জাহিদ আকবর চৌধুরী
কবিতা সংক্রান্তি – একটি ছোট কাগজ। যাকে কবি ও কবিতার কাগজ বলা যায়। ২০০৭ সালে এর জন্ম। আমরা কজন তার পৃষ্ঠপোষক।
যতদূর মনে পড়ে, ৪ নভেম্বর ২০০৭। কবি ও সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বাংলাদেশে আসেন – কবিতা সংক্রান্তির প্রথম জন্মবার্ষিকীতে।
সন্ধ্যায় ঢাকা ক্লাবে নৈশভোজ। কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী ও নানা ব্যক্তিত্বের গমগম সমাবেশ। রাত অনুমান ৯টা হবে, ছিপছিপে লম্বা অবয়বের আকর্ষণীয় একজন ব্যক্তির আগমন সবাইকে আরো সরব করে দিলো। আমি উৎসুক-দৃষ্টিতে তাঁর দিকে চেয়ে থাকি – সে অনেকক্ষণ। জানলাম, তিনিই দেশের বরেণ্য শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। ইতিপূর্বে তাঁর শিল্পকর্ম সম্বন্ধে প্রচুর শুনেছি। আজ চোখের সামনে তাঁকে দেখে অভিভূত হয়ে পড়ি। তাঁর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আগ্রহের ভীষণ চাপ অনুভব করি। আমার ভায়রা কবি হারিসুল হক তাঁর সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। অল্পবিস্তর আলাপ করে মনে হলো, তিনি কেবল একজন গুণী ব্যক্তিই নন, যেন এক অমূল্য পরশপাথর। এরপর প্রায়শই কাইয়ুম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছি, নিজেকে ধন্য মনে হয়েছে। আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ অন্তরে বাহিরের পান্ডুলিপি তখন প্রস্ত্তত। আমার মন, আগ্রহ, ভাবনা আমাকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরল – যেভাবেই হোক এ-বইয়ের প্রচ্ছদ কাইয়ুম চৌধুরীরই হওয়া চাই।
আমি জানি, এই মহান শিল্পী তাঁর শিল্পসাধনা, শিশু-কিশোর, সমাজ এবং জাতির উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ কাজে সর্বদা ব্যস্ত। এমন একজন ব্যস্ততম শিল্পীর কাছে কীভাবে বলব আমার কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদের কথা? কোনোভাবেই সাহস পাচ্ছিলাম না অনুরোধ করতে।
একটি কথা না বললেই নয়, পরিচয়-পরবর্তীকালে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর সঙ্গে সম্পর্কের পরিধি শুধু অনুরোধের মধ্যে আর সীমাবদ্ধ নেই – এখন যেন জোর করে দাবি আদায়ের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। সে-সুবাদে অনুরোধের পথ ছেড়ে বিনয়ের সঙ্গে আমার মনের বাসনা তাঁকে জানাই। কাইয়ুমভাই মুচকি হেসে আমার মনের বাসনাকে দুহাতে আলিঙ্গন করলেন। আমি ধন্য হলাম।
কাব্যগ্রন্থের পান্ডুলিপি কাইয়ুমভাইকে দেওয়া হলো। এরপর প্রতিটি সকাল-বিকেল আমার মন কাইয়ুমভাইয়ের ছায়ার সঙ্গে মিশে রইল আর আমি কাইয়ুমভাইয়ের আঁকা প্রচ্ছদ পাওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় থাকলাম। এক স্বর্ণালি বিকেলে কবি হারিসুল হক ফোনে জানালেন আজ সন্ধ্যায় কবি স্থপতি রবিউল হুসাইনের বাসায় নিমন্ত্রণ, সেখানে কাইয়ুমভাইয়ের সঙ্গে দেখা হবে। মনে মনে ভাবলাম, হয়তো আজ আমার পরম চাওয়া পরম পাওয়ায় পরিণত হবে। আমি চুপ করে অনেকক্ষণ বসে রইলাম। এরই মধ্যে সন্ধ্যা আগত। লাল সূর্য পশ্চিমাকাশে অস্তের পথে প্রায় ডুবো-ডুবো। মনোমাঝে সুখপাখি উড়ছে। এমন সুখ ইতিপূর্বে তো উদয় হয়নি কখনো!
পরম আনন্দেও যে মন দুরুদুরু করে, এর আগে তেমন দেখিনি। ঢিলেঢালা পাঞ্জাবি-পাজামা পরে রওনা হলাম কবি স্থপতি রবিউলভাইয়ের বাসায়। আমি আর কবি হারিসুল হক রবিউলভাইয়ের ধানমন্ডির বাসার নিচে কাইয়ুমভাইয়ের আগমনের অপেক্ষায় রইলাম। আমি শিহরিত, মুখরিত ও আনন্দিত। কাইয়ুমভাই এলেন – ওনার হাতে থাকা একটি বড় খাম এগিয়ে দিলেন। এরপর বিদ্যুৎবেগে খামের ভেতরে থাকা প্রচ্ছদটি বের করলাম – কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না – মনে হচ্ছিল স্বপ্ন দেখছি। আমার প্রথম বইয়ের প্রচ্ছদ, তাও আবার কাইয়ুম ভাইয়ের আঁকা। আমার সামনে দাঁড়ানো কাইয়ুমভাইকে দেখার চেষ্টা করছিলাম, আলো-অন্ধকারে তাঁর চেহারা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না, কাইয়ুম চৌধুরী নিজে প্রচ্ছদ হাতে করে নিয়ে এসেছেন, স্বল্পদিনের পরিচিত তাঁর এক গুণগ্রাহীর কাছে। মন আমায় বলল, হ্যাঁ, কাইয়ুম চৌধুরীরাই পারেন স্বল্পপরিচিত কোনো ব্যক্তির ইচ্ছার মর্যাদা এত সহজে দিতে।
আমি কাইয়ুমভাইকে কিছুই মুখে বলতে পারলাম না। মনের ভেতর একটা চিৎকার – আমি শুনতে পাচ্ছিলাম। যদি পৃথিবীকে এ-আনন্দ চিৎকার শোনাতে পারতাম, হয়তো কাইয়ুমভাইয়ের ঋণ কিছুটা হলেও শোধ করা হতো। আজ কাইয়ুমভাইয়ের সেই প্রচ্ছদটি যেন একটি টুকটুকে লাল গোলাপ।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.