আমি বীরাঙ্গনা বলছি : বেদনাদগ্ধ নারীত্বের আর্তস্বর

মঞ্চের প্রবেশমুখে কালোর আচ্ছাদন, বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ধর্ষিত নারীর নানা চিহ্ন-প্রতীক স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল মুক্তিযুদ্ধের সেই শোকাবহ কষ্টের দিনগুলির কথা। ‘বীরাঙ্গনা’রা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। এদের নিয়ে নানাভাবে রাজনীতি হয়েছে। শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার মঞ্চে প্রায় মাসব্যাপী প্রদর্শিত আমি বীরাঙ্গনা বলছি নাটকটি সেই লাঞ্ছিত-বঞ্চিত-নিপীড়িত বাঙালি নারীদের কান্না-শোক-দুঃখের মানসিক রূপকে তুলে ধরেছে। নাটকটির কাহিনিসূত্র নেওয়া হয়েছে নীলিমা ইব্রাহিম-রচিত আত্মজীবনীমূলক আমি বীরাঙ্গনা বলছি গল্পগ্রন্থ থেকে। নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন নাট্যশিক্ষক, নির্দেশক সৈয়দ জামিল আহমেদ। নাটকটি প্রযোজনা করেছে ‘স্পর্ধা’ নামের পেশাদার নাট্যদল। প্রদর্শনীগুলিতে বিপুল পরিমাণ দর্শক-সমাগম এর সাফল্যের প্রমাণ।  

সৈয়দ জামিল আহমেদের প্রতিটি নাট্যনির্মাণ নানা কারণে গুরুত্ববহ। স্পেসের বহুমাত্রিক ব্যবহার, স্পর্শকাতর নাট্যীয় উপকরণ, পয়েন্ট অফ ভিউর নিরীক্ষাসহ নানা কিছু থাকে তাঁর নির্মাণে। আমি বীরাঙ্গনা বলছি নাটকও নানা বৈচিত্র্যে প্রত্যুজ্জ্বল।

নীলিমা ইব্রাহিমের বইটি ১৯৯৪ সালে এক বিরূপ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইতিহাসের সত্য উন্মোচন করে। মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বারা নির্যাতিত সাতজন নারীর করুণ কাহিনি এতে বর্ণিত। নির্যাতিত এই সাত বীরাঙ্গনা নানা পেশাজীবী পরিবার থেকে উঠে আসা।

এ-নাটকে এই সাত নারীর দুজন তাঁদের ত্যাগ-নির্যাতন ও সংগ্রামের কথা বলেন। নাটকটিতে ফুটে উঠেছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ভয়ংকর রূপ আর আমাদের সমাজের হীন মানসিকতা।

নাট্যদল ‘স্পর্ধা’ মনে করে, সামাজিক ও আদর্শগত চেতনার প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা রয়েছে। তাই তারা তাদের চতুর্থ প্রযোজনা হিসেবে বেছে নিয়েছে এ-নাটক। বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে বীরাঙ্গনা নিয়ে ইতোপূর্বে একাত্তরের দিনগুলো, শামুকবাস, লালজমিন, বীরাঙ্গনার বয়ান প্রভৃতি শিরোনামে বেশ কিছু নাট্য  প্রযোজনা হলেও নীলিমা ইব্রাহিমের রচনা থেকে এটিই প্রথম।

নাটকের শুরুতে যখন ঘোষণা আসে ‘বীরাঙ্গনা’ শব্দটির অর্থ নাটকের শেষে পাল্টে যাবে তখন যেন শব্দের সংজ্ঞাগত ধ্বনিগুলি মনে বারবার ওলটপালট হতে শুরু করল। তারপর মঞ্চে সামনের পর্দায় ভেসে উঠতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের নিপীড়িত নারীদের করুণ দুষ্প্রাপ্য ছবি, বোঝা গেল এই নাটক দর্শকদের ইতিহাসের গভীর পাঠের রসদ দিয়ে যাবে। সাদামাটা মঞ্চের সহজ-সরল ডিজাইন। মাঝখানে অভিনয়ের স্থান। স্থানটি যেন কোনো আর্মি ক্যাম্পের কক্ষ। তাতে বেশ কয়েকটি টুল রাখা। এর তিনদিকে দর্শকসারি এবং একদিকে শেল্টার দেওয়া দেয়াল। তাতে নানা ছবি ফুটে উঠতে থাকে আর আবেগপূর্ণ মিউজিকের সঙ্গে সাতজন বীরাঙ্গনা মঞ্চে প্রবেশ করেন। গম্ভীর চলন, সংগীত ও আলো-আঁধারির বুননে অপূর্ব মঞ্চমায়া ঘিরে ধরে দর্শককে। 

সৈয়দ জামিল আহমেদ সবসময়ই দৃশ্যনির্মাণে বাঁধহীন কল্পনা, ইঙ্গিতপূর্ণ উপকরণ ও শিল্পসৌন্দর্যের পরিচয় দেন। এ-নাটকও তার ব্যতিক্রম নয়। দুটো চরিত্র তাঁদের জবানিতে মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের নির্যাতিত হওয়ার ঘটনা বলেন। কাহিনি একরৈখিক হলেও শিল্পসত্যের নৈপুণ্যে নির্দেশক প্রতিটি সময়কেই যেন নাট্যমুহূর্তে রূপান্তরে সচেষ্ট। আলো, সংগীত ও
অভিনয়-কোরিওগ্রাফিতে উপস্থাপিত হতে থাকে ঘটনাবৃত্ত। বৃত্তগত নাটকীয়তা না থাকলেও নাটকীয়তা আছে দৃশ্য-উপস্থাপনে। গল্পকার যেভাবে গল্প বর্ণনা করেছেন নির্দেশক সেই পয়েন্ট অফ ভিউতে, নতুন কিছু সংলাপ, গল্পের নানা নাট্যীয় উপকরণযোগে দৃশ্যবাস্তবতা নির্মাণ করেছেন। নির্দেশক শিল্পমুন্সিয়ানায় বীরাঙ্গনাদের নিয়ে এক অপূর্ব সহমর্মিতার নাট্যভাষা তৈরি করেছেন। 

‘আমি একজন বীরাঙ্গনা। কিন্তু আপনাদের পরিচয় অঙ্গে ভূষণ হয়ে রয়, না পারি পরতে না পারি ফেলতে। তা লোকচক্ষে রয়ে গেলাম ‘বারাঙ্গনা’।’ গানের সুরে সুরে সাতজন নারী যখন মঞ্চে আক্ষেপের সুর তোলেন তখন বীরাঙ্গনাদের যে হৃদয়ভরা কষ্ট-ক্ষোভ-অসীম যন্ত্রণা তা শ্লেষাত্মকভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে দর্শকের কাছে। নাটকটি শুরু হয় নির্যাতিত ‘ময়না’ চরিত্রের মধ্য দিয়ে। ঘটনা বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে অন্য অভিনেত্রীদের দেহভঙ্গিমায় নির্মিত হতে থাকে দৃশ্যের নানা পরত। ময়না চরিত্রে অভিনেত্রী শারমিন আক্তার শর্মীর দেহ-মনের গহিনে সেই কষ্ট যেন ঠিকরে ওঠে। ভারী ভাঙা ভাঙা গলায় বলতে শুরু করেন নির্মম জীবনাভিজ্ঞতা। স্মৃতিগুলি ময়নাকে তাড়ায়। নাটকে নির্মিত আতঙ্ক, চরিত্রের ভেতরে আতঙ্ক, সে-আতঙ্ক দর্শককে আতঙ্কিত করে না। বরং দর্শককে করুণার বন্ধনে বাঁধে।

ময়না নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া ছাত্রলীগের সদস্য ছিলেন। মঞ্চে আলো-আঁধারি রূপ ও কোরিওগ্রাফিতে ফুটে উঠতে থাকে গণঅভ্যুত্থান, রাজনীতির নানা অনুষঙ্গ। ‘জয়বাংলা’ গানের তালে তালে মঞ্চ যেন কেঁপে কেঁপে ওঠে। ময়না ২৫শে মার্চের কালরাতের ভয়াবহতায় গ্রামে চলে গিয়েছিলেন; কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। বাবাকে ছাড়াতে থানায় গিয়ে বন্দি হন তিনি। ধীরে ধীরে রাজাকারদের উচ্ছিষ্ট হয়ে পাকিস্তানি হানাদারদের সামরিক ঘাঁটির জালে আটকা পড়েন ময়না। মঞ্চের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে যখন ভোরের আলো পৌঁছে ময়না তখন মঞ্চে দেখতে পান লুঙ্গি, গেঞ্জি ও পড়ে থাকা রক্তাক্ত নারী। ময়নার কষ্ট-আবেগ শারীরিক নানা কসরতে মঞ্চমায়ায় দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। পেছনের পাটাতনের ছিদ্র দিয়ে হাত বেরিয়ে নারীশরীর আটকে রাখা ও মধ্যমঞ্চে শারীরিক নানা ভঙ্গি-অভিব্যক্তিতে প্রতিরাতের অমানবিক গণধর্ষণের রূপরেখা দৃশ্যমান তখন মঞ্চে। বাথরুমের নোংরা দৃশ্যের ইমেজ প্রতীকী মানসিকতার নানা রূপভেদ দর্শকের মনকে নানা অর্থেই হয়তো স্পর্শ করে। গান বাজে – ‘ঢাকায় গণহত্যা, জগন্নাথ হলে গণকবর ঠিক তেমনি এখানে প্রতিরাতে গণধর্ষণ।’ অবর্ণনীয় এক পিশাচীয় উৎসব। এসব দেখে যেন পাগল হয়ে ওঠেন ময়না। তাই  জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে তিনি পালাতে চান।

চরিত্র, ঘটনা ও তার ভাবের রূপগুলি যখন শারীরিক নানা ক্যারিশমায় দৃশ্যরূপ নির্মাণ করছিল, তখন হৃদয় বারবার কেঁদে উঠছিল। একসময় বিকট শব্দ। অবশেষে একদিন অন্ধকার কক্ষের জানালার ফাঁকা দিয়ে ঘোষণা আসে – ‘মা জি বাহার আইয়ে।’

ময়না অবাক হন তাঁদের ‘মা’ বলে সম্বোধন করে কে? এতদিন ‘কুত্তি’ গালাগাল শুনেছেন। বিকাল ৪টায় পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করবে, দেশ স্বাধীন। কিন্তু যে পাশবিক পরিস্থিতির পথ বেয়ে তিনি এসেছেন, সেই জীবন থেকে তাঁকে মুক্তি দেবে কে? তিনি যাবেনই বা কোথায়?

বাড়িতে ফেরার মুক্তির আনন্দের কোরিওগ্রাফিতে মঞ্চ আনন্দে ভরে উঠলেও ময়নার চারদিকে সমাজের ঘৃণা। নাটকে মায়ের সেই অপমান – ‘ফিরে এলি কেন? যে নরকে গিয়েছিলি সেখানেই থাকতে পারলি না?’ বাবার কাছে, সমাজের কাছে নির্যাতনের শিকার নারীরা কি পেয়েছিলেন ন্যূনতম সম্মান? না, তাঁরা পেয়েছেন অসম্মান আর নিগৃহীতের যন্ত্রণা? একটা সম্মানজনক ঠাঁয় কী হবে ময়নার?

শেষে ময়নার ঠাঁই হয় ধানমন্ডির নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে। দীর্ঘদিন পরে ময়নার ভালো ঘুম হয়। চাকরি নেন। ভালোবাসার মানুষ মুক্তিযোদ্ধা হারুনকেই বিয়ে করেন। হারুন চরিত্রে সারওয়ার জাহান উপল চমৎকার অভিনয় করেছেন; কিন্তু ততদিনে দেশ আবার পাল্টাতে শুরু করেছে। আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন ময়না। স্বামী হারুনকে প্রায়ই কে যেন ফোন করে। দৃঢ়চেতা গম্ভীর স্বরের হারুন চুপসে যেতে থাকেন। একসময় হারুন এক দুর্ঘটনায় মারা যান। ময়না উপলব্ধি করেন, তাঁর ভাঙা কপাল এবার ভেঙে শত টুকরো হয়ে গেল আর কখনো জোড়া লাগবে না। কিন্তু মনোবল হারাননি তিনি।

– আমি আবার রাজপথে এসে দাঁড়িয়েছি। আমি একজন  বীরাঙ্গনা। যারা বারাঙ্গনা বানাতে চেয়েছিল তারা আমার স্বামীকে নিয়েছে। কিন্তু আমি বেঁচে আছি গৌতমের মা হয়ে।

নীলিমা ইব্রাহিমের বর্ণিত গল্পগুলির মূল সুর ঠিক রেখে সম্ভবত নাটকীয়তা সৃষ্টি করতে সৈয়দ জামিল আহমেদ কিছুটা পরিবর্তন এনেছেন। তা সংলাপে, গল্পে ও চরিত্রে। তাঁর সব নাটকেই নিরীক্ষাধর্মিতা, শিল্পের প্রতি তাঁর নিষ্ঠা এক নতুন মাত্রায় তাদের নিয়ে যায়। বিষাদসিন্ধু থেকে নিয়ে সন্ত্রাস পর্যন্ত তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের সাক্ষ্য রেখেছেন।

আমি বীরাঙ্গনা বলছি নাটকের আরেকটি চরিত্র ‘মেহেরজান’।  মেহেরজান চরিত্রে মহসিনা আক্তার ভাবে-ভাষায়, চলনে-বচনে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের নৃশংসতার শিকার হওয়ার অভিব্যক্তিগুলি ফুটিয়ে তোলেন।

– আমি গওহরজান বা নগরজানের ঘরানার কেউ। … বাঙালি মেয়ের জীবন পরিচালিত হবে আল্লাহর নির্দেশে! তাহলে এদেশের মৌলবি-মাওলানারা তো বেকার হয়ে থাকবেন, আর রাজনীতিবিদরাই-বা চেঁচাবেন কী উপলক্ষ করে? … পুরুষের লালাসিক্ত জান্তব দৃষ্টি আমি দেখেছি, ভর্ৎসনা অত্যাচার সয়েছি আর তাতেই জীবনের দীর্ঘ আট মাস আমি প্রতি মুহূর্তে অনুভব করেছি, উপলব্ধি করেছি, আমি অঙ্গনা, এই-বা কম কি? নারীজন্ম তো কম কথা নয়।

ঘটনার অনুভব-অনুভূতি আবহের সঙ্গে শারীরিক ভাব-ভাষা-অলংকরণে মুখর তখন মঞ্চ। মঞ্চের পেছনের ছিদ্র দিয়ে তখন অসংখ্য পুরুষ মুখাবয়বের ছবি দেখা যায়। ভয়ংকর সে-দৃশ্য! মঞ্চে মেহেরকে দেখতে পাওয়া যায় প্রায় সাদা শাড়ি পরা। কাপাসিয়ার মেয়ে ফিরে যান অতীতে।

– হ সাব, এইডাই মেহেরজানগো বাড়ি, বহুত খুব সুরত লেড়কি।

আতঙ্কিত মেহেরকে দরজা ভেঙে যখন পাকিস্তানিরা তুলে নিয়ে যায় তখন অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া বালিকা মেহের কি বোঝেন জীবন কিংবা রাষ্ট্রের হিসাব? সংগীতের অপূর্ব নিনাদ আর অভিনেত্রীদের কোরিওগ্রাফিতে সে-বেদনা দৃশ্যমান। অন্ধকার প্রকোষ্ঠে চলে নির্মম নির্যাতন। রাতের প্রথম প্রহর কাঁদতে হতো পশুদের অত্যাচারে, বাকি রাত মনের কষ্ট আর দেহের যন্ত্রণা ভোগ করে। কোরিওগ্রাফির বেদনার্ত চলন আর মেহেরজানরূপী মহসিনার হাঁটার ভঙ্গির মধ্যে দর্শক যেন সে-ছবির রূপই দেখতে পান। আবেগপূর্ণ নানা মিউজিকের সুরে দর্শকমন বেদনার্ত হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে গণজাগরণমূলক নানা সংগীতও দর্শককে উদ্দীপ্ত করে তোলে। মেহেরজান যেন অশরীরী কোনো উপস্থিতি। তবুও দেহটার মুক্তি নেই। পরনে শাড়ি দেওয়া হয় না। যদি আবার গলায় বেঁধে আত্মহত্যা করেন। শার্ট কিংবা গেঞ্জি টাইপের পোশাক। মহসিনার আবেগপূর্ণ সংলাপ অনুরণন, প্রক্ষেপণ ও আলো-সংগীতের অপূর্ব ঐকতানে যেন আবেগের খেলা। হঠাৎ বিকট শব্দ। বয়স্ক হাবিলদার জানায় –

– তোমার দেশেই আমার কবর হবে। আমরা হেরে গেছি।

– খাঁ সায়েব আমাকে শাদি করো, আমি তোমাকে মুক্তির হাত থেকে বাঁচাবো।

লায়েক খান বেঁচে যায়। মেহেরজান বাবা-মায়ের কাছে ফেরত যেতে পারতেন, কিন্তু তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তাতে ন্যূনতম মর্যাদাটুকু কখনো থাকবে না। পুনর্বাসন সংস্থা এগিয়ে এলেও পাকিস্তান যাওয়াতেই ইচ্ছুক কারণ ওখানে পতিতাবৃত্তিই করুক আর রাস্তাই ঝাড়ু দিক ‘লোকে আমাকে চিনবে না’।

মেহেরজান স্বেচ্ছায় সে-সিদ্ধান্ত নিলেও অনেকের পরিবারই বীরাঙ্গনাদের গ্রহণ করেননি। ঢাকা সেনানিবাসে স্বামী এসে শাড়ি উপহার দিয়ে গেছেন। কিন্তু ঘরে তুলে নেননি। মেহেরজান পাকিস্তানে গিয়ে ভূমিষ্ট হওয়া শিশুর নাম রাখেন তাজ খান। আওয়ামী লীগের নেতার নাম। কিন্তু মেহের কী পাকিস্তানে স্বামীর সংসারে সুখী? না, হতে হয় নিঃগৃহীত। একসময় বাংলাদেশে এসে আবেগে আপ্লুত হয়ে পরিবারের কাছে গেলেও হতে হয় মানসিক লাঞ্ছনার শিকার। তবুও থেমে নেই মেহের। নীলিমা ইব্রাহিম তাঁকেই জীবন-রণাঙ্গণে বীর হিসেবে ‘বীরাঙ্গনা’র সম্মান দিতে অকুতোভয়। আলো-আঁধারি দৃশ্য নির্মাণের খেলায় মেহেরজান দর্শকের মুখোমুখি দাঁড়ান। আমি একজন বীরাঙ্গনা। সমাজের জুলুমবাজির ভয়ে আমি তাদের ঘরে যেতে পারিনি। তবে আপনারা বিশ্বাস করতে পারেন আপনাদের দৃষ্টিতে আমি বীরাঙ্গনা না হলেও নিঃসন্দেহে বারাঙ্গনা নই। একজন যুদ্ধজয়ী বীরাঙ্গনা হিসেবে বাংলাদেশ ছুঁয়ে এসেছি। তা কম কিসে।

গানের কথা সেই সম্ভ্রমকেই স্মরণ করিয়ে দেয় – ‘আমি বীরাঙ্গনা, আমি তোমার মা।’ 

সৈয়দ জামিল আহমেদ গল্প, অভিনয়, আলো-সংগীত ও কোরিওগ্রাফির দৃশ্যবুননে মানবিক হৃদয়ের অতলকে স্পর্শ করতে চেয়েছেন। নাটকটি বাস্তববাদী চরিত্রাভিনয় রীতির। আত্মকথন হিসেবে বর্ণনাত্মক ধারাটি নিয়েছেন নির্দেশক। তবে নান্দনিক নানা মাত্রা, বিশেষত মঞ্চে অভিনেতৃদের দেহের ভঙ্গিমা, চলার গতি, দাঁড়ানোর রেখা-ভঙ্গি, দেহযন্ত্রের নানা ভাষা, চলনের নানা মাত্রা ভালোলাগার স্পর্শে বেঁধে রাখে। আর সংলাপে কোনোখানে ঝোঁক দিয়ে দর্শককে কী অর্থ বোঝাতে হবে তা প্রত্যেক অভিনেতৃর মধ্যেই স্পষ্ট। আবেগের ওঠানামায় অপূর্ব অভিব্যক্তি। সমস্তটাই ব্লকিং বা কোরিওগ্রাফি নির্ভর। বর্ণনাত্মক ধারায় এই বীরাঙ্গনা নিজের জীবনের ঘটনা বর্ণনা করলেও চরিত্রাভিনয় বাস্তবতায় ঠিকরে ওঠে। এ-নাটকে নাট্যদ্বন্দ্বের জায়গায় মানসিক দ্বন্দ্ব ও অভিঘাতই গুরুত্ববহ হয়ে উঠেছে। সহজ-সরল পোশাক। ইতিহাস-আশ্রিত বাস্তবের ঘটনা হলেও নানা মাত্রা নানা রঙে নানা রূপে তার বহুমাত্রিক দৃশ্যরূপ।

এ-নাটকে আলো নাট্যচরিত্রের মতো কখনো কখনো স্বতন্ত্র অর্থ প্রকাশ করেছে। লাইটের অ্যাঙ্গেলগুলি চরিত্রের ভাব স্পষ্ট করতে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকায় অবতীর্ণ। সৈয়দ জামিল আহমেদ সবসময় মঞ্চে একধরনের মায়াজাল তৈরি করেন। রেকর্ডেড মিউজিকের পাশাপাশি এ-নাটকে অর্কেস্ট্রার মতো লাইভ মিউজিক ইউনিট কাজ করেছে। রেকর্ডেড মিউজিকগুলি ইউরোপীয় আবেগ বাস্তবতা-আশ্রিত। মিউজিকের নিনাদের সঙ্গে চরিত্রের কথোপকথন দর্শকের আবেগকে স্পর্শ না করে পারে না।

সৈয়দ জামিল আহমেদের নাটকে ভান-ভণিতা কিংবা হালকা রস-আহ্লাদের রূপ সাধারণত দেখা যায় না। নাটক যে অত্যন্ত সিরিয়াস বিষয় তা তিনি সবসময়ই দেখিয়ে  থাকেন। আর কঠোর শারীরিক অনুশীলনের ছাপ আছে প্রতিটি চরিত্রে। চরিত্র নির্মাণে নানা লেয়ার চরিত্রের সাবজেক্টকেই সুদৃঢ় করেছে দর্শকের সামনে। বীরাঙ্গনা নিয়ে সমাজের হীনম্মন্যতার একধরনের জবাব দিয়েছে নাটকটি।

নাটকে আরো অভিনয় করেছেন – বুড়ী আলী, শ্রাবণী ফেরদৌস, আরমীন মূসা, মো. সোহেল রানা, সিফাত নওরীন বহ্নি, জৌপারী লুসাই, রিয়াসাত সালেকিন ঋত্বিক ও উম্মে আইমান। ড্রামাটার্গ ও পোশাক – মহসিনা আক্তার, মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনা – সৈয়দ জামিল আহমেদ। সংগীত পরিবেশনা – ঘাসফড়িং কয়্যার-মৈনাক কানুনগো, ওমর বিন পারভেজ, জিষ্ণু হায়দার, আতকিয়া সাদিয়া রহমান, সানোয়ারা সেহরী, সামিরা তাসনিম লাবণ্য, উম্মে আইমান, প্রাপ্তি মজুমদার গল্প ও মুশফিকুর রহমান চৌধুরী।