উদার মানবিকতার চিত্রশিল্প

রবিউল হুসাইন

Art Work
Art Work

‘বন্ধনহীন হৃদয়নদীর গান’ শিরোনামে চিত্রকলার শিক্ষক, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন শিল্পী মতলুব আলীর সম্মিলিত প্রয়াসের এ-যাবৎ কৃত নানা ধরনের, বিষয়ের ও বৈচিত্র্যের বহুবিধ চিত্রকর্ম নিয়ে একটি একক চিত্রপ্রদর্শনী শিল্পকলা একাডেমীর সৌজন্যে গত মার্চ মাসে হয়ে গেল। প্রদর্শনীতে শিল্পীর ষাটের দশকে ছাত্রজীবনের অনুশীলন থেকে শিল্পীজীবনের সৃজনশীল নিরীক্ষাপ্রবণ অনেক ছবি স্থান পেয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গের সংগ্রহ থেকে শিল্পকলা একাডেমী কর্তৃপক্ষ বেশ একাগ্রতা ও শ্রম স্বীকার করে শিল্পীর চিত্রকর্মগুলো সংগ্রহ করে প্রদর্শনীটি দর্শকদের জন্যে সাজিয়েছেন। তাই ১৯৬০ সালে সৃষ্ট শিল্পীর কাঠখোদাই ছাপচিত্র যেমন দেখা যায়, তেমনি ২০১১-এর আত্মপ্রতিকৃতি দিয়ে অ্যাক্রিলিকে ‘বন্ধনহীন হৃদয়নদীর গান’ শীর্ষক ছবিটিও। শিল্পী তাঁর দীর্ঘ শিল্পীজীবনে বহু আঙ্গিক, বিষয়, মাধ্যম ও প্রকরণ নিয়ে যেসব ছবি সৃষ্টি করেছেন, তার একটি পূর্ণাঙ্গ ও সামগ্রিক পরিচয় এবং রূপ এই প্রদর্শনীতে তুলে ধরা হয়েছে। জলরং থেকে কালি-কলমের রৈখিক প্রতিবেদন, পেনসিল-রেখা, ক্রেয়ন, তেল, অ্যাক্রিলিক, মিশ্র মাধ্যম, কোলাজ, ছাপচিত্র – এরকম বহুবিধ মাধ্যমে শিল্পী তাঁর সৃজনপ্রক্রিয়ার প্রতিরূপ নিয়ে এসেছেন। তাঁর অঙ্কনশৈলী বাস্তবমুখী, বলিষ্ঠ, স্পষ্ট ও সহজ-সরলতায় বাঙ্ময়। জটিলতামুক্ত এই চিত্রপ্রয়াস শিল্পীকে যেমন দর্শকপ্রিয় করে তুলেছে, তেমনি তিনিও তাঁর শিল্পসৃষ্টির মাধ্যমে নিজেকে সৃজনক্ষমতার কাছে সমর্পণ করে ভারশূন্যতায় অবগাহন করেছেন। প্রকৃতি আর মানুষ যেমন প্রত্যেক শিল্পীর উৎসমুখ, শিল্পী মতলুব আলীরও তদ্রূপ। যে-কোনো প্রকৃত শিল্পীর শিক্ষক ও প্রেরণাদাতা প্রকৃতি। এই প্রকৃতির মধ্যে নিসর্গ, জনপদ, জলবায়ু, মাটি, বৃক্ষ, নদী, সাগর, জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ এবং পরিশেষে মানুষই প্রধান। ওইসব যোগসূত্র ঘিরে আবর্তিত হয় মানুষের আবেগ, সুখ, দুঃখ, স্বপ্ন, আনন্দ, অপমান, বিদ্রোহ, সংরাগ, হিংসা আর সর্বোপরি ভালোবাসা। ছবির মধ্যে দৃশ্যমান জগৎ যা আমরা দেখি সেই আবহ আর একটি ভাবনা ও অবচেতনার ভুবন – এই দুটি বিশেষ উৎসরণকে শিল্পীরা নিজস্ব বোধ, বিবেচনা ও চেতনার সাহায্যে ফুটিয়ে তোলেন। শিল্পীর সৃজনক্ষমতা তাঁর অভিরুচি অনুযায়ী প্রকাশিত হয়। কেউ বাস্তবতাসমৃদ্ধ মূর্ততায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, কেউ আবার বিমূর্ত, নৈর্ব্যক্তিকতা বা নির্বস্ত্তকতায়। মূর্ততায় সরাসরি যা সামনে দেখি তারই প্রতিরূপ রং, রেখা, আকারে হুবহু বা আধা-আধি আঙ্গিক-আলেখ্যে নিসর্গ, প্রকৃতি বা মানুষের জীবনকেন্দ্রিক বিষয়ে প্রতিভাত হয়, যা দৃশ্যগতভাবে দর্শকদের বোধে সরাসরি সহজে ফুটে ওঠে। পক্ষান্তরে বিমূর্ততায় ধরা দেয় মানুষের নির্বস্ত্তক ভাবনার জগৎ, যা প্রতিভাত হয় জ্যামিতিক রেখা, বিন্দু, বর্গ, ত্রিভুজ, আয়তাকারে বিভিন্ন রঙের মাধ্যমে নানা রকমের বুনুনির সাহায্যে নৈর্ব্যক্তিক প্রকাশবাদিতায়। এই প্রধান দুটি প্রকাশের মধ্যে আরো বহুবিধ বিশদ মাধ্যম বিদ্যমান, এটা স্বীকৃত। দৃশ্যজগৎ, অবচেতনা ও ভাবনার জগতে শিল্পীরা তাঁদের প্রাকৃতিক শিল্প সৃজনক্ষমতায় নিজ নিজ স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণ করেন। শিল্পী মতলুব আলী এই দুই শিল্পপরিসরেই জায়গা করে নিয়েছেন। আলোচ্য সম্মিলিত চিত্রপ্রদর্শনীর ছবিগুলোতে সরাসরি সেই সাক্ষাৎ-পরিচয় পাওয়া যায়। কতক ছবিতে তিনি এই দুটি ধারার সম্মিলিত রূপও পরিস্ফুটন করেছেন। যেমন, এক সবুজ পায়রার উপাখ্যান, যেখানে জ্যামিতিক চৌকো-বর্গের খাঁচার ভেতরে এক সবুজ পায়রা সবকিছু ভেঙে বেরিয়ে আসছে – এই ধরনের মিশ্ররীতির ‘ডিসর্টেড থিম-১’, ‘বাস্তব ও প্রাকৃতিক লাইভ’, ‘এক্সপ্রেশনিস্ট ইম্প্রেশন’, ‘নিজেরে হারায়ে খুঁজি’ – এসবে পাওয়া যায়। আর বিমূর্ত প্রকাশবাদিতাসমৃদ্ধ বেশ কয়েকটি ছবি বেশ স্পষ্ট হয়ে অবচেতন জগতের পরিচয় দেয়, যেমন – ‘ডিসর্টেড থিম-২’, ‘উৎসর্গ : মাদার তেরেসা’, ‘হ্যালুসিনেশন-১’, ‘অ্যান্টিক’, ‘অ্যান্ড দি ক্যামোফ্লেজ-রিয়ালিটি’ ‘রেখা ও না-রেখায় গড়ন গঠন’ ইত্যাদি। অনুশীলনী ছাত্রজীবনে কৃত স্কেচ জলরঙের নগর, গ্রাম নিয়ে কিছু ছবিও দৃশ্যমান। ছবিগুলোর মধ্যে দিয়ে শিল্পী তাঁর শিল্পনিষ্ঠা, শ্রম, সময়, একাগ্রতা নিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত সৃজনক্ষমতা প্রকাশ করেছেন অবলীলায় ও আরাধ্য শিল্প-সচেতনতায়। একজন শিল্পীর শিল্পচর্চার দীর্ঘ কষ্ট ও কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে তাঁর অর্জিত স্থানে পৌঁছতে হয়েছে সফলভাবে, এই প্রমাণ পাওয়া যায়। তাঁর সামগ্রিক একক প্রদর্শনী তাই শিল্পী ও শিক্ষাপ্রয়াসী শিক্ষার্থী- ছাত্রদের কাছে একটি শিক্ষণীয় উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। সাম্প্রতিককালে একজন শিল্পশিক্ষক ও শিল্পীর এই সামগ্রিক সম্মিলনী প্রদর্শন সেজন্যে উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ শিল্প-ঘটনা। শিল্পী মতলুব আলী বহু গুণের অধিকারী। তিনি একজন সাহিত্যিক, শিল্পলেখক-গবেষক (জয়নুল-গবেষণা), সুরকার, গীতিকার ও গণসংগীত রচয়িতা। তাঁর সুযোগ্য পরিবারসদস্যরাও এসবে অবদান ও সক্রিয় সহযোগিতা দিয়ে চলেছেন। তাঁর একটি গণসংগীত খুব বিখ্যাত, সেটি হলো – ‘লাঞ্ছিত নিপীড়িত জনতার জয়’। শিল্পী আরেকটি ক্ষেত্রে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন যা প্রণিধানযোগ্য। তিনি একটি বিষয় নিয়ে পর্যায়ক্রমে ছবি রচনা করতে ভালোবাসেন যেমন – ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি নিয়ে চিত্রসমূহ, পরে ২০০৯-এ আন্তর্জাতিক নারীবর্ষের শতবার্ষিকী উপলক্ষে ৮৯টি ছবি নিয়ে অবিনাশী আর সুন্দর চিত্রাঙ্কনমালা আর ঢাকা-কলকাতা দিল্লি-ঢাকার দিনলিপিমালা উল্লেখ্য। স্বাধীনতা, দেশ ও সমাজকেন্দ্রিক অসাম্প্রদায়িক উদার মানবতাবাদ নিয়ে অগ্রসর চিন্তা তাঁর ছবির মধ্যে নিয়ে আসেন সাবলীলভাবে। সমাজতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনায় সাধারণ মানুষ, তাদের অবহেলিত দারিদ্র্যপীড়িত, অধিকারবঞ্চিত দুর্দশাগ্রস্ত জীবনালেখ্য ছবিতে অবলীলায় জায়গা করে নেয়। কালি-কলমের বলিষ্ঠ বাস্তবধারার অাঁচড়ে প্রাগুক্ত বিষয়ে বিশেষ শিল্পক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়। ‘রাজারবাগ একাত্তরে’ কোলাজ-তেলরং, ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধার বীরাঙ্গনা বোনে’ কালি-কলমের অাঁচড়, ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধার প্রত্যাবর্তনে’ জলরং, ‘মানব সন্তানে’ জলরং, ‘দুই বালকে’ পেনসিলে অাঁকা – এসব ছবিতে শিল্পীর সেই মানবপ্রেমের দরদ ও আকুতি বিশেষভাবে প্রস্ফুটিত। শিল্পী মতলুব আলী তাই একজন মানবতাবাদী, জনদরদি, সমাজ-সচেতন ও প্রাগ্রসর চিন্তার অধিকারী চিত্রশিক্ষক ও চিত্রশিল্পী। আগামী দিনে এই বহুমুখী সৃজনক্ষমতার শিল্পী তাঁর নতুন নতুন শিল্পপ্রয়াস নিয়ে আমাদের চিত্রজগৎকে আরো সমৃদ্ধশালী, আরো উজ্জ্বল বিভায় আলোকিত করে তুলবেন এই আশা রাখি।