একাত্তরের রাজারবাগ ও শাহজাহানের যুদ্ধ

১৯৬৫ সাল। ম্যাট্রিক পাশ করেছি মাত্র। একটা চাকরিও পেয়ে যাই তখন। দিনাজপুরের হাউজিং অ্যান্ড সেটেলমেন্ট অফিসের ওয়ার্ক অ্যাসিস্ট্যান্ট। কয়েক মাসের মধ্যেই আমার বিয়ে দেয় সবাই। কিন্তু সে-আনন্দ বেশিদিন টেকেনি। প্রজেক্ট শেষ হওয়ায় বছর দেড়েকের মধ্যেই চাকরি হারাই। কেউ তখন পাত্তা দেয় না। পরিবারেও আদর কমতে থাকে। অনেক কষ্ট পেলাম। রাগ করে একদিন বাড়ি থেকে এক কাপড়েই বেরিয়ে যাই। কাজের সন্ধানে চলে আসি চট্টগ্রামে।

পকেটে টাকা নেই। ঠিকমতো খেতেও পারতাম না তখন। দিনভর চাকরি খুঁজি আর রাতে থাকি মসজিদে। লোকমুখে একদিন পুলিশে লোক নেওয়ার খবর পাই। লাইনে দাঁড়াতেই শরীরের মাপে ফিট। ম্যাট্রিক পাশ শুনতেই নিয়ে নিল; কিন্তু মেডিক্যাল করাতে হবে। সেজন্য লাগবে একত্রিশ টাকা। মন খুব খারাপ হলো। হাসপাতালে বসে টাকার চিন্তা করছি। হঠাৎ এক রোগী পেটের ব্যথায় ছটফট করছে। চিৎকার শুনে তার কাছে ছুটে যাই। নানাভাবে সেবাও করি। ধীরে ধীরে তিনি সুস্থ হতে থাকেন। পরে জানলাম, পুলিশেরই এক হাবিলদার তিনি। সমস্যার কথা শুনে তিনিই সাহায্য করলেন। পুলিশ বাহিনীতে কনস্টেবল হিসেবে যোগ দিলাম। ব্রাশ (বডি) নম্বর ছিল ১৯৯।

হালিশহরে ছয় মাস ট্রেনিং। অতঃপর পোস্টিং হয় কুমিল্লায়। পরে পুলিশ টেলিকমিউনিকেশন কোর্সের জন্য আমাকে পাঠানো হয় রাজারবাগে। ১৯৭১-এ ছিলাম ওখানকার ওয়্যারলেস অপারেটর।

৭ই মার্চ ১৯৭১। বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণ দেন রেসকোর্স ময়দানে। এরপর থেকেই পুলিশ ব্যারাকের অবস্থা বদলে যেতে থাকে। ওখানে অবাঙালি পুলিশ সদস্য যেমন ছিল, আবার বাঙালি হয়েও স্বাধীনতার বিপক্ষের লোকও ছিল। খেতে বসলেই ওরা অহেতুক আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করত। আগে এটা আমরা সহ্য করতাম; কিন্তু শেখ সাহেবের ভাষণের পর হাতাহাতি হতে থাকল।

রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের পুকুরপাড়ে আমরা আলোচনায় বসতাম। সিদ্ধান্ত হয়, যা-ই ঘটুক আমরা প্রতিহত করব; কিন্তু কীভাবে? তা-ও জানা ছিল না! ভয়ও ছিল। কারণ তখন আমাদের বিপক্ষে ছিলেন এআইজি টেলিকমিউনিকেশনের প্রধান এসএম নবাব এবং ডিএসপি (ট্রেনিং) বজলুর রহমান মজুমদার। তবে পক্ষে ছিলেন ডিএসপি (প্রশাসন) মোজাম্মেল হকসহ কয়েকজন।

২৫শে মার্চ ১৯৭১। সকালবেলা। ঢাকা শহর থমথমে। পাকিস্তানি সেনারা হেভি মেশিনগান নিয়ে মেইন রাস্তাগুলোয় টহল দিচ্ছে। কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে; কিন্তু কী ঘটবে কেউ জানে না। সন্ধ্যার পর সংগ্রাম কমিটির লোকেরা রাস্তায় নামেন।

আমাদের আবাসন ছিল মৌচাক মার্কেটের পাশে, ২০৬ নিউ সার্কুলার রোডের বাড়িটিতে। রাত তখন ৮টা ৩০ মিনিট। খবর আসে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি আর্মিরা যে-কোনো সময় ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় আক্রমণ করবে। নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি গাজী গোলাম মোস্তফার ছেলে ছিলেন পরিচিত। তিনিও এসে একই খবর দেন। তখন পোশাক পরে দ্রুত রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে চলে আসি।

রোলকল হচ্ছিল তখন। খবরটা তুলতেই সবাই উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এর আগেই পালিয়ে যায় অবাঙালি পুলিশ সদস্যরা। আমরা ২০-৩০ জন ইন্সপেক্টর মফিজ উদ্দিনের কাছ থেকে চাবি এনে মেইন অস্ত্রাগার খুলে দিই। কমান্ড বলতে তখন কিছু ছিল না। উচ্চ পর্যায়ের কেউ সাহায্যও করেনি।

থ্রি নট থ্রি রাইফেলসহ ম্যাগাজিনভর্তি গুলি নিয়ে দুশো-তিনশো সদস্য পুলিশ লাইন্সের ব্যারাক, প্রশাসন ভবনের ছাদ, পুকুরপাড়, রোডের পাশে ও মানুষের বাড়ির ছাদে পজিশনে চলে যান। সাধারণ মানুষের সহযোগিতায় তাঁরা ব্যারিকেড দেন মৌচাক, মালিবাগ, শান্তিনগর ও চামেলীবাগের ডন স্কুলের সামনে (বর্তমানে ইস্টার্ন প্লাস মার্কেট)। ওই স্কুলের ছাদেও পজিশন নেন ২০-২৫ জন পুলিশ সদস্য।

দুটো রাইফেল নিয়ে আমি আর মনির ওয়্যারলেস বেইজ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণে থাকি, প্রশাসন ভবনের নিচতলায়। ওয়্যারলেস সার্কিটে বসে অপেক্ষায় আছি ওয়্যারলেসে কোনো মেসেজ আসে কি না।

রাত তখন ১০টা ৩০ মিনিট। একটা মেসেজ পাই। তেজগাঁও এলাকায় প্যাট্রলে থাকা ওয়্যারলেস অপারেটর আমিরুল মেসেজ দেন।

তিনি বলেন : ‘চার্লি সেভেন ফর বেইস, হাউ ডু ইউ হেয়ার মি, ওভার।’

আমি প্রত্যুত্তরে বলি : ‘বেইস ফর চার্লি সেভেন, ইউ আর লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার, সেন্ড ইউর মেসেজ, ওভার।’

তখন তিনি বলেন : ‘চার্লি সেভেন ফর বেইস, অ্যাবাউট  থার্টি সেভেন ট্রাকস লোডেড উইথ পাকিস্তানি আর্মি আর প্রসিডিং টুওয়ার্ডস ঢাকা সিটি ফ্রম দ্য ক্যান্টনমেন্ট।’

আমরা নিশ্চিত হই। ওরা আসছে। প্রায় ছয়শো-সাতশো লোক ছিল রাজারবাগে। একজন গিয়ে পাগলা ঘণ্টা বাজান।

ফলে বাকি পুলিশ সদস্যরাও আরেকটি অস্ত্রাগার ভেঙে অস্ত্র নিয়ে পজিশনে চলে যান।

রাত ১১টা ৩০ মিনিট। সর্বপ্রথম পাকিস্তানি আর্মির বহর শান্তিনগর পার হয়ে চামেলীবাগের ব্যারিকেডের সামনে এসে থামে। ব্যারিকেড সরাতে ১০-১২ জন গাড়ি থেকে নামতেই ডন স্কুলের ছাদ থেকে পুলিশ সদস্যরা থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে গুলি চালান। প্রথম টার্গেটেই পাকিস্তানি সেনাদের দুজন মারা যায়। আহত হয় বেশ কয়েকজন। পাকিস্তান সেনাদের ওপর ওটাই ছিল প্রথম আক্রমণ, যা শুরু করেছিলেন পুলিশ সদস্যরাই। পাকিস্তানি সেনারা তখন ব্রাশফায়ার আরম্ভ করে। ওদের এলএমজি, এমএমজি, এইচএমজি, মর্টারগুলোও গর্জে ওঠে।

গোলাগুলির শব্দ পাচ্ছিলাম। হঠাৎ পাশের বিল্ডিংয়ে কামানের একটা গোলা এসে পড়ে। ফলে বিদ্যুৎ চলে যায়। টেলিফোন লাইনও কাটা। নানা চিন্তা ভর করে মনে। কী করা যায়? আক্রান্ত হওয়ার খবরটি সারাদেশের সবাইকে জানাতে পারলে হয়তো অনেকেই আত্মরক্ষা করতে পারবেন – এ চিন্তা থেকেই নিজ উদ্যোগে একটা ওয়্যারলেস বার্তা ট্রান্সলেট করে সারা পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানোর প্রস্তুতি নিই।

রাত ১২টা বাজার তখনো তিন-চার মিনিট বাকি। রাজারবাগে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের প্রথম ওয়্যারলেস বার্তায় আমি বলি :

Base for all station of East Pakistan police, very very important message for you, keep note, keep listening, watch. We are already under attack by Pak army, try to save yourself, over and out.

১৯৭১-এর ২৫শে মার্চ রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের প্রথম ওয়্যারলেস মেসেজ প্রদানের ইতিহাস এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কনস্টেবল মো. শাহজাহান মিয়া। এক বিকেলে তাঁর বাড়িতে বসেই আলাপ হয় একাত্তর প্রসঙ্গে।

সৈরত আলী ও আমেনা বেগমের বড় ছেলে শাহজাহান। বাড়ি নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার বাট্টা গ্রামে। তাঁর শৈশব-কৈশোর কেটেছে ওই গ্রামেই। স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন ওই সময়কার নানা কথা। তাঁর ভাষায় –

নানায় একটা স্কুল করেছিলেন। বড়তলা মিলকী বাড়ি স্কুল। ছোটবেলায় ওখানে কলার পাতায় লিখতাম। কুপিবাতির সলতের ওপরের কালি এবং উরু বা শিমের পাতার রস মিশিয়ে কালি তৈরি করতাম। কলম ছিল বাঁশের কঞ্চি। কলম আকারে তা কেটে কালি দিয়ে কলা পাতায় লিখতাম : অ, আ, ই, ঈ। পরে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হই বাট্টা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ম্যাট্রিক পাশ করি জয়হরি স্প্রাই ইনস্টিটিউশন থেকে।

আলাপচারিতায় ফিরে আসি একাত্তরে। ২৫শে মার্চ ওয়্যারলেস মেসেজ পাঠানোর পর রাজারবাগে কী ঘটল? আপনারাইবা কী করলেন?

তিনি বলেন, ‘মনিরকে নিয়ে প্রশাসন ভবনের চারতলার ছাদে অবস্থান নিই। সেখানে ছিলেন আরো ৪০-৫০ জন। আমরা পাঁচজনের একটা করে ট্রুুপস করি। আমার ট্রুুপসে ছিলেন মনির, গিয়াসউদ্দিন, আবু সামাদ, সালাম প্রমুখ। মূল ভবনের ওপর থেকে প্যারেড গ্রাউন্ডের দিকে পজিশনে যাই। আর্মিরা ভেতরে ঢুকলেই ঠেকাব।

রাত তখন ৩টা হবে। গোলাগুলি চারদিকে। ট্যাংকের সাহায্যে ওরা রাজারবাগের মেইন দুটি গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকেই টিনের ব্যারাকে আগুন দেয়। বেরোতে না পেরে অনেকেই সেখানে পুড়ে মারা যান। ছাদ থেকে আমরা গুলি চালালে ওরা ব্রাশফায়ার করতে থাকে। তখন আর টেকার জো ছিল না। দেখলাম, পুলিশের শত শত লাশ পড়ে আছে। ভোর ৪টার পর ৮-১০ ট্রাক এনে ওরা লাশগুলো তুলে নিয়ে যায়।

আমাদের গুলি তখন শেষ। ২০-২৫ জন পুলিশ সদস্য ছাদ থেকে পাইপ বেয়ে নিচে নেমে পেছন দিয়ে পালিয়ে যান; কিন্তু আমরা বেরোতে পারিনি। নিরুপায় হয়ে রাইফেল ফেলে পানির ট্যাংকের নিচে আশ্রয় নিই। ফজরের আজানের পরে পাকিস্তানি সেনারা ছাদে আসে। ওরা রাইফেলের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে আমাদের বের করে আনে। শুরু হয় ভয়াবহ নির্যাতন। রাইফেলের বাঁট আর হকিস্টিক দিয়ে মারতে মারতে আমাদের নিচে নামিয়ে আনে। ওদের বুটের নিচে স্টিলের পাত থাকত। সেই বুট দিয়ে লাথি দিতে থাকে। রক্তে লাল হয়ে জমাট বেঁধে যায় আমাদের খাকি পোশাক। বন্দি ছিলাম দেড়শোর মতো। ভেবেছিলাম মেরেই ফেলবে!

২৮শে মার্চ ১৯৭১। বেলা তখন ৩টা। তালিকা করে আমাদের হস্তান্তর করা হয় এসপি এমাজ আহমেদ চৌধুরীর কাছে। ১০ জন করে গ্রুপ করে চিকিৎসার জন্য ছাড়া হয়। পরে রিপোর্ট করতে হবে মিল ব্যারাক পুলিশ লাইনে। রিপোর্ট না করেই পালিয়ে আমি চলে যাই এক আত্মীয়র বাড়িতে, উলুনে। পরে বন্ধু আসেক আলীকে নিয়ে হেঁটে চারদিন পর পৌঁছি নেত্রকোনায়।’

২৫শে মার্চের আগে দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা তুলে ধরেন শাহজাহান। ইতিহাসে যা প্রায় অজানাই রয়ে গেছে। তাঁর ভাষায় – ‘১লা মার্চ ১৯৭১। ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকায় বাঙালি ও অবাঙালি শ্রমিকদের মধ্যে গোলমাল চলছিল। খবর পেয়ে অ্যাডিশনাল এসপি ফজলুর রহমান যান কালিগঞ্জ থানায়। সেখানে অবাঙালিরা তাঁর ওপর আক্রমণ করে। কুপিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে মেরে ফেলে তাঁকে। তাঁর লাশ যখন রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে আসে তখন নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। কালিগঞ্জের অবাঙালিদের ওপর আক্রমণের প্রস্তুতিও নিই সবাই। পরে পুলিশের বড় কর্মকর্তারা আমাদের শান্ত করেন।’

‘আবুজর গিফারী কলেজের ভিপি ছিলেন ফারুক। তাঁর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিল। ৩রা মার্চ ১৯৭১। সেনারা হেভি মেশিনগান নিয়ে টহল দিচ্ছে। ফারুকের নেতৃত্বে ছাত্ররা তখন পিকেটিং করতে রাস্তায় নামেন। ডিউটি না থাকায় আমিও থাকি। বড় একটা আর্মির ট্রাকে পাকিস্তানি সেনারা মগবাজার থেকে টার্ন নিয়ে রামপুরার দিকে এগোচ্ছে। পেছন থেকে ছাত্ররাও ঢিল মারছেন। রামপুরায় টিভি সেন্টারের কাছাকাছি এসে ওরা ব্যাক পজিশনে থেকে ফায়ার ওপেন করে। প্রথম গুলিটি এসে লাগে ফারুকের বুকে। আমি তাকে কোলে তুলে পিছু হটি। তার রক্তাক্ত শরীরটা এখনো চোখে ভাসে। সেদিন সঙ্গে ছিলেন পুলিশের নুর ইসলাম ও অক্ষয় কুমার বড়ুয়াও। পরে ফারুকের লাশ নিয়ে মিছিল হয়। আন্দোলনের তীব্রতাও বেড়ে যায়। গুলি চালিয়েও পাকিস্তানিরা বাঙালিদের দমাতে পারেনি।’

শাহজাহান তখন গ্রামে, বাবা-মায়ের কাছেই। কয়েকদিন পরেই রেডিও পাকিস্তান থেকে ঘোষণা করা হলো : ‘যারা পুলিশ থেকে বের হয়ে গেছে তারা যেন অনতিবিলম্বে যোগদান করে। তাহলে সাধারণ ক্ষমা করা হবে। তা না হলে রাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেবে।’

এদিকে তাদের গ্রামের মাওলানা আব্দুল জলিল শান্তি কমিটির থানা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ফলে তাঁদের পরিবারের ওপর হুমকি আসে : চাকরিতে যোগদান না করলে ওরা ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেবে। ফলে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই শাহজাহান ছোট দুই ভাইসহ ধর্মপাশার মধ্যনগর এলাকা হয়ে চলে আসেন ভারতের মহেশখোলায়।

বাকি ইতিহাস জানালেন মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান, তাঁর ভাষায় : ‘ওখানে পাই বারহাট্টা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুজ্জামান চিসতি, আটপাড়ার সাধারণ সম্পাদক সেকান্দার নুরিকে। কয়েকদিন পরই ইপিআরের হাবিলদার মোবারক আলীসহ ছয়-সাতজন ট্রেইন্ড লোক চলে আসেন। যুবকদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। আমরা তখন মহেশখোলা নামা হাই স্কুলে রিক্রুটিং ক্যাম্প খুলি। বাঁশের লাঠি দিয়ে ট্রেনিং করিয়ে হায়ার ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠাই ১২০ জনকে। যুদ্ধ করি এগারো নম্বর সেক্টরে। বিএসএফের ক্যাপ্টেন চৌহান আমাদের গাইড করেন।

প্রথমদিকে অস্ত্রের ঘাটতি ছিল। আমরা ট্রেইন্ড পারসনরা নৌকায় করে ধর্মপাশা থানা অপারেশন করে ১০টি রাইফেল ও গুলির বাক্স নিয়ে আসি। সেটি ছিল প্রথম অপারেশন। একবার চান্দুয়ায় অ্যামবুশ করে এক মেজরসহ ১২ পাকিস্তানি সেনাকে খতম করি। সে-সংবাদ বলা হয় ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ থেকে। পরে জগসোগ্রাম সাব-সেক্টর কোয়ার্টার মাস্টারের দায়িত্ব পাই। সেখানে ক্যাপ্টেন মুরারি কমান্ড করতেন। পাহাড়ের ভেতর ছিল ক্যাম্প। বাঁশ দিয়ে মাচা করে থাকতাম। ডালডা দিয়ে মাটির প্রদীপ জ¦ালাতাম। চিনা জোঁকের আক্রমণে রাতভর ঘুমাতে পারতাম না।’

রণক্ষেত্রে শাহজাহানদের ব্রিফ করতেন ভারতের সেনা কর্মকর্তারা। স্মৃতিপটে গেঁথে থাকা তেমন একজনের কথা বললেন তিনি – ‘রংরা নামক স্থানে ক্যাম্প ছিল তখন। একদিন রাতে ক্যাম্পে আসেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শান্ত সিং। সবাই তাঁকে বাবাজি বলে ডাকতেন। তিনি বললেন, ‘শুধু রাইফেল হলেই যোদ্ধা হওয়া যায় না। মনটাকে আগে পবিত্র ও আত্মাকে শুদ্ধি করতে হবে। লোভ-লালসা ত্যাগ করতে হবে। তোমাদের উদ্দেশ্য থাকবে একটিই, সেটি হলো – স্বাধীনতা। অস্ত্র হাতে নিলেই মনে হবে বিরাট শক্তি। যুদ্ধে যখন যাবে সুন্দরী নারী দেখলেই ঠিক থাকতে পারবে না, মানুষের টাকা-পয়সা আর সম্পদ দেখলেই লোভ হবে। মন থেকে এগুলো আগে ত্যাগ করো। তারপর অস্ত্র নাও। তা না হলে অস্ত্র নিয়ে কোনো লাভ হবে না।’ বাবাজির ওই কথাগুলো মনে গেঁথে আছে।’

দেশের স্বাধীনতার জন্য এক অপারেশনে গুরুতর আহত হন এই সূর্যসন্তান। পাকিস্তানি সেনাদের পুঁতে রাখা মাইনের স্পিøন্টার বিদ্ধ হয় তাঁর বাঁ পায়ের পাতায়। ক্ষতবিক্ষত হয় ওই পায়ের একটি আঙুল। রক্তাক্ত  সেইদিনের স্মৃতি শুনি শাহজাহান মিয়ার জবানিতে : ‘আমরা তখন জগসোগ্রাম ক্যাম্পে। যৌথবাহিনীর কমান্ডে তখন মেজর পিরিত। বিজয়পুরে পাকিস্তানি সেনাদের ঘাঁটিতে অ্যাটাক করতে হবে। কাছাকাছি থেকে ওই ক্যাম্পের দিকে গোলাগুলি চলে ৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত। ওইদিন রাত ১২টায় পাহাড়ি পথ বেয়ে নিচে নেমে আসি।

৭ই ডিসেম্বর ১৯৭১। ভোরবেলা। ওদের ফার্স্ট ক্যাম্পের পূর্বদিকে প্রথম অ্যাটাক করি। ওরা ধীরে ধীরে পালাতে শুরু করে। ক্রলিং করে সামনে এগিয়ে একটা বাংকার দখলে নিই। এর আগেই ওরা ক্যাম্প ছেড়ে পিছু হটে, আশ্রয় নেয় দুর্গাপুরে। বাংকারগুলো আমরা সার্চ করছি। সামনে ওসমান গনি, তাঁর পেছনে ছোটভাই নুরুল ইসলাম, এর পেছনে আমি, কামাল ও অন্যরা। সবাইকে সতর্ক থাকতে বলি।

একটি বাংকার থেকে অন্য একটি বাংকারে যাওয়ার ছোট্ট একটি রাস্তা। অন্যদিক দিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। চলে যাওয়ার আগে ওরা সেখানে অ্যান্টিপারসোনাল মাইন পুঁতে যায়। হঠাৎ একটি মাইনে পা পড়ে ওসমানের। বিকট শব্দ হয়। চারদিকে কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া। দেখলাম ওসমানের পা উড়ে গেছে, নুরুল ইসলামের গালের মাংস উড়ে গিয়ে দাঁত বেরিয়ে গেছে। খানিক পরে দেখি আমার বাম পায়ে স্পিøন্টার বিদ্ধ হয়েছে। ওই পায়ের একটি আঙুলের মাংস উড়ে যায়। পায়ের পাতা রক্তে ভেজা। সহযোদ্ধারা আমায় তুলে নেন বাগমারা ক্যাম্পে। সেখানেই প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।’

মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রসঙ্গে এ-বীর যোদ্ধা দুঃখ করে বলেন : ‘বাট্টা গ্রামে শুধু আমরা দুই ভাই মুক্তিযোদ্ধা। এক ভাই শহিদ হয়েছেন। আর কেউ নেই। এখন দেখলাম একশর বেশি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আবেদন করেছেন। আমরা সুপারিশ করিনি। ১৯৭৫-এর পর থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত এই লোকগুলো কোথায় ছিল? আগে কি একটাও দরখাস্ত করেছে এরা? তখন মুক্তিযোদ্ধাদের ওপরে নির্যাতন হয়েছে নানাভাবে। তবুও সহ্য করেছি।’

’৭৫-এর পর দেশ আবার পাকিস্তান হয়ে গিয়েছিল বলে মনে করেন এই বীর যোদ্ধা। তাঁর ভাষায় – ‘বঙ্গবন্ধুর আমলে গণভবনে ছিলাম। ১৯৭২ সালে এসএম নবাব এবং বজলুর রহমান মজুমদারের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতার অভিযোগ এনে মামলা করি এবং প্রমাণ তুলে ধরি। ফলে তাদের চাকরি থেকে ডিসমিস করা হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর জিয়ার হাত ধরেই আবার চাকরিতে ফিরে আসেন ওই বজলুর রহমান মজুমদার। এভাবে প্রায় সব সেক্টরেই স্বাধীনতাবিরোধীরা পুনর্বাসিত হতে থাকে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর নির্যাতন শুরু হয়। ওটা ছিল আরেক পাকিস্তান আমল।’

দেশের জন্য এতো ত্যাগ স্বীকার করলেন, পঞ্চাশ বছর পর যদি প্রশ্ন রাখা হয়, স্বপ্নের দেশ কি পেয়েছেন?

মুচকি হেসে মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহানের উত্তর : ‘সেটা পাইনি। তবে আশায় আছি। দেশ উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আশা ছিল বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলা’ হবে। এদেশে কেউ পাকিস্তানের পক্ষে থাকবে, ‘জিন্দাবাদ’ বলবে, ওদের পক্ষ নিয়ে রাজনীতি করতে পারবে – এমন দেশের জন্য তো দেশ স্বাধীন করিনি।’

স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালো লাগার অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বলেন : ‘শেখ মুজিবের প্রেরণায় মুক্তিযুদ্ধ করেছি। তাঁর কন্যা এখন ক্ষমতায়। শেখ হাসিনা দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করছেন। মানুষকে উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন – এটা দেখলে সত্যি ভালো লাগে ভাই।’

খারাপ লাগে কখন?

‘ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি দেখলে খারাপ লাগে। জামায়াত-শিবির আর ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীলদের তাণ্ডব দেখলে কষ্ট লাগে। এদের তো নিষিদ্ধ করা উচিত।’

পরবর্তী প্রজন্মকে নিয়ে স্বপ্নবিভোর হন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা কনস্টেবল মো. শাহজাহান মিয়া। চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে, বুকভরা আশা নিয়ে তাদের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন : ‘প্রথমে হলো দেশপ্রেম। তোমরা দেশপ্রেমে উজ্জীবিত থেকো। নিজের মাকে যেভাবে ভালোবাস, তেমনি দেশের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে নিজের কাজটুকু করো। তবেই দেখবে দেশটা বদলে যাবে।’