আসমা সুলতানার একক শিল্পকলা-প্রদর্শনী বিস্মৃতির সঙ্গে স্মৃতির সংগ্রাম

টরন্টোর পূর্বদিকে ইন্ডিয়া বাজারের মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া জেরার্ড স্ট্রিটে খানিকটা ঢুকতেই হাতের বাঁপাশে পড়ে জেরার্ড আর্ট স্পেস (Gerrard Art Space)। এখানে গত ১৯ জুলাই থেকে ৬ আগস্ট ২০২৩ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়েছে শিল্পী আসমা সুলতানার ত্রয়োদশ একক শিল্পকলা প্রদর্শনী ‘লং লস্ট লুলাবাই’ (বিস্মৃত ঘুমপাড়ানি গান)।

বাণিজ্যিক কিংবা সেøাগাননির্ভর শিল্পকলা সৃষ্টি করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া আসমার এবারের প্রদর্শনীও একটি একক ধারণাগত পরিপ্রেক্ষিতের প্রতিনিধিত্ব করেছে। প্রদর্শিত শিল্পকর্মগুলির ঐক্যবদ্ধ সমন্বয় শিল্পীর অভিব্যক্তির সার্বিক রূপ তুলে ধরেছে। এবার অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীতে সেই অভিব্যক্তি ঘিরে ছিল আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের ক্রমশ বিস্মৃত হতে থাকা একটি ইতিহাস – নিহত, নির্যাতিত, নির্বাসিত,  অবহেলিত শিশুরা। ধারণা করা হয়, আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে শহিদ হয়েছিল প্রায় চার লক্ষ শিশু আর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীদের অর্ধেকই ছিলেন কিশোরী, যারা এক অর্থে শিশু। খুব রক্ষণশীল একটি হিসাবেও এটি স্পষ্ট যে, প্রায় চার লাখ নারী ধর্ষিত হয়েছিলেন।

তাঁদের মধ্যে গর্ভবতী হয়েছিলেন কত জন – সেই প্রকৃত সংখ্যাটি দুর্জ্ঞেয় থেকে অজ্ঞেয় একটি বাস্তবতায় রূপান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়ায় আছে। ধারণা করা হয়, এই সংখ্যা প্রায় তিন লক্ষ স্পর্শ করেছিল। ভারতে কিংবা গোপনে যাঁরা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, অসংখ্য গর্ভপাত হয়েছে। গর্ভপাত সম্ভব হয়নি – এমন শিশুরা ‘যুদ্ধশিশু’ হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছে। কানাডিয়ান ইউনিসেফের একটি প্রতিবেদনে দশ হাজার যুদ্ধশিশুর কথা উল্লেখ রয়েছে। সুসান ব্রাউন মিলারের মতে, সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন এমন বীরাঙ্গনার সংখ্যা কমপক্ষে পঁচিশ হাজার। এই ভয়ংকর ইতিহাসের প্রকৃতি এখনো উন্মোচনের অপেক্ষায় আছে। ক্ষমা চায়নি এই অননুতপ্ত নৃশংস ধর্ষক গণহত্যাকারীরা। আজো স্বীকৃতি পায়নি বিশ শতকের ভয়াবহ একটি গণহত্যা।

গ্যালারির ছাদ থেকে ঝুলে থাকা জামাগুলি সব বাংলাদেশ থেকে সংগৃহীত সাদা কাপড় দিয়ে তৈরি। গ্যালারির আলোকসম্পাত সেগুলিকে শুভ্র শুদ্ধতা আর নিষ্কলুষতার একটি জ্যোতির্বলয় দিয়ে ঘিরে রেখেছিল। এগুলি সেলাই করতে শিল্পী তাঁর নিজের মাথার চুলকে সুতা হিসেবে ব্যবহার করেছেন। নির্ভার, নিষ্কলঙ্ক শিশুদের অনুপস্থিত শরীরের প্রতীক হয়ে উঠেছিল সেগুলি দর্শকদের সামনে।

শিল্পকর্মে চুল-ব্যবহার করে আসছেন আসমা দীর্ঘদিন ধরে। তাঁর কাজে চুল ব্যবহৃত হয়েছে প্রায়শই সূচিকর্ম, বর্ণমালা, প্রতিকৃতি সৃষ্টিতে, তাঁর আত্মপরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে।

এ-বিষয়ে শিল্পী আসমা সুলতানা বলেন, ‘আমার চুল আমার ডিএনএ বহন করে, আর আমার শিল্পকর্মগুলি হচ্ছে আমার সেই আত্মপরিচয়ের সিলমোহর। আমার মাথার চুল হচ্ছে আমার শিল্পকলার উপকরণ, আর সাদা কাপড় হচ্ছে পরিসর, কিংবা কখনো নিজের ব্যবহৃত চিরুনি, ছবি আঁকার তুলি বা অন্য কোনো আটপৌরে সরঞ্জাম। আমার অভিব্যক্তির প্রকাশ এতোটাই সরল। আমার শিল্পকর্মগুলো আত্মজৈবনিক – বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক-ভৌগোলিক পরিবেশে নিজের আত্মপরিচয় খুঁজে নেওয়ার সংগ্রাম। মানুষ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর নিরন্তর যুদ্ধ, অপমান, বঞ্চনা আর আত্মত্যাগের নানা আখ্যানের প্রতীকী রূপ খুঁজে বেড়ায় আমার শিল্পকর্ম।’

প্রদর্শনীতে নিচ থেকে ভাসমান জামাগুলির ঘিরে থাকা শূন্যস্থানগুলি দেখা গেছে সুস্পষ্টভাবে। দর্শকরা সেই দৃশ্যের ফ্রেমের ভেতর প্রবেশ করেছেন অস্বস্তিকর একটি প্রশ্ন নিয়ে – এদের কথা কি আমরা আসলেই ভুলে গেছি?

ঢুকতেই প্রদর্শন-কক্ষের বাঁপাশের দেয়ালে একটি শূন্য জামা দেখা যায়। সেখানে কোনো অবয়ব নেই। এর ওপর শিল্পী হাতে লিখেছেন, যুদ্ধাপরাধ আদালতে সাক্ষীর জবানবন্দি থেকে নেওয়া কিছু বাক্য, বাংলা বর্ণমালায়। এর পাশেই আছে আরেকটি জামা, যেখানে শিল্পী চুলের সূচিকর্মে ইংরেজি বাক্যে অ্যানা ফ্রাঙ্কের একটি উপলব্ধি প্রতিধ্বনিত করেছেন : ‘জামার চেয়ে স্মৃতি আমার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ বিপরীত দেয়ালে ঝুলে আছে ঘুমপাড়ানি গান লেখা দুটি তালপাতার হাতপাখা, শিল্পী যা শিল্পকর্মে রূপান্তরিত করেছেন সতর্কভাবে পুড়িয়ে আঁচড় কেটে, দহনের ক্ষত যেন সেই স্মৃতিবহ যন্ত্রণাকে দর্শকের চোখের সামনে তুলে ধরছে। এর পাশেই আছে দীর্ঘ একটি শাড়ি, যেখানে পুড়িয়ে লেখা হয়েছে একটি জবানবন্দির চুম্বক অংশ। দর্শক চাইলে সেই শাড়ি উল্টে দেখতে পারেন, পোড়ানো অংশ গলে আলো সেই ভয়ংকর স্মৃতিবহ শব্দগুলোকে দেয়ালে মূর্ত করে রেখেছে।

আরেকটু অগ্রসর হলে বিশাল কাগজের ওপর সার্চলাইট থেকে বেরিয়ে আসা আলোকরশ্মির একটি ট্রাপিজয়েড আকৃতির রেখাচিত্র, যার পুরো ক্ষেত্রটি আন্দোলিত হচ্ছে অসংখ্য বৃদ্ধাঙ্গুলির ছাপে। বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিতদের কাছে সার্চলাইট শব্দটির ভয়াবহতা অবিস্মরণীয়। কালি আর আঙুলের ব্যবহারে সাদা কাগজের ওপর একের পর এক স্তরে কালো রঙের নানা ঘনত্বের অসংখ্য বৃদ্ধাঙ্গুলির ছাপ। আঙুলের ছাপ খুবই ঘনিষ্ঠ একটি অননুকরণীয় আত্মপরিচয়, শিল্পী যেন সেই বহু লক্ষ শিশুকে জীবন্ত করতে চেয়েছেন তাদের একটি চিহ্নে রূপান্তরিত করে। দুই পাশের দুই দেয়ালে আঙুলের ছাপের বিশাল দুটি ড্রইং সেই ভাসমান জামাগুলির প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। এগুলির ওপর ঝুলন্ত জামাগুলির ছায়ার নানা ধরনের রূপ সৃষ্টি করতে দেখা যায়। শিল্পী সেই সব শিশুদের হয়ে চিহ্ন এঁকে রেখেছেন, তাদের অস্তিত্বের সাক্ষ্য হিসেবে। তালপাতার হাতপাখায় আবার আমরা ফিরে আসি, পুড়িয়ে লেখা নানা ছড়া, ঘুমপাড়ানি গান, জাতীয় সংগীত। যে তালপাতার পাখা মায়ের হাতে দুলত, এই শিশুরা তা আর কোনো দিনও পাবে না। আমরা সেখানে দেশ থেকে নির্বাসিত এক যুদ্ধশিশুর জবানবন্দির কিছু অংশ দেখি। মায়ের জরায়ুই ছিল যাদের সর্বশেষ স্বদেশের ঠিকানা।

আসমার এবারের প্রদর্শনীটি দর্শকদের আবেগীয় স্তরকে খুবই আলোড়িত করে। কানাডার দর্শকরাও নতুন কিছু ইতিহাসের মুখোমুখি হয়েছেন। পরিত্যক্ত যুদ্ধশিশুদের দত্তক নিতে কানাডা উদ্যোগী হয়েছিল প্রথম। ১৯৭২ সালে কানাডার সমাজকর্মী বনি কাপুচিনোর সংগঠন ‘ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেন’ পনেরোটি যুদ্ধশিশুকে কানাডায় নিয়ে এসেছিল। পরে এই পথ ধরেই যুদ্ধশিশুদের পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করার কার্যক্রম শুরু হয়। ৭১-এর যুদ্ধশিশু : অবিদিত ইতিহাস গ্রন্থে গবেষক মুস্তফা চৌধুরী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন, ‘যে যুদ্ধশিশুরা মানবিক বিবেচনার দুগ্ধধারা থেকে বঞ্চিত হয়েছিল, তারা যে মর্মবিদারী দুঃখ পেয়েছিল, তার খবর কেউ জানে না। কেউ সে বিষয়ে জানার ইচ্ছা পোষণ করে কি না, সে প্রশ্নের উত্তরও আমাদের জানা নেই।’

শিল্পী আসমা সুলতানা ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত অথচ ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতাযুদ্ধের সেই নয় মাসকে তুলনা করেছেন কোনো ছোটগল্পের মতো, সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীরভাবে। সেই যুদ্ধে আমরা সবাই কিছু না কিছু হারিয়েছি। আমরা শুধু আমাদের প্রিয়জনকেই হারায়নি, বরং হারিয়েছি সেই যুদ্ধশিশুদের, যারা মায়ের মুখ দেখার আগেই মৃত্যুবরণ করেছে। যুদ্ধশিশুদের মায়েরা হারিয়েছেন তাঁদের সম্ভ্রম এবং সন্তান। যেখানে মায়ের কোল নিরাপদ আশ্রয় হওয়ার কথা ছিল, অথচ তাদের মায়েদের জঠর হয়েছে তাদের সমাধিস্থান। আর যারা এই ভয়াবহ গণহত্যার মাঝেও বেঁচে ছিল তাদের পাড়ি দিতে হয়েছিল ভিনদেশে কোনো বিদেশি মা-বাবার ঘরে পালিত সন্তান হয়ে। আমাদের মানচিত্র, পতাকা, মাটি এবং আত্মপরিচয়ের জন্য আমরা এই শিশুদের কাছে ঋণী।

শিল্পী তাঁর বার্তায় স্মরণ করিয়ে দেন : ‘আমরা ভুলে গেছি তাদের বিসর্জনের কথা, আমরা আত্মপরিচয়ের গ্লানি নিয়ে বেঁচে আছি বিস্মৃতির পথে হারিয়ে গিয়ে। আমাদের স্মৃতি, দৃষ্টি, সব কিছু ঘোলাটে হয়ে গেছে রাজনীতি এবং জীবন দর্শন দ্বারা। আমরা আগের মতো শিশুদের ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে আর ঘুম পাড়াই না। আমরা ঘুমন্ত এক জাতি হিসেবে নিজেদের আত্মপরিচয়কে ভুলে যেতে বসেছি, ভুলে যেতে বসেছি যুদ্ধশিশুদের আত্মবলিদান। সে-কারণে আমাদের ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে ঘুম পাড়াতে নয়, ঘুম ভাঙাতে হবে। আজ সময় এসেছে আমাদের পেছনে ফিরে দেখার, ইতিহাসকে আরো একবার বিশ্লেষণ করে দেখার, যেন আমরা আমাদের ইতিহাসকে বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করতে পারি।’

বাংলাদেশিদের আমন্ত্রণ জানানো হলেও আসমার উদ্দেশ্য  ছিল এটাই, সেই সত্যিকারের কাহিনিটি জানানো, যারা সেটি জানতে চায়, আর যারা ভুলে যেতে যায়, তাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে, ঘুমপাড়ানি এই গান যেন আমাদের সত্য প্রতিষ্ঠা করতে জাগিয়ে তোলে, নতুন আত্মবিশ্বাসী আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধানে প্ররোচিত করে।