মঙ্গল বৃক্ষের ছায়া

‘মাতাল তরণীর মতো দোলে মন/ মনে পড়ে আমারও প্রেম ছিল, ধ্বংসস্তূপের দরজায় কড়া নেড়ে বলেছিল/ মঙ্গল বৃক্ষের নিচে দাঁড়াব হাত ধরাধরি করে …’ – লিখেছেন কবি মাহমুদ আল জামান, আমাদের প্রিয় সুহৃদ। শিষ্ট সৌম্য নম্র মৃদুভাষী সুভদ্র আবুল হাসনাত। হয়তো এখন তিনি মঙ্গল বৃক্ষের নিচে দাঁড়িয়ে।

কিন্তু কাঙ্ক্ষিত এই বৃক্ষের ছায়া কেড়ে নিল আমাদের এই প্রিয়জনকে। নির্বিরোধী নিরহংকারী এই মানুষটির যে বড় প্রয়োজন ছিল আমাদের সমস্যাধূসর আবহে। তাঁর ব্যক্তিত্ব নিষ্ঠা তৎপরতার ওমে সমৃদ্ধ ছিল দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি। বড় অসহায় এই আকস্মিক প্রয়াণ। আরো কিছু কর্মময় সময়ের দক্ষিণা আমাদের দাবি ছিল। অনাকাক্সিক্ষত এই হতাশা শূন্যতায় বিদ্ধ করল। আমরা শোকাভিভূত বেদনাবিদ্ধ। ছড়ানো স্মৃতির টুকরোয় আমাদের দৈনন্দিন তাকেই অনুসরণ করে।

মনে পড়ে বছর-বারো আগের সেই দিন। কবি-গল্পকার সুদর্শন সাহা এবং বাংলাদেশের খ্যাতনামা প্রবন্ধ-লেখক হায়াৎ মামুদের সঙ্গে হাসনাতের প্রথম আগমন … নাকি আবির্ভাব। ঢাকার কাছে অবিভক্ত পুব বাংলায় সুদর্শনের জন্ম এবং প্রাক-কৈশোর। ঢাকার সঙ্গে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা এবং শৈশবের যোগ। বাংলাদেশের অনেকের সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের পরিধি। হায়াৎ মামুদ তাঁর প্রাণের বন্ধু। তখন হায়াতের কলকাতা যাতায়াত প্রতি মাসে নৈমিত্তিক। আমার বাড়িতেই হতো আড্ডার বৈঠক। এই বৈঠকে মৃদুভাষে হাসনাতের কথা অসামান্য হয়ে উঠেছিল দেশের পারিপার্শ্বিক সংস্কৃতিভাবনার চিন্তাবৃত্তে। প্রতিভাত হয়েছিল তাঁর সাহিত্যবোধ ও গভীরতার স্ফুরণ।

এরপর আর ভূমিকার দরকার হয়নি। হাসনাত সরাসরি পৌঁছে যেতেন আমাদের অধিবেশনে। আলোচনা-বিতর্কে কেটে যেত আমাদের দ্বিপ্রহর সন্ধ্যা কখনো প্রায় মধ্যরাত্রি। মুখর হতো বিভিন্ন কবি-গল্পকার-সাংবাদিকের সান্নিধ্য। হয়তো কখনো উপস্থিত থাকতেন হায়াৎ মামুদ, খন্দকার মুনীরুজ্জামান, জ্যোতি দত্ত, মফিদুল হক, সাদ কামালী, পূরবী দেবী, কদাচিৎ আনিসুজ্জামান সাহেব, ফারুখভাই, হ্যারিসউদ্দিন, রমণী দেবনাথ, পার্থশংকর বসু এবং বন্ধু সুদর্শন সাহাসহ এপার বাংলার কবি-লেখক। আড্ডার কেন্দ্র কখনো হোটেল, কখনো বা হায়াৎ মামুদের, হাসনাতের বা ফারুখভাইয়ের বাড়ি। হাসনাত কলকাতায় এলে আমার বাড়িতে আড্ডা ছিল অবধারিত। বিষয় : দেশ, সংস্কৃতি, সাহিত্য, কখনো বা রাজনীতি অথবা একান্তই গেরস্তালি যাপন প্রণালির খুঁটিনাটি। কখনো আবার তাঁরা আসতেন মুগলে অর্থাৎ স্ত্রী খুকুসহ হায়াৎ মামুদ, মিনুকে নিয়ে হাসনাত, রুকিয়াকে নিয়ে মুনীরুজ্জামান, স্ত্রী দীপ্তি এবং কন্যা শ্রীজিতাসহ ফারুখভাই, ভাবিসহ হ্যারিসউদ্দিন। আমিও চাঁদনীকে নিয়ে কয়েকবার গিয়েছি ঢাকার আড্ডায়।

এই নিবিড় সখ্য ক্রমে পারিবারিক আত্মীয়তায় রমণীয় হয়ে ওঠে। আমরা সবাই মিলে এক পরিবার। কখনো কেউ কলকাতায় এলে বা ঢাকায় গেলে সাক্ষাৎ ছাড়া এড়িয়ে যাবার উপায় ছিল না। অবশ্য আমার ঢাকা যাওয়া খুবই অল্প। অদর্শনের অভাব একা হাসনাত পূর্ণ করে দিতেন। প্রয়োজনে ফোনে আলাপচারিতা।

হঠাৎ একটা দিক শূন্য হয়ে গেল। বন্ধুহীন হয়ে উঠছে আমার বাংলাদেশ। যোগাযোগ তো শুধু আড্ডা বা উপস্থিতির ছিল না। নিয়মিত লেখালেখি এবং পাঠচক্রে খোলামেলা মানসিকতার বিনিময়। সবই যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। বিক্ষিপ্ত মন। বিষাদঘন পরিবেশ। একে একে ফারুখভাই, মুনীরুজ্জামান এবং হাসনাত চলে গেলেন। বাংলাদেশের সবুজ ছায়া যেন অন্ধকারে ঢেকে গেল।

মাহমুদ আল জামান তথা আবুল হাসনাতের নির্বাচিত কবিতাসহ ভুবনডাঙার মেঘ ও নধর কালো বেড়াল, কোনো একদিন ভুবনডাঙায়, জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক, সংকলিত এবং সম্পাদিত গ্রন্থ বিষ্ণু দে কবিতায় ও শিল্পে, রবিশংকর মানিক সতীনাথ ও অন্যান্য, আলো ছায়ার যুগলবন্দি গ্রন্থসমূহ আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে। করোনাপ্রবাহের বাধ্যবন্দিত্ব এবং এই শোকাবহ নিঃসঙ্গতায় ফিরে পড়ছি। হাসনাতের ভাবনার গভীরতা অনুধাবনের চেষ্টা করছি নীরব মনস্কতায়। আলোচনা-সমালোচনা বা মূল্যায়নের ধৃষ্টতা নেই আমার। কেবল সেই সুন্দর মানুষটির সঙ্গে একাত্ম হবার প্রয়াস। কোনো দায়িত্ব পালনে তাঁর ফাঁকি ছিল না। পরিশ্রমে অনীহা ছিল না। গভীর একাগ্রতায় কমিউনিস্ট আন্দোলন থেকে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, সাংবাদিকতা, সম্পাদনা, চিত্রশিল্পে অনুরাগ, সমাজ ও সংস্কৃতি ভাবনায় নিবেদিতপ্রাণ। এরই মাঝে নিভৃত চর্চায় আত্মবীক্ষা ও জীবনদর্শনে স্ফুরিত হয়েছে কাব্য ও গদ্যচিন্তা।

এই গুণী মানুষটি বাংলাদেশের বাংলা একাডেমির সম্মানসূচক ফেলোশিপ এবং অগ্রণী ব্যাংক পুরস্কারে অলংকৃত। এই সঙ্গে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নানা সভা-আলোচনা অনুষ্ঠানে, পত্রপত্রিকায় আছে তাঁর মনোজ্ঞ ভাষণ ও সাহিত্যকৃতি। তবু যেন মনে হয় প্রায় পাঁচ-সাতটি পত্রিকা সম্পাদনায় তাঁর উজ্জ্বল অভিনিবেশ আরো কোনো বিশিষ্ট সম্মান প্রাপ্য ছিল।

আমরা যারা তাঁর খুবই কাছের মানুষ ভেবে কাতর হই যে, এই প্রাণঢালা ভালোবাসা, এত আবেগভেজা সান্নিধ্য, এত কাছে থাকা সংস্পর্শের উত্তালে ধন্য, সে কি বেদনাময় স্মৃতিভারে রেখে অকালে ছেড়ে যাওয়ার জন্যে!

আমি নদীর কাছে যাবো

আর মাতৃভাষায়

গান শুনবো। আজ তোমার গানের সুর বড় করুণ, কান্নায় আকুল মনে হয় ভাই হাসনাত। জেনে রাখো ‘মৃত্যু কোনো অন্ধকার নয়’।