আইএফআইসি ব্যাংক-নিবেদিত ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার ২০২০’

সুন্দরের মধ্যে বেঁচে থাকার প্রেরণা

‘যাঁরা  সৃষ্টি  করেন,  শিল্পের  মধ্যে  আছেন, যাঁরা  পৃথিবীকে সুন্দর কিছু উপহার দিতে চান, তাঁরা কিন্তু সকলেই মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। চারপাশে মৃত্যুর একটা প্রতিবেশ তৈরি হয়েছে। তার মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই চলছে। এ-বেঁচে থাকা শুধু শারীরিক বেঁচে থাকা নয়, কর্মের-সৃষ্টির মধ্য দিয়ে, সুন্দর কিছু সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকা।’ – অধ্যাপক পবিত্র সরকারের এ-বক্তব্য যখন শুনছি তখন পৃথিবীকে গ্রাস করতে উদ্যত কোভিড-১৯ ভাইরাসের ভয়ংকর থাবা। দাঁত বসিয়ে ছিন্নভিন্ন করতে চাইছে মানুষের এতদিনের পরিশ্রমে-মেধায়-সাধনায় তিলতিল করে গড়ে তোলা সভ্যতাকে। কিন্তু ওই যে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বরেণ্য অধ্যাপক পবিত্র সরকার বলেছেন – ‘সুন্দর কিছু সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকা’ – সেই জীবন তো আর কেড়ে নিতে পারে না কেউ, কোনো কিছু। সৃষ্টিশীল মানুষ চরম প্রতিকূলেও জীবনের জয়গান গেয়ে যায়, আশা দেখায় সুন্দর আগামীর। আর এই ‘আশার মিছিলে’র প্রথম সারিতে যাঁদের হাতে থাকে উদ্ধত মশাল, তাঁরা নবীন, অকুতোভয়, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘সবুজ’। সেই নবীনদের বরাবরের মতো এই অতিমারির সময়েও সম্মানিত করেছে কালি ও কলম। তাঁদের হাতে তুলে দিয়েছে আইএফআইসি ব্যাংক নিবেদিত ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার ২০২০’।

বাংলাদেশের সাহিত্যচর্চায় নবীনদের উৎসাহদান ও তাঁদের লেখনীকে গতিশীল করার লক্ষ্যে ২০০৮ সাল থেকে এ-পুরস্কার প্রদান করে আসছে বাংলা ভাষার অন্যতম সাহিত্য পত্রিকা কালি ও কলম। কবিতা, কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ ও গবেষণা, মুক্তিযুদ্ধবিষযক গবেষণা ও সাহিত্য এবং শিশু-কিশোর সাহিত্য – এ পাঁচটি বিভাগে প্রতিবছর এ-পুরস্কার প্রদান করা হয়ে থাকে। প্রতিটি পুরস্কারের মূল্যমান এক লক্ষ টাকা। এ-পর্যন্ত ৫১ জন তরুণ সাহিত্যিক এই পুরস্কার লাভ করেছেন। এ-বছর এই আয়োজনে যুক্ত হয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান ‘আইএফআইসি ব্যাংক’।

২০২০ সালে কোভিড-১৯-এর ব্যাপক বিস্তারে যখন দেশের প্রতিটি ক্ষেত্র প্রায় থমকে দাঁড়িয়েছিল, ভবিষ্যতের ভাবনায় মানুষ হয়ে উঠেছিল, এবং এখনো অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি, উদ্বিগ্ন – তখনো বরাবরের মতোই পুরস্কার প্রদানের নিমিত্ত নবীন সাহিত্যিকদের বই আহ্বান করে কালি  ও কলম। মহামারির বিমর্ষ এই সময়েও সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে অসংখ্য বই জমা পড়ে, যা এক কথায় অভাবনীয়। যেন সকল বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে এগিয়ে চলার এ এক দৃপ্ত পদক্ষেপ।

গত ১৮ জুন ২০২১, এক অনলাইন আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রদান করা হয় আইএফআইসি ব্যাংক নিবেদিত ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার ২০২০’। এ-আয়োজনে সম্মানীয় অতিথি হিসেবে যুক্ত হন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ওয়াসি আহমেদ এবং পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পবিত্র সরকার। পুরস্কৃতদের নাম ঘোষণা ও শংসাবচন পাঠ করেন কালি ও কলম পুরস্কারের বিচারকমণ্ডলীর পক্ষে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ  ঘোষ।  এ-প্রতিযোগিতার  অন্য  দুই  বিচারক কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন এবং কবি মাহবুব সাদিক।

আয়োজনে আরো বক্তব্য রাখেন কালি ও কলমের প্রকাশক আবুল খায়ের এবং পত্রিকাটির সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষে সুব্রত বড়ুয়া। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন কালি ও কলমের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ও বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী এবং অভিনেত্রী ত্রপা মজুমদার।

নির্ধারিত দিন সন্ধ্যা ৭টায় যখন এ-আয়োজন শুরু হয়, তখন সবার মন স্বভাবতই আনন্দে পূর্ণ থাকার কথা, যেমনটা অন্যান্য সময় পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন, সশরীর নয়, সবার চোখ হয় মুঠোফোনে, নয় কম্পিউটারের স্ক্রিনে।

এই আনন্দযজ্ঞের এবারের শুরু বিষাদের সুর দিয়ে। কারণ কালি ও কলম যাঁদের পরিচর্যায় দীর্ঘ ১৭ বছর পার করে আঠারোয় পা দিয়েছে, সেই দুজন গুণী-কৃতী মানুষ – অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এবং আবুল হাসনাত – তাঁদের হারাতে হয়েছে করোনাকালীন সময়ে। বড় কষ্টের সেই অনুভূতি যখন কালি ও কলম তার ঐতিহ্য ও ধারাবাহিকতা বজায় রেখে প্রদান করছে তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার, কিন্তু পত্রিকাটির দুই প্রাণপুরুষ নেই সেই আয়োজনে।

অনুষ্ঠানের শুরুতে এই দুই বিরলপ্রজ ব্যক্তিত্বকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয় দুটি স্বল্পদৈর্ঘ্য তথ্যচিত্রের মধ্য দিয়ে।

প্রথমেই অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে প্রদর্শিত তথ্যচিত্রে কৃতি এই ব্যক্তিত্বের জীবনের নানা দিক তুলে ধরা হয়। তাঁর কর্ম-মেধা-শ্রমে ও পরামর্শে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন এবং কালি ও কলম কতভাবেই না উপকৃত হয়েছে, তার বিশদ বিবরণ পরিস্ফুট হয়ে ওঠে স্বল্পায়তন এ-চলচ্চিত্রে। একই সঙ্গে এদেশের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে তাঁর যে অবদান, তাও বিস্তারিত প্রকাশের প্রয়াস ছিল লক্ষণীয়।

‘একদিন ভুবনডাঙায়’ – ত্রপা মজুমদারের কণ্ঠে মাহমুদ আল জামানের এই কবিতা আবৃত্তির মধ্য দিয়ে আবুল হাসনাতের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন পর্বের সূচনা হয়। উল্লেখ্য, আবুল হাসনাতের কবি-নাম মাহমুদ আল জামান।

আবুল হাসনাতের জীবন ও কর্মভিত্তিক তথ্যচিত্রে তাঁর দীর্ঘ সাফল্যমণ্ডিত কিন্তু নিভৃত জীবনের অলিগলিতে আলো ফেলেন তাঁর কন্যা দিঠি হাসনাত। তাঁর চরিত্রের অনন্য দিক তুলে ধরেন আবুল খায়ের ও আবুল হাসনাতের বাল্যবন্ধু এবং চলার পথের আজীবন সঙ্গী প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। আবুল খায়ের বলেন, আবুল হাসনাত কখনোই বোঝাতে চাননি যে তিনি একজন বড়মাপের মানুষ। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, চৌকস ও চিন্তাশীল, যা কালি ও কলম দেখলেই বোঝা যায়। মতিউর রহমান বলেন, আবুল হাসনাত ছাত্রজীবন থেকেই যুক্ত ছিলেন সাহিত্য ও শিল্পের সঙ্গে। সেই ধারাবাহিকতা তার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

প্রতিভাবান কিন্তু মুখচোরা আবুল হাসনাতের নানা দিক তুলে ধরার ক্ষেত্রে এ-তথ্যচিত্র নিঃসন্দেহে সফল হয়েছে।  

কালি ও কলমের দুই কাণ্ডারিকে স্মরণের পর পত্রিকাটির পথচলা এবং তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার নিয়ে কিছু কথা বলেন সুব্রত বড়ুয়া। তিনি বলেন, সাহিত্যপত্রিকা হিসেবে প্রায় দীর্ঘ দেড় যুগ ধরে অব্যাহত প্রকাশনা কালি ও কলমের বিশেষ অর্জন। তবে শুধু অব্যাহত প্রকাশনা নয়, বরং দীর্ঘকাল পত্রিকাটি যে গুণ ও মান রক্ষা করে চলতে পেরেছে, সেটাই কালি ও কলমের বড় অর্জন।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও আবুল হাসনাতকে কালি ও কলমের ‘প্রাণপুরুষ’ উল্লেখ করে তাঁদের দুঃখভরে স্মরণ করেন তিনি। সুব্রত বড়ুয়া বলেন, ‘এই দুজনকে ছাড়াই আমরা প্রায় এক বছর ধরে এ-পত্রিকা প্রকাশ করে আসছি। আমরা চেষ্টা করেছি তাঁরা (অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও আবুল হাসনাত) যে ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছেন, তাঁরা যে মান রক্ষা করতে চেয়েছেন এবং যে-চিন্তাধারা তার (কালি ও কলমের) মধ্যে প্রতিফলিত করতে চেয়েছেন, সেটি যেন আমরা অক্ষুণ্ন রাখতে পারি।’

কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার সম্পর্কে তিনি বলেন, ২০০৮ সাল থেকে সাহিত্যের নানা শাখায় উন্নত গুণ-মানসম্পন্ন লেখার জন্য প্রদান করা হচ্ছে এ-পুরস্কার। সুব্রত বড়ুয়া বলেন, যেসব তরুণ লেখক এ-পুরস্কার লাভ করেছেন তাঁদের অনেকেই সাহিত্য ও শিল্পের নানা ক্ষেত্রে স্বীকৃতি অর্জন করেছেন।

তিনি বলেন, এ-পুরস্কার প্রদানের মধ্য দিয়ে কালি ও কলম যেমন নতুন লেখক সৃষ্টি করতে পেরেছে, তেমনি নতুন পাঠক তৈরিতেও সমর্থ হয়েছে। তিনি কালি ও কলমের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

সুব্রত বড়ুয়ার বক্তব্যের পর এ পর্যন্ত কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার প্রদানের অনুষ্ঠানমালা নিয়ে তথ্যচিত্র প্রচার করা হয়। এই তথ্যচিত্রে অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবালসহ গুণিজনদের বক্তব্যাংশ তুলে ধরা হয়।

এরপরই আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ২০২০ সালের কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেন অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ। এবার কথাসাহিত্যে তিমিরযাত্রা গ্রন্থের জন্য মোজাফফর হোসেন, প্রবন্ধ ও গবেষণায় চলচ্চিত্রনামা গ্রন্থের জন্য মাসুদ পারভেজ, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্য ও গবেষণায় ১৯৭১ : বিধ্বস্ত বাড়িয়ায় শুধুই লাশ এবং গ্রন্থের জন্য ইজাজ আহমেদ মিলন এবং শিশু-কিশোর সাহিত্যে স্কুলে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল গ্রন্থের জন্য রণজিৎ সরকার পুরস্কার লাভ করেন। এবার বিচারকদের বিবেচনায় কবিতা শাখায় যোগ্য বই না পাওয়ায় কাউকে পুরস্কৃত করা হয়নি।

বিশ্বজিৎ ঘোষ বিজয়ীদের নাম ঘোষণার পূর্বে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন কালি ও কলমের সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আবুল হাসনাতকে।

তিনি বলেন, কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার দেশের সবার কাছে এমন মান অর্জন করেছে যে সেখান থেকে নিচে নামার কোনো সুযোগ ছিল না। তাই এবার কবিতা শাখায় অনেক বই জমা পড়লেও কোনো যোগ্য বই না পাওয়ায় বিচারকমণ্ডলী এ-শাখায় কাউকে পুরস্কৃত করতে পারেননি।

পুরস্কারবিজয়ী চার তরুণকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি আশা করি এ-পুরস্কার তাদের দায়িত্ব সচেতন করে তুলবে। এ-পুরস্কার তাদের আরো ভালো লিখতে সাহস সঞ্চার করবে, প্রেরণা সঞ্চার করবে।’

পুরস্কার প্রদানপদ্ধতি সম্পর্কে বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, ‘এই তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার প্রদানের সঙ্গে কালি ও কলমের কেউ কখনো যুক্ত থাকেন না। বিচারকরা স্বতন্ত্রভাবে মূল্যায়ন করেন বলেই এই পুরস্কার বাংলাদেশে একটি আকর্ষণীয় ও গৌরবোজ্জ্বল পুরস্কার হয়ে উঠেছে।’

তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, তরুণরা পুরস্কারের জন্য লিখবে না, বরং লিখতে লিখতেই পুরস্কার পেয়ে যাবে। কারণ লেখকের সবচেয়ে বড় পুরস্কার পাঠকের ভালোবাসা।

বক্তব্যের শেষে তিনি করোনাকালীন বিপর্যয়ের মধ্যে এ-পুরস্কার নতুন শক্তি ও সাহসের সঞ্চার করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

নাম ঘোষণা পর্বের পর একে একে অনুভূতি প্রকাশ করেন চার তরুণ বিজয়ী।

প্রথমেই কথাসাহিত্য শাখায় বিজয়ী মোজাফফর আহমেদ বলেন, কবিতা দিয়ে সাহিত্যাঙ্গনে পদচারণা শুরু হলেও আবদুশ শাকুরের কথায় তাঁর ছোটগল্প লেখা শুরু। পরবর্তীকালে কালি ও কলম সম্পাদক আবুল হাসনাতের অনুপ্রেরণায় তিনি প্রবন্ধ লেখায় মনোযোগী হন। এ-সময় তিনি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন ফোকলোরবিদ অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান ও অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে।

তিনি বলেন, যাঁরা সাহিত্যচর্চা করেন তাঁদের জন্য তারকাখ্যাতি লাভ বা সবার কাছে পরিচিত হয়ে ওঠা আমাদের সমাজের প্রেক্ষাপটে সহজ ব্যাপার নয়। এক্ষেত্রে এমন ছোট ছোট পুরস্কার বা সম্মাননা এক ধরনের ইন্ধন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য।

তাঁর মতে, সাহিত্য যে একটি বড় ইন্ডাস্ট্রি (শিল্প) সেটা অনুধাবনের জন্য এ-ধরনের পুরস্কারের আরো প্রয়োজন রয়েছে।

মোজাফ্ফরের বাবা-মা চাইতেন না তিনি সাহিত্যচর্চা করেন। অনেকের মতোই তাঁদের ধারণা ছিল, এই চর্চা তাঁর জীবনে দুঃখ ছাড়া ফলপ্রসূ কিছু বয়ে আনবে না। ফলত তাঁদের এই উৎসাহহীনতাই তাঁকে আরো সাহিত্যমুখী করেছে বলে মনে করেন মোজাফফর হোসেন।

ইজাজ আহমেদ মিলন বলেন, তাঁর লেখালেখি শুরুর পেছনে বড় উৎসাহ ও প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর অমর গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি …।’ কবিতায় এর আগে ‘সিটি-আনন্দ আলো পুরস্কার’ পেলেও পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধকেই তিনি বেছে নেন তাঁর কাজের ক্ষেত্র হিসেবে।

মিলন বলেন, তাঁর সাহিত্যচর্চার পথ শুরুতে ছিল কণ্টকাকীর্ণ। কিন্তু তাঁর বাবার প্রেরণায় তিনি চালিয়ে যান সাহিত্যচর্চা। তিনি বলেন, ‘আমরা স্বপ্ন দেখতে ভয় পাই। আমার বাবা আমাকে স্বপ্ন দেখাতে পেরেছিলেন।’

মিলন বলেন, ‘আমরা বলি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন। কিন্তু আমরা কি তাঁদের নামগুলো শনাক্ত করতে পেরেছি? এই ক্ষেত্রে কাজ করার জন্য সবার নিজ নিজ জায়গা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত, বিশেষ করে তরুণদের। আর তাঁদের এই কাজের ক্ষেত্রে উৎসাহ হিসেবে, প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে কালি ও কলম পুরস্কার।’

কোভিড পরিস্থিতির কারণে পুরস্কার নিতে ঢাকায় আসতে না পারলেও ভিডিওবার্তায় মাসুদ পারভেজ এ-পুরস্কারপ্রাপ্তির অনুভূতি ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে লেখালেখির ক্ষেত্রে এখনো পেশাদারিত্ব সৃষ্টি হয়নি, তাই এ-ধরনের পুরস্কারপ্রাপ্তিতে অর্থযোগ লেখকদের জন্য আনন্দ বয়ে আনে।

মাসুদ বলেন, একজন তরুণ লেখকের ক্ষেত্রে পুরস্কারপ্রাপ্তি যেমন আনন্দের তেমন সংকটেরও। কারণ পুরস্কারের সঙ্গে সঙ্গে একজন লেখক যদি অধিক আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন তবে সেটা তাঁর লেখালেখির জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াকালীন প্রথম কবিতা লিখে মাকে শোনানোর পর কেঁদেছিলেন মাতা-পুত্র দুজনে – এভাবেই শুরু হয় রণজিৎ সরকারের অনুভূতি প্রকাশ। তিনি তুলে ধরেন কণ্টকাকীর্ণ পথ বেয়ে তাঁর আজকের অবস্থানে পৌঁছানোর ইতিবৃত্ত। বলেন, ছোটবেলায় তাঁর লেখাকে কেউ বেশি গুরুত্ব না দিলেও দমে যাননি তিনি, চালিয়ে গেছেন সাহিত্যচর্চা, যার উপহার কালি ও কলম পুরস্কার।

বাংলাদেশে শিশু-কিশোর সাহিত্য অবহেলিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, কেউ শিশুসাহিত্য চর্চা করলে তাঁকে সঠিক মূল্যায়ন তো করা হয়ই না উপরন্তু অবহেলার চোখে দেখা হয়।

রণজিৎ বলেন, শিশুদের জন্য ভালো বই করা মানে একজন মননশীল-সৃজনশীল মানুষ তৈরি করা, যার কাছ থেকে আমরা ভালো কিছু আশা করতে পারি। তিনি প্রবীণ-নবীন সবার প্রতি সাহিত্যের এ-শাখার প্রতি আরো যত্নবান হওয়ার আহ্বান জানান। অভিভাবকদের প্রতি রণজিতের বক্তব্য, ‘শিশুদের হাতে গেম (মোবাইল বা কম্পিউটার গেম) নয়, সৃজনশীল-মননশীল বই তুলে দিন।’

পুরস্কারপ্রাপ্ত চার তরুণের অনুভূতি প্রকাশের পর তাঁদের অভিনন্দন জানিয়ে বক্তব্য রাখেন কালি ও কলম প্রকাশক আবুল খায়ের। তিনি স্মরণ করেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও আবুল হাসনাতকে। আবুল খায়ের বলেন, দুই বাংলায় এই পত্রিকার আজ যে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে তা এই দুজনের জন্যই। তাঁদের অবর্তমানে এ-পত্রিকার প্রকাশনা অব্যাহত রাখতে তিনি সাহিত্যাঙ্গনের সবার আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করেন।

তিনি আরো বলেন, অতিমারির কারণে এ-বছর পুরস্কার দেওয়াটা অত্যন্ত দুরূহ কাজ হলেও সবার সম্মিলিত চেষ্টায় তা সহজ হয়েছে। এ-আয়োজনে পবিত্র সরকার ও ওয়াসি আহমেদ যুক্ত হওয়ায় তিনি তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

আইএফআইসি ব্যাংকের এ-পুরস্কারের সঙ্গে যুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আইএফআইসি ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর শাহ এ সারওয়ার সাহিত্য ও শিল্পানুরাগী। তাঁর আগ্রহেই এই যুক্ততা। তিনি শাহ এ সারওয়ারের এই উদ্যোগের জন্য তাঁর প্রতি আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।

পরিশেষে আবুল খায়ের বলেন, সবার প্রচেষ্টায় কালি ও কলমের প্রকাশনা যদি ৫০ বছর ধরে অব্যাহত থাকে তবে সেটি একটি বড় কাজ হবে বাংলা সাহিত্যের জন্য।

সম্মানীয় অতিথি ওয়াসি আহমেদ বলেন, দেশে নবীনদের জন্য পুরস্কার একমাত্র  কালি  ও  কলমই  দিয়ে  থাকে।  তিনি  বলেন, ‘এ-পুরস্কার যাঁরা অর্জন করেছেন তাঁরা অল্পদিনের মধ্যেই নিজেদের সৃষ্টিশীলতাকে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন, শ্রীবৃদ্ধি করতে পেরেছেন। এটি একটি বড় কাজ, যা কালি ও কলম এই পুরস্কারের মাধ্যমে অর্জন করতে পেরেছে।’

ওয়াসি আহমেদ বক্তব্যের এ-পর্যায়ে দুঃখভারাক্রান্ত মনে স্মরণ করেন কালি ও কলম সম্পাদক আবুল হাসনাতকে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, এখন যাঁরা কালি ও কলমের হাল ধরেছেন তাঁরা সুন্দরভাবে সুষ্ঠুভাবে পত্রিকাটিকে আরো সমৃদ্ধশালী করবেন। পুরস্কার বিজয়ীদের উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়ে তিনি তাঁর বক্তব্য শেষ করেন।

অধ্যাপক পবিত্র সরকার বলেন, অর্থবিত্ত, রাজনৈতিক ক্ষমতা, বিশাল চাকচিক্য থাকে না, থেকে যায় মানুষের শিল্প, যা মহত্তম কাজ। তিনি বলেন, শিল্পীরা, সাহিত্যিকরা মানুষের অমরত্বের জন্য সাধনা করছেন। মহামানবের দায় তাঁরা কাঁধে তুলে নিয়েছেন। ফলে তাঁরা আমাদের সমস্ত মানুষের কৃতজ্ঞতাভাজন।

কালি ও কলম পুরস্কারজয়ী তরুণদের অভিনন্দন জানিয়ে পবিত্র সরকার আশা প্রকাশ করেন, এ-পুরস্কার তাঁদের আরো নতুন নতুন, আরো সুন্দরতর, আরো মহত্তর সৃষ্টিকে নতুন সফলতায় পৌঁছে দেবে।

সবশেষে বক্তব্য রাখেন আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ এ সারওয়ার। বক্তব্যের শুরুতেই তিনি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, আবুল হাসনাতসহ সকল গুণী ব্যক্তিত্বদের প্রতি, যাঁরা সম্প্রতি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।

কালি ও কলম পুরস্কারের সঙ্গে আইএফআইসি ব্যাংকের যুক্ততা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দেশের জন্য যা কিছু দেশপ্রেমজনিত, মঙ্গলজনিত, কল্যাণজনিত তার সঙ্গে যুক্ততা আইএফআইসির কাছে একটি দায়বদ্ধতার মতো।’ 

তিনি বলেন, আইএফআইসি যেমন তার অর্থনৈতিক বিনিয়োগে, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে এবং সেবায় স্থায়িত্ব, আস্থা ও নির্ভরশীলতার প্রতীক, তেমনি আইএফআইসি ব্যাংক সমাজের প্রতিও স্থায়িত্ব, আস্থা ও নির্ভরশীলতার প্রতীক হিসেবে নিজেকে পরিচিত করছে এবং সে-ভূমিকা পালন করছে।’

তিনি   বলেন,   একটি   দেশের   যে-কোনো   উন্নতির   জন্য  সাংস্কৃতিক পরিশীলতা দরকার বলে মনে করে আইএফআইসি। এক্ষেত্রে আইএফআইসি ব্যাংক শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুরস্কার প্রদান করে আসছে বলে উল্লেখ করেন শাহ এ সারওয়ার।

তিনি জানান, তরুণদের সাহিত্যচর্চাকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যেই কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কারের সঙ্গে আইএফআইসি ব্যাংকের এ-যুক্ততা। শাহ এ সারওয়ার আশা প্রকাশ করেন, ভবিষ্যতেও কালি ও কলমের এ-পুরস্কারের মতো মঙ্গলজনক কর্মকাণ্ডে আইএফআইসি ব্যাংক জড়িত থাকবে।

পুরস্কারপ্রাপ্ত চার তরুণকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আশা করি আপনাদের লেখালেখি অব্যাহত থাকবে এবং আপনাদের কাজের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যচর্চায় নতুন মাত্রা যোগ করবেন। নবীন লেখকরাই চর্চা, সাধনা ও প্রথাবিরোধিতার মধ্য দিয়ে যে-কোনো দেশের সাহিত্যের ভিত নির্মাণ করেন।’

পরিশেষে তিনি চার তরুণের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলেন, তাঁদের সাহিত্যচর্চার পথে যত বাধাই আসুক না কেন তাঁরা যেন সেই  পথ থেকে বিচ্যুৎ না হন। তাঁরা যেন দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে আরো বেশি নিবেদিত হন। তাঁরা যেন তাদের সাহিত্যচর্চার মধ্য দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশকে একটি বিশেষ স্থানে অধিষ্ঠিত করতে পারেন শাহ এ সারওয়ার সেই প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।

অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে ছিল বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী অদিতি মহসিনের কণ্ঠে সুরের মূর্ছনা। তিনি প্রথমেই গেয়ে শোনান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুটি বর্ষার গান – ‘আবার এসেছে আষাঢ়’ ও ‘বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা, আষাঢ় তোমার মালা’।

তৃতীয় ও শেষ গান ‘তবু মনে রেখো’ গাইবার আগে তিনি স্মরণ করেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও আবুল হাসনাতকে। অদিতি মহসিন বলেন, এই দুই পণ্ডিত ব্যক্তির স্নেহসান্নিধ্য পাওয়ার সৌভাগ্য তাঁর হয়েছিল। তাঁদের স্মরণ করে তিনি গানটি পরিবেশন করেন। এই গানের মধ্য দিয়েই যবনিকা নামে আইএফআইসি ব্যাংক-নিবেদিত ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার ২০২০’-এর।