আবুবকর সিদ্দিক : বহুমুখী প্রতিভার প্রতিভূ

বাংলা সাহিত্যভুবনে আবুবকর সিদ্দিক স্বল্পালোচিত, অথচ বহুমুখী প্রতিভাগুণে সমৃদ্ধ এক বিশেষ সাহিত্যব্যক্তিত্ব। প্রায় সত্তর বছর যাবৎ সাহিত্যচর্চায় তাঁর শ্রম ও সাধনা আমাদের সাহিত্যভুবনকে করেছে সমৃদ্ধ। সমাজজীবনমনস্ক ও আঙ্গিক নিরীক্ষায় কুশলী শিল্পী আবুবকর সিদ্দিকের বর্তমান গ্রন্থসংখ্যা প্রায় অর্ধশতক। সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য তিনি লেখেন না। দীর্ঘ সময়পরিক্রমায় তাঁর গ্রন্থসংখ্যা কারো দৃষ্টিতে অপ্রতুল নয়, গুণগত মানদ-েও তা সাফল্যের শীর্ষবিন্দুস্পর্শী। কখনো স্বচ্ছ এবং জোরালো ভঙ্গিতে, কখনো প্রচ্ছন্নভাবে, কিংবা প্রতীকী-প্রয়োগে গড়ে ওঠে তাঁর সাহিত্যের মৌল বিষয় আর আঙ্গিকে পরিলক্ষিত হয় ভিন্নমাত্রিক অভিজ্ঞতা ও নিরীক্ষার শিল্পিত প্রকাশ। সাহিত্যের সব শাখায় রয়েছে তাঁর স্বচ্ছন্দ ও সফল বিচরণ। তিনি অর্জন করেছেন সব্যসাচী লেখকের দুর্লভ অভিধা।
আবুবকর সিদ্দিক ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ আগস্ট (২ ভাদ্র ১৩৪১) রোববার বাগেরহাট জেলার গোটাপাড়া গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতৃনিবাস একই জেলার বৈটপুর গ্রাম। পিতা মতিয়র রহমান পাটোয়ারী ছিলেন সরকারি চাকুরে, আর গৃহিণী মাতার নাম মতিবিবি। পিতার চাকরিসূত্রে ১৯৩৫ থেকে হুগলি শহরে এবং ১৯৪৩ থেকে তিনি বর্ধমানে বসবাস করেন। বাল্যকাল থেকেই পড়া ও লেখার প্রতি তাঁর প্রবল ঝোঁক পরিলক্ষিত হয়। ১৯৪৬-এ তিনি যখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র, তখন বর্ধমান জেলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক আবদুস সাত্তার-সম্পাদিত বর্ধমানের কথা পত্রিকায় তাঁর প্রথম কবিতা মুদ্রিত হয়। সাতচল্লিশের দেশভাগের পরের বছর তাঁরা স্বদেশে ফিরে আসেন। শিক্ষানুরাগী পিতা আবুবকর সিদ্দিককে বাগেরহাট মাধ্যমিক সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। সেখান থেকে তিনি ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে মাধ্যমিক, বাগেরহাট সরকারি পিসি কলেজ থেকে ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে উচ্চমাধ্যমিক এবং একই কলেজ থেকে ১৯৫৬-তে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। অতঃপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
শিক্ষাজীবন শেষ করার পরপরই শুরু হয় তাঁর শিক্ষকতা পেশা। পর্যায়ক্রমে তিনি চাখার ফজলুল হক কলেজ, দৌলতপুর বিএল কলেজ, কুষ্টিয়া কলেজ, বাগেরহাট পিসি কলেজ এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ৭ জুলাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। এরপর কুইন্স ইউনিভার্সিটি এবং ঢাকার নটর ডেম কলেজে অধ্যাপনারত ছিলেন। তিনি সর্বদা লেখালেখিতে নিমগ্ন ছিলেন। বর্তমানে শারীরিক অসুস্থতার কারণে সে-লেখার গতিও কমে গেছে।
আবুবকর সিদ্দিকের সাহিত্যসৃষ্টি ও শিল্পদৃষ্টি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সাহিত্যামোদী পিতার কর্মসূত্রে তাঁর বাল্যকাল কেটেছে পশ্চিমবঙ্গে আর জন্মভূমি দক্ষিণ বাংলার বাগেরহাটে অতিবাহিত হয়েছে কৈশোর, তারুণ্য ও কর্মজীবনের অনেকটা সময়। দু-দশকের অধিককাল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সুবাদে গোটা উত্তরবঙ্গ অবলোকনশেষে তিনি রাজধানী ঢাকার জনজীবন থেকে পাঠ নেন। বর্তমানে তিনি খুলনায় বসবাস করছেন। দুই বাংলার বাঘা বাঘা সাহিত্যিকের সঙ্গে হার্দিক সম্পর্ক এবং বিশ্বের বড়মাপের বিপুল সাহিত্যপাঠ তাঁর অভিজ্ঞতার পুঁজিকে করেছে অধিক সমৃদ্ধ। তৃণমূল মানুষের গভীরতম তলদেশ থেকে বিত্তবান বিলাসীজীবনের খুঁটিনাটি তাঁর নখদর্পণে। ব্যক্তিজীবনেও তাঁকে বহু ঝড়ঝাপটা পোহাতে হয়েছে। দীর্ঘ এই ব্যক্তিক, আর্থসামাজিক ও রাষ্ট্রিক পরিক্রমা এবং শিল্প-দর্শনের নির্যাস তাঁর সাহিত্যভুবনে প্রতিফলিত হয়।
আধুনিক বাংলা কবিতার মননশীল কবি আবুবকর সিদ্দিকের বর্তমান কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা আঠারোটি : ধবল দুধের স্বরগ্রাম (১৯৬৯), বিনিদ্র কালের ভেলা (১৯৭৬), হে লোকসভ্যতা (১৯৮৪), মানুষ তোমার বিক্ষত দিন (১৯৮৬), হেমন্তের সোনালতা (১৯৮৮), নিজস্ব এই মাতৃভাষায় (১৩৯৭), কালো কালো মেহনতী পাখি (২০০০), কংকালে অলংকার দিয়ো (২০০১), শ্যামল যাযাবর (২০০০), মানব হাড়ের হিম ও বিদ্যুত (২০০২), মনীষাকে ডেকে ডেকে (২০০২), আমার যত রক্তফোঁটা (২০০২), শ্রেষ্ঠ কবিতা (২০০২), কবিতা কোব্রামালা (২০০৫), বৃষ্টির কথা বলি বীজের কথা বলি (২০০৬), এইসব ভ্রƒণশস্য (২০০৭), বাভী (২০০৮), নদীহারা মানুষের কথা (২০০৮) ইত্যাদি এবং ছড়াগ্রন্থ : হট্টমালা (২০০১)। এসব কাব্যরচনার পাশাপাশি তিনি ক্রমাগত নির্মাণ করে চলেছেন অবিনাশী গণসংগীত, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা ও জীবনীগ্রন্থ। সামগ্রিক সাহিত্যভুবনে তাঁর শিল্পমানস অভিন্ন প্রতীয়মান হলেও প্রতিটি শাখাই আবার স্বাতন্ত্র্যম-িত। বস্তুত বিষয়ের ভার ও রচনার ধার মিলেই তাঁর সাহিত্যসম্ভার, যা কালোত্তীর্ণ হওয়ার যোগ্যতাপূর্ণ।
সমকাল পত্রিকায় কবিতা ছাপা হলে আবুবকর সিদ্দিকের পরিশীলিত ও স্বাতন্ত্র্যম-িত কাব্যসৃষ্টি পাঠকের মনোযোগ আকৃষ্ট করে। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ধবল দুধের স্বরগ্রাম। দুধের রং শুভ্র, তাকে পুনরায় বিশেষিত করা হয়েছে ‘ধবল’ সংযুক্ত করে; যা শুদ্ধতার প্রতীক হিসেবে গৃহীত। আর দুধ নানা গুণে গুণান্বিত, জন্মের সূচনালগ্নে জীবনরক্ষার প্রধানতম খাদ্য Ñ অস্তিত্বের উপকরণ। মাতৃদুগ্ধ যেন মাতৃভূমিসম। অপরদিকে ‘স্বরগ্রাম’ও হচ্ছে অস্তিত্বের কথন। তাই ধবল দুধের স্বরগ্রাম শিরোনামের অন্তরে রয়েছে স্বদেশপ্রীতির শিল্পিত প্রকাশ। অর্থাৎ মা-মাটি-মানুষের কাব্যকথায় সমৃদ্ধ ও শিল্পের বাঁধনে ঋদ্ধ ধবল দুধের স্বরগ্রাম।
কাব্যগ্রন্থটির জন্মক্ষণে এদেশের মানুষ পাকিস্তানের দুঃশাসন থেকে মুক্তির জন্যে সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ। এ-লক্ষ্যে কবির চেতনা অধিক সক্রিয় Ñ স্বভাষা, স্বজন ও স্বদেশের জন্য দায়বদ্ধ এবং তারই প্রতিফলনে সমৃদ্ধ বর্তমান গ্রন্থ। দুটি চরণ স্মরণযোগ্য, ‘স্বদেশের নদনদী আমাদের ধমনীতে বয়/ স্বদেশের নীলাকাশে আমাদের শেষ নিঃশ্বাস।’ (‘স্বদেশের নাম’)
বিনিদ্র কালের ভেলা কাব্যগ্রন্থটি দেশ আর মানুষের প্রতি ভালোবাসার মূল থেকে উৎসারিত। হে লোকসভ্যতার প্রধান সুর রাজনৈতিক চেতনা। ষাটের দশকের গণআন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নিবেদিত লাখ লাখ শহীদের রক্তে অর্জিত সাধের স্বাধীনতা চরিত্রহীন রাজনীতির খপ্পরে পড়ে ব্যর্থতার পাল্লা ভারী হয়। দেশপ্রেমিক কবির বিবেককে তা নাড়া দেয়। তিনি জোরালো প্রশ্ন করেন Ñ ‘এ কোন্ দেশ এলো এখন?/ শয়তান নদী জল ছুঁড়ে মুখ বন্ধ করে দ্যায়।/ রী রী রাত বাড়ে, কুক্ষণ বড়ো কুক্ষণ!/ কে কোথায় আছো হে? কী ভাবে বেঁচে আছো?’ (‘অযাত্রা’)
কালো কালো মেহনতী পাখির কবিতাসমূহের বিষয়ও গণআন্দোলন এবং শ্রমজীবী মানুষ। মানুষ তোমার বিক্ষত দিন কাব্যে আবুবকর সিদ্দিক মানবজীবনের প্রেমানুভূতি ব্যক্ত করেন। কবি জানেন প্রেমের সার্থকতা, ব্যর্থতা, মধুরতা ও তিক্ততা নির্ভর করে পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং মানুষের সৃষ্ট সমাজব্যবস্থার ওপর। প্রেমপ্রত্যাশী, শান্তিপ্রিয় মানুষের সুদিন ক্ষতবিক্ষত হয় বৈরী সমাজ ও সময়ের কারণে। সে-পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ তোমার বিক্ষত দিন কাব্যগ্রন্থ যথার্থ ও তাৎপর্যম-িত। হেমন্তের সোনালতা কবিমানসের অনিবার্য জীবনপ্রীতি এবং অমোঘ মৃত্যুভাবনার শিল্পিত রূপায়ণ। কংকালে অলংকার দিয়ো কাব্যগ্রন্থেও একই ভাবনা ও সাফল্য প্রতিফলিত। শেষোক্ত কাব্যগুলোতে আবুবকর সিদ্দিকের মজ্জাগত যাযাবরবৃত্তি, সন্তানপ্রীতি, মাতৃপিতৃভক্তি এবং মাটি-বৃক্ষ-নিসর্গ-জনজীবন কী নিবিড় শিল্পের সুতোয় গ্রথিত।
জন্মভূমির প্রতি কবির শ্রদ্ধা-ভালোবাসা অপরিসীম। তিনি আমার যত রক্তফোঁটা কাব্যগ্রন্থের ‘ডাইনি বুড়ি’ কবিতায় বলেন, ‘আমাকে চিনতে পারছো গো বৈটপুর?/ আমি যে তোমার সেই মাটিমাখা সিদ্দিক।/ নাও গো/ আমার মাথাটা বুকে নিয়ে ঠোঁট ছুয়ে দাও,/ একটুখানি মাটিফোঁটা টিপ দাও চটান কপালে।’ ছড়াকার হিসেবেও তাঁর সাফল্য সুবিদিত। তাঁর একটি মাত্র ছড়াগ্রন্থ হট্টমালা (২০০১)।
আবুবকর সিদ্দিক একই সঙ্গে কবিতা ও গল্প রচনা শুরু করলেও তাঁর গল্পগ্রন্থ প্রকাশে বেশ বিলম্ব ঘটে। প্রকাশিত ছোটগল্পগ্রন্থসমূহ : ভূমিহীন দেশ (১৯৮৫), চরবিনাশকাল (১৯৮৭), মরে বাঁচার স্বাধীনতা (১৯৮৭), কুয়ো থেকে বেরিয়ে (১৯৯৪) এবং ছায়াপ্রধান অঘ্রান (২০০০)। কবিতার মতো তাঁর গল্পসমূহ প্রজ্ঞাদীপ্ত; কখনো প্রচ্ছন্ন, প্রয়োজনে সাহসিক এবং ভিন্নমাত্রিক। চটুল প্রেমের প্রাবল্য নয় Ñ সামগ্রিক ঐতিহ্য, একাত্তরের স্বাধীনতা, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের জনজীবন, শোষণ-নির্যাতন এবং চিরন্তন মানবিক ও হৃদয়বৃত্তিক উপলব্ধির শিল্পরূপই হচ্ছে তাঁর ছোটগল্প। বিষয়ের গুরুত্বে এবং নির্মাণশিল্পের কুশলতায় তাঁর গল্প বোদ্ধাপাঠকের কাছে হয়েছে নন্দিত।
আবুবকর সিদ্দিক মোহমুক্ত ও নিরাসক্ত জীবনদ্রষ্টা। নির্মম কালপুরুষের মতো তিনি বাংলাদেশের শোষিত মানুষের অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনসত্যকে ভূমিহীন দেশের (১৯৮৫) ‘ভূমিহীন দেশ’ গল্পে চিত্রিত করেন। এ-গ্রন্থের নামকরণের নেপথ্যে রয়েছে গল্পকারের অসাধারণ সাহস, আন্তরিকতম বেদনাবোধ, দায়বদ্ধপ্রজ্ঞা এবং নবলব্ধ স্বাধীন দেশের রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক পটভূমির আবেগবর্জিত ইতিহাস। স্বাধীনতা ভোগের অধিকার থেকে দুঃখজনকভাবে বঞ্চিত হয় দেশের অধিকাংশ মানুষ। তাদের পায়ের তলায় বেঁচে থাকার প্রত্যয়পুষ্ট মাটি সরে যায়। স্বাধীনতা-উত্তর সমস্ত সৌভাগ্য ও সম্পদ চিরাচরিত কায়দায় ভোগ করে এক বিশেষ শ্রেণি। লেখকের শৈল্পিক প্রতিবাদ এখানেই এবং তারই ধারাবাহিক প্রকাশ মরে বাঁচার স্বাধীনতা (১৯৮৭) গল্পগ্রন্থ, যা মুক্তিযুদ্ধের শিল্পদলিল হিসেবে
স্বীকৃত। উল্লিখিত গ্রন্থদ্বয়ের নামগল্প ছাড়াও ‘বেলুনওয়ালা’, ‘খালখসা লাল কংকাল’, ‘ভূতপ্যাদানী’, ‘খাদ্য মন্ত্রণালয় কতো দূরে’, ‘চন্দনের ঘূণ’, ‘লাশের নাম নেই’, ‘খতম’, ‘এই সেই জয় বাংলা’, ‘ফজরালি হেঁটে যায়’, ‘রক্তগর্জন’ ও ‘খোঁড়া সমাজ’ গল্পের কোথাও কৃত্রিমতার ফাঁক নেই; নেই অতিরঞ্জনের সস্তা রং। আছে একটি উদ্বেল আশা ঘিরে যোদ্ধাহৃদয়ের অমিত উচ্চারণ আর আশাভঙ্গের গুপ্তক্ষত থেকে ঝরে পড়া ব্যক্তিগত যন্ত্রণা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা নিয়ে এত সৎ, এত খাঁটি গল্প আমাদের কথাসাহিত্যে বিরলপ্রায়। চরবিনাশকাল (১৯৮৭) গল্পগ্রন্থের সাতটি গল্পে রূপক-প্রতীকী ভাষায় মানবজীবনের কিছু অস্তিত্বের প্রসঙ্গ উপস্থাপিত হয়েছে। কিছু আশ্চর্য নর-নারী, তাঁদের সূক্ষ্মানুভূতি, সমাজবিন্যাসের বাঁকাচোরা গ্রন্থিতে তির্যক অস্তিত্বের অনিকেত চেহারা, কখনোবা অমোঘ ফুসলানিতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসা অসহায় মানুষের স্মৃতিতে তপ্ত হয়ে-ওঠা জীবনের স্পন্দন; এসবই সংবেদনশীল ভঙ্গিতে, পরাবাস্তব আর রোমান্টিকতার মাধ্যমে গল্পরূপ দেন আবুবকর সিদ্দিক। স্বল্পায়ু সংসারে বিমূঢ় মানুষের কথাচিত্র চরবিনাশকালে বিধৃত হলেও বস্তুবাদী সিদ্দিককে চিনে নিতে আমাদের কষ্ট হয় না। কুয়ো থেকে বেরিয়ে (১৯৯৪) গল্পগ্রন্থে তাঁর এ-পরিচিতি অধিক সমুজ্জ্বল। যে-কোনো গ-ির ক্ষুদ্রতা ক্লান্ত করে তোলে মনকে। অতিঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মধ্যেও অতলস্পর্শী ফাঁক থাকে। সমাজবন্ধনের
অনেক গ্রন্থিই টোটাফাটা। মুক্তিকামী মানুষ তাই সীমাবদ্ধ বন্ধন ছিঁড়ে-কেটে বেরিয়ে আসতে চায় কুয়ো থেকে সীমাহীন সমুদ্রের পানে। কী অদ্ভুত এই মুক্তিপিপাসার রূপকধর্মী রূপায়ণ। এর ভাষার স্তরে স্তরে প্রতীকের জাদুস্পর্শ। ‘কোথায় যাবেন?’ চলমান এ ধুয়ো যেন নিখিল মানুষের চিরকালীন মুক্তিযাত্রার আর্তিরূপে ধ্বনিত হয়ে উঠেছে গল্পকারের লেখনীশক্তিতে। ছায়াপ্রধান অঘ্রান (২০০০) গল্পসংকলনেও রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র, গ্রামীণজীবন, ধর্মীয় অন্ধত্ব, শোষণ-নির্যাতন গাল্পিকের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা এবং নিজস্ব রচনাশৈলীতে নির্মিত হয়েছে। কান্নাদাসী (২০০৬), হংসভাসীর তীরে (২০০৮), কালাকুম্ভীর (২০০৮), মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত গল্প : মুক্তিলাল অভ্যুদয় (২০০৮), মধুবন্তী (২০০৯) এবং বরীনভূমি-বাদাবন (২০১৭) গ্রন্থের প্রতিটি গল্পই ভিন্নমাত্রিক ও জীবনঘনিষ্ঠ। আবুবকর সিদ্দিকের অভিজ্ঞতা, মেধা, শ্রমসাধনা এসব গল্পে প্রতিফলিত। আঙ্গিকও স্বাতন্ত্র্যম-িত।
আবুবকর সিদ্দিকের উপন্যাসের ভুবনও প্রচলিত ধারায় ভিন্নতর নির্মাণকর্ম Ñ কি বিষয় নির্বাচনে, কি আঙ্গিক পরিকল্পনায়, কি ভাষা প্রয়োগ-প্রকৌশলে। তাঁর প্রকাশিত উপন্যাস চারটি : দক্ষিণবঙ্গের জনজীবন নিয়ে রচিত জলরাক্ষস (১৯৮৫, দ্বি. প্র. ২০০১), উত্তরবঙ্গের খরাপীড়নের ভয়াবহ শিল্পনির্মাণ খরাদাহ (১৯৮৭, দ্বি. প্র. ২০০০), স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনের পটভূমিতে রচিত বারুদপোড়া প্রহর (১৯৯৬) এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের আলেখ্য একাত্তরের হৃদয়ভস্ম (১৯৯৭)। বাংলাদেশে প্রায় প্রতিবছরই প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানে। ঝড়-বৃষ্টি-বন্যায় মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়। এ-নির্যাতনের সঙ্গে যুক্ত হয় সুবিধাবাদী একশ্রেণির মানুষের
স্বার্থ-উদ্ধার অভিযান। রিলিফ পাচার থেকে শুরু করে অসহায় নারীকে প্রলোভনের জালে ফেলে সম্ভোগ করা তাদের নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। রাক্ষুসে জল, ঝড় ও মানুষের হাত থেকে অসংখ্য নিরীহ মানুষ বাঁচতে চায়। এই মরা-বাঁচার এক ভয়ংকর দলিল রচনা করেন আবুবকর সিদ্দিক তাঁর জলরাক্ষস উপন্যাসে। শওকত ওসমানের ভাষায়, ‘তীক্ষè সমাজসচেতন লেখক ক্ষমাহীন চাবুক হেনেছে অবিচার এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে।’ অন্যদিকে খরাপোড়া বরীন এলাকার নিসর্গপট ও মঙ্গাপীড়িত গণজীবনভিত্তিক উপন্যাস খরাদাহ পড়ার পর সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় আবুবকর সিদ্দিককে লিখেছিলেন, ‘একজন লেখক সোনার দোয়াত-কলম কামনা করে। আমি কামনা করব আপনার লোহার দোয়াত-কলম হোক।’ অশ্রুকুমার সিকদার ও অরুণ সেন উপন্যাসটির উচ্চপ্রশংসা করেন। সমরেশ বসু খরাদাহের মূলভূমি বরেন্দ্র অঞ্চল দেখার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে ওঠেন। এসবই উল্লিখিত উপন্যাস এবং ঔপন্যাসিকের সাফল্যের পরিচয়। কেবল বিষয়ের গুরুত্ব ও স্বাতন্ত্র্যে নয়; ভাষার আয়রনি-স্যাটায়ার, রূপক-প্রতীক ও আঞ্চলিক প্রয়োগে অনন্যসাধারণ এ-উপন্যাসদ্বয়। বাংলাদেশের স্বৈরাচার সরকারের রাজনৈতিক সারাৎসার শিল্পায়িত হয়েছে বারুদপোড়া প্রহর উপন্যাসে। এ গলিত-উত্তেজিত প্রহর বলতে গত শতাব্দীর আশির দশক বোঝানো হয়েছে। আর স্বাধীনতাকামী মানুষের হৃদয়ে একাত্তর হচ্ছে এক মহৎ স্মৃতিচিহ্ন, শোষণ-নির্যাতন ও প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ-সংগ্রাম এবং রক্তসাগর পাড়ি দিয়ে বিজয়গাথার ঐতিহাসিক মহাক্ষণ। তবে একাত্তরের পটচিত্র দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধশক্তি রাজাকার-আলবদর পরিণত হয় মুখোশধারী মুক্তিযোদ্ধায়। নির্ভেজাল মুক্তিযোদ্ধার অনেকেই আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক মার খেয়ে ইতরতম জীবনযাপন করেন। হৃদয়ের রক্তধারায় যে-স্বাধীনতার নাম লেখা হয়, তা দলিত-মথিত হলেও ক্রমাগত তার বিপক্ষে প্রতিরোধ-আন্দোলন দানা বাঁধে এবং প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের ইঙ্গিত সূচিত হয়। এ-পটভূমিতে রচিত আবুবকর সিদ্দিকের মহাকাব্যিক শিল্পনিপুণ উপন্যাস একাত্তরের হৃদয়ভস্ম। শেষোক্ত উপন্যাসদুটি সময়ের দাবি ও লেখকের দায় মিটিয়ে হয়েছে কালোত্তীর্ণ এবং নবমাত্রিক শিল্পপ্রকরণে বিশিষ্ট। তাই আবুবকর সিদ্দিক কেবল বাংলাদেশের নন, সমগ্র বাংলা ভাষার এক নন্দিত কথাকোবিদ।
মৌলিক সাহিত্যসৃষ্টির পাশাপাশি আবুবকর সিদ্দিক গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ, নিবন্ধ, জীবনী, স্মৃতিকথা, কলাম ও গণসংগীত রচনায় বিশেষ পারদর্শী। তাঁর প্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থ Ñ কালের কলস্বর (২০০১) ও সাহিত্যের সংগপ্রসংগ (২০০১)। জীবনীগ্রন্থ রমেশচন্দ্র সেন (১৯৯২)। স্মৃতিকথা Ñ সাতদিনের সুলতান (২০০২), প্রীতিময় স্মৃতিময় (২০১০) এবং স্মরণের মুখশ্রী (২০১১)। সাম্প্রতিক প্রজন্মের কাছে তো বটেই, অগ্রজ সাহিত্যানুরাগীদের স্মৃতিতেও রমেশচন্দ্র সেন আজ বিস্মৃতপ্রায়। অথচ তিনি ছিলেন আমৃত্যু বস্তুনিষ্ঠ ও জীবনঘনিষ্ঠ কথাকোবিদ, দক্ষ সাহিত্যসংগঠক, নির্ভীক রাজনীতিক ও মানবপ্রেমিক কবিরাজ। এই বিরল প্রতিভা ও গুণধর ব্যক্তির জীবন ও সাহিত্যকর্ম সযতেœ লিপিবদ্ধ করেন আবুবকর সিদ্দিক তাঁর রমেশচন্দ্র সেন গ্রন্থে। সাহিত্যের সংগপ্রসংগ গ্রন্থ প্রকাশের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আবুবকর সিদ্দিক যে বিনীত সত্য উচ্চারণ করেছেন তা প্রণিধানযোগ্য : ‘আমি তো মূলত প্রবন্ধলেখক নই। লোকে জানে কবিতা-গল্প-উপন্যাস লিখে থাকি। কিন্তু যতটুকু লিখি, তার কয়েকশোগুণ পড়ার অভ্যাস। বলা চলে, ফুলটাইম পাঠক। পড়তে পড়তে নিজস্ব কিছু চিন্তাবিন্দু ঘেমে ওঠে মাথার মধ্যে। তাঁর ওপর আবার গত চার-সাড়ে চার দশক ধরে সাহিত্য পড়ানো পেশা। যাকে বলে নিñিদ্র সাহিত্যচর্চার বাতাবরণে বাস। এরকম অনুকূল আবহে সাহিত্য প্রসঙ্গে কিছু নিবন্ধ স্বভাবস্রোতে বেরিয়ে এসেছে কলম থেকে। এ স্রোত এত মুক্ত যে, বিষয়ের ধারাবাহিকতা নিয়ে কোনো পরিকল্পনার ফুরসত হয়নি। যখন যেমন মেজাজ বা উপলক্ষ এসেছে, লেখাগুলো তেমনি দাঁড়িয়ে গেছে। বিষয়বুদ্ধিবর্জিত আমার এসব প্রবন্ধের বিষয়গত পরমার্থ যদি কিছু থেকে থাকে তো সে একান্তই মুক্তবুদ্ধির স্বেচ্ছাবিহার।’ (‘প্রাসঙ্গিকী’) গ্রন্থের প্রবন্ধসমূহকে আবুবকর সিদ্দিক তিন পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন : ১. বিষয়ভিত্তিক তেরোটি, ২. বিষয় ও লেখককেন্দ্রিক এগারোটি এবং ৩. মহান একুশের প্রবন্ধ তিনটি। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কবিতা, উত্তর-আধুনিকতা, সাহিত্যে হাস্যরস, লোকসাহ্যিত্যচর্চা, অনুবাদসাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধসমূহে প্রাবন্ধিক যথারীতি প্রজ্ঞাদীপ্ত ও স্বকীয়বৈশিষ্ট্যম-িত। খানিকটা হালকা মেজাজের হলেও ‘বইপ্রেমের কিশোরবেলা’ ও ‘বই তুমি জনতার হাতে এসো’ প্রবন্ধদুটি আবুবকর সিদ্দিকের মন-মানসিকতা-সাধনা-কামনার নির্ভেজাল প্রকাশক। কতটা আন্তরিক হলে তিনি বলতে পারেন, ‘পান-বিড়ি-সিগারেট নয়, চা বা অন্য কোন পানীয় নয়, বই-ই আমার জীবনে প্রকৃত অ্যাডিকশনের বা নেশার মতো হয়ে পড়েছে। রাতে বালিশের কাছে বই না থাকলে দম বন্ধ হয়ে আসে। এখনো বই পড়তে পড়তে রাত ফর্সা হয়ে আসে। কোথাও বেড়াতে গেলে সেখানে রাতে বিছানায় বই না পেলে পাগলের মতো অস্থিরতায় আক্রান্ত হই। সারাজীবন জমি নয়, বাড়ি নয়, শুধু বই-ই কিনেছি। এখন রাখার আর জায়গা কুলোয় না ঘরে। জানি না, পরিণামে কী হবে। মনে মনে খুব ইচ্ছা করে, মরার পর মাটি দেওয়ার সময় আমার কবরটা যেন মাপে একটু বড় করে খোঁড়া হয় আর তার মধ্যে আমার বাছাই করা প্রিয় বইগুলো সাজিয়ে দেওয়া হয়।’ (পৃ ৮৫)
আবুবকর সিদ্দিকের গণসংগীত রচনা ও সাধনার নিদর্শন সম্পর্কে সীমিতসংখ্যক মানুষ অবগত। অথচ একান্ত নিভৃতে এবং অন্তর্গত তাগিদে গণমানুষের উন্নয়ন আর জাতীয় জাগরণের জন্য আবাল্য গণসংগীতভুবনে তাঁর বিচরণ ছিল সর্বদা বিদ্যমান। একাত্তরের যুদ্ধে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ থেকে প্রচারিত তাঁর ‘ব্যারিকেড বেয়নেট বেড়াজাল’ জনমনে বিপ্লবের প্রেরণা জুগিয়েছিল। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয় কর্মী ছিলেন। তাই তৎকালীন গণবিরোধী শক্তির হাতে তাঁকে শারীরিকভাবে নির্যাতিত হতে হয়। ‘গণমানুষের গান’ প্রবন্ধে বামপন্থি মতাদর্শে বিশ্বাসী সিদ্দিক বলেন, ‘এ যাবৎ অনেকে আমার গণসংগীতে গণবিমুখ বা দুর্বোধ্য ভাষা ব্যবহারের অনুযোগ করে আসছেন। জবাবে আমি সবিনয়ে জানাতে চাই, আমার লেখা প্রায় দুশো-আড়াইশো গণসংগীতের মধ্যে মাত্র সামান্য কয়েকটি গান সুরারোপিত হয়ে জনতার পাতে পড়তে পেরেছে। তার প্রায়গুলোর ভাষাই বৈদগ্ধ্যদোষে ঈষৎ দুষ্ট। এর বাইরে বহু অপ্রচারিত গান কথার দিক দিয়ে সম্ভবত জনজীবনের কাছাকাছি।’ (পৃ ২৭)
আবুবকর সিদ্দিকের গান জনমানুষ-নির্ভর না হলে তিনি কখনো কবি সামছুদ্দিন কিংবা সাধন সরকারের প্রকৃত মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি প্রদানের লক্ষ্যে আবেদন জানাতেন না; উচ্চারিত হতো না সলিল চৌধুরী, শেখ লুৎফর রহমান এবং হেমাঙ্গ বিশ্বাস প্রসঙ্গ; প্রবন্ধশেষে ঘোষিতও হতো না, ‘জয় হোক শোষিত মানুষের! জয় হোক গণমানুষের শোষণমুক্তির গানের।’ এখানে শ্রদ্ধা ও গর্বের সঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে, তাঁর রুদ্রপদাবলি : গণমানুষের গান (২০০৮) শিরোনামে সমৃদ্ধ সংকলনটির কথা। এর ভূমিকায় কামাল লোহানী যথার্থই বলেন, ‘গণসংগীতের কমরেড কবিয়াল আবুবকর সিদ্দিক : সংগ্রামী সেলাম।’
সাতদিনের সুলতান আবুবকর সিদ্দিকের স্মৃতিকথামূলক একটি মূল্যবান রচনা। স্বনামধন্য এবং স্বকীয়বৈশিষ্ট্যে দীপ্ত চিত্রকর এস এম সুলতানের সঙ্গে তাঁর সাতদিনের সাক্ষাৎ-সান্নিধ্যের স্মৃতিচারণ নিখুঁত বর্ণনায় হয়েছে জীবন্ত। রচনার মধ্যমণিতে আছেন অবশ্যই সুলতান; কিন্তু প্রাসঙ্গিকভাবে এসেছে লেখকমানসে আজীবনলালিত আবহমান বাংলার চিত্র, লোকসংস্কৃতি, গণজীবন, শিক্ষা-রাজনীতি আর মানবতা Ñ যা পাঠকের দৃষ্টিতে ছবির মতো সব ভেসে ওঠে। প্রীতিময় স্মৃতিময় গ্রন্থে বারোজন কবি-সাহিত্যিক সম্পর্কে কবি আবুবকর সিদ্দিকের অন্তরঙ্গ স্মৃতিচারণ বিধৃত হয়েছে। বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বেগম সুফিয়া কামাল, বদরুদ্দীন উমর, হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান, কবি আতাউর রহমান, খালেদা এদিব চৌধুরী, সিকদার আমিনুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও কবি শামসুল ইসলাম সম্পর্কে তথ্যবহুল ও মনোমুগ্ধকর লেখায় সমৃদ্ধ বর্তমান গ্রন্থটি। কবিকে লেখা বিষ্ণু দে-র চিঠিগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
স্মরণের মুখশ্রী গ্রন্থে এগারোজন গুণীব্যক্তির স্মৃতিসান্নিধ্য স্থান পেয়েছে। এঁদের মধ্যে আবুবকর সিদ্দিকের শিক্ষাগুরু কালিদাস মুখোপাধ্যায়, গণসংগীতের অমর রূপকার সাধন সরকার, একুশের চারণকবি শেখ সামছুদ্দিন, কবিসুধাকর বিজয় সরকার প্রমুখ গুণধর ব্যক্তি তথ্যনির্ভর আর সবিশেষ মর্যাদায় উপস্থাপিত হয়েছেন।
আবুবকর সিদ্দিকের মৌলিক ভাবনা ও সৃজনশীল সাহিত্যকর্ম পাঠকদের সর্বদা মুগ্ধ করেছে। সাহিত্যানুরাগী গুণধর ব্যক্তিদের তিনি আন্তরিক দরদে কাছে টেনেছেন Ñ ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছেন, বোদ্ধাপাঠকদের বন্ধু হয়ে উঠেছেন।
বাংলার মানবপ্রকৃতি, তার আর্থসামাজিক এবং সাংস্কৃতিক রূপরূপান্তর দেখা ও জানার অদম্য বাসনায় তিনি সারাবাংলা চষে বেড়িয়েছেন। তাঁর পছন্দের ঝুড়িতে আছে Ñ দুচোখ মেলে নতুন গ্রাম, বিস্তৃত প্রান্তর, শহর, মানুষ ও প্রাচীনবৃক্ষ দেখা; বিভিন্ন নামের ও বিচিত্র স্বাদের মিষ্টি খাওয়া, ঝর্ণাকলম দিয়ে লেখা, গান শোনা, বই পড়া, ক্রিকেট খেলা দেখা এবং সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা।
আবুবকর সিদ্দিক তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, বাংলাদেশ কথাশিল্পী সংসদ পুরস্কার, বঙ্গভাষা সংস্কৃতি প্রসার সমিতি পুরস্কার (কলকাতা), অতন্দ্র সাহিত্য পদক (কলকাতা), খুলনা সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার, বাগেরহাট ফাউন্ডেশন পদক, ঋষিজ পদক, আখতার জাহান রুমা স্মৃতিপদক (খুলনা) এবং বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ স্বর্ণপদকে ভূষিত হন।
আবুবকর সিদ্দিক পঁচাশি বছর বয়স অতিক্রম করছেন। তিনি পারিবারিক নানা সমস্যায় নিমজ্জিত। তাঁর যে-হাত সর্বদা ছিল লেখায় নিমগ্ন, একাত্তরে পশ্চিমা সেনাদের বন্দুক দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত সে-হাত আজ নিথরপ্রায়। না লিখতে পারার কষ্ট তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছে। আমাদের প্রত্যাশা Ñ তিনি শতায়ু হোন, অমরত্ব পাক তাঁর সাহিত্যকর্ম।