আনন্দ বাগচী : ‘শেষ ইস্টিশান ছুঁয়ে যায়’

সৌভিক রেজা

আনন্দ বাগচী (১৯৩৩-২০১২); বিস্মৃতিতে তলিয়ে-যাওয়া একজন কবির নাম। অথচ নিজের যৌবনের শুরুতে যিনি ছিলেন পঞ্চাশের দশকের উজ্জ্বলতম কবিদের একজন। কবি-সম্পাদক সুশীল রায়ের (১৯১৫-৮৫) ভাষায় : ‘স্বগত-সন্ধ্যা যখন বের হয় তখন আনন্দ বাগচী অসাধারণ খ্যাতি লাভ করেছিলেন। যে-কোনো সাহিত্যসভায় বা কবিসম্মেলনে যে-নাম নিয়ে সব-প্রথম এবং সবচেয়ে বেশি আলোচনা হত।’ আর যে-কৃত্তিবাস (১৯৫৩) পত্রিকা, যা কিনা সে-সময়ে তরুণ কবিদের আত্মপ্রকাশের প্রধান আশ্রয় হয়ে-উঠতে পেরেছিল, সেই পত্রিকার সঙ্গেও ছিল আনন্দ বাগচীর যুক্ততা। হয়তো তেমন নিবিড় নয়, কিন্তু সংযোগটা ছিল তো! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জানিয়েছেন :
১৯৫৩ সালের বর্ষাকালে (শ্রাবণ ১৩৬০) প্রকাশিত হয় প্রথম সংখ্যা কৃত্তিবাস। আমি তখন থার্ড ইয়ারের ছাত্র, বয়েস উনিশ। কারাবাসের কারণে দুটি বছর নষ্ট হওয়ায় দীপক (দীপক মজুমদার) পড়ে ফার্স্ট ইয়ারে স্কটিশ চার্চ কলেজে; তাঁর সহপাঠী আনন্দ বাগচী, যাঁর কবিতা তখন সমস্ত পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়। ও-রকম খ্যাতিমান একজনকে সম্পাদকমণ্ডলীতে নিয়ে আমরা পত্রিকার গৌরব বৃদ্ধি করতে চেয়েছিলাম।
অবশ্য সুনীল সেইসঙ্গে এ-ও জানাতে ভোলেননি যে প্রথম তিনটি সংখ্যা প্রকাশের পরই দীপক মজুমদার যেমন কৃত্তিবাস থেকে সরে যান, তেমনি আনন্দ বাগচীকেও ‘পত্রিকা প্রকাশের বাস্তব দিকে বিশেষ পাওয়া যায় নি।’
দীপক মজুমদারের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও বন্ধুত্বের ইতিবৃত্ত জানাতে গিয়ে আনন্দ বাগচী তাঁর একটি ব্যক্তিগত-স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন :
স্কুলের গণ্ডী ছাড়িয়ে… কলেজে ঢুকেছি… কয়েকদিনের মধ্যেই আবিষ্কার করলাম বাংলার ক্লাসে আমার পাশে বসা ছেলেটি এক ডাকসাইটে কবি, বাংলা দেশের তা-বড় তা-বড় জ্ঞানী গুণী মানুষের কাছে তার ঘনিষ্ঠ যাতায়াত।… প্রায় সন্ধি স্থাপনের ভঙ্গিতে বন্ধুত্ব করে ফেললাম। এই বিচিত্র চরিত্রের ব্যক্তিটির নাম দীপক মজুমদার।
তারপর তো সেই দীপক মজুমদারের মাধ্যমেই সুনীলের সঙ্গে আনন্দের পরিচয়। যার কথা সুনীলও আমাদের তাঁর বিভিন্ন স্মৃতিচারণমূলক লেখায় জানিয়েছেন।
আনন্দ বাগচী লিখেছিলেন, তাঁদের ‘তিন মাথা এক হয়ে ‘কৃত্তিবাস’ বেরোনোর সঙ্গে-সঙ্গে ‘কবি হিসেবে আমারও একাকীত্বের দিন শেষ হল।’ শুধু এইটুকুতেই কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেষ করেননি আনন্দ বাগচী; বলেছিলেন, তাঁর কাছে :
‘কৃত্তিবাস’ মানেই আড্ডা, প্রমাণ সাইজের আড্ডা। সাহিত্যের সেই আড্ডাখানায় প্রায় মিছিল করে কবিরা এল। শরৎ-শক্তি-উৎপল-মোহিত-শিবু আর ফণিভূষণ। এবং তারপর আরও অনেকে। কলকাতার উত্তর-দক্ষিণ এক হয়ে গেল।…  আমাদের নিজেদের কাগজে এমন প্রকাণ্ড কাণ্ড ঘটে যাবে ভাবতে পারিনি।
পরবর্তীকালে কৃত্তিবাস থেকে তিনি কাগজে-কলমে সরে এলেও কৃত্তিবাসের কবিদের সঙ্গে যে তাঁর ‘বন্ধুত্ব ছিন্ন হয়নি’ –  সে-কথাও অকপটে বলেছিলেন।

দুই
এই ‘কৃত্তিবাস-প্রকাশনী’ থেকেই আনন্দ বাগচীর প্রথম কবিতার বই স্বগতসন্ধ্যা প্রকাশিত হয় ১৩৬০ বঙ্গাব্দে। বইটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন বুদ্ধদেব বসুকে। কেন, বুদ্ধদেব বসু কেন? আনন্দ বাগচীর ভাষায় : ‘কবিতা’ সম্পাদক আমাকে কৌলিন্য দিয়েছিলেন।’ এ-কথা তো সত্যিই। কেননা, আনন্দের ‘ভোগবতী’ বা ‘জলসিঁড়ি’র মতোন লেখা কবিতা পত্রিকাতেই প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। কী ছিল সেইসব কবিতায়?
ক.
পাণ্ডুর জ্যোৎস্নার খিল দরজায় কান্নাক্লান্ত হাতে
তুলে দিয়ে, দেয়ালের রঙছুট ছবিটার নিচে
শিথিল প্রণাম সেরে বিছানায় শূন্য শেষ রাতে
যে মেয়েটি শুতে গেল, সমাজ সংসার তার মিছে।
(‘ভোগবতী’)
খ.
জল-শাড়ি-পরা এমন সুরেলা সকাল বেলায়
কাকে একাঘরে ভালোবাসি, মন?
মুখোমুখি কার সাথে মাতি বলো বিন্তি খেলায়
নানা হৃদয়ের তাসে উন্মন?
‘কাকে ফাঁকাঘরে ভালোবাসি, মন?
(‘জলসিঁড়ি’)
আবার এ-ও সত্যি যে, বুদ্ধদেব বসু-সম্পাদিত আধুনিক বাংলা কবিতা সংকলনে (প্রথম সংস্করণ ১৯৫৪, পরিবর্ধিত পঞ্চম সংস্করণ ১৯৭৩) শরৎকুমার মুখোপ্যাধায়, শঙ্খ ঘোষ, আলোক সরকার, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ পঞ্চাশের দশকের উল্লেখযোগ্য কবির জায়গা হলেও আনন্দ বাগচীর কোনো কবিতা সেখানে স্থান পায়নি। অন্যদিকে, আবার, বুদ্ধদেবের সংকলনে জায়গা না-পেলেও বিষ্ণু দে-সম্পাদিত একালের কবিতায় (১৯৬৩) ওঁর ‘সহজিয়া’কে যেন সহজেই পাওয়া যায়। সেই সহজিয়ার স্বরূপটা কেমন ছিল? –
সমস্তটাই আমার শরীর এই যে কাঁপে থিরথিরিয়ে জল,
এই যে কাঁপে চোখের পাতা, লুব্ধ ঠোঁটে ছায়া,
বুকের কাছে টাল-খাওয়া রোদ্দুরে
শঙ্খিনী মন ফনার নিচে ঘুমোয়,
সমস্তটাই আমার শরীর, আমার।
এই কবিতাটি আনন্দ বাগচীর দ্বিতীয় কাব্য তেপান্তরে (আর্ট ইউনিয়ন, ১৩৬৬) পাওয়া যাবে। সংকলনের প্রসঙ্গ যখন উঠছেই, তখন আবু সয়ীদ আইয়ুব-সম্পাদিত পঁচিশ বছরের প্রেমের কবিতার (সিগনেট, ১৩৬৩) কথাও তো বলা দরকার।  ‘জলসিঁড়ি’ ও ‘কাকতালীয়’ – আনন্দ বাগচীর এই দুটি কবিতা তাঁর এই সংকলনে নিয়েছিলেন আইয়ুব। এইখানে শুধু এইটুকু বলে রাখি – আবু সয়ীদ আইয়ুবের সংকলনটিতে শঙ্খ ঘোষ (‘দিনগুলি রাতগুলি : ৮ জানুয়ারি রাত্রি’) কিংবা সুনীল গঙ্গোপ্যাধায়ের (‘তুমি’) মতোন কবিদের একটি মাত্র কবিতাই স্থান পেয়েছিল। আমাদের শামসুর রাহমানেরও দুটি কবিতা (‘মনে-মনে’ ও ‘তার শয্যার পাশে’) স্থান পেলেও তিনি ছিলেন ‘রহমান’ নামে। বিষ্ণু দে-র একালের কবিতায়ও শামসুর রাহমানের ‘পিতা’ কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত হলেও সেখানেও তিনি কিন্তু ‘রহমান’ই রয়ে গিয়েছিলেন। এ-ও তো অন্য-একরকম দুর্ভাগ্য আমাদের।
পঁচিশ বছরের প্রেমের কবিতায় দুটি কবিতা অন্তর্ভুক্ত করে আবু সয়ীদ আইয়ুব যে আনন্দ বাগচীকে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়ে গিয়েছেন – অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে সে-কথাটি জানিয়েছিলেন আনন্দ। এ-ও বলেছিলেন যে, ‘এই ত্র্যহস্পর্শে কবি হিসেবে আমি সে যাত্রা টিকে গেলাম।’
অন্যদিকে আবার, কৃত্তিবাসের সঙ্গে আনন্দ বাগচীর সম্পর্ক ক্রমে-ক্রমে যেমন শিথিল হয়ে এসেছিল, তেমনি সেখানে তাঁর প্রকাশিত কবিতার সংখ্যা ধীরে-ধীরে কমে আসতে থাকে। তারপরেও তো অস্বীকার করা যাবে না যে ‘একটি ব্যক্তিগত পত্র’ বা ‘আত্মবিলাপে’র মতো কবিতা কৃত্তিবাসেই প্রথম ছাপা হয়েছিল :
এ মন-মৃগ-মদে        তা হলে দ্বিধা কেন?
পেয়ালা সাকী-সখী,    আকাশে তুলে ধরো
হৃদয় থরোথরো         আকাশে তুলে ধরো,
তুমি তো মেঘ-মেয়ে,   তোমার দ্বিধা কেন!
তাহলে মুছে দাও         কাজরী-কল্পনা
জীবন জ্যামিতির         সজল জল্পনা।
আপাতদৃষ্টে মনে হতেই পারে বুঝি মোহিতলাল বা নজরুলের অনুকরণ, কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যাবে নিজের স্বাতন্ত্র্যটুকু এই কবিতাটির মধ্যে দিয়ে ঠিকই ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন। এর মূল কারণ এই যে, আনন্দ বাগচীর কবি-প্রতিভা কখনই নি®প্রভ ছিল না। এছাড়া এখানে শাব্দী-ব্যঞ্জনার যে-বৈচিত্র্য, তা কবিতার সৌন্দর্য ক্ষুণœ না-করেও কবির কল্পনাশক্তিকে যেমন বিভাবিত করেছে, তেমনি বিভাসিতও ।

তিন
স্বগতসন্ধ্যা আর তেপান্তরকে বাদ দিয়ে পরবর্তীকালে উজ্জ্বল ছুরির নীচে (আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৭৭), বিস্মরণ (করুণা প্রকাশনী, ১৩৮৯)- এই দুইটি কাব্যগ্রন্থ সম্ভবত প্রকাশিত হয়েছিল আনন্দের। শেষোক্ত কাব্যটি যখন প্রকাশিত হচ্ছে তখনই তিনি কবিতার নতুন প্রজন্মের পাঠকের কাছে বিস্মৃতপ্রায়। সে-বিষয়টি তাঁর নিজের কাছেও পরিস্কার হয়ে উঠেছিল। নতুবা এইভাবে কেন লিখবেন? –
আছি। দিন যাচ্ছে তবু আছি।
সকালের চিনি ছাড়া চায়ের সঙ্গে
পেপার স্যান্ডুইচ।
খবরের কাগজের পাঁচের পাতা…
হেডলাইন টপকে, কলমের ভাঙা
শেষ তলানি
আমিও এখন পঞ্চম পৃষ্ঠায় দ্রষ্টব্য
এই পঞ্চাশোর্ধ্বে।
(‘কেমন আছেন’, বিস্মরণ)
বিস্মরণই আনন্দ বাগচীর শেষ কাব্য – তথ্য হিসেবে এইটি কিন্তু সত্যি নয়। ওঁর শ্রেষ্ঠ কবিতাটির সঙ্গে একই মলাটের ভেতর প্রকাশিত হয়েছিল নতুন কাব্য (নাকি অপ্রকাশিত?) ‘আড়ালে খেলছিল সে’। এই বিষয়টি নিয়ে করুণ-ব্যঙ্গও করেছিলেন তিনি শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায়। বলেছিলেন :
চারখানা মরা বইয়ের মুখ আবার দেখতে পাওয়া যাবে, সেই সঙ্গে একখানা জ্যান্ত বইয়ের। কেমন জ্যান্ত? না, যে কখনো ভূমিষ্ঠই হয়নি। তার নাম ‘আড়ালে খেলছিল সে’, ঠিকই তো, আড়ালেই খেলছিল, ছাপাখানার বাইরে আসেনি।
(শ্রেষ্ঠ কবিতা কবিতা প্রকাশের পরে আনন্দ বাগচীর নতুন আর কোনো কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল কিনা তা বর্তমান আলোচকের জানা নেই।) তবে আনন্দ বাগচী কবিতার জগৎ থেকে যে একরকম স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়েছিলেন, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। এই যে ধীরে-ধীরে কবিতার জগৎ থেকে স্বেচ্ছানির্বাসন নেওয়া – এটা তো নতুন কিছু নয়। সমর সেন ছিলেন, ছিলেন অরুণকুমার সরকার, আমাদের শহীদ কাদরীর কথাও তো বলতে পারি। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এসব স্বেচ্ছানির্বাসনের পেছনে কবিদের ব্যক্তিগত পরাজয়ের, ব্যর্থতার বা দুর্ভাগ্যের কোনো-না-কোনো (এক বা একাধিক) করুণ কাহিনি জড়িয়ে থাকে। সব কবির জীবনেই এরকম ঘটনা কম-বেশি হয়তো ঘটে, কিন্তু, সকলেই  তো আর তেমন-তেমন করে সেসব সামলে নিতে পারেন না। আমাদের মনে হয়েছে যে, আনন্দ বাগচীও পারেননি। তাঁর কবিখ্যাতি যখন তুঙ্গে, সেইসময়কার ব্যক্তিগত বিপন্নতার কথা জানাতে গিয়ে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত গদ্যে বলেছিলেন :
আমার অজ্ঞাতবাস এবং নির্বাসনের পালা শুরু হতে যাচ্ছে এই সময়। প্রেমের দায়ে প্রায় আকণ্ঠ ডুবে আছি তখন। লেখালিখি, বন্ধুবান্ধব, আড্ডা – সামাজিক সব বন্ধনগুলোই আলগা হতে হতে শেষ পর্যন্ত ছিঁড়ে গেছে। এইভাবে প্রায় বছর দুই প্রেম নামক বেকার ভাতায় দিনযাপন প্রাণধারণ করে কলকাতা থেকে আচমকা বিদায় নিলাম।
বোঝাই তো যাচ্ছে জীবন-জীবিকার প্রশ্নে, অন্য আরো অনেকের মতো তাঁকেও হিমশিম খেতে হয়েছে। জীবনের সঙ্গে সাহিত্যের যোগ মেলানো ক্রমশই যেন কঠিন থেকে কঠিনতর হতে শুরু করেছিল। ঠিক এমনই সময় তিনি কলকাতা থেকে বিদায় নিলেন। বলা উচিত কলকাতাকে তাঁকে বিদায় জানাতে হলো :
কলেজের চাকরি নিয়ে চলে গেলাম বাঁকুড়ায়। আমার নাগর-জীবনের পাট চুকিয়ে দূর মফস্বলে, রাতারাতি যেন বদলে গেল আমার জল হাওয়া মাটি আর জীবনযাপনের ছন্দ।
এই ছন্দকে অস্বীকার করার প্রাণপণ চেষ্টা তাঁর মধ্যে ছিল। আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন কলকাতায় ফিরে আসার জন্যে, কিন্তু জীবন-জীবিকার কঠিন থেকে কঠিনতর সেই সংগ্রামের দিনগুলিতে সেটি আর সম্ভব হয়নি। এ-প্রসঙ্গে লিখেছিলেন :
বছর দুই তিন পালাই  পালাই করলাম, কলকাতার জন্যে মন প্রাণ অস্থির, আবাল্যের বন্ধুদের জন্যে ছটফট করছি কিন্তু ভাগ্যের অভিরুচি বোধহয় অন্যরকম। স্থায়ীভাবেই যেন বাঁধা পড়ে গেলাম বাঁকুড়ায়।
বাঁকুড়ার বিখ্যাত ক্রিশ্চান কলেজে অধ্যাপনার কাজে যুক্ত হলেন। প্রায় সতেরো বছর তিনি ছিলেন তাঁর প্রিয় শহর, কবিতার শহর, কলকাতা থেকে দূরে। কতটা দূরে? তিনি নিজেই জবাব দিয়েছিলেন, ‘কলকাতা থেকে মাত্র  একশো চুয়াল্লিশ মাইল দূরে।’ সেইসঙ্গে তাঁর পাঠকদেরকে এটিও স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন যে, এই ‘দুর্গমতার হিসেব মাইল স্টোনে মাপা যাবে না।’
জীবনযাপনের ছন্দ যখন বদলে যায় তখন কবিতার ছন্দও তো বদলে যেতে বাধ্য। আবার কখনো-কখনো জীবনের এই পরিবর্তিত ছন্দ আগ্রাসী ভূমিকায় কবির আত্মপ্রকাশের ছন্দটাকেই বরং গিলে খাবার চেষ্টা করে। আনন্দ বাগচীর ক্ষেত্রে তেমনটিই ঘটেছিল। বেদনাহত হৃদয়ে আশাহত কবি তাঁর এই জীবনযাপনের পরিণতি সম্পর্কে লিখেছিলেন :
প্রাচীন পুঁথির মত ধুলোয় ভরা এই আদিম শহর এবং শহরতলী… শাল পিয়াল মহুয়া সেগুনের পাতা পোড়ানো লু… প্রবল জ্বরের ঘোরের মত এর আসন্ধ্যা দুপুর আমাকে নিঃশব্দে কেড়ে নিল।
এভাবেই ঘটে গেল একজন কবির কাব্যিক-মৃত্যু। কবির অভিপ্রায়, কখনো-কখনো তাঁর নিজেরও অনিচ্ছায় বা অজান্তে, নৈঃশব্দ্যকে আমন্ত্রণ জানায়। এটি হচ্ছে একজন সৃষ্টিশীল মানুষের জন্যে এক মৃত্যুর-অধিক-মৃত্যু। যা মেনে-নেওয়া যায় না আবার এড়ানোও যায় না। আনন্দ বাগচী তাঁর সেইসময়কার কথা জানাতে গিয়ে লিখেছেন :
এই সময়টা আমার জীবনে… এক হিসেবে খোয়াই পর্ব। বাঁকুড়া আমার জীবনে প্রকৃত অর্থেই মল্ল¬ভূমি। দুঃখ-মৃত্যু-সফলতা-বিচ্ছেদ মিলিয়ে কেবল ঘটনার পর ঘটনা, কেবলই ভাঙচুর আর একলা হওয়ার ইতিহাস; উপচে-পড়া সময়ের নিস্তরঙ্গ গুরুভার বহন করে যাওয়া। এই সময়টা বলতে গেলে আমার না-লেখার নৈরাজ্য। যা লিখেছি সে নিতান্তই অনিয়মিত অভ্যাসবশে, বা বাইরের ফরমাসে।
অভ্যাসবশে লেখা বা শুধুই ফরমাসে লেখায় যে প্রাণস্পন্দ থাকে না সেটি আনন্দ বাগচী বুঝবেন না তো কে বুঝবে। কোনো আত্মসচেতন কবিই নিজের ভেতরের এই নৈরাজ্যকে চোখ-বন্ধ করে মেনে নিতে পারেন না। যে-কারণেই তাঁকে লেখা বন্ধ করে দিতে হয়।

চার
এই প্রস্থানপর্বের জীবনেও আনন্দ বাগচী তাঁর সাহিত্যকর্মে একটিমাত্র সোনা ফলিয়েছিলেন। সেটি হচ্ছে স্বকাল পুরুষ নামে কাব্যোপন্যাস-রচনা। এমনিতেই উপন্যাস তিনি বেশ কয়েকটি লিখেছিলেন, কিন্তু কাব্যোপন্যাস ওই একটিমাত্র। ধ্র“পদী প্রকাশন থেকে এটি গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩৭০ বঙ্গাব্দে। তারও আগে সুশীল রায়ের ধ্র“পদী পত্রিকায় কাব্যোপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়েছিল। মূলত সুশীল রায়ের প্ররোচনাতেই এরকম একটি অসম্ভব কাজ সমাপ্ত করতে পেরেছিলেন আনন্দ বাগচী। এ-গ্রন্থের প্রথম সংস্করণে পাঠকদের কাছে ‘কৈফিয়ত’ দিতে গিয়ে আনন্দ বাগচী বলেছিলেন :
বেশ কিছুকাল আগেই উপলব্ধি করেছিলাম, কবিতার কোনো নিরপেক্ষ পাঠক নেই।… সাম্প্রতিককালে এক ধরনের কবিতাবিমুখী মনোভাব বহু গদ্যলোভী পাঠকের মধ্যে গড়ে উঠেছে। আধুনিক কবিতা অর্বাচীন এবং নির্বচনীয়, ভ্রান্তিকর এবং শ্রান্তিকর এবং উদ্ভট – এমন বিদ্রƒপাত্মক লোকশ্র“তি সংক্রামক হয়ে উঠেছে। অথচ কবিতা অব্যয় এবং কবিতা যে ফুরিয়ে যায়নি, তার যে আরো অফুরন্ত অনুশীলনের অবকাশ রয়েছে, এই কথা জানান দেবার ইচ্ছা সেই সময় থেকেই জেগেছিল।… পরে কলকাতা থেকে দূরে চলে গিয়ে স্মৃতিজীবী কলকাতাকে আরো নতুন আভাসে দেখতে পেলাম। গদ্য-উপন্যাসে এদের চিত্রিত করতে গিয়ে মন তৃপ্ত হল না। ব্যক্তিগত বেদনা এবং নিঃসঙ্গতার আবেগ, কবিতা বা গানের চেয়ে আর কিছুতেই ভালো ফোটে না। সেইজন্যেই স্বকালপুরুষ-এর সৃষ্টি।
এই গ্রন্থের একটি দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯২ সালে (প্রকাশক মহাদিগন্ত)। রানীবালা আর নিখিলেশের অমৃতে গরল আর গরলে অমৃতের কাহিনি নিয়েই তো এই স্বকালপুরুষ। আমাদের বাংলা সাহিত্যে এরকম কাব্যোপন্যাস খুব একটা রচিত হয়নি। এমনিতেই তো আমাদের কাব্যোপন্যাসের সংখ্যাও তো তেমন কিছু নয়। দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি যে, আমাদের কবিদের কাছে, এখনো পর্যন্ত, সাহিত্যের এই-ধারাটি প্রায় অপরীক্ষিতই রয়ে গেল।

পাঁচ
শেষ পর্যন্ত অবশ্য বাঁকুড়ার পাট চুকিয়ে দিয়ে তাঁর সেই কলকাতাতেই ফিরে এসেছিলেন আনন্দ বাগচী। কিন্তু ততোদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। সতেরো বছর তো আর কম দীর্ঘ সময় নয়! এ-প্রসঙ্গেই কবি অমিয় চক্রবর্তীর কথা মনে পড়ে। তিনি ওই যে শান্তিনিকেতন ছেড়েছিলেন, আর তেমন করে আগের মতোন ফিরতে তো পারেননি। যদিও আমরা জানি, অবকাশ পেলেই তিনি তাঁর শান্তিনিকেতনে মাঝে-মাঝে ফিরেও এসেছেন। শিবনারায়ণ রায়কে লেখা এক চিঠিতে অমিয় চক্রবর্তী একবার বলেছিলেন :
আমাদের দেশে যাওয়ার সময় এগিয়ে আসছে… মন কিন্তু বিমনা হয়ে গেছে – যে-শান্তিনিকেতনের খুব কাছে ছিলাম তার থেকে দূরে সরে এসেছি। ফিরলেও ঠিক ফেরা হয় না।
এমনও কথা তিনি একবার বলেছিলেন যে, ‘আমি সত্যসত্যই আমার জীবনের শান্তিনিকেতন-পর্ব অতিক্রম করে এসেছি।’
আনন্দ বাগচীর বেলাতেও আমরা এমনটাই দেখতে পেয়েছিলাম। কলকাতায় ফিরে এলেও, মনে হয়েছে, তিনি তাঁর জীবনের কলকাতা-পর্ব যেন অতিক্রম করে ফেলেছিলেন। যে-কারণে শারীরিকভাবে ফিরলেও মনোগত দিক দিয়ে আর ফিরতে পারেননি। সেইসঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে, এই কবির বয়সও তো হয়েছিল। প্রত্যেক সৃষ্টিশীল মানুষেরই একটা নির্দিষ্ট বয়স থাকে; যার পরে, সেই ‘না-শুরুর পর্ব’ থেকে নতুন করে আর কিছুই শুরু-করা যায় না। লুপ্তপ্রায় সংযোগকে নতুন গতিপথে ফিরিয়ে নিয়ে-আসার ব্যর্থতা, কবি আনন্দ বাগচীও, যেন তাঁর সমুচিত বাস্তব-বোধ থেকেই মেনে নিয়েছিলেন :
কলকাতায় ফিরে এসেছি কিন্তু এখনো আমার না-লেখার পর্বই চলেছে। ইতস্তত কিছু খাপছাড়া গদ্যে কলম জ্বালিয়ে রাখলেও মন তৈরী হয়নি এখনও। যতদূর তাকিয়ে আছি কবিতার চিহ্নও নেই।… নতুন বিষয় নতুন মাধ্যম খুঁজছি, পাচ্ছি না, পাবো কিনা তাও জানি না। সেই বয়স সেই আবেগ হারিয়ে গেছে।
উৎপলকুমার বসু যে লিখেছিলেন, ‘তোমার ব্যক্তিগত বসন্তদিনের চটি হারিয়েছ বাদামপাহাড়ে।/ আমার ব্যক্তিগত লিখনভঙ্গিমা আমি হারিয়েছি বাদামপাহাড়ে’ – সেই পরস্পর-স্পর্শিতা যেন আনন্দ বাগচীর ওই স্বীকারোক্তির সূত্রে নতুনতর এক ভিন্নমাত্রা পায়। তারপরেও আমরা দেখতে পাই যে, কবিতা-রচনার নামে ব্যক্তিপুরুষের আত্মানুভূতির নিছক যান্ত্রিক প্রকাশ ও পুনরাবৃত্তি তাঁকে প্রলোভিত করেনি। সেই কারণেই কবির অহংকার নিয়েই তিনি বলতে পেরেছিলেন :
কবিতায় বন্ধ্যাদশা এর আগেও একাধিকবার এসেছে… আবার কোনো নতুন ধ্বনি, নতুন প্রেরণা হয়তো হঠাৎই এসে যাবে… হয়তো আদৌ আসবে না, তবু প্রতিধ্বনি আর নয়। (দেশ, সাহিত্য সংখ্যা, ১৩৮৭)
না, সেই ‘প্রতিধ্বনি’কে তিনি স্বদম্ভে এড়িয়ে গিয়েছিলেন, বলা উচিত, যেতে পেরেছিলেন। সেইসঙ্গে এরকম নমনীয় রূপবন্ধে জীবন-মৃত্যুর সামঞ্জস্যতাকে মেনে নেওয়ার সক্ষমতাও আনন্দ বাগচীর ছিল :
যাওয়া খুব সহজ এখন…
দিনান্তে আয়নার দিকে চেয়ে মনে হয়
সামান্যই পরমায়ু…
চুকিয়ে দিয়েছি সব দাম।
যাওয়া খুব সহজ এখন
চোখের একফোঁটা জলে জমে আছে শেষ বিস্মরণ।
যে-কবি এমনটি বলতে পারেন, ‘আমি আমার চোখ দিয়েই দেখি, আমার মত করেই লিখি। সেই দৃষ্টি ক্ষীণ হতে পারে, সেই লেখা অক্ষম হতে পারে কিন্তু তা একান্তই আমার নিজস্ব’ – কেবল তাঁর পক্ষেই এমন একটি স্বনির্ভর শর্ত দ্বিধাহীনভাবে মেনে-চলা সম্ভব ছিল। কবি আনন্দ বাগচী আমৃত্যু (৯ জুন ২০১২) তাঁর নিজের সেই ব্রত আঁকড়ে ধরেছিলেন।