আমার বাবার মোট ভাইবোন ছিল আটজন। বড় পিসি বা ফুপু আনোয়ারা। তিনি বিবাহিত জীবনে বাইশ বছর বয়সে মারা যান। বাবা ছিলেন দাদা শেখ মোহম্মদ এহিয়া ও দাদি গুলেজান বেগমের দ্বিতীয় সন্তান। পুত্রসন্তান হিসেবে প্রথম।
আনোয়ারা পিসিকে আমি দেখিনি। অর্থাৎ আমি জন্ম নেওয়ার আগেই তিনি ইহকাল ত্যাগ করেন। বাকি যাঁদের আমি দেখেছি ও জীবন কাটিয়েছি তাঁরা হলেন ফুপু আমিনা খাতুন ও তাঁদের সর্বকনিষ্ঠ ভাই শেখ গোলাম জিলানী। আমার জীবন কেটেছে এই তিনজনকে নিয়ে। যদিও দেশভাগের ফলে আমিনা ফুপুর স্নেহ থেকেও বঞ্চিত হই। একসঙ্গে জীবন কাটিয়েছি শুধু ফনেচাচার সঙ্গে। পরে তাঁর সঙ্গেও ছাড়াছাড়ি হয়। সেটা পরবর্তী সময়ে বয়ান করব।
মামাবাড়ি ঝামটিয়ার প্রভাব ও ইতিহাস আমার জীবনে প্রবলভাবে বিরাজ করছে; কিন্তু পিতৃগৃহের ইতিহাস অতি ক্ষীণ। কারণ একে তো বছরে ন-মাস থাকতাম মাতুলালয়ে আর আমার দশ বছর বয়সে দেশত্যাগ করতে হলো। তা-ও গিয়ে পড়লাম বাংলার শেষ পূর্ব-দক্ষিণ প্রান্ত চট্টগ্রামে। যেখানে আমাদের জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর কেউ ছিল না। ঢাকায় ছিল অনেক নিকটাত্মীয়। যেমন সবচেয়ে কাছের হলো মেজো নানার পরিবার। মেজো নানার পালককন্যা ওলিমননেসার স্বামী গোলাম গওস ছিলেন স্যানিটারি ব্যবসায়ী। বেশ ধনিক ব্যক্তি। দেখতেও ছিলেন খুব সুন্দর। ফর্সা রং। মধ্যম উচ্চতা। আর বাচনভঙ্গিতে ছিল অভিমত প্রকাশ আর মানুষকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা। তাঁর আন্তরিক আচরণ ছিল তাঁর ব্যবসার উন্নতির অন্যতম উপাদান। নবাবপুরে তাঁর স্যানিটারি বিপণি ছিল। খদ্দের প্রায় ছিল বাঁধা। সব ক্রেতাই বিক্রেতার মধুর আচরণে আকৃষ্ট হয়। আর একবার পরিচয় হয়ে গেলে, নিশ্চিন্তে মাল গ্রহণ করে। বিনা বাক্য ব্যয়ে। এই খালুর তিনতলা ভবনটি বেইলি রোডে এখনো সবার দৃষ্টি কাড়ে। যখন এটা হয়েছিল, তখন ছিল সবচেয়ে সুদর্শন গৃহ। দক্ষিণে অর্ধচন্দ্রাকৃতির ব্যালকনি ছিল ছন্দময়। বাড়িটি এখনো টিকে আছে। প্রতিযোগিতায় আধুনিকতার ছাপ নেই বলেই সবার চোখে লাগে।
আমার এই খালা-খালু দুজনই পরলোকে। এমনকি তাঁদের দত্তকপুত্র হোসেনও পরলোকে। হোসেন ছিল আমার এক
মামার চতুর্থ পুত্র। ওরা ভাইবোন মিলে ছিল প্রায় আট-ন’জন। তাই মামা জয়নাল আবেদিন দিতে পেরেছেন। তাঁদের অবস্থা খুব সচ্ছল ছিল না। তাই দান করেছেন। বদলে বেশ কিছু সোনার হার ও অন্যান্য উপঢৌকন দান করেন। এই নিয়ে ঝামটিয়ার দক্ষিণপাড়ায় নানা রকম কানাঘুসো চলে। আমি তখন পিচ্চি। সেই বয়সেও অনেক কথা আমার কানে আসত। আমি আর কী বুঝতাম। তবে এটুকু বুঝতাম যে, পক্ষে-বিপক্ষে মত আছে। কেউ খুশি, কেউ ভিন্নমত : ছেলেকে বিক্রি করে দিলো। আমি ভালোর পক্ষ নিতাম। ধনী ঘরে ভালো সুযোগ পাবে। সম্পত্তিও পাবে। এসব চিন্তা মনে আসত, আবার উবে যেত। আমার এখন মন পড়ে আছে বড় পুকুরের পারে চোরকাঁটা ঘাসের মধ্যে বসে থাকা লালফড়িংয়ের দিকে। ছোট গোল জাল দিয়ে চাপা দিয়ে ধরতে হবে। পার্থিব চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে যেতাম। অবশ্য আমার পৃথিবী তখন ফড়িং ধরা আর কাশমলা গাছে (জিকাগাছ) রঙিন টিপ-পোকা ধরার চিন্তায়। শুনেছিলাম বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী ডারউইন ছোটবেলায় এরকম রঙিন পোকা ধরতেন। একবার দুটো পোকা ধরেছেন। দু-মুঠো ভরা। এমন সময় আরেকটা আরো সুন্দর পোকা দেখেন। কী করবেন? দু-হাত জোড়া। তখন মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত, একটা পোকা মুখে পুরে দেন এবং বাকিটাকে খপ করে ধরে ফেলেন। পাখা মেলার সুযোগ দেননি। এরপরে কী ঘটেছিল তার বর্ণনা আর কোথাও পাইনি। শুধু জানি এই ব্যক্তিটি – বালকটি হয়ে ওঠেন বিবর্তনবাদের স্রষ্টা চার্লস ডারউইন। ইংল্যান্ডের বাসিন্দা।
কোথা থেকে কোথায় চলে এলাম। কী করব। আমার পুরো শৈশবকালজুড়ে ঝামটিয়া ঝামট মেরে গেড়ে বসে আছে।
ঝামটিয়া গ্রামের নাম নিয়ে আমার এক জ্ঞাতিমামা আবদুশ দেইয়ানের সঙ্গে একসময় আলাপ হয়েছিল তাঁর ইস্পাহানি কলোনির সাততলা ফ্ল্যাটে। তিনি বলেছিলেন, একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায় যে, এই নিচু বেনো অঞ্চলে খুব লম্বা লম্বা বেনাঝোপ হতো – যেটা ভালো বাংলায় নলখাগড়া – এই বেনাঘাস এতটা জমাট বেঁধে মাটিতে প্রোথিত থাকত যে, টেনে তোলা যেত না। এই ঝামট মেরে মাটিতে গেঁথে থাকা – এই থেকেই গ্রামের নাম হয়েছে ঝামটিয়া। ঝামটিয়া গ্রামটি এই অঞ্চলের সবচেয়ে ঢালুভূমি। আর প্রতিবছর তিন-চারটে বান হতো। এমনকি বর্ষাকালে ও শরৎকালে খালে যখন জোয়ার আসত, সব মাঠ ছাপিয়ে যেত জোয়ারের জলে। এসব আমার নিজের চোখে দেখা। দশ বছর তো কম সময় নয়। এক দশক বলে কথা। তাছাড়া জীবনের প্রথম দশ বছর একজন মানুষের ব্যক্তিত্বের ভিত্তি গড়ে দেওয়ার সময়।
আমি এখন ভাবি, মৃত্যুর পর আমাকে যদি স্বর্গ অর্পণ করা হয় আমি বলব – হে সৃষ্টিকর্তা, আপনি তো পরম দয়ালু, আমাকে বেহেশতে না দিয়ে আবার ঝামটিয়ায় কোনো এক পরিবারে জন্ম দিন নন্দদুলালের মতো। আপন মা সালেহা ওসমান না হোক মা যশোদার ঘরেই পাঠিয়ে দিন।
স্রষ্টা যখন রহমানুর রহিম, আর্জিটা তো কবুল করতেও পারেন।
তো নিজ পিতৃপরিবারের কথায় ফিরে আসি। এঁরা অষ্টবসুরা কংসের হাতে বধ হয়ে হয়ে তিনজনে ঠেকেন। আগেই বলেছি বাবা শেখ আজিজর রহমান প্রথম পুত্রসন্তান – মাঝে ফুপু আমিনা বেগম। আর সবশেষে শেখ গোলাম জিলানী। এই চাচার সঙ্গে ছেলেবেলার ঘটনা আগে বলেছি। তাঁর সঙ্গে আমার বিচ্ছেদের কারণ ভারতবর্ষ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে তিন খণ্ডে খণ্ডিত হওয়া। ভারত, পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব বাংলা – পরে পূর্ব পাকিস্তান। আমি স্বাধীন ভারতে ছিলাম তিন বছরের মতো। তারপর পূর্ব বাংলা। পরে নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান। আজ যা বাংলাদেশ : ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে।
আমি জন্মের পর আমাদের ঘরে আমিনা ফুপুকে দেখিনি। তাঁর বিয়ে হয় পুবপাড়ায়। গ্রামের একেবারে পুবদিকে বলে পুবপাড়া। এই পাড়া অবশ্য বেশ বর্ধিষ্ণু। সারি দিয়ে পাকা দোতলা ভবন। তারই একটায় আমার পিসি আমিনাদের বসবাস।
ফুপু আমিনা ফর্সা। একহারা চেহারা। কিছুটা শীর্ণ বলতে হবে। তবে তাঁর চোখদুটো ছিল মায়ায় ভরা। মুখে হাসি। আমাকে পেলে ফুপু আদরে আদরে ভরিয়ে দিতেন। যেন সাত রাজার ধন পেয়েছেন। কী যে করবেন, ভেবে পান না।
আমার পিসান বা ফুপার নাম শেখ নজর আলী। নাতি উচ্চতার মানুষ। রং কৃষ্ণ। বেশ গাঁট্টাগোঁট্টা চেহারা। তখন যুদ্ধের কাল – কোনো এক সংস্থায় কাজ করতেন। যাকে বলে বিপর্যয়কালের সেবাদান। তাঁকে আমি যে ক’বার দেখেছি, তাতে মুখটা ভালো করে মনে করতে পারছি না। তবু যেটুকু মনে পড়ে, খুব হাসিখুশি লোক ছিলেন। পরণের খাকি হাফ শার্ট-হাফ প্যান্টের কথা মনে আছে। আমার সঙ্গে কথোপকথনের কোনো স্মৃতি নেই। শুধু মনে আছে, হাসিমাখা অবয়বটুকু। আজ যখন এসব মনে করি, খুব দুঃখ হয় – এত কাছের মানুষগুলোর সঙ্গে জীবন কাটানোর সামান্যতম সুযোগও পাইনি। দেশ ছেড়ে আসতে হয়েছে। স্মৃতির কোঠায় এরা সবাই পেছনে পড়ে আছে। কম মেধাবী ছাত্রের লাস্ট বেঞ্চে বসানোর মতো।
আমিনা পিসির সঙ্গে পরে যখন দেখা হয়, তখন তিনি বার্ধক্যে পৌঁছে গেছেন। ফর্সা রং আরো ফর্সা হয়েছিল। শুধু ছিল দেহের কাঠামোটুকু। সাদা শাড়িতে তাঁকে তখন আমার চোখে খুব আপন আর মোহনীয় মনে হয়েছে। পিঠে হাত বুলিয়ে সে-আদরের শিহরণ এখনো টের পাই।
আমার জন্মের দু-বছর আগে ফুপুর পুত্রসন্তান হয় – নাম শেখ আনসার আলী। ডাকনাম আনসু। আনসুভাইয়ের সঙ্গে আমাদের খেলাধুলা হতো, আমরা যখন বালক বয়সী। তিনি আমাদের ঘরে এলে আমরা খেলার সঙ্গী পেতাম। আমরা তখন সবাই খুব ছোট।
ফুপুর একমাত্র মেয়ে শামসুন্নাহার বেগম। সবাই বেগম বলে ডাকত। এটাই ওর ডাকনাম হয়ে গিয়েছিল। তিনি ছিলেন কালো। আনসুভাইও তাই। দুজনই বাবার রং পেয়েছিল। বেগমকে অবশ্য ছোটবেলায় একটু চওড়া মনে হতো। কিন্তু অনেক বছর পর যখন দেখা হয়, ওকে ফুপুর মতো তেমনি পাতলাই দেখি।
আনসুভাইকে নিয়ে একটা ঘটনা মনে পড়ছে।
আমরা পাড়ার আরো কিছু ছেলেদের নিয়ে রায়মণির ডাঙ্গার পর সমতল জায়গাটায় খেলা করছি। কাঁধে করে কিছুদূর নিতে হবে এই হলো খেলা। আমাদের সঙ্গে ছিল পাড়ার সেকান্দার, কালো, সেকান্দারের ছোট ভাই রহিম। সঙ্গে ছিল আনসুভাই, আমি আর আমার মেজোভাই মুজিবর। ওর বয়স তখন চার-পাঁচ, আমি ছ-সাত … এমনি সব কুঁচেদের খেলা। আনসুভাই আরো দু-বছরের বড়। মুখটা একটু লম্বাটে। আরো কালো রং তো স্থায়ী। আনসুভাইকে কাঁধে নিয়ে সেকান্দার – আমাদের পাড়ার জ্ঞাতি চাস্তভাই – ওর বড়ভাই করিম। ওর মাকে সবাই করিমের মা বলেই ডাকত। উজ্জ্বল শ্যামলা রং। নাকে একটা নাকছাবি। খুবই সুন্দর সুতোলো একটি মুখ। দেখলেই ভালো লেগে যাবে। মানুষটাও খুব মাটির মানুষ। শুধু কণ্ঠটি ছিল তীক্ষ্ন। এই চাচির চার ছেলে। বড় করিমভাই, মেজো সোলেমানভাই, সেজো সেকান্দার আমার সমবয়সী আর ছোট রহিম। এরাই সব আমার খেলার পার্টনার। করিমভাইকে পাওয়া যেত না। ওপরের ক্লাসে পড়ে। স্কুলে চলে যেত। সোলেমানভাই একইভাবে থাকত অনুপস্থিত। পাড়ায় আমার খেলার সাথি ছিল একেবারে হাতেগোনা। এক কথায় নেই বললেই চলে। একমাত্র সঙ্গী সেকান্দার আর কালো।
কালো আমাদের পাড়ার ছেলে নয়। পাশের মুনশিপাড়ার। ওর মা আমাদের পাড়ার মেয়ে। নামটা মনে আসছে না।
কালোর নানা আমার এই অভিজ্ঞতার ঝুলিতে ছিলেন বেশ বড় এক চরিত্র।
আমি যখন দু-তিন মাসের জন্য নিজ বাড়িতে বেড়াতে আসতাম, তখন এই কালোর নানাকে দেখতাম। সে-যুগে মানুষ অত দীর্ঘজীবী হতো না – অর্থাৎ ভাগ্যতাড়িত যারা তাদের কথা বলছি। তাছাড়া তখন অনেক অসুখের ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। আর হলেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর হাতে তা পৌঁছত না। মনে রাখতে হবে কালটা, তখন ঔপনিবেশিক যুগ। কে মরল কে বাঁচল তাতে রাষ্ট্রের কিছু যায়-আসে না। কারণ সম্রাটকে কেউ হঠাৎ পাবে না। এটাই রাজতন্ত্র, যা এখনো ইউরোপের অনেক দেশে চালু আছে। তারা অবশ্য আধুনিক যুগের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শ্রদ্ধা করে। রাজার রাজত্ব হলেও জনগণের দায়িত্ব রাষ্ট্র দেখা। কিন্তু উপনিবেশমুক্ত দেশেও এখনো জনগণকে তেমন সেবা দেওয়া হয় না। শুধু ভোটের আগে দু-মুঠো ভিক্ষা দেয়।
কথায় আছে ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হবে না। এই জনগণ কা-কা রবে সবাইকে জানিয়ে দেবে, অমুক পার্টি টাকা দিচ্ছে। সবাই সেদিকে ছুটবে চোখ বন্ধ করে। ভোটের পরে কিছু পাওয়া যাবে না। নগদ যা পাওয়া যায় নিয়ে নাও। যাকে বলে নগদ নারায়ণ।
কালোর বাবার নাম মনে আছে – ফসি মুনশি। ওরা মুনশিপাড়ার বাসিন্দা। আমাদের মেছোদি মহল্লার প্রতিবেশী।
কালোর নানাকে যখন থেকে দেখছি, তিনি গুঁজো হয়ে চলতেন। হাত-দুটো পেছনদিকে বেঁকে থাকত। আঙুলগুলো দেখা যেত। বেশিরভাগ সময় গায়ে একটা গাঢ় বাদামি রঙের পাঞ্জাবি পরতেন। সেটার রং দেখতাম সব সময় একই রকম। তবে কি কখনো ধুতেন না? সাবান দিয়ে? আমার মনে প্রশ্ন জাগত। পরমুহূর্তে মনে পড়ত, ঘরে যদি সাবান না থাকে? সাবান নেই কেন? এই প্রশ্নের সমাধানে গিয়ে আটকে যেতাম। ভাবতাম, সাবান কিনলেই তো পারেন। সমস্যার সমাধান দিতে পারতাম না।
মনে পড়ে, গ্রামে মাটি লেপে মেয়েরা মুখের তেলতেলে ভাব কাটায়। সাবান তাদের কাছে স্বর্গের পণ্য।
এই সাবানের কথা মনে পড়লেই মনে পড়ে, ঝামটিয়ায় স্নানের সময় বাঁকাদাকে সাবান দিয়েছিলাম তার গামছাটা ধোবে বলে। তারপর মায়ের কাছে প্রচুর রূঢ় বাক্য শুনতে হয়েছিল। অথচ চোখে ভাসে বাঁকাদা এত তাড়াতাড়ি সাবান ঘসছিল যে গামছা মুড়ে যাচ্ছিল। ধোবার পর দেখি পুরো দাগ ওঠেনি। গামছাটা ডোরাকাটা হয়ে গেছে। কোথাও সাদা-কোথাও বাদামি। বাঁকাদার তাড়াহুড়োর ব্যাপারটি বুঝতে অসুবিধে হয় না। তিনি আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন। যাতে কেউ দেখে না ফেলে।
সত্যি বলতে, ওদের কাউকে সামান্য সাহায্য করতে পারলে আমার ভালো লাগত। তখনি আবার মনে পড়ে, কলার থোড় নিয়ে আমি হারানদার মায়ের পিছু পিছু কতদূর দৌড়ে ছিলাম। এখনো লজ্জা পাই সেই কথা ভেবে। জীবনে এমন কাজ করিনি। আমার খুব বড় একটা শিক্ষা হয়েছিল সেই থেকে।
তো কালোর নানা। আমাদের গলি ছাড়িয়ে যখন যেতেন তার বাঁ-হাতের কনিষ্ঠ আঙুলটি দেখতাম প্রায় চামড়াশূন্য। অনেকটা শুকনো হাড়ের মতো দেখা যেত। আমরা ছোটরা বলতাম – পাখির ঠোঁট। মা বকতেন। আবার ফিক করে হেসেও ফেলতেন। অর্থাৎ তার কুঁজো হয়ে যাওয়াটা সবাইকে কৌতুকদান করত।
পাখির ঠোঁট বলে আমরা ভাইরা হাসাহাসি করতাম। এখন বুঝি, ছোটরা কত নির্দয় হয়। খুব ছোটবেলা থেকে না শেখালে ছোটদের মধ্যেও মানবিক বোধ সঞ্চারিত হয় না। এদেশে মানুষের বিপদে তাই আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি না।
আমি যে-সময়ের কথা লিখছি, সেই চল্লিশের দশকে, ফটোগ্রাফ গ্রামের কোথাও পাওয়া যেত না। বাবা একটা আগফা ক্যামেরা কিনেছিলেন। কিন্তু তাতে আমাদের ছবির কোনো হদিস এখন আর পাওয়া যায় না। তাই ফুপু আমিনার অবয়ব আমার মানসে রয়ে গেল। আজ নিজেও মনে করে আঁকব যে, তা আর হয়ে ওঠে না। একমাত্র বর্ণনা দিয়ে সিআইডি যেভাবে পোর্ট্রেট আঁকায়, তেমনভাবে চেষ্টা নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু জীবনধারা এমনভাবে চলতে থাকে যে, মানুষের জীবনের হাজার বাসনা তুলে ধরার সুযোগ থাকে না। তাই আমার আমিনাফুপু আমার মানসেই থাকবেন। কাউকে দেখাতে পারব না। তবে চেষ্টা ছাড়ব না। হয়তো কোনোদিন সফল হবো।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.