আধুনিকবাদ রবীন্দ্রনাথ ও একটি বিতর্ক

১৯৬৮ সালের এপ্রিলে আবু সয়ীদ আইয়ুবের আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ বেরোবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কবি অরুণকুমার সরকার (১৯২১-৮০) বইটির সমালোচনা লেখেন কলকাতা পত্রিকায় (১/২, জুলাই ১৯৬৮)। আইয়ুব উত্তর লিখতে দেরি করেননি। একই পত্রিকার চতুর্থ-পঞ্চম যুগ্মসংখ্যায় সেটি প্রকাশিত হয়। এই আলোচনা-প্রত্যালোচনা আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় সংস্করণ থেকে পরিশিষ্টে মুদ্রিত হয়ে আসছে।

অরুণকুমার সরকার ছিলেন মুখ্যত কবি। পঞ্চাশের দশকে ‘আরো কবিতা পড়ুন’ আন্দোলনের সংগঠক ও কবিতা পত্রিকার সম্পাদক। কাব্যের সংখ্যা মাত্র দুটি – দূরের আকাশ (১৯৫২) ও যাও উত্তরের হাওয়া (১৯৬৫)। কম লিখলেও সমকালে বিশিষ্ট কবি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। অন্যদিকে আইয়ুব কবি না হলেও, অরুণকুমার জানিয়েছেন, ‘… যে দু’জন ধাত্রীর সহায়তায় আধুনিক বাংলা কবিতার জন্ম হয়েছিলো, আবু সয়ীদ আইয়ুব তাঁদেরই একজন।’ তাছাড়া ‘কবিতা বিষয়ে, বিশেষ করে বাংলা কবিতা বিষয়ে, তাঁর বলবার অধিকার স্বোপার্জিত।’ অরুণকুমারের আলোচনা থেকে বোঝা যায়, তিনি নিজেও এই গুণের অধিকারী ছিলেন। ফলে এই দুই বোদ্ধার তর্ক-বিতর্কটি আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথে সম্পূরকতার মূল্য অর্জন করে পাঠকের কাছে একটা আলাদা মাত্রা দাবি করেছে। এই মাত্রাটিকে একটুখানি বুঝতে চাওয়া বর্তমান লেখার মূল লক্ষ্য। তবে তার আগে গ্রন্থনামে যুক্ত ও দুই আলোচকের লেখায় বারংবার উল্লিখিত ‘আধুনিকতা’ ব্যাপারটিকে বুঝে নেওয়া দরকার।

সবাই জানেন আধুনিক, আধুনিকতা, আধুনিকবাদ – এসব শব্দ আমাদের মনে যথেষ্ট বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে থাকে। এর কারণ আছে। আধুনিক বা মডার্ন শব্দটি মূলত ইউরোপীয় ইতিহাসের যুগবিভাগের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত। রেনেসাঁসের সময় থেকে ওই ইতিহাসের আধুনিক যুগ চিহ্নিত হয়েছে।

যে-যে বৈশিষ্ট্য বা লক্ষণের ওপর ভিত্তি করে পূর্ববর্তী পর্ব থেকে আলাদা হয়ে এই নতুন যুগের জন্ম, তাই-ই আধুনিকতা (মডার্নিটি)। যেমন পূর্ববর্তী মধ্যযুগের বৈশিষ্ট্যসমূহকে বলা হয় মধ্যযুগীয়তা।

ইতিহাসের এই আধুনিক বা আধুনিকতা নিয়ে বিশেষ সমস্যা নেই বোধকরি। সমস্যা শুরু হয়েছে এই বিশেষণ-বিশেষ্য শব্দ দুটি যখন শিল্পসাহিত্য ও জ্ঞানের অন্যান্য শাখায় প্রযুক্ত হতে শুরু করেছে তখন থেকে, বিশেষ করে শিল্পসাহিত্য। তখন থেকে এ হয়ে উঠেছে বহুবর্ণিল ও গতিশীল। ফলে কালে-কালে এর অর্থ পালটে গেছে। এক রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই বাংলা সাহিত্যে অন্তত দুই প্রকৃতির আধুনিকতার সাক্ষাৎ মিলছে। এক. রবীন্দ্রনাথের আধুনিকতা; দুই. ত্রিশোত্তর কালের কয়েকজন লেখকের আধুনিকতা। বোঝা যায়, এই বিভ্রান্তি অমোচনীয়।

অন্যদিকে আধুনিকবাদ বা মডার্নিজম ভিন্ন পরিচয়বাহী। শব্দটি মুখ্যত শিল্পসাহিত্যকেন্দ্রিক। এর সঙ্গে বহু বিষয় জড়িত। ইতিহাসের আধুনিকতা পুষ্টতর হয়েছিল ফরাসি আলোকায়নে। তার মূল কথা হচ্ছে মানব-প্রগতি। সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতা এর মর্মবাণী। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, মানুষের জ্ঞান যত বাড়ছে ততই তা কর্তৃত্বপ্রাপ্ত ও আধিপত্যবাদী হয়ে উঠে সাম্রাজ্যবাদে ব্যাপ্ত হয়ে পড়ছে। পরিণামে বিশ শতকের প্রথমার্ধে ঘটছে দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, কোথায় প্রগতি, কোথায় মুক্তি? কোথায় স্বাধীনতা, কোথায় মানবতা? উনিশ শতকেই দার্শনিক নিটশে অনুধাবন করেছিলেন যে, আলোকায়ন বা জ্ঞানদীপ্তি একটা ভান ছাড়া কিছু নয়। পৃথিবী আসলে ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের নৃত্যশালা। সেখানে নটরাজ হচ্ছে সুপারম্যান। সুতরাং ঈশ্বর ও খ্রিষ্টীয় আদর্শবাদ মৃত। শোপেনহাওয়ার প্রচার করলেন নৈরাশ্য ও দুঃখবাদ। ডারউইনের অরিজিন অব দ্য স্পিসিস (১৮৫০) গ্রন্থ সহস্রাধিক বছরের খ্রিষ্টীয় ধর্মবিশ্বাসকেন্দ্রিক সমাজদর্শনের ভিত নড়িয়ে দিলো। ফ্রয়েড দেখালেন মানুষের অবচেতন মনে যেসব প্রেষণা ক্রিয়াশীল তার সঙ্গে ইতর জন্তু-জানোয়ার ও পৈশাচিকতার পার্থক্য নেই।

এই নৈরাশ্য ও নির্বেদ গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে সাহিত্যকে, বিশেষ করে কবিতাকে। জীবন-জগৎ সম্পর্কে এই মনোভাবের শিল্পরূপ প্রথম দেখা গেছে ফরাসি কবি বোদলেয়ারে (১৮২১-৬৭)। বলা হয়ে থাকে, তাঁর রচনা থেকেই আধুনিকতাবাদের শুরু। বলা যেতে পারে, এক কেন্দ্রচ্যুত অনিকেত, অস্থির, অভিবাসী, অমঙ্গল চেতনাভাবিত সংশয়াকীর্ণ মানসতার তাত্ত্বিক রূপ হচ্ছে আধুনিকবাদ; যা দুঃসময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরো ঘনীভূত ও তীব্র হয়েছে। বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাতে বিপর্যস্ত জীবনে ইয়েটস শুনিয়েছেন কেন্দ্রের ভাঙনের কথা, এলিয়ট এঁকেছেন এক উষর অনুর্বর ভূমির চিত্রকল্প। স্বীকার না করে উপায় থাকল না যে, মানুষ আসলে ‘hollow men’ – ফাঁপা, শূন্য। মূল্যবোধের বিনষ্টি ও শূন্যতাবোধের কথা শোনা গেল আরো অনেকের রচনায়। আধুনিকতাবাদের এ হচ্ছে তুঙ্গ পর্ব। ১৯২০-এর দশকের এই পর্বকে কেউ কেউ বলতে চেয়েছেন High Modernism।

এ-প্রসঙ্গে আরেকটি কথা জরুরি। আধুনিকবাদ একশিলা কিছু নয়। এর পরিসীমার মধ্যে সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্যসমন্বিত বেশ কয়েকটি আন্দোলনকে শনাক্ত করা হয়ে থাকে। যেমন সিম্বলিজম, ইমেজিজম, ফর্মালিজম, এক্সপ্রেশনিজম, ডাডাইজম, সুররিয়ালিজম ইত্যাদি। এসব আন্দোলনের চরিত্রে ভিন্নতা আছে, এমনকি পরস্পরবিরুদ্ধতাও আছে। কিন্তু সবমিলিয়ে আধুনিকবাদ সাহিত্যের ইতিহাসে একটি অনস্বীকার্য পর্যায়।

দুই

আবু সয়ীদ আইয়ুব তাঁর বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় জানিয়েছেন, কেউ কেউ অনুযোগ করেছেন যে কেন তিনি ‘আধুনিকতা’র কোনো সংজ্ঞা দেননি। সেজন্যে এই ভূমিকায় কৈফিয়ত হিসেবে তাঁকে কিছু কথা বলতে হয়েছে। সে-বক্তব্যের সারসংক্ষেপ এই যে, কাজটা দুঃসাধ্য। বিশিষ্টজনদের মতামত তুলে ধরা যেত অবশ্য। কিন্তু আলোচনা তাতে অনাবশ্যক দীর্ঘ হতো, সৃষ্টি হতো জটিলতা। জটিলতার বড় কারণ এখানে যে, আধুনিকতার ধারণা ‘স্বভাবতই গতিশীল, ধাবমান’। সে-হিসেবে অস্থির। কেবল তা-ই নয়, বহু বর্ণিলও বটে।

কেউ কেউ ব্যাপারটাকে সহজ করে নিতে চেয়েছেন এই বলে যে, ‘নতুন’ যুগের মনন ও হৃদয়ানুভূতি যে-সাহিত্যে প্রতিবিম্বিত, সে-সাহিত্যই আধুনিক। কিন্তু সমস্যা এখানেও কম নেই। সময় বা যুগ তো দেশ ছাড়া নয়। উনিশ শতকের প্রথম দুই দশকে ইংল্যান্ডে যে-সাহিত্যমেজাজ দানা বেঁধে উঠেছিল, ভারত বা আরব কিংবা চীন দেশে তখন তার অঙ্কুর পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায় না। দ্বিতীয়ত, বিশেষ করে এ-কালে কোনো একটি দেশে বা ভাষায় একটি মাত্র মন ও মেজাজ সুস্পষ্ট প্রাধান্য পায় না। এলিয়ট এক উষর ও অনুর্বর ভূমির ছবি আঁকলেও তাঁর ধর্মবিশ্বাসী, অন্তত ধর্মসন্ধানী, কণ্ঠ ক্ষীণ হয়ে যায়নি। আবার এরই মধ্যে বোদলেয়রীয় জীবনবিতৃষ্ণাও স্তিমিত হয়নি। তৃতীয়ত, ‘আধুনিকতা’ কারো কাছে প্রশংসক শব্দ, কারো কাছে নিন্দক। যারা যুগের মন-মেজাজের মধ্যে যেগুলোকে পছন্দ করেন সেগুলোকেই আধুনিকতার সংজ্ঞাভুক্ত করেন। অপরপক্ষীয়রা তাদের চোখে প্রতিভাত যুগের খারাপ দিকগুলোকে আধুনিকতার লক্ষণ ধরে নেন। বোঝা যায়, ব্যাপারটা আদৌ সহজ-সমাধেয় নয়।

আইয়ুব আগেই বলেছেন, আধুনিকতার ধারণা গতিশীল। সুতরাং এটি তাঁর কাছে বিচিত্র-অর্থবাহী হওয়াই স্বাভাবিক, কেবল প্রশংসা বা নিন্দাসূচক শব্দ হিসেবে নয়। নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে নিয়ে আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ লেখার কারণ বা উদ্দেশ্য তিনি ব্যক্ত  করেছেন। প্রথম প্রকাশের ভূমিকাতেও প্রসঙ্গটি আছে। সেখানে জানিয়েছেন, বিশ শতকের দ্বিতীয় পাদে ইউরোপে ও তৃতীয় পাদে স্বদেশে রবীন্দ্রনাথের ‘কাব্যমহিমা’ প্রতর্কের বিষয় হয়ে উঠেছে। বিশেষত বাংলাভাষী একাধিক ‘আধুনিক’ কবি ও কাব্য-সমালোচক রবীন্দ্রনাথ-বিষয়ে কয়েকটি আপত্তি তুলেছেন। সেগুলোকে মোটামুটি দু-ভাগে ভাগ করে আইয়ুব লিখেছেন,

প্রথম শ্রেণীটি ভাষাগত। রবীন্দ্রনাথ যা বলেন – বিশেষত শেষ দশকের কবিতায় – বড়ো সোজাসুজি বলেন, ভাষা প্রায় গদ্যের মতো স্বচ্ছ ও ঋজু, সব-ক’টি শব্দ তার অভিধাযুক্ত, সব-ক’টি বাক্যের মানে বোঝা যায় অনায়াসে বা অল্পায়াসে। … দ্বিতীয় শ্রেণীর আপত্তি ভাবগত। শোনা যায়, জগতের অশুভ, কদর্য, বীভৎস রূপটা রবীন্দ্রনাথের চোখে ঠিকমতো ধরা দেয়নি, রোম্যান্টিক ভাবালুতায় রাঙানো গোলাপী কাচের পুরু চশমা প’রে তিনি সব-কিছুকে – মানুষকে, প্রকৃতিকে, সমগ্র বিশ্বচরাচরকে – অত্যন্ত শুভ ও সুন্দর ক’রে দেখেছেন; স্বভাবতই তাঁর মনে হয়েছে ‘ধন্য এই মানবজীবন, ধন্য এই বিশ্বজগৎ’।

এরপর আইয়ুব জানিয়েছেন, তাঁর বইটি লেখা হয়েছে প্রধানত এই দ্বিতীয় শ্রেণীর ও গৌণত প্রথম শ্রেণীর আপত্তির কথা মনে রেখে। তবে, দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় এ-ও বলেছেন যে, ওই প্রধান আপত্তির সূত্রে রবীন্দ্রকাব্যে অমঙ্গলবোধের ক্রমবিকাশ দেখানোর চেষ্টা তিনি করেছেন রবীন্দ্রনাথকে ‘আধুনিক’ সাব্যস্ত করার জন্য নয়। এখানে একটা প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। তাঁর উদ্দেশ্যের মধ্যে ওই সাব্যস্ত করার ব্যাপারটা যদি না থাকে, তাহলে বইয়ের নামে ‘আধুনিকতা’ শব্দটি ব্যবহার করলেন কেন? তাঁর মূল উদ্দেশ্য তো দেখানো যে, অমঙ্গলবোধের প্রকাশ কেবল বোদলেয়র ও বোদলেয়রীয় কাব্যধারাতেই নেই, রবীন্দ্রনাথেও আছে; প্রকৃতিগত দিক থেকে তাতে দুস্তর ব্যবধান থাকলেও আছে। তাহলে এমন একটা সিদ্ধান্ত কি প্রতীয়মান হয়ে ওঠে না যে, বোদলেয়র ‘আধুনিক’ হলে রবীন্দ্রনাথেরও ‘আধুনিক’ না হওয়ার কারণ নেই?

এখানে আরেকটি প্রশ্ন তুলতে হচ্ছে। এটি তোলা সম্ভব হতো না যদি না অনুষ্টুপ পত্রিকায় প্রকাশিত (শারদীয় সংখ্যা, ২০১৯) তপোব্রত ঘোষের ‘আইয়ুবের রবীন্দ্রচর্চা’ শীর্ষক প্রবন্ধে একটি তথ্যের সাক্ষাৎ ঘটত। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত আইয়ুবের Poetry and Truth বইটি আমরা দেখিনি। তপোব্রত জানিয়েছেন, ওই বইয়ের মুখবন্ধে আইয়ুব তাঁর বাংলা বইটির ইংরেজি শিরোনাম লিখেছেন Modernism and Tagore। তপোব্রতের বিবেচনায়, ইংরেজি নামটাই সঠিক। কেননা, বোদলেয়রের অমঙ্গলচেতনা বা sense of evil-কে পরিমাপক ধরে আইয়ুব তাঁর প্রতিপাদ্য প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়েছেন। একটা বিশেষ সময়ে পশ্চিম ইউরোপে উদ্ভূত একটা বিশেষ সাহিত্য-আন্দোলন, বোদলেয়রে সম্ভবত যার উজ্জ্বল সূচনা এবং তপোব্রত যাকে বলেছেন ‘decadent modernism’, আইয়ুবের পরিমাপক সত্যি সেটাই।

অরুণকুমার সরকারও তাঁর আলোচনায় এই বিষয়টার ওপর কোনো আলোকপাত করেননি। বরং আধুনিক-আধুনিকতা প্রশ্নে তিনিও ধোঁয়াটে অবস্থার মধ্যে রয়ে গিয়েছেন। যেমন তিনি যখন বলেন, ‘স্বীকার করি রবীন্দ্রনাথের অনেক-অনেক কবিতাই আধুনিক পাঠকের মনে বিন্দুমাত্র দাগ কাটে না …’, তখন প্রশ্ন করতেই হয় যে, কাদের তিনি আধুনিক পাঠকের তকমা দিতে চান? তাঁর নিজের সমকালীন পাঠকদের, না বিশেষ কোনো কাব্যধারার অনুরাগী পাঠকদের?

তিন

অরুণকুমার সরকার তাঁর লেখার শুরু ও শেষে নানাদিকের বিচারে আবু সয়ীদ আইয়ুবের যথেষ্ট প্রশংসা করেছেন। সেসব আমাদের এই আলোচনায় জরুরি নয়। আমরা গুরুত্ব দিয়ে দেখতে চাইব আইয়ুবের বইয়ে অভিব্যক্ত মত ও সিদ্ধান্তসমূহের যেগুলোতে অরুণকুমার আপত্তি জানিয়েছেন এবং মূল লেখক যে-উত্তর দিয়েছেন, সেইগুলোকে।

অরুণকুমারের মনে হয়েছে, আইয়ুব ধরে নিয়েছেন যে, আধুনিক কবিতা (অর্থাৎ বোদলেয়রীয় ধারার কবিতা) এবং রবীন্দ্রনাথের কবিতা একই সঙ্গে উপভোগ করা যায় না। না যাওয়ার কারণ রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য তথা বিশ্বনিরীক্ষার সঙ্গে আধুনিক পাঠকের মনের মিল নেই। এই ধারণা থেকেই রবীন্দ্রানুরাগী আইয়ুব আধুনিক কবি ও কবিতার প্রতি কিছুটা নির্দয় হয়েছেন।

অরুণকুমারের এই ধারণা ঠিক নয়। মনে হয়, আধুনিকতার (অর্থাৎ আধুনিকবাদের) যে-দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্যকে – অমঙ্গলভাবনা ও কাব্যদেহের প্রতি মাত্রাধিক গুরুত্বারোপ – প্রেক্ষণবিন্দু করে আইয়ুবের রবীন্দ্র-বিচার, তিনি তা অনুধাবন করতে পারেননি। সে-কারণে রিলকে, এলিয়ট, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ কবি সম্পর্কে আইয়ুবের অস্তিবাচক মতামত তাঁর নজর এড়িয়ে গেছে। এঁরা সকলেই তো ‘আধুনিক’ কবি।

অরুণকুমারের দ্বিতীয় অভিযোগ, ‘রবীন্দ্রনাথের কবিতায় যে-দুটি গুণের অল্পতা, অসদ্ভাব নয়, আমাদের মর্মপীড়ার কারণ, আইয়ুব বেছে-বেছে ঠিক সেই দুটি গুণকেই আধুনিক কবিতার পরম দুর্লক্ষণ বলে চিহ্নিত করেছেন; কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন বোদলেয়র এবং মালার্মেকে।’ এই দুটি গুণ বা বৈশিষ্ট্যের কথা আগের স্তবকে আমরা বলেছি। ভাব বা বক্তব্যকে অস্বীকার বা প্রায়-অস্বীকার করে মালার্মের কাব্যদেহের প্রতি অতিরিক্ত গুরুত্বারোপ নিয়ে পরে আলোকপাত করা যাবে। প্রথমে বোদলেয়রে অমঙ্গলচেতনা নিয়ে কথা বলা যাক।

এ-প্রসঙ্গে প্রথমে একটা প্রশ্নের সুরাহা বোধকরি হওয়া দরকার। বোদলেয়রে অমঙ্গলবোধের যে-আধিপত্য, তার কতটা দেশকালজাত আর কতটাই-বা ব্যক্তিগত? আইয়ুব বোদলেয়রের জীবনের যে-তথ্যাবলি হাজির করেছেন তা থেকে মনে হয়, দেশকাল থেকে উদ্ভূত বৈরী পরিস্থিতির তুলনায় তাঁর জীবন ও জগৎ দৃষ্টি গঠনে ব্যক্তিজীবনের ওই তীব্র যন্ত্রণাদায়ক ও নৈরাশ্যজনক অভিজ্ঞতাসমূহ সর্বাধিক ক্রিয়া করেছে। আমাদের এই মনে হওয়ার বড়ো কারণ বোদলেয়রের কালে এসে ফরাসি আলোকায়নের মূল্যবোধের মূল্যহীনতার উপলব্ধি, নিটশে-শোপেনহাওয়ার-ডারউইন-ফ্রয়েড প্রমুখের দর্শন ও মতের যে-অভিঘাত, সে-তুলনায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি অনেক বেশি মারাত্মক। এক সর্বব্যাপী ভাঙনের চিত্র এই সময়কার কবি-সাহিত্যিকরা এঁকেছেন। তা সত্ত্বেও তাঁদের রচনায় অস্তিবাচকতারও পরিচয় পাওয়া যায়। আইয়ুব তার দৃষ্টান্ত দিয়েছেন।

বোদলেয়রের দৃষ্টি রবীন্দ্রনাথের মতো ব্যাপক বা অখণ্ড ছিল না – অরুণকুমার এ-সত্য মানেন। কিন্তু আইয়ুব তাঁকে যেভাবে ‘মূর্তিমান শয়তান’ সাব্যস্ত করেছেন, তা মানেন না। ‘সব সমালোচকে’র ঐকমত্যের বরাত দিয়ে অরুণকুমার লিখেছেন যে, বোদলেয়র ছিলেন

…উল্টোমুখো খৃষ্টান, হাড়ে-হাড়ে পিউরিট্যান এক জেনসিনাইট। চরম মঙ্গলে পরিপূর্ণ আস্থা ছিলো বলেই একান্ত অমঙ্গলের নির্ভীক সাধনা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিলো। যে-কবি অন্ধকারের শ্বাসরুদ্ধকর বীভৎসতাকে ফুটিয়ে তুলতে পারেন তিনি কি আলোর প্রত্যাশী নন? স্পষ্ট ক’রে আলো চাই বা আলো আছে বলাটাই বড়ো কথা? ফলত, বোদলেয়রের কবিতার ভিতর আমরা একজন মোহমুক্ত সন্ন্যাসীর কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। আইয়ুব পান না। এ-নিয়ে তর্ক করে লাভ নেই। প্রশ্ন এই যে বোদলেয়রের কুপিত পিত্ত, যা বিরক্তি, দুঃখ এবং হতাশার সংমিশ্রণ, একটা আধ্যাত্মিক গুণ এবং আধুনিক সাহিত্যের অন্যতম প্রেরণা হিসেবে স্বীকৃত হলো কেন?

বোদলেয়রের সপক্ষে তিনি আরো বলেছেন, দোষটা হয়তো তাঁর নয়, দোষটা হয়তো আধুনিক যুগের। ‘শূন্যতা, বিরক্তি, বিতৃষ্ণা, বিবমিষা, একঘেয়েমি এবং অর্থহীনতার বোধ ছাড়া আর কী আছে এ-যুগের মানুষের সামনে?’ এ-যুগের অর্থাৎ আধুনিক যুগের মানুষের মনে ওইসব বোধ বা অনুভূতির জন্ম-কারণও ব্যাখ্যা করে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন।

দেশকালের বিরূপ পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত যেসব নেতিবাচক অনুভূতির কথা অরুণকুমার বলেছেন, সেসবকে একমাত্রিক জ্ঞান করা কতটা সংগত ও বাস্তবসম্মত? স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নটা আইয়ুবও তুলেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, বিশ্বযুদ্ধোত্তর ‘High Modernism’-এর কালেও কবি-সাহিত্যিকরা শুধু অন্ধকারের ছবিই আঁকেননি, অন্ধকারের পাশাপাশি আলোর ইশারাও তাঁদের রচনায় আছে। পাশ্চাত্য সাহিত্যে তা যেমন রয়েছে, তেমনি বাংলা সাহিত্যেও আছে। তাছাড়া বর্তমান যুগটাই কেবল খারাপ, আর অতীত ভালো – ইতিহাস এমন সাক্ষ্য দেয় না। অতীতে ইউরোপে, ভারতবর্ষে বহু নিষ্ঠুর ও পৈশাচিক কাণ্ড কখনো ধর্মের নামে, কখনো সামাজিক-অর্থনৈতিক স্বার্থে সংঘটিত হয়েছে। আইয়ুব দেশকালনির্বিশেষে ভালো-মন্দ দুদিকেরই কিছু কিছু দৃষ্টান্ত দিয়েছেন।

অরুণকুমারের বিচারে বোদলেয়রও আলোর প্রত্যাশী। যে-কবি অন্ধকারের বীভৎসতাকে অত্যন্ত শিল্পদক্ষতায় ফুটিয়ে তুলতে সমর্থ, তাঁর পক্ষে আলোর প্রত্যাশী হওয়াই স্বাভাবিক। সেজন্যে স্পষ্ট করে আলো চাই বা আলো আছে বলা তাঁর মতে, বড়ো কোনো ব্যাপার নয়। তাছাড়া অমঙ্গলবোধ নিয়ে উৎকণ্ঠিত হওয়ার কোনো কারণ আছে বলেও তিনি মনে করেন না। কেননা, ‘অমঙ্গলবোধ আর অমঙ্গলসাধনা মনুষ্যস্বভাব বিরোধী; মানুষমাত্রেই আদর্শবাদী, মঙ্গলের সাধক, কেউ প্রচ্ছন্নভাবে, কেউ প্রকাশ্যে। কবিরা তো বটেই।’

এটা ঠিক যে, মানুষ মাত্রই চায় অমঙ্গলের অবসান ঘটে মঙ্গলের প্রতিষ্ঠা ঘটুক। কবি-সাহিত্যিকদের সংবেদনশীল চেতনায় এটা আরো তীব্রভাবে কাজ করে। নৈরাশ্যের ঘন অন্ধকারের মধ্যেও তাঁদের রচনায় তাই আলোর কিছু-না-কিছু ইশারা থাকে। এমনও দেখা যায়, বিশেষ পরিস্থিতিতে জন্ম-নেওয়া কোনো রচনায় হয়তো নৈরাশ্যের আধিপত্য, আবার সেই একই স্রষ্টার অন্য রচনায় আশার দীপ্তি। কখনো-বা একসঙ্গে দুই-ই। তথাকথিত আধুনিক বাংলা কবিতায় এর সবচেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বোধকরি জীবনানন্দ দাশ। জীবন-মৃত্যুর দ্বৈরথে জর্জরিত তাঁর মতো আর কেউ বাংলা ভাষায় আছেন বলে মনে হয় না। সুতরাং আলো চাই বা আলো আছে বলা বড়ো কোনো ব্যাপার নয় বলে অরুণকুমার যে-অভিমত দিয়েছেন তা হয়তো শিল্পসম্মত নয়।

অরুণকুমার মনে করেন, বোদলেয়রের শিল্পকর্মকে আইয়ুব উঁচুদরের বিবেচনা করেও সেখানেই তৃপ্ত থাকতে পারেনি এ-কারণে যে, শিল্পের সৌন্দর্য একান্তভাবে শিল্পবস্তুতেই নিবদ্ধ – এ-তত্ত্ব তিনি একেবারেই মানেন না। তিনি বরং জড়জগতে মানবমননিরপেক্ষ সত্য-শুভ-সুন্দরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী। এই সূত্রেই অরুণকুমারের অভিযোগ,

আইয়ুব আস্থা রাখেন না কিন্তু মনে হচ্ছে ধর্ম এবং ঈশ্বরের কাজটা তিনি কবিকে দিয়ে করিয়ে নিতে চাইছেন। কবি কি প্রেরিত পুরুষ, প্রবক্তা, মরমী, যোগী সবাকার স্থান পূরণ করতে পারেন? হয়ত রবীন্দ্রনাথ পেরেছিলেন। আধুনিক কবিরা এ-প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছেন না বলেই আইয়ুবের আক্ষেপ।

অরুণকুমারের এ-অভিযোগের উত্তরে আইয়ুবের বক্তব্যের সারকথা হচ্ছে, কাব্যকলার সঙ্গে শিল্পকর্মের সমীকরণের পক্ষপাতী তিনি নন। তা যদি হতেন তাহলে বোদলেয়রকে উঁচুদরের কবি হিসেবে বিবেচনা করতেন। ‘উঁচুদর’ মানে শিল্পোৎকর্ষের সঙ্গে ‘আরো-কিছু’ গুণের সমীকৃত রূপ। কী সেই গুণ তা বলা সহজ নয়। তবু বিষয়টাকে খানিকটা স্পষ্ট করার জন্য ধরে নেওয়া যাক সেই বাড়তি গুণ হচ্ছে উপলব্ধির গভীরতা। এর সঙ্গে শিল্পকলার মণি-কাঞ্চনযোগে জন্ম হয় উঁচুদরের কবিতা। না হলে সে-জাতীয় রচনা উঁচুদরের নীতিশিক্ষা, ধর্মদেশনা কিংবা দার্শনিক তত্ত্বকথায় পর্যবসিত হয়।

এই বক্তব্য থেকে কাব্য আস্বাদন অথবা বিচারের একটি অপরিহার্য সূত্র বেরিয়ে আসছে। সেটি হচ্ছে, কাব্যের মূল্য নিরূপণের ক্ষেত্রে আমরা দুই ভিন্ন মানদণ্ড ব্যবহার করে থাকি – একটি, উপলব্ধির গভীরতা; অন্যটি, শিল্পগুণ। আইয়ুব এই বক্তব্যের সমর্থনে ওয়ালটর পেটর, টলস্টয়, রবীন্দ্রনাথ, টি.এস. এলিয়ট এবং আই.এ. রিচার্ডস – এই পঞ্চ-দিকপালের সাক্ষ্য মেনেছেন। এঁদের মধ্যে রিচার্ডসের অভিমত আলোচনার গতিমুখ এগিয়ে নিতে বিশেষভাবে সহায়ক হতে পারে। রিচার্ডস তাঁর একাধিক রচনায় কবিতা থেকে বিশ্বাস-অবিশ্বাস,

সত্য-মিথ্যা ইত্যাকার প্রসঙ্গ খারিজ করে দেওয়ার জন্য জোরালো ওকালতি করেছেন। অথচ তিনিই হয়তো কোনো-এক অসাবধান মুহূর্তে বলে ফেলেছেন :

শিল্পরচনা কখনো ব্যর্থ হয় কমিউনিকেশনের ব্যর্থতার দরুন, কখনো এই কারণে যে যা কমিউনিকেট করা হয়েছে তার কোনো মূল্য নেই (because the experience communicated is worthless); কখনা-বা উভয় কারণে।

অরুণকুমার সরকারও কবিতার মধ্যে কেবল শিল্পকর্মের নৈপুণ্য খোঁজেন না, আবেগও চান। আরো অনেক-কিছু চান – ‘মনের একটু বিস্তার, একটু অস্পষ্ট আলো।’ কিন্তু আইয়ুব প্রশ্ন তোলেন, আবেগমাত্রেরই বলিষ্ঠ প্রকাশ কি মহৎ কবিতা হয়ে ওঠে? তাঁর বিবেচনায় সেটা হয়ে উঠতে পারে একমাত্র তার কাছে যিনি ওই আবেগকে সর্বান্তঃকরণে অবাধে গ্রহণ করতে সমর্থ। কোনো রূপদক্ষ কবি যদি বর্ণবিদ্বেষ-জাতীয় ভাব নিয়ে কবিতা লেখেন, তবে আইয়ুবের কাছে অমন কবির আবেদন তাঁর কলাকৌশলের গুণগ্রহণেই সীমাবদ্ধ থাকবে। বর্ণবিদ্বেষীরা তাঁকে মহৎ কবির শিরোপা দিতেই পারেন।

আইয়ুবের মতে, কবি যতই আঙ্গিকসিদ্ধ হোন না কেন, তবু তিনি পাঠকের সঙ্গে কমিউনিকেশন ঘটাতে দুই কারণে ব্যর্থকাম হতে পারেন : ১. উপলব্ধি যদি শ্রেয়োনীতি-বিগর্হিত বলে মনে হয়; ২. সে-উপলব্ধি যদি অসত্য বলে প্রতিভাত হয় অথবা তার ভিত্তি যদি অভিজ্ঞতালব্ধ তথ্যের ওপর স্থাপিত না হয়। এই দুই মানদণ্ডের আলোকে এরপর আইয়ুব বলেন –

ফাশিস্ট সাহিত্য প্রথম কারণে আমার কাছে অগ্রাহ্য ঠেকে; বোদলেয়রের অনেক কবিতায় আমি সম্পূর্ণ সাড়া দিতে পারি না দ্বিতীয় কারণে। কোনো-কোনো পাঠক ভুল বুঝেছেন বলে এখানে স্পষ্ট করে বলতে চাই যে বোদলেয়রের বিরুদ্ধে আমার অনুযোগ শ্রেয়োনীতিক নয়, দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক বিরোধ-ঘটিত।

তাঁর কোনো কবিতাই আমার মতে ইম্মরাল নয়, কিন্তু  কোনো-কোনো কবিতা ‘অসত্য’ – কাব্যিক অর্থে অসত্য, অর্থাৎ not bounded on the facts of experience.

চার

রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে আধুনিক পাঠকের এবার দ্বিতীয় অভিযোগের প্রসঙ্গ। অভিযোগটি কবিতার নির্মাণ, সহজ কথায় মুখ্যত কবিতায় ভাষা বা শব্দ ব্যবহার সম্পর্কে। ফরিয়াদিদের মধ্যে অরুণকুমার সরকারও আছেন। তিনি লিখেছেন,

আসলে বক্তব্য বা দৃষ্টিভঙ্গির গরমিলের জন্যে নয়, রবীন্দ্রকাব্যের উদার মানসিকতাকে বিদ্রƒপ করবে এমন পাষণ্ড ভূভারতে কেউ আছে বলে মনে করি না, কবিতা-নির্মাণের ব্যাপারে আধুনিকদের ধারণা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না বলেই গণ্ডগোলটা বাধছে। রবীন্দ্রনাথ বড়ো বেশি স্পষ্ট, বড়ো বেশি বিস্তারিত, বড়োই বক্তৃতাবাগীশ, যে-কারণে অনেক সময়েই দেখতে পাচ্ছি তাঁর আবেগ উপযুক্ত দেহ খুঁজে পাচ্ছে না, নেহাৎ ঘোষণা হয়ে দাঁড়াচ্ছে যা বাণী হিসেবে চমৎকার কিন্তু কিছুতেই একালের পাঠকের মনের মতো কবিতা নয়।

অরুণকুমার তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে কোনো দৃষ্টান্ত ও ব্যাখ্যা দেননি। না-দেওয়ার কারণ হিসেবে বলেছেন যে, আইয়ুব নিজেই তাঁর বইয়ে অনেক সময় দেখিয়ে দিয়েছেন কোনগুলো কবিতা আর কোনগুলো নয়।

মূল বইয়ের ‘কবিতার ভাষা’ অধ্যায়ে আইয়ুবের আলোচ্য সাহিত্য, বিশেষত কবিতা-রচনার যে-উদ্দেশ্য, স্রষ্টা ও সৃষ্টির সঙ্গে ভোক্তার মিলন ঘটানো, তাতে ভাষার ভূমিকা পর্যবেক্ষণ। এখানেও আইয়ুবের লক্ষ্য রবীন্দ্র-কবিতার, বিশেষত শেষ পর্যায়ের কবিতার ভাষা সম্পর্কে উত্থাপিত আপত্তি-খণ্ডন। এ তো অনস্বীকার্য যে, ভাষাই কবিতার বাহন। তাহলেও সেই ভাষার পক্ষেই আবার যোগ ও বিয়োগ দুই-ই সাধ্য। ভাষা যদি কাচের মতো দৃষ্টিভেদ্য হয়, তবেই মনের কক্ষে ওপারের আলো নিয়ে আসতে পারে, মনকে প্রসারিত করে দিতে পারে বিশ্বের প্রাঙ্গণে। কিন্তু আধুনিক কবি ও কাব্যতাত্ত্বিকরা এই সত্যকে মান্য বিবেচনা না করে সম্পূর্ণ ভিন্ন লক্ষ্যকে তাঁদের উদ্দিষ্ট করলেন। ফরাসি কবি মালার্মে বললেন – ‘one makes poetry with words, not with ideas।’ এর মধ্যেই হয়তো লক্ষ্যান্তরের পথনির্দেশ ছিল। আইয়ুব লিখেছেন :

শব্দকেই কবিতার মূল তন্মাত্র এবং ভাবকে ভেজাল মনে করার ফল হল এই যে, কাব্যসৃষ্টিতে শব্দযোজনা কেবল ধ্বনির দিকে লক্ষ্য রেখে হতে লাগল, কবিতার ভাষারও যে-একটা বোধগম্য, অন্তত হৃদয়গ্রাহ্য, অর্থ থাকা আবশ্যক এই অনুশাসনের বিরুদ্ধে কবিদের বিদ্রোহ ক্রমাগত প্রবলতর হয়ে উঠল।

কবিতায় ভাব বা বক্তব্যের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহের পরিচয় এরপর এলিয়ট, জাঁ পল সার্ত্রে, ভালেরি, র্যাঁবো, মালার্মে প্রমুখ কবি ও তাত্ত্বিকের রচনা এবং মতামত থেকে আইয়ুব দিয়েছেন। অরুণকুমার অবশ্য কেবল মালার্মের প্রসঙ্গই তুলেছেন। বলেছেন যে, মালার্মে যেসব তত্ত্বকথা প্রচার করতেন আক্ষরিকভাবে সে-অনুযায়ী কবিতা লেখা কতটা সম্ভব তা তিনি জানেন না। মালার্মে নিজে ও তাঁর শিষ্যরাও তা পারেননি। কিন্তু আইয়ুব যা-ই বলুন, মালার্মের এমন-কিছু কবিতা আছে যেগুলো সুস্পষ্ট অর্থবাহী। অনেকদিন ধরে কবিদের দিয়ে নানা ধরনের কাজ, যা প্রকৃত কবিকর্ম নয়, করিয়ে নেওয়া হয়েছে। মালার্মে তারই প্রতিবাদ। কবিতার ধর্ম বা স্বরূপ সম্পর্কে তাঁর মত অরুণকুমার নিজের ভাষায় এভাবে তুলে ধরেছেন :

তাঁর মতে কবিতার জগৎ এক অপার রহস্যের জগৎ, যে-জগতে প্রবেশ করবার চাবি পাঠককেই নিজের চেষ্টায় আপন অনুভূতি দিয়ে খুঁজে নিতে হবে। কবিতা কিছু বলবে না, তা নয়; বরং অনেক অনেক কিছু বলবে, স্তরে-স্তরে তার অন্তহীন অর্থ ছড়ানো থাকবে। কিন্তু বলবে পরোক্ষভাবে, আকার-ইঙ্গিতে, নানা সংকেতের মধ্যবর্তিতায়, শব্দকে তার সাধারণ গ্রাহ্য অর্থের বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে।

প্রশ্ন রেখেছেন অরুণকুমার : এই তত্ত্বে কী আপত্তি থাকতে পারে? না, এই তত্ত্বে কেউই বোধকরি আপত্তি করবেন না। আইয়ুবও করেননি। তবে তাঁর আপত্তি অরুণকুমারের সেই ধারণার প্রতি, যেখানে তিনি বলেছেন, কবিতার লক্ষ্য বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের ধারণাও মালার্মের কাছাকাছি ছিল, যদিও বহির্বিশ্বের প্রতি অত্যধিক কৌতূহল অথবা অন্য যে-কোনো কারণেই হোক নিজের যুক্তি অনুযায়ী কবিতা লিখতে তেমন উৎসাহ বোধ করেননি। রবীন্দ্রনাথের ‘ভাষা ও ছন্দ’ এবং শেষ সপ্তক কাব্যের সতেরোসংখ্যক কবিতা থেকে অংশবিশেষ নিজের মতের সমর্থনে উদ্ধার করে অরুণকুমার বলেছেন, ‘মালার্মে এর চাইতে নতুন কিছু বলেন নি। আর থিয়োরিটা জানা থাকলেও রবীন্দ্রনাথ তা নিয়ে তন্নিষ্ঠ পরীক্ষা করেন নি, এই যা।’

এই বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিরোধিতা করে আইয়ুব বলেছেন, মালার্মে ও রবীন্দ্রনাথের কাব্যতত্ত্বের ব্যবধান দুস্তর। ‘ভাষা ও ছন্দ’ কবিতা থেকে কয়েকটি পঙ্ক্তি তুলে দিয়ে এই দুই কবির কাব্যভাবনাকে মেলাতে যাওয়া মানে অসাধ্যসাধন করতে চাওয়া। কেননা উদ্ধৃত অংশটি সংগীতবিষয়ক, কবিতাবিষয়ক নয়। আসলেও অরুণকুমার সচেতনভাবে অংশটি চয়ন করেননি। উদ্ধৃতির শেষ তিন চরণে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে, মানুষের ভাষা ‘ধূলি ছাড়ি একেবারে ঊর্ধ্বমুখে অনন্ত গগনে/ উড়িতে সে নাহি পারে সংগীতের মতন স্বাধীন/ মেলি দিয়া সপ্তসুর সপ্তপক্ষ অর্থভারহীন।’ প্রকৃতপক্ষে রচনাটি কবিতাবিষয়ক, আর তার কেন্দ্রে রয়েছে কারয়িত্রী শক্তি হিসেবে ছন্দের প্রসঙ্গ। বাল্মীকি বলেছেন : ‘মানবের জীর্ণ বাক্যে মোর ছন্দ দিবে নব সুর,/ অর্থের বন্ধন হতে নিয়ে তারে যাবে কিছু দূর/ ভাবের স্বাধীন লোকে, …।’

‘কিছু দূর’ বিশেষণটির প্রতি আইয়ুব পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এর মানে সংগীতের যা সাধ্য, কবিতা তা পারে না। অথচ মালার্মে কবিতার অঙ্গে সংগীতের ধর্ম আরোপ করতে চেয়েছেন। সংগীত ছাড়া নির্বস্তুক চিত্রকলার দ্বারাও তিনি অনুপ্রাণিত ছিলেন। এই দুই প্রেরণা তাঁকে বস্তুভারহীন (abstract) কবিতা লিখতে প্রয়াসী করে। সে-প্রয়াস অবশ্য অংশত সফল হয়েছিল। আইয়ুব একে সৌভাগ্য বিবেচনা করেছেন। কেননা ‘মালার্মে নিঃসন্দেহে উঁচুদরের কবি, উত্তম কবিতা লিখেছেন যখন তাঁর উদগ্র কাব্যতত্ত্ব তাঁর কবিকর্মকে বিভ্রান্ত করেনি।’

প্রত্যুত্তরের উপান্তে পৌঁছে আবু সয়ীদ আইয়ুব যে-সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন সেটি বেশ চমকপ্রদ। বলেছেন যে, সমালোচক অরুণকুমার সরকারের সঙ্গে তাঁর কিছু দূরত্ব আছে বটে, কিন্তু কবি অরুণকুমারের সঙ্গে দুজনের অবস্থান কাছাকাছি। তাঁর দুটি কবিতা  উদ্ধৃত করে আইয়ুব ব্যাখ্যাপূর্বক লিখেছেন – ‘শূন্যতা, বিরক্তি, বিতৃষ্ণা, বিবমিষা, একঘেয়েমি এবং অর্থহীনতার বোধ ছাড়া আর কী আছে এ-যুগের মানুষের সামনে’ – এই যাঁর বিশ্বাস, তিনি অমন শুদ্ধ প্রেমের অর্থাৎ গভীর অস্তিধর্মী কবিতা লিখতে পারেন না। ‘বুদ্ধদেব বসুকে’ শিরোনামার দ্বিতীয় কবিতাটিকে আইয়ুব যদিও রবীন্দ্রনাথের প্রতি নিক্ষিপ্ত অরুণকুমারের অভিযোগ ফিরিয়ে দিয়ে উৎকৃষ্ট

‘বক্তৃতাবাগীশ’ কবিতা বলেছেন, তবু এতে ব্যক্ত উপলব্ধির তিনি প্রশংসা করেছেন। কবিতাটি থেকে জানতে পারা যায় জীবনের এবং সাহিত্যের এই মহার্ঘ্য মূলনীতির কথা :

আশৈশব কবিতাকে ভালোবেসে বুঝেছি প্রেমেই

রূপ, কল্পনার তথা কবিতার আদি বাসস্থান।

এরপর আর গোটা দুই-তিন বাক্যে আইয়ুব তাঁর প্রত্যুত্তর শেষ করেছেন। শেষের ছোট বাক্যটায় যেন এক ধরনের ব্যঞ্জনাধর্মী ঝংকার রয়েছে। সেজন্যে আইয়ুবকে উদ্ধৃত করেই এ-আলোচনা শেষ করছি : হ্যাঁ, প্রেমেই; ঘৃণায় নয়, বিতৃষ্ণায় নয়। অরুণ দুটি ছত্রে যা সুন্দর করে বলেছেন, আমিও সেই কথা দু’শ পঞ্চাশ পৃষ্ঠায় যুক্তিসহকারে বলতে চেষ্টা করেছি। তবে ঝগড়াটা কোথায়?