আবুল হাসনাত কিংবা মাহমুদ আল জামান

এ কেমন আকাল! এ কোন করোনাকাল! অনাদি অনন্ত অক্সিজেন আমাদের শ্বাসকষ্ট ঘোচাবে না? একটুখানি শ্বাসকষ্ট নিয়েই হাসনাতভাইকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল, তিনি হাসপাতালে থাকতে চাননি, বাসায় ফিরতে চেয়েছেন। বাসায় ফেরা হয়নি; তবে তাঁকে হাসপাতালেও আর যেতে হবে না। তাঁকে যে যেতে হবে না এটাও তো একটা ভালো খবর।

টোয়েন্টি টোয়েন্টির মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত একাধিকবার তিনি অনেককেই বাসা থেকে বেরোতে নিষেধ করেছেন, সাবধানে থাকতে বলেছেন, নিজের যত্ন নিতে বলেছেন। তাঁর চোখের সামনে গত ক-মাসে তাঁর বহু প্রিয়জন বিদায় নিয়েছেন এটা তো কম ধাক্কা নয়, তিনি সয়েছেন। আর কোনো দুঃসংবাদের ভার বইতে পারবেন না বলেই সম্ভবত আগেভাগে নিজের প্রস্থান নিশ্চিত করে নিয়েছেন।

তিনি কড়া নাড়ার শব্দ নিজেই শুনেছেন, কবিরা শুনতেই পারেন :

সঙ্গবিহীন ছিলে দূরে

মৃত্যু কড়া নেড়ে যায় নিঃশব্দে

অথচ হৃদয় ছিল কাছাকাছি

প্রতিটি ধ্বনি শব্দ হয়ে

দুঃসময়ে সংকটে ও বিপন্নতায়

তোমার নাম ধরে ডেকে যাচ্ছে

রংধুন রঙে।

কে নাম ধরে ডাকছেন? এখানে হাসনাত নন, মাহমুদ আল জামান। ১৯৪৫-এর জুলাই মাসের ১৭ তারিখে খান্দানি ঢাকাতেই তাঁর জন্ম, নিজের জীবনের ৭৬তম বর্ষে নভেম্বরের প্রথম দিন সকালবেলাতেই বিদায় নিলেন। যাঁরা তাঁকে জানেন, তাঁরা জানেন, এমন সুজন-সজ্জন কল্যাণকামী দ্বিতীয় কোনো মানুষ আর খুঁজে পাবেন না। তিনি নিন্দা করতে শেখেননি, নিন্দাজ্ঞাপন নেহায়েত যদি অপরিহার্য হয়েই পড়ত যেটুকু করতেন তাও নৈর্ব্যক্তিক ভাষায়।

সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমি এবং আমার ষাটোর্ধ্ব বন্ধুরা লিখতে এবং প্রকাশ করতে শুরু করি। আমাদের সামনে তিনটি দৈনিকের সাহিত্যপাতা, প্রচারের শীর্ষে ইত্তেফাক, তারপর দৈনিক বাংলা এবং তৃতীয় স্থানে সংবাদ। যদি কেবল সাহিত্যপাতা দিয়ে বিচার করি তাহলে সবার শীর্ষে অবশ্যই সংবাদ। ততদিনে আমার ইত্তেফাক ও দৈনিক বাংলার সাহিত্যপাতায় হাতেখড়ি হয়ে গেছে। হায়দার পরিবারের একজন কবি, মাকিদ ভাই-ই আমাকে বললেন, এক পত্রিকাতে লেখা বেশি ছাপা হলে পিঠে সিল পড়ে যাবে, সংবাদেও যাও।

এটুকুই যথেষ্ট। আমার বিদ্যা ও বুদ্ধিতে যতটুকু কুলায় তা খাটিয়ে চতুর্দশ শতকের ইতালির রোমান্টিক কবি ফ্রান্সিকো পেত্রার্ক ও তাঁর কল্প-প্রেমিকা লরাকে নিয়ে একটি নিবন্ধ লিখে পুরনো শহরের বংশাল সড়কের সংবাদ অফিসে গিয়ে একজন কাউকে জিজ্ঞেস করি সাহিত্য সম্পাদক কোনজন। যে-মানুষটির টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম তিনি চোখ তুলেও তাকালেন না। নাম-সাকিন, কিছু জানতে চাইলেন না, বিদ্যের দৌড়ও পরীক্ষা করলেন না। শুধু বললেন, টেবিলে রেখে যান। আমি তারপরও দাঁড়িয়ে, সম্ভবত বিরক্তি থেকেই বললেন, তিন মাসের মধ্যে ছাপা না হলে ধরে নেবেন মনোনীত হয়নি।

যে-সপ্তাহে লেখা দিয়েছি সে-সপ্তাহের সাহিত্যপাতার কাজ নিশ্চয়ই আগে শেষ হয়ে গেছে। কাজেই পরের সপ্তাহ থেকে তিন মাস দেখব, যদি ছাপা না হয়, এদিকে আর আসব না। তাছাড়া এ-পত্রিকায় লেখক সম্মানী কম, নতুনদের রেট নাকি মাত্র তিরিশ টাকা!

কাছাকাছি একটি টেবিল থেকে পর্যাপ্ত চুল ও দাড়িসর্বস্ব ঋষিতুল্য রবীন্দ্রনাথ টাইপের একজন ইশারায় তাঁর কাছে ডাকলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, কী করো?

তাই তো, আমি কী করি? লিখিটিখি আর কি! কিন্তু তাও বলিনি, তবু ভালো লাগল, একটা প্রশ্ন তো অন্তত কেউ জিজ্ঞেস করেছেন। পরে জানতে পারি তিনিই রণেশ দাশগুপ্ত। সপ্তাহে একবার সাহিত্যপাতা উলটাই নিজের নাম দেখার জন্য। নেই। চতুর্থ সপ্তাহে সাহিত্যপাতায় একটি প্রতিক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া পড়তে গিয়ে মনে হলো কোনো এক পাঠক সাহিত্যপাতায় দুজন লেখককে গালমন্দ করেছিলেন, তাঁদের একজনের নাম শাকের চৌধুরী, অন্যজনের লেখা সম্পর্কে সরাসরি মন্তব্য এ-ধরনের লেখা ছাপার কী দরকার? যিনি প্রতিক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তার নাম কায়েস আহমেদ। তিনি দুজনের হয়ে লড়েছেন। দ্বিতীয়জন আমি, যে-সপ্তাহে লেখা দিয়েছি সে-সপ্তাহেই ছাপা হয়েছে, যা যথেষ্ট যুক্তি দিয়ে আমি এড়িয়ে গেছি।

সেই সাহিত্য সম্পাদকের নাম আবুল হাসনাত।

একটা লেখা ছাপা হওয়ার মানে একজন নতুন লেখকের দরজা খুলে যাওয়া। কদিন পরই দাখিল করলাম একটি অনুবাদ, চেক লেখক জান নেরুদার গল্প ‘জারের একটি মাছ’। চেক জেলেরা জাল টানছে, ওঠাতে পারছে না। বিশাল মাছের স্বপ্ন তাদের জাদু করে রাখে। তারা জাল টানছে আর টানছে। শেষ পর্যন্ত যখন ওঠানো গেল, জালের ভেতর  মিলল শ্যাওলাঢাকা একটি লাশ। বুড়ো জেলে বললেন, এটি ‘জারের একটি মাছ’। যাদের গুম করা হচ্ছে, তাদের কেউ কেউ এভাবেই মাছ হয়ে উঠে আসে। আরো কিছুকাল পরে যখন পাবলো নেরুদার আত্মজীবনী এবং আরো কিছু গদ্যরচনা পড়ি, জানতে পারি নেরুদা নামটি তিনি তাঁর কাছ থেকেই নিয়েছেন।

এই লেখাটি ছাপা হওয়ার পরই প্রকৃত অর্থে তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম কথা হলো, তিনি একটি কথাই বললেন, ‘গল্পটা খুব টাচ করে।’

আমি ধরে নিই আমার মতো ‘হাসনাত-ভাগ্য’ নিয়ে আরো অনেকেই জন্মেছেন এবং ভাগ্যের সুফলও পেয়েছেন। সংবাদের সাহিত্যপাতা দিয়ে আবুল হাসনাত আমার প্রজন্মের রুচি তৈরি করে দিয়েছেন। পরবর্তী চল্লিশ বছরে আমরা যেসব ভালো সাহিত্যপাতার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি তার অধিকাংশই আবুল হাসনাতের তৈরি করা সাহিত্যরুচির অনুসরণ।

বিভিন্ন কারণে আমিও লেখালেখি থেকে দূরে সরে যাই, এর মধ্যে তাঁর ফোন পাই, সবিনয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন কালি ও কলমের জন্য সদ্যপ্রয়াত আদ্রে ভজনেসেনস্কির ওপর একটি লেখা ও কয়েকটি কবিতার অনুবাদ চান, আবার শুরু, নতুন সখ্য। সম্ভবত গত আট-দশ বছরে কালি ও কলমে আমিই সবচেয়ে বেশি লিখেছি, কোনো কোনো সংখ্যাতে দুটো, এমনকি কোনো সংখ্যাতে তিনটিও। উপমহাদেশের অনবদ্য শিল্পকলার ম্যাগাজিন শিল্প ও শিল্পীর জন্য আমাকে দিয়েই কয়েকটি প্রচ্ছদকাহিনি লিখিয়েছেন, অমৃতা শেরগিল আর মকবুল ফিদা হুসেন সংখ্যার কথা তো বলতেই হবে। কেবল হাসনাতভাই প্রশ্রয় দিয়েছেন বলেই বাজারে আমার হাজার টাকা দামের চিত্রকলার বই বিশ্বসেরা ৫১ চিত্রশিল্পী উঁকি দিতে পেরেছে। আলোঘর-প্রকাশিত বইটি হাতে আসতেই বহুদূর থেকে হাসনাতভাইয়ের কাছেই প্রথম পৌঁছি, বইটি তাঁকে দিতে পেরে দারুণ আনন্দ পাই।

তিনি চেয়েছেন বলেই তাঁর সবচেয়ে প্রিয় কবি এবং পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি অনূদিত আধুনিক কবি পাবলো নেরুদাকে নিয়ে তাঁর স্ত্রী উরুটিয়া মাতিলদের মাই লাইফ উইথ পাবলো নেরুদা অনুবাদ শেষ করতে পেরেছি এবং বেঙ্গল পাবলিকেশন্স করোনাকালের সূচনাতে পাবলো নেরুদার সঙ্গে আমার জীবন প্রকাশ করেছে।

আবুল হাসনাত গণসাহিত্য নামে যে-সাহিত্য পত্রিকাটি সম্পাদনা করেছেন, তার সমতুল্য একই ধরনের কোনো পত্রিকার নাম আমি জোর গলায় বলতে পারব না। গণসাহিত্য ছিল বলেই আমি রশীদ করীমের মায়ার খেলার অসাধারণ আলোচনাটি স্মরণ রেখেছি, আবুল মোমেনের ‘তরঙ্গিণীর মৃগয়া’ আমাকে দিয়ে তপস্বী তরঙ্গিণী নিয়ে লিখিয়ে নিতে পেরেছে, আল মাহমুদের ‘জলবেশ্যা’র মতো গল্প শিহরণ জাগিয়েছে, শামসুর রাহমানের ‘রবীন্দ্রনাথের গান ও আমার অনুভূতি’ আমাকেও নাড়া দিয়েছে।

এমনকি মাত্র কদিন আগেও কালি ও কলমের সম্পাদক হিসেবে হাসনাতভাই হুকুম দিলেন এবারের নোবেল সাহিত্য পুরস্কারে সম্মানিত লুইস গ্লিককে নিয়ে একটি প্রবন্ধ চাই এবং তাঁর কিছু কবিতার অনুবাদ। আমি সানন্দে তাঁর হুকুম মেনে নিয়েছি। সংখ্যাটি নিশ্চয়ই বেরোবে কিন্তু সদ্য ছাপাখানা থেকে আসা পত্রিকার পাতা এক এক করে তিনি কি আর ওলটাতে পারবেন? এই নিবন্ধের যে শিরোনাম, ঠিক এই কথা লিখেই আমার ঋণটুকু স্বীকার করার জন্য তাঁকে আমার একটি ফিকশন উৎসর্গ করেছি। এ-ধরনের ঋণ তো আর শোধ করার জন্য নয়। স্বীকার করার জন্য।

কিছু দুঃখ কি তিনি পাননি, একাত্তরের এই যোদ্ধাকে যোগ্য মর্যাদা দিয়ে কে কবার ডেকেছেন আর কবার এড়িয়ে গেছেন? আরো কিছু কথা আছে, থাক বাকি।

আবুল হাসনাত ছিলেন সমকালীন বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও চিত্রশিল্পের অন্যতম প্রধান সেবা প্রদানকারী কেয়ারগিভার। তিনি এসবের অভিভাবক সাজার মতো শঠতার আশ্রয় কখনো নেননি। এই দুর্জনবেষ্টিত সমাজে তিনি বাস্তবিকই একজন ভালো মানুষ ছিলেন।

দুই

যে-বই আমার কেনার কথা ছিল না সন-তারিখের বিস্মৃতি দূর করতে একালের ফোন কিছুটা সাহায্য করে। কলরেকর্ডস অনেক কিছু মনে করিয়েও দেয়। মাত্র কদিন আগে অক্টোবরের ৯ তারিখ হাসনাতভাই ‘অহাসনাতসুলভ’ একটি কথা বললেন। বললেন, তিনি আমার জন্য একটি বই রেখেছেন। যেদিন বাসা থেকে বেরোবেন, আমাকে ফোন দেবেন। আমি বইটা নিয়ে আসব। বইটার নাম : হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে। তিনি বললেন, ‘বইটা পড়বেন আর ভালোমন্দ যেমন মনে হয় একটা রিভিউ লিখবেন।’ শেষ কথাটিই ‘অহাসনাতসুলভ’ নিজের বই নিয়ে লেখার কথা তিনি কাউকে বলেছেন, আমার জানা নেই, আমাকে আগে কখনো বলেননি। তিনি যে লেখেন, এ-কথাও যদি কখনো বলতে বাধ্য হন, বলেন, ‘একটু চেষ্টা করি, এমন কিছু নয়।’

সত্তরের দশকের শেষভাগ এবং আশির দশকের শুরুর দিকটাতে বিনে পয়সায় একটি বই পাওয়া যাবে এই লোভেই বিশেষ করে বাংলাদেশ অবজারভার এবং ইত্তেফাকে অনেক বই নিয়ে লিখেছি। তারপর একসময় কাজটা প্রায় একেবারে বন্ধ করে দিই। যখন সায় দিলাম, হাসনাতভাই যে হাত বাড়িয়ে আমাকে একটা বই দিতে পারবেন, সেই সম্ভাবনা যে চিরদিনের মতো ফুরিয়ে গেছে নভেম্বরের প্রথম দিনই।

যে-বইটি আমাকে দিতে চেয়েছেন কিন্তু বৈরী এ-করোনাকালের কারণে দিতে পারেননি সে-বই আমার কাছে থাকবে না, তা তো হয় না। আমি কিনে আনি জার্নিম্যানের প্রকাশনা রফিকুন নবীর প্রচ্ছদে, আবুল হাসনাতের হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে। এই বই কি আমাকে পড়তেই হবে? না পড়লে সমস্যা কী? তিনি তো জিজ্ঞেস করতে পারছেন না। তাছাড়া আমার কেনা এবং মোটেও পাতা না-ওলটানো আরো কিছু বইও তো আছে। থাকুক না আমার কেনা কিন্তু না-পড়া বইয়ের একটি হয়ে। কিন্তু তা হওয়ার নয়, এই বই নিয়েও একসময় লিখব শিরোনাম হবে : ‘আবুল হাসনাতের ঢাকা’।

আমারই সৌভাগ্য তাঁর হাত দিয়ে বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত শেষ বইটি আমারই পাবলো নেরুদার সঙ্গে আমার জীবন। কয়েক বছর আগে মাতিলদে উরুটিয়ার লেখা মাই লাইফ উইথ পাবলো নেরুদার তিন পর্বের এক পর্ব আমি অনুবাদ করি এবং তা একটি ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত হয় এবং তাঁর নজরে পড়ে। তিনি আমাকে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি বাকি অংশটুকুর অনুবাদ শেষ করে আমাকে দিন, বেঙ্গল ছাপবে।’ আমি খানিকটা অনুবাদ করি, খানিকটা এখানে-ওখানে, খানিকটা কালি ও কলমে ছাপা হয়। ২০১৯-এর নভেম্বরে তিনি আলটিমেটাম দেন, ডিসেম্বরের মধ্যেই অনুবাদ শেষ করতে হবে, ২০২০-এর ফেব্রুয়ারির বইমেলাতে প্রকাশিত হবে। ডিসেম্বরেই আমার হাত থেকে হাতে লেখা অনূদিত কিছুটা অংশ হারিয়ে যায়। আমি হাসনাতভাইকে বলি, ‘এবার সম্ভব নয়, ২০২১-এর বইমেলায় বের হোক।’

তিনি বললেন, ‘২০২১ অনেক দূর, আমরা তখন কে কোথায় থাকব কে জানে। তাড়াতাড়ি শেষ করে দিন।’ ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে কাজ শেষ করলাম, শিল্পী ও কবি নির্ঝর নৈঃশব্দ্য বইটির অঙ্গসজ্জা নিয়ে বেশ খাটাখাটনি করলেন। ফেলিসিটা সালার আঁকা একটি পাবলো ও মাতিলদের ছবি নিয়ে একটি প্রচ্ছদ হলো, হাসনাতভাই নাকচ করে দিলেন, বললেন, ‘সহজ প্রচ্ছদ চাই, হাসিমুখ দুজনকে নিয়ে।’ তাই হলো, আমার শ্রমজড়িত যে-কটা বই নিঃসন্দেহে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পাবলো নেরুদার সঙ্গে আমার জীবন। ততদিনে করোনা ভাইরাস পৃথিবীকে ছেয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশও লকডাউনের  ঘোষণা দিতে যাচ্ছে। হাসনাতভাই ফোন করলেন, ‘এক্ষুনি চলে আসুন, পাবলো নেরুদা আমার হাতে।

আমি ছুটে যাই। না বই নয়, ডামি। জিজ্ঞেস করলেন, আমার আর কোনো পরামর্শ আছে কি না?

হাসনাতভাই যেখানে খেটেখুটে বই প্রকাশ করছেন সেখানে আমার পরামর্শ! আমি দু-চার লাইন লিখতে জানি, কিন্তু প্রকাশনার তো কিছু জানি না। হাসনাতভাই লিখতে জানেন, সম্পাদনা করতে জানেন, অপরকে প্রকাশ করতে জানেন।

লকডাউন একেবারে আসন্ন, তারিখও ঘোষণা হয়ে গেছে। হাসনাতভাই ফোন করলেন, বললেন, ‘এবার ডামি নয়, বই এসে গেছে।

আমি আবার ছুটি। নেরুদা ও মাতিলদের হাস্যোজ্জ্বল ছবি প্রচ্ছদে এসেছে।

আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘আমার বন্ধুকে বইটা উৎসর্গ করে ভালো করেছেন, ভীষণ নেরুদাভক্ত।

অনূদিত বইটি প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানকে উৎসর্গ করা।

টাকার অংকে বড় একটি পুরস্কারের নাম বলে বললেন, পাবলো নেরুদার সঙ্গে আমার জীবন অনুবাদ গ্রন্থ হিসেবে তা পেতে পারে।

তিনি আমাকে আরো দুটো অ্যাসাইনমেন্ট দিলেন : চে গুয়েভারার স্ত্রী হিল্ডার লেখা রিমেম্বারিং চে : মাই লাইফ উইথ চে এবং মার্ক শাগালের স্ত্রী বেল্লা শাগালের লেখা ফাস্ট এনকাউন্টার অনুবাদ করতে হবে। তিনি ধারাবাহিকভাবে কালি ও কলমে প্রকাশ করবেন, তারপর বই। এ-ধরনের চারটি বই নিয়ে তিনি একটি দীর্ঘ লেখা তৈরি করছিলেন।

হাসনাতভাই বললেন, সম্ভব হলে নেরুদাকে নিয়ে আরেকটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করুন, নেরুদার প্রিয়জন ও ভক্ত লেখকরা তাঁকে নিয়ে অনেক লিখেছেন, সেগুলো অনুবাদ করুন।

বেঙ্গল থেকেই প্রকাশিত আমার অনূদিত ভাইস চ্যান্সেলর অন্যান্য গল্প বইটির ভাইস চ্যান্সেলর নিয়ে বললেন, ‘একেবারেই আমাদের ভাইস চ্যান্সেলরদের মতো মেরুদণ্ডহীন। এমন একটা চরিত্র নিয়ে উপন্যাস হলে ভালো হতো।’ তাঁর প্রতিষ্ঠানও দুর্যোগের মধ্য দিয়েই এগোচ্ছিল, করোনার দুঃসংবাদগুলো তাঁকে ভীষণ বিচলিত করছিল। একদিন বললেন, ‘ফোন এলে আশংকা হয় খারাপ কোনো খবর নয় তো।

একটা কথা স্বীকার করতেই হবে, তুলনামূলকভাবে তাঁর সঙ্গে কম ঘনিষ্ঠদের একজন আমি তিনি আমাকে যেসব কাজ করতে বলেছেন তা শেষ করতেই পাঁচ বছর লেগে যাওয়ার কথা; যাঁরা ঘনিষ্ঠ তাঁদের যে দায়িত্ব দিয়েছেন সে-সবের বাস্তবায়ন দেখে যেতে হলেও তাঁকে তো আরো এক কুড়ি বছর ভালোভাবে বেঁচে থাকতে হতো।

এ কেমন কথা, হাসনাতভাই চলেই গেলেন।

আবুল হাসনাতকে হারিয়ে দূরপ্রসারী ক্ষতির হিসাব থাক তাৎক্ষণিক কী কী ক্ষতি হলো? বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং শিল্পকলা অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য একটি প্লাটফর্ম হারালো এই ক্ষতিটা পূরণ হওয়ার নয়।

তিমির হননের গান আর ঘণ্টাধ্বনি

অনেকটা সংগত কারণে মাহমুদ আল জামান কবিতার আলোচনায় তেমন উঠে আসেননি। যাঁরা জানতেন, ভালো। কিন্তু আমি কখনো তাঁকে বলতে শুনিনি আমি মাহমুদ আল জামান। তাঁর প্রান্ত থেকে বলতেন, আমি হাসনাত কিংবা আবুল হাসনাত। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কোনো কবির কবিতা নিয়ে লেখার যে সংস্কৃতি তা এখন আর বিরাজ করে না। যেসব আলোচনা কদাচিৎ চোখে পড়ে তার অধিকাংশই ফরমায়েসি কিংবা তুষ্ট করা রচনা, তাতে দেওয়া-নেওয়ার একটা সম্পর্ক লুকোনো থাকে, এতে শিল্পের জন্য বাড়তি কিছু পাতা ছাড়া তেমন কিছু সংযোজিত হয় না।

ইস্টিমার সিটি দিয়ে যায় নামের একটি শিশুতোষ কিশোরতোষ গ্রন্থ দিয়ে আমি প্রথম মাহমুদ আল জামানকে চিনি এবং সবশেষে হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে কিনতে গিয়ে নির্বাচিত কবিতাও কিনি। কবিতার পাতা ওলটাতেও চোখ পড়ে : ‘মুখোশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি রাস্তার চৌমাথায়’। এ তো করোনাকালের কবিতা নয়, বহু বছর আগের। এ তো এন৯৫ মুখোশ নয়, যা নিয়ে এত শোরগোল এ-মুখোশ সৃষ্টির শুরু থেকেই আছে।

তিমির হননের গান আর ঘণ্টাধ্বনি

কোনোদিন শুনব না বলে

মুখোশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি রাস্তার চৌমাথায়।

সাম্যবাদী রাজনীতির সৃষ্টিশীল মানুষের অনেকেই কাস্তে-হাতুড়ি কিংবা লালসূর্য দিয়ে উপসংহার টানবেন বলে আগে থেকেই নিজের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থেকে শিল্পের নিজস্ব গতি ও স্বাধীনতায় বাধা হয়ে দাঁড়ান। মাহমুদ আল জামান সেই রাজনীতি থেকেই উঠে এসেছেন বটে; কিন্তু হাতুড়ি-কাস্তের গায়ের জোর বাড়াবাড়ি কি তাঁর কবিতায় কারো চোখে পড়েছে? খুব সহজভাবে বলতে চাই তিনি শিল্পকে শিল্পের মতো করেই ধারণ করেছেন, লালন করেছেন। ‘উৎসমুখ’ পুরোটাই উদ্ধৃত করছি :

খুলে যাচ্ছে উৎসমুখ, খুলে যাচ্ছে

বন্ধ দরোজা

তুমি কি যাবে, তুমি কি নেবে?

দ্যাখো

তারস্বরে চেঁচাচ্ছে নদীর কাছে

আশা আর নৈরাশ্যে

দুলতে দুলতে একটি মানুষ যাচ্ছে উজানে।

ব্যাকুলতায়

তার কণ্ঠ

অন্তিম ইচ্ছার মত আছড়ে পড়ছে।

কিসের ইচ্ছা?

সন্তানকে বুকে নেবার আর সমুদ্র

দেখবার ইচ্ছাও মরে উঠছে

খুলে যাচ্ছে উৎসমুখ, খুলে যাচ্ছে

বন্ধ দরোজা।

একটি কবিতায় আমি যা কিছু পেতে চাই তার পুরোটাই পাই ‘একটি মৃত্যু’ কবিতায় আছে, আমি ভাবি আবুল হাসনাত কিংবা মাহমুদ আল জামানের মৃত্যুও কি আমার কাছে ‘রাহেলার মৃত্যুর মতো’ নয়!

আমার দুঃখের জন্ম আছে, আমার আনন্দের মৃত্যু আছে!

রাহেলা,

শবাধার কাঁধে নিয়ে যাবো

ছোঁব না তোমার শরীর।

এমন অসাধারণ পঙক্তিমালা একালে খুব বেশি পাবার কথা নয়।

‘শরণার্থী শিবিরে এক কবির সঙ্গে আলাপ’ কবিতাটি যাঁদের পড়া হয়নি তাঁরা যদি উদ্বাস্তু মানুষের যাতনা কিছুটা হলেও বুঝতে চান, একাত্তরের বাংলাদেশের শরণার্থী হোক কি আশির সাবরা-শাতিলা কিংবা কঙ্গো-কিনশাশার, তাঁরা যদি জীবন্ত মাহমুদ দারবিশকে কথোপকথনরত অবস্থায় দেখতে চান, শরণ নিন এই কবির মাহমুদ আল জামান। এমন কিছু কবিতাই একজন কবিকে টিকিয়ে রাখে দশকের পর দশক :

চুয়াত্তরে আল-সাঈদা শরণার্থী শিবিরে কবি

মাহমুদ দারবীশের সঙ্গে

যখন আলাপ

তখনও এখানে ওখানে বোমায়

বিধ্বস্ত, আর ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন ছড়ানো।

দুজন ফিদেল ক্যাস্ত্রোর মতন

তরুণ

মারণাস্ত্র কাঁধে নিয়ে

ঝড় বৃষ্টির জলে

দিগন্ত রেখার দিকে চেয়ে আছে

একাত্তরের যোদ্ধা-কবিও এভাবেই দিগন্তরেখার দিকে চেয়ে থাকতেন একাত্তরের স্বপ্নগুলো দূর থেকে অতিদূরে চলে যাচ্ছে। মাহমুদ আল জামানের মর্ত্যলোক ও কল্পলোকের সবিতা হালদারের সন্ধানে যখন একজন পাঠক তাঁর কবিতায় প্রবেশ করবেন, দেখবেন এ-কালের একজন অন্যতম রোমান্টিক কবিই তাঁকে পথ দেখাচ্ছেন, ওই তো আলেয়া ওই তো সবিতা হালদার।