কল মি লাইক
মোজাফ্ফর হোসেন – ক্রিয়েটিভ ঢাকা লিমিটেড
ঢাকা, ২০২৫ – ৪৫০ টাকা
মোজাফ্ফর হোসেনের দ্বিতীয় উপন্যাস কল মি লাইকা পড়ার পর মনে হলো, লেখক এই উপন্যাসে একটি স্পিরিচুয়াল জার্নি সম্পন্ন করেছেন। এও মনে হলো যে, মোজাফ্ফর তাঁর আগের সব কাজকে ছাড়িয়ে গেছেন এই জার্নির ভেতর দিয়ে। শুধু তাই নয়, আমি অনুভব করে উঠলাম – এই উপন্যাস সময়কে অতিক্রম করবে। সব উপন্যাস সেটা করে না, ভালো উপন্যাস হলেও করে না। কেন এসব মনে হলো, আমি তা ব্যাখ্যা করব।
লক্ষ করে দেখুন, বিশ্বসাহিত্যের যে-উপন্যাসগুলোকে সময়োত্তীর্ণ বলে চিহ্নিত করা হয়, তার সবগুলোতেই কোনো না কোনোভাবে স্পিরিচুয়াল জার্নির ব্যাপারটা আছে। উদাহরণ দিচ্ছি। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের শত বছরের নিঃসঙ্গতাকে কেউ সাধারণ উপন্যাস হিসেবেই পাঠ করতে পারেন; কিন্তু পড়ার পর মনে হবে, মার্কেস এই উপন্যাসে এক স্পিরিচুয়াল জার্নি সম্পন্ন করেছেন। কারণ? উপন্যাসে কর্নেলের যে-পরিবারটা দেখানো হচ্ছে, সেটা এক বিশাল পরিবার এবং সেই পরিবার একসময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই ঐতিহ্যবাহী পরিবার শেষ হয়ে যাওয়ার প্রধানতম কারণ হলো প্রেমহীনতা। এই পরিবারে সবই ছিল; কিন্তু ভালোবাসা ছিল না। ভালোবাসা না থাকলে, প্রেম না থাকলে, মায়ার বন্ধন না থাকলে একসময় পারম্পর্য শেষ হয়ে যায়, তা সে যতই ঐতিহ্যবাহী-প্রাচীন-সমৃদ্ধ পরিবার হোক না কেন? ক্রিটিকরা পরে বলেছেন যে, কর্নেলের এই পরিবারের মাধ্যমে মার্কেস আসলে লাতিন আমেরিকার ইতিহাস তুলে ধরেছেন। যদি তাই হয়, তাহলে বলতে পারি, লাতিন আমেরিকার যে-পরিণতি ও সমৃদ্ধ অতীত থেকে পতন, সেটার জন্য দায়ী এই প্রেমহীনতা। একটা জাতির দুর্ভোগ-সৌভাগ্য, দুর্নীতি-দুর্যোগ, পাপ-পতন ইত্যাদির কারণ নিয়ে সমাজতাত্ত্বিকরা একভাবে আলোচনা করেন, ইতিহাসবিদরা অন্যভাবে করেন,
রাজনীতিবিদ-অর্থনীতিবিদদের আলাপ হতে পারে ভিন্নরকম; কিন্তু এর অন্তর্নিহিত সত্যটা উপলব্ধি করতে পারেন লেখকরা, যেমনটি মার্কেস করেছিলেন। এই প্রেম হলো পারস্পরিক মমত্ত্ববোধ, দায়িত্ববোধ, সৌহার্দ্যবোধ, যেটা বন্ধন হিসেবে কাজ করে। স্পিরিচুয়াল জার্নি না হলে জাতিগত পতনের এ-কারণটা তাঁর চোখে ধরা পড়ত না। এইভাবে আমি দস্তয়েভস্কি, তলস্তয়, কামু, কাফকাকে দিয়ে উদাহরণ দিতে পারি, তাঁরা কোনো না কোনো উপন্যাসে গিয়ে এই স্পিরিচুয়াল জার্নিটা করেছেন। গোটা মানবজাতিকেই তাঁরা একটা মেসেজ দিতে চেয়েছেন। এটা সব উপন্যাসে হয় না। সেই অর্থে কল মি লাইকা স্পিরিচুয়াল জার্নি। এই উপন্যাসে কোন সত্যটা লেখকের কাছে ধরা দিয়েছে, সে-প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি।
বলেছিলাম, মোজাফ্ফর এই উপন্যাসে নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন। তাঁর খ্যাতি ও পরিচিতি এসেছে ছোটগল্পের মাধ্যমে। আয়তনে বেশ ছোট ছোট গল্প লেখেন তিনি। মোটামুটি এমন একটা ইমেজ তৈরি হয়েছে যে, মোজাফ্ফর ছোটগল্প লিখবেন, সেই গল্প আবার এক-দু পৃষ্ঠার মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। তাঁর গল্পের বিষয় হবে ডার্ক। অন্ধকার একটা জগৎ – যেখানে কল্লাবিহীন মানুষেরা হেঁটে বেড়াচ্ছে, এমন একটা ভয়াবহ বিপর্যস্ত পরিস্থিতি, যেখানে অনায়াসে মানুষ মানুষের মাংস খাচ্ছে ইত্যাদি। কোথাও কোনো আশাবাদ থাকে না, ভালোবাসাও থাকে না, থাকে এক ধরনের মরবিডনেস। মোজাফ্ফরের প্রথম উপন্যাস, তিমিরযাত্রা, সেখানেও প্রধান চরিত্রের মা-বাবাকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তার মধ্যে বিবমিষা আছে। এই যে একটা প্যাটার্ন ছিল, সব অর্থেই সেই প্যাটার্ন থেকে বের হয়ে এসেছেন মোজাফ্ফর এই উপন্যাসের মাধ্যমে। এখানে বর্ণনার যে-ধরন সেটা গল্পে তো নয়ই, এমনকি সাধারণ ফিকশন যে লেখা হয়, তেমনও নয়। এটার গদ্য মহাকাব্যিক।
এই উপন্যাসে যে-চরিত্রগুলো আছে, প্রতিটি চরিত্রই, সে যত ছোট ভূমিকাতেই থাকুক না কেন, প্রটাগনিস্ট হয়ে ওঠে। প্রধান চরিত্র ছাড়াও, তার আশেপাশে যারা আছে, যেমন তার মা বা বোনেরা, এমনকি তার বাবা শেষে গিয়ে যখন তার কন্যার কবরে ঘুমাতে চায়, তাদের জন্য মমতা জাগে, মন খারাপ হয়। কী একটা অভিশপ্ত জীবন তাদের! প্রত্যেকের জীবনই এখানে অভিশপ্ত। ভাষা, বর্ণনাভঙ্গি, চরিত্র সৃষ্টি সব জায়গাতে নিজের আগের বৈশিষ্ট্য থেকে বের হয়ে এসেছেন মোজাফ্ফর। এই উপন্যাস ভালোবাসার কথা বলে, মমতা জাগায়। আর বর্ণনার মধ্যে
যে-মুনশিয়ানা এবং ভাষার যে-আভিজাত্য, সেটা একটা মহাকাব্যিক অনভূতি দেয়। তবে ভবিষ্যতে একটা সমালোচনা তাঁকে শুনতে হবে, যেহেতু এই উপন্যাসটা কালোত্তীর্ণ হবে, তাই এই সমালোচনা আসবে ভবিষ্যতে, সেটা হলো, এই উপন্যাসে লেখকের উপস্থিতি ঘটেছে। লেখক আসলেই উপস্থিত। মজার ব্যাপার হলো, এই ব্যাপারটাকেই আমি পছন্দ করেছি। এর পেছনে একটা যুক্তি আছে। আমাদের প্রচলিত সাহিত্যবিচারে বলা হয়, উপন্যাসে বা গল্পে যদি লেখক নিজেই উপস্থিত থাকেন, তাহলে সেটার মান ক্ষুণ্ন হয়। এই কথিত ধারণাটি মোজাফ্ফর ভেঙে ফেলেছেন, এবং সেটা খুব মুনশিয়ানার সঙ্গে। লেখক উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও নৈর্ব্যক্তিকতার কোনো অভাব ঘটেনি।
এই উপন্যাসের বর্ণনা মহাকাব্যিক দ্যোতনা দেয়। এমন কিছু বাক্য কিংবা অনুচ্ছেদ আছে যা প্রচলিত গদ্যসাহিত্যে সচরাচর দেখা যায় না। এর অনেকগুলোই ভবিষ্যতে উদ্ধৃতিযোগ্য হয়ে উঠবে বলে ধারণা করি। যেমন, ‘গ্রামে ধনী বলতে লোকে বোঝে কার কতটুকু জমি আছে, আমি বুঝি কার ভাণ্ডারে কত শব্দ আছে। প্রায় ভূমিহীন নিরক্ষর দাদির চেয়ে ধনী মানুষ আমি এখন পর্যন্ত দেখিনি। অঢেল শব্দ তার, রংবেরঙের অর্থ সেসবের।’ কিংবা : ‘কোনো কোনো শব্দ আবার সকাল-বিকেল অর্থ বদল করে – শীতে এক অর্থে, গরমে আরেক অর্থ হয়; জলে এক অর্থে সাঁতার কাটে, আরেক অর্থে বাউরি বাতাসে দুরন্ত ছোটে; এক অর্থে নিশ্চুপ, নির্জন রাখালের মন, আরেক অর্থে হুহু বাউলা কীর্তন।’
আবার ধান নেড়ে দেওয়ার দৃশ্য বর্ণনার সময় বলা হচ্ছে : ‘রোদ পাওয়া ধানগুলোর সঙ্গে রোদ না পাওয়া ধানগুলো জায়গা বদল করে।’ ধান নেড়ে দেওয়া যারা দেখেছে, তারা কেউ এভাবে কখনো ভেবে দেখেনি। এর পরেই মোজাফ্ফর লিখেছেন : ‘প্রকৃতির নিয়মই এমন – চাঁদের সঙ্গে সূর্যের, অন্ধকারের সঙ্গে আলোর, ঝড়ের সঙ্গে সৃষ্টির, শব্দের সঙ্গে মৌনতার জায়গা বদল করা।’
এরকম বাক্যসচেতন চিন্তা থেকে লেখা যায় না। এগুলো হলো একটি জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত বিমূর্ত চিন্তা ও সৃজনশীল কল্পনার বিকশিত রূপ।
কতগুলো অসাধারণ চিত্রকল্পও তৈরি করেছেন মোজাফ্ফর, যেমন ‘বটগাছ থেকে একপ্রস্থ ঘোলা মেঘ ধোঁয়ার মতো প্রসারিত হয়ে হেঁটে যাচ্ছিল জঙ্গলের সরুপথ ধরে।’ একবার পড়লেই চিত্রকল্পটা চোখে ভেসে ওঠে। আবার কীভাবে মিথ তৈরি করেন তিনি, দেখুন : ‘পুরো পৃথিবীটারই জš§ হয়েছে বড়ো কোনো কারণ ছাড়াই। এটা আমাকে টিপু সুলতান বলেছে। এই কারণে পৃথিবীটা আজো টিকে আছে। গুরুতর কোনো কারণ থাকলে পৃথিবী এত দীর্ঘজীবী হতো না। মানুষ যেমন একটা কারণ নিয়ে জš§ায়, যেমন : আদম-হাওয়ার পৃথিবীতে আসার পেছনে কারণ ছিল। এই কারণে মানুষ বেশিদিন বাঁচে না। প্রাণিকুলে কচ্ছপের বেঁচে থাকার কারণ সবচেয়ে কম, এই কারণে বাঁচেও সবচেয়ে বেশি।’
আরেকটা জায়গা পড়ি, মহাকাব্যিক কেন বলছি এখানে বোঝা যাবে। বলা হচ্ছে, ‘কিছু কিছু গন্ধ এখন জীবনের সুবাস দেয়।’ এরপর আলু পচার বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখছেন : ‘আলু পচার গন্ধটা খুব তীব্র, এটা মানাতে একটু সময় লাগে। গন্ধটা এখন এমনভাবে মর্মে লেগেছে যে, আলুর তরকারি দেখলেও নাকে লাগে, খেতে পারি না।’ খুবই স্বাভাবিক। এটুকু আসলে ভূমিকা, এরপরই লেখা হচ্ছে আসল কথাটা : ‘জীবনে কিছু কিছু ঘটনা থাকে এমন গন্ধের মতো, স্মৃতির স্লেটে এমনভাবে মেখে যায় যে, শত ডাস্টার ঘষেও মোছা যায় না। অনেক বছর আগে একদিন রাতে ঘুম ভেঙে দেখেছিলাম আব্বার হাতে হুড়কো, এক পাশ ধরে কাকুতিমিনতি করছে মা। দৃশ্য এটুকুই, তা-ও আবছা অন্ধকারে দেখা। তিনটা জোনাকি পোকা পথ ভেবে জানালার ছিদ্র দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল, আলোটা ওদেরই। কিছু কিছু আলো থাকে অন্যের, আমরা সেই আলোতে ভুল করে চোখ মেলে দিই। সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত কি না জানি না, এরপর থেকে যখনই মা আর বাবাকে একা হতে দেখেছি, স্মৃতির সেই হুড়কোটা চলে এসেছে। ভয়ে কেঁপে উঠেছে শরীর।’ এখানে পচা আলুর গন্ধ ধরে এই দৃশ্যের কথা বলা হচ্ছে; অন্যের আলোতে ভুল করে কিছু দেখে ফেলা। এই জায়গাগুলো লক্ষ করতে হবে। এই কারণে বলি উপন্যাসের কাহিনি মুখে বলার বিষয় নয়। উপন্যাসের বিষয়বস্তু বলে কিছু হয় না। অনেক ছোট ছোট বিষয় নিয়ে একটা বয়ান তৈরি হয়।
এই উপন্যাসে অনেক জায়গা আছে উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। আমি একবার একটা গদ্যে লিখেছিলাম, মহৎ সাহিত্য মানেই উদ্ধৃতিযোগ্য সাহিত্য। অল্প বয়সে লিখেছিলাম। আমরা যারা সাহিত্য পাঠ করি নিজের অজান্তেই অনেক টেক্সটের কিছু কিছু অংশ মনে রাখি। যেমন উপন্যাসের একটা বাক্য এরকম : ‘নারী রক্ষা করা নদী রক্ষা করার মতোই কঠিন কাজ।’ বাংলাদেশে কে না বুঝবে নদী রক্ষা করা কত দুঃসাধ্য একটি কাজ। নারীদের রক্ষা করাও তেমনই কঠিন। আরেকটা জায়গায় বলা হচ্ছে, ‘পাপ ছাড়া সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয় না।’ বোনের ব্রা নিয়ে ফ্যান্টাসি করার পর তার মধ্যে পাপবোধ তৈরি হয়েছে। এবার তার নামাজ পড়তে গিয়ে মনোযোগটা পাল্টে গেছে। তারপর সে বলে, ‘মনে হয়, এতদিনে নামাজ পড়ার মধ্যে একটা অর্থ খুঁজে পেয়েছি। পাপ ছাড়া সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয় না। যে যত পাপী তার সঙ্গে সৃষ্টিকর্তার সম্পর্ক তত বেশি ক্রিয়াশীল।’ এটার সঙ্গে বাইবেলের একটা ভার্সের মিল খুঁজে পেয়েছি, যেখানে বলা হচ্ছে যে, যত ইচ্ছা পাপ করো, কিন্তু অত পাপ তুমি করতেই পারবে না যে ঈশ্বর তোমাকে ক্ষমা করতে পারবে না। তলস্তয়ের আনা কারেনিনা উপন্যাসের এক চরিত্র বলেছিল, তার মনে কোনো শান্তি নেই, কারণ এত পাপ সে করেছে ক্ষমা পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। তখন তার বন্ধু তাকে বলছে, ওইভাবে ক্ষমা চাও, বলো, ‘আমার প্রাপ্যতার মাপে নয়, তোমার করুণার মাপে আমাকে ক্ষমা করো।’
মানে তার তো প্রাপ্যতা নাই, কিন্তু ঈশ্বরের করুণাও তো অন্তহীন। প্রাপ্যতার মাপে না-হয় না-ই পাওয়া গেল, অন্তত তাঁর করুণার মাপে কি ক্ষমা সম্ভব নয়? আনা কারেনিনার অন্তর্গত বিষয়ও কিন্তু পাপ। খ্রিষ্টধর্মানুযায়ী আনা কারেনিনাও পাপী। তবে এতটা পাপী নিশ্চয়ই নয় যে, ক্ষমাই পাওয়া যাবে না!
একটা জায়গা লেখা হচ্ছে, ‘মানুষ কি শ্রদ্ধায় কোনো পিঁপড়াকে পথ ছেড়ে দাঁড়িয়েছে কখনো?’ একটা বাক্যই একটা প্যারাগ্রাফ। এই বাক্যটা পড়ার পর স্বাভাবিকভাবেই চোখটা বন্ধ করে ভাবতে হবে। এরকম অনেক জায়গা আছে এই উপন্যাসে। আমি বিচ্ছিন্নভাবে কিছু উল্লেখ করে যাচ্ছি। যেমন এই অংশটা : ‘হাঁসের বাচ্চাগুলোকে মা ছেড়ে দিতেই কলপাড়ের দিকে ছুটে যায়। বাবলাফুলের মতো হলুদ ছানাগুলোর শরীরে দুদিন পর রং ধরতে শুরু করবে। এর নাম জীবন। একবার জীবন ছুটে গেলে, সেই জীবনের আর কোনো মূল্য থাকে না। যে মৃত তার জন্য হাহাকার থাকে, আকাক্সক্ষা থাকে না। আমি মরে গেলে কি মা-ও বড়ো বোনের মতো মুক্তি পাবে?’ এরপর স্বেচ্ছামৃত্যুর প্রসঙ্গ আসে। একজনের কথা বলা হয়, যে বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে হাসপাতাল থেকে ফিরে আসে। এই ফিরে আসার অপমানটা তার জন্য আরো অসহনীয় হয়ে ওঠে। সেই লোকটা তখন বলে, ‘মানুষজন যখন তোমার জন্য মরাকান্না কেঁদে ফেলে, তখন যত আপন মানুষই হোক, আর চায় না তুমি বেঁচে ওঠো। তখন বেঁচে উঠলে দুনিয়া আরো বিস্বাদ হয়ে ওঠে, ততোধিক বিষাদময় হয়ে ওঠে সম্পর্ক।’ কী ভয়াবহ! কত সূক্ষ্ম সাংঘাতিক অনুভূতিকে ছুঁয়ে গেছে।
এই যে দাদির মৃত্যু, দাদি মরেনি কিন্তু বলা হচ্ছে দাদির শরীরের মধ্যে জিন ঢুকে সে নিশ্বাস নিচ্ছে। এরপর নিশ্বাস নেওয়া অবস্থাতেই শতবর্ষী দাদিকে কবর দেওয়া হচ্ছে। পরিবারের লোকজন কী পরিমাণ বিরক্ত তাঁর বেঁচে থাকার ওপর যে জীবিত অবস্থাতেই জানাজা পড়িয়ে কবর দিয়ে দিচ্ছে। কী ভয়ংকর! জিনের এই ঘটনা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি। কারণ এখানে অন্য প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘এই বিশ্বাস পূর্বকাল থেকে প্রবাহিত হলে নতুনভাবে পরখ করার দায় বা তাড়না কোনোটাই আর থাকে না।’ এরপর ‘কখনো কখনো চলে যাওয়ার চেয়ে ফিরে আসা বেদনার।’ এই কথাটি বলার পর আরেকটি ভয়াবহ প্রত্যাবর্তনের গল্প শোনানো হয়। জীবিত দাদিকে কবর দেওয়ার চেয়ে সেটা কম বেদনার নয়। এই বেদনার বিপরীতে দাঁড়িয়ে মায়ের ওই ঘটনাটির কথা বলা হচ্ছে। রান্নাঘরে ইঁদুরের কল পেতেছে, ইঁদুর ধরাও পড়েছে; কিন্তু সেই ইঁদুর আর মারতে পারে না। জ্বালানি ঘরের নিচে কলের মধ্যেই নিয়মিত খাবার দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে।
এরপর বলা হচ্ছে : ‘আলাদা আলাদা গল্পের প্রয়োজনেই আলাদা আলাদা জীবন, এটাই পৃথিবীর নিয়ম, এই নিয়মের কারণেই পৃথিবীতে নতুন নতুন প্রাণ আসে। আগে মনে করতাম, প্রাণ আছে বলে গল্প; এখন বুঝি, গল্প আছে বলেই প্রাণ। জলের গল্প তখনই থাকে যখন সে জলে মাছ ভেসে ওঠে। জীবন আর জড় তখন আর আলাদা থাকে না।’
সত্যিই তো, এভাবেও তো ভাবা যায়! জীবনকে যে কতরকমভাবে দেখা যায়, কতরকমভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, তার এক উজ্জ্বল উদাহরণ তৈরি করেছে এই উপন্যাস। আখ্যান এখানে প্রধান নয়, চিন্তা এবং দর্শনই প্রধান। আখ্যানের অভিনবত্ব দিয়ে লেখক তাঁর পাঠককে চমৎকৃত করতে চাননি এ-উপন্যাসে, চেয়েছেন তাঁর চিন্তা আর দর্শনের সঙ্গী করতে। এবং এমন এক গতিশীল-প্রাঞ্জল-ঋজু-স্মার্ট-অনিন্দ্যসুন্দর গদ্যে সেসব বর্ণনা করেছেন যে, মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। এ-কারণে বলছি যে, এটা একটা স্পিরিচুয়াল জার্নি।
জার্নিটা পরিপূর্ণ হয় যখন বেদেরা গ্রামে আসে। এই অধ্যায়টা হলো উপন্যাসের ক্যাথারসিস। এটাই টার্নিং পয়েন্ট। বেদেদের নিয়ে বলতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘স্থায়ী ঘরসংসার বলে কিছু নেই। জলে-স্থলে ভেসে ভেসে সংসার করা জীবন ওদের। যখন যেখানে যায়, সেখানেই জীবনের কিছু ক্ষয়, কিছু স্মৃতি রেখে চলে যায়। মানুষ তো পাখি, পা দুটো ডানা, মাটির পৃথিবী এক উন্মুক্ত আকাশ, মানুষ এই আকাশে পা রেখে ওড়ে।’
বেদে আসার পরে এই প্রটাগনিস্টের জীবনবোধ বদলে যায়। বেদে-সর্দার মালদাদা বলেন, ‘অবশ্যই দুঃখের মাঝে সুখ আছে। অবশ্যই দুঃখবোধই জীবনের নিয়তি।’ এরপর সে বুঝতে পারে, বেদেদের জীবনও নিয়তিবাদের বাইরে নয়। অথচ সে ভেবেছিল বেদেদের সঙ্গে গিয়ে এই দুর্বিষহ জীবন থেকে সে মুক্তি পাবে। কিন্তু বেদে-সর্দারের মতে, এই ভাসমান গোষ্ঠীও অভিশপ্ত, সেই আদমপুত্র হাবিল-কাবিলের সময় থেকে। এক ভাই আরেক ভাইকে হত্যা করেছিল, পৃথিবীর প্রথম খুন। বেদেরা হলো সেই খুনির উত্তরসূরি। তারা এইভাবে অভিশপ্ত হয়েছিল যে, যে ভূমিতে তারা রক্ত ঝরিয়েছে সেই ভূমি কোনোদিনই তাদের ঘর হবে না। শুধু বেদে নয়, ঢোঁড়া সাপের মতো প্রাণীও অভিশপ্ত জীবন বয়ে বেড়াচ্ছে। একসময় তাদের প্রচণ্ড বিষ ছিল, কিন্তু অভিশপ্ত হয়ে বিষ হারিয়েছে। এই কারণে একটা জায়গায় এসে বলা হচ্ছে, ‘প্রত্যেকটা জীবন একটা অভিশাপের পরম্পরা।’ তাহলে সমাজ-পরিবার থেকে বহিষ্কৃত এই প্রটাগনিস্ট মুক্তি খুঁজবে কোথায়?
প্রটাগনিস্ট আলেক চাইলেও কিন্তু যাযাবর জীবনে যেতে পারছে না। বেদেদের সমাজে বাইরে থেকে কাউকে গ্রহণ করার রীতি নেই। তাতে বোঝা যায়, আলেক ততটা অভিশপ্ত নয়। আবার যেতে যে পারছে না, এই কারণেই সে আরো বেশি অভিশপ্ত। কারণ যেখানে আছে সেখানে তার মুক্তি নেই। ফুলবোন ওকে আগেই বলেছিল, ‘যে পৃথিবী থেকি অমোন তেজি সূর্যও চিরদিনের জন্যি পালাতি পারে না, সেই পৃথিবী থেকি আমাদের কারু মুক্তি নেই।’ ‘আমাদের’ মানে সে শুধু তার ভাইবোনদের কথা বুঝিয়েছিল; কিন্তু শেষে দেখা গেল কারো মুক্তি নেই, এমনকি সাপেরও। যে-ছাগলটার কথা বলা হয়েছে, সেই ছাগলটাও অভিশপ্ত, তাকে যত্ন করে লালনপালন করে জবাই করা হবে। কুলের চারাটাও অভিশপ্ত জীবন নিয়ে জন্মেছে। এই ধরনের অনুভূতি, পর্যবেক্ষণ ও উদ্ঘাটনকে আমি স্পিরিচুয়াল জার্নি বলি, এই জার্নিটা না হলে এটা সম্ভব নয়। এই উপন্যাস তো শুধু একজন মানুষের সেক্সুয়াল আইডেন্টিটির বিষয় নয়, আইডেন্টিটি অ্যাজ এ হোল।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.