আলোর অন্বেষণে

একেকটি মৃত্যু সব মৃত্যুর চেয়ে আলাদা। একেকটি মৃত্যু আমাদের তছনছ করে দেয়। একেকটি মৃত্যু তার অতল সমুদ্র থেকে উঠে এসে জীবনের বিশালতা ও মহত্বকে চিনিয়ে দেয়। একেকটি মৃত্যু আলো ফেলে প্রকৃত মহীরুহের ওপর। একেকটি মৃত্যু আমাদের ভাঙে, গড়ে।

এই রক্ত হিম করা বছরে আমরা অনেক দীর্ঘকায় মানুষকে হারিয়েছি। আমাদের সামনে আলোকস্তম্ভ কমে এসেছে, শূন্যতার ক্লিন্ন ঢেউ ঘিরে ফেলছে আমাদের ভাঙা ঘর। স্বয়ং অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও দেবেশ রায়কে দিয়ে যে-ভাঙনের শুরু।

আবুল হাসনাত কখন যেন হয়ে উঠেছিলেন আমার আপনজন। তিনি যেদিন চলে গেলেন অন্ধকার কালো জল ঢুকে পড়েছিল আমার কংকালে, যার থেকে শত চেষ্টাতেও কিছুতেই মুক্ত হতে পারছি না। পরে এই নভেম্বর মাসেই আরো তিনজন আপনার লোক চলে গেলেন, কিন্তু আবুল হাসনাতের মুখটিই আমার মনে দীপশিখার মতো জ্বলছে।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম যথার্থই লিখেছেন, তিনি যেন ছিলেন হাওয়ার মতো, যখন ছিলেন বোঝা যায়নি, যখন নেই নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কেউ তাঁকে বলেছেন শুদ্ধতম মানুষ। এমন নম্র সজ্জন মানুষ হয়? তিনি সেই বাঙালি যাঁকে আমরা আজ আর সহজে খুঁজে পাই না। সদা সুস্থির, বিদ্বেষহীন, নিচু স্বরে স্বল্প কথা বলা, মঞ্চের পেছন থেকে প্রকৃত সৃজনশীল ভূমিকা পালন করে যাওয়া এ কোন আশ্চর্য সুজন? পথভোলা এক বাউল যিনি সারাজীবন নিঃস্বার্থভাবে শুধু প্রকৃত শিল্পী ও সাহিত্যিক অনুসন্ধান করেছেন। যেন খ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশপাথর। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই খোঁজা অব্যাহত ছিল।

এই বছর প্রকাশিত আত্মজীবনী হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে-তে সেই অনুসন্ধানের বীজমন্ত্র লিখে গেছেন : ‘জীবন প্রবহমান। জীবনের পথে এখনো হেঁটে চলেছি। দেখা যাক চলতে চলতে কোথায় গিয়ে তা শেষ হয়। পথের শেষ কোথায়? তবু আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ।’ ভাবির কাছে শুনেছি হাসপাতালে অমিয় চক্রবর্তীর ‘বিনিময়’ নামক বিখ্যাত কবিতার ‘ঝোড়ো হাওয়া আর পোড়ো বাড়িটাকে মেলাবেন’ পঙক্তিটি আবৃত্তি করেছিলেন তিনি বন্ধুবর তারিক সুজাতের কাছে। সুরের এই কারুবিন্যাস হাসনাতদার চরিত্রের সঙ্গে মেলে। তাঁর সর্বশেষ কবিতা ছিল :

আমার রোদ্দুর ঢেকে যাচ্ছে কালো মেঘে

হায় ছায়াবৃতা দাও, আমাকে দাও সজীব সহজ উজ্জ্বলতা

ঘুম নেই চোখে, তাকিয়ে থাকি

অক্সিজেনের মিটারে।

চোখ বুজে আমি হাসনাতদাকে নানা দৃশ্যপটে ভাবতে চেষ্টা করি। ছাত্র ইউনিয়নের এক লাজুক, সৎ, আন্তরিক কর্মী হিসেবে। অথবা সংবাদ সাময়িকীর দফতরে এক উজ্জ্বল চোখের তরুণ, যিনি নিঃস্বার্থভাবে অক্ষর সাজাতে সাজাতে প্রবীণ হলেন। তাঁর মাথার ওপরে, তাঁর চারপাশে ঝড়। কমিউনিস্ট পার্টির সংগ্রামদৃপ্ত কর্মী। মহান মুক্তিযুদ্ধে কলকাতায় তাঁর নিবিষ্ট কর্মকাণ্ড, যা প্রসারিত করল তাঁর মানবতাকে। গণসাহিত্য পত্রিকার অফিসে। সংবাদের সাহিত্যের পাতার চিন্তাশীল সম্পাদক একদিন কালি ও কলমে আনিসুজ্জামানের স্নেহচ্ছায়ায় তাঁর আপন কর্তব্য পালন করে চলেছেন। তাঁকে দেখছি পাঁচ দশক ধরে তাঁর অতি প্রিয় প্রতিষ্ঠান ‘ছায়ানট’-এ, কথা বলছেন সনজীদা খাতুনের সঙ্গে। খুঁজছেন ছবি ও ভাস্কর্যের রেখাবিভঙ্গ। আর পড়ে চলেছেন বই, রাশি রাশি বই, অনন্ত প্রশ্নের খোঁজে।   

মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় ১৬/১ আমীর আলী অ্যাভিনিউতে পার্টির লিয়াজোঁ অফিসের দায়িত্ব পালন তাঁর গভীর আন্তরিকতার দর্পণ হয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এপারে যে আনন্দিত উত্তেজনার ফল্গুস্রোত বয়েছিল তা তিনি নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। কলকাতায় সেই সময়ের ভালোবাসাময় বিচরণ তাঁর মনে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে বলে আমার মনে হয়। যেন হৃদয়ের একটি অংশ তিনি এখানে রেখে গিয়েছিলেন। তাই তিনি এখানে ঘুরে ঘুরে আসতেন। সকল গুণীজনকে চিনতেন বলে অনায়াসে হয়ে উঠেছিলেন এক সেতুবন্ধ। সীমাবদ্ধতাগুলিও তিনি জানতেন। কালি ও কলমের ষোড়শ বর্ষ একাদশ সংখ্যায় নবনীতা দেব সেনকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে গিয়ে একটি অসাধারণ মূল্যায়ন শেষ করেছেন এই ভাবে : ‘আমিও আত্মীয়-বিয়োগের মতো ব্যথিত হয়েছি তাঁর চলে যাওয়ায়।’ এ তো তাঁর সম্পর্কে আমাদের অনেকের কথা।

আমার মনে হয়, আবুল হাসনাত আসলে ছিলেন এক কবি ও বাউল, এক প্রকৃত শিল্পী, যার দু-চোখে শিশুর আগ্রহ ও বিস্ময়। কাছের মানুষেরা জানেন, এই ক্লান্তিহীন আগ্রহ আমৃত্যু অব্যাহত ছিল।

যখন দেখা হলো, যেন জলের ভেতরে দেখা হলো। যেন কয়েক শতাব্দীর  আলাপ। কলকাতায় সস্ত্রীক এসেছিলেন আমার বাড়ি। সম্পাদকের সম্পাদক হিসেবে তাঁর কথা জানতাম। কালি ও কলমের সম্পাদক হিসেবে তাঁর অবদান সম্পর্কে আমি ওয়াকিবহাল ছিলাম। তারপর থেকে এক অপূর্ব বন্ধুত্ব আমার জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকল। দেখা হয়েছে রিচি রোডের এক কাফেতে। সেদিনই আকস্মিকভাবে ভিতর-মানুষটি উদ্ঘাটিত হলো আমার সামনে। আমি বললাম সাম্প্রতিককালে আমার লাঞ্ছনার কথা, বিষণ্ন হলেন, তিনি বললেন সাহিত্যজগৎ সম্পর্কে কিছু কিছু অতৃপ্তির কথা। অতঃপর যখনই  কলকাতায় কাজে এসেছেন, প্রায় নিয়মিত দেখা হয়েছে নিভৃতে, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের এক কাফেতে। আমি নিজে এপার বাংলার একটি বিশিষ্ট পত্রিকার গ্রন্থ-সমালোচনার সম্পাদনার সঙ্গে দশ বছর যুক্ত ছিলাম, কিন্তু বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর গভীর ভালোবাসা, অনুসন্ধিৎসা ও জ্ঞান ছিল হতবাক করার মতো। অমন তন্নতন্ন করে খুঁটিয়ে সাহিত্যের প্রকৃত গুণ বিচার আমি বেশি দেখিনি। হাসনাতদা যেন সম্পন্ন করে চলেছিলেন দুই বাংলার সাহিত্যভুবনের এক অলৌকিক যৌথ পাঠ। আনন্দবাজার পত্রিকায় বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা সম্পর্কে তাঁর রচনাগুলি সেতুর কাজ করেছে। আর কালি ও কলম তো এই সেতুবন্ধের সেরা উদাহরণ।

কবি শামীম রেজার আমন্ত্রণে ২০১৫ সালে ঢাকা লিট ফেস্টে অংশগ্রহণ করি। পরে ২০১৭ সালের জানুয়ারির শেষে হাসনাতদার আন্তরিক আহ্বানে আন্দামান থেকে ঢাকায় যাই কালি ও কলম পত্রিকা-আয়োজিত যুব পুরস্কারের অনুষ্ঠানে। সেটি আমার জীবনের এক সুরভিত সন্ধ্যা। হাসনাতদার আতিথেয়তা ছিল আপন অগ্রজ ভ্রাতার মতো। সঙ্গে দিয়েছিলেন খোন্দকার তাজমী নূরকে, খাঁটি সম্পাদকের মতো জানতেন কার সঙ্গে আমার সুরে মিলবে। জাতীয় কবিতা উৎসব ও একুশে বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছিলাম, অতিরিক্ত পরিশ্রম করে রাত জেগে তিনটি বক্তৃতা লিখে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনছি বুঝিনি। আগাগোড়া হাসনাতদা ও তাঁর প্রিয় তরুণ সুহৃদ তারিক সুজাতের আপ্যায়ন ভুলতে পারব না। ঢাকা ক্লাবে দুপুরবেলায় এক খোলামেলা আড্ডায় আমার অতি প্রিয় সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সঙ্গে ছিলেন শামসুজ্জামান খান, মারুফুল ইসলাম, রামেন্দু মজুমদার। হাসনাতদা এসেছিলেন, চোখ বড় বড় করে শুনছিলেন; কিন্তু একটি কথাও বলেননি, পাছে অন্যদের কথার সুর কেটে যায়। মনজুরদা স্বভাবসুলভ রসিকতায় কানে কানে বললেন, এই মানুষটি কোনোদিন কারুর ক্ষতি করতে পারবেন না। 

ঢাকায় একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে আমার সঙ্গে ছিলেন তিনি। সকলের স্পষ্ট ও উচ্চকিত মতের পাশে তিনি ছিলেন বিনয়নম্র ও কুণ্ঠিত, নিজের মতামত দিচ্ছিলেন নিচু গলায়। রাতে ওঁর বাসায় নিমন্ত্রণ ছিল, আমার প্রিয় কয়েকজন অধ্যাপক আসবেন। ‘একুশে’র অনুষ্ঠানের পর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এক মধুর বাক্যালাপের স্মৃতি মনে আছে। এলাম অনেক রাতে। হাসনাতদার বাসা যেন অপরূপ এক চিত্রশালা। এক জায়গায় এত সুরুচিপূর্ণ ছবি উঁচুমানের প্রদর্শশালায় দেখা যায় না। মুক্তমনা সেই আড্ডায় ওঁকে নিয়ে মৃদু রসিকতা তিনি উপভোগ করছিলেন।

পরের দিন প্রবল জ্বরের মধ্যে ঢাকা ক্লাবের ঘরে দেখছিলাম আমার সেবা করছেন সেই আশ্চর্য মানুষটি। আমার জন্য নাপা ট্যাবলেট কিনে আনছেন, যা আজো রেখে দিয়েছি, জামাকাপড় গুছিয়ে সুটকেসে তুলে রাখছেন, এত মানুষের দেওয়া বইগুলি কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। এই ভালোবাসায় ভরা স্মৃতি আমি কোনো দিন ভুলতে পারব না। ফিরে দীর্ঘকাল অসুস্থ ছিলাম। একে বলে কপাল।

হাসনাতদা নিয়মিত খোঁজ নিয়েছেন। যে-বইগুলি ফেলে এসেছিলাম, সেগুলির মধ্যে সেরাগুলিকে নিপুণভাবে বেছে, যার মধ্যে শামসুজ্জামান খানের বই ছিল, নিজে হাতে নিয়ে এসেছেন। আর আমি ভেবেছি, ইনি মানুষ, না দেবতা? এত অসাধারণ তাঁর দীর্ঘ সাংস্কৃতিক সংগ্রাম, এত নিষ্ঠাবান তাঁর কাজ, নিরবচ্ছিন্ন সাধনা তাঁর রক্তে, আমার মতো আধা-চেনা মানুষের জন্য এত অনুধ্যান তাঁর!

হাসনাতদার সঙ্গে বন্ধুত্ব আমায় চিনিয়ে দিয়েছে প্রকৃত ভদ্রলোকের ধর্ম। আমার চেনা মানুষদের গ্যালারিতে তাই তাঁর স্থান অতি বিশিষ্ট। বারবার দেখা হয়েছে, যেন দুদিনের জন্য কলকাতায় এলেও দেখা তাঁকে করতেই হবে। আমরা পঞ্চাশের বেশি বার ফোনে কথা বলেছি। একজন মানুষ আটত্রিশ বছর সংবাদে কাজ করার পর কালি ও কলমে জীবনের নতুন পৃষ্ঠা খুলেছেন, শিল্প ও সাহিত্যের আবিষ্কারমালার সামনে তাঁর ঘোর কাটেনি। উপহার হিসেবে এনেছেন প্রিয় বই, হয়তো মাজহারুল ইসলাম বা জয়নুল আবেদিনের ওপর গ্রন্থ। অথবা অলকনন্দা প্যাটেল বা সুস্মিতা ইসলামের আত্মকথা। নতুন বইয়ের খবর নিয়েছেন, এবং বিদ্যুৎগতিতে আমার আগে সেই বই সংগ্রহ করে নিয়েছেন।

শঙ্খ ঘোষকে নিয়ে তাঁর ভালোবাসা আর ভাবনার অন্ত ছিল না। একটিবারও তাঁর স্বাস্থ্যের খবর নেননি, এমন হয়নি। সেই শঙ্খদা যে হাজার উপরোধেও অসুস্থতার কারণে ২০১৭ সালে সিলেটের সাহিত্য উৎসবে যেতে পারেননি তার জন্য দুঃখ পেয়েছি। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে সস্ত্রীক গিয়েছিলেন, তাঁকে বাংলাদেশের সাগরময় ঘোষ বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়ায় কুণ্ঠিত হয়েছিলেন, অথচ কথাটি তো সত্যি! আমার মাঝে মাঝে মনে হয়েছে আবুল হাসনাতের প্রকৃত ঘরানা প্রবাসী ও মডার্ন রিভিউ-এর। সেই এক একাগ্রতা, সেই এক অনমনীয় বিশ্বাস।

রম্যাঁ রলাঁ ও রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র নিয়ে ব্রিজিং ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট বাংলাদেশে সহজলভ্য নয়, বইটির দামও অত্যধিক বেশি, তবু আনিয়ে পড়েছেন। এই বইয়ের কথা আত্মকথায় আছে। গান্ধীজিকে নিয়ে লিখছি শুনে দীর্ঘ লেখাটি পড়তে চেয়েছিলেন। যতক্ষণ না পাঠিয়েছি শান্তি নেই। অনেক সময়ই বুদ্ধদেব বসুর কথা হতো, তাঁর স্মৃতিকথায় পুরানা পল্টনের কথা, বদলে যাওয়া পৃথিবীর কথা। যেন দুজনে নিচু গলায় সমবেত কণ্ঠে গান করছি আমরা।

এত কথা হয়েছে, একবারের জন্যও বলেননি তিনি একজন পুরস্কৃত শিশুসাহিত্যিক। আমাকে অন্যদের কাছে জেনে নিতে হয়েছে। জসীমউদ্দীন, চ্যাপলিন, জয়নুল, সফিউদ্দীন, কামরুল, রবিশঙ্কর, মানিক, সতীনাথের ওপর গ্রন্থের সম্পর্কে একটি কথা বলেননি। শামসুর রাহমানের গ্রন্থ সম্পাদনার কথা নম্রভাবে উল্লেখ করেছেন। মাহমুদ আল জামানের নির্বাচিত কবিতা উপহার দিয়েছিলেন। ক্ল্যাসিক আধুনিক বাংলা কবিতার ধরন, বুঝতে অসুবিধে হয় না সমর সেন, বুদ্ধদেব বসু, শামসুর রাহমানের প্রতি তাঁর আনুগত্য।

তাঁর কবিতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাঁর মনের গোপন চাবিকাঠি। কেন লিখলেন ছদ্মনামে? আমার ধারণা, আপন সত্তাকে অন্তরালে রেখে সম্পাদক আবুল হাসনাত নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে চেয়েছিলেন।

করোনার মাসগুলিতে নিয়মিত ফোনে কথা হয়েছে। যখন তাঁর ফোন পেয়েছি, এমনকি এই অক্টোবর মাসেও, আমাকে বিরক্ত করার জন্য কুণ্ঠিতভাবে ক্ষমা চেয়ে কথা শুরু করেছেন। ইতিহাসদীপ্ত এক সংস্কৃতিকর্মীর কুণ্ঠা আমার কাছে? এমন নম্রতা আমাদের এই রুক্ষ ও কর্কশ জীবনে সজলতা আনে।

কথা তো নয়, খোঁজ। ভালো লেখার জন্য এমন ক্লান্তিহীন তৃষ্ণা আমায় আশ্চর্য করত। মন খারাপের সময় পার হয়ে আনিসুজ্জামানের ওপর কালি ও কলমের একটি অসাধারণ সংখ্যা করলেন। সেটি করে পরম তৃপ্তি পেয়েছেন। বিদ্যাসাগর সম্পর্কিত সংখ্যার কাজও নাকি শেষ করেছিলেন। শেষ ফোনের সময় সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কথা উঠল, আফ্রো-এশীয় সম্মেলনে তাঁদের হৃদ্যতার কথা। বললেন শেষ জীবনে কমিউনিস্ট পার্টি তাঁর প্রতি সুবিচার করেনি। পাঠক তাঁর এই মতের যাথার্থ উপলব্ধি করবেন। মৃত্যুর আগে সেদিন তাঁর প্রধান জিজ্ঞাস্য ছিল : এলিয়ট সম্পর্কে আমার ইংরেজি বইটি বেরিয়েছে কি না! আমি নিজেই ভুলে গিয়েছিলাম। বললাম, কী হবে? আপনার এত কাজের মধ্যে। উনি বললেন, না, পড়তে হবে। এই শেষ কথা। তাঁর প্রয়াণের পর বইটি বেরিয়েছে। সেই বইয়ের শাদা পৃষ্ঠার শূন্যতায় নক্ষত্রের নীল জল গড়িয়ে পড়ছে।