এক ডজন চাঁদের কবিতা

অনুবাদ : আন্দালিব রাশদী

মানুষের চাঁদে পদার্পণের ৫০ বছর পূর্তি হলো ২০ জুলাই ২০১৯। কল্পনার চাঁদ, স্বপ্নের চাঁদ এবং বাসত্মবের চাঁদ নিয়ে নতুন করে আলোচনার স্রোত বয়ে যাচ্ছে।
সুবর্ণজয়মত্মীতে বারোজন খ্যাতিমান কবির চাঁদ-উদ্ধৃত কবিতা ভাষান্তরিত হলো। কবিরা হচ্ছেন – খালিল জিবরান, মাহমুদ দারবিশ, নিজার কাববানি, সের্গেই ইয়েসেনিন, ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা, হোর্হে লুই বোর্হেস, হুয়ান র‌্যামন হিমেনিথ, ওমর খৈয়াম, জালালউদ্দিন রুমি, আবু নওয়াস, কো উন এবং পাবলো নেরুদা।

খালিল জিবরানের চাঁদ
পূর্ণ চাঁদ

শহরের ওপর সগৌরবে পূর্ণ চাঁদ উঠেছে
সে-শহরের সব কুকুর চাঁদের দিকে তাকিয়ে
ঘেউ ঘেউ শুরু করেছে।
কেবল একটি কুকুর ঘেউ দেয়নি, ভারি গলায় সে
অন্যদের বলেছে, ‘ঘেউ ঘেউ করে তোমরা তার
মুখ থেকে নির্জনতা খসাতে পারবে না
কিংবা তোমাদের ডাকে চাঁদ পৃথিবীতে নেমে আসবে না।’
তখন অন্য কুকুরেরা ঘেউ ঘেউ থামাল, নেমে
এলো ভয়ংকর নির্জনতা। কিন্তু যে-কুকুর
তাদের সাথে কথা বলেছে, বাকি রাত
নির্জনতার জন্য ঘেউ ঘেউ চালিয়ে গেল।

মাহমুদ দারবিশের চাঁদ
অবরোধ

এক নারী মেঘকে বলল, আমার প্রিয়তমকে ঢেকে রেখো
তার রক্তে আমার পরনের কাপড় ভিজে গেছে।

তুমি যদি বৃষ্টি না হও, প্রিয়
তবে বৃক্ষ হও
উর্বরতায় পরিপূর্ণ, বৃক্ষ হও
তুমি যদি বৃক্ষ না হও, প্রিয়
তবে পাথর হও
আর্দ্রতায় পরিপূর্ণ পাথর হও
যদি তুমি পাথর না হও, প্রিয়
তবে চাঁদ হও,
প্রিয় নারীর স্বপ্নের, চাঁদ হও
[এ-কথাই বলেছে এক নারী তার পুত্রের শেষকৃত্যে।]

নিজার কাববানির চাঁদ
রুটি, মাদক ও চাঁদ

পূর্বদিকে যখন চাঁদের জন্ম হয়
সাদা ছাদ তখন ঘুমের ঘোরে
আলোর সত্মূপের নিচে
মানুষ তাদের দোকান ছেড়ে দলে দলে বেরোয়
তারা চাঁদের সাথে সাক্ষাৎ করবে
হাতে রুটি, রেডিও নিয়ে পর্বতের চূড়ায়
এবং সাথে তাদের মাদক।
সেখানে তারা কল্পনা বেচাকেনা করে
এবং চিত্রকল্প
এবং মৃত্যু – যখন চাঁদ তাদের জীবনে আসে।

এই আলোচিত চাকতি
আমার জন্মভূমির কোন কাজে লাগে?
নবীদের ভূমি,
সরলসোজা মানুষের ভূমি,
তামাক চিবোনো মানুষ কিংবা মাদকের পাইকার
চাঁদ আমাদের কোন কাজে লাগে
আমরা আমাদের সাহসের অপচয় করি
কেবল ঈশ্বরের কাছে ভিক্ষক্ষ চাইতে বেঁচে থাকি?
অলস ও দুর্বলের জন্য
দেবার মতো ঈশ্বরের কী আছে?
যখন তাদের জীবনে চাঁদ আসে, তা তো
লাশ হয়ে যায়, এবং সন্তদের সমাধি
নাড়তে থাকে এই আশায় যে তারা
কিছু চালের মঞ্জুরি দেবেন, কিছু সন্তান …
তারা তাদের অভিজাত মিহিন আলখাল্লা ছড়িয়ে
আফিম দিয়ে তাদের আশ্বসত্ম করেন যাকে
আমরা বলি ভাগ্য ও নিয়তি। …

সের্গেই ইয়েসেনিনের চাঁদ
চাঁদ আমার জানালার ওপর

চাঁদ আমার জানালার ওপর
বাতাস জানালার নিচে
পুরো নগ্ন পপলার গাছ অভ্র-উজ্জ্বল রং ধরেছে;

অ্যাকোর্ডিয়ানে দূরের কান্না, দূরের স্বর একাকী
এত দূরে যদিও বা, আমার হৃৎপি–র কাছে।

গান কাঁদছে, গান হাসছে লঘুচিত্ত গানের
অন্তত শতাব্দীবয়সী আমার লেবুগাছ কোথায়?

অতীতে আমিও সেখানে উৎকণ্ঠায় ছিলাম
অ্যাকোর্ডিয়ানের শব্দ ছড়াতেই, ভোরে জাগতে হবে

কিন্তু আজ আমার দিকে আমার সুন্দরের নজর নেই
কাজেই হাসছি, গানের তলদেশে কাঁদছি, অচেনা সুরে।
চন্দ্রালোকিত রাত
একটি চাঁদ হয়ে উঠবে
ছোট একটি চাঁদ তো
এখনই আছে।
আর এবার পূর্ণ একখানা চাঁদ
বাতাসে ঝুলছে।
তিনি অবশ্যই ঈশ্বর হবেন
তার বিস্ময়কর
রুপোর চামচ দিয়ে
তারাভরা মাছের
স্যুপ তুলছেন।

ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার চাঁদ

অশ্বারোহীরা আরো কাছে এসে গেছে
ড্রাম পিটিয়ে সমতলে আঘাত করে
নেহাই-এর ভেতর শিশুর
দুচোখ বন্ধ তখন।

জলপাই গাছের ভেতর দিয়ে তারা আসে
ব্রোঞ্জ স্বপ্ন, জিপসি
উঁচু ক’রে থাকা তাদের মাথা
তাদের চোখ আধেক খোলা।

কেমন করে পেঁচা ডাকছে
দেখো, শাখার ওপর ডাকছে
একটি শিশুর আঙুল ধরে
আকাশের মধ্য দিয়ে চাঁদ চলে গেছে।

কামারের নেহাই-এ জিপসিরা
চেঁচাচ্ছে আর কাঁদছে
বাতাস পাহারা দেয়, আর পাহারা
বাতাসের প্রহরায় থাকে।

হোর্হে লুই বোর্হেসের চাঁদ
চাঁদ

সেই স্বর্গের মধ্যে এমনই নির্জনতা
আদম প্রথম যে-চাঁদ দেখেছিল, ইদানীং
রাতের যে-চাঁদ সে-চাঁদ নয়।
মানুষের সজাগদৃষ্টি রাখার শত শতাব্দী
পুরনো বিলাপে ভরে দিয়েছে। দেখো,
চাঁদ তোমার আয়না।

হুয়ান র‌্যামন হিমেনিথের চাঁদ
পূর্ণ চাঁদ

দরজা খোলা আছে
ঝিঁঝিরা গান ধরেছে
তুমি কি পুরো নগ্ন হয়ে
মাঠে যাচ্ছো?

অমর জলের মতো
সবকিছুর ভেতরে যাচ্ছে বেরোচ্ছে
তুমি কি পুরো নগ্ন হয়ে
বাতাসে বেড়াবে?

পুদিনাপাতা ঘুমোয়নি
পিঁপড়া ব্যসত্ম খুব
তুমি কি পুরো নগ্ন হয়ে
বাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছ?

ওমর খৈয়ামের চাঁদ
কী দুর্ভাগ্য সে-হৃদয়ের

কী দুর্ভাগ্য সে-হৃদয়ের
যে জানে না কেমন করে ভালোবাসতে হয়
জানে না ভালোবেসে বুঁদ হয়ে থাকার মানে।
তুমি যদি প্রেমে মত্ত না থাকো তাহলে
কেমন করে চোখ অন্ধ করে দেওয়া সূর্যের আলো
কিংবা চাঁদের কোমল রশ্মি উপভোগ করবে?

জালালউদ্দিন রুমির চাঁদ
আমি চাঁদের আত্মা

  আমি চাঁদের আত্মা

আমি যেহেতু আত্মার ভেতর লুকিয়ে
তুমি আমাকে দেখতে পাও না

অন্যেরা তোমাকে তাদের জন্য চায়,
আমি তোমাকে ডাকি
নিজের কাছে ফিরে এসো।

তুমি আমাকে অনেক নাম দিয়েছ
কিন্তু আমি নামের ঊর্ধ্বে উঠে গেছি
আমি সব বাগানের বাগান
আমি ফুলদের বাদশাহ হিসেবে বলছি

আমি সমসত্ম জলরাশির ঝর্ণাধারা
আমার শব্দগুলো জাহাজের মতো
আর সমুদ্র আমার শব্দের মানে।

চলে এসো আমার কাছে
আমি তোমাকে আত্মার গভীরে
নিয়ে যাবো।

আবু নওয়াসের চাঁদ
ভালোবাসার প্রস্ফুটন

তার ভালোবাসায় আমি মরিয়া হয়ে আছি
পুরোপুরিভাবে, সবদিক থেকেই; আলতো করে ভেসে আসা
সংগীতের সুরে ভালোবাসা লুপ্ত যখন
আমার চোখ পড়ে আছে তার আনন্দপ্রদ শরীরে
আমি তার সৌন্দর্যে বিস্মিত হই না
তার কটিদেশ চারাগাছের মতন, মুখ তার চাঁদ
তার গোলাপি গাল বেয়ে সৌন্দর্য গড়িয়ে পড়ে
তোমার জন্য ভালোবাসায় আমি মরিয়া হয়ে আছি
কিন্তু এটুকু গোপন রেখো : যে-দড়ি আমাদের
বেঁধেছে তা ভাঙার মতো দড়ি নয়
হে দেবদূত, তোমার সৃষ্টিতে কত সময় লেগেছিল?
তাতে কী এসে যায়! আমি তো তোমার বন্দনাই করব।

কো উনের চাঁদ
যতবার চাঁদ ওঠে

যতবার চাঁদ ওঠে, সে প্রার্থনা করে
শেষ পর্যন্ত চলিস্নশ বছর বয়সে
উল-নামে মায়ের একটি ছেলে হয়।
গর্ভবতী হবার আগে স্বপ্নে সে
চাঁদটা গিলে ফেলেছিল।

ছেলের জন্ম হবার পর
যতবার চাঁদ উঠবে
উল-নামে মার নিশ্চিত
মাথা খারাপ হয়ে যাবে।

শেষরাতে বাসনকোসন মেজে
তার হাতে কাচের বড় বাটি ভাঙতেই
চাঁদ তখন একটি মেঘের ভেতর লুকোয়,
আর পৃথিবী অন্ধ হয়ে যায়।

তুমি সূর্য – মেঘের পেছনে লুকোতে যেও না
তুমি চাঁদ – আলো ছড়ানো বন্ধ করো না

তুমি কামাসক্ত নারী – কামনা অবদমন করো না
তুমি বিদ্যুচ্চমক – ঝলকানি বন্ধ করো না

এখনো যেহেতু ভালোবাসা হার মানেনি
এখনো ভালোবাসার ওপর ভরসা ছেড়ো না।

পাবলো নেরুদার চাঁদ

তুমি যদি আমাকে ভুলে যাও

আমি তোমাকে একটি বিষয়
জানাতে চাই
এটা কেমন তুমি তো জানো :
যদি আমি স্ফটিক চাঁদের দিকে তাকাই
আমার জানালায় শস্নথ শরতের লাল শাখার
দিকে তাকাই
যদি স্পর্শ করি
আগুনের কাছে অস্পর্শ ছাই অথবা
কাষ্ঠের কুঁচকে যাওয়া শরীর; সবকিছুই
আমাকে বহন করে তোমার কাছে নিয়ে যায়,
যেন যা কিছু বিরাজ করে সবই –
সুঘ্রাণ, আলো, ধাতব পদার্থ ছোট নৌকা
পাল তুলে তোমার কিনারে আসে, যা ছিল
আমার অপেক্ষায়।
কিন্তু এখন
একটু একটু করে তুমি ভালোবাসা বন্ধ করেছ,
আমিও একটু একটু করে বন্ধ করব
যদি তুমি হঠাৎ
আমাকে ভুলে যাও
আমাকে খুঁজতে যেও না
কারণ আমি এর মধ্যে তোমাকে ভুলেই গেছি।
(আংশিক)