ঋদ্ধ চেতনার কর্মযজ্ঞ : আবুল হাসনাতের ভুবন

মুক্ত চিন্তার মানুষ আবুল হাসনাত জীবনব্যাপী নিষ্ঠার সঙ্গে নিজের সাধনার ক্ষেত্র তৈরি করেছেন। এই ক্ষেত্র শুধু তাঁর ব্যক্তিগত বিষয় ছিল না। তিনি ব্যক্তির ঊর্ধ্বে সার্বিক সচেতনতায় শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্র দীপ্ত করেছেন।

কবিতা-গদ্য লিখে নিজের সৃজনশীল ভুবন যেমন পরিচর্যা করেছেন, তেমন সম্পাদকের গভীর বোধের নিষ্ঠায় গড়েছেন সাহিত্যের শিল্পক্ষেত্র। নবীন লেখকদের তৈরি করেছেন সাহিত্যের স্রোত বহমান রাখার মৌলিক শর্তে। নিঃসন্দেহে বলতে হবে সম্পাদক আবুল হাসনাত সম্পাদনার বটবৃক্ষ। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীর পৃষ্ঠা উজ্জ্বল করে রেখেছিলেন নবীন-প্রবীণ লেখকের লেখায়। ঊনত্রিশ বছর ধরে তিনি এই কাজটি করেছেন। গড়ে উঠেছে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের সাহিত্য। 

অন্যদিকে সাংস্কৃতিক চেতনায় তিনি ছিলেন পরিসর নির্মাণের অগ্রপথিক। দেশবাসীর বেঁচে থাকার ভুবন আলোকিত করে রেখেছিলেন। গড়ে তুলেছেন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। ‘ছায়ানট’ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করার দ্বারা তিনি বিপুল পরিধি সাধন করেছেন। তাঁর সম্পাদনার কাজ আজকের দিনে সাহিত্যের জগতে আলোচনার বিষয়। সবার মুখে এক কথা, এমন একজন সম্পাদক তৈরি হতে অনেক সময় লাগবে। তিনি ২০০৪ সাল থেকে কালি ও কলম সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। এই পত্রিকা বাংলাভাষী পাঠক ও লেখকদের মাঝে বিপুল আলোড়ন তুলেছে। কলকাতার অনেক লেখক ও পাঠকের কাছে কালি ও কলম পত্রিকার প্রশংসা শুনেছি। সবাই আবুল হাসনাতের সম্পাদনার দায়িত্ববোধ নিয়ে বলেছেন যে, তাঁর সম্পাদনা তুলনাহীন। এভাবেই তিনি মননশীলতার জগতের শিল্পস্রষ্টা। 

তাঁর সঙ্গে আমার স্বাধীনতার আগে দেখা হয়নি। পরিচয় হয় বাংলা একাডেমিতে। আমার শিক্ষাজীবনের পুরোটা সময় কেটেছে রাজশাহীতে। লেখালেখির সূত্রপাত হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়। ঢাকা আমার কাছে ছিল অচেনা-অজানা শহর। রাস্তাঘাট যেমন চিনতাম না, তেমনি লেখক-সম্পাদক কারো সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। জানাশোনার সূত্র ছিল পত্র-পত্রিকা। 

১৯৬৯ সালে ঢাকা শহরে আসি। সে-সময় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে ড. মুহম্মদ এনামুল হক-প্রদত্ত প্রবন্ধ লেখার প্রতিযোগিতায় ‘পূর্ব পাকিস্তানের ছোটগল্প’ শীর্ষক প্রবন্ধ লিখে বিজয়ী হয়ে স্বর্ণপদক পাই। পুরস্কার বিতরণের অনুষ্ঠানে দেখতে পাই অনেককে। তারপর বাংলা একাডেমির দেওয়া বিজ্ঞাপন পত্রিকায় দেখে গবেষণা সহকারী পদে আবেদন করি। ১৯৭০ সালের জুন মাসে ইন্টারভিউ হয়। ইন্টারভিউ বোর্ডে ছিলেন বাংলা একাডেমির পরিচালক কবীর চৌধুরী, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, ড. নীলিমা ইব্রাহিম, আব্দুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দীন। চাকরিটি আমার হয়।

এই চাকরির সূত্রে আবুল হাসনাতের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়। তিনি বাংলা একাডেমিতে আসতেন সরদার ফজলুল করিমের কাছে। সময় কাটাতেন তাঁর সঙ্গে। লেখার জন্য অনুরোধ করতেন। সরদারভাই যেখানে বসতেন তার কাছাকাছি জায়গায় আমি বসতাম। সংবাদ পত্রিকার সাহিত্যপাতার সম্পাদক আবুল হাসনাত এটা জেনে আমি গিয়ে সরদারভাইয়ের টেবিলের সামনে বসতাম। মনে মনে ভাবতাম তিনি যদি আমার কাছে লেখা চান। এমন আগ্রহ ছিল আমার। সরদারভাই আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন আবুল হাসনাতের। আমার লেখালেখির কথাও বলেন। ছোটগল্পের বিষয়ে প্রবন্ধ লিখেছি সে-কথাও বলেন। হাসনাত সাহেব মৃদু হেসে বলেন, আমাদের গল্প দেবেন। প্রবন্ধও। দেশ স্বাধীন হয়েছে সাহিত্যের নতুন ধারা তৈরি করব আমরা। 

বাহাত্তরে আমি একজন তরুণ লেখক। তখনো লেখা ঠিকমতো তৈরি হয়নি।

’৭০-এর ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব দেখে এসেছি। ঘুরেছি পটুয়াখালীর বিভিন্ন এলাকা। একটি ছোট চর ছিল। সেখানে মানুষের বসতি এবং গাছপালা ছিল। দেখলাম পুরো চর শূন্য, কিছু নেই। এক জায়গায় দেখলাম একজন মহিলা অর্ধেক পানিতে পড়ে আছে। হাতে সোনার মোটা বালা, কানে দুল। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। কেউ আসেনি এগুলো লুট করতে। রাঙাবালিতে দাঁড়িয়ে ভেবেছি একটি উপন্যাস লিখব। লিখতে শুরু করি জলোচ্ছ্বাস উপন্যাস। ততোদিনে হাসনাত সাহেব আমার তিনটি গল্প ছেপেছেন। মফস্বল শহর থেকে উঠে আসা একজন লেখককে তিনি মনের আনন্দে ভরিয়েছেন। তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। বুঝতে পারি, প্রবীণ-নবীন লেখককে দিয়ে তিনি স্বাধীন দেশের সাহিত্যের স্রোত তৈরি করছেন। 

একদিন বাংলা একাডেমিতে আসেন। রফিক আজাদ, রশীদ হায়দারসহ আড্ডা হচ্ছিল। আমিও যুক্ত হই। হাসনাত সাহেব কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলেন, কী লিখছেন এখন? বললাম, সত্তরের জলোচ্ছ্বাসের পটভূমিতে একটি উপন্যাস। 

– তাই নাকি। ভালোই তো বিষয়। আমাকে দেন আমি ছাপব ধারাবাহিকভাবে। 

আমি আনন্দে ডুবে যাই। 

রফিক আজাদ বলেন, সেলিনার একটি উপন্যাস আমি ছেপেছি উত্তরাধিকার পত্রিকায়। 

– ওহ তাই। 

হাসনাত সাহেব হাসিমুখে আমার দিকে তাকান। রফিক আজাদের ঘরে রোজই বিভিন্নজনের সঙ্গে আড্ডা হতো। এসব ছিল সাহিত্য আড্ডার বড় দিক। সংবাদ সাময়িকীতে আমার উপন্যাসটি অনেকদিন ধরে ছাপা হয়। এমন স্মৃতি অনেক আছে।

এরপর আবুল হাসনাত কালি ও কলম পত্রিকার সম্পাদক হন। ২০০৪ সাল থেকে এই পত্রিকার যাত্রা শুরু হয়। এই সাহিত্য পত্রিকাকে তিনি সূচনা থেকে বড় পরিসরে সম্পাদনা করেছেন। সবার মুখে এক কথা, হাসনাতের সম্পাদনা তুলনাহীন। 

একদিন আমাকে ফোনে বললেন, ধারাবাহিকভাবে ছাপব এমন একটি উপন্যাস এই পত্রিকার জন্য লিখুন। 

তখন আমি ছিটমহল পটভূমি করে একটি উপন্যাস লেখার কথা ভাবছি। ঘুরে এসেছি ছিটমহল দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা। হাসনাত সাহেবের ফোন পেয়ে লিখতে শুরু করি। পুরো উপন্যাসটি ছাপা হয় কালি ও কলম পত্রিকায়। বই হওয়ার পরে কলকাতার লেখক অমর মিত্র আমাকে বললেন, ছিটমহল পটভূমিতে আপনি প্রথম উপন্যাস লিখলেন। এর আগে লেখা হয়নি। আমি নিজে একটা লিখব ভাবছি। এ-বছরই প্রকাশিত হয়েছে ছিটমহলের পটভূমিতে লেখা উপন্যাস কুমারী মেঘের দেশ চাই। আপনার উপন্যাসটি আমি কালি ও কলম পত্রিকায় পড়েছি। এই পত্রিকাটি পড়তে আমার খুব ভালো লাগে।  আমার লেখালেখির সঙ্গে সম্পাদক আবুল হাসনাত এভাবে জড়িত। তাঁর মৃত্যু মেনে নেওয়া কঠিন। আমি তাঁকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। তাঁকে অনবরত মনে করে যাবে সৃজনশীল জগতের মানুষেরা। সৃজনশীল মাত্রাকে সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত করে এক বিপুল পরিসর গড়ে জীবন কাটিয়েছেন আবুল হাসনাত। কবিতা ও গদ্য লিখেছেন মাহমুদ আল জামান নামে। তিনি শিল্পের দুই মাত্রাকে গভীর মগ্নতায় ধারণ করেছিলেন। এখানেই তিনি সবার সামনে উদাহরণ। এই প্রত্যাশা করি যে শিল্পের জগতের প্রজন্ম তৈরি হবে এমন অসাধারণ উদাহরণে।