সনৎকুমার সাহা
‘ফোর কোয়ার্টেট্সে’ টিএস এলিয়ট শুরুর কবিতা, ‘বার্ন্ট্ নর্ট্ন্’ (Burnt norton, রচনাকাল ১৯৩৫)-এ বলছেন, ‘যা হতে পারত, আর যা হয়ে চলেছে, – একই লক্ষ্য নির্দেশ করে, তা সবসময় বর্তমান।’ আবার ‘অতীত ও বর্তমান, দুই-ই সম্ভবত এসে মেলে ভবিষ্যতে।’ তা হলে অতীত ও ভবিষ্যৎ একাকার হয় চিরকালীন বর্তমানতায়। আর একটা বিখ্যাত কবিতা ‘হলো মেন’ (Hollow Men, 1925)-এর সমাপ্তি টানছেন তিনি এই বলে, ‘এইভাবে শেষ বিশ্বলোকের, এইভাবে শেষ বিশ্বলোকের, এইভাবে শেষ বিশ্বলোকের – দুনিয়া-কাঁপানো অট্টনাদে নয়, অস্ফুট চাপা গোঙানোয়’ (Not with a bang but a whimper)। দুটো মিলে এই বার্তা যেন পাই, কখনো কোনো কিছু অসামান্য নয়। এবং এমনটাই তার নিয়তি। একে নৈরাশ্যবাদী বলা যায় কি না জানি না। তবে চূড়ান্ত নিরাবেগ-নিরাসক্ত
বোধি-লালিত বাণীও বটে। সময় যদি এক স্থির বিন্দুতে তার মৌলিকতা ধরে রাখে, এবং অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতে তার বিন্যাস ঘটায়, তবে কার্যত কোনো এগোনো-পেছুনো থাকে না। তখন-এখন-তারপর, সবই ঘটনার বৈচিত্র্য দেখায়। চূড়ান্ত বিচারে আন্তরমূল্যে এক। হওয়া-না-হওয়া, দেখা-না-দেখা, প্রত্যক্ষের মায়া। বিকল্পের দাবি, – ভিন্ন কিছু নয়। এবং অন্তিম পরিণতি তাৎপর্যহীন ফুরিয়ে যাওয়া। মানুষ অমত্মঃসারশূন্য। ছায়াপাতে হারিয়ে যায় হওয়া-না-হওয়া, করা-না-করা। অন্তিমে তাই নাটকীয়তা নেই, বিরাট কোনো অনুভূতির যোগ-বিয়োগ পাদপ্রদীপের আলো আকর্ষণ করে না। খিঁচুনিতেই নির্বাণ।
শেষের সে-দিনের কথা আপাতত ভাবছি না। এলিয়টের ওই সময় হয়তো তাঁকে কোনো আশার আলো দেখায়নি। তাছাড়া ব্রহ্মা–র সংকোচনে পৃথিবী যদি কোনোদিন শূন্যে মিলায়, তবে তার সম্ভাবনা এত কল্পনাতীত দূরে যে, তা নিয়ে মাথা ঘামানোর আগ্রহ জাগে না। কিন্তু ‘বার্ন্ট্ নর্ট্ন্’ সীমিত পরিসরেও ভাবনা জাগায়। মনে হয় না, তা উড়িয়ে দেওয়ার। এলিয়টীয় চিমত্মাসূত্র যেমন আন্দাজ করি, তেমন যদি না মানতে চাই, তা-ও।
প্রতিটি কালবিন্দুতে অসংখ্য সম্ভাবনারাশি থাকে। ব্যক্তিজীবনে। বিক্ষিপ্ত বা একত্র বহু-জনের জীবনেও। প্রত্যেকে দান দেয়। চুপ করে বসে থেকে কিছু না করাও কিন্তু দান-দেওয়া। তা থেকে ফলের ছবি ফুটে ওঠে। একার। সবারও। নতুন পরিস্থিতি তৈরি হয়। আবার দান দেওয়া। এই রকম অবিরাম। কিন্তু প্রতিটি নতুন বাস্তবতা পুরনো খারিজ সম্ভাবনাগুলোও হাজির করে। তাতে প্রত্যেকের সামনে, একক ও সামষ্টিক, উভয়ের বেলাতেই, এবং সমষ্টির শাখা-প্রশাখাতেও, দান দেওয়ার ছক একেবারে বদলে যাওয়া সম্ভব। একাধিক দান কেউ দিতে পারে না। একবার দিয়ে তা ফিরিয়েও নিতে পারে না। বহমান সময় তার সুযোগ রাখে না। অতএব প্রত্যক্ষের চেহারা প্রত্যেকের সামনে প্রতিটি প্রাসঙ্গিক বাস্তবতায় একটিই দাঁড়ায়। এদের কালিক প্রবাহে যা দেখি, তা ইতিহাসের ধারা। কিন্তু প্রতিটি বিন্দুতে পশ্চাৎপটে থাকে, যা হতে পারত, কিন্তু হয়নি, তারও দূরান্বয়ী সংযোগ। ‘What has been’-এর সঙ্গে ‘What might have been’, ‘মৌন মন্তরে’, অথবা কখনো কখনো সরবে আত্মস্বরূপ বোঝায়। ইতিহাস রচনায় তা ফেলনা নয়। ভবিষ্যৎকেও তা নির্দেশ পাঠায়। যেমন পাঠায় যা ঘটেছে, ও, ঘটে চলেছে, তা। অতএব কালের সঙ্গে ঘটনার ধারাবাহিকতায় একৈকান্তিকতা ছিন্ন হয় না। কিন্তু প্রতিটি ঘটনা অসংখ্য প্রাক্সম্ভাবনার স্মৃতি মাথায় রেখে সেই অনুযায়ী ক্রিয়ায়-প্রতিক্রিয়ায় কেলাসিত হয়ে, এবং হতে হতে, প্রকাশিত হয়ে চলে। ‘বার্ন্ট্ নর্ট্ন্’ এদিকটাও কিন্তু আমাদের মনোযোগ কেড়ে নিতে পারে। এখানে তারই প্রতিক্রিয়ায় কিছু লেখার চেষ্টা। অবশ্যই এলিয়টীয় নয়। তবে তাঁর পথ ধরে না হলেও আমার মতো করে তাঁর ইঙ্গিত, যেমন বুঝেছি, মাথায় নিয়ে।
রবীন্দ্রনাথের ভিন্ন দৃষ্টিপথে ভিন্ন ভাবনা-কল্পনা থেকেও কিঞ্চিৎ ধার করি। ওই বাক্-প্রতিমায়, যদিও কবিতায় হতে পারে তা অপ্রাসঙ্গিক, তবু এখানে অন্য আবেদনের ইঙ্গিত খুঁজে নিয়ে – তাতে আর একভাবে অনুমানে প্রাণসঞ্চারের চেষ্টা। অথবা, হতে পারে, এ বাড়তি কিছু নয়। কবির এই দৃশ্যকলা স্বয়ং বহুমাত্রিক। একটি স্রোতের অনুসরণে, অন্য-এক বা একাধিক-স্রোত আড়ালে মিশে থাকলেও, আমরা অনুভবে তা ধরতে পারি না। হয়তো চাইও না। কালের প্রবাহ ওই স্রোতের প্রবাহে নিত্যদিন নানাদিক থেকে অবিরাম আলো ফেলে। তাতে তার গোপন লীলার সঞ্চারণ কখনো-কখনো আমাদের মনোযোগ কেড়ে নেয়। নতুন নতুন অর্থ ভেসে ওঠে। অবশ্য ‘পথ ভাবে আমি দেব, রথ ভাবে আমি’ – এমন পরিহাসেও মজতে পারি। কিন্তু কালও যে নির্গুণ নয়, নিষ্ক্রিয়ও নয়, প্রত্যক্ষের সব মিলিয়ে যৌগিক, যোগরূঢ় বা রূঢ়িও হতে পারে, এবং সব আত্মসাৎ করে বাস্তবে ঢেলে দিতে পারে, দেয়, – এ কথাটাও মনে রাখি। তা চৈতন্যে এই পৃথিবীকেই শুধু মননের কেন্দ্রভূমি ধরে। সব নীহারিকাপুঞ্জ-ছায়াপথ মিলে বিশ্বব্রহ্মা–র চলমান-বর্তমানতাকে প্রেক্ষণে রেখে তার সঙ্গে মিলিয়ে কিছু বলছি না। ভাবনা-চিমত্মায় তার কূল পাওয়া আমার সাধ্যের বাইরে।
আমি ‘দুঃসময়’ কবিতার দুটো চরণে আটকে যাই : ‘বিশ্বজগৎ নিশ্বাস বায়ু সম্বরি/ স্তব্ধ আসনে প্রহর গনিছে বিরলে।’ কবিতায় রূপকল্পনার ঐশ্বর্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে একে যদি একটা স্বয়ংনির্ভর ‘স্টেটমেন্ট’ হিসেবে পড়ি, তবে দেশ-কাল-পাত্রের প্রতিটি বাস্তবতার সামনে অনিশ্চিত সম্ভাবনার, অথবা সম্ভাবনারাশির কোনটি ঘটবে, তা দেখার আকুতি যেন ফুটে ওঠে সর্বব্যাপ্ত উৎকণ্ঠায় মিশে গিয়ে। এই প্রহর গোনায় কিন্তু ভালো-মন্দ, সদসৎ, পছন্দ-অপছন্দ, কিছু নেই। সবটাই নিরাসক্ত কৌতূহল। এবং ক্রিয়ার কথা প্রাণে-অপ্রাণে অসংখ্য তাড়নায় অন্বিত প্রত্যক্ষে-অপ্রত্যক্ষে বিস্তারিত বস্তুজগৎ। আমরা প্রেক্ষিত রচনা করি মানুষের সীমানায়। কার্যকারণের যোগসূত্র তাৎক্ষণিকেই ফুরোয় না। প্রতিটি পর্যায়ে ক্রিয়ার পরিণাম উদ্দেশ্যের স্বরূপকেও বদলে দেয়। এবং অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ যুক্ত হয় বিরতিহীন চলমান স্থিরবিন্দুতে। যদিও প্রহর-গোনাও অনিঃশেষ। এলিয়টের শুদ্ধ-বিরাগ, ‘Quick now, here, now, always -/ Ridiculous the waste sad time/ Stretching before and after’ – ‘দুঃসময়ে’ নেই। ‘আছে, শুধু পাখা, আছে মহানভ-অঙ্গন/ ঊষা দিশাহারা নিবিড় তিমির আঁকা’ – অসম্ভবের সামনে আশা জাগিয়ে রাখে। তাকে মহিমান্বিত করে। আর কে না জানে, এই পারাটুকুতেই তৈরি হয় মানুষের ইতিহাস, যদিও অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের বিরতিহীন সংযোগবিন্দু রচিত হয়ে চলে, – দৃশ্যে বা অদৃশ্যে। বেঁচে থাকার অগৌরব ও গস্নানিও তা বহন করে নিরুপায় অনিবার্যতায়। তারপরেও, দেখি, মানুষ স্থির থাকে না এক জায়গায়। ‘পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থা।’ তবু তার যাত্রা ক্ষান্তিহীন। তাতে অসংখ্য নিয়ামক। ন্যায়-অন্যায়-পাপ-পুণ্য, যেভাবেই বিচার করি না কেন, সেসবের যোগসূত্রে তারাই দেখায় ওই ইতিহাসের পথরেখা। এখানে তার এক খ-াংশকে আংশিক বোঝার চেষ্টা। অবশ্য চূড়ান্ত দ্রষ্টব্য, এই বঙ্গভূমির মানবযাত্রা। তার প্রবহমানতার বর্তমান ধারা।
তবে শুরুতেই সবিনয়ে বলে রাখি, প্রথা মেনে ইতিহাস পড়া আমার ভাগ্যে জোটেনি। স্থান-কাল-মাপজোখের বিদ্যা আমার জানা নেই। এই বিদ্যামন্দিরের পাঁচিলের বাইরে একটু-আধটু ঘোরাফেরা। লেখাটি বিদ্যা জাহির করতে নয়। গলদগুলো কেউ ধরিয়ে দেবেন, এই আশায়। অবশ্য সংশোধনের অতীত যদি হয়ে থাকে, তবে কে-ই বা আগ্রহ দেখাবেন! আর একটা ব্যর্থ-প্রয়াসের নজির শুধু তৈরি হবে। পড়ে যদি কারো সময় নষ্ট হয় তবে তাঁর কাছে করজোড়ে মার্জনা ভিক্ষা চেয়ে রাখি। এছাড়া লেখা অগোছালো ও উৎকেন্দ্রিক হওয়ারও আশঙ্কা আছে। স্বভাবদোষ। কাটাতে পারি না। যাঁরা যোগ্য, তাঁরা পথ দেখাবেন, এই আশাটুকু বোধহয় করতে পারি।
আর একটা কথা। এখানে যা লিখছি, সবই যে আমার মনঃপূত, তা কিন্তু নয়। অনেক কিছু অন্যরকম দেখাতে পারলে ভালো লাগত। কিন্তু বিষয়-বিষয়ীর সংযোগগুলো এমন, অন্তত আমার কাছে যেমন-যতটুকু ধরা পড়েছে, তাতে, তাদের সামনে আমি অসহায়। ইতিহাস অনেক সময়, বোধহয়, নির্মম। বেহিসেবি ইচ্ছা পূরণে বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় দেয় না।
দুই
খ্রিষ্টীয় পনেরো শতকের অন্তিমলগ্নে দুটো সমুদ্রাভিযান পৃথিবীর মানব-মানচিত্রে শুধু যে একটা বড়-ধরনের পরিবর্তন ঘটাতে শুরু করে, তাই নয়, সব জায়গাতেই সমাজ-সভ্যতার গতিপথে তার প্রতিক্রিয়ার দূরান্বয়ী নির্ভুল ছাপ কোথাও সরাসরি, কোথাও বা নানা বাঁক পেরিয়ে অনিবার্য পড়তে থাকে। তা এখনো বহুমুখে জায়মান। প্রকৃতপক্ষে বিশ্ববাস্তবতার আগের খোলস পুরোটাই বাতিলের অপেক্ষায়। হয়তো সুখ-দুঃখের মায়া কিছু অবশেষ রেখে যায়। তাদের কুহক পশ্চাতেও টানে; – যদিও তার সবটাই ক্ষতিকর, এমনও হয়তো নয়। ধারাবাহিকতায় বহুমুখী ঘাত-প্রতিঘাত নিয়ে এই মানব-প্রবাহ। আশীর্বাদ বা অভিশাপ কখন কীভাবে কার ওপর পড়ে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। শুধু এটুকু বলা, ওই দুই সমুদ্রযাত্রা ছিল যুগান্তকারী। স্বয়ং তারা প্রাথমিক কর্তা, এমন দাবি অযথার্থ। বহু মানুষের কর্মযজ্ঞ তাদের নিয়মত্মা। এবং সবারই যে লক্ষ্য এক ছিল, তাও নয়। ইতিহাস এভাবেই প্রকাশমান। কোনো কিছুই কাল-বিচ্ছিন্ন নয়। ভালো-মন্দ প্রতিটি মুহূর্তে আপেক্ষেক। তবুও গতিমুখ খোঁজা। অথবা অনিশ্চয়তার ব্যাপক বিস্তারে নিরাসক্ত দৃষ্টি ফেলার চেষ্টা। নিরাসক্তি নিয়েও অবশ্য প্রশ্ন ওঠে। প্রত্যেকের চিমত্মা-জগৎ মেধা ও মননে ব্যক্তিস্মৃতি ও ব্যক্তি-অভিজ্ঞতার ধারায় চলমান। আসক্তি-নিরাসক্তি ওই সীমা-শর্ত মেনে নিয়ে। তারপরেও সমুদ্রাভিযান দুটোয় প্রাথমিক গুরুত্ব দেওয়া।
একটি, ১৪৯২ সালে য়োরোপ থেকে আটলান্টিক মহাসাগর পেরিয়ে কলম্বাসের স্প্যানিশ নাবিক ও দলবল নিয়ে পশ্চিম গোলার্ধে আমেরিকা-ভূখণ্ডের উপকূলে অবতরণের সূত্র ধরে প্রথম ওই জলপথের খোঁজ পাওয়া। দ্বিতীয়টি, ১৪৯৭-৯৮ সালে পর্তুগিজ অভিযানে নেতৃত্ব দিয়ে আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগরে অজানার আশায় জাহাজ ভাসিয়ে ভাস্কো-ডা-গামার ভারতে পৌঁছুবার সমুদ্রপথ আবিষ্কার। এটা কাকতালীয় নয়, স্পেন ও পর্তুগাল, দুটোই আটলান্টিকের পারে একত্রে মিলে আইবেরিয়ান উপদ্বীপ। য়োরোপ বা উত্তর আফ্রিকার চাপ তাদের অস্থির রাখে সব-সময়েই। সমুদ্রপথে কোনো স্বপ্নরাজ্যে পৌঁছুতে পারলে সম্ভাবনার অনেক পথ তাদের সামনে খুলে যায়। ভারতের অসিত্মত্ব ও বৈভব তাদের অজানা নয়। সেখানে পৌঁছুবার স্থলপথ বহু-প্রাচীন। কিন্তু ঘুরপথে যেতে হয় অনেক দেশ পেরিয়ে। তাতে ঝুঁকি বেশি। লাভের আশা ক্ষীণ। অবশ্য আইবেরীয় সব মানুষই এমন ভেবেছে, তা নয়। কিছু নাবিকের মাথায় সমুদ্র অভিযানের কল্পনা দানা বাঁধে। রাজশক্তি তাতে উৎসাহ জোগায়। তবে দুটো অভিযানেই লক্ষ্য ছিল, ভারতে পৌঁছুবার জলপথের সন্ধান।
আমেরিকার উপকূলে পৌঁছুনো ছিল অপ্রত্যাশিত। যদিও তা বিশ্ব ইতিহাসের বাস্তবভূমি, গতি ও পরিণতির ওপর প্রভাব ফেলে অনেক বেশি। ভারত মহাসাগরে অভিযানও মূল ধরে পরিবর্তনের অস্থিরতা বহুদিকে ছড়ায়। সমকক্ষ, এমন কি কোথাও কোথাও উন্নততর সভ্যতার মোকাবিলা অনিবার্য হয়ে পড়ে। আগের অবস্থান, অথবা, আগের অগ্রাধিকার অটুট থাকে না। বহু-মানুষের ধারা নব-নব শক্তির, নব-নব দ্বন্দ্বের, নব-নব ধ্বংসের-মিশ্রণের-সৃষ্টিকুশলতার ও জয়-পরাজয়ে-সম্পর্কের বিবিধ রূপান্তরের অনিবার্য অনিশ্চয়তা মেনে নিয়ে কোনো অকূলের পথে ধাবিত হয়, তার অনেক কিছুই আগে কল্পনাতেও আসত না। হয়তো মানবসভ্যতার ইতিহাস নানা বাঁক পেরিয়ে যে অগ্রসর হয়, জন্ম-মৃত্যুর ওঠাপড়ায় যে-কোনো সময়ে যে-কোনো ব্যক্তির জীবনের ব্যাপ্তি মহাকালের প্রেক্ষাপটে বিন্দুবৎ সীমিত-ও-ব্যতিক্রমহীন অবলুপ্তিতে নিশ্চিহ্ন হওয়া সত্ত্বেও, তাতে এমনটি অস্বাভাবিক ভাবার কারণ নেই। এলিয়টীয় ধারণায় মানুষের হয়ে ওঠায় প্রত্যেক্ষের মায়াজালে বৈচিত্র্য বা বিভ্রম যেমনই হোক না কেন, তাগিদের স্থিরবিন্দু তো অবিচল। তবু ওই তাগিদ অন্তহীন। রূপে-রূপান্তরে, কল্পনা থেকে কল্পনাতীতের সম্ভাব্যতায় মানুষের যাত্রা।
তবে পনেরো শতকের শেষে মানব উদ্যোগে নতুন মাত্রার যে সংযোজন, তার পৃষ্ঠভূমি যে য়োরোপ তা তার আগে পর্যন্ত দীর্ঘকাল ছিল তুলনায় কোণঠাসা। ব্যাবিলন-প্যালেস্টাইন, আরব-ভারত-চীন, এদেরই ছিল সভ্যতায় আভিজাত্যের গৌরব। প্রাচীন গ্রিক বা ইতালীয় সংযোগ যতটা পশ্চিমমুখো, তারচেয়ে বেশি ছিল পুবমুখো। পনেরো শতকে যে-কর্মযজ্ঞের উৎসার, প্রকৃতিগতভাবে তা মূলত য়োরোপীয়, যদিও দুই সফল সমুদ্রাভিযানের আগে উদ্যোগের ধরন-ধারণে এই সম্ভাবনার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে ছিল, এমনটি বলা যায় না। আবার এ স্বপ্ন-কল্পনা যে একটু-একটু করে বিভিন্নভাবে সামনে জেগে উঠছিল, এও অস্বীকার করা চলে না। ‘বিশ্বজগৎ’ ‘স্তব্ধ আসনে প্রহর গনিছে’ – ব্যাপারটা যেন এই রকমই। ঘটার পরে তার প্রতিক্রিয়া হয় সুদূরপ্রসারী। কাল থেকে কালান্তরে তার বিস্তার। এখনো অনিঃশেষ। যদিও য়োরোপ মানে একটি কেন্দ্র নয়। য়োরোপেই অসংখ্য কেন্দ্র। কর্মকা– রসদ জোগায় জ্ঞানকা-। পনেরো শতকের অন্তিম লগ্নে অবশ্য কর্ম-কাঠামোয় তেমন পরিবর্তন আসে না। জীবনযাত্রার তাগিদ বিশেষ-বিশেষ উদ্যোগে প্রাণস্পন্দন বাড়ায়। শুরুতে উৎসাহ জোগায় কোনো-কোনো রাজশক্তিও। স্পেনে ও পর্তুগালে নৌবহর গড়ে তোলায় এর অবদান কম নয়।
আমরা জানি, তেরো শতকে কারুশিল্পীদের কর্ম-যোজনায় কম্পাসের উদ্ভব ঘটেছে। কিন্তু তাতেই সমুদ্রযাত্রায় স্থানাঙ্ক নির্ণয় নিশ্চিত হয় না। সমস্যা আয়ত্তে আনতে পর্তুগালে প্রিন্স হেনরি য়োরোপের বাঘা-বাঘা গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীকে ডেকে এনে তাঁদের পরামর্শ চাইলেন। অনেকটা সুরাহা হলো। কোনো লক্ষ্য-স্থানের অক্ষাংশ নির্ণয় খুব কঠিন থাকল না। তবে দ্রাঘিমাংশ নির্ণয়ে তেমন অগ্রগতি হলো না। অভিজ্ঞতা ও অনুমানের ওপরই ভরসা। এই সমস্যার সুনিশ্চিত সমাধানের জন্য অপেক্ষা করতে হয় আরো প্রায় দুশো বছর। সমুদ্রপথের অধিকার তখন বেশিরভাগ ব্রিটিশদের দখলে। ক্যাপ্টেন জেম্স্ কুক তাঁর সফল অভিযানে (১৭৬৮-৭৯) ওশিয়ানিয়া অঞ্চলের হদিস পাওয়ার কালে মজবুত ও সবদিক থেকে কার্যকর সমুদ্রযাত্রার উপযোগী ক্রোনোমিটার ব্যবহারে সমর্থ হন। এতে স্থানাঙ্ক নির্ণয়ে অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ দুটোই প্রায় নির্ভুল বের করা সম্ভব। যাই হোক, প্রিন্স হেনরির নেতৃত্বে তাঁর সময়ে পর্তুগিজ নৌবহর লক্ষণীয়ভাবে এগিয়ে যায়। প্রতিফলন ঘটতে থাকে তার দুঃসাহসিক বোম্বেটেপনাতেও। এদিকে প্রিন্স হেনরির উদ্যোগে জাহাজের আয়তন আরো বড় হয়েছে। পাল-তোলা হলেও বাষ্পের ব্যবহারও শুরু হয়েছে। আগের তুলনায় অনেক পুরু শক্ত-সমর্থ পাটাতনে দূরপাল্লার কামান বসানোও নিশ্চিত করা গেছে। দূরসমুদ্রের হাতছানি সাড়া দেওয়ার অযোগ্য আর থাকে না। তবে এই জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দ্রম্নত পশ্চিম য়োরোপের সমুদ্রোপকূলে অন্যদের ভেতরেও ছড়ায়। অনিশ্চিত উদ্যোগে জীবন বাজি রেখে আকস্মিক বিপদ মোকাবিলায় তাদের প্রতিযোগিতা দুঃসাহসের চূড়ায় গিয়ে ঠেকে। বিপুল বিনিয়োগও তা দাবি করে।
স্পেনও তখন চুপ করে বসে থাকে না। বৈবাহিক সূত্রে হাপ্স্বার্গ ও স্পেন একই শাসনের আওতায় আসায় রাজা ফার্দিনান্দ ও রানী ইসাবেলা প্রচুর ধনরাশি একত্র করে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের নেতৃত্বে ভাস্কো-ডা-গামার অভিযানের আগেই ভারতবর্ষে পৌঁছুবার জলপথ খুঁজে বের করার উদ্যোগে বিনিয়োগ করেন। কলম্বাসের জাহাজ স্থলভূমিতে ভেড়ে ঠিকই। কিন্তু তা আটলান্টিক মহাসাগরের অপর পারে অজানা সব দ্বীপে। নাম হয় তাদের পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ। কিন্তু ভুল ভাঙে আমেরিগো ভেসপুচির পশ্চিম গোলার্ধের স্থলভূমিতে পদার্পণে। পশ্চিম য়োরোপের সামনে খুলে যায় দুই মহাদেশে পাড়ি দেওয়ার পথ। নবজাগ্রত সমৃদ্ধির সম্ভাবনা সমুদ্র পেরোবার ঝুঁকি মস্নান করে দেয়।
প্রথম চোটে স্পেনের স্বার্থচক্র মেক্সিকো থেকে শুরু করে দক্ষিণ আমেরিকার বাসযোগ্য প্রায় সব জায়গায় অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। পর্তুগিজরাও পিছিয়ে থাকে না। তারা দখল নেয় ব্রাজিলের, যার বেশিরভাগই আমাজনের দুধারে ঘন বনাঞ্চল। তবে তার বাড়তি আকর্ষণ, সোনার খনি। তাল তাল স্বর্ণ লুণ্ঠনের হাতছানি। বসে থাকা মিছে। যেন পৌরাণিক এলডোরাডো। দখলই অধিকারের যৌক্তিক ভিত্তি। শুধু ব্রাজিলে নয়, গোটা আমেরিকা গোলার্ধেই।
এমন নয় যে, সেখানে কোনো জনবসতি ছিল না, বা, তাদের সভ্যতার মানদ- কিছু ছিল না। পেরুতে আছে তিন হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ইন্কা সভ্যতার নিদর্শন। পাবলো নেরুদার ‘মাৎচু-পিৎচু-র শিখরে’ কবিতা তার দৃশ্য ও বর্ণমালায় সাজানো। তবে কিটস তাঁর ‘On first looking into Chapman’s Homer’ কবিতায় কর্টেজ ও তাঁর সঙ্গী-সাথিদের যে-বাহবা দিয়েছেন (‘Or like stant Cortez, when with eagle eyes/ He stared at the Pacific – and all his men/ Look’d at each other with a wild surmise/ Silent, upon a peak in Darien.’ – এর সঙ্গে তিনি তুলনা করছেন চ্যাপম্যানের হোমার-অনুবাদ পড়ে তাঁর যে উলস্নসিত বিস্ময়, তার।) তা কতটা সংগত, তা ভেবে দেখার বোধহয় অবকাশ আছে। কর্টেজ ১৫১৯-২১-এ বর্তমান মেক্সিকোয় তৎকালীন আজটেক রাজশক্তিকে দুর্বার নৃশংস আক্রমণে ধ্বংস করেন। স্থানীয় অধিবাসীদের গোলাবারুদের সঙ্গে কোনো পরিচয় ছিল না। ধ্বংসযজ্ঞ কেমন ঘটে, এ থেকে তা অনুমেয়। অবশ্য গোটা বসতি আরো ছারেখারে যায় স্প্যানিশদের বয়ে আনা গুটিবসন্ত, হাম, পেস্নগ, এসব সংক্রামক মহামারিতে, এতদিন তাদের আপন ভূমিতে যাদের কোনো অসিত্মত্বই ছিল না। একইভাবে পিজেরো ১৫৩১-৩৫-এ পেরুতে ইন্কা রাজশক্তি ধ্বংস করে সেখানে প্রভুত্ব কায়েম করেন। তবে আইবেরিয়ান দেশ দুটো মেক্সিকো পেরিয়ে আরো উত্তরে এগোতে পারে না। স্থানীয় কোনো শক্তির প্রতিরোধে নয়, সুযোগসন্ধানী ব্রিটিশ ও ফরাসি নৌ-বাণিজ্যবহর তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ষোলো শতকের মাঝামাঝি ওই অঞ্চলে আগেই প্রভুত্ব কায়েম করায়। ব্রিটিশ বা ফরাসি রাজশক্তি সরাসরি কারবারে যুক্ত থাকে না। যদিও তাদের সমর্থন ও প্রশ্রয়ে এতটুকু কমতি হয় না। আর, কে না জানে, নিজেদের ভেতর সমুদ্রপথে অধিকার কায়েমের প্রতিযোগিতায় ওই সময়ে জোর যার, দখল তার, এইটিই ছিল শেষকথা। তবে ব্রিটিশ-ফরাসি শক্তি স্থানীয় আমেরিসিত্ময়ানদের উচ্ছেদ করলেও একেবারে নির্মূল করে না। বিশাল ভৌগোলিক বিস্তারে ক্রমাগত কোণঠাসা করে সব মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করে চলে। আরো পরে আঠারো শতকের সমাপ্তিপর্ব থেকে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডেও মোটামুটি একই নীতি তাদের বজায় থাকে।
আমেরিকায় বসতি গড়ার সুযোগ য়োরোপের অনেক সমস্যা লঘু করে দেয়। আমরা অনেকে য়োরোপের সমৃদ্ধি ও শ্রেষ্ঠত্ব পূর্বনির্ধারিত বলে মেনে নিই। কিন্তু তা যথার্থ নয়। য়োরোপীয় গণমানুষের জীবনযাত্রার প্রকৃতমান উনিশ শতকে এসেও আমাদের এই উপমহাদেশীয় মানের তুলনায় উন্নত ছিল না। দলে-দলে মানুষ আমেরিকা গোলার্ধে অভিবাসী হয়েছে। এমনকি একাকী মেয়েরাও। উনিশ শতকের আগে য়োরোপে গণশিক্ষার হার-ও-মান আমাদের তুলনায় উলেস্নখযোগ্য রকম বেশি ছিল না। গড় আয়ু আজকের তুলনায় ছিল অর্ধেকেরও কম। ষোলো শতক থেকে অভাবের তীব্রতাই য়োরোপকে বহির্মুখী করে। আপন-আপন সামর্থ্য বাড়ানোর চেষ্টা ছাড়া তাদের বেঁচে থাকা সহজ ছিল না। এই সামর্থ্যের প্রতিফলন মারামারিতেও। মানব-মানচিত্রের চেহারা এতে পালটেছে। আমেরিকা গোলার্ধ মানসিকভাবে য়োরোপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। বিচিত্র হয়েছে। তবু বিবিধ সমীকরণও থেকে যায়। বিশেষ করে সংস্কৃতির বলয়ে ও ক্ষমতার সমন্বয়ে।
এই কালপর্বে য়োরোপের উত্থানের পেছনে একটা বড় উপাদান প্রোটেস্টান্ট ধর্ম সংস্কার। ১৫১৭-তে মার্টিন লুথার রোমান ক্যাথলিক আচার-নিষ্ঠা, সামাজিক প্রভুত্ব, কায়েমি স্বার্থ ও অলৌকিকের দোহাই দিয়ে নিষ্ঠুর অবিচার, এসবের প্রতিবাদে রুখে দাঁড়ান। আন্দোলনে নামেন। জর্মন এই যাজক বলেন, ব্যক্তি ও ঈশ্বরের মাঝখানে গির্জার শাসকচক্রের অহেতুক হস্তক্ষেপ, অযৌক্তিক দ-বিধান ও অলৌকিকের আনুগত্য বাইবেলে যিশুখ্রিষ্টের বাণীর বিরোধী। গির্জার আমূল সংস্কারের পথ তিনি বাত্লান। ওই কালপর্বেই কিছু পরে ফরাসি ধর্ম-বিপস্নবী কেলভিন আরো যোগ করেন, – ন্যায়নিষ্ঠ অর্থ উপার্জন কোনো পাপ নয়। তেমন সম্পদের বিনিয়োগও নয়। মৌলিক এই দুই নীতির ওপর গড়ে ওঠে প্রোটেস্টান্ট সংস্কার আন্দোলন। দ্রম্নত তা পশ্চিম য়োরোপে ছড়ায়। ধর্ম সংগঠন, ব্যতিক্রমী কিছু গোষ্ঠী বাদ দিলে, মূলে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। ভৌগোলিক বিভাজনেও তা ছড়ায়। পর্তুগাল, স্পেন, ইতালি, ফ্রান্স, এরা রোমান ক্যাথলিক আওতায় থাকে, – যদিও ফ্রান্স রাষ্ট্রপরিচালনায় কেবল ক্যাথলিক আনুগত্যের ওপর নির্ভরশীল থাকে না। অন্যদিকে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, হল্যান্ড, ডেনমার্ক, জর্মনি, এসব উত্তর-পশ্চিম ভাগের দেশগুলো প্রোটেস্টান্ট আদর্শের অনুগামী হয়ে পড়ে। অবশ্য আয়ারল্যান্ড থেকে যায় রোমান-ক্যাথলিক। অবর্ণনীয় দারিদ্র্য ও মহামারি তখন তার নিত্যসঙ্গী। তাকে তীব্রতর করে প্রোটেস্টান্ট উত্তমর্ণের শোষণ। দলে দলে বুভুক্ষু মানুষ ত্রাণ খোঁজে নতুন মহাদেশ আমেরিকায় উদ্বাস্ত্ত হয়ে।
ব্রিটিশ-আইরিশ বিভাজন এখনো মিলিয়ে যায়নি। কিপলিং যদিও গত শতকে তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস কিম-এ ওই নামের নায়ক যে ব্রিটিশ রাজশক্তির অনুগত হয়েও জন্মসূত্রে আইরিশ, এ-কথাটি মনে করিয়ে দেন। একি তাঁর ইচ্ছা পূরণের প্রচ্ছন্ন চাল? এরই প্রতিস্বর কি রবীন্দ্রনাথের গোরা? প্রোটেস্টান্ট উত্থান কিন্তু গোটা য়োরোপে চিমত্মাজগতে বিপস্নব আনে। যাকে বলি ‘এনলাইটেনমেন্ট’, যা পরবর্তী সময়ে মানবভাবনাকে বহুলাংশে শৃঙ্খলমুক্ত করে, তার শুরু প্রোটেস্টান্ট আন্দোলনের ক্রিয়ায়-প্রতিক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ আবেদন থেকে। অবশ্য কোনো কিছুই সরলরেখায় নয়। বাস্তবের-সংকর্ষণে বহুমাত্রিক-বহুরূপ-বহুপথ পেরিয়ে ভিন্নস্থানে ভিন্নকালে বীজ উদ্ভিদে প্রকাশমান হতে পারে। ঘটেও তেমন বারবার। ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তায় অসংখ্য সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে। কী হবে, আর, কী হবে না; কী রবে, আর, কী রবে না, আগে থেকে বলা যায় না। তবে তারা কেউই অলৌকিক নয়। সবই মানুষের কর্মফল। প্রত্যেকটির পেছনে কাজ করে ইহজাগতিক তাড়না; – এবং, স্থান-ও-কালে সহায়-সম্বলের ইন্ধন।
ষোলো শতকের মাঝামাঝিতেও ব্রিটেন কিন্তু ছিল অস্থির। ক্যাথলিক প্রভাব তখনো যথেষ্ট প্রবল। রানী প্রথম এলিজাবেথ ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডকে এক শক্তিশালী প্রোটেস্টান্ট ভিত্তির ওপর দাঁড় করান। পোপ তাঁকে পরিত্যাজ্য ঘোষণা করেন। এই সূত্রে ক্যাথলিক স্পেনের সঙ্গে তাঁর বিরোধ প্রকাশ্যে চলে আসে। অবশ্য স্কটল্যান্ডের ক্যাথলিক রানী মেরিকে দীর্ঘদিন আশ্রয় দিয়েও, পরে সংগত কারণেই ১৫৮৭ সালে মৃত্যুদ- দিতে বাধ্য হয়ে, এলিজাবেথ বিরোধে নতুন মাত্রা যোগ করেন। তার আগে এক কলঙ্কময় অতীত নিয়ে মেরি স্পেনের রাজা ফিলিপকে বিয়ে করে নিষ্কৃতির পথ খোঁজেন। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা ও অন্যান্য জঘন্য অপরাধ সন্দেহাতীত প্রমাণিত হওয়ায় এলিজাবেথের আর কিছু করার ছিল না। বিষয়টি দীর্ঘদিন ঝুলে থাকায় ব্রিটেন ও স্পেনের ভেতর তিক্ততা ক্রমাগত বাড়ে। পোপ অবশ্য মেরিকে নিষ্ঠাবতী
ক্যাথলিক সাধ্বীর (saint) মর্যাদা দিয়ে ভ-ামির চূড়ান্ত করে ছাড়েন। তবে এটিই রেষারেষির একমাত্র কারণ ছিল না। বোধহয় আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল আটলান্টিকের ওপারে বিশাল নতুন জগতের সম্পদ আহরণে সমুদ্রপথের দখল নিয়ে মারামারি। বলেছি, স্পেন ও পর্তুগালই ছিল পথপ্রদর্শক। পঞ্চাশ বছর পেরুতে না পেরুতেই ব্রিটিশ, ফ্রান্স ও ওলন্দাজ নাবিকেরাও প্রতিযোগিতায় নামে। জাহাজ আরো বেশি শক্ত-সমর্থ হয়ে উঠতে থাকে। তা সবারই। একটা তফাৎ অবশ্য হয়। স্পেন ও পর্তুগিজ উদ্যোগ ছিল সরাসরি রাজশক্তির আনুকূল্যে। অন্যগুলো কিন্তু এক-একটা বেসরকারি নৌবহর। মাঝ-সমুদ্রে প্রত্যেকে যার যার মতো স্বাধীন। রাজার, বা, রানীর কোনো দায় নেই। বাস্তবে সবারই নির্ভরতা কামান-গোলা-বন্দুকের ওপর, বোম্বেটেপনায় দক্ষতার ওপর, ও সমুদ্র-শাসনে পারদর্শিতার ওপর। কেউ কাউকে এতটুকু ছাড় দিতে নারাজ। তবে ততদিনে মেক্সিকো থেকে দক্ষেণে সবটার দখল নিয়ে নিয়েছে স্পেন ও পর্তুগাল। ওপরের অংশের উপকূল নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষক্ষ্যই একে-অন্যে মাঝ দরিয়ায় সংঘাত।
প্রথমে পর্তুগাল পিছু হটে। অথবা ভারত মহাসাগরের পথ খুলে যাওয়ায় আরো বড় দাঁও মারার আশায় সেদিকে ছোটে। ফ্রান্স যতটা সম্ভব অন্যদের এড়িয়ে কানাডা অঞ্চলের উপকূলের বেশ কিছুটার ওপর অধিকার ফলায়। সরাসরি সংঘর্ষের জন্য মুখিয়ে থাকে ব্রিটিশ ও স্প্যানিশ জলদস্যুরা। শুধু স্থলভাগে দখল কায়েমই নয়, সুযোগ পেলে প্রতিপক্ষের ধন-দৌলত, বাণিজ্যিক সম্পদ লুণ্ঠনও তাদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। ব্রিটিশ দলপতি হকিন্স ও ড্রেক প্রতিপক্ষ সব দলের হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে দেয়। ১৫৬৭ থেকে পরের আটাশ বছর আমেরিকা উপকূলে ড্রেক যথেচ্ছ লুণ্ঠন চালায়। আমেরিকার অভিনব ফলমূল দেশে এনে রানীকে উপঢৌকন দিয়ে তাঁকে অবাক করে দেয়। তালিকায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, আলু। গরিব আয়ারল্যান্ডে তা-ই হয়ে ওঠে বেঁচে থাকার জন্য প্রধান খাবার। অবশ্য আইরিশ স্থানীয় বাসিন্দা প্রায় সবাই রোমান-ক্যাথলিক দুর্ভিক্ষে-অনাহারে কাতর হয়ে পরে উদ্বাস্ত্ত হয়ে আমেরিকা গিয়ে তারা অনেকে থিতু হয়। কিন্তু প্রোটেস্টান্ট-ক্যালভিনিস্ট ঝুঁকি নিয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে লুণ্ঠনে ঝাঁপিয়ে পড়ায় হকিন্স বা ড্রেকের মতো তারা উৎসাহ দেখায় না।
রানী এলিজাবেথ ছিলেন ফ্রান্সিস ড্রেকের গুণমুগ্ধ। এমনকি তার উদ্যোগে গোপন অংশীদার। সে ছিল তাঁর বিশেষ প্রিয়জন। তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই তিনি আমলে নিতেন না। ‘The Master Thief of the Unknown World’ – এই নামে ড্রেক কিংবদন্তি হয়। রানী তাকে ‘নাইট’ সম্মানে ভূষিত করেন। কীর্তি তার অক্ষয় হয় সমুদ্র অভিযানের নায়ক হিসেবে, ও, অবিসংবাদিত ‘Head of the Pirates Profession’ বলে স্বীকৃতি পেয়ে।
উত্তর আমেরিকায় আজ যা যুক্তরাষ্ট্র বলে পরিচিত, তখন তাকে মনে করা হতো নিউ ইংল্যান্ড। কানাডাতেও ছিল তার বিস্তার। প্রোটেস্টান্ট ধ্যান-ধারণা প্রবল। আচার-বিচারের পিছুটান কম। ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তি-উদ্যোগ নিয়মকানুনের বাধা-নিষেধে পিছু হটে না। নামে ব্রিটিশরাজ সর্বময় কর্তা। কিন্তু তা যেন শুধু এক নিয়ম-রক্ষা। জনগণের মানসিকতায় তার প্রভাব ক্ষীণ। এই মুক্তি চিমত্মাবিদদেরও আগ্রহ জাগায়। উনিশ শতকেও কাল মার্কস যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি তুলনায় সদয় ছিলেন। ভিন্নমত প্রকাশের অনুকূল বলে তিনি তাকে মনে করতেন।
দক্ষিণ ভূখ– কিন্তু রোমান ক্যাথলিক ‘আচারের মরুবালুরাশি’ অবাধে ঢুকে পড়ে। ঢুকে পড়ে যাজকদের কায়েমি স্বার্থ ও সৎ পরিশ্রমে ব্যক্তির আলম্ব উত্থানে সংস্কারের বিধি-নিষেধ। এদিকে অঢেল সম্পদে লোভ অবাধ। প্রয়োজন দাস ও শ্রমিক। কারণ তখন সম্পদ উত্তোলনে, অথবা, উৎপাদনে সরাসরি তারাই জরুরি কার্যকর শক্তি। সহজ কার্যোদ্ধারের উপায় ক্রীতদাসের আমদানি, – প্রাচীন জনগোষ্ঠীকে দাস হিসেবে ব্যবহার করা ও বাইরে থেকে চুক্তিবদ্ধ শ্রম এনে স্থায়ীভাবে কাজে লাগানো। ইংরেজ, ফরাসি বা ওলন্দাজ মালিকরাও পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে ও তার সংলগ্ন উপকূলীয় অঞ্চলে এসবে বিন্দুমাত্র অরুচি দেখান না। আফ্রিকার বন্দর পাঠায় শৃঙ্খলিত কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস-ক্রীতদাসী, শ্বেতাঙ্গ দাসী যে থাকে না, তা নয়। তবে তাদের ব্যবহার বেশিরভাগ ভিন্নতর। উনিশ শতক থেকে ভারতবর্ষও শ্রমের জোগান দিতে থাকে। তবে এরা ক্রীতদাস নয়। চুক্তিভিত্তিক বাধ্যতামূলক শ্রম (Indentrued labour)। বিশেষ করে ব্রিটিশশাসিত পশ্চিম-ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে ও তাদের সংলগ্ন উপকূলীয় ভূখ–।
এই ক্রীতদাস-প্রথা কিন্তু বহু পুরনো। প্রাচীন গ্রিক সভ্যতাতে এর প্রচলন ছিল। এমনকি প্রজাতন্ত্রের অনুমোদিত মানব-মুক্তির অনুশীলনেও। কারণও কিছুটা অনুমেয়। উৎপাদন-প্রযুক্তি তখনো প্রাথমিক পর্যায়ের। প্রায় পুরোটাই প্রত্যক্ষ শ্রমনির্ভর। জনসংখ্যা অপ্রতুল। জোর খাটানো যায় কারা-বন্দিদের ওপর – সে যে স্তরেরই হোক। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। অতএব গড়ে ওঠে দাস কেনাবেচার প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন। শুধু এই নয়। যুদ্ধে লুটের ভাগ-বাটোয়ারায় বন্দি নারীদেরও রেহাই মেলে না। হোমারের ইলিয়াডের শুরুই তো ব্রাইসিস নামে একিলিস্নসের যুদ্ধেজেতা এক সুন্দরীকে সেনাপতি আগামেমননের জবরদখল করার হুকুমের পরিণতিতে বিবাদ দিয়ে। শেষ পর্বে পড়ি, ট্রয়ের নিহত রাজকুমার হেক্টরের সদ্য-বিধবা পত্নী আন্দ্রোমাশের বিলাপ-সংগীত, যাতে ফুটে ওঠে তার শঙ্কা আপন ছেলের ও তার নিজের বন্দিজীবনের দাসত্ব নিয়ে। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে স্পার্টাকাসের বিদ্রোহ ততউর্বর গাথা। দাসপ্রথা দূর-অতীতেই মিলিয়ে যায়নি। ভূমধ্যসাগরের দুই পারে তার রমরমা ব্যবসা দুশো বছর আগেও চালু ছিল। হাজার বছর আগের আরব্য রজনীর উপাখ্যানেও ঘুরেফিরে আসে শ্বেতাঙ্গ মামলুক ও কৃষ্ণাঙ্গ হাবসি ক্রীতদাসদের কথা, যাদের পৌরুষ সুন্দরী রাজকন্যাদের কাছে ছিল অমূল্য আকর্ষণীয়। উনিশ শতকের বাজারচিত্রতেও দেখি, কেনাবেচার সামগ্রী হিসেবে সারি-সারি নগ্নবক্ষা রূপযৌবনা নারী, শ্বেতাঙ্গিনীও; খোলাখুলি চলছে তাদের দরদাম। ষোলো শতক থেকে সমুদ্রের অধিকার কায়েম করে স্প্যানিশ-পর্তুগিজ বণিকেরা আফ্রিকার উপকূলে ডেরা বেঁধে সেখান থেকে জোরজবরদসিত্ম খাটিয়ে দাস-দাসী জোগাড় করে আমেরিকা ভূখ– আপন-আপন অধিকার বলয়ে নিয়ে গিয়ে বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োগ করে। মানবিক আইনকানুন এখানে অবান্তর। শ্রমের প্রাথমিক প্রয়োজনই মুখ্য। অভিবাসী ইঙ্গ-ফরাসি জনগোষ্ঠী তুলনায় নমনীয়। তবে বাধ্যতামূলক শ্রম আদায়ে কেউই পিছপা থাকে না।
এই অবমাননার অতলে এবং, খানিকটা তো বটেই, এরই ধারাবাহিক অনিবার্যতায়, নতুন রূপান্তরের বীজ একটু-আধটু জেগে উঠতে থাকে। সময় নেয় প্রায় তিনশো বছর। কিন্তু ল্যাটিন আমেরিকা অগ্রসর হয়, আপন পরিচয়ে জাগ্রত হওয়ার পথে। স্পেন-পর্তুগালের ঐতিহ্য হারিয়ে যায় না। এখনো অনেক দুঃখ তার সংযোগ রেখায়। কিন্তু ওই বিশাল ভূখ- নিজেকে চেনাতে থাকে নব-নব রূপে। এই চেনানোও সৃষ্টি করে নতুন-নতুন সম্ভাবনার। ‘স্তব্ধ আসনে প্রহর’ গোনা, – এর শেষ নেই। মূল্যবিচার অবশ্য সবসময়ে আপেক্ষেক।
আজ ল্যাটিন আমেরিকার কোনো দেশই স্পেন, পর্তুগাল বা ব্রিটিশ-ওলন্দাজ উপনিবেশ নয়। যে-যেখানে পত্তন গাড়ুক, কেউই তার প্রাথমিক বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে পারে না। মানব-মানবী-পরিম-ল, ভূপ্রকৃতি ও জীবন-অভিজ্ঞতা আলাদা-আলাদা পরিচয়ের নিশান তোলে। উনিশ শতকের গোড়ায় স্প্যানিশ আমেরিকায় সাইমন বলিভার, সান মার্টিন, ও’হিসিন্স্, – এঁদের নেতৃত্বে স্বাধীনতা-সংগ্রাম ক্রান্তিকালে পৌঁছোয়। ১৮২২ সালে ল্যাটিন আমেরিকায় স্প্যানিশ উপনিবেশ আর থাকে না। যদিও অভ্যন্তরীণ আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা ও স্বার্থের বিভিন্নতা তাকে একক রাষ্ট্রিক পরিচয় দেয় না। তা না দিলেও স্প্যানিশ ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি সেখানে স্থায়ী আসন গাড়ে। স্প্যানিশ সাহিত্যের প্রবলতার ধারা এখন ল্যাটিন আমেরিকাতেই। দ্বান্দ্বিক বৈচিত্র্যে তার প্রকাশ আজ প্রাণের স্পর্শে সমর্থর, উজ্জ্বলতর ও জীবন-মহিমায় পূর্ণতর। ব্রাজিলও ১৯২২-এ পর্তুগিজ অধিকার অস্বীকার করে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র প্রায় তাৎক্ষণিকই এদের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়। তার নিজেরও ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অভিজ্ঞতা। ১৭৭৬ সালে তার স্বাধীনতা ঘোষণা আর ১৭৮৯-তে – দুনিয়া-কাঁপানো ফরাসি বিপস্নবের বছরেই – জর্জ ওয়াশিংটন গঠনতান্ত্রিক সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত হন প্রথম রাষ্ট্রপতি। তার আগে অবশ্য সাত বছরের ইঙ্গ-ফরাসি যুদ্ধের (১৭৫৬-৬৩) অনুসরণে প্রাপ্ত সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশ শক্তি ফরাসি কানাডা দখল করে নেয়। তবে ফরাসি কানাডার স্বাতন্ত্র্য গোটা দেশটি এক হওয়ার পরেও অক্ষুণ্ণ থাকে। তার সংস্কৃতি এখনো সজীব। এটা খেয়াল করবার, পশ্চিম য়োরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা যত মানবমুখী হয়, তত তার প্রতিফলন মেক্সিকোর ওপরভাগে ঘটে চলে। এমনকি প্রাচীন ঐতিহ্যের পিছুটান কম থাকায় ইহজাগতিক কল্যাণভাবনার বাস্তবায়নে সেই সময়ের যৌক্তিক বিচারে আলম্ব অগ্রসরমান সমাজ গড়ে তোলার পরীক্ষা-নিরীক্ষা তারা অনেক খোলামনে করতে পারে। অভিজাততন্ত্র কায়েমি স্বার্থের ছড়ি ঘোরায় না। অন্ধবিশ্বাসের স্বপ্নকল্পনা বা পিছুটান প্রবল হতে পারে না। অবশ্য সেই বাস্তবতার বিচারও আপেক্ষেক। কোনো পরম ধ্রম্নবত্ব এতে নেই। তেমন কোনো ধ্রম্নবত্বকে প্রবহমান বাস্তব যৌক্তিক প্রক্রিয়া অস্বীকার করে। দক্ষেণের দেশগুলোয় রোমান-ক্যাথলিক শুভাশুভের আচার-বিচার অনর্গল জ্ঞানকা-কে উৎসাহ দেয় না। স্বীকারোক্তি (Confession) ও মহাবিচার (Inquisition) মানুষের হাতে-পায়ে শিকল পরিয়ে রাখে। প্রত্যাশিত শ্রীবৃদ্ধি ঘটে না। যদিও সমাজে বহুমুখী দ্বান্দ্বিকতা পরস্পর জড়াজড়ি করে নশ্বর মানবজীবনে দুর্ভোগ বাড়ায়। বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ থাকা সত্ত্বেও।
তবু কোনো কিছু স্থির থাকে না। তিন-চারশো বছর আগে দাসত্বের শৃঙ্খলে যারা বাঁধা থেকেছে, স্বদেশের সমাজ-সংসার যাদের মনে আশাহীন-অনুকম্পাহীন বেদনা জাগিয়েছে, মন্থনে-মন্থনে, মিশ্রণে-মিশ্রণে তাদেরই উত্তর প্রজন্ম হয়ে উঠেছে ওইসব দেশে স্বাভাবিক নাগরিক। কোথাও বা ক্ষমতার অংশীদার। শুদ্ধ স্প্যানিশ বা শুদ্ধ পর্তুগিজ কোথাও খুঁজে মেলে কি না সন্দেহ। যদিও তারাই স্প্যানিশ-পর্তুগিজ সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রবলতর প্রবাহ। বিশ্বজুড়ে তাদের স্বীকৃতি। এমন কি পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে যে ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ, সেখানেও কৃষ্ণাঙ্গ ও ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের প্রাধান্য। কী রাষ্ট্রশাসনে, কী সাহিত্য-সংস্কৃতিতে। অতীতের অন্যায়কে পরিহাস করে বর্তমানের অর্জন। তবে দ্বন্দ্বের শেষ নেই। চলারও বিরাম নেই। ব্যক্তির নশ্বরতা ‘পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়’। কর্মকা- বিরতিহীন বাস্তবের পথরেখায় চলে। ‘মানব থেকে যায়’।
এতদিন অজানা সমুদ্রপথের সন্ধান মেলায় পশ্চিম য়োরোপের উপকূলীয় দেশগুলোয় যে নতুন কর্মচঞ্চলতা জাগে তা এক কথায় যুগান্তকারী। শুরু হয় নতুন-নতুন দেশে উপনিবেশ গড়ার প্রতিযোগিতা। মানবিক মূল্যবোধ যদি মার খায়, তবু। আবার তার ওপরে ভর করেই সমাজ-সভ্যতার রূপান্তর; এমন কি শ্রীবৃদ্ধি। আটলান্টিক পেরিয়ে এই অভিযানের গতিমুখ কিছুটা বোঝার চেষ্টা করেছি। ভারত মহাসাগর পেরিয়ে আফ্রিকা, এশিয়া ও ওশিয়ানিয়ায় কী সুদূরপ্রসারী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ধারা চলমান, তা-ও আমাদের জানা প্রয়োজন। মানুষের হয়ে ওঠার-না-ওঠার ইতিহাসে একে উপেক্ষা করা যায় না। তবে আপাতত এদিকে দৃষ্টি না-দিয়ে সম-সময়ে য়োরোপেরই পূর্বভাগে মানবযাত্রা কোন দিকে যায়, তা বোঝার চেষ্টা করি। অবশ্য নেহাত-ই ওপর-ওপর। বিশৃঙ্খলও বটে।
বিশ্বসভ্যতার উৎসভূমি ছিল কিন্তু এসব অঞ্চলেই। মিসর, ব্যাবিলন, ভারত, গ্রিস, চীন – এরা ছিল চিমত্মায়-আদর্শে-কর্মে-সংস্কৃতিতে ও বহুজনের একত্র বসবাসের সুসম্বদ্ধ নিদর্শন রচনায় অগ্রগামী। যদিও ভূপ্রকৃতির বিভিন্নতায় বৈচিত্র্যও কম ছিল না। পরে বিপুল প্রভাববিস্তারী ধর্ম প্রবর্তনাও এই অঞ্চল থেকে। অনিত্য জীবনে অসহায় মানুষের শূন্যতার অর্থহীন আগ্রাসনকে আড়াল করে তারা এখনো। কখনো কখনো অযৌক্তিক আবেগে নির্মম দ্বন্দ্বে তারা প্রেরণা। এবং ছড়ায় তা বিশ্বব্যাপী। পাশবিক নৃশংসতাও তাতে উৎসাহ পায়। এখানে যা বলবার, য়োরোপের পূর্বপ্রান্তে গত পাঁচশো বছরে এরা সিত্মমিত হয়নি। যুক্তি-বিজ্ঞানের অবাক করা অগ্রগতি সত্ত্বেও ঐতিহ্যের প্রাসাদে প্রাসাদে এদের অর্চনা আবেগের উন্মাদনায় অব্যাহত এখনো। বাস্তব ইন্ধন জুটলে ছড়ায় বিশ্ব জুড়েই। উদ্ধত কায়েমি স্বার্থের মানবিক বোধবর্জিত নিরাবেগ উপায় হতে পারে তা সবখানে। এবং সব যুগে। সংহতির ইতিবাচকতা সত্ত্বেও। নাম-ধাম যা-ই হোক।
সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই পুবদিকে এশিয়ার সঙ্গে য়োরোপের যোগাযোগ। সচেতনভাবে দুই মহাদেশের অধিবাসী বলে নয়। কারণ মহাদেশের ধারণাই অর্বাচীন। মানব প্রকৃতির স্বাভাবিক আকর্ষণে-বিকর্ষণে, দ্বন্দ্বে-মৈত্রীতে যৌথ শক্তির পারস্পরিক বিস্তারে ও সংকোচনে এই যোগাযোগের ধারাবাহিকতা। প্রাথমিক তাগিদ আসে ভূপ্রকৃতি ও জলবায়ুর বৈচিত্র্য থেকে। তাতে যুক্ত হয় যূথবদ্ধ মানব-মানবীর বেঁচে থাকার, ও, আরো ভালোভাবে বাঁচার জৈবিক অন্বেষণ। মানব-সম্প্রদায়ের এই মরিয়া জিজীবিষা তাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। একে-অন্যে পরস্পর সংযোগের নৈকট্যে-দূরত্বে, স্বার্থের সংঘাতে-ঐক্যে সম্পর্ক সব আকার পায়। ভাঙা-গড়ার খেলাও চলে। তবে যুগ-যুগান্তর বেয়ে ঐতিহ্যের ধারাও একটা গড়ে ওঠে।
আমরা জানি প্রাচীন গ্রিকদের কাল থেকেই পারস্য ও ভারতবর্ষ নিয়ে তাদের মনে এক সশ্রদ্ধ কৌতূহল ছিল। পারস্পরিক দেওয়া-নেওয়ায় কোনো হীনম্মন্যতা কারো ছিল না। ভূমধ্যসাগরের ওপারে মিসরও ছিল প্রায় একই বৃত্তে। পরে রোমে বাইজান্টিয়ান আমলেও। আর চীন ছিল দূরের রহস্য। সভ্যতায় স্বয়ম্প্রভ। প্রাচীনতরও।
কিন্তু পরিস্থিতি পালটায় গ্রিস ও রোমের পতনে। পোপ হয়ে ওঠেন খবরদারিতে নাটের গুরু। সাধারণ মানুষের হাজার সমস্যা। দাওয়াই বাত্লান, একজনের-পর-আর-একজন ধর্মযুদ্ধ। ক্রুসেড। খাবার জোটাবার দায় নেই। যুদ্ধে জিতলে লুটপাটে যে-যার মতো ধন্য-ধন্য করবে। মরে গেলে প্রভুর কৃপালাভ! ওই সময় সেনাবাহিনীর বাড়তি প্রশিক্ষণের প্রয়োজন সামান্যই ছিল। কৃষক-শ্রমিক-জনতার কানে ধর্মের অলৌকিক নির্দেশ পোপের ঘোষণায় জারি করলেই হলো। ফ্রান্স, গ্রিস, ইতালি, হাঙ্গেরি, এরকম সব জায়গা থেকে দলে দলে জোটে ধর্মযোদ্ধা। ১০৯৬ থেকে ১২৭০-এর ভেতর ক্রুসেড ঘটে আটবার। ক্ষয়ক্ষতি কমবেশি প্রতিবারই দুপক্ষে উত্তেজনা আরো বাড়ায়। কিন্তু সুনিশ্চিত জয়-পরাজয় কিছু ঘটে না। যদিও রিচার্ডস, সালা’দিন, – নামগুলো বীরত্বে কিংবদন্তি হয়। অবশ্য ক্রুসেডের পরিসমাপ্তি এখানেই ঘটে না। পনেরো শতকের শেষাশেষি ও ষোলো শতকের গোড়ায় স্পেন এরকম একাধিক ধর্মযুদ্ধে জড়ায়। ১৪৯২-তে পরিণত হয় তা অবিসংবাদিত রোমান ক্যাথলিক রাষ্ট্রে। আবার ১৫০৯-১১-এ উত্তর আফ্রিকাতেও তার অনুরূপ অভিযান। তুর্কিশক্তি অনেক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকারে বাধ্য হয়। এলিয়টীয় অতীত পরবর্তী-বর্তমানকে তাড়া করে ফেরে।
কিন্তু এর কোনোটিই নতুন সমুদ্রপথের সন্ধান পাওয়ার পরিণামে ঘটে না। জিব্রালটার, ও মরক্কো-আলজেরিয়ার মাঝখানে সমুদ্র একটা খাঁড়ি মাত্র। খলিফা ওমরের কালেই (সপ্তম শতকের মাঝামাঝি) তাঁর দুর্ধর্ষ সেনানায়করা স্পেনে সফল অভিযান চালান। অন্যদিকে কলম্বাস-ভাস্কো-ডা-গামার কীর্তি যে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি করে, তার ফল হয় সুদূরপ্রসারী। বাণিজ্য হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক প্রভুত্ব স্থাপনের ও সাম্রাজ্য-বিস্তারের হাতিয়ার। ন্যায়-অন্যায়, বৈধ-অবৈধ যা-ই হোক না কেন। এতে পশ্চিম য়োরোপে সমুদ্রতটের দেশগুলোর বাড়তি সুবিধা। চোখেও পড়ে বেশি। কিন্তু পুবে এশিয়া ও আফ্রিকার যোগাযোগ মানব-সভ্যতার সমান বয়সী। পরিবর্তনের হাওয়াও শুরু থেকে সঙ্গে সঙ্গে বয়ে চলে। হঠাৎ করে সমুদ্রপথ খোলার মতো এক ধাক্কায়, বা তার প্রবল টানে নয়, কিন্তু স্থান-কালের বস্তু ও ভাবগত সমীকরণের চলমান রূপান্তরের পথ বেয়ে। ঘাত-প্রতিঘাতের অভ্যস্ত টানাপড়েনে। সমুদ্রপথে অভিযানের পরিণামের মতোই আন্তর্মহাদেশীয় বিস্তারে ক্ষমতার নতুন বিন্যাস ঘটে। সমূহ জীবনের কর্মকা– সীমান্তরেখার প্রায় সবটা জুড়েই কেন্দ্রভূমি ও দিকনির্দেশ বদলে যায়। অথবা কোথাও কোথাও দোলাচলে বিভ্রান্তি বজায় থাকে।
প্রাচীন গান্ধার-ভাস্কর্যের যে-নিদর্শন দেখি তা আনুমানিক ২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ১০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্বের। বিষয় গৌতম বুদ্ধ বা তাঁর দেশনা হলেও শিল্পকর্মে ধরা পড়ে নির্ভুল গ্রিক ছাপ। মেগাস্থিনিসের বিবরণ থেকে জানতে পাই আনুমানিক ৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজধানী পাটলিপুত্রের বিস্তারিত কথা। বাণিজ্য বৃত্তান্তও। য়োরোপে রেনেসাঁ পর্বে (১৩০০-১৫৫০ খ্রিষ্টাব্দ) ইতালি থেকে চীন অবধি ‘সিল্ক রোড’ ধরে রমরমা বাণিজ্য চালু ছিল। পোপ ও তাঁর যাজকচক্রের অবিমৃষ্যকারিতায় পরে এতে ভাটা পড়ে। ইতালির সমৃদ্ধি লুপ্ত হয়। য়োরোপের মনন ও কর্মপ্রতিভা মার্টিন লুথারের প্রোটেস্টান্ট ধর্ম-আন্দোলনের পথ ধরে। সঙ্গে যুক্ত হয় সৎ চেষ্টায় ব্যক্তির ইহজাগতিক উন্নয়ন যে ধর্মবিরুদ্ধ নয়, কেলভিনের এই প্রচারণা। তবে পূর্ব সীমান্তে য়োরোপের তখন নাজেহাল দশা। একের পর এক বাইরের আক্রমণে বিপর্যস্ত।
এই বাইরের আক্রমণ বাস্তবত দুদিক থেকে। সংযোগে ও সংকর্ষণে, পারস্পরিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকলেও, কখনো-কখনো তাদের তফাত প্রায় মিলিয়ে যায়। আর এই হামলা-হাঙ্গামার পরিণতিতে বিজেতা ও বিজিত যদি একই এলাকায় স্থায়ী হয়, তবে অনতিবিলম্বেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এসে আচার-ব্যবহার-ভাষা-সংস্কৃতির নির্মীয়মাণ মাধ্যাকর্ষণ তাদের জীবনযাত্রার তাগিদ অনেকটা একাভিমুখী করে তোলে। পুবে উত্তর ও মধ্য এশিয়ার বিশাল অবিচ্ছিন্ন স্টেপ-প্রান্তরের অশ্বারোহী যাযাবর দলসমূহ ও তুরস্কের সভ্যতা-লুব্ধ আগ্রাসী জনসমুদয় একাদশ শতক থেকে শুরু করে অন্তত ষোড়শ শতক পর্যন্ত পূর্ব য়োরোপে তাদের অভিযান অব্যাহত রাখে। বিকাশমান ধর্মপ্রতিষ্ঠানের প্রায়োগিক সুবিধা-অসুবিধার, গৌরব-অগৌরবেরও একটি দ্বান্দ্বিক ভূমিকা আছে। তবে এদিকে খুব বেশি নজর দিতে চাই না। এটাও মনে রাখি, স্টেপ-প্রান্তরের যাযাবরেরা বা তুর্কো-আফগান ভাগ্যান্বেষী সেনানায়করা শুধু য়োরোপেই বারবার হামলা চালায়নি, চীনে, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেও তাদের প্রবেশ ঘটেছে। আপন-আপন সভ্যতার বিকাশের পাশাপাশি এই বর্বরতাও তার ছাপ রেখেছে। ঘটমান বর্তমানেও এদের ধারাবাহিক রূপান্তরের প্রতিফলন দুর্নিরীক্ষ্য নয়।
ওই সময়ে আমরা দেখি তুর্কো-মোঙ্গল-আফগান শক্তির প্রবল প্রতাপ। আরব অভ্যুত্থানের কেন্দ্রভূমি স্থানান্তরিত হয় তুরস্কে। আর পূর্ব য়োরোপের প্রতিরক্ষাব্যূহ তছনছ হয় বারবার। স্টেপ-প্রান্তরেই কাস্পিয়ান সাগরের আশপাশে কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, এইসব অঞ্চলে স্থায়ী মোঙ্গল রাজশক্তির উদ্ভব ঘটতে থাকে। ওদিকে য়োরোপে কৃষ্ণসাগর ঘিরে ইউক্রেন, জর্জিয়া, হাঙ্গেরি, বসনিয়া, বুলগেরিয়া, ম্যাসিডোনিয়া, এমনকি গ্রিস, তুর্কো-মোঙ্গল হামলায় বারবার বিপর্যস্ত হয়। সবচেয়ে হিংস্র, সবচেয়ে ভয়াবহ অভিযান চালান (১২০৬-২৭) চেঙ্গিস খান। গোটা স্টেপ-প্রান্তর, ভোলগা থেকে আমুর অববাহিকা পর্যন্ত তাঁর লুণ্ঠন অবিরাম চলে। পরেও তা অব্যাহত থাকে। প্রসারিত হয় পারস্যে, ইরাকে, আনাতোলিয়ায় (১২৫৮) এবং গোটা চীন ভূখ–ও (১২৭৯)। কিন্তু এসব অভিযান কোনো প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলায় উৎসাহী ছিল না। কোনো উন্নততর সমরাস্ত্রও তারা ব্যবহার করেনি। শুধু সংঘবদ্ধ দুঃসাহস ও নির্বিচার হত্যা ও লুণ্ঠন, এই দিয়েই তাদের ত্রাসের সঞ্চার। শান্ত সমাজের মানবিক বোধ স্বয়ং গণমানবকে অপ্রস্ত্তত রাখে। তবে এমন বিভীষিকারও শেষ আছে। ত্রয়োদশ শতাব্দীর অন্তিম-লগ্নে মোঙ্গলদের আধিপত্য বিলীন হলেও শুধু এ বিভীষিকার স্মৃতি রেখে যায়। তুর্কো-মোঙ্গল কতিপয় সমরনায়ক, যেমন তৈমুর লং (১৩৬০-১৪০৪), নাদির শাহ (দিলিস্নতে হত্যা-লুণ্ঠন, ১৭৩৮-৩৯) এত দুর্ধর্ষ না হলেও এই রকম আরো কেউ কেউ অবশ্য তার ধারাবাহিকতা পরেও বজায় রাখে। মানব-সভ্যতার অগ্রাভিযানে এদের ছাপ বিন্দুমাত্র কোথাও থাকে না। পিছুটান অবশ্য সবসময় সন্ত্রস্ত রাখে।
এখানে খুব প্রাসঙ্গিক না হলেও একটা বিষয় কিঞ্চিৎ বিশদ করি। ১২৬০ সালে মিসরের মামলুক রাজশক্তি মোঙ্গলদের পরাস্ত করে তাদের প্যালেস্টাইন ও সিরিয়া থেকেও তাড়িয়ে দেয়। মামলুক শাসন মিসরে ওই কালপর্বে দীর্ঘস্থায়ী হতে পেরেছিল (১২৬০-১৩১৭)। আরব্য রজনীর উপাখ্যানে শ্বেতাঙ্গ ক্রীতদাস মামলুকদের কথা আগে একবার বলেছি। কিন্তু কেমন করে এই দাসরাই গড়ে তোলে দীর্ঘস্থায়ী রাজ্যশাসন পর্ব? কল্পকথায় নয়, ঐতিহাসিক বাস্তবতায়? এর মূলে আছে মধ্যপ্রাচ্যে জীবনধারায় ধারাবাহিক নেতৃত্বে উত্তরাধিকার নির্ণয়ে অস্পষ্টতা। সপ্তম শতকেই লক্ষ করি বারবার তার নির্মম পরিণাম। কখনো বা বিপুল শোকাবহ। এদিকে মামলুক বা হাবসিরা ক্রীতদাস হলেও তাদের কাজ কিন্তু বাধ্যতামূলক প্রাসাদ রক্ষার ও অস্ত্রচালনায় জীবনের ঝুঁকি নিয়েও পারদর্শী হবার। রাজ্যশাসনে উত্তরাধিকারে শূন্যতা দেখা দিলে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় দক্ষ মামলুকদের নজর এদিকে পড়া স্বাভাবিক। ঘটেও তেমন বারবার। শুধু মিসরে ওই সময়ে নয়, ভারতবর্ষেও তুর্কো-আফগান শক্তির প্রাথমিক লুণ্ঠন ক্রিয়ায়, ও কিছু পরে রাজ্য প্রতিষ্ঠায়। গজনির সুলতান মাহমুদ ছিলেন এক তুর্কো মামলুকের স্বঘোষিত সমত্মান। ৯৯৮-১০৩০ খ্রিষ্টাব্দ, এই সময়ের ভেতর তিনি আটবার ভারতবর্ষে হামলা চালান। কিন্তু কোনো রাজ্যপ্রতিষ্ঠা করেন না। গাঙ্গেয় অববাহিকায় আফগানিস্তান থেকে এসে দিলিস্নতে প্রথম অধিকার কায়েম করেন কুতুবুদ্দিন আইবেক (১২০৬)। তিনিও ছিলেন তুর্কি দাস-সেনাপতি। পরবর্তী কজন সুলতানও তাঁর ধারা বজায় রাখেন। দিলিস্ন মসনদে উত্তরাধিকারকা- বেশ কবার পারিবারিক রক্তক্ষয় ডেকে আনে। মামলুক, বা দাস রাজত্ব ওই কালখ– মধ্যপ্রাচ্য থেকে গাঙ্গেয় অববাহিকা অঞ্চলে কখনো কখনো কার্যকর হতে পেরেছিল এক বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে। বাস্তবই অনিশ্চয়তাকে প্রশ্রয় দেয়। তুর্কো-মোঙ্গল আদিমতার বিরোধিতা বা মিশ্রণ ভিন্ন কোনো স্থিতিশীল ব্যবস্থায় উৎসাহ জোগায় না।
তবে ক-শতাব্দী পার করে মোঙ্গলদের দাপট থিতিয়ে আসে। প্রধান কারণ, য়োরোপে গোলাবারুদের ব্যবহার চালু হলে তরবারি হাতে ঘোড়-সওয়ার বাহিনী তার সঙ্গে আর পাল্লা দিতে পারে না। অভ্যস্ত জীবনাচরণ থেকে তারা বেরিয়েও আসে না। ফলে ক্রমশ পিছু হটে। তুর্কো-আফগান শক্তি অবশ্য অবান্তর হয়ে পড়ে না। মননশীলতায় ও জীবনচর্চায় আববাসীয় স্বর্ণযুগ পেরিয়ে আসার পর যে-অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়, তা থেকে উত্তরণ ঘটে তুরস্কে ওসমানীয় খিলাফত (অটোমান এম্পায়ার) প্রতিষ্ঠায়। সুন্নি বিশ্বাসের পক্ষে আনুগত্য ঘোষণা করে মক্কা-মদিনার কর্তৃত্বও তারা পায়। দীর্ঘকাল (১২৮৪-১৯২১) শাসনের প্রথম দুশো বছর পূর্ব ও মধ্য য়োরোপে হানা দিয়ে তারা তাদের ব্যতিব্যস্ত রাখে। প্রোটেস্টান্ট আন্দোলন ও জ্ঞানকা– নবতরঙ্গ এবং বিবিধ উৎপাদনে তার প্রভাব-সমরাস্ত্র উদ্ভাবনের – অবশ্য তার পরে তুরস্ককে পিছু হটতে বাধ্য করে। ষোলো শতকের শেষভাগ থেকে য়োরোপই ঢুকে পড়তে থাকে এশিয়ায়। যদিও নানা রকম ঘাত-প্রতিঘাত ও রূপান্তর প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে। এখানে প্রবলতম ভূমিকা রাশিয়ার, সরাসরি প্রোটেস্টান্ট আন্দোলন যেখানে সামান্যই ছাপ ফেলে। তারা প্রাক-রোমান, অর্থাৎ অর্থোডক্স চার্চের প্রতি তাদের আনুগত্য অক্ষুণ্ণ রাখে। এতে জীবনাচরণে একধরনের প্রশ্নহীন বাধ্যতা একেবারে মূলে বাসা বাঁধে। পরে অনেক বৈপস্নবিক রূপান্তরেও, এমনকি গির্জার শাসন অস্বীকার করাতেও এই সামষ্টিক মনোবৃত্তির প্রকাশ চোখে পড়ে। সব বিপস্নবই সেখানে ওপর থেকে নিচে ছড়ায়। মনীষীদের ভাবনাও অনুরূপ।
এখানে বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে ১৫৬৪ সালে জার চতুর্থ আইভানের য়োরোপ পেরিয়ে পুবদিকে সাইবেরিয়ার বিশাল সমতলভূমি ও তৃণভূমি রুশ শাসনের আওতায় আনা, আঠারো শতকের গোড়ায় পিটার দ্য গ্রেটের পশ্চিম য়োরোপের প্রযুক্তি ব্যবহার প্রক্রিয়া আত্মস্থ করেও অর্থোডক্স চার্চকে পাশে রাখা, হুকুম জারি করে তথাকথিত অভিজাতদের ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্ত খর্ব করা, কাস্পিয়ান সাগরের পার পর্যন্ত রাশিয়ার সীমা নিশ্চিত করা, – এ সবই পুবদিকে রাশিয়াকে প্রসারিত করে চলে।
রানী দ্বিতীয় ক্যাথারিন (রাজত্বকাল, ১৭৬২-৯৬) অর্থব্যবস্থায় উন্নতি ঘটান, সরকারি রাজস্ব বাড়ে, অভিজাত শ্রেণির বাইরেও কেউ দক্ষতা বাড়াতে পারলে সামাজিক স্বীকৃতি পায়। রাশিয়ার একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আগে তা অকল্পনীয় ছিল। কৃষ্ণসাগরের আশপাশে তুর্কি কর্তৃত্বও তিনি খর্ব করেন। পশ্চিম তীরে য়োরোপীয় শক্তি উপনিবেশ গড়ার প্রতিযোগিতায় নামে। একই কালপর্বে রাশিয়াও পুবদিকে বিশাল ভূখ- নিজের করে নেয়। পশম, কাঠ, আমিষ খাবার, এসবের জোগান বেড়ে যায় বহুগুণ। অতি মূল্যবান খনিজ পদার্থের সন্ধানও মেলে প্রচুর। মোঙ্গলদের বাড়াবাড়ি থামিয়ে দেয় ইউক্রেনের কসাকরা, (কসাক জনপদ-কথা পড়ুন সলোকভের চারখ– অ্যান্ড কোয়ায়েট ফ্লোস দ্য ডন-এ), কৃষ্ণসাগরের অন্য পারে সস্নাভ জনগোষ্ঠীরাও। অথচ একে উপনিবেশবাদ বলা যায় না। সবাই তারা রুশ জারতন্ত্রে এক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অধীন। আমরা যা দেখি তা হলো ষোলো শতক থেকে শুরু করে য়োরোপের দুপাশেই দুভাবে তার নিজের প্রসারণ। তবে এশিয়া মহাদেশে রাশিয়ার বিস্তার কোথাও তেমন সাড়া জাগায় না। কারণ, তাতে ব্যতিক্রমী কিছু ধরা পড়ে না। সমুদ্রপথে অভিযান চালিয়ে দেশ-মহাদেশ দখল করা তুলনায় অভিনব ও রোমহর্ষক। তারপরেও পশ্চিম য়োরোপের স্বার্থবাহী শক্তিগুলোর আটলান্টিক পেরিয়ে উপনিবেশ গড়ার সঙ্গে ভারতবর্ষে আসার সংযোগপথ ধরে অগ্রসর হওয়ার গুণগত তফাত আছে। এবার এদিকটি বোঝার চেষ্টা করি।
তিন
আমেরিকা ছিল শুধু অজানা নয়, অভাবিতপূর্বও। কলম্বাস নিজেও মনে করেছিলেন, তিনি ভারতভূমি স্পর্শ করেছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জ এই নাম পায় এমন ধারণা থেকে। পরে আমেরিগো ভেসপুচি এই ভ্রান্তি দূর করেন। ওই ভূভাগও তাঁর নামে পরিচিত হয়। ভারতবর্ষ, চীন বা পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ কিন্তু য়োরোপে অভিজ্ঞতার একেবারে বাইরে ছিল না। স্থলপথে যোগাযোগ ছিল। মোঙ্গলরা যখন চীন দখল করে, তখন চীন পেরিয়ে জাভাতেও হানা দেয়। অনেকে সেখানে থিতু হয়। সেই সূত্রেও একটা ধারণা ফিরতি পথে য়োরোপ পর্যন্ত যায়। কল্পনার মিশেলে এক কাঙিক্ষত ভুবনের ছবি তৈরি হয়েছিল। তা সভ্য, বিচিত্র ও রমণীয়। এবং অসংখ্য মূল্যবান সামগ্রীর উৎস। ভাস্কো-ডা-গামা সমুদ্রপথের সন্ধান পাওয়ায় অনেকেই তাঁকে অনুসরণ করতে চাইবেন, এমনটিই স্বাভাবিক। তবে দেখার চেয়ে দখলের অথবা বাণিজ্যিক লাভের তাগিদই থাকে বেশি। এবং জলদস্যুদের ভূমিকা এখানে নগণ্য নয়। আরো বেশি এ-কারণে যে, নিজ নিজ দেশের রাজশক্তির প্রশ্রয়ই তারা পায়। সমুদ্রবাণিজ্যে পরোক্ষ লাভের একটা অনুপ্রেক্ষণীয় সূত্র তারা রচনা করে। এবং এ-বিষয়ে পর্তুগিজ বোম্বেটেদের নৃশংসতা ও দুঃসাহস কারো চেয়ে কম নয়।
আমরা তাই অবাক হই না, যখন জানি, ভাস্কো-ডা-গামার সফল অভিযানের পর এক দশক পেরোতেই পর্তুগিজ নৌবাহিনী ভারতবর্ষের পশ্চিম সমুদ্রোপকূলে দিউ-এ এক সংঘর্ষে বিপক্ষ শক্তিকে তুলাধোনা করে (১৫০৯) এবং এরই অনুসরণে ১৫১০-এ গোয়া বন্দর দখল করে। পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের মালাক্কাতেও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় (১৫১১)। ১৫১৫ সালে পারস্য উপসাগরের মুখে হুরমুজ বন্দর তারা স্থায়ীভাবে কব্জা করে। এই সব নয়। পর্তুগিজ বাণিজ্য-জাহাজ চীনের ক্যান্টনে ঢুঁ-মারে ১৫১৩-১৪-তে; এবং দক্ষিণ চীন উপকূলে ম্যাকাওতে এক স্থায়ী কর্মকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তীকালে এই বাংলার পূর্বকূলে সতেরো শতকে সন্দ্বীপ-দ্বীপটি তারা গায়ের জোরে কব্জা করে নেয়। সেনানায়ক গঞ্জালেস ছিলেন তার সর্বময় কর্তা। পশ্চিম ভারত উপকূলে গোয়া ও দিউ-এর পাশাপাশি দমনেও তাদের মজবুত ঘাঁটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
একটা বিষয় ক্রমশ স্পষ্ট হয় – পর্তুগিজ কৌশলে এখানে কোনো উপনিবেশ গড়ে তোলায় অগ্রাধিকার ছিল না। স্থায়ী ঘাঁটিতে তারা শক্তি সঞ্চয় করে। বাইরে থেকে কোনো ভিনদেশি বাণিজ্যিক জাহাজ আসছে খবর পেলে গুপ্তচর লেলিয়ে তাদের সামর্থ্যের বিষয়ে বিস্তারিত জেনে নেয়। জয়ের সম্ভাবনা বেশি মনে হলে তার ওপর অতর্কিত চড়াও হয়ে লুটপাট সাঙ্গ করে আবার ঘাঁটিতে ফিরে আসে। আর, তা রক্ষায় মন দেয়। এই ছিল তাদের কর্মকা–র অন্যতম প্রধান কৌশল। সুযোগ পেলে ওই অঞ্চলের ভেতরে ঢুকে হামলা চালাতেও তাদের উৎসাহে কমতি ছিল না। এমন মানসিকতা অবশ্য আরো অনেকের ভেতর চোখে পড়ে। উপনিবেশ গড়ায়, বা রাজ্য চালানোয় ঝামেলা বেশি। দায়দায়িত্বও। তুলনায় লুণ্ঠন অভিযান তাৎক্ষণিকভাবে বেশি লাভজনক। বিশেষ করে আক্রান্ত অঞ্চল সমৃদ্ধ হলেও যদি সুরক্ষায় দুর্বল থাকে। স্থলপথে একাদশ ও দ্বাদশ শতকে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে বহু লুণ্ঠন অভিযান পরিচালিত হয়েছে। ‘উন্মাদ কলরবে’ পথে পথে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছে। কিন্তু গাঙ্গেয় অববাহিকায় নেমে স্থায়ী দখল কায়েম করেনি। পরে তৈমুর লং, নাদির শাহ্ বা আফগান দলপতি আহমদ শাহ্ আবদালিও হামলা শেষে দেশে ফিরে যান। আহমদ শাহ্ আবদালি তো পাঁচবার অভিযান চালান (১৭৪৮, ১৭৫০, ১৭৫২, ১৭৫৬-৫৭, ১৭৫৮)। সবশেষে ১৭৬১-তে পানিপথের যুদ্ধে মারাঠা নায়ক পেশোয়া বালাজি বাজিরাওকে নিহত ও তাঁর বাহিনীকে বিধ্বস্ত করেন। কিন্তু নিজ রাজধানী অরক্ষিত রেখে অনির্দিষ্টকাল বাইরে থাকার ঝুঁকি নেন না। ভারতবর্ষের ভেতরে মারাঠিদের বর্গির হাঙ্গামার ধরনও ছিল অনুরূপ। পর্তুগিজরা অবশ্য ব্রাজিলে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু সেখানে য়োরোপের সমান্তরাল কোনো বিধি-ব্যবস্থা ছিল না। রোমান ক্যাথলিক যাজকরা এ-সুযোগের পুরো ফায়দা উসুল করেন। পর্তুগিজ ও স্প্যানিশ অধিকৃত দুই মহাদেশের বিপুল অংশে তাঁরা স্থানীয়-বহিরাগত মানব-মানবীর মিশ্রণে উৎসাহ জোগান। অবশ্য তাঁদের ধর্ম-সংগঠনের আওতায়। পরিণামে ওই ভূভাগে স্প্যানিশ ও পর্তুগিজ ভাষার আলাদা দুই খ- বজায় থাকলেও জনগণ অনুরূপ জাতি-পরিচয় আর বহন করে না। উনিশ শতকের গোড়ায় ফরাসি বিপস্নবের প্রতিধ্বনি তুলে গোটা অঞ্চল আলাদা-আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদায় আত্মপ্রকাশ করে। রোমান ক্যাথলিক গির্জার ন্যায়বোধ অবশ্য দ্বিধাবিভক্ত হয়। অস্থিরতা পুরোপুরি কাটে না। সেনাশাসনে বারবার রক্ত ঝরে বিভিন্ন দেশে। বৈষম্যের শিকড় উৎপাটিত হয় না। এখনো না। রোমান ক্যাথলিক আদর্শে বিশ্বাস দয়ায় বা করুণায়। তাও নিজেদের অগ্রাধিকার বজায় রেখে। সমতায় নয়। ঈশ্বরের বিধান বাস্তব। সেটাই মানুষের ললাট-লিখন। আইবেরীয় দেশ দুটোর নৌ-শক্তির আধিপত্য কিন্তু দীর্ঘকাল বজায় থাকে না। পর্তুগালে প্রিন্স হেনরির উদ্যোগে পালতোলা জাহাজের কলাকৌশলে যে উন্নতি ঘটে, আশপাশের প্রতিযোগীরাও নানাভাবে তার কারিগরি জারিজুরি জেনে যায়। সমুদ্রযাত্রায় সবারই ঝুঁকি কমে। পাশাপাশি রাজনৈতিক টানাপড়েনে স্পেন-ওলন্দাজ আঁতাত ভেঙে যায়। পরিণামে ষোলো শতকের শেষভাগে ডাচ নৌ-বাণিজ্য ভারত মহাসাগরে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে শুরু করে। এদিকে ১৫৮২-১৬৪০-পর্বে পর্তুগাল স্পেনের অধীনে চলে যায়। ফলে পর্তুগালের নৌ-বাণিজ্যেও সে-সময় ভাটা পড়ে। ডাচরা এর সুযোগ নিয়ে ১৬১৮ সালে জাভায়, ১৬৪১ সালে মালাক্কায় ও ১৬৪৪ সালে শ্রীলংকায় পর্তুগিজদের তাড়িয়ে নিজেদের বাণিজ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে। ডাচদের জাভায় মশলা বাণিজ্যে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় কিঞ্চিৎ অভিনবত্ব আছে। তারা আটলান্টিক পেরিয়ে দক্ষিণ আমেরিকায় যায়। তারপর আরো এগিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে জাহাজ ভাসিয়ে জাভায় পৌঁছে নোঙর ফেলে। শ্রীলংকায় অভিযানের ব্যাপারে এমন কিছু জানিনি। বিলেতে অধ্যাপক ডক্টর তীর্থংকর রায় তাঁর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস বইতে (আনন্দ, কলকাতা, ২০১৩, পৃ ৫৬) অন্য প্রসঙ্গে এই তথ্য দেন যে, ‘১৬৫৬ সালে ১৭০ বছরের পর্তুগিজ শাসন অপসারণ করে ডাচরা সিংহল দখল করে।’ (সিংহলের বর্তমান নাম শ্রীলংকা)। বিষয়টি গোলমেলে ঠেকে। বাণিজ্যকেন্দ্র খোলা আর দেশ দখল করা সমার্থক নয়। এবং সেটিরও সন অন্যখানে দেখি ১৬৪৪ (W.H. McNeill, The Rise of the West, Mentor Book, Chicago, 1963, p 630)। সন ১৬৫৬ হলেও ১৭০ বছরের পর্তুগিজ শাসন কী করে হয়, হিসাব মেলাতে পারি না।
ভাস্কো-ডা-গামা তো প্রথম সমুদ্রপথের সন্ধান পান ১৪৯৮-তে। তার আগে পর্তুগিজদের শ্রীলংকা পৌঁছুতে হলে স্থলপথে ভারতবর্ষ হয়ে, অথবা, হরমুজ প্রণালি পার হয়ে আসতে হয়। তেমন তথ্য কি কোথাও মেলে? প্রশান্ত মহাসাগর উজিয়ে এলেও ১৪৯২-এর আগে তেমন ঘটেছে, কল্পনা করা যায় না।
১৫২৬-এ পানিপথের যুদ্ধে সুলতান ইব্রাহিম লোদিকে পরাস্ত করে তুর্কো-মোঙ্গলীয় বাবর দিলিস্নর অধীশ্বর হয়ে মোগল শাসনের সূত্রপাত ঘটান। এই বংশের তৃতীয় সম্রাট আকবরের রাজত্বকাল (১৫৫৬-১৬০৫) ও ব্রিটেনে রানি প্রথম এলিজাবেথের শাসন আমল (ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি থেকে ১৬০৩) প্রায় সমসাময়িক। দুজনের গৌরবই শিখরস্পর্শী। তবে সাধারণ মানুষের জীবনে শান্তি ও স্থিতিশীলতা তখন ভারতবর্ষে যেমন ছিল ইংল্যান্ডে, অথবা, য়োরোপে অন্য কোথাও তেমন ছিল না। সেখানে খাবার-দাবার ছিল অপ্রতুল। অসুখ-বিসুখে মৃত্যুহারও বেশি। মরিয়া হয়েই অনেকে সমুদ্র-বাণিজ্যে বের হয়। ডক্টর রায় জন জুর্দেইন নামে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চতুর্থ অভিযানের (১৬০৮-১৬০৯, প্রায় দুবছর) এক যাত্রীর হয়রানির যে বিবরণ দিয়েছেন, তা ব্যতিক্রমী বলেই মনে হয়। কারণ ভাস্কো-ডা-গামা পথ ভুলে ব্রাজিল উপকূলের কাছাকাছি গিয়ে আবার পথ শুধরে ৪৫০০ মাইল একটানা সমুদ্রে থেকে উত্তমাশা অন্তরীপে পৌঁছুতে সময় নেন ৯৬ দিন। পথ চেনা হলে যে-কোনো নাবিকেরই সময় অনেক কম লাগার কথা। দৈব-দুর্বিপাক এখনো হয়। তা যাত্রাপথে নিরাপত্তাহীনতার প্রতিনিধিত্ব করে না। তখন ভারতবর্ষে নিশ্চিন্ত জীবনের অধিকতর নিশ্চয়তাই কিন্তু এ-অঞ্চলে মানুষকে উদ্ভাবনী শক্তি কাজে খাটাতে নিরুৎসাহিত করেছে। পরিণাম তার শুভ হয়নি। এছাড়া সম্প্রদায়-নির্বিশেষে সামাজিক স্তরবিন্যাসে প্রশ্নহীন আনুগত্যও প্রতিরোধ খাড়া করে। আজো কি তা কার্যকরভাবে নির্মূর্ল হয়েছে?
ডক্টর রায়ের বই পড়ে মনে হয়, এদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কারবার আজকের করপোরেট ব্যবসার অগ্রদূত। এদিক থেকে তার ভূমিকা প্রেরণাদায়ী। তবে ব্যবসার সঙ্গে উপনিবেশে শাসনব্যবস্থা গুলিয়ে ফেলে কোম্পানি নিজের পায়ে কুড়ুল মেরেছে। ঘটনার যোগাশ্রয়ী বিন্যাস (Additive) খুব কমই বাস্তবের ব্যাখ্যা দেয়। পালটা কিছু বলতে গেলে তাও খ–তই হবে। তবু বলি, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ভাগে জাপানে মেইজি পুনঃপ্রতিষ্ঠা পর্বে সরকারের প্রশ্রয়ে ও পারস্পরিক বিশ্বাসে কতিপয় ব্যবসায়ী পরিবার, মিৎসি, মিতসুবিসি, ইয়াসিদা ও সুমিটোমো দ্রম্নত শিল্পায়নে সফলতা দেখায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বাংলায় – কলকাতা শহরে রাজধানী হওয়ায় – সেরকম তাগিদও তৈরি হয়নি। স্বাধীনতার পর সরকারি খাত অবকাঠামো নির্মাণের দায়িত্ব নেয়। তাতে সামর্থ্যের পুরো বিকাশ নিশ্চয় হয়নি। তবে আরো ঝুঁকিপূর্ণ সামাজিক বিভাজন, অস্থিরতা, পরিণামে রাষ্ট্র-কাঠামোর যৌক্তিকতা ও সংহতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অনেকখানি মোকাবিলা করা গেছে। এতে আত্মসন্তুষ্টির কোনো কারণ নেই। খোলামনে মুক্তচিমত্মায় (কোনো দায়িত্বজ্ঞানহীন তন্ত্রধারীর চ্যালা হয়ে নয়) দূর-ভবিষ্যতের কল্পনা মাথায় রেখে সিদ্ধান্তের ছক কষাই শ্রেয়। তোতাপাখির বুলি আওড়ানো কোনো জাঁদরেল অধ্যাপকের জন্যও অসম্মানের।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্ম ১৬০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর। এটি আইনত এক যৌথ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। মালিকানায় অংশীদার সবাই জাহাজিকা– জড়িত নন। কেউ কেউ অর্থ-বিত্তে সমর্থ, এমন কি পার্লিয়ামেন্টের প্রভাবশালী সদস্যও। রানি এই প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেন। ১৬১৮ সালে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর একে ভারতবর্ষে ঘাঁটি গেড়ে ব্যবসা করার হুকুমনামায় নিজের সিলমোহর বসান। এইটিই যে পরে ভারতবর্ষের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেবে, এমনটি অকল্পনীয় ছিল। কিন্তু তার বীজ বপন হলো তখনই। তারপর স্তব্ধ আসনে প্রহর গোনার পালা। সমুদ্র পেরিয়ে কেউ উপনিবেশ গড়বে, এ-সম্ভাবনা এখানে তখন কাউকে বিচলিত করেনি। আগের সব অভিযান ছিল স্থলপথে, উত্তর-পশ্চিম থেকে। মোগল শাসনে আত্মবিশ্বাস তখন তুঙ্গে।
বাদশার আচরণ প্রাচ্য ভূমির অন্যান্য অধীশ্বরের মতোই। ভেট দিয়ে সন্তুষ্ট করতে না পারলে কোনো কাজ হয় না। এই অভ্যাস তৃণমূল পর্যন্ত ছড়ায়। তার ঐতিহ্য এখনো আমাদের বিপর্যস্ত করে। ঘুণপোকার মতো আর্থ-সামাজিক সম্ভাবনার মূলে বাসা বেঁধে তাকে ফোঁপরা করে ছাড়ে।
তবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসায়িক স্বার্থ ও উপনিবেশ বিস্তারে ভূমিকা সবসময়ে সমলয়ে থাকেনি। যদিও তাৎক্ষণিকভাবে সব মিলিয়ে ব্রিটিশ স্বার্থে ইতিবাচক প্রভাবই পড়েছে। একদিকে উনিশ শতকের মাঝামাঝি এসে ভারতবর্ষ ছাড়াও সিংহল (বর্তমান শ্রীলংকা), ব্রহ্মদেশ (বর্তমান মিয়ানমার), শ্যাম (বর্তমান থাইল্যান্ড) ও ইন্দোনেশিয়ার কটি দ্বীপে কোম্পানিই যুদ্ধ করে ব্রিটিশ প্রভুত্ব ছড়িয়েছে, অন্যদিকে সব রাজনৈতিক কর্মকা–র ব্যয়ভার বহন করে সে নিজে দুর্বল হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ব্যক্তিগত ব্যবসার দিকে ঝুঁকে পড়ায় তার নিজের খাতায় নিটলাভ সেই পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। একচেটিয়া কারবার কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে তার কেতাবি ছক ধরে রাখা যায়নি। যদিও ব্রিটিশ অর্থনীতিতে উদ্বৃত্তের যোগফল ইতিবাচকই থেকেছে। অবশ্য শুরুর বাজার-কাঠামো থেকে শিল্প-বিপস্নবোত্তর বাজার-কাঠামো পুরোপুরি উলটো দিকে ঘুরে যায়। এমন পরিস্থিতিতে একচেটিয়া কারবারের ব্যবহারিক উপযোগিতা হ্রাস পায়। খোলাবাজারেই তুলনামূলক সামর্থ্যে ব্রিটিশ পণ্য সুবিধাজনক অবস্থায় চলে আসে। কোম্পানির কাছ থেকে বাড়তি কিছু আর আশা করা যায় না। তার বিদায়ঘণ্টা বাজে। ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ পার্লিয়ামেন্টের সিদ্ধান্তে ভারতবর্ষের শাসনভার সরাসরি মহারানী ভিক্টোরিয়ার হাতে অর্পিত হয়। পরপরই কোম্পানির অবলুপ্তি ঘটে।
ষোড়শ শতকে সমুদ্রপথ অবাধ হওয়ার পরিণামে পশ্চিম য়োরোপে বাণিজ্য-ভাবনায় সরাসরি তার ছাপ পড়ে। মার্কেন্টাইলিজম (Mercantilism) বা বাণিজ্যিক বা বাণিজ্যিক স্বার্থনির্ভরতার মতবাদ সেখানে ছড়ায়। এতে জোর দেওয়া হয় উদ্বৃত্ত রপ্তানি আয়ের ওপর। তাতে সোনা-রুপার মজুদ বাড়বে। মানুষের হাতে বাড়তি টাকা আসবে, উৎপাদন চাঙ্গা হবে, পণ্য-দাম বাড়তে থাকায় বাজারের কর্মকা– গতি আসবে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে সমৃদ্ধি ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী হবে। এক কথায় বলা যায়, Price-Specie-Flow-Mechanism। স্পষ্টতই এতে চাবিকাঠি ধরা থাকে বাইরে উপনিবেশ গড়া উঠতি স্বার্থশক্তির হাতে। বাণিজ্য এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া হয়, যাতে আপন-আপন উপনিবেশের সম্পদে অন্য কেউ খোলাবাজারের দোহাই দিয়ে হস্তক্ষেপ করতে না পারে। একই সঙ্গে আগ্রাসী বাণিজ্যের নতুন বাজার দখল করাতেও যেন কোনো নৈতিক বা আইনগত বাধা না থাকে। সোনা-রুপার প্রবাহ তাই শুধু দেশীয় পণ্যের রপ্তানির ওপরই নির্ভর করে না, করে বিশ্ববাজারে কেনাবেচার প্রবাহের ওপরেও। আক্ষরিকভাবেই ‘এক হাটে লও বোঝা, শূন্য করে দাও অন্য হাটে’। লাভের অংক কেবল বাড়ে। উপনিবেশের কারবারও তার নিজের বলে গণ্য হয়। মার্কেন্টাইলিজমের কোনো যৌক্তিক সিদ্ধতা থাকে না।
এই স্বার্থবাহী মতবাদের এক নির্মম পরিণতি, চীনে আফিমের যুদ্ধ (১৮৩৯-৪২)। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উৎসাহী মদদে ভারতে, বিশেষ করে বিহারে ও মহারাষ্ট্রে, আফিমের উৎপাদন ছড়ায়। তার বিশাল বাজার চীনে। কোম্পানির নিজের বাণিজ্য শুধু নয়, কিছু ইংরেজের ব্যক্তিগত ব্যবসা – অনেকটাই কালোবাজারি, – এমনকি, তলে তলে কিছু প্রলুব্ধ ভারত সমত্মানের উদ্যোগও ফায়দা লোটায় উৎসাহী হয়ে এই কারবারে ভিড়ে যায়। চীনের মাঞ্চু রাজের ম্যান্ডারিনরা একে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আফিমের সব চালান বাজেয়াপ্ত করার হুকুম দেয়। কোম্পানি উলটো ক্ষতিপূরণ দাবি করে। এই নিয়ে যুদ্ধের সূচনা। এতে হার হয় চীনের। কোম্পানির দাবির কাছে নতিস্বীকার করে হংকংয়ের অধিকার তাদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়। আর-একবার অনুরূপ আফিমের যুদ্ধ ঘটে ১৮৫৬-৬০-এ। এবারো হেরে যায় চীন।
তবে লক্ষণীয়, কোম্পানি-বাহিনীতে হাবিলদার থেকে অধস্তন সব সেপাই ছিল ভারতবর্ষীয়। ওপরের হুকুমদাতারাই কেবল ব্রিটিশ শ্বেতাঙ্গ। সাধারণ চৈনিক-বা-যুদ্ধরত সৈনিকদের কাছে তারা দৃশ্যমান নয়। প্রত্যক্ষ লড়াই তাদের এই উপমহাদেশের জওয়ানদের সঙ্গে। এই স্মৃতি সুখকর হওয়ার কথা নয়। তাদের সেই সামষ্টিক বিদ্বেষ কি ফিরে আসে ১৯৬২-র সীমান্ত সংঘর্ষে? এলিয়টীয় অতীত কি এভাবে অতর্কিত হানা দেয় শতাব্দী পেরিয়ে ভবিষ্যতে? ডক্টর রায়ের বিজ্ঞ ইতিহাসচর্চায় অবশ্য এসব তথ্য প্রাসঙ্গিক নয়।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর কালান্তরে (১৩৪৪, বৈশাখ) ‘শূদ্রধর্ম’ নামে এক লেখায় ক্ষোভের সঙ্গে জানাচ্ছেন, ‘…প্রথমবারে যখন জাপানের পথে হংকং-এর বন্দরে আমাদের জাহাজ লাগল দেখলুম, সেখানে ঘাটে একজন পাঞ্জাবি পাহারাওয়ালা অতি তুচ্ছ কারণে একজন চৈনিকের বেণী ধরে তাকে লাথি মারলে। আমার মাথা হেঁট হয়ে গেল।… দেশ বিদেশে এরা শূদ্রধর্ম পালন করছে। চীনকে অপমানিত করবার ভার প্রভুর হয়ে গ্রহণ করেছে, সে সম্বন্ধে এরা কোন বিচার করতেই চায় না; কেননা এরা শূদ্রধর্মের হাওয়ায় মানুষ।…’ (১৩৩২, অগ্রহায়ণ)। তখন তা হয়নি, কিন্তু বিকল্প সম্ভাবনায়, ‘what might have been’, – তার প্রতিচিত্রণ কি আমরা খুঁজছি না?
রবীন্দ্রনাথের অতিপরিচিত এই পদ, ‘বণিকের মানদ- পোহালে শর্বরী দেখা দিল রাজদ- রূপে।’ এ কিন্তু শুধু এই উপমহাদেশেই ঘটেনি। ঘটেছে বিশ্বের সব মহাদেশে। বাণিজ্যের সমুদ্রপথ খুলে যাওয়ায় য়োরোপের সুযোগসন্ধানী শক্তিগুলো সবাই তার সদ্ব্যবহারে প্রতিযোগিতায় নামে। অচেনা দেশের রীতি-নীতি-আইন-কানুন আলাদা। তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে ও প্রতিযোগীদের দূরে ঠেলতে স্থানীয় প্রভুত্বকারী ও প্রভুত্বকামী শক্তিবলয়েও তারা অনিবার্য ঢুকে পড়ে। সহজেই এটা মাথায় ঢোকে, অস্ত্রপ্রযুক্তির ব্যবহারে ও তার যথোপযুক্ত কর্মকৌশল রচনায় তারা এগিয়ে গেছে অনেক দূর। মোঙ্গল ও তুর্কি ঘোড়সওয়ার বাহিনীর আকস্মিক আক্রমণে বীরত্ব দেখাবার বা ভীতসন্ত্রস্ত করার কাল অস্তাচলে। দূরপাল্লার কামান-বন্দুকের পরিকল্পিত ব্যবহার অনেক বেশি কাজের। সফল বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য সাধনেও তার গুরুত্ব উপেক্ষার নয়। চূড়ান্ত ফল অনিশ্চিত। কিন্তু সম্ভাবনার পথ খোলা, ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭১৭-য় মোগল সম্রাট ফররুখ শিয়রের কাছ থেকে তাঁর অধীনস্থ এলাকায় বিনাশুল্কে বাণিজ্যের অধিকার আদায় করে। পরবর্তী ধাপগুলো কোনোটিই আর আকস্মিক থাকে না।
তবে আমরা ১৭৫৭-য় পলাশীর যুদ্ধকে যে যুগান্তকারী ঘটনা বলি, এবং বাংলার স্বাধীনতাসূর্য অস্তমিত হলো বলে আক্ষেপ করি, তাতে অতিশয়োক্তি আছে বলে মনে হয়। মুর্শিদাবাদের নবাবরা বাঙালি ছিলেন না। স্বাধীনও ছিলেন না। আচরণে দিলিস্ন থেকে দূরত্ব বাড়িয়েছিলেন মাত্র। আলিবর্দি খান ও তাঁর বড়ভাই হাজি আহমদ খান ছিলেন তুর্কি। মুর্শিদাবাদের নবাব সুজাউদ্দিনের দরবারে কাজের সন্ধানে আসা। তারপর আলিবর্দি খানের কর্মদক্ষতার গুণে বিহারের শাসনকর্তা হওয়া। সুজাউদ্দিন ছিলেন মুর্শিদকুলি খানের জামাই। তাঁর মৃত্যুর পর ছেলে সরফরাজ খান নবাব হয়ে বসেন। কিন্তু হাজি আহমদ খান ও জগৎশেঠ ফতে চাঁদের সঙ্গে জোটবেঁধে চক্রান্ত করে সরফরাজ খানকে মেরে আলিবর্দি খান মুর্শিদাবাদে নিজেকে নবাব বলে ঘোষণা করেন। ১৭৪০ সালে পারস্য থেকে অভিযানে আসা নাদির শাহর লুণ্ঠনে ও হত্যাযজ্ঞে তখন দিলিস্ন টলোমলো। বাংলার দিকে তাকাবার ফুরসত নেই। আলিবর্দি খানের নবাবি পাকা হয়। ১৭৫৬-তে তাঁর মৃত্যুর পর একই রকম পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি ঘটে। আলিবর্দি খান দৌহিত্র সিরাজদ্দৌলাকে নবাব মনোনীত করে যান। কিন্তু পুর্ণিয়ার শাসক সিরাজের জ্ঞাতিভাই হাজি আহমদ খানের ছেলে শওকত জঙ্গ দাবি করেন, দিলিস্নর ফরমানের বলে তিনিই নবাব। সিরাজ তাঁকে যুদ্ধে আহত করে নিজেকে নিষ্কণ্টক ও প্রবল পরাক্রমশালী ভাবতে শুরু করেন। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গেও সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। এদিকে পুরনো ঐতিহ্যে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র দানা বাঁধে। সুযোগ বুঝে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানিও শামিল হয়। তখন শুরু হয়ে গেছে ইঙ্গ-ফরাসি সাত বছরের যুদ্ধ (১৭৫৬-৬৩)। ভারতবর্ষে ফরাসি ঘাঁটি প–চেরির অধিনায়ক ডুপেস্ন। ইংরেজ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বার্থ সুরক্ষার কারণ দেখিয়ে ব্রিটিশ সরকার এক কোম্পানি সৈন্য পাঠায়। নেতৃত্বে অ্যাডমিরাল ওয়াট্সন। তার আগে কর্ণাটকে এক ছোট রাজ্যে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত ঝামেলায় কোম্পানি বাহিনী ও ফরাসি সেনারা পরস্পর বিপক্ষ দুই দলের হয়ে লড়ে। তাতে কর্নেল ক্লাইভ দারুণ চমক দেখিয়ে তাঁর পক্ষকে জিতিয়ে মাদ্রাজে কোম্পানির সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। সিরাজের দখল থেকে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গ পুনর্দখলে এবার ক্লাইভ ও ওয়াট্সন একত্রে অভিযানে অগ্রসর হন, যদিও আপন-আপন বখরা বুঝে নেওয়ার বেলায় দুজনের দা-কুমড়ো সম্পর্ক। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কুশীলবরা কোম্পানিকে নিজেদের দলে টেনে কার্যোদ্ধারে সফল হওয়ার ফন্দি আঁটে। পরিণামে পলাশীর যুদ্ধ। কিন্তু এর ফলেই নবাবি আমলের সমাপ্তি ঘটে না। ভেতরের চক্রান্তকারীরা কেউ চাননি, নবাবি শাসন উঠে যাক। ক্লাইভ-ওয়াট্সন সুযোগ বুঝে নবাবের কোষাগার লুট করাতেই প্রাথমিকতা দেয়। সিরাজের ঔদ্ধত্যে ও অবিমৃষ্যকারিতায় বিক্ষুব্ধ আমির-ওমরাহরা মনে করেছিলেন, ক্লাইভকে পারিষদ সভায় এক উঁচু পদে বসিয়ে তাঁদের প্রভাব-প্রতিপত্তি পছন্দের নবাবের অধীনে আগের মতো বজায় রাখবেন। কিন্তু তা হয় না। কোম্পানির খাঁই ক্রমাগত বাড়ে। নতুন নবাব মীরজাফর তাদের হাতের পুতুল। তবু তাদের দাবি মেটে না। শেষ পর্যন্ত তাঁকে সরিয়ে মীর কাসিমকে তারা নবাব বানায়। মীর কাসিম স্বাধীনভাবে কাজ করতে চাইছিলেন। কিন্তু সমঝোতা না হওয়ায় সংঘাতের পথে যাওয়া ছাড়া তাঁর উপায় থাকে না। এবার যুদ্ধ-প্রস্ত্ততিতে কিন্তু কোনো ঘাটতি ছিল না। অযোধ্যা ও দিলিস্নর সেনাবাহিনীও তাঁর পক্ষে যোগ দেয়। সরাসরি পূর্ণ শক্তিতে যুদ্ধ। তবু উধুয়ানালা, ঘোরিয়া ও বক্সারে, তিন যুদ্ধেই হেরে যান মীর কাসিম (১৭৬৪)। অথর্ব মীরজাফরকে কোম্পানি আবার নবাব বানায়। কিন্তু রাজস্ব আদায়ের সব ক্ষমতা কেড়ে নেয়। এই রাজস্ব শোষণের দায়িত্বজ্ঞানহীন নির্মমতায় বাংলার কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি রসাতলে যায়। পরিণাম ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (১১৭৬ বঙ্গাব্দ; খ্রি. ১৭৭০), প্রতিক্রিয়ায় ব্রিটিশ পার্লিয়ামেন্টে রেগুলেটিং অ্যাক্টে পাশ করে গোটা বাংলার শাসনভার কোম্পানির হাতে প্রদান ও গভর্নর জেনারেল পদ সৃষ্টি (১৭৭৩)। ক্লাইভ ১৭৬৫-৬৯ ছিলেন বাংলার গভর্নর। তারপর ওয়ারেন হেস্টিংস। তিনিই হলেন প্রথম গভর্নর জেনারল (১৭৭৪-৮৪)।
তাহলে ১৭৫৭-তেই সে-সময়ের সুবে বাংলা ব্রিটিশ বাণিজ্য শক্তির করায়ত্ত হয়, এ-কথা যথার্থ নয়। একটা সুবিধাজনক অবস্থা তাদের জন্য তৈরি হয়েছিল অবশ্য। মীর কাসিম পূর্ণ শক্তি নিয়েই লড়েছিলেন। তবু হেরেছিলেন শোচনীয়ভাবে। ব্রিটিশ রণকৌশল ও অস্ত্রপ্রযুক্তি মূল তফাৎ গড়ে দেয়। এখানকার স্বৈরাচারী রাজন্যবর্গ ও তাঁদের মধ্যযুগীয় আচার-আচরণ শিল্পবিপস্নবের প্রাক-পর্বের ব্রিটিশ বস্তুতান্ত্রিক শৃঙ্খলার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারেনি। এটাও খেয়াল করবার, কোম্পানির ওই সেনাবহরে ভারতবর্ষীয়, বিশেষ করে তেলেঙ্গারাই ছিল সংখ্যায় বেশি। পরে এমনটি ঘটেছে বারবার। কোম্পানির ফৌজ একটা সর্বভারতীয় আকার পায়, যদিও তাতে বাঙালির অনুপাত নগণ্য। অনুমান অসংগত হবে না, যদি বলি এই উপমহাদেশে জাতীয়তাবোধ বলে কিছু তখনো গড়ে ওঠেনি। এমন কি পলাশীর যুদ্ধ বাংলাতেও তেমন দাগ কাটেনি। কে শাসনকর্তা এ নিয়ে সাধারণ মানুষের কোনো কৌতূহল ছিল না বললেই চলে। নজর বেশি কুসংস্কারে, ও তারই আওতায় আচার-বিচারে। এটা মোটেই আপতিক নয় যে, কোম্পানি উনিশ শতকের মাঝামাঝি গোটা উপমহাদেশই নিজেদের আওতায় নিয়ে নিতে পারে। কোথাও প্রত্যক্ষ শাসনে, কিছুটা স্থানীয় রাজা বা নবাবের মাধ্যমে। ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহে উপমহাদেশের মধ্যযুগীয় শক্তির একটা সংহতি গড়ে উঠেছিল। তা সফল হলে প্রত্যেক দলপতি আপন ভাগ নিয়ে তুষ্ট থাকতেন। বড় করে জাতীয় চেতনা কিছু জাগত না। এটা চোখে পড়বার মতো, তখন বাংলায় চলছে এক জাগরণপর্ব। কিন্তু মহাবিদ্রোহে সবাই উদাসীন। এমনটি কেন? নতুন মুদ্রণ ও প্রকাশন ব্যবস্থা গণযোগাযোগ ত্বরান্বিত করে। য়োরোপীয় ধ্যান-ধারণা ও শিক্ষার দরজা ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে হাট করে খুলে যায়। নতুন যুগের, সবাই নয়, কতিপয় মানুষ এই মহৎ ঐশ্বর্যের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। মনের প্রসার ঘটে তাদের। বাংলাভাষা নবযৌবনে উছলে উঠতে থাকে। শতাব্দীর ওপর শতাব্দীর জড়ত্ব আঘাতে আঘাতে দীর্ণ হয়। জাতীয় চেতনাও প্রশ্নের মুখে পড়ে। নতুন আকার খোঁজে। তবে সরলরেখায় নয়। অসংখ্য জটাজালের উলটো-পালটা পথ মাড়িয়ে। তর্ক-বিতর্ক ভিড় করে। সবার ভেতরে নয়, একটা ক্ষুদ্র গ–তে শহুরে পরিবেশে। তার প্রভাব পড়ে গোটা সমাজেই। ঔপনিবেশিক শাসন হলেও তা পরিবর্তনের দূত হয়ে আসে। সংস্কারের বেড়া পুরোপুরি না ভাঙলেও প্রশ্নগুলো মরে না। হিংস্র আকারও নেয়। তাতে প্রাচীন স্বার্থচক্রের ঘাঁটি আগলে থাকার বিশ্বাসতাড়িত সংকল্পও মদদ পায়। তবু পরিবর্তন ঘটে চলে। যতটা কাঙিক্ষত, ততটা না হলেও। হয়তো দাম দিতে হয় তুলনায় বেশি। এখনো।
তবে অনুন্নয়নের জন্য ঔপনিবেশিক স্বার্থ দায়ী, আমরা সবাই তার ফন্দি-ফিকিরের শিকার, এমন কথায় অতিসরলীকরণ ঘটে। দায়িত্বজ্ঞানহীনতাও। প্রভুশক্তি নিজের ক্ষতি করে উপনিবেশের উন্নয়নে মনোযোগ দেবে, এমন আশা করা বাতুলতা। পরাধীন দেশের ভাবসম্পদ আত্মসমীক্ষায় ও আত্মউদ্ধারের সঠিক পথ খোঁজায় ব্রতী হবে, অতীতের আবর্জনা, সংস্কারের জড়ত্ব ঝেঁটিয়ে বিদায় করার সাহস দেখাবে, এ-কাজ তার নিজস্ব। সত্য কথা, আমাদের চিমত্মায় য়োরোপ ছায়া ফেলেছে। ভাবজগতে আলোড়ন জেগেছে। কিন্তু কর্মকাঠামো বদলেছে সামান্যই। সেদিকে তাকাবার তাগিদ এখানে তেমন অনুভূত হয়নি। বরং প্রতিক্রিয়ায় উলটো মুখে দৌড় দেওয়ার আগ্রহ বাহবা পেয়েছে। এখনো পায়।
১৭৯৩-এ বাংলায় ভূমি ব্যবস্থায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হয়। কর্নোয়ালিস বা ফিলিপ ফ্রান্সিস গণমানুষের অকল্যাণ চেয়ে অথবা বশংবদ উদ্বৃত্ত-শোষকগোষ্ঠী গড়ে তোলার লক্ষক্ষ্য এই ফাঁদ পাতেন, উচ্চকণ্ঠে এ-কথা বারবার বলে আমরা দায় এড়াই, আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলি, কিন্তু তা সর্বাংশে যথার্থ, এ-কথা কি বলা যায়? মনে রাখা দরকার, ১৭৬৫ থেকে দ্বৈতশাসনে অরাজক কৃষি-ব্যবস্থায় বৃহৎ জনসমাজ বিধ্বস্তপ্রায় হয়ে পড়ে। এরই মর্মান্তিক পরিণাম ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। দ্বৈতশাসনের অবসানে কোম্পানি যে এক-সলা বা দশ-সলা বন্দোবস্ত চালু করে স্থিতিশীলতা খোঁজে, তাও ব্যর্থ হওয়ার পর এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। পেছনে উদ্যোক্তাদের ফিজিওক্রেসির বা ভূমিবাদী অর্থনীতির প্রতি দুর্বলতা কাজ করে থাকতে পারে; কিন্তু এ-থেকে জমির উৎপাদন বাড়ানোয় জমিদারদের মেধা ও কর্মকুশলতার পুরো সদ্ব্যবহারের যে প্রত্যাশা, তা তাঁরা সামান্যই মিটিয়েছেন। অধিকাংশই অনুপস্থিত-ভূস্বামী হয়ে উদ্বৃত্ত শোষণে কৃষকদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙেছেন। জমি-সংক্রান্ত মামলা-মোকদ্দমা যত বেড়েছে, তত ওকালতি পেশা বেশি লাভজনক হয়েছে। উদ্বৃত্তের বখরা এভাবে অনুৎপাদনে মদদ জুগিয়েছে। কেউ চাক-বা-না-চাক, সামাজিক বিভাজন-ও-বৈষম্য আকার পেতে শুরু করেছে।
আরো গভীরে রয়ে গেছে বর্ণ-বিভাজনপ্রথা। প্রাথমিক সরল উৎপাদন ব্যবস্থায় এতে এক ধরনের স্থিতিশীলতা আশা করা যায়। বৈষম্যও প্রশ্রয় পায় না। কিন্তু সামাজিক সম্পর্ক-সম্বন্ধ যখন বহুদিকে ছড়ায় ও জটিল হয়, বহিরাগতরা যখন নানাদিক থেকে আসে, আর, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে নতুন নতুন বিধানের প্রয়োজন পড়ে, তাল সামলাতে বিভাজন বংশানুক্রমিক হয়ে দাঁড়ায়, তখন একক-সমাজ অদৃশ্য-ভাঙনে টুকরো টুকরো হয়। আবার তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমাজ অস্থিরতা এড়ায়। সম্প্রদায়ের বিভিন্ন চেহারা থাকলেও তলে তলে বর্ণ-বিভাজনপ্রথা একই থেকে যায়। তা এগোবার পথ আগলে থাকে। এসবের জন্যও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি দায়ী নয়। যদিও এতে তাদের সুবিধা বাড়ে। রবীন্দ্রনাথের ‘এ আমার, এ তোমার পাপ’ – এই কথাটা মনে আসে। নিস্তার মেলেনি কিন্তু এখনো।
তবে এখানে ঔপনিবেশিকতার অবসান ও বিশ শতকীয় স্বাধীন রাষ্ট্র নির্মাণ, এর পেছনে কিন্তু ঔপনিবেশিকতাই ধারণাগত ভিত্তি রচনা করেছে। উপনিবেশের একক ভৌগোলিক সীমাকে ভারতবর্ষের একক পরিচয়ের চিরকালের বাস্তব ধরে নিয়ে ব্রিটিশ শাসন থেকে তাকে মুক্ত করার সংগ্রাম তখন পরিচালিত হয়েছে। এই যে অখ- উপমহাদেশিক ভাবকল্পনা, এ কিন্তু অনন্যপূর্বা। অতীতে কোনোকালেই গোটা অঞ্চল কারো শাসনসীমা নির্দেশ করেনি। অশোক-সাম্রাজ্য দাক্ষিণাত্যে বর্তমান কেরালা রাজ্য পর্যন্ত পৌঁছোয়নি। তিনি শুধু কলিঙ্গরাজ্য, যুদ্ধে জয় করেন। পরে বুদ্ধবাণী প্রচার করে প্রায় গোটা ভারতবর্ষের আনুগত্য পান। শ্রীলংকারও। এ-কোনো স্থায়ী সীমা নির্দেশ করে না। পরে আলাউদ্দিন খিল্জি (১২৯৬-১৩১৬) যুদ্ধ-জয় করতে করতে রাজ্যসীমা প্রায় ওই পর্যন্ত বাড়ান। তিনি ছিলেন অতি নিষ্ঠুর
প্রকৃতির। দিলিস্নতে তাঁদের মতোই মোগলারা বাইরে থেকে এসে চক্রান্ত করছে, এই সন্দেহবশে এক রাতের অভিযানে সপরিবারে তিরিশ হাজার মোগল হত্যা করেন। তবে কোথাও কোনো স্থায়ী আনুগত্য তিনি প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। যখন একদিকে তিনি রাজ্য-জয় অভিযানে, তখন অন্যদিকে বিজিত রাজ্যের হাতছাড়া হয়ে যাওয়া – নিট ফল দাঁড়ায় দিলিস্ন ঘিরে কিছু অঞ্চলের ওপর তাঁর সময়টুকুতে আধিপত্য। প্রায় একই দশা সম্রাট আওরঙ্গজেবের (১৬৫৮-১৭০৭)। জীবনের শেষ ছাবিবশ বছর তাঁর কাটে দাক্ষিণাত্যেই। যুদ্ধের খরচ জোগাতে জনগণের ওপর অতিমাত্রায় কর বসান। পরিণামে প্রজাবিদ্রোহ। মোগল সাম্রাজ্যের পতনের এইটিই প্রধান কারণ।
বিপরীতে ব্রিটিশ সংযোগের সূত্রে এখানে য়োরোপীয় উত্থানের কাহিনি, বিশেষ করে ফরাসি বিপস্নব (১৭৮৯) ও ব্রিটিশ শিল্পবিপস্নবের (আঠারো শতকের শেষ দুই দশক থেকে উনিশ শতকের মাঝামাঝি) কথা নব্যশিক্ষিত মহলে স্বপ্নের জাল বোনে। উনিশ শতকেই ভারতবর্ষে রেললাইন পুব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ দুদিকের ভৌগোলিক প্রান্ত-সীমা স্পর্শ করে। আধুনিক ডাক-ও-তার ব্যবস্থা চালু হয়। ঔপনিবেশিক মনে আনুগত্য ছাপিয়ে একত্ববোধ বড় হয়ে উঠতে থাকে। যদিও বৈচিত্র্যের ও বিভেদের লক্ষণগুলোও উপেক্ষা করা যায় না। আনন্দমঠের উপান্তে বঙ্কিম মহাপুরুষের জবানিতে শোনান, ‘শত্রম্ন কে? শত্রম্ন আর নাই। ইংরেজি মিত্র রাজা। আর ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধে শেষ জয়ী হয় এমন শক্তিও কাহারও নাই।’
মন্তব্যটিকে দেখতে হয় এই দৃষ্টিকোণ থেকে। পরিবর্তনের ও উন্নয়নের ভাবনারাশি এখানে পৌঁছোয় ব্রিটিশ সংযোগের দৌত্যে। যদিও সম্পর্ক বিরোধের। এটা খেয়াল করি, ব্রিটিশ শাসনের অবসানে উপনিবেশের অখ- ভারতবর্ষ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবু ওই গণপ্রজাতন্ত্রী স্বাধীন ভারতের যে ভৌগোলিক মানচিত্র পাই অতীতে কোনোকালে তার তুল্য কিছু টেকেনি। ক্ষমতা কোনো ব্যক্তির বা বংশের হাতে নয়। এইখানে তার জোর। ফরাসি বিপস্নব ও ব্রিটেনের শিল্পবিপস্নব তার প্রেরণা। ব্রিটেনে পার্লিয়ামেন্ট, বিচার ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক দায়িত্বে পারস্পরিক স্বাধিকার ও সহযোগের দীর্ঘ ঐতিহ্য, – সিদ্ধান্ত ভালো-মন্দ যাই হোক – তাতে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে। এই শৃঙ্খলা ও সংযম রাষ্ট্রকে স্থিতিশীল রাখে। মূলে এই মডেল বজায় রাখাই ভারতের টিকে থাকার চাবিকাঠি। এদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখার দায়িত্ব তাদেরই।
১৯৪৭-এ যে পাকিস্তানের সৃষ্টি তাতে পূর্ব ও পশ্চিম খণ্ডের মানুষের ঐতিহ্যে ও জীবন ভাবনায় মৌলিক পার্থক্য ছিল। পশ্চিম খ– ‘রণধারাবাহী জয়গান গাহি উন্মাদ কলরবে’ যুগের পর যুগ বহিরাগতরা হামলা করেছে, দখলদারিকে গৌরবের বিষয় বলে মনে করেছে, এই মানসিকতা গণচেতনায় মিশেছে। অন্যদিকে পুবের অংশে সুফি সাধক, বাউল-বৈষ্ণব, এঁরা মানব-মানবীর ভাবনাজগতে স্থায়ী আসন পেতেছে। এক দেশ হলেও পশ্চিমাংশ পুবে স্বভাবসুলভ দখলদারি কায়েম করতে চেয়েছে। পারস্পরিক সম্মান নিয়ে বাঁচা সম্ভব হয়নি। পাকিস্তানি গণহত্যার সঙ্গে লড়াই করে বিজয়ী হয়ে বাংলাদেশ নিজেকে গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এটা কিন্তু নতুন সংগ্রামের শুরু। পাকিস্তানি ভাবধারার দ্বান্দ্বিক অবশেষ এখনো এখানে বর্তমান। সুযোগ পেলেই মাথা তোলে। পথের শেষ কোথায়, কী আছে শেষে – জানি না। তবে ব্যক্তিস্বার্থে দাঁও মারার লুব্ধ অভ্যাস অসহিষ্ণু ইতরতায় ওপর থেকে নিচে পর্যন্ত গড়ায়, এবং তা বুদ্ধির কারবারে যৌক্তিক ভিত্তি খোঁজে, এর প্রকট সংক্রমণে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না।
পশ্চিম য়োরোপ থেকে পশ্চিমে-পুবে নতুন সমুদ্রপথের সন্ধান এবং পুবে রাশিয়ার অগ্রসর হয়ে এশিয়ার সাগরসীমা পর্যন্ত বিশাল ভূভাগ অধিকার অনেক উথাল-পাথালের ভেতর দিয়ে অভাবিতপূর্ব জাগতিক সম্ভাবনা সব সৃষ্টি করে। এটা নয় যে য়োরোপের মানুষ তখন ধনদৌলতে বেশি সমৃদ্ধ ছিল। এমনও নয় যে, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে তারা বেশি উন্নত ছিল। বরং অভাবই সেখানে অনিশ্চয়তার পরিম-লে ঝুঁকি নিয়ে নতুন সম্ভাবনার আশায় কাউকে কাউকে তাড়িত করে। বিশ্বপটে উত্থান ঘটে য়োরোপের। অবশ্য তার জন্য তাকে দামও দিতে হয়েছে প্রচুর। নিজেদের ভেতরেও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব তাদের ক্রমাগত বাড়ে। গত শতকে দুই মহাযুদ্ধ। বস্তুগত ও মানসগত দুদিক থেকেই য়োরোপ বিধ্বস্ত হয়। তবে তা সৃষ্টিশীলতার পথকেও অবারিত করে দুনিয়াজুড়ে। পৃথিবীর মানচিত্র বদলে যায়। যদিও নিশ্চিন্তে বসবাস এখনো অনায়ত্ত। হয়তো মানব স্বভাবই তার বৈরী। তারপরেও ভেষজ ও যোগাযোগ বিজ্ঞানে, এবং বহুমুখী প্রযুক্তিতে তুলনাহীন অগ্রগতি যে-কোনো জায়গাতেই মানুষের আয় বাড়িয়েছে; দৃষ্টিকে প্রসারিত করেছে। তার দুশ্চিমত্মা কমেছে এ-কথা যদিও বলা যায় না। বিপরীতভাবে তার জগৎ বিসত্মৃত হয়, এবং, প্রত্যেকে আরো একা হয়। সবার সহযোগিতা অপরিহার্য; কিন্তু নৈর্ব্যক্তিক। রাষ্ট্র বহু মানুষের দেওয়া-নেওয়ার সমজাতীয়তা খোঁজে; অথবা সমজাতীয়তাকে ধারণ করে। তার স্থায়িত্ব নির্ভর করে পারস্পরিক দায়িত্ববোধের বাস্তব সংযোগ ও সমন্বয়ের ওপর।
আরো একটা প্রশ্ন সামনে। পৃথিবী বাসযোগ্য থাকছে কি? আর কিছু বাদ দিলেও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সঙ্গে তার বেঁচে
থাকার পরিবেশের কাঙিক্ষত সামঞ্জস্য কি ক্রমশ বিলীন হয়ে যাচ্ছে না? মানুষের ইতিহাস কি কোনো পথ দেখায়? না কি ইতিহাসের বাইরে গিয়ে নতুন পথ খুঁজতে হয়? আমার জানা নেই। এলিয়ট লিখেছিলেন, পৃথিবীর শেষ গোঙানোয়। এখন পর্যন্ত সব রাজ্য ভাঙা-গড়ার ইতিহাস বুঝি তেমনই। কিন্তু মানুষের মৃত্যু হলেও মানব তো থাকে! জীবনানন্দ এই আশাটুকু বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। আজো কি তা ধরে রাখা যায়? যদিও মানুষের সবটার কল্পনা এখন আয়ত্তে?
আমরা বাঙালিরাও আমাদের কোথায়-কীভাবে দেখি? ভৌগোলিক-ঐতিহাসিক দুই প্রেক্ষাপট কি এক জায়গায় ধরা দেয়? দূরতর অতীতে বঙ্গ-শব্দের স্থানিক উলেস্নখ পাই। কিন্তু তার সঙ্গে বাঙালি পরিচয়ের ঐক্য-সূত্র মেলে না। এমন কি তরলিত অবস্থা থেকে বাংলা ভাষা ফুটে ওঠার দীর্ঘ কালপর্বের পরেও, না। নিরাসক্তভাবে দেখলে বাংলা ভাষার বিকাশে কোনো অনন্যতা ছিল না। প্রাকৃত ভাষার বহুমুখী বিস্তার থেকে আরো বিবিধ ভাষা যেভাবে এক কালখ– বিকশিত হয়েছে, বাংলা ভাষাও তেমন। (দক্ষেণী ভাষাগুলো অবশ্য প্রাচীনতর ও তাদের উৎস ভিন্ন।) এবং দীর্ঘকাল তা ছিল প্রান্তিকই। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতাই কিন্তু বাংলাকে আর সবার থেকে এগিয়ে দেয়। কলকাতা ওই শাসন ব্যবস্থায় রাজধানী হওয়ার সূত্রে য়োরোপীয় জ্ঞানকা–র সঙ্গে তাৎক্ষণিক পরিচয় এর অন্যতম প্রধান কারণ। কলকতা স্বয়ং ছিল এক অর্বাচীন শহর। তার পিছুটান ছিল তুলনায় কম। তাই নতুন ধ্যান-ধারণা রোপিত হওয়ার সুযোগ মেলে বেশি। তাতে বাংলা ভাষায় সমৃদ্ধির জোয়ার বয়। অবশ্যই তা অপ্রতর্ক্য ছিল না। তবু তা মাথা তুলে দাঁড়ায়। নিজেকে আপন বৈভবে আলাদা করে চেনায়। বাঙালি মেধার স্ফুরণ ও বিচ্ছুরণ ঘটে। স্বাদেশিকতার চেতনাতেও। ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতা ছাড়া এর কোনোটিই ঘটত না। উপমহাদেশে বাংলা প্রান্তিকই থেকে যেত।
তাই বলে কি সে কাঙিক্ষত পথে এগিয়েছে? মানব ভাবনার সর্বোত্তম বিকাশ ঘটিয়েছে? দুটোর উত্তরই, না। জ্ঞানে-কর্মে-সামাজিক ব্যবস্থায় কোনো সামঞ্জস্যের দেখা মেলেনি। বরং অতীতে-বর্তমানে তালগোল পাকিয়েছে। সেখানে অতীতের বজ্রমুষ্টি আলগা হয়নি। বর্তমান তার সঙ্গে আপস করেছে। অথবা তাকে স্বতঃসিদ্ধ মেনেছে। এখানে ঔপনিবেশিক শক্তির স্বার্থবুদ্ধিকে টানছি না। তারা আমাদের ঝিনুকে দুধ মুখে তুলে দিয়ে বড় করবে, এমন প্রত্যাশাই আত্ম-অবমাননাকর। তাকাতে হয় আমাদের নিজেদের দিকেই।
চিরস্থায়ী-বন্দোবস্তকে অনেকে আমরা নষ্টের মূল বলে মনে করি। সার্বিকভাবে তা যে তুলনায় অকল্যাণই বয়ে এনেছে বেশি, এতে দ্বিমত পোষণের কোনো কারণ দেখি না। তবে এ পুরোটাই অভিনব ছিল না। নিকট অতীতের ইতিহাস ঘাঁটলে চোখে পড়ে, আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যে যুদ্ধের ও নানাস্থানে বিদ্রোহের ক্রমবর্ধমান ব্যয় মেটাতে সুনির্দিষ্টভাবে রাজস্ব বাড়াবার লক্ষক্ষ্য এ-বিষয়ে অভিজ্ঞ ও কর্মকুশলী মুরশিদ কুলি খানকে ১৭০১ সালে সুবে বাংলায় দেওয়ানির দায়িত্ব দিয়ে পাঠান। ১৭১৩-তে মোগল বাদশাহ ফররুখ শিয়র তাঁকে বাংলার সুবেদার ও নবাব বলে স্বীকৃতি দেন। তখন রাজস্বের সিংহভাগ ছিল ভূমি-রাজস্ব। তা আদায়ে বড় বড় জমিদারদের সঙ্গে মুরশিদ কুলি খান যে-বন্দোবস্ত করেন, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ধারাবাহিকতার সূত্র মেলে চিরস্থায়ী ভূমি-ব্যবস্থায়। অবশ্য নবাবি আমলে জমিদারের গাফিলতিতে তাকে বেঁধে এনে অবমাননাকর ‘বৈকুণ্ঠ-বাসে’র যে রীতি ছিল, চিরস্থায়ী বন্দোবসেত্ম তার পুনরাবৃত্তি ঘটে না। আরো গভীরে যা কাজ করে, তা আগেই বলেছি, শিল্পায়নে অনীহা। জনসংখ্যার চাপ নেই, জমি উর্বর, নদী-নালা, খাল-বিলে প্রচুর মাছ, পুঁজি-প্রযুক্তির বিকাশ ভেতর থেকে হয় না। উদ্বৃত্ত যে জমে না, তা নয়। তা রূপান্তরিত হয় সোনা-রুপায়। তাল-তাল মজুদ। আর অঙ্গসজ্জায় ধনাঢ্য প্রদর্শনী। শুধু বঙ্গভূমিতে নয়, গোটা উপমহাদেশেই। কার্ল মার্কস বিস্মিত হয়েছিলেন এমন অলস সম্পদের প্রাচুর্যে।
অবশ্য উপনিবেশের প্রথম রাজধানী কলকাতায় না হয়ে পশ্চিম-মধ্য বা দক্ষিণ ভারতে যদি হতো, তবে একই রকম
শিল্প-ভাবনা কাজ করত, এমনটি নিশ্চিত করে বলা যায় না। আমরা দেখি, নানা প্রতিকূলতার ভেতরেও তখন এই উপনিবেশে যেটুকু শিল্পায়ন ঘটেছে, তার পেছনে উদ্যোগী ছিলেন কটি পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতীয় পরিবার। যদিও শুরুতে কলকাতা রাজধানী হওয়ায় তার বিশেষ সুবিধার কারণে তাঁরা পুঁজি নিয়োগ করেন বাংলাতেই বেশি। এ কিন্তু কোম্পানি ব্যবসার বিকল্প, মূলে জাপানের মতো পরিবারনির্ভর উদ্যোগ। ডক্টর তীর্থংকর রায়ের করপোরেট ব্যবসা নিয়ে সরল সমীকরণ কতটুকু বাস্তবের অনুমোদন পায়, তা প্রশ্নের বিষয়। এখানে বাঙালিবাবুরা অবশ্য পুঁজির কারবারিদের সবসময়ে তাচ্ছিল্য করেছেন। মেড়ো, উরে, খোটা, বাঁধাকপি – তাদের এইসব বলে নাক সিঁটকে আত্মপ্রসাদে ফেটে পড়েছেন। বর্তমানেও তার এলিয়টীয় অনুবর্তন কিন্তু একেবারে দুর্নিরীক্ষ্য নয়।
তবে বর্ণ-বিভাজনের মানসিকতা যে জাতি-ধর্ম-বিশ্বাস নির্বিশেষে মূলে স্থিতিশীল থেকে উপমহাদেশীয় আচরণ বরাবর নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে, এই বাংলাতেও, এ-কথা গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখা যে প্রয়োজন, তা আর একবার বলি। বাংলার উপকূলীয় নিম্নবর্ণের অনেকে অষ্টম-নবম শতকে আরব বণিকেরা সমুদ্রপথের দখল নেওয়ার পরেও নৌযানে মাঝি-মাল্লা-খালাসি হয়ে তাদের দলে ভিড়ে গিয়ে দেশ-দেশান্তর ঘুরে এসেছে। তাদের জীবনযাত্রার এই প্রক্রিয়া ব্রিটিশ আমলেও ক্ষুণ্ণ হয়নি। বরং আরো বিসত্মৃত হয়েছে। কালাপানি পার হতে কোনো নিষেধের সংস্কার তাদের ছিল না। কোনো না কোনো পরিবর্তনের বার্তা ও কর্মকুশলতা নিয়ে তারা ফিরবে, এইটিই সাধারণত আশা করার কথা। কিন্তু তা হয়নি। বর্ণপ্রথার অনুচ্চারিত কিন্তু অভ্যস্ত সংস্কার তাদের আপন-আপন কোটরে নিশ্চিন্ত রেখেছে। বৃহৎ সমাজে পারস্পরিক নৈকট্য গড়ে ওঠেনি। একই রকম ঘটে কলকাতা-শিল্পাঞ্চলে যারা পরে কুলি-মজুর হয়ে যায়, তাদের বেলাতেও। অবশ্য ওইসব
কুলি-মজুরের শতকরা প্রায় নববই ভাগই আসে বাংলার বাইরে থেকে। এ নয়, যে সবাই একে-অন্যে বিবাদে জড়ায়। কিন্তু সমাজ খোপে-খোপে ভাগ হয়ে যায়। পারস্পরিক অসাড় উদাসীনতা অবিরাম বজায় থাকে। সত্যিকারের শিল্পায়ন ঘটে না। বহু-মানুষের বহুমুখী যোগাযোগের জটিল বিন্যাস প্রশ্রয় পায় না। এখনো ‘মা-মাটি-মানুষ’-এর আবেগ উস্কে দিয়ে গণচেতনায় সাড়া জাগানো যায়। কর্মপরিসরে মানসমুক্তি না ঘটলে ব্যাপ্ত সমাজেও তা আশা করা যায় না। সংকট ও বিভ্রান্তি ফেটে পড়ে ঠিকই, – এবং তা সঠিক পথ খুঁজে না পেয়ে আকার নেয় উৎকট সাম্প্রদায়িকতার। এলিয়টীয় অতীতের বিকার এইভাবে বর্তমানকে তাড়া করে। এবং এই বিকার তাঁরই ভাবনার অনুসরণে এক অবজেকটিভ-কোরিলেটিভ।
তবে একে অনিবার্য ভেবে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা অপরাধ। ইতিহাসের ধারা শুভ সম্ভাবনারও ইঙ্গিত দেয়। তাকে চিনে নিয়ে বহু দ্বান্দ্বিকতার ভেতরে পথ খোঁজার দায় আমাদের। বর্তমানে। ভবিষ্যতেও। r
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.