আনন্দলোকের ডাক

ঋতু চলে গেল।
আমি কখনো ভাবিনি আমার আগে ঋতু চলে যাবে। ঋতু আমার চেয়ে দশ বছরের ছোট। আমি ওকে বাংলা পড়াতাম। সেই পুরনো গল্প। ছাত্রী ঋতু একদিন হয়ে গেল আমার প্রেমিকা। তারও পাঁচ বছর পর হয়ে গেল আমার স্ত্রী। ঋতু একটা বেসরকারি প্রাইমারি স্কুলে পড়ায়। আর আমি একটা কোচিং খুলে সকাল-সন্ধ্যা পড়াই। বিকেলের দিকে কমার্সের দুটো ব্যাচ পড়ায় ঋতু। এভাবেই আমাদের সংসারজীবন কাটছিল, ঋতু একদিন বলল, ‘জানো কৃশানু আমার না ভীষণ আনন্দ হচ্ছে।’
আমি বললাম, ‘কেন? আজ হঠাৎ কিসের জন্য আনন্দ?’
‘আমি না মা হতে চলেছি।’ শব্দগুলো এমনভাবে উচ্চারণ করল ঋতু, যেন প্রতিটি শব্দ এক একটা স্বপ্ন। স্বপ্নই তো! বিয়ের চার বছর হতে চলল আমাদের কোনো উত্তরসূরি আসছে না। খুব চিন্তা আর হতাশা ছিল বুকের পাঁজরে। বাইরের কেউ বুঝতে পারত না, আজ উত্তরসূরির আগমনের ডাক শুনতে পেয়েছে ঋতু। এটা ঋতু কেন, আমারও স্বপ্ন। ঋতু যে-শব্দগুলো উচ্চারণ করল, তার প্রতিটি শব্দ বাতাসে ম-ম গন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে। আমি অনুভব করতে পারছি। ঋতুর চোখদুটোর মধ্যে গুপ্তধন খুঁজে পাওয়ার আনন্দ। সারা মুখটা কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ার মতো সোনালি আভায় মাখামাখি। আমি কেমন মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখছি। কারণ এত খুশি ঋতুকে কোনোদিন আমি দেখিনি।
ঋতুরা ছয় বোন, দুই ভাই। ওর বাবা গেঞ্জির কারখানায় কাজ করেন। মা মেশিন সেলাই করেন। ঋতু যখন আমার প্রেমে পড়ল, কিংবা আমি যখন ঋতুর প্রেমে মজলাম, তখন ঋতুর একটা ছোট্ট বোন এলো পৃথিবীতে। সেটা জানলাম ঋতুর এক বন্ধুর কাছ থেকে। ঋতু তখন বারো ক্লাস পাশ করে বিকম ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হবে। ঋতু দেখা করছে না আমার সঙ্গে। ওর বন্ধুকে দিয়ে খবর দিলাম। ইমারজেন্সি। ঋতু যেন একবার দেখা করে। তবু দেখা করে না ঋতু। আমি জানতাম, বৃন্দাবন লেনে ঋতু একটি ছাত্রকে পড়াতে যায়। আমি সেই রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। একেবারে ঋতুর মুখোমুখি। ‘কী ব্যাপার, তুমি দেখা করছ না কেন?’
‘আমার ভীষণ লজ্জা করছে কৃশানু।’
‘কেন?’
‘মা-বাবা যে কী করে না? কী কষ্ট করে আমাদের সংসার চলে, তুমি কিছুটা জানো। তার ওপর …।’
‘তার ওপর তোমার একটা বোন হয়েছে, তাই তো?’
কিছু বলে না ঋতু। যেন লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে যেতে চাইছে। ঘাড় নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে।
‘এতে তোমার লজ্জা পাওয়ার কী আছে ঋতু? বুঝতে পারছি না আমি।’
‘তুমি জানো না কৃশানু, আমরা দুবেলা ঠিকমতো খেতে পাই না। একবেলা ফ্যানভাত খাই। রোজ বাজার হয় না। কলেজের মাইনে দিতে পারি না। আমার পরের বোনটা নাইন পর্যন্ত পড়ে ছেড়ে দিলো। এখন মায়ের মতো সেলাই করে। আমার বড়ভাই অশোক ছেঁড়া প্যান্ট সেলাই করে পরে কলেজে যায়। বিএসসি পড়ছে। করে টিউশন। করে এলআইসি। তা দিয়ে নিজের খরচ চালায়। এই হাভাতে আকালে সংসারে বাবা-মা আর একটা সন্তান আনল কী ভেবে? আমি ভেবে পাচ্ছি না। ভীষণ ঘেন্না করছে বাবা-মাকে।’ সত্যিই সেদিন ঋতুর চোখমুখ ঘৃণায় বীভৎস হয়ে উঠেছিল।
এখন খাটের ওপর শুয়ে আছে ঋতু। ওর চোখমুখ যেন আমাকে পুরনো দিনের কথাগুলি মনে করিয়ে দিচ্ছে। ওর ছয় বোন, দুই ভাইকে খবর দিতেই এসে গেছে। একপ্রস্থ কেঁদেছে ওরা। দিদিকে সাজাবে। কারণ দিদি ওদের কাছে মায়ের মতো ছিল। ওদের জন্য দিদি অনেক কিছু করেছে আমি দেখছি। আর শ্রাবণধারার মতো পুরনো দিনগুলি চোখের পর্দায় ভাসছে। ঋতু তখন বিকম অনার্স পাশ করেছে। কমার্সের স্টুডেন্ট পড়াচ্ছে। ভালো আয় হচ্ছে। একদিন আমি ওদের বাড়িতে গেলাম। ঋতুর কথামতো। ওর বাবাকে বললাম, ‘আমি ঋতুকে বিয়ে করব।’ কথাটা শুনে ঋতুর বাবা দেশলাই কাঠির মতো জ্বলে উঠলেন, বললেন, ‘তুমি কী করো?’
‘আমি কোচিং করি।’
‘তোমার তো বড্ড সাহস!’
‘এ-কথা বলছেন কেন?’
‘আমার মেয়ের দিকে তুমি হাত বাড়িয়েছ, তোমার স্পর্ধা তো কম নয়। বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে। আর কোনোদিন আসবে না।’
ঋতুর মা সেলাই মেশিন বন্ধ রেখে বললেন, ‘তুমি কী করে জানলে ও তোমার মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়েছে। তোমার মেয়েও তো ওর দিকে হাত বাড়াতে পারে!’
‘তুমি চুপ করো।’ গর্জে উঠলেন ঋতুর বাবা।
‘ওরা যখন ভালোবেসেছে। ওরা বিয়ে করুক। তুমি আপত্তি করছ কেন?’
‘তুমি একদম কথা বলবে না, তুমি কী বোঝ?’
আমরা বুঝতে পারছিলাম। তাই ঋতুর কথামতো আবার আমি আর একদিন ঋতুর বাড়ি যাই। আমি বলি, ‘ঋতু এখন যেমন টাকা দিচ্ছে, বিয়ের পরও দেবে।’
ঋতুর বাবা ঠান্ডা হয়ে গেল। নরম সুরে বললেন, ‘বসো। চা খাবে?’
‘না।’
‘সত্যি দেবে তো তোমরা টাকা?’
ঋতু মাঝখান থেকে বলেছিল, ‘ভয় পেও না বাবা। আমি না পারি ও এসে তোমাকে মাসে মাসে দিয়ে যাবে।’
শেষ বোনটার নাম ছিল সমাপ্তি। ওর বিয়ে পর্যন্ত টাকা দিয়েছে ঋতু।
সেই ঋতু যেদিন সাড়ে তিন কেজি ওজনের একটা ফুটফুটে ফর্সা শিশুর জন্ম দিলো। শিশুটিকে কোলে নিয়ে ঋতুর মুখে এত আলো ফুটে উঠেছিল যে, একটা সূর্য এত আলো দিতে পারে না। সেদিন আকাশে দুটো-তিনটে সূর্য উদয় হয়েছিল।

ওর ছটা বোনই খাটের পাশে দিদিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। সকলের চোখই অশ্রুধারায় ছোট ছোট হ্রদ হয়ে উঠেছে আর মেয়ে তিতলি! অঝোরধারায় কেঁদে চলেছে। ছেলেকে কোলে নিয়ে।
এই ফ্ল্যাটবাড়িতে আটটা পরিবার থাকে। সকলেই এসে দেখে যাচ্ছে ঋতুকে। শেষ দেখা। তারা ভাবতে পারছে না কাল দেখলাম, আজ সকালেও দেখলাম। কখন কী করে ঘটল এমন অঘটন!
সবাইকে একই কথা বলে যেতে হচ্ছে বারবার, ভালো লাগছে না। তবু বলছি, ঋতু আজ স্কুল থেকে ফিরতে দেরি করেছে। রাস্তায় জ্যাম ছিল। আমি অপেক্ষা করছিলাম। আমরা দুজন একসঙ্গে খাই। আজ নয়, বিয়ের পর থেকেই খেতে খেতে আমরা গল্প করি। আজো গল্পই করছিলাম। একটা হাসির গল্প। মোল্লা নাসিরুদ্দিনের। ঋতু খুব হাসছিল। হাসতে হাসতে খাবার আটকে গেল গলায়। জল খাচ্ছে। তবু নামছে না খাবার। কাশছে। একসময় অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল মেঝেতে। হাতের কাচের গ্লাসটা ভেঙে ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। জল আর ভাঙা কাচের টুকরার মাঝে শুয়ে আছে ঋতু। আমি কী করব ভেবে পাচ্ছি না। আমার চেনা গৌর ডাক্তারকে কল করি। ওর চোখেমুখে জল দিই। ঋতুকে নাড়া দিই। পাখাটা জোরে চালিয়ে দিয়েছি। টিভি চলছিল, বন্ধ করে দিলাম। গৌর ডাক্তার দেখে বললেন, ‘শেষ।’
ছ-ঘণ্টা পর ডাক্তারের চেম্বার থেকে ডেথ সার্টিফিকেট নিয়ে আসতে হবে। এখনো ছ-ঘণ্টা হয়নি।
চলে যাওয়ার মতো বয়সও হয়নি ঋতুর। মাত্র ৫৫। এর আগে দুবার ইপিএস হয়েছে ওর। হার্টের ব্লকেজ। প্রতি দশ বছর অন্তর এটা হবে। ডাক্তার বলেছিলেন। এবারো বাইপাসের ধারে একটা নার্সিংহোমে ইপিএস করিয়ে আনলাম। নার্সিংহোমে বসে বলেছিলাম, ‘ঋতু তুমি একটা রেকারিং খরচ রেখেছ।’
‘কী ব্যাপারে বলো তো কৃশানু?’
‘তুমি বুঝতে পারছ না?’
‘ও তুমি হার্টের কথা বলছ? এই হার্টটা ছিল বলেই তো তোমাকে ভালোবাসতে পেরেছি। এটা হলো দশ বছর অন্তর অন্তর প্রেমার্ঘ্য দেওয়া।’
‘আর কত বছর এই প্রেমার্ঘ্য দিতে হবে?’
‘বোধহয় আর দিতে হবে না।’
‘মানে?’ আমি চমকে উঠে বললাম।
হাসতে হাসতে ঋতু বলল, ‘সময় হয়ে আসছে। আমি বুঝতে পারছি। এবার যাব।’
‘কী যা তা বলছ? আমি ৬৫। যাওয়ার কথা ভাবছি না। ভাবছি বিদেশ ভ্রমণে যাব। ফ্ল্যাটটাকে নতুন করে সাজাব আর তুমি ৫৫-তে যাই যাই করছ? তুমি কি শীতের রোদ্দুর নাকি?’
‘না গো? ভেতর থেকে কে যেন বলছে, এখানকার সব কাজ তোমার হয়ে গেছে। তুমি একজনের মেয়ে হয়ে জন্মেছিলে, তারপর কৃশানুর স্ত্রী হলে, তারপর তিতলির মা হলে, এখন কৌনিশের দিদা। আর তো কোনো পর্বে অভিনয় করা বাকি নেই তোমার। এবার চলো অসীম আনন্দলোকে।’
‘মানে? এই অসীম আনন্দলোকটা কী?’
‘এই জীবনের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা আর সামান্য আনন্দের পর্ব শেষ। এবার অন্য এক জীবন। এই গ্রহ ছেড়ে অসীম আনন্দলোকে যাত্রা। সেখানে শুধু আনন্দ, আনন্দ আর আনন্দ।’ সেদিন ঋতুর চোখেমুখে খুশির নৌকো পাল তুলেছিল।
আমি ঋতুর দিকে তাকাই। ফুল এসে গেছে। চন্দন ঘষা হচ্ছে। খুব করে সাজাচ্ছে বোনেরা দিদিকে। চন্দনে ফুলে ঋতুর মুখটা বড্ড উজ্জ্বল। মনে হচ্ছে মুখে একরাশ হাসি, শীতের রোদ্দুরের মতো ঝলমল করছে। তাহলে সত্যিই ঋতু অসীম আনন্দলোকে পৌঁছে গেল? আমার আগে?
চিরটা কাল আমি এগিয়ে গেছি। ঋতু পেছনে পড়ে থাকত। বলত, ‘আমাকে ফেলে তুমি এগিয়ে যাও কেন কৃশানু?’
‘তুমি আমার সঙ্গে সমানতালে হাঁটতে পারো না কেন ঋতু?’
‘আমি মেয়ে, তুমি পুরুষ। তোমার সঙ্গে পারব কেন? তবে কথা দিচ্ছি, একদিন দেখবে, আমি তোমার আগে চলে গেছি।’
আমি জোর দিয়ে বলতাম, ‘কোনো দিন তুমি পারবে না আমাকে পেছনে ফেলে আগে চলে যেতে।’
‘কথা দিচ্ছি, দেখবে একদিন।’
সেই দিনটা আজ। ওরা ঋতুকে নিচে নামিয়ে নিয়ে গেছে। এতক্ষণে কাচের গাড়িতে ঋতু উঠে গেছে। আমি শূন্য ঘরে দাঁড়িয়ে আছি। বিয়ের পর তোলা আমাদের যৌথ ছবিটা আমার চোখের সামনে। মাথায় সিঁদুর নিয়ে ঋতু হাসছে। যেন বলছে, ‘কৃশানু আমি কিন্তু কথা রেখেছি।’
‘জামাইবাবু নিচে আসুন। গাড়ি ছাড়বে যে।’ সমাপ্তি ডাক দিলো। আমি নিচে গিয়ে অবাক। সামনের উজ্জ্বল সংঘ ক্লাবের কয়েকটা ছেলে একটা ফুলের তোড়া ঋতুর পায়ের কাছে রাখল। ধূপ জ্বালাল। প্রণাম করল।
কী ব্যাপার ক্লাবের ছেলেরা ঋতুকে কেন শেষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছে!
শ্মশান থেকে ফিরে জানতে পারলাম, ওই ক্লাবের একটি ছেলের কাছ থেকে জানতে পারলাম, ওদের ক্লাবে প্রতিবছরের বস্ত্রদান, কম্বলদান, রক্তদান অনুষ্ঠানের জন্য ডোনেশন দিত ঋতু। স্কুলের সহকর্মীদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে দিত। বোনদের কাছ থেকে অনুদান এনে দিত। কোনোদিন বলেনি এসব আমাকে। কাজটা করেছে নিঃশব্দে।

সত্যিই আমি কোনোদিন ভাবিনি, আমার আগে ঋতু চলে যাবে। অসীম আনন্দলোকের ডাকে ঋতু চলে গেছে। সেটা বড় কথা নয়। যাওয়াটাকে যে এত উজ্জ্বল আর মহার্ঘ্য করে যেতে পেরেছে, এটা কয়জনে পারে?
আমি কি পারব?