আমাদের – আমার – সকলের প্রিয় বন্ধু আবুল হাসনাত

প্রিয় বন্ধু, আপনি আজ বন্ধুদের ছেড়ে তো বটেই আত্মার আত্মীয়, পরম বন্ধু, সুহৃদ নাসিমুন আরা হক মিনু এবং মেয়ে, নাতনি, পরিজন, ভাইবোনদের ছেড়ে চলে গেছেন। আমরা যারা আপনাকে কেন্দ্র করে নিজ নিজ প্রয়োজন, আনন্দ-বিনোদন, দুঃখ-বেদনার চাহিদা পূরণ করতাম, আজ তারা হতাশা-কষ্টের মধ্যে আছি।

ষাটের দশকে (১৯৬০) আমার সঙ্গে আপনার বা আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় রাজনীতি, ছাত্র-আন্দোলনের স্বপ্নময় জগৎ ঘিরে গড়ে উঠেছিল। আমাদের বাবা-মায়ের বাড়ি ওয়ারীর লারমিনি স্ট্রিটে ছিল আর আপনার বাবা-মায়ের বাড়ি ছিল যুগীনগর – সেটা প্রায় কাছাকাছি ছিল। মাঝে ফারাক টেনেছিল র‌্যাংকিন স্ট্রিট।

ব্যক্তিগত কত কথাই মনে পড়ছে, হাসনাত। আপনি হঠাৎ একদিন বলে বসলেন, ‘আপনি কি মতিকে পছন্দ করেন না?’ – আকস্মিক এই প্রশ্নের মাথামুণ্ডু বুঝলামই না। এই পছন্দ যে ‘প্রেম’-সৌরভের ইঙ্গিতবহ তা বুঝতে সময় লেগেছিল। আপনারা স্কুলজীবন থেকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।

খুব কষ্ট পেতেন বন্ধুর কষ্ট জেনে। তাই বন্ধু যা মুখ ফুটে জানাতে পারেনি সেই কথা আপনি জানালেন।

আমার বর্তমান প্রয়াত ভাই আব্দুল হালিম ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের গোপন কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম যুবক নেতা। তাঁর পরিচালিত গোপন পার্টির গোপন ছাত্র গ্রুপের অন্যতম দুই সদস্য ছিলেন আপনারা দুই বন্ধু। কবে যে আপনাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কের সঙ্গে জড়িয়ে গেলাম বুঝলাম না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়ছিলাম আমি, মতিউর রহমান স্ট্যাটিসটিক্সের ছাত্র ছিল। আপনি বাংলা বিভাগে ভর্তি হলেন। বাড়িতে সাদামাটা উর্দু-বাংলা মেলানো পুরান ঢাকার চলতি ভাষায় কথা বলতেন। কিন্তু বাইরে চোশত সাহিত্যিক ভাষায় বলতেন।

কবিতা, আর্ট, লেখালেখি, সাহিত্যচর্চা এসবের প্রিয় সঙ্গী ছিলেন আপনি ও মতি। আমিও সম্পৃক্ত হলাম। স্মৃতিময় সময় কাটিয়েছি আপনার আম্মা ও বোনদের সঙ্গে মাঝে মাঝে। মায়ের জন্য আপনার ছিল অসীম শ্রদ্ধা, ভালোবাসা।

আপনার বাবা ছিলেন অতিশয় ভদ্র। যুগীনগরের পরিবেশে আপনার সাহিত্য-শিল্পকলার চর্চা যেভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েও শৈল্পিক রূপ পাচ্ছিল তা সত্যিই বিস্ময়কর। 

নবাবপুর স্কুলে বাংলাদেশের বিখ্যাত শিল্পীবৃন্দ শিক্ষকতা করেছেন। আপনারা সেই শিল্পসাধনার পরিবেশে স্কুলজীবন থেকেই অন্তরঙ্গ বন্ধু।

আমি বর্তমান ছাড়া ভাবতেই পারছি না – তাই অতীতকে বিসর্জন দিয়ে বর্তমানের ক্রিয়া ব্যবহার করছি – হাসছেন তো?

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতার স্মৃতিতে আপনি ভাস্বর হয়ে আছেন। সাহিত্যিক, সংগ্রামী বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আপনি সে-সময় পরিচিত হচ্ছিলেন। আমি শুনতাম নানা সূত্রে। রমেন মিত্র, ইলা মিত্র, রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেনসহ আরো বহু ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আপনি যুক্ত ছিলেন পার্টির দায়িত্বসূত্রে। সেই যে পরিচয় উপাখ্যান শুরু হলো, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সেই সূত্র আপনি সাহিত্যচর্চা-যোগাযোগের মধ্য দিয়ে চিরস্থায়ী করেছেন। কলকাতার সাহিত্যসেবীরা, পত্র-পত্রিকা, বাংলাদেশের সাহিত্যসেবীরা আপনার কথা লিখেছেন। 

এত প্রাপ্তি আপনার জীবিতকালেরই সোনালি ফসল।

শেষ হাসি হেসেছিলেন, শেষ আতিথেয়তা করতে পেরেছিলাম করোনার সতর্কতার মধ্যেই একদিন। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের শিল্প প্রদর্শনী শিল্পী মুর্তজা বশীরের (প্রয়াত) আয়োজনের প্রয়োজনে মতিউর রহমানের সংগ্রহে থাকা শিল্পীর ছবিগুলো বাছাই করে নেওয়ার জন্য উদ্যোগী আবুল খায়ের লিটু, লুভা এবং আপনি এসেছিলেন। আমরা পাঁচজনই মাস্ক পরে হাসিগল্পে দুপুরের বেশ কয়েক ঘণ্টা কাটিয়েছিলাম। আপনি আর লুভা উদ্বেগ জানাচ্ছিলেন আবুল খায়ের লিটুর সাময়িক অসুস্থতার জন্য। চমৎকার শিল্প-সাধনার পরিবেশে আপনি নিঃশব্দে-উৎফুল্ল চিত্তে হাসছিলেন। বারবার আপনাকে খোঁচাচ্ছিলাম, কী হলো? মিনুকে সঙ্গে পেলে ভালোই হতো। কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছিলেন।

ভালো খাওয়া-দাওয়া হলো, চেয়েচিন্তে যা করেন না সেদিন তাই করলেন; চা-কফি চাইলেন। পরে চলে গেলেন সকলেই।

আপনার সঙ্গে আমার সেটাই শেষ দেখা। তবে কথা হয়েছিল একদিন। ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরে’র জন্মদ্বিশত বছরপূর্তিতে কালি ও কলম ম্যাগাজিনে লেখা দিতে বললেন। প্রথম আলোর সাহিত্যপাতায় প্রকাশিত আমার লেখা ‘রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরচন্দ্র’  প্রবন্ধটি ভালো লেগেছে বললেন।

হাসনাতভাই, আমার – আমাদের – সকলের ভেতরে লেখালেখির গুণ থাকুক না থাকুক উৎসাহ দিয়ে সেটার চর্চা উসকে দিতে নীরব উদ্যোগী আপনি।

আজ মনে বড়ই ব্যথা – আপনার, আমাদের, কালি ও কলমের লেখক আপনার গুণগ্রাহী আমার প্রিয় বন্ধু-দিদি উত্তরা চক্রবর্তী করোনা ও কিডনির অসুস্থতায় ইহলোক ত্যাগ করেছেন ৩০ নভেম্বর, ২০২০। আপনাকে আমরা যেদিন হারালাম সেদিনই সকালে উত্তরাদি কলকাতার পত্রিকায় খবর পড়ে জানালেন, ‘ইস, হাসনাতদাদা নেই!’ আপনার সঙ্গে তাঁর সাহিত্যিক-বন্ধনের মাঝখানে আমি ছিলাম। আজ আপনারা দুজনই আকাশের তারা হয়ে গেলেন।

আপনার-আমাদের প্রিয় অধ্যাপক, কালি ও কলমের সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি, সংস্কৃতিসেবী, বাংলাদেশ ও বহির্বিশ্বের অন্যতম প্রথিতযশা আনিসুজ্জামান স্যার আকস্মিক করোনায় আক্রান্ত হয়ে ইহলোক ছেড়ে যাওয়ার ঘটনায় আপনার বিমর্ষ-দুঃখিত-অভিভাবকহারা চেহারাটা মনে পড়ছে। প্রিয় বাবাকে হারিয়েছেন যৌবনে, প্রিয়তম মাকে হারিয়েছেন যৌবন-উত্তর কালে। সেইসব বেদনা আপনাকে আচ্ছাদিত করেছে। আমরা সেইসব বেদনায় পাশে ছিলাম। আপনার সুলিখিত আত্মকথনের মধ্যে সেসব উল্লিখিত আছে। অনেক আবেগমথিত স্মৃতি আমাদের স্মৃতিও জাগিয়েছে।

আপনি আমার ও মতির ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। আপনার সঙ্গে আমার তারুণ্যের-যৌবনের বন্ধুত্ব, ঘনিষ্ঠতা বাইরের বন্ধুবান্ধবের কাছে ছিল অন্যরকম অর্থবহ। মতিউর রহমানের সঙ্গে আমার বিয়ের আমন্ত্রণপত্র আপনি-আমি বিচিত্রা অফিসে সম্পাদককে যখন দিলাম ১৯৭০ সালের ২০ জুন (তারিখটা মনে আছে এখনো) – সম্পাদক বললেন, ‘এ কি, আমি, আমরা তো ভাবতাম হাসনাতই আপনার …।’ হা-হা হাসিতে হাসনাত আপনি বললেন, ‘আড়ালে লুকিয়ে থাকা মতিউর রহমান এখন উদ্ভাসিত হলো।’ আমাদের বিয়েতে (২৬ জুন, ১৯৭০) আপনার ও ছাত্র ইউনিয়নের দলবাঁধা বন্ধু-বান্ধবীদের উপস্থিতি বড়ই আনন্দের ছিল।

আমাদের যৌথজীবনে মতি এবং আমি শিল্পী নিতুন কুন্ডু দাদা এবং তাঁর স্ত্রী বৌদির, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ভাইয়ের-ভাবির এবং সচিত্র সন্ধানীর সম্পাদক মূল ব্যবস্থাপক গাজী শাহাবুদ্দিন ভাই ও বীথি ভাবির সঙ্গে কতই না ঘনিষ্ঠ-আনন্দিত সময় কাটিয়েছি। আপনি প্রতিটি ঘটনার সাক্ষী ছিলেন সশরীরে, সাহিত্য-শিল্প-সাংবাদিকতার সাহচর্যে।

ছাত্র ইউনিয়ন, সংস্কৃতি সংসদ, কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত থেকে, আমার সকলে ষাটের দশক থেকে আজ অবধি (কমিউনিস্ট পার্টির সমাজতান্ত্রিক পরিবর্তনের বাস্তবতা মেনে নিয়ে) চলেছি সুস্থ, গণতান্ত্রিক, মানবিক, সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার সাহিত্য-শিল্প সাধনা, সাংবাদিকতা, লেখালেখি, সাহিত্যচর্চা ইত্যাদির স্রোতধারায়। আপনি সরাসরি ‘ছায়ানট’ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থেকে সংগীতরসিক পরিচয়ে উদ্ভাসিত হয়েছেন। আবুল হাসনাত, কলম তৈরি হচ্ছিল বিদ্যাসাগরের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে, আগে লিখিয়েছেন আপনি আনিসুজ্জামান স্যারের প্রতি ‘শ্রদ্ধা নিবেদন’। আজ আপনার কথা লিখতে আমাদের স্নেহের লুভা বার্তা পাঠিয়ে মনে করিয়ে দিলো। ভাবছি কেন আমার বেঁচে থাকাকালীন স্মৃতিকথা লিখি না, বন্ধুত্বের কাহিনি লিখি না? আপনার প্রতি জানাচ্ছি অকুণ্ঠ প্রীতি ও শুভেচ্ছা। আমাদের স্নেহের বন্ধু নাসিমুন আরা হক মিনুকে জানাচ্ছি সহমর্মিতা। আপনি আছেন, থাকবেন সকলের হৃদয়ে।