো।

আবুল কাসেম ফজলুল হক তখন থাকতেন শহীদ মিনার সংলগ্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসিক বাড়ির নিচতলায়। প্রথমে তাঁকে সেখানেই নিয়ে আসা হলো। তিনি যখন এই বাসায় এসে পৌঁছলেন, তখন সন্ধ্যা। এমনিতে তিনি অত্যন্ত শুকনো মানুষ। তদুপরি সারাদিনের ক্লান্তিকর জার্নিতে আরো শুকিয়ে গেছেন। যে-গাড়িতে তাঁকে নিয়ে আসা হলো, দেখলাম তাতে এসি নেই। তাঁর মুখের দিকে তাকালাম কিন্তু কথা বলতে পারলাম না। নিজেকে যেন অপরাধী মনে হলো। খুব স্পষ্ট মনে আছে, তিনি হাত-মুখ ধুয়ে ড্রইংরুমে এসে যখন বসছিলেন, তখন আমিও তাঁর পাশ ডিঙিয়ে অন্য একটি আসনে বসতে যাচ্ছিলাম। চকিতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন আছো?’ আমি উত্তর না দিয়ে বোকার মতো কেবলই তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এরই মধ্যে অনেক লোকজন এসে গেছে। তাঁকে নাস্তা করিয়ে আহমদ শরীফের বাসায় বিশ্রামের জন্য পাঠানো হলো।

পরের দিন, ২৪ ফেব্রম্নয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্টাডিজ ভবনের কনফারেন্স হলে অনুষ্ঠান হলো। হলভর্তি লোক। জায়গা সংকুলান হলো না। অনেকে বাইরে দাঁড়িয়ে ওঁর বক্তৃতা শুনলেন। বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘মনুষ্যত্বের ভবিষ্যৎ’। লিখিত বক্তৃতা তিনি পড়েননি। ছোটবেলা থেকেই তিনি বক্তৃতায় ছিলেন পারঙ্গম। গুছিয়ে কথা বলার শক্তি ছিল তাঁর অসাধারণ। এখানেও বিষয়টি তিনি মুখে বলে গেলেন। আমরা নীরব হয়ে কান পেতে শুনলাম। তাঁর বক্তৃতার পরে পুরস্কার ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলো। স্মারক বক্তৃতার জন্য পঁচিশ হাজার টাকা সভাপতি তাঁর হাতে তুলে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সে টাকা তিনি ‘স্বদেশ চিন্তা সংঘে’র তহবিলে প্রদান করলেন। দর্শক-শ্রোতার মধ্যে বিপুল করতালি পড়ে গেল। পরিবেশ এবং অস্ত্র কীভাবে মানবজাতির সর্বনাশ করছে, এই ছিল সেদিনে তাঁর বক্তৃতার বিষয়। ২৫ ফেব্রম্নয়ারি পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের মতো এক কলঙ্কময় ঘটনা ঘটল। এই দিনই অম্লান দত্ত কলকাতায় ফিরে গেলেন। তাঁকে বেনাপোল থেকে যেভাবে নিয়ে আসা হয়েছিল, সেভাবে রেখে আসা হলো!

কয়েকদিন পর সদ্য হয়ে যাওয়া আহমদ শরীফ-সম্পর্কিত অনুষ্ঠান ও তাঁর ঢাকায় ঘুরে যাওয়া নিয়ে আমার অনুভূতির কথা জানিয়ে একটি চিঠি লিখলাম। সে-চিঠির উত্তরে তিনি লিখেছিলেন,

কলকাতা

১৩/৩/০৯

প্রিয় সাইফুল,

তোমার চিঠি আজই পেলাম। আমার স্মৃতিতে এবং ভাবনায় ঢাকা তথা বাংলাদেশের জন্য একটা প্রীতিপূর্ণ স্থান আছে, তাই সেখানকার আমন্ত্রণ সাগ্রহে গ্রহণ করেছিলাম। আমার এখন অনেক বয়স হয়েছে, সময়ের নিয়মে দৃষ্টিশক্তি দৈহিকশক্তি সবই হ্রাস পেয়েছে। কলকাতার ভিতরেও স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করা আর সম্ভব হয় না। কাজটা কষ্টসাধ্য বলেই কেউ আমাকে বাসস্থান থেকে সভাস্থানে নিয়ে যান, আবার বাড়িতে সঙ্গে করে পৌঁছে দেন। স্বদেশ চিন্তা সংঘকে আমি কলকাতা-ঢাকা-কলকাতা যাতায়াতের ক্ষেত্রেও সেই রকম ব্যবস্থা করতে অনুরোধ জানিয়েছিলাম, হাসান ফকরী সাহেব সে কথা ভোলেন নি। কিন্তু কার্যত সেই রকম ব্যবস্থা করা হয় নি। এ নিয়ে তোমাকে অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে জেনে দুঃখিত হলাম।

অক্ষয়কুমার দত্ত বিষয়ে তোমার দীর্ঘ রচনাটি পুস্তক আকারে প্রকাশিত হতে চলেছে জেনে আনন্দিত হলাম। আমার কাছ থেকে তুমি একটি ভূমিকা চেয়েছ। এই সঙ্গে আলাদা পাতায় কয়েকটি বাক্য লিখে পাঠালাম। এতে তোমার উদ্দেশ্য পূর্ণ হবে কি না জানি না।

তুমি এবং স্মৃতি আমার ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা জেনো।

অম্লান দত্ত

দ্র. এই চিঠির প্রাপ্তি সংবাদ জানালে আশ্বস্ত হব।

 

সাত

উলিস্নখিত চিঠির দু-একটি তথ্য সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু কথা বলা আবশ্যক। প্রথমে ‘অপ্রীতিকর অবস্থা’র কথাটা বলে নিই। কীভাবে এই অবস্থার তৈরি হলো। অম্লান দত্তকে কোথায় রাখা হবে – এ নিয়ে এক সভায় কথা উঠলে আমি এশিয়াটিক সোসাইটির রেস্ট হাউসের উল্লেখ করেছিলাম। সেখানে সুন্দরভাবে থাকার সুব্যবস্থা আছে। আমি তখন বাংলাপিডিয়া সম্পাদনার কাজে ও-প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত ছিলাম। ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, সেখানেই তাঁকে রাখা হবে। পরে এ-সিদ্ধান্ত বাতিল হয়ে তাঁকে আহমদ শরীফের বাড়িতে রাখা হয়, এটা আমি কারো কাছে শুনিনি। এটা জানলাম ভিন্ন এক পরিস্থিতির মুখে পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই ফকরী সাহেব তখন অম্লান দত্তের দেখভাল করছিলেন। তাঁর থাকার অবস্থান পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু উনি কোথায় আছেন, জানি না বলে ফকরী সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তিনি কোথায় আছেন’, সঙ্গে সঙ্গে তিনি বাধা দিয়ে বললেন, ‘এখন দেখা করা যাবে না, উনি বিশ্রাম নিচ্ছেন।’ এটা ২৪ তারিখের কথা। তখন দুপুর বারোটা হবে। আমার দেখা করা প্রয়োজন – কথাটা আবার বলায় ফকরী সাহেব শক্ত অবস্থান নিলেন। বললেন, ‘উনি বিকেলে যখন অনুষ্ঠানে আসবেন, তখন দেখা করো।’ দেখলাম, অম্লান দত্ত কোথায় বিশ্রাম নিচ্ছেন, সেটাও তিনি বলবেন না। ‘স্বদেশ চিন্তা সংঘে’র একজন সদস্য হিসেবে অম্লান দত্তকে সড়কপথে আনার ব্যাপারে আমার আপত্তির কথা ইতোমধ্যে উল্লেখ করেছি। ঠিক এজন্য বেনাপোলেও আমি তাঁকে আনতে যাইনি। এসব কারণে কি তিনি আমাকে দেখা করতে দিচ্ছেন না? আমার এরকম ধারণা হওয়ায়, আমি তাঁকে খুলে বললাম অম্লান দত্তের সঙ্গে সে-মুহূর্তে দেখা করা কেন জরুরি। তাঁর মেজাজ উঁচুতে বাঁধা ছিল। সে-অবস্থায় বললেন, ‘উনি শরীফ স্যারের বাসায় আছেন, তুমি এই কাজটি স্বপনকে দিয়ে করিয়ে নিও, তাঁর সঙ্গে গল্প করো না।’১০

আহমদ শরীফের বাসায় গিয়ে দেখলাম, দোতলার এক কক্ষে ছোট একটি খাটে তিনি কাত হয়ে চোখ বুজে শুয়ে আছেন। তাঁর বিশ্রামকক্ষটির দরজা অল্প ভেড়ানো ছিল। আমার কণ্ঠ শুনে তিনি বিছানা থেকে উঠে বসলেন। দু-একটি কুশল বিনিময় হচ্ছে – এমন সময় নাট্য অভিনেতা মামুনুর রশীদ এলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য। তিনি অম্লান দত্তকে তাঁর পরিচয় দিলেন। পরে বাংলাদেশের নাটক ও সাংস্কৃতিক কর্মকা- নিয়ে মামুলি ধরনের কিছু আলাপ হলো। তখন তাঁরা মান্নান হীরার লেখা প্রসঙ্গ বিদ্যাসাগর নাটকের রিহার্সাল করছিলেন। ২৫ ফেব্রম্নয়ারি সেটি মঞ্চস্থ হবে, দেখার জন্য অম্লান দত্তকে তিনি অনুরোধ করলেন। আমাকে সঙ্গে নিয়ে এ-নাটকটি তাঁর দেখার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু পরের দিনই পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের মতো এক নজিরবিহীন ঘটনা ঘটল। মামুনুর রশীদ চলে গেলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক এলেন। আমি তাঁকে চিনি না। কোনোদিন তাঁর নামও শুনিনি। দু-এক কথার পর তিনিও চলে গেলেন।

যে-জরুরি কাজের জন্য আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, এখন সে-প্রসঙ্গ বলি। অম্লান দত্ত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পিএইচডি ডিগ্রির একজন বহিস্থ পরীক্ষক ছিলেন। তাঁর এবং অপর দুজন পরীক্ষকের সম্মতিক্রমে ইতোমধ্যে আমার ডিগ্রি Awarded হয়ে যায়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্য সম্মানী অম্লান দত্তকে দেওয়া যায়নি। সম্ভবত, দেশের বাইরে হওয়ায় এমনটা ঘটেছে। যেহেতু তিনি তখন ঢাকায় আসছেন, সেজন্য ফজলুল হক স্যার আগেই আমাকে একটি ফরম দিয়ে রেখেছিলেন। কথা ছিল সে-ফরম পূরণ করে আমি যেন তাঁর স্বাক্ষর নিয়ে রেজিস্ট্রার বিল্ডিং থেকে সম্মানীটা তুলে তাঁর হাতে দিই। সেদিন ও-কাজ করতে গিয়ে অম্লান দত্তের যে-পরিচয় পেয়েছিলাম তা উল্লেখযোগ্য।

তাঁকে ফরমটা দেখিয়ে তার ইতিবৃত্ত জানিয়ে বললাম যে, ‘এই জায়গাটায় আপনি একটি স্বাক্ষর দিন, আমি আপনার সম্মানীটা উঠিয়ে দিই।’ তিনি বললেন, ‘আমার স্বাক্ষর দরকার নেই। এই টাকা দিয়ে আমি কী করব।’ ইতোমধ্যে আমি অম্লান দত্ত নামের ব্যক্তি মানুষটিকে যতটুকু জেনেছি, তাতে আমার মনে হয়েছে, তাঁর ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’র অর্থ আমাদের মতো দুর্বল নয়। তবু সাহস করে আর একবার অনুরোধ করলাম। শর্ত দিয়ে বললেন, ‘তুমি যদি টাকাটা নাও তাহলে আমি স্বাক্ষর করে দিই।’ আমি হ্যাঁ বলায়, তিনি ফরমে স্বাক্ষর করলেন। অতি অল্প কয়েকটি টাকা। মাত্র তিন হাজার। পরে এই টাকাটা আমি আমার দরিদ্র শিক্ষার্থী ভাইপোকে দিই।

মুহূর্তে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, দেড়টা। ঘড়ি দেখলাম বলে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাড়া আছে?’ বললাম, ‘না, আপনার একটু বিশ্রাম নেওয়া দরকার। বিকেল ৪টায় তো আপনাকে বক্তৃতা করতে হবে। সম্পাদক সাহেব নিষেধ করেছেন, আপনার সঙ্গে গল্প করতে।’ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু স্নিগ্ধ হাসি হাসলেন। অর্থপূর্ণ ছিল সে-হাসি। তখন বুঝিনি। পরে বুঝেছিলাম। বললেন, ‘বসো।’ আমার ব্যক্তিগত অনেক বিষয়ে খোঁজ নিলেন। বললেন, ‘তোমার এশিয়াটিক সোসাইটির চাকরিটা স্থায়ী কিনা।’ বললাম, ‘না।’ পরমাত্মীয়ের কণ্ঠে বললেন, ‘ধৈর্য হারাবে না, কাজ করে যাচ্ছ, বিফল হবে না। আজ না হোক, কাল হবে।’ আমার জীবিকা নিয়ে ওঁর উৎকণ্ঠা ছিল।

আগের দিন ছোট্ট একটি প্যাঁটরায় করে বয়ে আনা ওঁর যেকথা বলিতে চাই বইটির কথা ঠালাম। বললাম, ‘আপনার দুই ভাইয়ের সঙ্গে আমাকেও বইটি উৎসর্গ করেছেন, এ আমার সৌভাগ্য। এমনভাবে ঋণী করলেন, এ-ঋণ শোধ করব কীভাবে।’ তিনি একটি আশ্চর্য কথা শোনালেন। বললেন, ‘সমাজ আমাদের যা দেয়, তা আমরা শোধ করতে পারি না। সেটা শোধ করাও যায় না। কিন্তু আমাদের অনুভবে যদি সমাজের সেই দায়বোধটা থাকে, তবে আমাদের
ছোট-বড় নানা কাজের ভেতর দিয়ে তার শুদ্ধ রূপের প্রকাশ ঘটে। মানুষ হিসেবে আমাদের সুনীতিবোধের সেটা এক প্রধান দিক। এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, আমরা কিছু একটা করলাম বা দিলাম। সমাজকে আমরা কেউ কিছু দিতে পারি না। সে সাধ্য আমাদের নেই। মানুষ যখন শুদ্ধচিত্তে কেবল তার নিজের সংকল্পিত কাজ সচেতন ও সজ্ঞানে করে যায়, সমাজ তখন স্বাভাবিকভাবেই উপকৃত হয়। সেটাকেই বলা হয়েছে মানুষের সামাজিক দায়।’ মানুষের ‘সামাজিক দায়’ আমি নতুন করে শিখলাম। এ এক অসামান্য অন্তর্দৃষ্টি। আমরা মুষ্টিমেয় মানুষ সামাজিক দায় কখনো কখনো স্বীকার করি; কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পালন করি না। আমি অম্লান দত্তের চিঠি থেকেই তার প্রমাণ পেলাম। স্বদেশ চিন্তা সংঘ অম্লান দত্তকে আনা-নেওয়ার দায় স্বীকার করেছিল কিন্তু তা পালন করেনি।১১ আমরা কথা বলি, কাজ করি না। বিপদে পড়ে অনেক সময় দায় স্বীকার করি, কিন্তু দায় পালন করি না। অঙ্গীকার রক্ষা না করা যে ব্যক্তিত্বের স্খলন – এ বোধ আমাদের অতি অল্প মানুষের মধ্যেই আছে। অম্লান দত্তকে বহুবার বলতে শুনেছি, ‘তুমি সেই অঙ্গীকার করবে, যা তুমি পালন করতে পারবে।’ ‘স্বদেশ চিন্তা সংঘ’ অম্লানের নৈতিক চরিত্র জানত না। ফলে তাঁর সঙ্গে ব্যবহারে ভুল করেছে। সেই ভুলের প্রকৃত স্তরটার দিকে তিনি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে গেলেন।

আহমদ শরীফের বাড়িতে অম্লান দত্তের সঙ্গে আমার শেষ দেখা। মনে আছে, সেদিন তাঁর কাছ থেকে একাধিকবার ওঠার অনুমতি চেয়েছিলাম, প্রত্যেকবারই বলেছেন, ‘বসো।’ তিনিই আমাকে চিঠিতে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, ‘জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এইসব নতুন যোগাযোগ, যত অল্প কালের জন্যই হোক না কেন, তবু সৌভাগ্যের কথা।’ কে জানে, তাঁর সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না। ‘কলকাতায় এসো’ – কথাটি বারদুয়েক বলেছিলেন। আমার দুর্ভাগ্য, জীবিকার যন্ত্রণায়, আর্থিক অনটনে জীবনের প্রসাদ গ্রহণ করার জন্য তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আর যেতে পারিনি। তবু যখন যা দাবি করেছি, তিনি তা পূরণ করেছিলেন। আজ আর এ-কথা প্রকাশ করতে বাধা নেই যে, আমার অনুরোধেই তিনি আমার পিএইচডি ডিগ্রির বহিস্থ পরীক্ষক থাকতে সম্মত হয়েছিলেন। তাঁর দেওয়া অতি সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট দেখে আমার দ্বিতীয় পরীক্ষক অধ্যাপক খোন্দকার সিরাজুল হক ভাইভা বোর্ডেই আমাকে বলেছিলেন, ‘অম্লান দত্ত যথার্থই স্কলার। এ না হলে কি কেউ এমন একটা থিসিসের মূল কথা মাত্র পাঁচটি বাক্যে বলে দিতে পারেন?’ পরে অম্লান দত্ত আমার অনুরোধে এই রিপোর্টটি কিছু যোগ-বিয়োগ করে বই আকারে মুদ্রিত গবেষণাপত্রের ভূমিকা তৈরি করে দিয়েছিলেন।

 

আট

১৯২৪ সালের ১৭ জুন অম্লান দত্ত জন্মেছিলেন কুমিল্লায়। ২০১০ সালের ১৮ ফেব্রম্নয়ারি তাঁর মৃত্যু হলো কলকাতায়। তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে নিজের সম্পর্কে বলতেন, ‘যে কাজ নিশ্চিত অন্যায় বলে আমি বিশ্বাস করি সে কাজ করিনি।’ তাঁর আরো একটি কথা উল্লেখযোগ্য। কোন ভালোবাসা মূল্যবান, জীবনে এটা বিচার করা দরকার। সেটা করলে দেখা যাবে, যে-ভালোবাসা ঠিক তার বিপরীত ধর্ম তৈরি করতে পারে না, অর্থাৎ ঈর্ষার জন্ম দিতে পারে না, সেটাই মূল্যবান।

তাঁর পুরো জীবন ছিল অধ্যয়ন ও অধ্যাপনায় দীপান্বিত। দেশ-বিদেশে পড়িয়েছিলেন, সেটা বাদ দিলেও তিনি ভারতের মতো একটি বিরাট রাষ্ট্রের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ছিলেন। প্রশাসন তাঁকে চালাতে হয়েছিল। এই প্রশাসনের দুর্নীতি তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি সেটা হতে দেননি। আমার বরাবরই মনে হয়েছে তাঁর লেখা, তাঁর কথা, তাঁর আচরণ সবই এক মূল থেকে জন্মলাভ করেছিল। সে-মূল তাঁর মানবিক অনুভূতি ও শুদ্ধ যুক্তি। বহু-বিচিত্র জ্ঞানের প্রতি তাঁর আগ্রহ, তাঁকে সেই মূলের কাজে সহায়তা করেছিল। রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে তিনি ছিলেন গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। মানবেন্দ্রনাথ রায় ও বার্ট্রান্ড রাসেল তাঁর নিজস্ব চিন্তনে উজ্জ্বল আলো ফেলেছিল – এ-কথা তিনি বলতেন। বিশেষভাবে বলতেন, রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীর কথা। একদিন প্রশ্ন করেছিলাম, ‘আপনার রচনায় গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ একটা বড় জায়গা জুড়ে আছে। কারণ কী?’ তাঁর উত্তর ছিল : ‘বিশ্বে একজন চিন্তককে আমি জানি, যিনি ভেবেছেন, জটিলতম ভাবনাকে সহজ করে বুঝতে চেয়েছেন এবং মাঠে নেমে কাজ করেছেন, তিনি গান্ধী। তিনি সমাজের ওপরে এবং সবচেয়ে নিচে অনায়াসে বিচরণ করতে পারতেন। এমন আর কোনো নেতা ও চিন্তকের সঙ্গে আমাদের পরিচয় নেই। রবীন্দ্রনাথের প্রেরণা অন্য রকম। তাঁকে ছাড়া আমরা আর একজন কবির নাম শুনিনি, যিনি সুরুলের মতো গ্রামে কোঅপারেটিভ করার পরীক্ষা করেছেন, চাষ নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছেন, জনশিক্ষার জন্য শ্রীনিকেতন গড়েছেন এবং একই সঙ্গে আইনস্টাইনের সঙ্গে বৈদগ্ধ্য রক্ষা করে চলেছেন। এঁরা যে-দেশে জন্মেছেন, আমিও সেই দেশে জন্মেছি। আমি ধন্য!’ পাশ্চাত্যের মানবতাবাদের সঙ্গে ভারতীয় আধ্যাত্মিক চিন্তার একটা গভীর যোগের সন্ধান মেলে অম্লান দত্তের সমগ্র সত্তার মধ্যে।

তিনি মনে করতেন, রবীন্দ্রনাথের গান শুনে যদি কারো চোখে জল আসে, তবে শুধু যুক্তি আর বস্ত্তবাদী ব্যাখ্যায় এর কারণ নির্ণয় করা যায় না। মানব অনুভূতির এক ভিন্ন স্তরে, এক জ্যোতির্ময় আলোয় এ-সত্যের কিনারা মিলতে পারে। রবীন্দ্রনাথের এমন সব গান আছে, প্রকৃতির রূপ রস গন্ধ ইন্দ্রিয় গ্রহণ করেও যা ইন্দ্রিয় অতিক্রমী। প্রেমের গানের বেলায়ও তাই। সাংসারিক হয়েও কতকগুলো গান সংসারসীমায় আবদ্ধ নয়। অম্লান এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘আমি সেই আধ্যাত্মিকতা খুঁজেছিলাম, যাকে যুক্তির বিপরীতে রাখা চলে না। রবীন্দ্রনাথের গানে আমি সেই জিনিস পেয়েছিলাম, আমার জীবনদর্শনের সামগ্রীতে।’ এই কথার ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। স্বল্প সময়ের জন্য হলেও এই মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। সে আমার সৌভাগ্য। সেই পরিচয়ের দু-একটি খ- স্মৃতি আমার এ ক্ষুদ্র জীবনে অমলিন হয়ে থাকল।

 

টীকা

১. আবু সয়ীদ আইয়ুব, পথের শেষ কোথায়, কলকাতা, দে’জ পা লিশিং, অক্টোবর, ১৯৯২, পৃ ২৮।

২. বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ঢাকার ‘শিল্পতরু প্রকাশনী’ থেকে ১৯৯২ সালে। তিনি যে-আকৈশোর নাসিত্মক, এই কথাটি এ-বইয়ের শুরুতে শুনিয়ে দিয়েছেন। এ-বইয়ের বক্তব্য বুঝে ওঠা তখন আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবু এর প্রভাবে আমি লিখেছিলাম ‘বিজ্ঞান-বুদ্ধি’ নামের একটি তিন পৃষ্ঠার প্রবন্ধ। রচনাটি ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত ‘বিজ্ঞান চেতনা পরিষদে’র পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। প্রায় এক যুগ পরে আবিষ্কার করি, উলিস্নখিত শিরোনামে রাজশেখর বসুর (১৮৮০-১৯৬০) একটি অসামান্য সুন্দর প্রবন্ধ।

৩. বাংলাদেশের কোনো চিন্তক যখন কথা বলেন, তখন দেখা যায়, তিনি বড় বেশি বিদেশি লেখকের নাম কপচান। আর তসবি টেপার মতো করে বস্ত্তবাদ বস্ত্তবাদ করেন। ঘন ঘন মার্কস-অ্যাঙ্গেলসের নাম নেন। লেনিন-মাওয়ের কথা যেন ঠোঁটের ডগায় আঠার মতো লেপটে থাকে। সক্রেটিস-পেস্নটো থেকে হেগেল-ফ্রয়েড প্রমুখ পাশ্চাত্যের প–তের উদ্ধৃতি এঁদের লেখায় দেদার পাওয়া যায়। কিন্তু এঁদের অধিকাংশের ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে বস্ত্তভিত্তিক নৈতিক সংগ্রামের উপাদান অতি অল্প। যে-সমস্ত বাঙালি লেখক ও চিন্তক এই সংগ্রামে বিশ্বাসী ছিলেন, কাজ করে গেছেন অবিচলিতভাবে সেই  নীতিনিষ্ঠায়, এঁদের লেখায় সেসবের কোনো সংবাদই নেই। অক্ষয় দত্ত থেকে আবদুল হক যে কত চমৎকার ভাবনা আমাদের উপহার দিয়েছেন এবং সেসব যে আমাদের কার্যকর করা দরকার আরো নতুন চিন্তা যুক্ত করে, সেদিকে আমাদের খেয়ালই নেই। অম্লান দত্ত সমাজ গড়ার কাজে, আমাদের মনোগঠনে, রামমোহন-রবীন্দ্রনাথের সদর্থক চিন্তাভাবনার কথা বলেন। গান্ধী-মানবেন্দ্রনাথ থেকে রোকেয়া ও বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের নেতাদের চিন্তাও তাঁর আলোচনায় নতুন করে প্রাণ পেয়েছে।

৪. আরতি সেন আমার অনুরোধে আবু সয়ীদ আইয়ুব সম্পর্কে একটি অসাধারণ সুন্দর প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সেটি আমার সম্পাদিত আইয়ুব স্মরণগ্রন্থের (২০০৭) প্রথম লেখা হিসেবে সংকলিত হয়েছে। লেখাটি ব্যক্তি আইয়ুবকে জানার ক্ষেত্রে খুবই চিত্তাকর্ষক ও মূল্যবান। আরতি সেন যে কী গুণের মানুষ ছিলেন, তা নিয়ে নিকট-ভবিষ্যতে কিছু লেখার ইচ্ছা রইল।

৫.  শিবনারায়ণ রায় সংকলনটির একটি কপি দেশের সম্পাদক হর্ষ দত্তকে দিয়েছিলেন কোনো সমালোচককে দিয়ে পত্রিকায় সমালোচনা করার জন্য। সম্পাদক হর্ষ দত্ত ২৩ ফেব্রম্নয়ারি, ২০০৬ তারিখে চিঠি দিয়ে অশোক মিত্রকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ বইটির সমালোচনা লিখে দেওয়ার জন্য। সে-সমালোচনা দেশে প্রকাশিত হয়েছিল ১৭ মার্চ, ২০০৭-এ, ‘বাংলা গদ্যের যুগ্ম পিতৃত্ব’ নামে। এভাবে শিবনারায়ণ রায় আমার কাজের একজন প্রধান প্রেরণাদাতা ও উৎসাহদাতা হয়েছিলেন।

৬. ডলি তখন শওকত ওসমানের নাটক নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল করছিল। ঢাকায় তার সঙ্গে আমার দেখা ও পরিচয় হয়। বিশেষ একটি কাজে সে তখন কলকাতায় গিয়েছিল। তারই হাতে আমি প্রবন্ধ সংকলনটি পাঠিয়েছিলাম।

৭. ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না, কিন্তু তাঁর নাম ও কাজ সম্পর্কে জানতাম। অম্লান দত্তের সুবাদে প্রিয়ভাষিণীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। প্রথমবার কলকাতা থেকে ফিরে, অম্লানের চিঠি প্রিয়ভাষিণীর ঢাকার ধানম–র বাসায় পৌঁছে দিয়েছিলাম। ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে আবার কলকাতায় গিয়েছিলাম। ফোন করে অম্লান দত্তের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। অন্য অনেক কথার পরে বললেন, ‘আমার একটি বই বেরিয়েছে। আগামীকাল তার মোড়ক উন্মোচন হবে। তুমি কি সেখানে থাকতে পারবে?’ বললাম, ‘হ্যাঁ’। ‘তা হলে আগামীকাল ঠিক চারটায় আমার বাসায় এসো। প্রকাশক গাড়ি পাঠিয়ে দেবে, সেই গাড়িতে আমরা অনুষ্ঠান-স্থানে যাব।’ বইটি বাংলার মেয়ে প্রিয়ভাষিণীকে। সেদিন ছিল ১৫ জানুয়ারি, ২০০৭। বিড়লা ভবনে বিকাল পাঁচটায় অনুষ্ঠান হলো। চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায় নামে এক সাবেক বিচারপতি, অম্লান দত্তের বন্ধু, সভাপতিত্ব করলেন। মঞ্চের সামনে বসেছিলাম। পেছনে মুখ ফিরে দেখলাম আরতি সেনও এসেছেন। ছোট একটি হল, লোকে ভর্তি হয়ে গেছে। রাত প্রায় আটটা বেজে গেল। অম্লান আগেই একটি বই আমাকে দিয়ে রেখেছিলেন প্রিয়ভাষিণীকে ঢাকায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য। ঢাকায় ফিরে প্রিয়ভাষিণীর ধানম–র বাসায় গেলাম। তাঁকে বইটি দিলাম। চোখ বুলিয়ে বইটি বুকে জড়িয়ে, ‘অম্লান দা’ বলে হুহু করে কাঁদতে লাগলেন। আমি তাঁর অন্তরদেশ দেখতে পেলাম।

৮. দেশে তসলিমা নাসরিনের ঠাঁই না হওয়ার কারণ কারো অজানা নয়। নিরামিষ একটি কারণের কথা উদাহরণ হিসেবে উল্লেখযোগ্য। আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজ, যাঁরা তসলিমা নাসরিনকে ঘর থেকে বার হওয়ায় সহায়তা করেছিলেন, উসকে দিয়েছিলেন তাঁর আক্রমণাত্মক ও আবেগী মতামতের তীব্রতা, সেই বুদ্ধিজীবীরা, তসলিমা যখন ঘরহারা হলেন, দেশহারা হলেন, তখন তাঁরা এগিয়ে এলেন না! শুধু তাই নয়, এই তথাকথিত কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা তাঁকে নানাভাবে বিব্রত ও ব্যবহার করেছেন। সে-কথা নাসরিন তাঁর আত্মজীবনীতে অত্যন্ত খোলাখুলিভাবে উল্লেখ করেছেন। এসব বিবেচনা করলে বলতে হয়, আমাদের সমাজ বিবেকহীন, বর্বর এবং প্রাকৃত। আমার এই মতামত তুলে নেওয়ার সময় যখন আসবে, তখন তসলিমা নাসরিন অনায়াসে দেশে ফিরতে পারবেন।

৯. এই প্রবন্ধটি অম্লান দত্তের যে কথা বলিতে চাই (২০০৯) গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। তাতে দেখলাম, আহমদ শরীফকে সম্বোধন করে তিনি যে প্রথম অনুচ্ছেদটি শুরু করেছিলেন, সে-অংশটি এ-প্রবন্ধে নেই। তাঁর হাতে লেখা প্রবন্ধটি আমার কাছে আছে। স্মারকবক্তৃতার জন্য প্রস্ত্ততকৃত পুসিত্মকার প্রম্নফ দেখার কাজ আমাকে করতে হয়েছিল। কাজেই মূল কপিটি আমার হাতে এসেছিল। সেখানে দেখলাম প্রথম অনুচ্ছেদটি আছে, কিন্তু সেটা সংযোজিত অংশ হিসেবে। তাঁর বইটি প্রকাশিত হয়েছিল জানুয়ারি মাসে। তিনি বক্তৃতা করতে ঢাকায় আসেন ফেব্রম্নয়ারি মাসে। এর থেকে মনে হয়, তিনি একান্তভাবে আহমদ শরীফ স্মারকবক্তৃতার জন্য এ-প্রবন্ধটি লেখেননি। পূর্বে লিখিত রচনার সঙ্গে প্রথম অনুচ্ছেদটি এঁটে দিয়ে তিনি স্মারকবক্তৃতার জন্য পাঠিয়েছিলেন।

১০. হাসান ফকরী সাহেবের সঙ্গে এই সমস্ত কথা হয়েছিল মোবাইল ফোনে। কথাটি এখানে বলে রাখা ভালো। অম্লান দত্তের সঙ্গে আহমদ শরীফের বাসায় দেখা হলে তিনি আমাকে কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘তুমি না কি খুবই ব্যস্ত?’ তাঁর এই কথায় আমি অবাক হয়েছিলাম। আমার সম্পর্কে তাঁকে এ অপবাদটি কে শুনিয়েছে! যাহোক, তাঁর এ জিজ্ঞাসায় ভিন্ন কিছু না বলে, শুধু বললাম যে, ‘না, কোথায় আমার ব্যস্ততা। আপনাকে কেউ ভুল বলেছে।’

১১. ‘স্বদেশ চিন্তা সংঘ’ অম্লান দত্তকে নিয়ে এসে যে কষ্ট দিয়েছে, বিশেষ করে তাঁর আসা-যাওয়ায় পথকষ্ট, সেটাই ছিল আমার বেদনার কারণ। আমি জানতাম, তিনি টাকা-পয়সার দিকে মুখে ফিরে দেখবেন না। তাঁকে ‘বিদ্যাসাগর পুরস্কার’ দেওয়া হয়েছিল। সে-পুরস্কারের অর্থমূল্য ছিল পঁচিশ হাজার টাকা। সে-টাকা তিনি তৎক্ষণাৎ উড়িষ্যা বন্যা ফান্ডে দেওয়ার জন্য মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। ‘স্বদেশ চিন্তা সংঘে’র আহমদ শরীফ স্মারকবক্তৃতা দিতে এসেও তিনি তাই করলেন। কিন্তু সংঘ তাঁর জার্নিটার ধকল কমানোর জন্য air-এর ব্যবস্থা করল না! অথচ পরের বছর যখন পবিত্র সরকার এলেন সেই একই বক্তৃতা করার জন্য, তখন তাঁকে air-এ নিয়ে আসা হলো। কেবল তাঁকে নয়, তাঁর সঙ্গে তাঁর স্ত্রীকেও! উল্লেখ করা দোষের নয়, বয়সের বিবেচনায় পবিত্র সরকার অম্লান দত্তের তেরো বছরের ছোট। r