জলের অক্ষরে লেখা 

পর্ব : ১৭

অবন্তির যাওয়ার দিন ঘনিয়ে এলো। তার আগে একদিন অংশুর বাসায় আড্ডা হলো খুব। বিকেলেই সবাই হাজির হয়ে গিয়েছিল। ঋভু অফিস থেকে আগেভাগে বেরিয়ে অবন্তিকে নিয়ে এসেছিল। সন্ধ্যার পর সাততলার গেস্টরুমে পানাহার আর আড্ডা চললো ঘণ্টাতিনেক ধরে। তারপর নিচে নেমে ডিনার সারলো সবাই। অপলা নিজেই রেঁধেছে আজকে। দেশি কই মাছের দোঁপিয়াজি আজকের প্রধান মেন্যু। এই দুর্লভ মাছ কোত্থেকে যে জোগাড় করলো অংশু, কে জানে! এখন তো সবই হাইব্রিড, চাষ করা মাছ, উৎপাদন বেড়েছে, দেশের প্রোটিনের চাহিদা মিটছে; কিন্তু স্বাদ আর পুষ্টিগুণ দুটোই হারিয়ে গেছে। দেশি কইয়ের দোপিঁয়াজি তাই অমৃতের মতো লাগলো। সঙ্গে অবশ্য আরো অনেক পদের সমাহার। কিন্তু মদ্যপানের পর খাওয়ার মুড তেমন নেই কারো। কেবল অপলার চমৎকার রান্নার সুবাদেই অনেকটুকু খাওয়া গেল।

খাওয়াদাওয়ার পর সবাই বেরুলো। রাত প্রায় এগারোটা। রাস্তা মোটামুটি খালিই বলা যায়। অংশু ড্রাইভিং সিটে, তার পাশে অপলা, পেছনে ঋভু আর অবন্তি। অংশু ঘুরে ঘুরে নিজের নকশায় তৈরি করা ভবনগুলো দেখাতে লাগলো। প্রতিটা দেখে অবন্তি মুগ্ধ। এত রাতে সব ভবনের ভেতরে ঢোকার উপায় নেই, বাইরে থেকে যতটুকু দেখা যায় তাতেই বোঝা যায়, এগুলো অন্য ভবনগুলোর মতো গড়পরতা নয়, বিশেষ কিছু। বিশেষ করে, প্রতিটি ভবনের চারপাশে কিছু খালি জায়গা রেখে সেখানে গাছ লাগানো হয়েছে দেখে আরো মুগ্ধ হলো অবন্তি। বললো, দেখে সাধ মিটলো নারে অংশু। দিনের বেলায় এসে দেখা উচিত ছিল।

– দেখার দিন ফুরিয়ে গেল নাকি? আবার তো আসছিসই।

– হ্যাঁ, আসছি। এখন আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি, আসছি। ওখানে পড়ে থাকার মানে হয় না।

– ঠিক। দেশের সুন্দরী মেয়ে বিদেশিদের চোখের ক্ষুধা মেটাবে, আর আমরা অভুক্ত থাকবো …

– ফাজলামো করিস না তো!

– আচ্ছা, করবো না।

– শোন, তোর এই ডিজাইনগুলো দেখতে দেখতে কী মনে হলো জানিস?

– কী?

– মনে হলো, তোর মতো যদি সবাই এমন করে ভাবতো, তাহলে শহরটা এমন কংক্রিটের জঞ্জাল হতো না। আগে কী সুন্দরই না ছিল শহরটা। সব জায়গায় সবুজ চোখে পড়তো।

– হ্যাঁ। চোখের সামনে শহরটা বদলে গেলরে! কিছুই করতে পারলাম না। এখন আর বোঝার উপায় নেই, একসময় প্রায় প্রতিটি বাড়িতে আর রাস্তায় গাছ ছিল। – দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো অংশু।

– একা একা আর কতটুকুই বা করা যায়? তুই তবু তোর সাধ্যমতো চেষ্টা করেছিস, সেটাই বা কজন করে?

এইভাবে আলাপ চললো। অবন্তির ফিরতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু রাত অনেক হয়েছে, না ফিরেও উপায় নেই। ফেরার আগে  গাড়ি থামিয়ে টং দোকানে দাঁড়িয়ে চায়ে টোস্ট বিস্কুট ভিজিয়ে ভিজিয়ে খেলো তারা, আরো কিছুক্ষণ দুষ্টুমি আর খোঁচাখুঁচি চললো পরস্পরের ভেতরে। তারপর অংশু আর অপলা চলে গেল বাসায়। ঋভু আর অবন্তিও এসেছিল ওদের সঙ্গে, কিন্তু ওপরে গেল না। ঋভু নিজের গাড়ি রেখে গিয়েছিল এখানে, সেটি বের করে অবন্তিকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য রওনা হলো।

একটা অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগলো ঋভুর। মনে হলো, এই শেষ, অবন্তির সঙ্গে আর কখনো তার দেখা হবে না। কোনো যৌক্তিক কারণ নেই এরকম মনে হওয়ার, তবু ফিরে ফিরে ওই একই কথা ভাবতে লাগলো সে। একসময় নিজের ওপর বিরক্ত হয়ে প্রসঙ্গ পাল্টালো। বললো, একটা কথা তোমাকে কখনো বলা হয়নি সুসান, বলার প্রয়োজনও হয়নি, কিন্তু এখন বলা দরকার।

– বলো, শুনি।

– আমার প্রথম বিদেশ ভ্রমণের কথা মনে আছে? সেই যে নেপালে গেলাম?

– হ্যাঁ, আছে। কাউকে না জানিয়ে গিয়েছিলে।

– হ্যাঁ। মা’র ওপর অভিমান করে …

– এতদিন পর ওই প্রসঙ্গ কেন?

– ওখানে এক ইতালিয়ান মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল।

– তাই নাকি? তারপর?

– বন্ধুত্বও হয়েছিল।

– শুধু বন্ধুত্ব? নাকি আরো কিছু?

– না, শুধু বন্ধুত্ব নয়। আমরা একসঙ্গে ছিলাম প্রায় এক সপ্তাহ।

অবন্তি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো।

একসময় ঋভু জিজ্ঞেস করলো, কিছু বলছো না যে! কী ভাবছো?

– সময়টা মেলাচ্ছিলাম। ওই সময় আমি সেই লেখকের সঙ্গে…

– ও! হ্যাঁ, সম্ভবত একই সময়ে দুটো ব্যাপার ঘটেছিল।

অবন্তি হেসে ফেললো – তাহলে তো কাটাকাটি হয়ে গেল, নাকি বলো?

– কী জানি!

– কী নাম ছিল মেয়েটার?

– আরিয়ানা।

– বাহ্। সুন্দর নাম। কিন্তু ওই প্রসঙ্গ হঠাৎ এলো কেন?

– মেয়েটা অনেকদিন পর আমাকে খুঁজে বের করেছে, যোগাযোগ করেছে।

– তাই নাকি? কীভাবে খুঁজে পেল?

– জানি না। তবে ও জানিয়েছে, একবার বাংলাদেশে আসতে চায়।

– তাই? কবে আসবে?

– সম্ভবত আগামী মাসে।

– ইস্! এ মাসে এলে তো ওর সঙ্গে আমার দেখা হতে পারতো।

ঋভু যে ইচ্ছে করেই দুজনের দেখা হওয়ার সম্ভাবনা ঠেকিয়েছে, সে-কথা আর বললো না। অবন্তিই ফের বললো, ঠিক আছে, আসুক না। এ আর এমন কী?

– ও আসার পর তুমি জানলে কষ্ট পেতে, তাই আগেই জানালাম আর কী!

অবন্তি হেসে বললো, সাবধান থেকো। ওই মেয়ে যেন আবার তোমাকে নিয়ে পালিয়ে না যায়।

– হা-হা-হা …

– হেসো না। নতুন করে যদি আবার প্রেম শুরু হয়ে যায়…

– তাই কি আর হয়? এত বছরেও হলো না, আর এই বয়সে!

– কখন যে কী হয়ে যায়, কিছুই বলা যায় না।

– মানে?

– মানে আর কি! আমিও কি দেশে ফেরার আগে জানতাম যে, তোমার সঙ্গে সম্পর্কটা এদিকে মোড় নেবে!

– তা অবশ্য ঠিক। তোমার-আমার ব্যাপারটা একটু অদ্ভুতভাবেই ঘটে গেল।

– অংশুকে বলে যেতে হবে। ও যেন তোমাকে পাহারা দিয়ে রাখে।

– হা-হা-হা … ও দেবে আমাকে পাহারা? পারলে এখনই বিয়ে করিয়ে দেয়। পাত্রী একটা হলেই হলো।

– কী সর্বনাশ! যে-কোনো পাত্রী? আমি তো ভেবেছিলাম, আমাকে ছাড়া তোমার পাশে ও আর কাউকে ভাবতেই পারবে না।

– ওকে কিছু ঘুষটুস দিয়ে যেতে পারো। অন্তত কনফার্ম করে যেতে পারো যে, তুমি ফিরে আসবে। তাতে যদি শান্ত হয়।

– হুম। দেখি দু-একটা চুমুটুমু দিয়ে বশ করা যায় কি না!

– চুমু আবার কেন?

– ঘুষ দিতে বললে না?

– একদম মেরে ফেলবো। পরপুরুষের দিকে তাকালেও চোখ গেলে দেবো।

– কী ডাকাতমার্কা কথাবার্তা! নিজে অন্য মেয়েদের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করে বেড়াবে আর আমি কিছু করলেই দোষ!

এইসব দুষ্টুমি করতে করতে পথ ফুরালো। বাসার গেটে নেমে অবন্তি বললো, ভেতরে আসবে না?

– না। এত রাতে না গেলাম।

– পরশু রাতে আমার ফ্লাইট। এর মধ্যে আর দেখা হবে না?

– কালকে তোমার কী প্ল্যান?

– গ্রামের বাড়িতে যাবো। সকালে গিয়ে সন্ধ্যায় ফিরবো।

– বাড়িতে? হঠাৎ বাড়িতে কেন?

– মা-বাবা ঘুমিয়ে আছেন ওখানে। আসার পর একবারও যাইনি।

– ও! ঠিক আছে তাহলে। পরশুদিন?

– পরশু রাতে তো ফ্লাইট। খুব বেশি গোছগাছের কিছু নেই। তবু বেশিক্ষণ বাসার বাইরে থাকতে চাই না।

– তাহলে তো দেখা হচ্ছে না আর।

– পরশু খুব সকালে এসে আমাকে নিয়ে যেতে পারবে?

– খুব সকালে মানে?

– ভোরে। বেলা ওঠার আগে।

– অত ভোরে গিয়ে কী করবে?

– এখনই বলবো না। পারবে কি না বলো।

– পারবো।

– ঠিক আছে, এসো তাহলে। বেশিক্ষণ থাকবো না। ফিরে এসে সবার সঙ্গে নাস্তা করবো। তুমিও থাকবে সেখানে।

– আচ্ছা।

– তাহলে আজকে বিদায় দাও। চুমু দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু রাস্তায় দাঁড়িয়ে …

– ওটা পাওনা রইলো। পরশু দিয়ো।

– আচ্ছা। শুভ রাত্রি।

– শুভ রাত্রি।

ফিরে আসতে আসতে ঋভুর মনে হচ্ছিল, হয়তো এটাই সুসানের সঙ্গে শেষ নৈশভ্রমণ। যদিও জীবনের কোনো সম্ভাবনাই ফুরিয়ে যায় না, অবন্তি যে ফিরে আসবে সে ব্যাপারেও সে মোটামুটি নিশ্চিত, তবু মনে হচ্ছে, কিছু একটা প্যাঁচ লেগে যাবে, কিংবা হয়তো সে নিজেই তখন থাকবে না। এরকম মনে হওয়ার কোনো কারণ সে খুঁজে পেল না; কিন্তু ওই যে, তার জীবন যে সরলরেখার মতো নয়, কোনোকিছুই ঠিকঠাক মতো ঘটে না, সেজন্য মনের মধ্যে স্থায়ী দাগ পড়ে গেছে। কিছুতেই সহজ চিন্তা করতে পারে না সে।

মন খারাপ লাগছে ঋভুর। মনে হচ্ছে, সুসানার সঙ্গে চিরবিচ্ছেদের সময় ঘনিয়ে এসেছে। সেই মন খারাপ ভাব রইলো পরের দিনও। সারাদিন কারো সঙ্গে কথাবার্তা বিশেষ বললো না। অংশুর সঙ্গেও না।

পরদিন ভোরে অবন্তিকে আনতে গেল ঋভু। অত ভোরে ওঠার অভ্যাস নেই তার, সে আসলে রাতে ঘুমায়ইনি। গিয়ে দেখলো, অবন্তি একটা শুভ্র-সাদা শাড়ি পরেছে। ভোরের নরম আলোয় তাকে লাগছে অলৌকিক এক মায়াবী দেশের রাজকন্যার মতো, যাকে কেবল কল্পনাই করা যায়, বাস্তবে পাওয়া যায় না।

ঋভুর মুগ্ধ দৃষ্টি চোখ এড়ালো না অবন্তির। মৃদু এবং লাজুক একটু হাসলো সে। বললো, চলো।

ভোরের ঢাকা একেবারে অচেনা রূপে ধরা দিয়েছে দুজনের কাছেই। সূর্য ওঠেনি, স্ট্রিট লাইটগুলোও নেভেনি এখনো, তবু স্নিগ্ধ আলোয় ভরে আছে পৃথিবী। মৃদু-শীতল একটা হাওয়া বইছে, গাড়ির গ্লাস তুলতে দেয়নি অবন্তি, হাওয়ায় তার চুলগুলো এসে পড়ছে মুখের ওপর, আর সে আলগোছে তা সরিয়ে দিচ্ছে বারবার, যেন এক স্বপ্নদৃশ্য। ঋভু আড়চোখে তাকিয়ে দেখছিল, দুজনেই চুপচাপ, যেন কথা না বলেও পরস্পরের ভেতরে প্রবাহিত হচ্ছিল কথার স্রোত।

গাড়ি এসে বাসার গেটে থামলে অবন্তি বললো, বাগানে চলো। একদিনও দিনের বেলায় তোমার বাগান দেখা হয়নি।

ঋভু এতক্ষণে বুঝলো। অবন্তির বৃক্ষপ্রেম আছে। গাছ দেখলেই সে থমকে দাঁড়ায়। এ-বাসায় কয়েকদিন এসেও ভালো করে দেখা হয়নি বাগানটা। সেজন্য, যাওয়ার দিন, এই ভোরবেলায় এসেছে। কিন্তু অবন্তির বোধহয় অন্য কিছুও মনে ছিল। সে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো শিউলি, বকুল, বেলি, টগর, কাঠগোলাপ ফুলগুলো। কেন শরতে ফোটে সাদা ফুলেরা, আর বসন্তে রঙিন? ঋতুর সঙ্গে ওদের সম্পর্ক কী?

টুকটাক কথা হচ্ছে দুজনের। জরুরি কিছু নয়, বলার জন্য বলা। নীরব থাকতেই যেন ভালো লাগছে এই ভোরবেলায়। একসময় অবন্তি বললো, একটু নীলুর কাছে যাবো।

– হুম, চলো।

নীলুর কবরের ওপর একটা বকুল গাছ। অনেক বছরের পুরনো। এই ভোরবেলায় ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে নীলুর কবর। অপার্থিব এক দৃশ্য। অবন্তি গিয়ে কবরের পাশে বসলো, হাত বুলিয়ে আদর করলো অনেকক্ষণ ধরে, ফিসফিসিয়ে বললো, শান্তিতে আছিস আপু। পৃথিবীটা বড় যন্ত্রণার জায়গা।

অবন্তি যখন বললো, চলো যাই এবার। ঋভু কিছুই বললো না। একটা ঘোরের মধ্যে আছে যেন সে। কেন যে অবন্তি এলো, কেনই-বা নীলুকে আদর করলো, বুঝে উঠতে পারছে না। ফিরে যেতে যেতে অবন্তি জিজ্ঞেস করলো, অংশু এয়ারপোর্টে যাবে সি-অফ করতে। তুমি যাবে না?

– উঁহু।

– কেন?

– বিদায় দিতে ভালো লাগে না।

– আচ্ছা।

তারপর কিছুক্ষণ আবার চুপচাপ।

– আমি কিন্তু ফিরে আসবো। – অবন্তি একসময় বললো মৃদুস্বরে।

– হুঁ।

– আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে গেলাম। তোমারটা জানা হলো না।

– জানাবো। আরেকটু সময় লাগবে আমার।

– আচ্ছা। আপত্তি নেই। একসঙ্গে থাকতে না পারলেও আসবো আমি। তুমি কোনো চাপ নিয়ো না।

– হুঁ।

অবন্তি দেখলো, ঋভু গভীর কোনো চিন্তায় মগ্ন, কথা বলতে চাইছে না। সেও আর কিছু বললো না। বাসার গেটে নামিয়ে দিয়ে ঋভু বললো, আসি তাহলে। অবন্তি একবারও বললো না, আমাদের তো একসঙ্গে নাস্তা করার কথা ছিল!

গাড়ি থেকে নেমে অবন্তিকে জড়িয়ে ধরলো ঋভু। বললো, ভালো থেকো। আশা করি আবার দেখা হবে।

তারপর ফের গাড়িতে উঠে চলে গেল।

অবন্তি চলে যাওয়ার পর বেশ খালি খালি লাগছিল ঋভুর। অবশ্য সেই অনুভূতি জেঁকে বসার সুযোগ পেল না। দু-সপ্তাহ পর আরিয়ানা আসছে, তার আগেই ঋভুর সঙ্গে বসে অংশু ওর পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ফেলতে চায়। শুভও ইতিমধ্যেই যোগ দিয়েছে টিমে। খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলো বুঝে নিচ্ছে, নিজেও কিছু আইডিয়া শেয়ার করছে।

একদিন মানিকগঞ্জ গিয়ে ঘুরে এলো ওরা চারজন। অংশু, অপলা, ঋভু আর শুভ। অবশ্য মানিকগঞ্জ বললে যতটা দূর শোনায়, জায়গাটা তত দূরে নয়। ধলেশ^রীর পাড়ে, ঢাকা থেকে যেতে মোটে ঘণ্টাখানেক সময় লাগে। ঋভু ভেবেছিল, একটা খোলা পতিত বা ফসলি জমি দেখতে পাবে। কিন্তু গিয়ে বেশ অবাক হলো। এক একরের মতো জমি, বড় প্রতিষ্ঠান করার মতো যথেষ্ট না হলেও অন্তত শুরু করার মতো তৈরি হয়েই আছে। চারদিকে সীমানা দেয়াল, এক পাশে ছোট একটা টিনের ঘর, সেখানে একজন কেয়ারটেকার, ভেতরের জমিতে অনেক রকম গাছপালা, বিভিন্ন ধরনের শাকসবজির চাষও করেছে কেয়ারটেকার মজনু মিয়া। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন মনোরম পরিবেশ। পাশেই ছোট একটা নদী, ধলেশ^রী। পঞ্জিকার পাতায় শরৎকাল হলেও বর্ষা এখনো বিদায় নেয়নি। নদীটি পূর্ণযৌবনা, তার সীমানা উপচে পানি গিয়ে ভাসিয়ে দিয়েছে আশেপাশের নিচু জমি। এরকম পরিবেশে এমনিতেই মন আর্দ্র আর কোমল হয়ে ওঠে। ঢাকাকে মনে হতে থাকে নিষ্ঠুর এক শহর। ঋভুর মনে পড়লো, সেই ছোটবেলার পর নিজের গ্রামের বাড়িতে আর যাওয়া হয়নি কখনো। হবেই বা কীভাবে? কোনো টান তো নেই, নেই কোনো সম্পর্কও। যতদিন বাবা ছিলেন, কিছু খোঁজখবর পাওয়া যেত। সেই সুযোগও আর হয় না এখন।

দিনটি ছিল মেঘলা। নদীর দিক থেকে ভারি সুন্দর একটা হাওয়া বইছিল। আশ্বিনের বিশ্রী গরমও পরাস্ত হয়ে গিয়েছিল সেই মেঘ আর নদীবাহিত হাওয়ার কাছে। মনটা এমনিতেই ফুরফুরে হয়ে ওঠে এরকম পরিবেশে। তাদেরও তাই হলো। ঘাসে বসে আড্ডা হলো, হাসি-ঠাট্টা-দুষ্টুমি হলো, যদিও শুভ ভাই থাকার কারণে মুখ খারাপ করার সুযোগ পেল না কেউ। দুপুর হতে-না-হতে খাবারের জন্য ডাক পড়লো। নদীর ভেঁশাল থেকে পাঁচমিশালি মাছ কিনে এনেছিল মজনু মিয়া, বাগান থেকে তুলেছে তাজা শাকসবজি। মজনু মিয়ার বউ পাকা রাঁধুনি, রান্না দারুণ সুস্বাদু। লাল চালের ভাত আর মজাদার সব তরকারি পেয়ে সবাই প্রতিদিনের চেয়ে বেশিই খেল। এখন একটু বিছানায় গড়াগড়ি করতে পারলে ভালো লাগতো। সে উপায় নেই। বসে বসেই কিছুক্ষণ আড্ডা হলো। তারপর অংশু তার কাজ শুরু করলো। একটা আর্ট পেপার বিছিয়ে তার ওপরে খসড়া পরিকল্পনাটা ছবি এঁকে বোঝাচ্ছে ও, আঙুল তুলে দেখিয়ে দিচ্ছে কোথায় হবে শিশুদের থাকার জন্য ভবন, তার পাশে থাকবে আলাদা বৃদ্ধনিবাস; কিন্তু দুই ভবনের ভেতরে প্রতিটি ফ্লোরে যাওয়া-আসার রাস্তা থাকবে। মানে, এক ভবন থেকে বেরিয়ে অন্যটিতে যাওয়ার দরকার হবে না, ভেতর দিয়েই যাওয়া যাবে। যেন বাচ্চারা সহজেই যেতে পারে ওখানে কিংবা বৃদ্ধরা আসতে পারেন এখানে। একটা ছোট্ট স্কুলঘর থাকবে, থাকবে স্বাস্থ্যকেন্দ্র, প্রাথমিক চিকিৎসাটা যেন দ্রুত দেওয়া যায়। ডাক্তার, নার্স, স্কুলের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থাকার জন্য আরেকটা ভবন।

অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিনাটি বোঝাচ্ছিল অংশু। অন্য সবাই প্রশ্ন করে, মতামত দিয়ে আরো পরিষ্কার হয়ে নিচ্ছিল। একসময় ঋভু উঠে পড়লো। ঘুম ঘুম লাগছে। একটু আড়মোড়া ভাঙা দরকার। অংশু-শুভ মগ্ন হয়ে আছে, খেয়ালই করলো না। অপলা দেখলো কি না তাও বোঝা গেল না। হাঁটতে হাঁটতে নদীর পাড়ে একটা গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ালো ঋভু। অবশ্য মেঘলা দিন বলে রোদের তীব্রতা নেই, তবু গাছের ছায়ায় একটা আলাদা অনুভূতি তো হয়ই। নদীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ তার মনে হলো, সমগ্র জীবনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। শৈশব থেকে কৈশোর, তারুণ্য থেকে যৌবন, তারপর এই পড়ন্ত বেলা … মুহূর্তেই যেন সবটা দেখে এলো সে।

কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল জানে না, হঠাৎ কাঁধে মৃদু স্পর্শ পেল ঋভু। তাকিয়ে দেখলো, অপলা দাঁড়িয়ে। মৃদু হেসে বললো, কখন এসেছ?

– অনেকক্ষণ। বুঝতে পারেননি, না?

– উঁহু।

একটুক্ষণ চুপ করে রইলো অপলা, তারপর বললো – আপনার ধ্যান ভাঙলাম। স্যরি।

– ধ্যান?

– হুঁ।

– আরে না। ধ্যানট্যান কিছু না।

– ধ্যানই। আমি পাশে এসে দাঁড়ালাম, টেরই পেলেন না। কী ভাবছিলেন অত?

– কী যে ভাবছিলাম, মনে নেই। একসঙ্গে অনেক কিছু।

– ফেলে আসা দিনের কথা?

– হ্যাঁ। জানো, কোথায় যেন পড়েছিলাম, ‘মানুষ সম্পর্ক নিয়ে বাঁচে না, বাঁচে সম্পর্কের স্মৃতি নিয়ে।’ এত অদ্ভুত লেগেছিল কথাটা।

– আমিই পড়িয়েছিলাম আপনাকে।

– তাই? কোথায় পড়েছি বলো তো?

– একটা উপন্যাসের উৎসর্গপত্রে।

– কোন উপন্যাস?

– অন্ধ জাদুকর।

– ও হ্যাঁ। মনে পড়েছে। তিন বন্ধুকে উৎসর্গ করেছিলেন লেখক। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, বন্ধুদের কেন লিখেছিলেন তিনি এই কথা! তাদের সঙ্গে সম্পর্কটা কি স্মৃতি হয়ে গিয়েছিল?

– জিজ্ঞেস করলেই পারেন!

– কাকে?

– লেখককে।

– তাঁকে পাবো কোথায়?

– পাওয়া কঠিন নাকি? বেঁচে আছেন এখনো, এই শহরেই আছেন …

– তুমি চেনো তাঁকে?

– হ্যাঁ, চিনি।

– চেনো! চিন্তার বিষয়!

– কেন?

– লেখকরা তো সন্দেহজনক চরিত্র।

– সন্দেহজনক হবেন কেন? আশ্চর্য!

– মেয়েরা অহরহ লেখকদের প্রেমে পড়ে। সেটা কি এমনি এমনি?

হাসিতে ভেঙে পড়লো অপলা।

– হাসছো কেন? – জিজ্ঞেস করলো ঋভু।

– খুব ঈর্ষা হচ্ছে, না?

– তা তো হচ্ছেই।

– কেন ঈর্ষা হবে? আমি তাঁর প্রেমে পড়লে আপনার কী?

– আমার কী মানে? তুমি আমাকে ছেড়ে উনার প্রেমে পড়বে কেন?

– আপনি যেন খুব কাছে রেখেছেন!

– রাখতেই তো চাই।

– সেরকম প্রমাণ তো দেখিনি কখনো!

– প্রমাণ দেবো? এক্ষুনি?

– কী প্রমাণ দেবেন শুনি?

– এক্ষুনি চুমু দেবো।

– দেন না, কেউ না করেছে?

– সত্যিই দেবো?

– আমি কীভাবে বলবো?

– যদি কেউ দেখে ফেলে?

– কে দেখবে? এখানে কেউ আছে নাকি? আর দেখলেই বা কী!

– দেখলে কিছু না?

– নাহ্!

– যদি অংশু দেখে ফেলে?

– দেখুক!

– কিছু বলবে না তোমাকে?

– উঁহু। ও জানে!

– কী জানে?

– তা তো বলবো না। – ঠোঁটে রহস্যময়ীর মতো হাসি নিয়ে বললো অপলা। মাঝেমধ্যেই রাতে ঋভুকে নিয়ে দুষ্টুমি করতে করতে অংশু যে বিছানায় ঝড় তোলে, সে-কথা তো আর বলা যায় না!

– আহা বলো না!

– উঁহু। আজকে বলা যাবে না।

– তাহলে কবে বলবে?

– এসব বলতে হয় বিশেষ পরিস্থিতিতে।

– সেটা আবার কী?

– থাক, আপনাকে তা আর বুঝতে হবে না। 

ঋভু আচমকা অপলার হাত ধরে টান দিয়ে নিজের বুকের কাছে নিয়ে আসে। অপলা প্রস্তুত ছিল না, কিন্তু আপত্তিও করে না। ঋভুর চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকে। ঋভু ঠোঁট নামিয়ে আনে অপলার অধরে, অপলার শ^াস-প্রশ^াস গাঢ় হয়ে ওঠে, তার হাত দুটো আঁকড়ে ধরে ঋভুর পিঠ।

ঋভু ঠোঁট উঠিয়ে কানে কানে জিজ্ঞেস করে, একদিন আসবে আমার বাসায়?

– বাসায়?

– হ্যাঁ। বাসায়ই তো ভালো।

– হুম।

– হুম মানে কী? আসবে?

– আসবো।

– কবে আসবে?

– আপনিই বুঝেশুনে জানাবেন, কবে এলে ভালো হয়।

– আচ্ছা।

– এখন ছাড়েন। খোলা মাঠের মধ্যে এরকম জড়াজড়ি ভালো না …

– খুব তো সাহস দেখাচ্ছিলে!

– সাহস কি এখনো কম দেখালাম?

– তা ঠিক। একটা কথা জিজ্ঞেস করি?

– নিশ্চয়ই।

– এই যে আমি সুসানের সঙ্গে প্রেম করছি, তোমার ঈর্ষা হয় না?

– একেবারেই হয় না, তা বলবো না। কিন্তু আপনি যে একা একা থাকেন সেটাও ভালো লাগে না। সেজন্য অবন্তি আপুর উপস্থিতি আমার ভালোই লেগেছে।

– আরিয়ানা নামে আমার এক বন্ধু ছিল, জানো?

– হ্যাঁ, সেদিনই শুনলাম।

– ও দু-সপ্তাহ পর আসছে, তা জানো?

– হ্যাঁ, জানি।

– তোমার ঈর্ষা হবে না?

– ঈর্ষা করে লাভ কী? আপনি এমন একজন মানুষ যে সব মেয়েই আপনার জন্য আকর্ষণ বোধ করবে।

– সব মেয়েই?

– হ্যাঁ।

– কেন? কী আছে আমার ভেতর?

– সেটা তো আপনাকে বোঝানো যাবে না।

– বলোই না, শুনি।

– আপনারা কোনো কোনো মেয়েকে আবেদনময়ী বলেন না?

– হ্যাঁ বলি। যেমন তুমি।

– আমি আবেদনময়ী?

– অবশ্যই। তোমাকে দেখলে যে-কোনো পুরুষের বুক দুলে উঠবে।

– আপনিও সেরকম আবেদনময় পুরুষ।

– পুরুষরা আবেদনময় হয় নাকি?

– হয় হয়! আপনারা যে কত কম জানেন নিজেদের সম্বন্ধে!

– কম না জেনে উপায় কী? তোমরা তো বলো না।

– বললে তো আমাদের সংসার টিকবে না।

– তা বটে। তোমদের তো আবার সংসার টিকিয়ে রাখতে হয়।

– না রেখে উপায় কী বলেন? আপনারা তো ছটফটে। কোথাও স্থির হয়ে বসতে চান না। মেয়েদের তাই শক্ত করে বেঁধে রাখতে হয়। 

ঋভু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, এই সময় দেখলো অংশু আসছে এদিকে, তাদের দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে বললো, এই ঋভু, আমার বউকে এরকম নির্জন জায়গায় নিয়ে এসেছিস কেন? তোর মতলবটা কী?

– কাছে আয়, বলছি।

অংশু কাছে এসে বললো, হ্যাঁ, বল। তোর মতলবটা কী?

– মতলব আবার কী? তোরা কাজে ব্যস্ত, আমরা তাই প্রেম করছিলাম।

অংশু অপলার দিকে চোখ পাকিয়ে বললো, সত্যি অপলা?

অপলা হাসলো, হ্যাঁ সত্যি।

– আজকে তোকে বাসায় নিয়ে যে কী করবো …

– আচ্ছা অপলা – ঋভু নিরীহ গলায় বললো – এই যে প্রতিদিন ও তোমাকে ভয় দেখায়, বাসায় নিয়ে এই করবে সেই করবে, এরকম একটা বর্বর লোকের সঙ্গে তোমার যাওয়া দরকার কী? আজকে আমার সঙ্গে চলো।

– তোর সঙ্গে যাবে মানে? – অংশু কৃত্রিম রাগে ফোঁস করে উঠলো।

– মানে, আমার বাসায় যাবে, আমার সঙ্গে থাকবে।

– প্রস্তাবটা মন্দ না – অপলা বললো – ভেবে দেখা যেতে পারে।

– কী? ওর সাথে যাবি? দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা।

– এই না না, মজা দেখাতে হবে না। আমি তোমার সঙ্গেই যাবো। – হাসছিল অপলা, ঋভুও হাসিতে যোগ দিলো। তারপর আড়মোড়া ভেঙে বললো, এই অংশু, এখানে জমি পাওয়া যাবে না?

 – জমি? কিসের জমি?

– বাড়ি বানানোর জন্য?

– বাড়ি বানাবি? এখানে?

– হ্যাঁ। জায়গাটা এত সুন্দর। ভাবছিলাম, এখানে একটা ছোটখাটো বাড়ি থাকলে মন্দ হয় না।

– জমি অবশ্য আমারও লাগবে। প্রজেক্টের এক্সটেনশনের জন্য আরো অনেক জায়গা লাগবে। কিন্তু জমির দাম যেভাবে বেড়েছে …

– বাড়ুক। তুই যখন কিনবি তখন আমার জন্যও একটু কিনিস। বেশি বড় জায়গা লাগবে না, কয়েক কাঠা হলেই হবে।

– আলাদা জমি দেখার দরকার কী? প্রজেক্টের ভেতরেই তোর জন্য একটা বাড়ি করে দেবো।

– না, আমার বাড়ি থাকবে আলাদা। একা থাকবো কি  না! এই এখন যেমন একটু গড়াগড়ি করতে ইচ্ছে করছে, একটা বাড়ি থাকলে কত ভালো হতো না? তবে তোর আশেপাশেই থাকবো, চিন্তা করিস না।

– সে দেখা যাবে। আপাতত কাজটা তো শুরু হোক।

– কবে নাগাদ শুরু করবি?

– শুরু তো হয়েই গেছে। এখন কেবল স্ট্রাকচারটা বানাতে হবে। ওটাও দ্রুতই শুরু করবো।

– আজকের মতো কাজ শেষ?

– হ্যাঁ।

– তাহলে চল, রওনা দিই। ঢাকায় গিয়ে একটু গলা ভেজাই।

– হ্যাঁ, চল।

– অপলা, তুমিও আজকে থাকবে আড্ডায়।

– আচ্ছা, থাকবো। কোথায় বসবেন?

– যেতে যেতে ঠিক করবো।

– আগামী শুক্রবার আরেকবার এখানে আসবো, তুই পারবি তো ঋভু? – অংশু জিজ্ঞেস করলো।

– হ্যাঁ, পারবো। আরিয়ানা আসার আগ পর্যন্ত আমি ফ্রি। ও এলে কয়েকদিনের ছুটি নিতে পারি।

– ছুটি কেন?

– ওকে বাংলাদেশটা ঘুরিয়ে দেখাবো। মানে যতটা সম্ভব আর কি!

– ওর আসার তারিখ ঠিক হয়েছে?

– হ্যাঁ। আগামী মাসের সাত তারিখ।

– মানে এখনো তের দিন বাকি। ঠিক আছে চলবে।

– কী চলবে?

– এর মধ্যেই এখানে কাজটা শুরু করবো। শুরুর দিকে তোকে আমার লাগবে।

– ঠিক আছে। চল এবার।

সেদিন ঢাকায় ফিরে তারা গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা দিলো। অপলা কী কারণে যেন বেশ ফুরফুরে মেজাজে ছিল। দু-তিন পেগ পেটে পড়তেই বেশ প্রগলভ হয়ে উঠলো। বললো, ঋভু ভাই আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।

– করে ফেলো।

– করবো? – অংশুর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো অপলা।

– হ্যাঁ, করো। কথা বলতে কী সমস্যা? অন্য কিছু না করলেই হলো।

– তোমার মাথায় শুধু কুচিন্তা!

– আরে বলো কী! এই চিন্তাই তো আসল চিন্তা। নইলে তো জগৎ-সংসার টিকতোই না।

– তুমি কিন্তু আমাকে কথাটা বলতে দিচ্ছো না।

– না না বলো। কী জিজ্ঞেস করবে করো ওকে।

– হ্যাঁ, ঋভু ভাই, আসেন আমরা কথা বলি।

– এত প্রিপারেশন নিচ্ছ, ভয়ই লাগছে। আচ্ছা, বলো কী বলবে।

– প্রশ্নটা হলো, এই যে একাধিক মেয়ের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক, এ নিয়ে আপনার ভেতরে কখনো কোনো প্রশ্ন তৈরি হয় না?

– প্রশ্ন? কিসের প্রশ্ন?

– আরে ও হচ্ছে প্লেবয় টাইপের। ওর মধ্যে এসব প্রশ্ন কোত্থেকে আসবে? – অংশু ফোড়ন কাটলো।

– তুমি থামবে? – ধমক দিলো অপলা।

– আচ্ছা, থামলাম। হ্যাঁ, ঋভু বল।

– আমি তো বুঝতেই পারিনি, প্রশ্ন কিসের?

– না, মানে, রিনি তো আপনার বউ ছিল, ওটা নিয়ে প্রশ্ন নেই। কিন্তু আরিয়ানা, অবন্তি এদের সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা নিশ্চয়ই স্রেফ প্লেটোনিক না?

– না, প্লেটোনিক না।

– এ নিয়ে আপনার ভেতরে কোনো দ্বিধা নেই?

– দ্বিধা কিসের?

– এই যে একাধিক সম্পর্কে জড়ানো, তাও শারীরিক …

– দ্বিধা থাকবে কেন, প্রশ্নই বা থাকবে কেন? আমি তো কাউকে জোর করিনি।

– সে-কথা আমি বলিওনি। কিন্তু আমাদের ধর্ম কিংবা সমাজ বা সংস্কৃতি তো এই ধরনের সম্পর্ক অনুমোদন করে না।

– আমি তো ধার্মিক নই অপলা, সামাজিকও নই।

সংস্কৃতিরও কোনো সুনির্দিষ্ট রূপে বিশ্বাস করি না।

– তাহলে কী বিশ্বাস করেন?

– সম্পর্কের প্রশ্নে পারস্পরিক সম্মতিই মূল ব্যাপার। এর বাইরে কিছু নেই।

– কিছুই নেই? ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি কিছুই না?

– না নেই। এই যে তোমাদের দুজনের সম্পর্ক, এটাও পারস্পরিক সম্মতির ব্যাপার।

– কিন্তু আমাদের তো ধর্মমতে বিয়ে হয়েছে।

– ধর্মমতে নয়, পরস্পরের সম্মতিতে। ওটাও তো সম্মতিই, বুঝেছ?

– তা কেন হবে? ধর্মীয় রীতি মেনেই তো …

– যদি তাই হতো তাহলে আমরা অন্য ধর্মের বিবাহরীতিকে বৈধ মনে করতাম না।

– কেন? বিয়ে তো বিয়েই, যে ধর্মেরই হোক …

– একটু ভেবে দ্যাখো। আমরা কিন্তু অন্য ধর্মের অন্য কোনো রীতিই স্বীকৃতিযোগ্য বলে মনে করি না, অথচ বিয়েকে সহজেই স্বীকৃতি দিই। কারণ ওটা আসলে সকলের উপস্থিতিতে দুজনকে একসঙ্গে থাকার সম্মতি দেওয়া হচ্ছে। ধর্ম এখানে নেই, তবে হ্যাঁ, সমাজ আছে।

– ধরেন, আমি আর আপনি এরকম কোনো সম্মতিতে পৌঁছলাম, তখনো আপনার নীতিবোধে বাধবে না? – মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করলো অপলা।

– না, বাধবে না। পারস্পরিক সম্মতি যদি থাকেই তাহলে কিসের নীতিবোধ?

– আমি যে আপনার বন্ধুর বউ …

– আমি তো তখন তোমাকে ওই পরিচয়ে চিনবো না, ভাববোও না।

– তাহলে কী ভাবেবেন?

– ভাববো, আমার প্রেমিকা।

– আপনার বন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা হবে না সেটা?

– সেটা কিন্তু আমার আর আমার বন্ধুর মামলা।

তোমার-আমার মামলা তো না।

– আপনার বন্ধু যদি আপনার বিরুদ্ধে বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ করে? যদি কষ্ট পায়?

– সেটা আমি অন্যভাবে সামলাবো। তোমার ওপর নিশ্চয়ই দায় চাপাবো না।

আলোচনা যেদিকে যাচ্ছে – অংশু গলা খাঁকারি দিয়ে বললো – তাতে তো মনে হচ্ছে তোরা আজকেই একটা মীমাংসায় পৌঁছে যাবি।

– হা-হা-হা … ভয় পেয়েছিস? তোর বউ আমার কাছে আসবে বলে মনে হয়?

– তুই যেরকম লেডিকিলার, কী হয় বলা যায় না …

– হা-হা-হা … ভালোই বলেছিস। কিল করার জন্য লেডি তো পেলামই না। তাও লেডিকিলার হয়ে গেলাম!

– সাধু সাইজো না চান্দু। তোমারে আমি ভালোই চিনি।

– তুমি তোমার প্রশ্নের উত্তর পেয়েছ অপলা? – ঋভু জিজ্ঞেস করলো।

– হুঁ, পেয়েছি। কিন্তু বুঝতে পারিনি।

– কী বুঝতে পারোনি?

– আপনি এতটা ডেসপারেট কীভাবে হলেন! কিছুই মানেন না!

– শোনো অপলা, আমি যেদিন থেকে বুঝেছি, জীবনের মালিকানা আমাদের নয়, সেদিন থেকেই সব ছুড়ে ফেলেছি।

– জীবনের মালিকানা আমাদের নয় বলছেন কেন? অবশ্যই আমাদের।

– বলছি কারণ, মৃত্যুকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না।

– তাও পারি।

– কীভাবে?

– মানুষ আত্মহত্যা করতে পারে না?

– পারে। সেটা তো মৃত্যুকে ডেকে আনা হলো। এমনিতেও মরতে হবে, দুদিন আগে মরলাম, এই আরকি। কিন্তু যদি বেঁচে থাকতে চায় একজন মানুষ? অনন্তকাল? পারবে?

– অনন্তকাল পারবে না।

– অনন্তকাল না হোক, ধরো একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত? কেউ নিশ্চয়তা দিতে পারবে?

– না, তা পারবে না।

– তাহলে? মানুষ চাইলে নিজেকে শেষ করে দিতে পারে, কিন্তু চাইলেই নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে না।

– হুম।

– বুঝতেই পারছো। ছোট্ট একটা জীবন, তাও অনিশ্চিত। সেটাকে এত নিয়ম-নীতির বেড়াজালে আটকে ফেলার কোনো মানেই হয় না।

– বুঝতে পারছি। আপনি পেরেছেন। কিন্তু আমরা পারি না।

– সেটা যার যার ব্যাপার। নিজের জীবন কে কীভাবে ব্যয় করবে, সেটা তার নিজস্ব পছন্দ।

এরপর আর কথা চলে না। নীরবতা নেমে এলো ওদের ভেতরে। গভীর নীরবতা। 

অংশুর মনে হলো, ভাগ্যিস সে ঋভুর মতো নয়। ওভাবে চিন্তা করলে জীবনের কোনো মানে খুঁজে পাওয়া যায় না। অংশু বিশ্বাস করে, জীবন অর্থহীন নয়, উদ্দেশ্যহীন নয়, নিশ্চয়ই এর কোনো মহত্তর তাৎপর্য আছে। সে সেটি খুঁজে বের করতে চায়, বড় কোনো কাজ করতে চায়। অবশেষে তার সেই বড় কাজের স্বপ্নটা সত্যি হতে চলেছে বলে অংশু একটু বিহ্বল আজকে। মনে হচ্ছে, এতদিনে একটা মনের মতো কাজ খুঁজে পেয়েছে। ঋভু এসবের মধ্যে নেই, তার কাছে জীবন মানে কেবল বয়ে চলা, উদ্যাপন বা উপভোগ করা নয়, কেবলই স্রোতে ভেসে ভেসে মৃত্যুর কাছে পৌঁছানো। ঋভুর এইসব চিন্তার সঙ্গে অংশু অনেক আগেই পরিচিত। যখন তরুণ ছিল তারা,  তখন বহুবার এসব নিয়ে তর্কও হয়েছে। তারপর যে যার মতো মেনে নিয়েছে যে, সবাই একরকম হবে না, জীবন কিংবা জগৎ নিয়ে সবার দৃষ্টিভঙ্গিও এক হবে না, এইসব মতভিন্নতা নিয়েও পাশাপাশি থাকা যায়, বন্ধু হওয়া যায়।

ঋভু এই মুহূর্তে একটু বিষণ্ন। মনে হচ্ছে, অংশু-অপলা নতুন প্রকল্প নিয়ে আরো ব্যস্ত হয়ে যাবে দিনদিন, তার আর যাওয়ার জায়গা রইলো না, এবার তার আরো একা হওয়ার পালা।

অপলা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ঋভুর দিকে। হঠাৎ হঠাৎ ঋভুর এই অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়া, চোখেমুখে বিষণ্নতার ছাপ, মগ্ন হয়ে কী যেন ভাবা, কিছুই তার চোখ এড়াচ্ছে না। মায়া লাগছে তার। এই লোকটাকে সে বুঝে উঠতে পারে না। সবকিছুর মধ্যে থেকেও নেই, সম্পর্কে জড়িয়েও ঠিক আপন হয়ে ওঠে না, একটা দূরত্ব রেখে দেয়। এরকম মানুষকে বুঝে ওঠা যায়?

রাত গভীর হয়েছে, এবার বাড়ি ফেরার পালা। এক ফাঁকে, অংশুর চোখ ফাঁকি দিয়ে ঋভুর কানে কানে ফিসফিসিয়ে অপলা বললো, কালকে … না, কালকে তো ছুটির দিন, সবাই বাসায় থাকবে, কালকে না, পরশুদিন আপনার বাসায় আসবো।

ঋভু মৃদু হাসলো। বললো, এসো, আমি অপেক্ষায় থাকবো। (চলবে)