এক

মরণভাইটি যখন জীবনভাইয়ের একেবারে গা ঘেঁষে চলে যায়, ঠিক না ছুঁয়ে, তারপর আর জীবনের দিকে ফিরে তাকায় না কেন? যার কাছে এসেছিল অত তোড়জোড় করে, তাকে না পাওয়ার আক্রোশেই কি সে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে, লুকিয়ে থেকে মিটিমিটি হাসে আর তামাশা দেখে? ভাবখানা যেন, পারলে এসো না আমার কাছে! শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তো ধীরে ধীরে অকেজোই হয়ে আসছে? তবু কিসের আশায়, কী অলীক সম্ভাবনার কথা ভেবে এই শরীরটার মধ্যে ধরে রেখেছ ক্ষয়িষ্ণু জীবনের নিভে আসা তাপটুকু? কতদিন আর টেনে টেনে নিয়ে যাবে মৃত্যুবঞ্চিত ক্ষীণ প্রাণের এই প্রলম্বিত প্রশ্বাস? হৃদয়ের বিষাদসংগীতের আলাপ?

তেজপুরের সেই ভয়াবহ বাইক দুর্ঘটনার পর প্রায় ছ-মাস হাসপাতালের বেডে কাটিয়েছে সুদাম। প্রথমে গৌহাটিতে টানা তিন মাস, তারপর কলকাতার পিজি হাসপাতালে। শিরদাঁড়াটি ভেঙে প্রায় বিচূর্ণ হওয়ার ঠিক আগের অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল। সেই অবস্থায় অনেকদিনই সে জীবন আর মৃত্যুর মাঝামাঝি একটা অপরিষ্কার জায়গায় শুধু কোনোরকমে বিকল্পহীনভাবে প্রশ্বাস নিয়েছে আর খুব মৃদুলয়ে নিশ্বাস ছেড়ে গেছে। বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে নিদ্রা আর জাগরণের মিশ্রণে তৈরি হয়ে যাওয়া একটা স্থিত অবস্থানে। যখনই চেতনায় ফিরতে পেরেছে, কখনো বা পেটে অনুভব করেছে সুতীব্র ক্ষুধার ছোবল। বিছানায় একপাশ হয়ে শুয়ে থাকার জন্যে শরীরের একটা পাশ প্রায় বিছানার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। শরীরের যে-প্রত্যঙ্গগুলোর উপস্থিতি বোঝাই যায় না, সেখানে কোনোরকম বড় সমস্যা না হলে, সেগুলোই একে একে স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারাতে শুরু করলো। যকৃত, পাকস্থলী, কিডনি ইত্যাদি একে একে যেন তৈরি হতে লাগল সর্বকর্মা এই শরীরটাকে ধীরে ধীরে মরণভাইয়ের অনাকাক্সিক্ষত আলিঙ্গনে সঁপে দিতে।

সেই ইঙ্গিত বুঝতে অসুবিধা হলো না হাসপাতালের ডাক্তারদের। মেরুদণ্ডহীন মানুষের জন্যে এই হাসপাতাল নয়, যদি না তার কাছে অঢেল টাকা-পয়সা থাকে একটা বেড কিনে রাখার। সুদামের বাবার কাছে সেই টাকা ছিল না। তিনি কাজ করতেন কলকাতা করপোরেশনের অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে একজন সাধারণ কেরানী হিসেবে। জীবনের প্রায় অন্তিমলগ্নে এসে একটাই মাত্র ক্ষীণ আশার প্রদীপ জ্বলতে দেখেছেন আগামীর – সুদামের স্থির একটা চাকরির আর তার সুস্থির সংসার।

হাসপাতালের এই এক বছরের খরচ চালাতেই তাঁর সমস্ত পুঁজি নিঃশেষিত হয়ে শুধু মাসমাইনের টাকাটাই বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হয়ে রইলো। তাও ধার মেটাতে অর্ধেক খরচ হয়ে যেত। তাই হাসপাতালে আর থাকা হলো না সুদামের। সিকিটুকু জীবন নিয়েই তাকে ফিরে আসতে হলো কদমতলার ভাড়াবাড়িতে। বাবা একটা জমি কেনার প্ল্যান করেছিলেন কাছেই, তখন সুদাম চাকরিতে এক বছর কাটিয়েছে। বাবা ভেবেছিলেন, নিজের জমানো এবং প্রভিডেন্ট ফান্ডের লোন নেওয়া টাকা দিয়ে জমিটা কিনে ধীরে ধীরে ভিত করবেন, গাঁথুনি হবে, ছাদ হবে, বাথরুম হবে – যত সুদাম চাকরিতে উন্নতি করে যাবে, বাড়িটা ততই একটা সুন্দর আশ্রয় হয়ে উঠবে তিনজনের এই সংসারের। পরে চারজন, পাঁচজন যেমন হয়। বাবার পরিকল্পনাতে কোথাও কোনো ফাঁক-ফোকর ছিল না, অথচ কোন অদৃশ্য ফাটল দিয়ে ঢুকে গেল ঘুণপোকা, জীবনের সব ভেবে নেওয়া ঘটনা ঝাঁঝরা করে দিলো, কল্পনার রঙে আঁকা ভবিষ্যতের সুন্দর সব ছবি বিবর্ণ হয়ে গেল।

তেজপুরে সুদাম গিয়েছিল তার কোম্পানির কাজে। সেখানে তাদের ব্রাঞ্চ অফিস। একটা ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিটও আছে। মাসে দু-তিনবার তাকে যেতেই হতো পারচেজ সংক্রান্ত কারণে। সেবার এমনই একটি কাজ মেটানোর তাগিদ ছিল এক সাপ্লায়ারের কাছে। তেজপুর ইউনিটে যাঁরা পারচেজে কাজ করতেন, সবাই বেশ পছন্দ করতেন সুদামকে। কারণটা ছিল সুদামের সুগঠিত চেহারার সঙ্গে মানানসই সুন্দর এবং অমায়িক ব্যবহার। যেন সে তার শরীরের স্থাপত্য দিয়ে সুরক্ষিত রাখত তার মানুষের জন্যে সঞ্চিত সব শুভ ইচ্ছা আর তাদের জন্য সামান্য কিছু করতে পারার তীব্র আকাক্সক্ষা। সুদামের চরিত্রের এই পজিটিভ দিকটা কলকাতা অফিসের সবাই জানতেন। মানুষের যে-কোনো সমস্যায় দ্বিধাহীন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মানসিকতা বা ইচ্ছা তার মতো অফিসে আর কারোই ছিল না। সেটা সিনিয়র দাদার মেয়ের বিয়ের জন্য ঠিক করা পাত্র সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া থেকে শুরু করে হাসপাতালে কোনো নির্দিষ্ট ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া পর্যন্ত। সুদাম যেন সবার সখা। অফিসের মেয়েরাও তাকে পছন্দ করতেন, কেউ কেউ একটু বেশি সুবিধা নিতে চাইতেন। সুদাম বুঝেও না বোঝার ভান করত।

ঠিক এই কারণেই তেজপুরে যখন সে কোনো লোকাল কাজে যেত, সেখানকারই এক সহকর্মী, সব্যসাচীর বাইকটা ব্যবহার করত।

সেদিনও তাই করেছিল। হাইওয়ে দিয়ে যাওয়ার সময় সামনে এক ভ্যানরিকশাকে পাশ কাটিয়ে ডান দিক দিয়ে একটু গতিতে পেরিয়ে যাচ্ছিল সুদাম। সে সময়ই সামনে থেকে ছুটে আসছিল এক মালবাহী দানব ট্রাক। রক্ষা পায়নি সুদাম সেই দানবের হাত থেকে।

সেই ভ্যানরিকশার লোকজন তাকে রক্তাক্ত, অচৈতন্য অবস্থায় নিয়ে যান স্থানীয় এক নার্সিংহোমে। সেখান থেকে বিকেলে গৌহাটি সদর হাসপাতালে। তারপর কলকাতা। হাসপাতালেই কেটে গেল ছটা মাস। সুদামের বাবার সব পরিকল্পনা বিধ্বস্ত, স্বপ্ন ছিন্ন, হাসপাতালের খরচ জোগাতে জমি কেনার টাকা শেষ। জমি কেনা হলো না, বাবার শরীর-মন ভেঙে পড়ল দ্রুত। যে-ছয় মাস সুদাম হাসপাতালে ছিল, সেই সময়ের মধ্যেই বাবার বয়স বেড়ে গেল যেন একলাফে দশ বছর। বাবা-মায়ের কাছে রোগশয্যায় দীর্ঘশায়িত সন্তানের শীর্ণ চেহারা প্রতিটি দিনকে করে তোলে বিষাদমগ্নতার অসহনীয় এক বোঝা। মা কীভাবে যেন শতদীর্ণ অবস্থার মধ্যেও নিজের মনকে মোটামুটি সুস্থতার একটা জায়গায় রেখে একমাত্র ছেলের সেবাযত্ন করে যাচ্ছিলেন; কিন্তু বাবার পক্ষে আর ভাঙা স্বপ্ন জোড়া দেওয়ার মতো সাহস বা শক্তি কিছুই অবশিষ্ট রইলো না। সুদামের ওই ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফিরে আসার সংবাদে তিনি আবার নতুন একটি আশার সঙ্গে অন্তরঙ্গতা করে ফেলেছিলেন। আগের আশাটাকে বিসর্জন দিয়ে তিনি এক নতুন সম্ভাবনাকে সামনে নিয়ে নিলেন। সেটা ছিল সুদামের দ্রুত আরোগ্য লাভ এবং ফের চাকরিতে যোগদান। সুদামের কোম্পানি বেশ অনেকদিন পর্যন্ত তার খোঁজখবর নিত, হাসপাতালে যেতেন কেউ কেউ, কেউ বাড়িতে এসে টাকা-পয়সাও দিয়ে যেতেন; কিন্তু সুদামের সুস্থতার আশা যতই দূরে সরে যেতে শুরু করল, ততই সহকর্মী আর সিনিয়রদের আসা কমে যেতে লাগল।

সুদাম একটা বেআইনি কাজ করেছিল। সেটা হলো, সব্যসাচীর বাইক নিয়ে সাপ্লায়ারের কাছে যাওয়া। কোম্পানি ওকে ট্যাক্সিতে যাওয়া-আসার টাকা দিত, হেড অফিসের কেউ জানতেন না ওর এই সামান্য মিথ্যাচারটুকু। ওর চাকরিও বেশিদিন হয়নি, তাই চিকিৎসার বিপুল ব্যয়ভারের একটা ছোট অংশমাত্রই সুদামের কোম্পানি বহন করতে রাজি হয়েছিল। বেশিটাই আসত বাবার জমানো পুঁজি থেকে। বাবার দ্বিতীয় আশাটুকুও যখন শৈশব পার হতে না হতেই নাভিশ্বাস তুলে ফেলল, তিনি আর নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলেন না। সুদাম বাড়িতে আসার দু-মাসের মধ্যেই তিনি চিরবিদায় নিলেন। রয়ে গেল সুদাম।

আর রইলেন মা। স্বামীর জন্য শোকের সময়টুকুও তিনি পেলেন না। বিছানার সঙ্গে মিশে যাওয়া যুবক ছেলেকে আবার জীবনে ফিরিয়ে আনার তাগিদটাই বড় হয়ে উঠল তাঁর কাছে। স্বামী হারানোর শোকে উদাসীন হয়ে থাকা তাঁর কাছে যেন বিলাসিতাই মনে হলো তখন। স্বামীর একটা আশার কথা তিনি জানতেন এবং নিজেও তাঁর সঙ্গে অনেক সন্ধ্যায় চা খাওয়ার সময় কাটিয়েছেন বাড়ির নকশা নিয়ে আলোচনা করে, জমি কেনার আগেই। কিন্তু তাঁর দ্বিতীয় আশাটির কথা তিনি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেননি। তিনি ভাবতেন, তাঁর স্বামীও ছেলের জন্য সেবা করেই সারাজীবন কাটিয়ে দেবেন। তিনি নিজে কখনো ভাবেননি যে, সুদাম আবার পুরোপুরি সুস্থ হয়ে চাকরিজীবনে ফিরে গিয়ে টাকা-পয়সা উপার্জন করবে, অথবা আগের মতো অফিসের সবার জন্য সদাতৎপর হয়ে উঠবে।

দুই

বাবা চলে যাওয়ার পর মা আগের থেকে আরো যেন নিজেকে দৃঢ় করে নিলেন সংকল্পে। সুদামকে নিজেই কোনোরকমে কোলে তুলে  নিয়ে ট্যাক্সিতে বসাতেন। ওঠানোর সময় ড্রাইভারকে বলতেন একটু সাহায্য করার জন্যে। হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে আউটডোরে বসে থাকতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কখনো ফিজিওথেরাপিস্ট, কখনো অর্থোপেডিক, আবার কখনো স্নায়ুর ডাক্তার। সকলেই দেখেছেন, একগাদা টেস্ট করতে বলেছেন; কিন্তু সুস্থ হয়ে ওঠার বিন্দুমাত্র হদিস বা সম্ভাবনার কথা কেউ বলতে পারেননি। মাঝখানে মায়ের বিয়েতে পাওয়া আর বাবার কাছ থেকে পাওয়া প্রায় সব গয়না চলে গেছে। মায়ের সংকল্পটাও কবে যেন একদিন বসে থেকে থেকে বিদায় নিয়েছে।

মা আর চেষ্টা করেননি ডাক্তার বা হাসপাতালে। তার বদলে এসেছে নানারকম বিকল্প ব্যবস্থা। জড়িবুটি থেকে শুরু করে যে-কোনো রকম ওষুধের সন্ধান কোনো সূত্রে পেলেই মা ছুটে যেতেন। এমন দিনও গেছে, সুদামকে বাড়িতে একলা ফেলে মা সারাটি দিন কাটিয়ে এসেছেন কোনো সাধুর ডেরায়। কোনোদিন কালীঘাট কখনো দক্ষিণেশ্বর আবার কোনোদিন প্রত্যন্ত কোনো গ্রামের অখ্যাত এক ভাঙা মন্দিরে গিয়ে পড়ে থাকতেন। পাশের বাড়ির মাসিমা এসে খোঁজ নিয়ে যেতেন। একবাটি মুড়ি দিতেন কখনো, সঙ্গে সিদ্ধ ছোলা বা বাদাম ভাজা। অবশ্য মা বেরোনোর আগে সুদামের প্রাতঃকৃত্য সম্পর্কিত সমস্ত কাজ করিয়ে রেখে যেতেন। সেসব দিন চানটা আর করা হতো না। মা অনেক রাতে ফিরে চান করতে যেতেন। পরদিন সূর্য ওঠার আগেই সুদামকে খাইয়ে দিতেন কোনো শিকড়ের রস অথবা হাতে বেঁধে দিতেন কোনো তাবিজ, বা এমনি মন্ত্রপুতঃ কোনো লাল সুতো।

সুদামের দুটো হাত ভরে ছিল এরকম অনেক সুতোয়। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য সুতো আড়াল থেকে সুদামকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল কোনো এক গভীর অন্ধকারের দিকে, অত্যন্ত ধীরে, সংগোপনে। সেটা মায়ের পক্ষে টের পাওয়া সম্ভব ছিল না। সুদাম বুঝতে পেরেছিল। কষ্ট হতো খুব মায়ের জন্য। বাবা তো আশার কাছে নিজেকে নিঃস্ব করে জীবন আর মৃত্যুর মাঝের ফাঁকটুকু কী আয়াসেই না পেরিয়ে চলে গেলেন। বোঝাই গেল না আদৌ কোনো ফাঁক আছে কি না। আর সুদামের বেলায় একটু একটু করে যেন ফাঁকটা বেড়েই চলেছে। প্রতিটি দিন যায় আর জীবনের হাতছানি যেন অস্পষ্ট হয়ে আসে, বোঝাই যেত না সে বিদায় জানাতে হাত নাড়ছে, নাকি আবার খেলায় আসার জন্যে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে সুদামকে। ওদিকে তার ভাইটি মরণ কখনো ডাকে, আবার কোনোদিন ইঙ্গিতে বলে যায় আরো কিছুদিন থেকে যেতে। ওদের মধ্যে আদৌ কোনো বোঝাপড়া আছে কি না সেটা আর বোঝা যাচ্ছিল না।

অবশেষে মাও একদিন হার মানলেন এই দুঃসহ যন্ত্রণাময় স্থিত অবস্থার কাছে। জীবনীশক্তি বলে যে দুর্দমনীয় ইচ্ছার কথা বলা বা লেখা হয়ে থাকে, তার পুরোটাই মায়ের খরচ হয়ে গেল ছেলের জন্য। আত্মীয়স্বজন পাড়া-পড়শিরা সবাই যথাবিহিত সুপরামর্শই দিয়ে গেলেন। সুদামের ছোটমামা একদিন নিজেই একজন উকিলের কাছে গিয়ে সব নিয়মকানুন জেনে একটা চিঠি লিখিয়ে নিয়ে এলেন দিদির কাছে।

‘একবার তুই নিজে পড়ে দেখবি না?’

মা ছেলের জন্যে কাটিয়েছেন অনেক বিনিদ্র রাত, হেঁটেছেন গ্রামের এবড়ো-খেবড়ো ভাঙাচোরা পথে, ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় নিজেকে সহ্যের শেষ সীমানাতে নিয়ে গেছেন বারবার। বিগত এক বছরে এমন একটি দিনও যায়নি যখন তিনি সকাল থেকে রাত অবধি কেবল ছেলের বিছানা থেকে উঠে বাসাটুকুর জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাননি।

‘তুই আমাকে এ-কথা বলতে পারলি? মা হয়ে ছেলের মৃত্যুর জন্য আবেদন জানাব?’

‘ভুল বুঝিস না দিদি – এটা কোনো মৃত্যুর আবেদন নয়, এটা মুক্তির জন্য একটা আইনি ব্যবস্থা। এটা আত্মহত্যা নয়। নিষ্কৃতির জন্য আবেদন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। তিনিই পারেন তোর ছেলের মুক্তির ব্যবস্থা করে দিতে।’

‘আমি পারব না! তোরা যা ভালো বুঝিস কর।’

‘কিন্তু এতে সুদামের একটা টিপসই লাগবে। সেটা আমিই করিয়ে নেব? তোর আপত্তি নেই তো? মুখ্যমন্ত্রীর আদেশ পেলে, হাসপাতালের ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। শেষ কাজটা তাঁরাই করবেন। ওর ভালো হয়ে ওঠার কোনো আশাই নেই রে দিদি – তুই তো অনেক কিছু, প্রায় সবকিছুই করলি। এবার একটু শক্ত হ। তুই ভাঙলে সুদামের আরো কষ্ট বাড়বে। ওকে যেতে দে।’

মা আর ভাইয়ের বাস্তব ব্যাখ্যা শুনতে পারেননি। নিজের শোবার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। কত আয়াসেই বলে দিলো – যেতে দে!

চব্বিশ বছরের একটা তরতাজা ছেলেকে নাকি যেতে হবে?

তরতাজা শব্দটা মায়ের কাছে কেমন যেন অদ্ভুত শোনাল। তিনি একসময় ধীরে ধীরে উঠে বাইরে এলেন। ভাই চলে গেছেন, সম্ভবত ভাগ্নের টিপসই নিয়েই। ছেলেটা কি জানল কোথায় সে টিপসই করল?

ছেলের ঘরে আসতেই সেই তরতাজা শব্দটা কেমন যেন ব্যঙ্গ করে সুদামের বিছানার ওপর পাগলের মতো অট্টহাস্য করতে লাগল। মা এসে বসলেন ছেলের শিয়রে। ও হয়তো বুঝতে পেরেছে, কোন কাগজে মামা এসে তার আঙুলের ছাপ নিয়ে গেল।

সে মুখে সামান্য হাসি ফুটিয়ে নিয়ে তাকাল মায়ের মুখের দিকে। কী আশ্চর্য! আজ পর্যন্ত, হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার পর কোনোদিন ছেলেকে সামান্যতম হাসির রেখাও মুখে ফুটিয়ে তুলতে দেখেননি। আজ সে কি বুঝতে পেরেছে, মাকে সে মুক্ত করে দেবে এই নিষ্ফল প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা থেকে? মা তো সবকিছু খুইয়ে প্রায় ডুবতে বসেছেন। শরীরটাও ভেঙে পড়ছে দিন দিন। মাকে দেখার তো কেউ আর নেই। সুদাম আজ অনেকদিন পর, পরের উপকার করার আনন্দ পেয়ে যেমন মনে মনে হাসত, ঠিক সেরকম হাসি ছড়িয়ে দিয়েছে শরীরজুড়ে।

মায়ের এতো বড় উপকার সে করতে পারবে তা কোনোদিন ভাবতে পারেনি।

নিষ্কৃতি-মৃত্যু।

মুখ্যমন্ত্রী এবার স্বাক্ষর করলেই হয়। সমস্ত কিছু জানার পর তিনি কি মায়ের কথা ভেবেও মঞ্জুরি দেবেন না? নিশ্চয়ই দেবেন।

তিন

সংবাদপত্রের লোকেরা কেমন করে যেন মানুষের গোপন আর্জি, আবেদন, প্রার্থনা – এসব জানতে পারে। সুদামের নিষ্কৃতি-মৃত্যুর আবেদনে ওদের কিছু করার ছিল না, তা সত্ত্বেও পরদিন ফলাও করে একটি প্রতিবেদন ছাপা হলো। শিরোনামে এলো, চব্বিশ বছরের যুবকের নিষ্কৃতি-মৃত্যুর আবেদন, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে – দোটানায় মুখ্যমন্ত্রী।

মুখ্যমন্ত্রী হয়তো দ্বন্দ্বে পড়তেন না যদি ব্যাপারটা এভাবে মিডিয়াতে না চলে যেত; কিন্তু এখন তিনি সত্যি সত্যি দোটানায় পড়ে গেলেন। কিছুদিন অপেক্ষা করার পর, নামঞ্জুর হয়ে গেল আবেদন। সুদামের নিষ্কৃতি-মৃত্যু মিলবে না। যেমন করেই হোক তাকে মৃত্যুকে ফুঁসলিয়ে-ভুলিয়ে, বাবা-বাছা করে, যেভাবেই হোক না কেন ডেকে আনতে হবে।

মা কিন্তু খুশি হলেন এই প্রত্যাখ্যানে। আবেদনটি জমা পড়ার পর থেকেই রোজ ভগবানের কাছে এই আশীর্বাদই চাইছিলেন তিনি।

মৃত্যু নিজে না এলে সুদামের এখন সে ক্ষমতাও নেই তার কাছে যাওয়ার। মা অবশ্য আগের মতো দৌড়াদৌড়ি করা বন্ধ করে দিলেন।

দু-বেলা একটু নরম ভাত আর সঙ্গে পাতলা ডাল। এই পথ্য চলতে লাগল।

সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের কিছু লাভজনক দিকও আছে। কিছু মানুষ সেই রিপোর্ট পড়েন মন দিয়ে। শুধু তাই নয়, এর মধ্যে অনেকে আবার এক ধাপ এগিয়ে কিছু একটা করার কথাও ভাবেন।

সেরকমই একজন মানুষ ড. গৌরীশঙ্কর মল্লিক। ফিজিক্যাল মেডিসিনের চিকিৎসক। নিজে একটি বেসরকারি পুনর্বাসন কেন্দ্র চালান পার্ক সার্কাসের কাছে। সেখানে সুদামের মতো পথ-দুর্ঘটনায় আক্রান্ত মানুষদের জন্য বিশেষ চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। মেরুদণ্ড, হাত, পা, ঘাড়ের থেরাপির সঙ্গে চলে সাইকো থেরাপি।

একদিন সকালের সংবাদপত্র দেখতে গিয়ে সুদামের ইচ্ছা-মৃত্যুর আবেদন নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনটির প্রতি দৃষ্টি চলে যায় তাঁর হঠাৎ। সেখানে সুদামের বাড়ির ঠিকানা, ল্যান্ডলাইন নাম্বার – সব দেয়া ছিল। তিনি কালবিলম্ব না করে নিজেই চলে এলেন সুদামের মায়ের কাছে। সেদিনই সুদামকে নিয়ে চলে গেলেন নিজের পুনর্বাসন কেন্দ্রে।

এরপর দীর্ঘ পনেরো মাস ড. মল্লিক যেন নাওয়া-খাওয়া ভুলে গেলেন। সুদামের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল মেরুদণ্ড। সেখান থেকেই শুরু হলো তাঁর বিশেষ ‘থেরাপি’।

সুদামের কোনো ধারণাই ছিল না এ-ব্যাপারে। সে ভেবেছিল, তার আবেদন গ্রাহ্য হয়েছে আর এই ডাক্তার স্বয়ং ভগবানের দূত হয়ে সুদামকে নিয়ে এসেছেন তাকে মুক্তি দেওয়ার জন্যে।

মৃত্যুর কথা ছাড়া সে আর কিছুই ভাবত না।

মায়ের সামনে যে ব্যাপারটা ঘটবে না, তাতেই সে খুশি। তার আর তো বেশি কিছু চাওয়ার ছিল না, এই মৃত্যুটুকু ছাড়া।

কিন্তু ভুল ভাঙল কয়েকদিন পর।

এই ডাক্তার তো তাকে ঘাড়ে, হাতে ম্যাসাজ করতে শুরু করে দিলেন। এ তো মারার জন্য নয়!

ইচ্ছা-মৃত্যুরও আবার অন্য কোনো পদ্ধতি আছে নাকি।

সুদাম এসব কিছু বুঝতে না বুঝতেই কেটে গেল একটা মাস। এর মধ্যে সেই ডাক্তার আবার একজন অন্য ডাক্তারকে নিয়ে এলেন। তিনি সুদামকে বলতে লাগলেন তার শৈশবের কথা, মায়ের কথা, তার অফিসের কথা, সহকর্মীদের কথা – একদিন তেজপুর থেকে সব্যসাচী চলে এলো। কী করে খবর পেল কে জানে।

সুদাম তো বিশ্বাস করেছিল, অফিসের বন্ধুদের যতটুকু করার, করা হয়ে গেছে। আর কেউ আসার তো কোনো মানে দাঁড়ায় না। মৃত্যু যে কামনা করে, মানুষ তার সাহচর্য এড়িয়ে চলে। একমাত্র মা ছাড়া বোধহয় এমন মানুষকে কেউ চোখের সামনে দেখতেও পারে না, কেমন ভয় পায়। সমস্ত ভরসার শেষ কেই বা দেখতে চায়।

সুদামও যেন ধীরে ধীরে ভুলতে লাগল মৃত্যুর কথা, বিশেষ করে সব্যসাচী আসার পর। কত কথাই না সে বলল।

জীবনের প্রান্তে শুয়ে থাকা একটা মানুষ আবার মনে মনে কামনা করতে শুরু করলো একজনের সঙ্গ। বাঁচার গন্ধ যেন একটু একটু করে আসতে শুরু করলো, মনে পড়ে গেল মায়ের কথা।

কেন আসছে না মা এখনো। মাকে কি এরা খবর দেয়নি? কিন্তু তাই বা কী করে হবে? সব্যসাচীর কথা তো এদের জানার কথা নয়। সে নিশ্চয়ই মায়ের কাছ থেকেই খবর পেয়েছিল। তবে মা নিজে এলো না কেন?

মা কি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়ল?

এ-কথা ডাক্তার মল্লিককে জিজ্ঞেস করতেই তিনি স্মিত হেসে বললেন, মা সব জানে।

তবে?

তুমি যেদিন সুস্থ হয়ে বাড়ি যাওয়ার অবস্থায় পৌঁছবে, সেদিন তিনি আসবেন তোমাকে নিয়ে যেতে। তার আগে নয়। তিনি চুক্তিবদ্ধ কারো সঙ্গে।

ধীরে ধীরে হাত-পায়ের নার্ভগুলোতে স্পর্শের অনুভূতি ফিরে আসতে লাগল। বিছানায় উঠে বসতে পারল সুদাম, কথা বলতে শুরু করল। নিজের ক্ষিদের কথা প্রকাশ করতে পারল। ক্ষিদে-তেষ্টা যেন আগের থেকে একটু বেশিই পেতে লাগল। এখন নার্সরা সুদামের সঙ্গে একটু-আধটু কথা বলেন, অনেকে তাঁদের ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সমস্যার কথা বলেন। সুদাম চুপ করে শোনে। কাউকে একটু আশ্বাসবাণী শোনায়, আমি একটু চলতে পারলেই তোমার অমুক কাজটা দেখবে হয়ে যাবে। ঠিক যেমন দুর্ঘটনার আগে অফিসের লোকদের বলত।

সুদাম অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকে দরজার দিকে। প্রতিদিন। ভিজিটিং আওয়ারে।

অবশেষে একদিন শেষ হয়ে যায় টানা পনেরো মাসের যুদ্ধ। ডাক্তার মল্লিক সেদিন সকালে এসে সুদামকে বললেন,

– আজ তোমার মা আসবেন, প্রতীক্ষা শেষ। আমাদেরও আপাতত কাজ শেষ। যে-ব্যায়ামগুলো বলে দিয়েছি সেগুলো মন দিয়ে করো কিন্তু। কেমন? বেশি উত্তেজিত হবে না, ঠিক আছে?

সেদিন বিকেলে সুদাম মাকে দেখল। কী সুন্দর লাগছে মাকে। স্বামীহীন এই নারী কেমন করে নিজেকে সংযত করে, স্থির করে রেখেছিল এই দীর্ঘ পনেরো মাস?

মায়েরও তো মনে হয় পুনর্জন্ম হয়েছে।

পুনর্জন্ম পেয়ে মা এই প্রথম ছেলের মুখ দেখলেন।

মুখ্যমন্ত্রী ভাগ্যিস সেদিন সই করেননি নিষ্কৃতি-মৃত্যুর আবেদনে। খারিজ করা আবেদন ফেরত এসেছিল মায়ের কাছে।

সুদাম বলল, তোমার নাকি আবার কীসব চুক্তি হয়েছে? কার সঙ্গে?

– সব শুনবি, আগে বাড়িতে চল তো, আমার কাজ আছে।

মৃত্যুরও বিকল্প একটা আছে মনে হয়। আমরা অনেকে জানিই না। সুদাম ভাবল।

মা হাত ধরে, আবার একটা সদ্য পাওয়া প্রাণ নিয়ে সুদাম এগিয়ে চললো পৃথিবীর আলোর দিকে।