\ ১৫ \

অমলিনী ভাবল এখানেই জাদুগরির সমাপ্তি। কিন্তু তা নয়। ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে আরবিতে খানিক ধারাভাষ্য দিলো শবনম, তারপর বলে উঠল, কে এই ডেকচি খুলতে পারবে? খুললেই বেরিয়ে আসবে সুগন্ধি সুস্বাদু অ্যালবুরিয়ানি! আর যে সফল হবে সে পাবে প্রথম চেখে দেখার সুযোগ।
দীর্ঘতম রাইটার মানঘিল ক্রমাগত আফসোস করছে, ইস্! কেন ক্যামেরাটা আনলাম না। অসাধারণ কিচেন ডকুফিল্ম হতে পারত। ইন ট্রু সেন্স অ্যান ইন্টারন্যাশনাল থিম।
মোলি : পরের সপ্তাহে নিয়ো।
মানঘিল : পরের সপ্তাহে এত লোক আসবে আশা করো? প্রথম দিনের মজাই আলাদা।
মোলি : শবনমের থেকে শেয়ার করো। তুমিও তো ফোনে তুলতে পারতে।
মানঘিল : সেটাও ভুলে ফেলে এসেছি। ওই দেখো, ইয়াকভ ডেকচি খুলতে যাচ্ছে। আরে অত সহজ হলে ওরা ডাকত নাকি?
মোলি : তুমি একবার চেষ্টা করবে না?
মানঘিল : সে তো করবই। পারলে আমিই পারব।
মোলি : ওহ্! দৃশ্যটা দেখে আমার দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরা মনে পড়ছে।
মানঘিল : দ্রৌপদী? গল্পটা আমি জানি। আমি নেপালে চার বছর কাটিয়েছি। তোমাদের দ্রৌপদীর পাঁচজন স্বামী ছিল। এক ভাই পরীক্ষায় পাশ করে তাকে জিতে নেয়। অত্যন্ত আদিম পদ্ধতি এবং চিত্তাকর্ষক। এই অ্যালবুরিয়ানির ঢাকনা খুলে ফেলার পর ওরা একটা মেয়ে অফার করতে পারত তো।
মোলি : শুনলে চপার দিয়ে তোমার মাথাটা আলতো করে গলা থেকে নামিয়ে দেবে। হাতে নিয়ে বাড়ি যেয়ো।
মানঘিল : হারিক কী সুন্দর বলো! হারিক। পারফেক্ট নেম। বলল, এর অর্থ আগুন। মেয়েটা আগুন। আহা! ওকে যদি আমার ফিল্মে নিতে পারতাম।
ডেকচি খোলার জন্য ইয়াকভ হাসিমুখে এগিয়ে এলো, ব্যর্থ হলো। এরপর জর্জ, জেরেমিস, মানঘিল, লোরেনটিনা। কেউই পারল না। প্রবল হইচই শুরু হলো। কেউ মুখে আঙুল পুরে শিস দিচ্ছে, কেউ লাফাচ্ছে, চিৎকার করছে। আমোদ আর কাকে বলে! এক কোণে তাকিকো দুটি হাত জোড় করে বিনীত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। এই আমোদে সে নেই। সে কর্তব্য পালন করছে। এতকিছু হচ্ছে – নাচা, গানা, মন্তব্য, ম্যাজিক, ধারাভাষ্য – কিন্তু কোনো কিছুতেই তাকিকো ভদ্রতার পরিমিত হাসি ছেড়ে বেরোতে পারল না। শবনম তাকেও ম্যাজিক করতে বলল। অমলিনীকেও। কিন্তু তারা এড়িয়ে গেল। শুরু হলো আসল ম্যাজিক। জাদুকরের মতো হাত নেড়ে ডেকচির ওপর ঢেউ খেলিয়ে মন্তর আওড়াতে লাগল শবনম। রোজানা ও হারিক হাতে তালি দিয়ে বলতে লাগল – আফতাহা আফতাহা আফতাহা! শবনম মন্ত্রপাঠ শেষ করে দুহাত মুঠো করে দুমাদ্দুম পিটতে লাগল ডেকচির পিঠ।
সেঁকা লাগবে! হাত পুড়ে যাবে! ফোসকা পড়বে!
আফতাহা আ আ আ!
এক নিমেষে দুহাতে বিশাল ডেকচি তুলে ফেলল শবনম। খুলেছে! খুলেছে! চিৎকার করে উঠল সবাই। খ- খ- মাংসের টুকরোসমেত হলুদ অ্যালবুরিয়ানি খোশবাই ছড়িয়ে ডেকচির আকার হয়ে ঢিবির মতো ঝলমল করছে বারকোশে। তাকিকো পর্যন্ত হাঁ করে তাকিয়ে আছে। সবার সঙ্গে সেও হাততালি দিতে শুরু করল এবার। হইচই ও উচ্ছ্বাসের বৃত্ত থেকে আসেত্ম করে সরে এলো অমলিনী। সে জানে, এবার বিরিয়ানি চাখতে দেওয়ার পালা শুরু হবে। তল্পিতল্পা গুটিয়ে সে চুপচাপ বেরিয়ে পড়ল। এক ঝোলায় মশলাপাতি, চাল-ডাল, আলু। অপর ঝোলায় রান্না করা খাবার। হাতে ডিমের খাঁচা। একা একা পথ চলতে লাগল সে। একবার ভয় হলো, যদি পথ হারিয়ে ফেলে। কিন্তু হারিয়ে আর কোথায় যাবে? আইওয়া নদীর পূর্বপারের বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ও ডাউনটাউনের জ্যামিতি মোটামুটি বুঝেছে সে।
রোদের তেজ কমে এসেছে। দু-কাঁধে দুই ভারী বোঝা নিয়ে ক্লান্ত পায়ে হাঁটতে হাঁটতে তার হঠাৎ মন খারাপ হয়ে গেল। নিজেকে দীন-দুঃখী মনে হলো। ডলার বাঁচানোর জন্য তার আকুলতা তাকে ব্যথিত করে তুলল। বাড়িতে আর একটা টয়লেট না বানালেই নয়। কিছু বাড়তি টাকা এলে এ-কাজে সে হাত দিতে পারে। আজ হাইভিতে সে প্রতিমুহূর্তে হিসাব কষেছে। পাঁচ ডলারে মাইক্রোওভেনে ব্যবহারযোগ্য একটি কাচের পাত্র কিনতে রীতিমতো কষ্ট হয়েছে তার। সে কি সত্যিই একজন ব্যর্থ লেখক? একজন সাহিত্যিকের সার্থকতা কোন মানদ– পরিমাপ হয়! তাঁর খ্যাতিতে? তাঁর লেখনীর গুণমানে? নাকি বিক্রয়ের নিরিখে! তার সবই অল্প! নিজের লেখার গুণমান সে নিজে নির্ণয় করতে পারে না। বইয়ের যা বিক্রি তাতে বারো মাসের সংসার চলে না। সে নিজেকে নিয়ে ভারি বিব্রত বোধ করতে লাগল।
খানিকটা পথ সোজা চলে পাহাড়ের ঢালের মতো নিচে নেমে গিয়েছে। সে ভারসাম্য রেখে অবতরণ করতে লাগল। ফের যখন চড়াই এলো, এত জিনিসপত্র সমেত তার গতি মন্থর হয়ে এলো। একটু হাঁপ ধরল তার। আমি, দানিয়েল এলফিনস্টোন হাওয়ার মধ্যে শক্তি সঞ্চার করে তাকে ঠেলে দিতে লাগলাম তার কষ্ট লাঘব করার জন্য। আমি জানি, সে ভাবছে, সে তো আরো অনেকের মতো রান্নার হ্যাপায় না গিয়ে খাবার কিনে খেতে পারত! সে কি একজন বোকা মানুষ যে, বরকে চাপ দিয়ে ন্যায়সংগত ও আইনসম্মত বিচ্ছেদ ও মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করতে পারে না, এমনই বুদ্ধিহীন যে শুধু ঠকে যায়? ঠকতেই থাকে?
আমি সত্যিই একজন ব্যর্থ মানুষ। ভাবল সে। তার চোখে জল ভরে এলো। সে সন্দীপনের দ্বারা প্রবলভাবে মানসিক নিপীড়ন ভোগ করার পরও, সুদীর্ঘ বিচ্ছেদ ও অবহেলার পরও আশা করে, বর আজো বুকের তলায় তার জন্য প্রেম পুষছে। হায়, সে আমেরিকায় আমন্ত্রিত হয়ে কতই আনন্দ পেয়েছিল। কেউ কি জানবে, সকালে ব্যাংকে যাওয়া-আসায় সে ৫০ মিনিট হেঁটেছে। বিশাল হাইভি বাজারে কেনাকাটার জন্য ৬০ মিনিট বরাদ্দ ছিল, এ-প্রান্ত ও-প্রান্ত ছোটাছুটি করে সময় বজায় রেখেছে, তিন ঘণ্টার গুঁতোগুঁতি রান্নার পর সে নিজের খাদ্যের ভার বয়ে আধঘণ্টা একা একা পথ হেঁটেছিল? যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা অধিকাংশই ঘরে ফিরে গিয়েছে! সন্ধ্যা হতে দেরি আছে এখানে, তবু সূর্যের তাপ পড়ে আসছে, আইওয়া নদীর দিকে, দূর পশ্চিমে লালের আভা – এ মুহূর্তে, সে আমেরিকায় ফেলোশিপ পেয়েছে বলে যদি কলকাতায় কেউ ঈর্ষান্বিত হয়ে থাকে, সে কি জানবে – সম্মানিত সাহিত্যিক পিঁপড়ের মতো আপন খাদ্য পিঠের বোঝা করে নিয়ে চলেছে, ব্যাংকের আধুলির মতো দৈনিক ডলারের ভাতা থেকে কিছু কিছু জমিয়ে দেশে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে!
এবং কী বৈপরীত্য নিজের মধ্যে! ন-ডলার দিয়ে ঘরে রাখার জন্য একটি গাছ কিনেছে সে।
‘হাই মোলি!’
সে থমকে দাঁড়াল। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল লম্বা লম্বা পা ফেলে হাতে বাঁশি নিয়ে হেঁটে আসছে ইয়াকভ। সে হাসিমুখে বলল, ‘এত বাঁশি শোনালাম, কিছু তো খাওয়ালেও না।’
অমলিনী দ্রম্নত নিজেকে সামলে নিল। হাসিমুখে বলল, ‘হাই ইয়াকভ! আমি বাঁশির দেশের মেয়ে। আমার মর্মে মর্মে বাঁশি। তোমার বাঁশরি আমার হৃদয় স্পর্শ করল কই!’
ইয়াকভ : একেবারেই করেনি বলছ?
মোলি : তোমার প্র্যাকটিস নেই ইয়াকভ।
ইয়াকভ : মিথ্যে প্রশংসা না করার জন্য ধন্যবাদ মোলি। দাও না তোমার ব্যাগগুলো আমাকে।
মোলি : আমি পারছি ইয়াকভ। তুমি যে রাঁধলে না, খাবে কী!
ইয়াকভ : ধ্যুৎ! এখন তো কিনে খাই! পরে দেখা যাবে। শবনমের অ্যালবুরিয়ানি এক্কেবারে ইয়াম ইয়াম। তবে খুব স্পাইসি।
মোলি : আমার খাবার দেবো তোমাকে?
ইয়াকভ : পরে দিয়ো। আমি অনেকটা কুকড ফুড কিনেছি। কাল সকালে তানিয়া জারভিরোভার সঙ্গে তোমার সাক্ষাৎ না? নটায়। আমার সাড়ে নটায়। একসঙ্গেই যাওয়া যাবে।
মোলি : যাব। আমাদের ক্যালেন্ডার ক্লিনিক। কী জিনিসটা?
ইয়াকভ : আজ রুবা, ইয়াসমিন, জেরেমিস ও লিলির ছিল। কার কবে কী অনুষ্ঠান, কবে কোন লেখা জমা দিতে হবে, কে কী কাজের পরিকল্পনা করছে, এসব আলোচনা আর কি! রান্নার ব্যবস্থা তোমার কেমন লাগল? দারুণ আইডিয়া, কী বলো। আমেরিকান মগজ!
মোলি : আমার ভালো লাগেনি ইয়াকভ।
ইয়াকভ : কেন?
মোলি : প্রথমত, অত লটবহর নিয়ে হেঁটে যাওয়া এবং আসা, তারপর বাঁধা সময়ের মধ্যে অতজনের রান্না, ইমু থেকে অত দূর সপ্তাহে অন্তত দুদিন করতে পারত, গাড়ির ব্যবস্থা রাখতে পারত। সারা সপ্তাহের রান্না করে বয়ে আনা সোজা নাকি? তারপর ঘরে যে-ফ্রিজ, সে তো ছোট্ট একখানা! কীইবা ধরবে!
ইয়াকভ : এসব তো আছেই। দূরত্ব ব্যাপারটা খুব আপেক্ষক্ষক জানো তো। এই আজ তোমার কিচেন বা শাম্বাগ হাউস দূরে লাগছে, একটু চেনা হলেই মনে হবে, এই তো, কাছেই, যেটা এদের মনে হচ্ছে! কিন্তু পজিটিভ দিকটা ভাবো। এই রান্নাঘরের মধ্য দিয়ে কি আমরা অনেক কাছাকাছি এসে গেলাম না? ধর্ম-বর্ণ-সংস্কৃতি সব তফাৎ ভুলে একটা পারিবারিকতা গড়ে উঠল।
মোলি : তোমার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি খুবই প্রশংসনীয়। কিন্তু প্রত্যেক সপ্তাহের জন্য ব্যবস্থাটা ভালো নয়। সার্থক তো নয়ই। আমি আজ মাইক্রোওভেনের পাত্র কিনেছি। ওতেই রান্না করব।
ইয়াকভ : কমিউনিটি কিচেনে আর যাবে না বলছ?
মোলি : বোধহয় না।
ইয়াকভ : হয়তো আমিও যাব না। আজ প্রথম দিন বলে আমার আগ্রহ ছিল। ঘরে বসেই বা কী করতাম। নদীটাও এমন কিছু সুন্দর নয় যে দেখলেই কাব্য আসবে। আসলে আমার যেমন ইচ্ছে, তেমনই করব। কখন কী ইচ্ছে হয় কে জানে! তা, তুমি ওদের অ্যালবুরিয়ানি না খেয়ে চলে এলে! দারুণ ছিল!
মোলি : ওরকম একটা খাবার খুব জনপ্রিয় আমার দেশে। নামটাও বেশ কাছাকাছি – বিরিয়ানি। চিকেন বা গোট মিট দিয়ে তৈরি হয়। ওরা খুব যত্নে বানিয়েছে – কী সুন্দর রং, গন্ধ, ভালো তো হবেই। তবে আমি যে বিফ খাই না!
ইয়াকভ : হাঃ হাঃ হাঃ! তুমিও এসব মানো? ওরা পর্ক খায় না, তুমি বিফ খাও না! মানুষের ভেদাভেদের কি কোনো সীমা নেই। ধর্মের সঙ্গে খাওয়ার কী সম্পর্ক কে জানে!
মোলি : আমার একটাই ধর্ম ইয়াকভ, তার নাম মনুষ্যত্ব। আমার ঠাকুরমা ছিলেন গোঁড়া হিন্দু। আমাদের বাড়িতে তাঁর জীবদ্দশায় মুরগি ঢুকত না। এখন সবাই সব খায়। তবে গরু বিষয়ে আমি খুব স্পর্শকাতর। আমাদের বাড়িতে গরু ছিল। আমি তাদের ভালোবাসতাম। গরু বাদে সাপ, ব্যাঙ, শুয়োর, হরিণ সব চেখে দেখেছি!
ইয়াকভ : সাপ খেয়েছ?
মোলি : বান মাছ। প্রায় সাপের মতোই। তবে সাপ যদি দারুণ ভালো করে রান্না করে দেয়, আমার অসুবিধে নেই। আঁশটে গন্ধ না থাকলেই হলো।
ইয়াকভ : বান মাছ? সে তো দারুণ!
‘হাই মোলি, হাই ইয়াকভ’ বলতে বলতে ছুটতে ছুটতে আসছে থাইল্যান্ডের শ্রীরং নিবাস। হাসছে সে। মঙ্গোলীয় গড়নের নিবাসের চোখ ছোট, মুখের ত্বক কোঁচকানো, লম্বা চুল কাঁধের ওপর ছোটার তালে তালে দুলছে। নির্মেদ, দীর্ঘ, সুগঠিত শ্রীরং নিবাস বলছে, ‘কী চমৎকার ছোটার জায়গা। এই নিয়ে সাত চক্কর হলো। নদীর ধারের পথ ধরে ইমু কেন্দ্র করে অনেকটা গোল রাস্তা। হাঃ হাঃ!’
খুব আনন্দ পাচ্ছে নিবাস। ইয়াকভ বলল, ‘তুমি রান্নাঘরে গিয়েছিলে না?’
শ্রীরং : [দাঁড়িয়ে জগিং করতে করতে] সবার আগে আমার হয়ে গিয়েছে। ক্যাটফিশ সেদ্ধ আর ভাত! দারুণ!
মোলি : আর কত দৌড়বে?
শ্রীরং : মোট বারো চক্কর।
সে আবার ছুটতে শুরু করল। সাদা টি-শার্ট, সাদা শর্টস, সাদা মোজা ও স্নিকার্স পরা নিবাস অচিরেই চোখের আড়ালে চলে গেল। ইয়াকভের সঙ্গে ইমুর লিফটে উঠল অমলিনী। আমিও তাদের সঙ্গে রইলাম।
ইমু পৌঁছতেই সারা ছুটে এলো। ‘চলো চলো, দেখবে চলো, তোমাদের জন্য কত কী ব্যবস্থা করেছি।’
খাবার-দাবার নিজের ঘরে রেখে আড্ডাঘরে এলো অমলিনী। সারার আয়োজন দেখল।
সারা : হোটেলকে বললাম, সববাইকে একটা করে থালা-বাটি দাও। ইয়াপের সবাইকে বললাম, যার বাড়িতে যত বাড়তি কনটেইনার আছে, নিয়ে এসো। ওই দেখো কত কনটেইনার! নিয়ে নাও যা লাগে। আর গ্রেগ কী করেছে দেখো। লোকটা উন্মাদ। তোমাদের জন্য একটা রাইস কুকার, একটা সেস্না কুকার, হাই কোয়ালিটি চা-পাতা, টি-পট, ইলেকট্রিক কেটলি সব কিনে এনেছে। হারিক আর লিলি বলাবলি করছিল পটে ভিজিয়ে চা খাওয়ার মজাই আলাদা। সেই শুনে গ্রেগ সব এনেছে। এ-ঘরেই সব থাকবে। যার যখন লাগবে এ-ঘরে এসে করে নেবে।
সারার উদ্যোগ ও গ্রেগের বদান্যতার প্রচুর প্রশংসা করে থালা-বাটি ও দুটো প্লাস্টিকের পাত্র নিয়ে ঘরে ফিরে এলো অমলিনী। তার ক্লান্ত লাগছিল। দুটি কনটেইনার ও প্রাপ্য থালা-বাটি ধুতে লাগল সে। বাসনগুলো তেলচিটে ও ময়লা। এদেশে ব্যবহৃত জিনিস অপরকে দেওয়া যায়। অপ্রয়োজনীয় বস্ত্ত বাইরে ফেলে রাখলে যার দরকার তুলে নিতে পারে। মনে করার মতো কিছু নেই। অমলিনীর দেশে উচ্চ ও মধ্যবিত্তের এ নিয়ে টনটনে অভিমান। … এমন ব্যবহৃত জিনিস অমলিনী তার পরিচারিকাকে দিতে পারে, প্রতিবেশীকে নয়। এটা ভালো, না খারাপ ভাবতে ভাবতে ময়লা বাসনগুলো – এমনকি তাতে খাবারের পুরনো, শুকনো কণা লেগে আছে – সব পরিষ্কার করে টেবিলে গুছিয়ে রাখল। প্লাস্টিকের ওই তেলচিটে পুরনো পাত্র তার না নিলেও চলত। কিন্তু সারার উদ্দীপনা দেখে না বলতে পারল না। রোজকার খাবার জন্য সে একগুচ্ছ কাগজের থালাও আজ কিনেছে। খাবারগুলো ফ্রিজে রাখতে গিয়ে লক্ষ করল জিনিসটা শুধু ছোট নয়, খুবই অপ্রসর। একটা ডিপ ফ্রিজ পর্যন্ত নেই। সবজি রাখার বাস্কেট নেই। অনেক চেষ্টায় রান্না, কাঁচা সবজি, মাখন, পাউরুটি সব গুছিয়ে ফ্রিজের ডালা বন্ধ করে দেখল বোতলগুলো খালি। হাইভি থেকে দুটো এক লিটারের জলের বোতল কিনেছিল, তারই একটা খুলে অনেকটা জল খেল সে। প্রায় সাত ঘণ্টা পর। অবসন্ন শরীরে সে বিছানায় শুয়ে পড়ল। শূন্য মনে বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়ল দ্রম্নত।
রাত্রি প্রায় আটটায়, যখন লাল রঙের বিচ্ছুরণ আকাশে লাগিয়ে সূর্য বিশ্রাম করছে, আইওয়া নদীর জলে হাঁসেরা সারাদিনের সন্তরণের বিমুগ্ধ আলোচনায় মশগুল, চাঁদ-তারা অপেক্ষা করছে তিমির রাত্রির, যখন কবর থেকে উঁকিঝুঁকি মারছে অতৃপ্ত আত্মারা আর ভাবছে, হায়, কী সুন্দর এই পৃথিবী! তখন আমার অ্যামেলিয়া ঘুম ভেঙে চোখ মেলল। তাকে দেখাচ্ছে সতেজ ও আনন্দময়। শরীরী মর্মে একটু ছুঁয়ে দেখতে বড় ইচ্ছে হলো আমার। কিন্তু উপায় নেই। ভেবেছিলাম এই নিরবয়ব সত্তার মধ্যেই আমার প্রেম স্ফূর্তি পাবে। শ্রবণ, দর্শন ও ঘ্রাণের সক্রিয়তাই আমার কাঙিক্ষত অনুভূতির পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু ছুঁতে বড় ইচ্ছে হয়, এ কি প্রেমেরই বৈশিষ্ট্য?
চায়ের জল চাপিয়ে স্নান সারল অমলিনী। মাইক্রোচুল্লিতে ভাত রাঁধে কী করে, গুগল থেকে পড়ে নিল। চাল ধোও, যতখানি চাল তার তিনগুণ পরিমাণ জল দাও, এক চামচ তেল বা মাখন ফেলে হাই লেভেলে ৯ মিনিট।
সে নির্দেশ অনুসারে ভাত রাঁধতে লাগল। চা খেতে খেতে ৯ মিনিট পার করে দেখল, চালগুলো সামান্য ফুলেছে মাত্র। সে আরো ৯ দিলো। তারপর আরো ৯। শেষ পর্যন্ত তার অতি সাধারণ মাইক্রোচুল্লি আধঘণ্টায় ভাত রাঁধতে পারল। জেসমিন রাইসের মধুর গন্ধে ভরে উঠল ঘর। দিনে খিচুড়ি ও মাশরুম ভাজি খাবে, রাতে ভাত আর ডিমের কারি, এই তার ইচ্ছা।
হৃষ্টচিত্তে, ভাত রান্নার স্বাধীন প্রক্রিয়া আয়ত্ত করে সে খানিক আড্ডা দেওয়ার ইচ্ছায় আড্ডাঘরে হাজির হয়ে দেখল জেরেমিস একটি সোফায় বসে আছে, তার পায়ের কাছে, বাঁদিকে, একটি পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ান, ডানদিকে তার কোলের ওপর ঝুঁকে নিচু স্বরে কথা বলছে ইয়াসমিন। জেরেমিস অল্প অল্প হাসিমুখে, দুহাত বুকের ওপর জড়ো করা, শুনছে।
সে যেতেই সোজা হয়ে বসল ইয়াসমিন। অমলিনী দেখল, ঘরের সব আলো জ্বালা হয়নি। আর কেউ নেই। দুজনের এইনিচুস্বর আলাপের মাঝে পড়ে সে অপ্রস্ত্তত বোধ করতে লাগল। (চলবে)