উপলব্ধির আলোকে আবুল হাসনাত

ইদানীংকার প্যানডেমিকজনিত পরিস্থিতিতে জানাশোনা মানুষজনের মৃত্যু যেন নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে উঠেছে। গেল কয়েক মাসে আমি হারিয়েছি বেশ কয়েকজন আত্মীয়, পরিচিত প্রিয়জন, বন্ধুবান্ধব, নানা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সুহৃদ-স্বজন, এ-তালিকায় সামান্য দিন আগে যুক্ত হলো শ্রদ্ধাভাজন আবুল হাসনাতের নাম। তাঁর প্রয়াণের সংবাদ পত্রিকাতে পাঠ করার পর থেকে একটি স্মৃতিময় ভাবনা আমার মনে বারবার ফিরে ফিরে আসছে। মৃত্যুসঞ্জাত কিছু কিছু স্মৃতি বোধ করি শিমুলের উড্ডীন তুলোর মতো হালকা, দিনযাপনের সক্রিয় চাপে তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না, উড়ে যায় বিস্মরণের ঠিকানাহীন গন্তব্যে, তবে কোনো কোনো মৃত্যুর অভিঘাত এত তীব্র যে, তা মনে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে থাকে, স্মৃতি থেকে সহজে সরানো যায় না, হাসনাতভাইয়ের পরলোকপ্রাপ্তির পর থেকে ভারাক্রান্ত শব্দটি আমার কাছে নতুন করে অর্থবোধক হয়ে উঠল।

হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল অতি-ক্ষীণ, আমাদের লেনদেনের বহর ছিল দু-ছত্রের ইমেইলে সীমাবদ্ধ, দু-চারবার আমি স্বদেশ ফেরা প্রসঙ্গে তাঁকে রিং করেছি, আমাদের কথাবার্তা কখনো অতিক্রম করেনি দু-মিনিটের সীমান্তরেখা, একবার সাক্ষাৎও হয়েছিল, আমাদের মিথস্ক্রিয়ার মেয়াদ ছিল পনেরো কিংবা জোর বিশ মিনিট, তারপরও মিতভাষী মানুষটি সম্পর্কে আমার কৌতূহল ছিল প্রচুর, এবং সবচেয়ে বড় কথা, তাঁকে কখনো পর মনে হয়নি। আমার লেখাজোকার ব্যাপারে তাঁর জাজমেন্টের ওপর আমি ভরসা করতে পারতাম, যা আমার অভিজ্ঞতায় ছিল অত্যন্ত বিরল একটি ব্যাপার।

হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে আমার সামাজিক অন্তরঙ্গতা ছিল না, তারপরও তাঁকে কাছের মানুষ মনে হতো, এটা যে পারসেপশন বা অবচেতনের উপলব্ধি, এ-ব্যাপারে আমি সচেতন, এ নিয়ে আমি খানিক ভেবেছিও। আমার অনুমান, শৈশবে তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ কোনো যোগযোগ না থাকলেও মানুষটি সম্পর্কে আমার একটি অপ্রত্যক্ষ ধারণা ছিল। এ-অনুমানের স্বপক্ষে কিঞ্চিত অপ্রাসঙ্গিক হলেও একটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। শৈশবে আমি বেড়ে উঠেছি মৌলভিবাজার জেলার একটি প্রত্যন্ত  গ্রামে। বাড়িতে সংবাদ পত্রিকাটি আসত, ১৯৬২ থেকে তৎপরবর্তী প্রতিটি গণআন্দোলনের খবরাদি কোনো না কোনোভাবে আমি জানতাম। আমার একজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় প্রয়াত সোলেমানভাই (মৌলভীবাজারের সৈয়দ মতিয়ুর রহমান সাহেব) নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন বাম ঘরানার রাজনীতিতে, তাঁকে প্রায়শ যেতে হতো আত্মগোপনে, তখন তিনি সংগোপনে বসবাস করতেন আমাদের বাড়িতে। তাঁর কাছ থেকে শুনতাম মিছিল, হুলিয়া প্রভৃতির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ। সোলেমানভাই সময় কাটাতেন পুকুরের ঘাট বা বৈঠকখানায় জোরে জোরে গ্রন্থ-পাঠ করে। শ্রোতা হিসেবে প্রথমত না পড়েই জানতাম, সত্যেন সেনের লেখা গ্রাম বাংলার পথে পথে বা মেহনতি মানুষ গ্রন্থ-দুটির প্রতিটি কাহিনি। তারপর যখন পাঠক হয়ে উঠলাম, সোলেমানভাই হাতে ধরিয়ে দিলেন ছোটদের রাজনীতি ও ছোটদের অর্থনীতি নামে দুটি জরুরি পুস্তক। আমার স্বদেশ তখনো রাজনৈতিক পরিচয়ে পূর্ব পাকিস্তান, আমি সপ্তম কিংবা অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। পত্রিকায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিবরণ খুঁটিয়ে পাঠ করছি। ঊনসত্তরের আন্দোলন দানা বাঁধল, সোলেমানভাই ঢাকা থেকে ফিরে এলেন, রাজনৈতিকভাবে আত্মগোপনের সঙ্গে যে আন্ডারগ্রাউন্ড শব্দটি সমার্থক তা খোলাসা হলো। তাঁর আধময়লা ঝোলা থেকে অতঃপর বের হলো সুকান্তসমগ্র, সম্পাদক সম্ভবত রণেশ দাশগুপ্ত ও বদরুদ্দীন উমর। সোলেমানভাইয়ের আলাপচারিতায় সত্যেন সেন ও রণেশ দাশগুপ্ত এ নাম-দুটির সঙ্গে উচ্চারিত হতে শুরু করল আবুল হাসনাত বলে একটি নাম, যিনি ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে, সোলেমানভাই তাঁর সাহিত্যপ্রীতি সম্পর্কে কী বলেছিলেন, এত বছর পর তা আর মনে নেই, তবে জেনেছিলাম মানুষটি রবীন্দ্রসংগীত ভালোবাসেন। স্বদেশে দোসরাবারের মতো সামরিক শাসন জারি হলো, সোলেমানভাই আমাদের বাড়িতে অনানুষ্ঠানিকভাবে অন্তরীণ হলেন, আমরা বেশ রাতে ট্রানজিস্টার রেডিওতে অ্যান্টেনা উঁচিয়ে দিয়ে আকাশবাণী থেকে প্রচারিত রবীন্দ্রসংগীত শুনতে শুরু করলাম। তারপর পূর্ব বাংলার দক্ষিণাঞ্চল ডুবল বিপুল জলোচ্ছ্বাসে, ত্রাণ সংগ্রহের সূত্র ধরে বিরাট পোস্টারে সোলেমানভাই লিখলেন ‘কাঁদো বাঙালী কাঁদো’, যতদূর মনে পড়ে আমিও কবিতা লিখলাম। সোলেমানভাই পাঠ করে নিচে লিখলেন, ‘কবিতায় যেন গণমানুষের কথা অবশ্যই থাকে’, তাঁদের সন্ধানলাভের সূত্র হিসেবে ফের সুপারিশ করলেন সুকান্তসমগ্র। মুক্তিযুদ্ধের পরপর মফস্বল শহর থেকে বের হলো একাধিক লিটল ম্যাগাজিন, আমার একটি গল্পও প্রকাশিত হলো, সোলেমানভাই পাঠ করলেন, গণমানুষের দিনযাপনের চালচিত্র তেমন করে ফুটে ওঠেনি, তাই রচনাকে বস্তুনিষ্ঠ করে তোলার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিলেন, রেফারেন্স হিসেবে এলো হাসনাতভাইয়ের নাম, সোলেমানভাই তাঁর সুপারিশে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পড়ে উপকৃত হয়েছিলেন, আমাকে তিনি জোগাড় করে দিলেন পদ্মানদীর মাঝি। কথাবার্তায় ‘বস্তুনিষ্ঠ’ ও ‘গণমানুষ’ শব্দ দুটি বারবার ফিরে এলো, আর আমার মনে ঢাকা নগরীতে বাসরত রবীন্দ্রসংগীতপ্রিয় হাসনাতভাইয়ের একটি ইমেজ আঁকা হয়ে গেল।

সত্তর দশকের প্রথম দিকে আমি ঢাকাতে আসি। সোলেমানভাই তখনো জীবিত, বাম ঘরানার রাজনীতিতে কতটা সক্রিয় ছিলেন, ঠিক মনে পড়ছে না, কোনো একটি পত্রিকায় সাংবাদিকতা করতেন, দু-একবার দেখাও হয়েছিল এবং আমি খোঁজ নিয়েছিলাম হাসনাতভাই নামক অদেখা মানুষটির। জানতে পেরেছিলাম, তিনি ঢাকাতে নেই, গিয়েছেন মস্কোতে। তখন দ্বিজেন শর্মাসহ পারিবারিক সূত্রে জানাশোনা আরো কয়েকজন পাড়ি দিয়েছেন সোভিয়েত ইউনিয়নে। আমার মানসে সমাজতন্ত্রের সূতিকাগার নামে পরিচিত, ভৌগোলিকভাবে বিচিত্র ও বিরাট, সাহিত্য ও শিল্পসম্পদে সমৃদ্ধ দেশটি সম্পর্কে চন্দ্রকলার বৃদ্ধির মতো কৌতূহল বাড়ছিল। পাঠ করতে শুরু করেছি সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে লেখা ভ্রমণকাহিনিগুলো। এ-পাঠক্রমের তালিকায় আরো বহুদিন পর কাকতালীয়ভাবে যুক্ত হয়েছিল সোভিয়েত ভ্রমণ : প্রত্যয়ী নতুন জীবন, গ্রন্থটির রচয়িতার নাম আবুল হাসনাত দেখে মনে হয়েছিল, লেখক তো আমার চেনা। সোভিয়েতবিষয়ক অন্যান্য বইপত্রের সঙ্গে তাঁর পুস্তকটি পৃথিবীর এ-অঞ্চলে ভ্রমণের ব্যাপারে আমাকে ইন্ধন জুগিয়েছিল, যার ফলে আমি অনেক বছর পর, পেশাদারি সূত্রে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের একাধিক প্রজাতন্ত্রে ভ্রমণের উদ্যোগ নিই, ওই সময় মাঝেমধ্যে মনে হতো হাতের কাছে হাসনাতভাইয়ের বইটি থাকলে কী যে ভালো হতো!

সত্তর দশকের মাঝামাঝি আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে যাওয়া-আসা শুরু করি। ছাত্র হিসেবে নিবন্ধিত হই বাংলা বিভাগে, তবে সময়ের বিপুল ভাগ কাটে গফুর মিঞা ও মোহাম্মদ আলীর চায়ের দোকান বা লাইব্রেরির বারান্দায় আড্ডা দিয়ে। পরিচিত হই সত্তর দশকের বেশ কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক তথা মাশুক চৌধুরী, শাহ কামাল, জাফরুল আহসান, রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, জাফর ওয়াজেদ, কামাল চৌধুরী, মঈনুল আহসান সাবের, ফারুক মঈনুদ্দীন, নকিব ফিরোজ, তুষার দাশ প্রমুখের সঙ্গে। অনুকূল পরিবেশে গল্প লেখার প্রবণতা ফের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। যতটা মনে পড়ে, ক্যাম্পাস থেকে বের হতো বেশ কিছু লিটল ম্যাগাজিন। এগুলোর কলেবর ছিল ক্ষীণ, প্রচ্ছদ কিংবা অঙ্গসজ্জা যে চমকপ্রদ ছিল, তা নয়, তবে মাঝেমধ্যে তাতে প্রকাশিত হতো নিরীক্ষাধর্মী বা অপ্রচলিত ধারার লেখাজোকা। যেসব কবি-সাহিত্যক দৈনিক পত্রিকার সাময়িকীর পাতায় লিখে বা একাধিক বইপত্র প্রকাশ করে তখনো যশস্বী হননি, তাঁদের রচনাও ছেপে যেত শোভনভাবে। এ-সূত্রে দ্রুত পরিচয় ঘটত যাঁদের নাম আগে শুনিনি বা লেখা চোখে দেখিনি, এ-রকমের চমৎকার কিছু মানুষ, সহজিয়া প্রকৃতির সম্পাদক, উষ্ণ হৃদয়ের কবি বা গদ্য কলাকারদের সঙ্গে। একটি লেখা মুসাবিদা হয়ে গেলে সমমনা কাউকে পড়ে শোনানো যেত, তেতো মন্তব্য শুনে বিব্রত হওয়ার সম্ভাবনাও ছিল অতিসামান্য। এ-প্রতিবেশে আমার দু-একটি ছোটগল্প ছেপে যায় লিটল ম্যাগাজিনে।

লেখা ছাপানোর ব্যাপারে আমি স্বনির্ভর ছিলাম না, আমার যে-যৎসামান্য লেখাজোকা ছেপেছিল, তা সম্ভব হয়েছিল কোনো না কোনো বন্ধুবান্ধব বা সুহৃদ-স্বজনের সূত্র ধরে। এঁদের সংখ্যা একাধিক, একজনের এখানে উল্লেখ করছি প্রাসঙ্গিক কারণে, তিনি হচ্ছেন ষাটের দশকের শেষদিকের কবি সম্প্রতি প্রয়াত মাশুক চৌধুরী। মাশুকভাই ছাত্রত্ব অতিক্রম করেছেন বছর কয়েক আগে, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আসতেন হামেশা, চাদর মুড়ি দিয়ে হাকিম মিঞার চায়ের দোকানে বসে থাকতেন। ক্রমাগত সিগ্রেট খেতেন, ধূমপান ছাড়া তাঁকে আমি অন্য কোনো বিষয়ে সক্রিয় হতে দেখিনি কখনো। তবে, সে-সময়ে প্রায় প্রতিটি লিটল ম্যাগাজিনের পয়লা দিকে ছাপত তাঁর কবিতা। বেশ কয়েকটি ম্যাগাজিনের সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র ছিল। চায়ের স্টলে কেউ না থাকলে আস্তে করে বলতেন, ‘শনিবারের মধ্যে একটি গল্প তৈরি করে দাও।’ প্রস্তাবিত টাইমলাইন কবুল না করলে সমস্যা কিছু হতো না, বলতেন, ‘আচ্ছা, বুধ-বৃহস্পতিবারে দিলেও চলবে।’ এ-প্রক্রিয়ায় তাঁর হাতে তুলে দেওয়া একটি গল্প ‘বামপন্থীর বিধ্বস্ত ডানহাত’ ছাপা হয়েছিল অরুণি অথবা অন্য কোনো একটি লিটল ম্যাগাজিনে। প্রকাশের পর আমাকে তাজ্জব করে দিয়ে জগৎ-সংসারে নিরাসক্ত এ-মানুষ গল্পটির তারিফ করলেন, সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘এ-রকমের একটি লেখা হাসনাতভাইকে দিয়ে এসো।’ জানতে পারলাম, হাসনাতভাই সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী সম্পাদনা করছেন। দৈনিক পত্রিকায় লেখা প্রকাশের ব্যাপারে আমার উচ্চাশা ছিল না, সন্তুষ্ট ছিলাম লিটল ম্যাগজিনের অনুল্লেখযোগ্য একটি-দুটি গল্প প্রকাশে। তবে তাঁর সঙ্গে প্রয়াত সোলেমানভাইয়ের রেফারেন্স দিয়ে একবার দেখা করার ইচ্ছা হয়েছিল, কিন্তু শুনতে পেলাম, তিনি মূলত কাজের লোক, কথাবার্তা তেমন বলেন-টলেন না। তো উদ্যোগ নিয়ে দেখা করতে যাওয়ার তাৎক্ষণিক উৎসাহ মিইয়ে এলো। তারপর ফিরে এলাম গ্রামে, দূরত্বের জন্য সাক্ষাতের সম্ভাবনাও বিলুপ্ত হলো।

বছর দু-তিন পর, কী কারণে জানি আমি সপ্তাহখানেকের জন্য ঢাকাতে ফিরি। এক সুযোগে শাহবাগের সিনোরিটা নামক রেস্তোরাঁতে যাই পুরানো দিনের সুহৃদ-স্বজনদের সন্ধানে। ওখানকার বারান্দায় বসে আড্ডা দেওয়া কার কাছ থেকে যেন নাম ঠিক মনে করতে পারছি না শুনতে পেলাম সচিত্র সন্ধানীতে আমার একটি কবিতা ছেপেছে। লেখাটি আমি সাবমিট করিনি, তবে ছেপে যাওয়াতে খুশি হলাম, জানতাম কথাসাহিত্যিক সুশান্ত মজুমদার ওখানে কাজ করেন। পরদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই। পত্রিকার কপিটি পেয়েছিলাম কি, সম্ভবত পাইনি, তবে অনেকদিন পর সুশান্তদার সঙ্গে দেখা হলো, আড্ডাও জমল দারুণভাবে। একটি চেয়ারে বিমর্ষ হয়ে বসেছিলেন আমার প্রিয় কথাসাহিত্যিক, অন্ধ তীরন্দাজ গল্পগ্রন্থের লেখক কায়েস আহমদ (১৯৪৮-৯২)। তাঁর কাছাকাছি বসে বই পড়ার সুযোগ হয়েছে আমার একাধিকবার। আমি গুলিস্তানের ভারতীয় তথ্যকেন্দ্রের লাইব্রেরিতে বই পড়তে যেতাম। ঝোলা-কাঁধে কোর্তা-পাজামা পরা মানুষটি একই টেবিলে প্রতিদিন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনাবলি নিয়ে বসতেন, কখনো চোখমুখে রাজ্যের বিরক্তি ফুটিয়ে নোট নিতেন, আমি দু-একবার সালাম দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কথা বলার তীব্র প্রচেষ্টায় হেসেছিও, সাড়া পাইনি। সচিত্র সন্ধানীর দফতরে সুশান্তদার কার্যালয়ে ফের তাঁর নাগাল পেলাম, সুশান্তদা পরিচয় করিয়ে দিলেন, আমরা হাত মেলালাম। একটু পর কবি ত্রিদিব দস্তিদার কামরায় ঢুকলেন, আলোচনা লঘু হয়ে এলো, আমাকে অবাক করে দিয়ে কায়েস আহমদ ভারি সুন্দরভাবে হাসলেন। ত্রিদিব অতীতে আমার দু-একটি গল্প ছাপিয়ে দিয়েছিলেন, জানতে চাইলেন লিখছি কি না, জবাব ভালো করে না শুনে প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে অস্থির ভঙ্গিতে উঠে পড়লেন তিনি। তবে সুশান্তদা লেখা চাইলেন, কাঁধ-ঝোলাতে মুনিপুরী সম্প্রদায়ের রাস-পরবকে কেন্দ্র করে তৈরি একটি গল্প ছিল, সুশান্তদা তা হাতে নিয়ে চোখ বুলাতে বুলাতে বললেন, ‘হাসনাতভাই গণসাহিত্য সম্পাদনা করছেন, ওখানে একটি লেখা দেন, যাওয়ার দরকার নেই, ডাকে পাঠিয়ে দিলেই হবে।’ কীভাবে গণসাহিত্যের একটি কপি সংগ্রহ করেছিলাম, তা মনে নেই, তবে বাড়ি ফেরার পথে ট্রেনে তা খুঁটিয়ে পড়লাম। আমার কাছে সদ্য লেখা অপ্রকাশিত গল্পও ছিল একাধিক, ডাকে পাঠানো যায় কি না তা নিয়েও ভেবেছিলাম, কিন্তু যেসব বিষয়বস্তু তথা পাখি পর্যবেক্ষণ কিংবা মৃত কারো প্রতি স্মৃতিঋদ্ধ অনুরাগ প্রভৃতি নিয়ে পল্লবিত হয়েছে আমার কল্পিত কাহিনিগুলো, কোনোটাতেই মনে হলো না, গণমানুষের দিনযাপনের চালচিত্র তেমন করে ফুটেছে, লেখা পাঠানোর উৎসাহ হারালাম।

ফাস্ট ফরোয়ার্ড, বছর পঁচিশেক পরের কথা, কাজ করছি আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে। স্বদেশের পত্রপত্রিকায় আমার বেশ কতগুলো ভ্রমণগল্প ছেপেছে। না, কোনোটাই আমার প্রিয় প্রিন্টমাধ্যম লিটল ম্যাগাজিনে ছাপেনি, প্রবাসে দিনযাপনের ফলশ্রুতিতে লিটল ম্যাগাজিনের যোগসূত্র চলে গেছে নাগালের বাইরে। দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকীতে পরিসর সীমিত, বড় আকারের রচনা মুদ্রণের সম্ভাবনা কম, কিন্তু আমার হাতে তৈরি হয়ে পড়ে আছে বেশ কতগুলো বড় আকারের ভ্রমণভিত্তিক বিবরণ। এগুলো না ছাপালে ক্ষতিবৃদ্ধি কিছু হতো না, তবে ততদিনে আমার মধ্যে তৈরি হয়েছে লেখা প্রকাশের প্রলোভন। রচনা মুদ্রণের জন্য জীবনভর আমি যেসব বন্ধুবান্ধবের ওপর ভরসা করি, এবং যাঁরা আমাকে কখনো বিমুখ করেন না, তাঁদের অন্যতম কথাশিল্পী ও ভ্রমণলেখক ফারুক মঈনুদ্দীন। টেলিফোনে সমস্যাটা তাঁকে বলি এবং তাঁর কাছ থেকে জানতে পারি, কালি ও কলম নামে হাসনাতভাইয়ের সম্পাদনায় চমৎকার একটি সাহিত্যপত্রিকা বের হচ্ছে। সরাসরি লেখা পাঠানোর সংকোচ কাটিয়ে উঠতে পারি না, তাই প্রথম লেখাটি সাবমিট করি ফারুকের মাধ্যমে। ধারণা করেছিলাম এটি অমনোনীত হবে তাই আর খোঁজটোজ নিইনি। 

মাসকয়েক পর আমি মোজাম্বিকের রাজধানী মাপুটো শহরের একটি ইন্টারনেট ক্যাফেতে বসে ফারুকের ইমেইল পাই, জানতে পারি, ভ্রমণ-আলেখ্যটি প্রকাশিত হয়েছে কালি ও কলমের একটি সংখ্যায়। কিছু ছেপে গেলে আমি খুশি হই, কিন্তু সচরাচর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করি না, কিন্তু এ-ঘটনায় সংযত থাকা কঠিন হয়, ইমেইলের জবাবে ফারুককে লিখি, সেলিব্রেট করতে হয়। ক্যাফে থেকে হোটেলে ফেরার পথে নিজের এ স্বভাববিরুদ্ধ উচ্ছ্বাস নিয়ে ভাবি। কোনো রচনা ছেপে যাওয়াটা বিরল কিছু না, এতে অতিমাত্রায় আনন্দিত হওয়া অপ্রয়োজনীয়, তারপরও মনে হয়, এই যে আমার পারসেপশন, শৈশবে আমার সাহিত্যরুচি নির্মাণে আমার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে হাসনাতভাই অপ্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছিলেন, তারুণ্যে একবার তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার আগ্রহও হয়েছিল, আমার লেখাটি তিনি ছাপার আগে নিশ্চয়ই পাঠ করেছেন, আনন্দিত না হওয়ারও কোনো কারণ খুঁজে পাই না। পরবর্তী বছর দু-তিনেকে আমার আরো দু-তিনটি ভ্রমণলেখা ছাপেন। ততদিনে আমি কালি ও কলমের ওয়েবসাইটের সন্ধান পেয়েছি, নিজের লেখা প্রকাশিত অবস্থায় পড়তে পেরে একটা বিষয়ে আশ্চর্য হই, লেখা থেকে বেমক্কাভাবে কোনো প্যারাগ্রাফ খোয়া যায়নি, যা ঘটছিল প্রায়-হামেশা অন্য দু-একটি কাগজে, এমনকি হাইফেনসুদ্ধ বিরতিচিহ্নগুলোও বহাল রাখা হয়েছে। ফের লেখা পাঠাতে উদ্বুদ্ধ হই। উৎসাহের চোটে দ্রুত লেখা ভিয়েতনামবিষয়ক একটি রচনায় ভুল তথ্য ছিল। সাবমিট করার পর তা বুঝতে পেরে, ইমেইলে সংশোধনী পাঠাই, তাজিকিস্তানের রাজধানী দুশামবের একটি ইন্টারনেট ক্যাফে থেকে ইমেইলটি পাঠিয়েছি, অন্তর্জালের কায়-কারবার বিশেষ বুঝি না, বার্তাটি যদি না পৌঁছায়, যদি-বা পৌঁছে কিন্তু হাসনাতভাই সময়মতো মেসেজটি না পড়েন, ভুল তথ্য কণ্টকিত লেখাটি যদি ছেপে যায় …। টেনশন নিয়ন্ত্রণ করা দুরূহ হলে অতঃপর আমি তাঁকে টেলিফোন করে বসি। নিরাসক্ত ভঙ্গিতে জবাব পাই ভুল সংশোধন করা হয়েছে। তিনি জানতে চান কোথা থেকে রিং করছি, বলি দুশামবে। তাজিকিস্তান নিয়ে কিছু একটা মন্তব্য করেন, খারাপ কনেকশনের কারণে ঠিক বুঝতে পারি না তিনি অতীতে কিছুদিন তাজিকিস্তানে কাটিয়েছেন, নাকি ওখানে যেতে তাঁর আগ্রহ হচ্ছে। লাইনে ক্র্যাকলিং সাউন্ড হয়, আফ্রিকান মুখোশ সম্পর্কে কিছু একটা বলেন, কিন্তু বাক্যটি সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই লাইন কেটে যায়। রিডায়াল করার সংকোচ কাটাতে পারি না।

কালি ও কলমে ভ্রমণলেখা পাঠানো ও তা মাসদেড়েকের ভেতর মুদ্রিত হয়ে যাওয়াটা প্রায় প্রত্যাশিত হয়ে ওঠে। আরো দু-তিনটি লেখা ছাপে, তাঁর সঙ্গে দু-ছত্রের ইমেইলেও আর তেমন যোগাযোগ হয় না, তবে প্রায় নিয়মিত লেখা ছাপা থেকে অনুমান করি, তিনি এখনো আমার লেখাতে আগ্রহ হারাননি, যা মাঝেমধ্যে ঘটছিল অন্যান্য পত্রপত্রিকায়। এ-সময়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কনসালট্যান্সির সূত্রে আমি সপ্তাহ তিনেকের মেয়াদে ঢাকা আসতে শুরু করি। একাধিক পত্রপত্রিকার ঈদসংখ্যায়ও আমার ভ্রমণলেখা ছাপার সুযোগ হয়। কোনো এক ঈদসংখ্যার জন্য সাবমিট করা একটি লেখার শিরোনাম ছিল ‘থ্যাইল্যান্ডে চীনা পল্লী’। পত্রিকা থেকে একজন টেলিফোন করে জানান, থাইল্যান্ডে চীনা পল্লি টাইটেল থেকে ‘চীনা’ শব্দটা বদলিয়ে তিনি ‘থাই’ করে দিতে চাচ্ছেন। আমি তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করি, বিপ্লবের পর দেশত্যাগী একটি চীনা সম্প্রদায় থাইল্যান্ডে রীতিমতো থিতু হয়ে গড়ে তুলেছে একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। লেখাটিতে তাদের দিনযাপনের বিশদ বর্ণনা আছে। কিন্তু কনভিন্স করতে পারি না। বিনীতভাবে অনুরোধ করি লেখাটি না ছাপানোর জন্য। কিন্তু ঈদসংখ্যার চাপ, লেখাটি তো খারাপ না, মাত্র একটি শব্দ ‘চীনা’কে ‘থাই’ করে দিলে কী এমন অসুবিধা? আমি জেনেশুনে কম্প্রোমাইজ করি, বলি, বিকল্প আরেকটি লেখা দ্রুত পাঠাচ্ছি। ‘থাইল্যান্ডে চীনা পল্লী’ রচনাটি অনেকদিন ধরে আমার ফাইলে পড়ে থাকে। এ লেখা-সংশ্লিষ্ট তথ্য সংগ্রহে আমি প্রচুর পরিশ্রম করেছি, এটি প্রকাশের বাসনা থেকেও নিস্তার পাচ্ছি না, এক পর্যায়ে লেখাটি আমি কালি ও কলমে সাবমিট করি। মাসখানেক পর ওয়েবসাইট ঘাঁটতে গিয়ে দেখি তা মুদ্রিত হয়েছে। লেখাটির কোয়ালিটি ভালো ছিল কি না, আমি জানি না, তবে এ-ঘটনাটি আমার উপলব্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ, ভ্রমণসাহিত্যে শুধু লেগে থাকা নয়, বরং প্রচলিত বিষয়বস্তুর সামান্য বাইরে গিয়ে কিছু লেখার ব্যাপারে প্রেরণা আমি পাই। আফ্রিকার প্রায় অচেনা রাজ্য লিসোটোর একটি কারাগারে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা পাঠাই, একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর আগুনে আত্মাহুতির বিষয় নিয়ে লিখতেও দ্বিধা হয় না, এ-ধরনের লেখাগুলো সাবমিট করার পর হাসনাতভাই এক ছত্রের ইমেইল পাঠিয়ে কখনো প্রাপ্তিসংবাদ জানাননি, তবে ছেপেছেন। আমার উপলব্ধির প্রসঙ্গ ফের টেনে নিয়ে আসছি, লেখাগুলো মুদ্রিত আকারে দেখতে পেয়ে মনে হচ্ছিল, লেখক হিসেবে শুধু বিষয় নির্বাচনই নয়, তথ্য-উপস্থাপনের যে স্বাধীনতা আমি চাচ্ছি, সম্পাদক হিসেবে তা অর্জনে তিনি সহায়তা করছেন।

যতদূর মনে পড়ে, ম্যানিলার একটি ইন্টারনেট ক্যাফেতে বসে অনলাইনে বাংলাদেশে আসার টিকিট কাটতে চেষ্টা করছি। অনেকদিন পর হাসনাতভাইয়ের একটি ইমেইল পাই। তিনি জানতে চেয়েছেন, দেশে আসার সম্ভাবনা আছে কি না? জবাবে লিখি, সপ্তাহ দিনের মধ্যে ঢাকায় আসছি, ফের রিপ্লাই আসে, তিনি পৌঁছার পর রিং করতে অনুরোধ করেন। স্বদেশে পৌঁছে যথারীতি তাঁকে টেলিফোন করি, তিরিশ সেকেন্ডে কুশলাদির পর্ব সেরে বলেন যে, তিনি দায়মুক্ত হতে চাচ্ছেন। ঠিক বুঝতে পারি না, দায়টা কীসের? সংক্ষিপ্তভাবে জানান, আমার বেশ কতগুলো বিল জমে আছে। আমি শিক্ষকতা করছি, হোটেলে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়, তাই কালি ও কলমের দফতরে গিয়ে বিল তুলতে আগ্রহ দেখাই না, তিনি আমাকে হোটেলের ঠিকানা পাঠানোর অনুরোধ করে রিসিভার রাখেন। পরদিন একজন মেসেঞ্জার কালি ও কলমের কয়েকটি পুরানো কপিসহ একটি এনভেলাপ পৌঁছে দেন হোটেলে। খাম খুলে পারিশ্রমিক হিসেবে পাওয়া টাকার অংক হাজার কয়েক দেখে ভীষণ অবাক হই! লিখে উপার্জনের এত বড় ঘটনা আমার জীবনে অতীতে কখনো ঘটেনি। সম্ভবত সত্তর দশকের মাঝামাঝি ফরিদপুর থেকে প্রকাশিত গণমন নামক একটি ম্যাগাজিনে লিখে আমি দশ টাকা উপার্জন করেছিলাম। উপার্জনে আমার আপত্তি নেই, তবে আদায়ের কৌশলটা ঠিক রপ্ত করে উঠতে পারিনি। এনভেলাপটি স্পর্শ করে আমার উল্লাস মাত্রাহীন হয়ে পড়ে। জানাশোনা বন্ধুবান্ধবকে টেলিফোন করে বলি, কালি ও কলম থেকে প্রচুর টাকা বিল হিসেবে পেয়েছি, পুরান ঢাকায় গিয়ে হাজির বিরিয়ানি খেয়ে সেলিব্রেট করতে চাই। আমার উচ্ছ্বাসকে কেউ বিশেষ পাত্তা দেয় না। ক্ষুণ্নমনে টাকাভর্তি এনভেলাপটি ব্রিফকেসে পুরে মিন্দানাও দ্বীপের উদ্দেশে দেশত্যাগ করি। মিডনাইট ফ্লাইটের আলো-আঁধারিতে বসে ভাবি, হাসনাতভাইয়ের কল্যাণে লিখে আমার অদৃষ্টেও প্রাপ্তিযোগ ঘটল, কিন্তু ইচ্ছামতো তা ব্যয় করার কোনো মওকা পেলাম না।

বছরখানেক পর বাস করছি মেক্সিকো সিটিতে। তিওতিহুয়াকান নামক একটি পুরাতাত্ত্বিক সাইটে বেড়াতে গিয়ে মুন পিরামিডের সিঁড়িতে বসা ফেরিওয়ালার কাছ থেকে সংগ্রহ করেছি পাথরে তৈরি ব্যতিক্রমী একটি মুখোশ। ওই যে একবার টেলিফোনে হাসনাতভাই আফ্রিকান মুখোশ সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন, আমারও বাসনা হয়েছিল তাঁকে আফ্রিকার কোনো দেশ থেকে জোগাড় করা একটি মুখোশ উপহার দিতে …। কিন্তু ক্রমাগত এক দেশ থেকে অন্য দেশে ঘুরে বেড়ানোর কারণে ঈপ্সিত মুখোশটি সংগ্রহ করা হয়নি। তিওতিহুয়াকান মুখোশটি হাতে পেয়ে ভাবলাম, যদি তাঁর সঙ্গে একবার সাক্ষাতের সুযোগ হয়, আর আমি যদি মুখোশটি তাঁকে দিই, তিনি কিছু মনে করবেন কী? 

মাসতিনেক পর ঢাকায় ফের আসার সুযোগ হয়। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের আগ্রহের কথাটা আমি বন্ধু ফারুককে (ফারুক মঈনুদ্দীন) জানাই। জানতে পারি, তাঁর কাছে তিনি আমার সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছেন, তো অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে ফারুক ও তাঁর স্ত্রী ফারজানার সঙ্গে বিকালবেলা বেঙ্গলের দফতরে যাই। অপেক্ষা করছিলেন তিনি। মুখোশটি পেয়ে খুশি হলেন, কিন্তু খুঁটিয়ে দেখলেন না, তবে তিওতিহুয়াকান গোত্রের মানুষজন মুখোশটি কীভাবে পুজো-অর্চনায় ব্যবহার করে তা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। কথাবার্তায় বিখ্যাত চিত্রশিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদের প্রসঙ্গ এসে পড়ল। কার কাছ থেকে যেন শুনেছিলাম শিল্পী তাঁর বন্ধু, তাঁর চিত্রকলা নিয়ে তিনি বই লিখেছেন। আমার শোনা কথা যাচাই করার কোনো সুযোগ হলো না, দ্রুত তিনি জোগাড় করে দিলেন বেঙ্গল থেকে প্রকাশিত শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদের সৃষ্টিসমগ্র শিরোনামে চিত্রকলার রঙিন প্লেটওয়ালা একটি  বই। বেঙ্গলের মঞ্চে চন্দনা মজুমদারের সংগীতের অনুষ্ঠান শুরু হতে যাচ্ছে। উঠে পড়তে পড়তে বললেন, ‘গানটা শুনে যাবেন।’ সংগীত শ্রবণের বিরতিতে ফারুক ও আমি তাঁর ছদ্মনামে লেখা কবিতা নিয়ে কথা বললাম।

মেক্সিকো সিটিতে ফেরার কিছুদিন পর তাঁর কাছ থেকে ইমেইলে অনুরোধ পাই, ফ্রিদা কাহ্লোর চিত্রকলা নিয়ে একটি আলোচনা শিল্প ও শিল্পী নামক ম্যাগাজিনের জন্য পাঠাতে। ইতোমধ্যে ফ্রিদার প্রচুর চিত্র দেখার সুযোগ হয়েছে, লিখতে গিয়ে মনে হলো, তাঁর চিত্রকর্ম নিয়ে তো আলোচনা হয়েছে বিস্তর, বাংলাদেশের সমঝদাররা নিশ্চয়ই তাঁর সৃজনের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবগত, তাই খানিক ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে আমি তাঁকে উপস্থাপন করতে চাইলাম। ততদিনে মেক্সিকো সিটিতে বাসরত জনাকয়েক চিত্রসমঝদারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। চাইলে তাদের ইন্টারভিউ করে ফ্রিদা কাহলোর চিত্রকলা পর্যবেক্ষণজাত প্রতিক্রিয়া সংগ্রহ করা যায়। আমি ফ্রিদা কাহলোর চিত্রকলার প্রেক্ষাপট ও ডিটেইল বর্ণনার সঙ্গে, মেক্সিকোর সমঝদাররা কীভাবে তাঁর কাজের ইন্টারপ্রিটেশন করছেন, তা যুক্ত করার প্রস্তাব করলাম। জবাব পেলাম দ্রুত, ইমেইল পড়ে বুঝতে পারলাম, তিনি প্রবন্ধের আকারে লেখাটি তৈরি করে দিতে অনুরোধ করেছেন। মেনে নিলাম, তবে লিখতে গিয়ে আমার উপলব্ধিজাত ইন্টারপ্রিটেশনকে বিশ্লেষণের সঙ্গে সংযুক্ত করলাম। সাবমিট করার পর ছোট্ট একটি সমস্যা দেখা দিলো। ফ্রিদা কাহলো মেক্সিকো তথা এসপানিওল ভাষাভাষী জগতে ফ্রিদা কালো নামে পরিচিত। তো আমি ‘কাহলো’ না লিখে ‘কালো’ লিখেছি। হাসনাতভাই জানালেন, মেক্সিকোর অসামান্য এ-চিত্রকর বাংলাদেশে ফ্রিদা কাহলো নামে পরিচিত, তাই ওই নামেই লেখাটি মুদ্রিত হবে। এ-সিদ্ধান্তে আমি খুশি হইনি, তবে কিছুদিন পর স্বদেশে ফিরে যখন শিল্প ও শিল্পীর একটি সংখ্যায় মুদ্রিত লেখাটি পড়লাম, রচনাটির শেষে তারকা চিহ্নযুক্ত ফুটনোটে সম্পাদক ফ্রিদা কাহলো যে মেক্সিকোতে ফ্রিদা কালো নামে পরিচিত, তা লেখকের রেফারেন্স দিয়ে জানিয়েছেন, তাঁর সম্পাদনার পেশাদারিত্বে আমি ফের মুগ্ধ হলাম। প্রায় বছর বারো ইমেইলের সূত্রে হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে এক ধরনের যোগাযোগ ছিল, তাঁর সঙ্গে আমার ইন পার্সন মিথস্ক্রিয়ার পরিধি ছিল অতিক্ষীণ, তবে উপলব্ধি ছিল প্রচুর। তাঁর পরলোকপ্রাপ্তিতে কেবলই মনে হচ্ছে, আমি যেন ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলাম।