উপমার রাজা সৈয়দ শামসুল হক

ফেরদৌসী মজুমদার
সর্বশাখায় পারঙ্গম সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক এখন কেবলই এক ছবি। গত ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে তিনি আর নেই – অন্য এক অজানা জগতে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আশ্চর্য এ-পৃথিবীর নিয়ম। তখন থেকেই তিনি আমাদের কাছে নিষ্প্রাণ এক ছবি। ছবি হতে তো সময় লাগে না। ভাবলেই আমি বিষণœ হয়ে যাই, তিনি আর কখনো লিখবেন না, নতুন কবিতা রচনা করবেন না, নতুন নাটক সৃষ্টি করবেন না। আসলে কে কখন ছবি হয়ে যাবে সে এক ওপরওয়ালাই জানেন। তবে ছবি হলেও কিছু কিছু ছবি কেবল ছবিই থাকে না। তার কর্ম, তার সৃষ্টি, তার সৃজনশীলতা ছবিটিকে মূর্ত করে তোলে – ছবি যেন কথা কয়ে ওঠে – যেন জীবন্ত হয়ে যায়। হক সাহেবও তেমনি এক ব্যক্তিত্ব। এত স্পষ্ট উচ্চারণে স্পষ্ট কথা বলতেন হক সাহেব! কতক্ষণ গুছিয়ে কথা বললেই মনে হতো, ওঁর কথাই যেন কবিতা। ওঁর কথা শুনলেই আমার মনে হতো – এটাই বোধহয় গদ্যকবিতা।
আমার সৌভাগ্য, আমি তাঁর বিখ্যাত কাব্যনাট্য পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়তে মুখ্য নারীচরিত্র মাতব্বরের মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছি, যেটা এখন আমার মেয়ে ত্রপা করছে। চরিত্রটা বুঝতেই আমার অনেক সময় লেগেছিল। কী অসাধারণ উপমা : ‘হঠাৎ আছাড় দিয়া আসমানে দেখা দিল চান, এক ফালি কদুর লাহান।’লাউয়ের ফালির মতো চাঁদ হতে পারে একমাত্র তাঁরই উপলব্ধি। পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়ের মহড়ার সময় মনে হয়েছিল আমি বোধহয় কোনোদিনও এ-অভিনয় করতে পারব না – একবার ছড়ার মতো সংলাপগুলো আওড়াই, আবার ছন্দ ছাড়া সংলাপ বলতে গেলে সেটা একেবারে নীরস হয়ে যেত। আবদুল্লাহ আল মামুন, এ-নাটকের নির্দেশককে আমার অপারগতার কথাটা বলার পরও তিনি সেটা কানেই তুললেন না – তিনি বললেন, ‘আপনাকে পারতেই হবে’। ভাগ্যিস বলেছিলেন। সংলাপ যখন ঠোঁটস্থ হলো, তখন দেখলাম এবং বুঝলাম – এটাই কাব্যনাট্য। বুঝলাম, গদ্য হলেও তার মধ্যে একটা ছন্দময়তা থাকতে হয়। হক সাহেব তো দৈনন্দিন জীবনেও আমাদের সঙ্গে ওইরকম ছন্দময় ভাষাতেই কথা বলতেন – কখনো তাঁর কথায় ছন্দপতন হতো না। তাঁর কথার রসাস্বাদন করতে হলে আমাদের বেশ সতর্ক ও সচেতন থাকতে হতো। জীবন সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান এবং জ্ঞানের পরিধি ছিল অপরিসীম।
পোশাক-আশাকে সাহেবি ও ছিমছাম ফিটফাট হলে কী হবে, মনেপ্রাণে আপাদমস্তক তিনি বাঙালি ছিলেন। কুড়িগ্রামের প্রকৃতি, কুড়িগ্রামের গ্রাম, ধু-ধু মাঠ, নদীর চর, চিকচিকে বালু, আকাশে চিল, চৈত্রের খাঁ-খাঁ দুপুর, আমের বোল, কুমারপাড়া এসবই তাঁর পায়ের আওয়াজে সাহিত্যের আকারে স্থান পেয়েছে। পায়ের আওয়াজে একটা গ্রামের ছবি অপূর্ব ছন্দময় ভাষায় দেখতে পাই। ভাষার ওপর কতখানি দখল থাকলে এমন লেখা যায়!
বাবা আল্লাতালার নাম,
কলমা কালাম
আপনের কাছেই শেখা, অতি ছোটবেলা,
মনে আছে, সকালে বিকালে
খ্যাতের ভিতর দিয়া বাবা আপনে রোজ দুইবেলা আসতেন –
আমার পুতুল খেলা ফালায়া তখন
ওজু নিয়া, মাথা কাপড় দিয়া
বসতাম আমপারা হাতে।
ভুল হইলে পর হাতের
পানখার বাড়ি পড়ত এ পিঠের উপর।

গ্রাম্যবালিকার, গ্রামবাংলার এ-দৃশ্যটা, হক সাহেবের বর্ণনায় – একেবারে জীবন্ত হয়ে উঠেছে – আমি যখন মাতব্বরের মেয়ের সংলাপ বলি, তখন নিঃসন্দেহে আমিও সেই গ্রামের পরিবেশে, সেই নিরীহ গ্রামের বালিকা হয়েই সেই গ্রামীণ প্রকৃতির সঙ্গে একাকার হয়ে যাই।
যেহেতু তাঁর মৌলিক নাটক পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়তে একাত্ম হয়ে ১০০ দিনেরও ওপরে অভিনয় করেছি, তাই আমি এ-নাটকের আলোকেই তাঁকে মূল্যায়ন করছি।
আমি বেশি অভিভূত ও আবেগতাড়িত হই, সংলাপে তাঁর উপমার ব্যবহার দেখে। মাতব্বরের মেয়ে যখন বলে,
আমার কী আছে?
গ্যাছে সুখ
য্যান কেউ নিয়ে গ্যাছে গাভীনের বাটে যতটুক
দুধ আছে নিষ্ঠুর দোহন দিয়া।
উপমার রাজা তিনি। এই একটা সংলাপেই, মেয়েটির বুক খালি করা আর্তনাদ যেন দর্শকশ্রোতার মনেও সমবেদনা সৃষ্টি করে, চোখকে সিক্ত করে দেয়। এ-সংলাপ এমন করে, গভীরভাবে উপলব্ধি করে লেখা সম্ভব হয়েছে এ-অসাধারণ কবিপ্রতিভা সৈয়দ শামসুল হকের পক্ষেই। বোঝা যায়, তাঁর গ্রামীণ পরিবেশের সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগ ছিল, যেমন ছিল গভীর এবং প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ শক্তি।
আবার কী সুন্দর করে ‘দেশ রক্ষার’ ব্যাপারে মাতব্বরকে দিয়ে তিনি উচ্চারণ করিয়েছেন – গ্রামবাসীকে উদ্দেশ করে মাতব্বর বলছেন,
এ তোমার এমন না যে হাল দিয়া জমি চাষ করা
অথবা খালুই দিয়া ইচা মাছ ধরা।
দেশ রক্ষা হইল পানি না নাড়ায়া
পানির উপরে ঠিক রাখা নিজ ছায়া।
অভাবনীয়! এখনকার প্রজন্ম ‘ইচা মাছ’ কী, আর ‘খালুই’ কী তা বোধহয় জানেই না। দোষ নেই – কারণ শব্দগুলোর সঙ্গে গ্রাম, গ্রামবাসী, গ্রামের প্রকৃতি, গ্রামের ভাষা, গ্রামীণ জীবন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আমাদের প্রজন্মই তো ভুলে যেতে বসেছে – ওদের আর দোষ কী? তবে তাঁর অনবদ্য সাহিত্য সৃষ্টি এসব আমাদের ভুলতে দেবে না। বারবার কাহিনির পটভূমিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। তাঁর ব্যাপারে আমার মুগ্ধতা যেন কাটতেই চায় না। একটা লোকের মধ্যে এত প্রতিভা থাকতে পারে? আমি বিস্মিত হই, কতখানি একনিষ্ঠ হলে একজন এমন অনবদ্য সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারেন।
সেই কবে থেকে তিনি লিখে চলেছেন – যে-কারণে যতদিন গেছে তাঁর কলমে তিনি তত সোনা ফলিয়েছেন। তাঁর রচনায় যেমন রোমান্টিকতা আছে, তেমনি আছে আগুনঝরা প্রতিবাদ।
রূপান্তর ও অনুবাদেও তিনি তাঁর পারদর্শিতা রেখে গেছেন। শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথ, টেম্পেস্ট, সবখানে তাঁর দক্ষতা ও ভাষাজ্ঞান প্রকাশ পেয়েছে। শেক্সপিয়রের ভাষা যেমন সমৃদ্ধ, সৈয়দ শামসুল হকের অনুবাদে বাংলা ভাষাটাও তেমনি সমৃদ্ধ হয়ে আমাদের কাছে ধরা দিয়েছে – কোথাও এতটুকু রস ক্ষুণœ হয়নি বা ভাষার অমর্যাদা হয়নি। যেমন সুখপাঠ্য হয়েছে, তেমনি হয়েছে রাজকীয় অনুবাদ বা রূপান্তর।
আমার আসলে তাঁর চলে যাওয়াটা মেনে নিতেই কষ্ট হয়, যদিও এটা ঠিক, তিনি পরিণত বয়সে ও একটি পরিপূর্ণ কর্মময় জীবন কাটিয়ে গেছেন। তাঁর লেখনী কখনো থামেনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত, হাসপাতালে শুয়েও লিখে গেছেন তিনি।
সেজন্যেই আমার মনে হয়, এ-ধরনের বিরল প্রতিভাদের অমর হলে কী হতো? কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। এটা তো ধ্রুব সত্য, প্রত্যেক মানুষের এ অমোঘ সত্যের মুখোমুখি হতেই হবে, সুতরাং আমি ব্যক্তিগতভাবে হক সাহেবের কাছে কৃতজ্ঞ যে, তাঁর রচনায়, তাঁর নাটকে আমার স্থান হয়েছে এবং জননন্দিতও হয়েছি। কোনো না কোনোভাবে তাঁর আশীর্বাদে আমিও পুষ্ট হয়েছি।
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক তাঁর সাহিত্যে, নাটকে, গল্পে, প্রবন্ধে, কবিতায় এ-জগতে তাঁর কর্মে অমর হয়ে থাকবেন। আমরা পদে পদে তাঁকে শ্রদ্ধাভরে, তাঁর উপমা, ভাষা এবং কাহিনির মধ্য দিয়ে তাঁকে স্মরণ করব। আমরা জানি, এ অমোঘ সত্য এড়ানো যায় না। তারপরও মনে হয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ-তিরোধানটা না হলেও পারত।
আমার বিশ্বাস, আরো কিছু সময় তাঁকে আমাদের মাঝে পেলে তিনি আমাদের আরো অনেক কিছু দিতে পারতেন। সৈয়দ শামসুল হকের উপমা এবং তুলনা তিনি নিজেই। তাঁর জয় হোক। তাঁর শান্তি হোক – কায়মনোবাক্যে এই প্রার্থনাই আমি করি। 